কাদিয়ানীদের স্বভাব হচ্ছে, নিজেদের ভ্রান্ত আকীদাকে সঠিক প্রমাণ করার অসৎ উদ্দেশ্যে হাদীসের আগপাছ বাদ দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক অংশটুকু উল্লেখ করে সাধারণ মানুষকে ধোকা দেয়া। আবার সাধারণ মানুষ যেন বিজ্ঞ আলেম উলামার দ্বারেকাছে না ঘেঁষে সে পথটিও বন্ধ করে দেয়া। এ জন্য দেখা যায়, বেশিরভাগ কাদিয়ানী আলেম উলামা বিদ্বেষী। ফলে এদের কপালে কোনোদিন হিদায়াত জুটেনা।
বিজ্ঞ আলেম উলামা থেকে মানুষকে দূরে রাখলে ওদের কী লাভ?
এর উত্তর হচ্ছে, বিজ্ঞ আলেম উলামাগণ বাতিলপন্থীদের তাবৎ বদ আকীদা, অপব্যাখ্যা এবং ধোকাবাজি সম্পর্কে খুব ভালোমত অবগত। ফলে তাদের আশংকা থাকে, সাধারণ মানুষজন আলেম উলামার সান্নিধ্যে গেলে নিশ্চিত যে, তাদের ধোকাবাজি ফাঁস হয়ে যাবে। আর সেজন্য যত গুরুতর বদনাম রটানো যায়, তারা এর ষোলকলাই পূর্ণ করে থাকে। কাদিয়ানী মতবাদ থেকে ফেরত আসা অসংখ্য নও মুসলিমের ইন্টারভিউতে বিষয়টি ভালোমতই উঠে এসেছে। তাদের প্রায় প্রত্যেকে সাক্ষ্য দিয়েছে যে, নতুন কাউকে কাদিয়ানী বানানোর সময় তারা আলেম উলামার বিরুদ্ধে সীমাহীন বিষোদগার করে থাকে। যার কারণে কাদিয়ানী মতবাদ আগাগোড়াই ধোকা হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ কাদিয়ানী চোখবন্ধ করে জীবন পার করে দিচ্ছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা আলেম উলামার সান্নিধ্যে যান না।
কাদিয়ানীদের প্রায় লেকচারে শুনা যায়, তারা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষনবী নন, বরং তাঁর পরেও নবী রয়েছেন। তারা নিজ থেকে আরেকটু সংযোজন করে বুঝাতে চান যে,
- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সর্বশেষ নবী’ – কথাটি আসলে ঠিক নয়। বরং তাঁর পরেও তাঁর আনুগত্যের ফয়েযের দরুন ‘নবী’ আসতে পারে। যিনি স্বতন্ত্র বা শরীয়তী নবী হবেন না। অন্যথা হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলতেন না যে, “তোমরা বলো না যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর কোনো নবী নেই।”
কাদিয়ানী চাঁদাখোর ধোকাবাজ মুরুব্বিদের নানা লেকচারে এভাবেই খতমে নবুওয়ত বিরোধী মনগড়া বয়ান দিতে শুনা যায়।
কাদিয়ানীদের সেসব মনগড়া বয়ানের জারিজুরি আজ আপনাদের সামনে ফাঁস করা হবে, ইনশাআল্লাহ। তার আগে আমি ঐ সব কাদিয়ানী চাঁদাখোর মুরুব্বিদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে চাই। তা হচ্ছে,
- উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর হাদীসটি কি শুধু এতটুকু? হাদীসটির প্রথমোক্ত কথাগুলোর কি কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই?
- যদি উক্ত হাদীসটি এতটুকু না হবে, তাহলে আপনারা কিজন্য সম্পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখ না করে মানুষকে ধোকা দিয়ে যাচ্ছেন?
- হাদীসটির প্রথমোক্ত কথা দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরেও নবীগণের আগমনী ধারা অব্যাহত রয়েছে, এ কথা উদ্দেশ্য হলে তাহলে আপনারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আগে এবং পরে ‘নবী’ দাবীদারদের মানেন না কেন?
