হাদীসে কথিত ‘উম্মতি নবী‘ এর দলিল থাকার দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট
প্রশ্নকর্তা : একটি হাদীসে উল্লেখ আছে “…অতপর মূসা (আ:) আরজ করলেন اِجْعَلْنِىْ نَبِيًّا تِلْكَ الْاُمَّة অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে সেই উম্মতের নবী বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন “মিনহা নাবিয়্যুহা” অর্থাৎ তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে।” ( ইমাম আবু নাঈম আল-ইস্পাহানী (রহ:)-এর সীরাতগ্রন্থ “হুলিয়া” এবং থানভীর সীরাতগ্রন্থ “নশরুত্তিব” দ্রষ্টব্য)। এই হাদীসে ‘তাদের নবী’ হতে মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের কথাই কি বুঝানো হয়েছে?
খন্ডনমূলক জবাব : প্রথমত, ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন মঈন, ইবনে আদী, ইমাম বুখারী, আবু যুর’আ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদীসটির রাবীগণের কঠোর সমালোচনা করেছেন [ইমাম যাহাবী (রহ:) রচিত ‘মীযানুল ইতিদাল’ ৩/৬৭ দ্রষ্টব্য]। ইমাম ইবনে হাব্বান (রহ:) থেকে উক্ত বর্ণনাটির একজন রাবী সাঈদ ইবনে মূসা আল-উমাবী সম্পর্কে ‘মীযানুল ইতিদাল’ কিতাবে লিখা আছে اتهمه ابن حبان بالوضع. ثم ساق له ثلاثة أحاديث هذا أحدها ، وقال: موضوع অর্থাৎ ইবনে হাব্বান (রহ:) উক্ত বর্ণনাকারীকে জাল হাদীস তৈরিকারী বলে অভিহিত করেছেন। অতপর তিনি ঐ বর্ণনাকারীর তিনখানা হাদীসের অন্যতম এই একখানা হাদীসকে জাল তথা বানোয়াট বলেছেন। শায়খ আলবানী (রহ:) লিখেছেন, এর সূত্র খুবই দুর্বল ও বানোয়াট (ইমাম ইবনে আবী আ’ছেম রচিত কিতাবুস সুন্নাহ’র তাহ্কিক শায়খ আলবানীর ‘যিলালুল জুন্নাহ ফী তাখরীজিস্ সুন্নাহ ১/৩০৬ দ্রষ্টব্য)। ফলে হাদীসের ঐ কথাগুলো প্রকৃতপক্ষে রাসূল (সা:)-এরই কথা কিনা তা নিশ্চিত নয়, বরং সন্দেহজনক। তাই ঐ কথাগুলো আকীদার ক্ষেত্রে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্যথা কাদিয়ানীদের নিকট নিচের প্রশ্নগুলোর কোনোই জবাব থাকেনা।
কারণ উক্ত হাদীস হতে বুঝা যায়, মূসা (আ:) প্রথমে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার নবী হতে আরজ করেছিলেন। এমনকি উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্যে শামিল হতেও চেয়েছিলেন! ফলে প্রশ্ন আসবে যে, হযরত মূসা (আ:) বনী ইসরাঈলের জন্য অলরেডি একজন রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েও তিনি উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ‘নবী’ হতে চাইবেন কেন? অথচ ঐ উম্মতের জন্য সর্বশেষ নবী মুহাম্মদে আরাবী (সা:) পূর্ব থেকেই মনোনীত হয়ে আছেন যার সংবাদ ‘তাওরাত’ কিতাবেও দেয়া হয়েছে! আরো প্রশ্ন আসবে যে, মূসা (আ:) নিজের নবী ও রাসূলের পদ মর্যাদা উপেক্ষা করে শুধুমাত্র একজন “উম্মত” হতে চাইবেন কোন্ যুক্তিতে? কোনো উম্মত কি কখনো নবী রাসূলের সমকক্ষ হতে পারে?
- দ্বিতীয়ত, ইমাম আবু নাঈম আল-ইস্পাহানী (রহ:)-এর আরেকটি সীরাতগ্রন্থ ‘দালায়িলুন নাবুওয়্যাহ‘ [دلائل النبوة] (পৃষ্ঠা ৬৮-৬৯) এর মধ্যে উক্ত বর্ণনাটি নিম্নোক্ত শব্দচয়নেও উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বর্ণনা করেছেন : إِنَّ مُوسَى لَمَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِ التَّوْرَاةُ، وَقَرَأَهَا فَوَجَدَ فِيهَا ذِكْرَ هَذِهِ الْأُمَّةِ فَقَالَ: يَا رَبِّي، إِنِّي أَجِدُ فِي الْأَلْوَاحِ أُمَّةً هُمُ الْآخِرُونَ السَّابِقُونَ، فَاجْعَلْهَا أُمَّتِي قَالَ: تِلْكَ أُمَّةُ أَحْمَدَ … قَالَ: يَا رَبِّ فَاجْعَلْنِي مِنْ أُمَّةِ أَحْمَدَ. অর্থাৎ “মূসা (আ:) এর প্রতি যখন তাওরাত নাযিল হল এবং তিনি যখন সেটি পড়লেন এবং সেখানে এই উম্মতের আলোচনা দেখতে পেলেন তখন তিনি আরজ করলেন, হে আমার প্রভু! আমি এই তখতে (তাওরাতের পান্ডুলিপি) শেষ যামানার অগ্রগামী উম্মতের আলোচনা দেখতে পাই। তাদেরকে আমার উম্মত বানিয়ে দিন। আল্লাহতালা উত্তরে বললেন, তারা আহমদের উম্মত।…. তখন মূসা (আ:) বললেন, তাহলে আমাকে আহমদের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করে দিন।”
তৃতীয়ত, ‘তাফসীরে আবী হাতিম’ (৫/১৫৮৭) এর মধ্যেও এই ধরণের আরেকটি দুর্বল বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, আল্লাহপাক মূসা (আ:)-কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করলেন: تِلْكَ الْاُمَّةُ تَكُوْنُ بَعْدَكَ اُمَّةُ اَحْمَدَ অর্থাৎ ঐ উম্মত তোমার পর আহমদের উম্মত হবে। এতে কিন্তু পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মূসা (আ:) যেই উম্মতের নবী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলিয়া কথিত আছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহও যে বলেছেন ‘তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে’-এই সমস্ত কথাবার্তায় ভবিষ্যতে একজন ‘উম্মতিনবী’ হবে—বুঝায় না, বরং ঐ সমস্ত কথাবার্তায় মুহাম্মদ (সা:)-এরই আগমনী সংবাদ দেয়া উদ্দেশ্য। নচেৎ ‘তিলকাল উম্মাতু তাকূনু বা’দাকা উম্মাতু আহমাদ’ (تِلْكَ الْاُمَّةُ تَكُوْنُ بَعْدَكَ اُمَّةُ اَحْمَدَ) একথার কী মানে?
- এবার প্রশ্ন আসতে পারে যে, ঐ “আহমদ” দ্বারা মুহাম্মদ (সা:)-ই যে উদ্দেশ্য তা কিভাবে বুঝলাম? একজন উম্মতিনবীর আগমনী সংবাদও তো হতে পারে! এর জবাব নিম্নরূপ:-
বিজ্ঞপাঠকবৃন্দ! একটু লক্ষ্য করুন। আবু নঈম এর হুলিয়াতুল আউলিয়া حلية الأولياء গ্রন্থের উক্ত বর্ণনাতেই “আহমদ” নামক ব্যক্তিটির পরিচয় এভাবে উল্লেখ আছে যে, “হযরত মূসা (আ:) আরজ করলেন, আহমদ কে? আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন : হে মূসা! আমার ইজ্জত ও গৌরবের শপথ। আমি সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে তাঁর চেয়ে অধিক সম্মানিত কাউকেই সৃষ্টি করিনি। আমি তাঁর নাম আরশের মধ্যে আমার নামের সাথে আসমান ও জমিন এবং চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টির বিশ লক্ষ বছর পূর্বে লিপিবদ্ধ করেছি। আমার ইজ্জত ও গৌরবের শপথ! আমার সমস্ত মাখলূকের জন্য জান্নাত হারাম যতক্ষণ মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর উম্মত জান্নাতে প্রবেশ না করবে।”
আশাকরি বুঝতেই পেরেছেন যে, হাদীসটি যদি সহীহও ধরি তাহলেও কিন্তু এখানে ‘আহমদ’ নামীয় মহান ঐ ব্যক্তিটি দ্বারা স্বয়ং মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-ই উদ্দেশ্য। সুতরাং এর দ্বারা তথাকথিত উম্মতিনবী’র কনসেপশন পুরোপুরি ভ্রান্ত ও বাতিল সাব্যস্ত হল।
- হাদীসের নামে তাদের আরো ১২টি দলিলের জবাব এখানে Click
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