ইমাম মাহদী একজন ‘জমিদার বংশীয়’ হবেন এটি কি হাদীস?

0
ইমাম মাহদী একজন ‘জমিদার বংশীয়’ হবেন এটি কি হাদীস?

ইমাম মাহদী জমিদার বংশীয় হবেন, বিপাশা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ‘কাদিয়ান’ গ্রাম থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন, বলিয়া হাদীসের নামে কাদিয়ানীদের প্রতারণার জবাব:

প্রশ্নকর্তা : হাদীসের কোথাও ইমাম মাহদী একজন ‘জমিদার বংশীয়’ হবেন এইরূপ উল্লেখ আছে কি?

উত্তরদাতা : না, এইরূপ কোনো হাদীস খোঁজে পাওয়া যায়না। তবে নবুওয়তের মিথ্যাদাবীদার মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীদের বইতে এই ধরণের অনেক কিছুই উল্লেখ আছে, যা ভুল এবং বানোয়াট। মূলত তারা হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে নিজেদের ভুল অনুবাদ থেকেই এই রকমটি মনে করে থাকে। এবার জেনে নেয়া যাক, হযরত আলী (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীসটিতে এমন কী উল্লেখ আছে! হাদীসে একটি শব্দ এসেছে ‘হারিছ হাররাছ’। তাই প্রশ্ন আসবে, এই ‘হারিছ হাররাছ’টা কে? জবাবে বলা হবে যে, সুনানে আবুদাউদ এর “কিতাবুল মাহদী” অংশে একই বর্ণনাকারী থেকে হাদীসটির আরবী ইবারত ( Text) দেখলে বুঝা যায় ওই হারিছ হাররাছ নামীয় ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি ওই সময়ে আত্মপ্রকাশকারী হযরত ইমাম মাহদীর সাহায্যে “ওরায়ুন্নাহার তথা মধ্য এশিয়া” থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে আসবেন। তার পূর্ণ নাম হবে হারিছ বিন হাররাছ (الحارث بن حراث) তথা হাররাছ এর পুত্র হারিছ। এবার অনুবাদসহ সংশ্লিষ্ট হাদীসটি নিচে দেখুন! হাদীস :

قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏: يَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ وَرَاءِ النَّهْرِ يُقَالُ لَهُ الْحَارِثُ بْنُ حَرَّاثٍ عَلَى مُقَدِّمَتِهِ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ مَنْصُورٌ يُوَطِّئُ أَوْ يُمَكِّنُ لآلِ مُحَمَّدٍ كَمَا مَكَّنَتْ قُرَيْشٌ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَجَبَ عَلَى كُلِّ مُؤْمِنٍ نَصْرُهُ ‏.‏ أَوْ قَالَ إِجَابَتُهُ ‏

অর্থাৎ : রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন “ওরায়ুন্নাহার তথা মধ্য এশিয়া থেকে হারিছ বিন হাররাছ (الحارث بن حراث) নামীয় এক ব্যক্তি বের হবে। তাঁর আগে “মানছুর” নামের অপর এক ব্যক্তি বের হবে। তিনি মুহাম্মদ (এখানে মুহাম্মদ বলতে ইমাম মাহদীকে বুঝানো উদ্দেশ্য। কেননা তার নাম মুহাম্মদ হবে)-এর অনুসারীর সাহায্যে এসে (বাহিনীতে) মিলিত হবেন ও তাঁকে শক্তিশালী করবেন; যেইরূপ কুরাইশরা রাসূল (সা:)-কে সাহায্য করেছিলো। (সেই সময়কার) সকল মুমিনের উচিত তাঁকে (ইমাম মাহদীকে) সাহায্য করা এবং তাঁর আহবানে সাড়া দেয়া।” রেফারেন্স, আবুদাউদ কিতাবুল মাহদী, হা/৪২৪০ [ইফা]; আরো দেখুন, ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) রচিত ‘আল আ’রফুল ওয়ারদী ফী আখবারিল মাহদী’ পৃষ্ঠা নং ২৭-২৮। (অনুবাদ শেষ হল)। হাদীসের মান, জঈফ।

وراء النهر ‘ওরাউন নাহার’ এর ভৌগোলিক সীমারেখা দেখুন ক্লিক

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! সুনানে আবুদাউদ শরীফের এই হাদীস দ্বারা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল যে, হারিছ হাররাছ এটি হারিছ ইবনে হাররাছ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। মূলত হারিছের পুত্র হাররাছ-এরূপই বুঝানো উদ্দেশ্য। এবার ‘ওরায়ুন্নাহার’ এর ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে জেনে নিন!

  • ওরায়ুন্নাহার (Wa’raun Nahar) এর ভৌগলিক পরিচয় :

ওরায়ুন্নাহার (ইংরেজি : Central Asia) হল, মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ (বিশেষত, সমরকন্দ, বুখারা, তিরমিয, তাসখন্দ ইত্যাদি)’র ভূ-বেষ্টিত এলাকা! অঞ্চলটির সীমানার অনেকগুলো সংজ্ঞা আছে, যার কোনোটিই পুরোপুরি সর্বজনগৃহীত নয়। ঐতিহাসিকভাবে অঞ্চলটি বিভিন্ন যাযাবর জাতি ও সিল্ক রোডের সাথে সম্পর্কিত। ফলে অঞ্চলটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জাতি, দ্রব্য ও সাংস্কৃতিক ধারণাসমূহের আদানপ্রদানের অঞ্চল হিসেবে কাজ করেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আছে কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, এবং অন্যান্য ছোট ছোট রাষ্ট্র যেমন – আজারবাইজান (কাস্পিয়ান সাগরের অপর পাড়ে অবস্থিত)। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকেও অনেক সময় এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)।

আপনি গুগলে আরবীতে ‘ওরায়ুন্নাহার’ (وراء النهر) লিখে সার্চ দিয়ে দেখুন, শব্দটির পুরো ডিটেলস মানচিত্রসহ বেরিয়ে আসবে। তখন আপনি নিজেও জেনে অবাক হবেন যে, কাদিয়ানীরা মধ্য-এশিয়ার ভৌগলিক সীমানার হাত পা ভেঙ্গে ‘বিপাশা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত গ্রাম বলিয়া মির্যার জন্মস্থান কাদিয়ান’-কে কিভাবে অপব্যাখ্যার নিশানায় পরিণত করল! শুধু কি তাই? না না, তারা ‘হাররাছ ইবনে হারিছ’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘হাররাছ হারিছ’ শব্দকে জমিদার বংশীয় বলেও ব্যাখ্যা দিতে ভুলেনি!

আহা! এ কি নিকৃষ্ট বিকৃতি! কি সব উদ্ভট ব্যাখ্যা!! কি যে অসম্ভব ধোকা!!! অথচ রাসূল (সা:) হাদীসটির আলোকে ইমাম মাহদীর বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসা তদানীংকালের একটি মুসলিম সৈন্যদলের নেতৃত্বদানকারী হারিছের পুত্র হাররাছ নামীয় ব্যক্তির ভৌগলিক অবস্থান কোথায় হবে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে চাচ্ছিলেন! মধ্য এশিয়ার মানচিত্র (উইকিপিডিয়া হতে সংগৃহীত) দেখুন, চীন, পাকিস্তান আর ইন্ডিয়া এই দেশগুলো নির্দিষ্ট সীমারেখার সম্পূর্ণ বাহিরে ও বরাবরই এশিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত। এমতাবস্থায় ‘কাদিয়ান’ গ্রামটিও মধ্য এশিয়ার সীমানার বাহিরেই থাকল কিনা? অবশ্যই। উফ! ওরা কিভাবে এতবড় প্রতারণার খেল খেলতে পারল!!

শেষে শুধু এইটুকু বলব, এখনো সময় আছে, রাসূল (সা:)-এর হাদীস, ইসলামের ইতিহাস আর ভৌগলিক অবস্থানের ভুলভাল ব্যাখ্যার কবলে পড়ে আল্লাহর ওয়াস্তে আর বিভ্রান্ত হবেন না! ফিরে আসুন, ইসলামের পুরণো ছাতার নিচে; আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মূলস্রোতে!

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here