- পরিশেষে আরেকটি প্রশ্ন, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা কি আগত ঐ নবী সম্পর্কে কোনো শর্ত বা কন্ডিশন দিয়ে গেছেন যে, তিনি স্বতন্ত্র বা শরীয়তী নবী ছাড়া ভিন্ন অর্থের তথাকথিত জিল্লি, বুরুজি, উম্মতিনবী টাইপের হবেন? নইলে আপনাদের এ ধারণাগুলোর অথেনটিক উৎস কী যা বিগত চৌদ্দশত বছরের ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ দ্বারাও সমর্থিত? সত্য বলতে, চাঁদাখোর ধোকাবাজ কাদিয়ানী মুরুব্বিদের নিকট এর কোনো সদুত্তর নেই।
আসল আলাপে আসছি :
পাঠকবৃন্দ, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসটি ধোকাবাজ কাদিয়ানী মুরুব্বিরা কাটছাঁট করেই পেশ করে থাকে। ফলে সাধারণ মানুষ ধোকায় পড়ে যায়। এ জন্য এখানে সম্পূর্ণ হাদীসটি অর্থ সহ তুলে ধরা হল,
সনদ সহ সম্পূর্ণ বর্ণনাটি : “الرَّبِيعُ بْنُ صُبَيْحٍ ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ ، عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : لا تَقُولُوا : لا نَبِيَّ بَعْدَ مُحَمَّدٍ ، وَقُولُوا : خَاتَمُ النَّبِيِّينَ ، فَإِنَّهُ يَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلا وَإِمَامًا مُقْسِطًا ، فَيَقْتُلُ الدَّجَّالَ ، وَيَكْسِرُ الصَّلِيبَ ، وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيرَ ، وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ ، وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا“. (519، تفسير يحيى بن سلام، سُورَةُ الأَحْزَابِ، تَفْسِيرُ سُورَةِ الأَحْزَابِ)
ইয়াহইয়া ইবনু সাল্লাম এর সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত : أما صاحب التفسير يحيى بن سلام فهو يحيى بن سلام بن أبي ثعلبة، التيمي بالولاء، من تيم ربيعة، البصري ثم الإفريقي القيرواني 124 – 200 هـ = 742 – 815 م.
অর্থাৎ…. তোমরা বলোনা মুহাম্মদ (সা.) এর পর কোনো নবী নেই, (তবে) তোমরা বলবে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’। কেননা নিশ্চয়ই মরিয়ম পুত্র ঈসা (অচিরেই) একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং ন্যায়নিষ্ঠ ইমাম রূপে নাযিল হবেন, তিনি দাজ্জালকে কতল করবেন, ক্রুস ভেঙ্গে ফেলবেন, শুয়োর হত্যা করবেন, রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স (জিজিয়া) উঠিয়ে দেবেন, তখন যুদ্ধ আপনা সমস্ত সরঞ্জামাদি গুটিয়ে নেবে। – (তাফসীরে ইয়াহইয়া ইবনু সাল্লাম ৫১৯, সূরা আহযাব ৪০)।
হাদীসের মান : সহীহ।
রাবীগণের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত : গ্রন্থকার ইয়াহইয়া ইবনু সাল্লাম (রহ.) একজন বিশ্বস্ত রাবী ও একজন তাবে তাবেয়ী। তিনি তাইমী বংশীয় ও ইরাকের বসরা নগরের অধিবাসী ছিলেন। জন্ম ১২৪ হিজরীতে এবং মৃত্যু ২০০ হিজরীতে। ইমাম যাহাবী (রহ.) ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ (سير اعلام النبلاء) কিতাবে তাঁর জীবনী উল্লেখ করে বলেছেন, ابن أبي ثعلبة ، الإمام العلامة أبو زكريا البصري ، نزيل المغرب بإفريقية অর্থাৎ “ইয়াহইয়া ইবনু সাল্লাম এর দাদার নাম ছিল আবূ ছা’লাবাহ, তিনি একজন ইমাম ও আল্লামা, উপাধি আবূ যাকারিয়া আল বসরী, তিনি আফ্রিকার দেশ মরক্কো পাড়ি দেন।” ইমাম আবূ হাতিম তাঁকে সদূক বা সত্যবাদী বলেছেন, ইমাম ইবনু আদী তাঁর কাছ থেকে জ’ঈফ হাদীসগুলোও লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি বিখ্যাত ইমামগণ যেমন ইমাম শু’বাহ, ইমাম সুফিয়ান আস সওরী এবং ইমাম মালেক প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ থেকে হাদীস শিখেছেন। তিনি ইরাকের বসরা নগরের বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত রাবী’ বিন ছুবাঈ (মৃত্যু ১৬০ হিজরী) এর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করতেন। উল্লিখিত হাদীসটিও উক্ত মুহাদ্দিসের কাছ থেকে বর্ণিত। হাদীসটির সনদ মুত্তাসিল, রাবীগণের সবাই ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য।
খতমে নবুওয়ত সংক্রান্ত উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত একটি হাদীস নিম্নরূপ, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
لا يَبْقى بَعدي منَ النُّبوةِ شيءٌ إلَّا المُبشِّراتُ، قالوا: يا رسولَ اللهِ، وما المُبشِّراتُ؟ قال: الرُّؤيا الصالحةُ، يَراها الرَّجلُ، أو تُرى له
অর্থাৎ আমার পর নবুওয়তের কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে মুবাশ্বিরাত অবশিষ্ট থাকবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মুবাশ্বিরাত কী? তিনি উত্তরে বললেন, সত্য স্বপ্ন, মানুষ যা দেখবে, অথবা তাকে দেখানো হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস ক্রমিক নং ২৪৮৫৮, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা হতে বর্ণিত, সনদ সহীহ)। বুখারী এবং বায়হাক্বীতেও হাদীসটি বর্ণিত আছে।

এ পর্যায় চাঁদাখোর কাদিয়ানী মুরুব্বিদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর প্রথমোক্ত হাদীসে তাঁর উল্লিখিত বক্তব্য “তোমরা বলো না যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর কোনো নবী নেই” দ্বারা তিনি যদি নবুওয়তের দ্বার এখনো খোলা রয়েছে বুঝাতে চাইতেন তাহলে মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে বর্ণিত তাঁরই অপর আরেকটি বর্ণনায় “মুহাম্মদ (সা.) এর পর নবুওয়তের কিছুই অবশিষ্ট নেই” কথাটির কী অর্থ? কাজেই জ্ঞানীদের নিকট এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র কথাটি খাস তথা নির্দিষ্ট একজন পুরাতন নবীর পুনরায় দুনিয়াতে আসার সাথে সম্পর্কিত। কাজেই এ ধরনের খাস কোনো বর্ণনা দ্বারা আম বা ব্যপক অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া এবং নতুন নতুন নবীর আগমনী ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে প্রচার করা সুস্পষ্ট ধোকাবাজি ছাড়া আর কিছু না!
শেষকথাঃ কাদিয়ানী চাঁদাখোর ধোকাবাজ মুরুব্বিরা এবার একটু বলুন তো, আপনাদের কথা অনুসারে উক্ত হাদীস দ্বারা নবী আগমনের ধারা অব্যাহত রয়েছে বুঝালে, তবে তো আপনাদের মানতে হবে যে, মির্যা কাদিয়ানীর পরেও নবী আগমনী ধারা অব্যাহত আছে! কিন্তু আপনারা তো তা মানেন না! বরং আপনাদের মির্যা কাদিয়ানী নিজ সত্তা সম্পর্কে স্বয়ং লিখে গেছেন যে, মুহাম্মদী সিলসিলার শেষনবী এ অধম (তথা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী)। দেখুন, তাযকিরাতুশ শাহাদাতাইন (বাংলা অনূদিত) পৃষ্ঠা নং ৮২। তো এবার সমীকরণ কিভাবে মিলাবেন? আল্লাহ আপনাদের হিদায়াত দিন। আমীন।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী