খতমে নবুওয়ত অস্বীকারকারী কাদিয়ানিদের ১২টি বিভ্রান্তিকর দলিল ও আমার জবাব :
প্রদত্ত দলিলগুলো কাদিয়ানীদের পক্ষ হতে আর জবাবগুলো আমার :
দলিল ১ :
প্রশ্নকর্তা : একটি হাদীসে উল্লেখ আছে “…অতপর মূসা (আ:) আরজ করলেন اِجْعَلْنِىْ نَبِيًّا تِلْكَ الْاُمَّة অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে সেই উম্মতের নবী বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন “মিনহা নাবিয়্যুহা” অর্থাৎ তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে।” (আবু নাঈম এর সীরাতগ্রন্থ হুলিয়া, থানভীর সীরাতগ্রন্থ নশরুত্তিব দ্রষ্টব্য)। এই হাদীসে ‘তাদের নবী’ হতে মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের কথাই কি বুঝানো হয়েছে?
ঈসা (আ:) উম্মতে মুহাম্মদীয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন কি?
দলিল ২ :
لو عاش ابراهيم لكان صديقا نبيا অর্থাৎ যদি ইব্রাহীম তথা হুজুর (সা:) এর সন্তান জীবিত থাকত তবে সে সত্যবাদী ও নবী হতো।” (সুনানু ইবনে মাজাহ ১/১০৮; ‘তারীখু ইবনে আসাকীর ৩/২৯৫)।
দলিল ৩ :
ابو بكر خير الناس الا ان يكون نبيا. অর্থাৎ আবু বকর এই উম্মতের মাঝে সবার শ্রেষ্ঠ তবে নবী হলে ভিন্ন কথা। (কাঞ্জুল উম্মাল ১২/১৮০, হাদীসের মান জঈফ ও মওযূ)।
জবাব : না, এই হাদীস দ্বারাও নবুওয়তে মুহাম্মদীর পরেও নবুওয়তেরধারা জারি রয়েছে বুঝাবেনা। তার কারণ এখানে ان يكون এর মধ্যে ঊহ্য هو (ইংরেজি : He) সর্বনামপদটি আবুবকর (রা:)-কে নির্দেশ করেছে। ফলে সম্পূর্ণ বর্ণনাটির অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন আবুবকর (রা:)। তবে সে যদি নবী হত তখন ভিন্ন কথা ছিল। রাসূল (রা:) এই কথা বলে যেন বুঝাতে চাচ্ছেন যে, আবুবকর (রা:) যেহেতু নবী নন, তাই তিনি শুধুমাত্র উম্মতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন। তবে হ্যাঁ সে “নবী” হলে তখন উম্মতির বাহিরে কোনো কোনো নবী অপেক্ষাও তাঁর পক্ষে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারা বিচিত্র ছিল না। কিন্তু আমি জানি যে, কাদিয়ানিদের নিকট আমার এই জবাব মোটেও সন্তোষজনক হবেনা। তাই তাদের উদ্দেশ্যে পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই যে, কাদিয়ানের কথিত কৃষ্ণ মির্যা গোলাম আহমদ কর্তৃক ১৮৯৩ সালে লেখিত ‘হামামাতুল বুশরা’ এর মধ্যে উল্লেখ আছে “আমাদের রাসূলের পর কিভাবে কোনো নবী আসতে পারে? তাঁর মৃত্যুর পর ওহী বন্ধ হয়ে গেছে আর আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে নবীদের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন।” (দেখুন, পৃষ্ঠা নং ৪৮; বাংলা অনূদিত)।
তাই আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নবুওয়তে মুহাম্মদীর পরেও নবুওয়তেরধারা অব্যাহত থাকলে মির্যা গোলাম আহমদ নবুওয়ত দাবী করার আগে সে নিজেও “রাসূল (সা:) এর মৃত্যুর পর ওহী বন্ধ হয়ে গেছে…” ইত্যাদি লিখে যাওয়ার কারণ কী? সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল, উক্ত বর্ণনাটির পরে আরো উল্লেখ রয়েছে هذا الحديث احد مما انكر (অর্থাৎ এই হাদীসটি মুনকার হাদীসগুলোর অন্যতম)। উল্লেখ্য, বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে দুর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসকে ‘মুনকার’ হাদীস বলা হয়। অতএব, জ্ঞানীদের বুঝার আর বাকি থাকেনি যে, তাদের প্রদত্ত বর্ণনাটি অন্ততপক্ষে আকীদা-বিষয়ক মাসআলায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংক্ষেপে।
দলিল ৪ :
قال ليس بينى و بينه نبى يعنى عيسى و انه نازل অর্থাৎ আমার এবং আগমনকারী ঈসার মধ্যবর্তীকালে আর কোনো নবী নেই এবং তিনি নিশ্চয় নাযিল হবেন। (আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৩২৪; কিতাবুল মালাহিম)।
জবাব : না, এই হাদীস দ্বারাও মির্যা গোলাম কাদিয়ানীর নবুওয়ত দাবী কোনোভাবেই সিদ্ধি লাভ করবেনা। তার কারণ, হাদীসটিতে আগমনকারী ঈসা সম্পর্কে “নাযিল” শব্দ এসেছে। তার মানে আগমনকারী ঈসা অবতরণ করবেন, জন্মিবেন না। তার দেড় লাইনের মাথায় তাঁর সম্পর্কে এটিও উল্লেখ আছে فيقاتل الناس على الإسلام (অর্থাৎ তিনি মানুষের বিরুদ্ধে ইসলামের খাতিরে সশস্ত্র লড়াই করবেন)। তার এক লাইনের মাথায় আরো এসেছে و يهلك الله فى زمانه الملل كلها إلا الاسلام (অর্থাৎ আল্লাহতালা তাঁর যামানায় ইসলাম ব্যতীত বাকি সমস্ত ধর্ম ও মতবাদ ধ্বংস করে দেবেন)। হাদীসটির শেষাংশে এটিও এসেছে, فيمكث فى الأرض اربعين سنة ثم يتوفى فيصلى عليه المسلمون (অর্থাৎ অতপর তিনি পৃথিবীতে চল্লিশ বছর থাকবেন তারপর মৃত্যুবরণ করবেন। অতপর মুসলমানগণ তাঁর জানাজা পড়বেন)। যাইহোক, একজন নিরপেক্ষ পাঠক ঠাণ্ডামাথায় চিন্তা করলে বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, আগমনকারী সেই ঈসা রূপক কেউ নন, বরং বনী ইসরাইলের প্রতি প্রেরিত সেই মরিয়ম-পুত্র ঈসাই উদ্দেশ্য। যিনি হাদীসটিতে “নবী” শব্দেও আহূত হয়েছেন। তারমানে এই অর্থ নয় যে, আগমনকারী সেই ঈসা তখন নবুওয়তের দায়িত্বেও থাকবেন।
এটি আমার মনগড়া কোনো কথা নয়, বরং কাদিয়ানের কৃষ্ণ মির্যা গোলাম নিজেও লিখে গেছেন, آنے والے مسیح کیلئے ہمارے نبی اکرم نے نبوت شرط نہیں ٹہرائی অর্থাৎ আগমনকারী মাসীহ’র জন্য আমাদের নবী করীম (সা:) নবুওয়ত শর্ত করেননি। (তাওযীহুল মারাম, রূহানী খাযায়েন ৩/৫৯)। সুতরাং সরলমনা মানুষকে বিভ্রান্ত করার আর কোনো সুযোগ থাকল না।
মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে চার চার বার ঈসা (আ.)-কে নাবীউল্লাহ বলা হয়েছে, কাদিয়ানীদের অতিব শঠতাপূর্ণ বক্তব্যের দাঁতভাঙা উত্তর এখানে
দলিল ৫ :
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন : قولوا خاتم الأنبياء و لا تقولوا لا نبى بعده অর্থাৎ তোমরা খাতামুল আম্বিয়া বলো এবং তোমরা বলবেনা, তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই। (মাজমাউল বিহার পৃষ্ঠা নং ৫০২)।
জবাব : না, এই বর্ণনা দ্বারাও কাদিয়ানিদের বিশ্বাস-মতে নবুওয়তী ওহীরধারা জারি থাকার দাবী কোনোভাবেই হালে পানি পায় না। কেননা ইমাম মুহাম্মদ তাহের পাটনী (মৃত ৯৮৬ হিজরী) বিরচিত ‘মাজমাউল বিহার’ কিতাবটির উক্ত পৃষ্ঠায় বর্ণনাটিতে আরো উল্লেখ আছে هذا ناظراً إلى نزول عيسى و هذا ايضا لا ينافى حديث “لا نبى بعدى” لانه اراد لا نبى ينسخ شرعه অর্থাৎ এটি ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণ হওয়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং এটি ‘লা নাবিয়্যা বা’দী’ শীর্ষক হাদীসকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবেনা। কেননা তদ্দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাঁর শরীয়তকে রহিত করতে পারে তিনি এমন নবী নন। এবার সম্পূর্ণ বর্ণনার তাৎপর্য দাঁড়াল এই যে “ঈসা আলাইহিস-সালামের নাযিলের প্রতি লক্ষ্য রেখে তোমরা খাতামুল আম্বিয়া বলো, তবে ‘তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই’ বলবেনা।” এছাড়া বিশিষ্ট সাহাবী হযরত মুগীরা (রা:) হতেও বর্ণিত আছে তিনি জনৈক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন حسبك إن قلت خاتم الأنبياء (অর্থাৎ তোমার জন্য খাতামুল আম্বিয়া বলাই যথেষ্ট। তিনি আরো বলেন فإنا كنا نحدث أن عيسى خارج فإن هو خرج فقد كان قبله و بعده অর্থাৎ কেননা আমরা আলোচনা করে থাকি যে, ঈসা (আ:) নিশ্চয়ই আগমন করবেন। তিনি যদি আগমন করেন তাহলে তিনি তাঁর (মুহাম্মদ) পূর্বের এবং পরের (একজন মানুষ) হবেন। (দেখুন, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহঃ ১৩/৫৬৬; কিতাবুল আদাব)।
ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সালাম আল বছরী (মৃতঃ ২০০ হিজরী) বিরচিত ‘তাফসীরে ইয়াহইয়া ইবনে সালাম’ (تفسير يحي بن سلام) নামক কিতাবেও এর সনদ (সূত্র) হিসেবে উল্লেখ আছে যে, রাবীঈ ইবনে ছুবাঈ (আরবি : ربيع ابن صبيح) এটি মুহাম্মদ ইবনে শিরীন (রহ:) থেকে আর তিনি হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, لا تقولوا : لا نبي بعد محمد و قولوا : خاتم النبيين، فإنه ينزل عيسى بن مريم حكماً عدلاً و إماماً مقسطا الخ অর্থাৎ তোমরা বলোনা, মুহাম্মদ (সা:)-এর পর আর কোনো নবী নেই (তবে) তোমরা ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ বলো। কেননা (অচিরেই) ঈসা ইবনে মরিয়ম একজন ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক এবং ইনসাফগার ইমাম হিসেবে অবতরণ করবেন।” সে যাইহোক, এ সমস্ত রেওয়ায়েত যত জায়গায় পাওয়া যায় কোথাও একথা বুঝায় না যে, হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর পরে নবুওয়ত আর রেসালত জারি থাকবে বরং এ ধরণের সবগুলো বর্ণনাতেই শেষ যুগে হযরত ঈসা (আ:)-এর দ্বিতীয়বার আগমনের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। সুতরাং এই বর্ণনা দ্বারাও তাদের নবুওয়ত জারি থাকার তাবৎ দলিল-প্রমাণ(!) অন্তঃসারশূন্যই সাব্যস্ত হল। সংক্ষেপে।
দলিল ৬ :
সহীহ মুসলিম শরীফের একটি হাদীসের খন্ডাংশ হচ্ছে, রাসূল (সা:) বলেছেন فإني آخر الأنبياء و ان مسجدى آخر المساجد অর্থাৎ নিশ্চয় আমি সর্বশেষ নবী এবং আমার মসজিদ সর্বশেষ মসজিদ। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩২৩৯)।
জবাব : না, এই হাদীসটিও নবুওয়তেরধারা অব্যাহত থাকবে বুঝায়নি। প্রাসঙ্গিক জবাবে আরেকটু পরে আসি। আমরা জানি, হযরত মুহাম্মদ (সা:) মদীনায় এসে নিজ তত্ত্বাবধানে প্রথমে মসজিদে কূবা তারপর মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা বর্তমান সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত। এই মসজিদ রাসূল (সা:) কর্তৃক ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সর্বশেষ মসজিদ হওয়াতে তিনি বলেছেন : مسجدى آخر المساجد অর্থাৎ আমার মসজিদই শেষ মসজিদ। এখন আমার প্রশ্ন হল, মসজিদে নববীর পরে কোটি কোটি মসজিদই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন তাতে কি? এগুলো কি রাসূল (সা:)-এর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত? নিশ্চয় না। কাজেই হাদীসটিকে কেউ বেঁকিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে পথভ্রষ্ট হতে চাইলে তাতে আমাদের কিছুই করার নেই। হাদিসের অন্যতম কিতাব ‘আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব’ কিতাবে উপরিউক্ত হাদিসটি শব্দের সামান্য পরিবর্তনসহ বর্ণনাকারীর বর্ণনাতে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা:) বলেছেন مسجدى آخر مساجد الأنبياء (মাসজিদী আখেরু মাসাজিদিল আম্বিয়া) অর্থাৎ “আমার মসজিদ নবীদের মসজিদগুলোর সর্বশেষ মসজিদ।”
হযরত উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) হতেও এ সম্পর্কে আরেকটি হাদীসে আছে, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন أنا خاتم الأنبياء و مسجدى خاتم مساجد الأنبياء অর্থাৎ “আমি সর্বশেষ নবী আর আমার মসজিদ নবীদের মসজিদগুলোর সর্বশেষ মসজিদ।” (দেখুন, কাঞ্জুল উম্মাল হাদীস নং ৩৪৯৯৯; হারামাঈন পরিচ্ছেদ)। প্রমাণের জন্য আরো দেখা যেতে পারে – ইমাম নূর উদ্দীন আল হাইছামী (মৃত ৮০৭হিজরী) রচিত ‘কাশফুল আছতার‘। ইমাম আল ফাকেহী (মৃত ২৭৫ হিজরী) রচিত ‘আখবারু মাক্কা‘। ইমাম ইউছুফ আল মুযনী (মৃত ৭৪২ হিজরী) রচিত ‘তাহযীবুল কামাল‘। ইমাম আবুল ফারাজ ইবনে জাওযী (মৃত ৫৯৭ হিজরী) রচিত ‘মাছীরুল গারামিস সাকিন ইলা আশরাফিল আমাকিন‘। ইমাম নূর উদ্দিন আলী ইবনে আহমদ আল সামহূদী রচিত ‘খোলাসাতুল ওয়াফা বি-আখবারি দারিল মুস্তফা‘ এর ‘ফাজিলাতু মসজিদিন নাবাবিয়্যি’ শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য। তার মানে, রাব্বুল আলামীনের ইবাদত করার জন্য প্রত্যেক যুগেই নবীগণ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, আর সর্বশেষ নবী হিসেবে আমি (মুহাম্মদ)ও “মসজিদে নববী” নির্মাণ করেছি। যেহেতু আমার পরে আর কোনো নবী নেই, সেহেতু নবী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদগুলোর সর্বশেষ মসজিদ হচ্ছে আমার মসজিদ তথা মসজিদে নববী।” সংক্ষেপে।
দলিল ৭ :
নবী করীম (সা:) স্বীয় চাচা হযরত আব্বাস (রা:)-কে সম্বোধন করে বলেন “নবুওয়তে আমি যেমন খাতামুন্নাবিয়্যীন, হিজরতে আপনি তদ্রূপ খাতামুল মুহাজিরীন” (কাঞ্জুল উম্মাল দ্রষ্টব্য)।
জবাব : না, এই হাদীস দ্বারাও নবুওয়তের ওহী অব্যাহত থাকা প্রমাণিত হয় না। তার কারণ, অষ্টম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ যুগ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) এ সম্পর্কে লিখেছেন أن العباس بن عبد المطلب هاجر قبيل فتح مكة إلى المدينة فصار خاتم المهاجرين الذين هاجروا من مكة إلى المدينة لأنه لا هجرة بعد فتح مكة من مكة , كما ورد في الحديث الصحيح الذي أخرجه البخاري : ” لا هجرة بعد الفتح ” أي بعد فتح مكة অর্থাৎ আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব তিনি মক্কা বিজয়ের পূর্বক্ষণে মদীনায় (সপরিবারে) হিজরত করেন। যার ফলে তিনি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতকারীদের মধ্যে ‘খাতামুল মুহাজিরীন’ সাব্যস্ত হন। তার কারণ, মক্কা বিজয়ের পর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পূর্ব-বিধান আর বহাল থাকেনি। সহীহ বুখারীতেও এ মর্মে হাদীস উল্লেখ আছে যে, লা হিজরাতা বা’দাল ফাতহে আই বা’দা ফাতহি মাক্কা।’ প্রমাণ হিসেবে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রচিত ‘আল ইছাবাহ’ (الاصابة) গ্রন্থের ২য় খন্ডের ২৬৩ নং পৃষ্ঠা এবং ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খন্ডের ৩৭ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। মোটকথা হচ্ছে, মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত মদীনায় হিজরত করা সকল মুসলমানের উপর যেহেতু ওয়াজিব ছিল সেহেতু রাসূল (সা:)-এর চাচা আব্বাসের উপরও ওয়াজিব ছিল। তিনি বদর যুদ্ধে গ্রেপ্তার হয়ে অতপর মুক্তি পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তিনি রাসূল (সা:) এর নিকট মক্কায় ফিরে গিয়ে সেখান থেকে মদীনায় হিজরতের অনুমতিও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মক্কায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি থাকলেও রাসূল (সা:) বিশেষ কারণে তাঁকে তৎক্ষনাৎ হিজরতকরা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন يا عم اقم مكانك فان الله يختم بك الهجرة كما ختم بي النبوة অর্থাৎ হে আমার চাচা! আপনি আপনার জায়গাতেই থাকুন। কারণ আল্লাহতায়ালা আমার মাধ্যমে যেরূপ ভাবে নবুওয়তেরধারা শেষ করবেন তেমনি আপনার মাধ্যমে আবশ্যকীয় হিজরতের ক্রমধারাও শেষ করে দেবেন। (ইমাম যাহাবী (রহ:) রচিত ‘মীযানুল ইতিদাল’ এর ১ম খণ্ডের ২৪৫ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। সিয়ারু আলামিন নুবালা থেকে স্ক্যানকপি :-
ইমাম বাগাবী (রহ.) তাঁর ‘শরহে সুন্নাহ‘ কিতাবের দশম খন্ডের ৩৭৩-৭৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, মক্কা বিজয়ের পর আর কোনো হিজরত নেই। একথা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, “মক্কা হতে মদীনায় আর কোনো অত্যাবশ্যকীয় হিজরতের বিধি অবশিষ্ট নেই।” সে হিসেবে রাসূল (সা.) আপন চাচা আব্বাসকে কাছে পেয়ে পূর্বের ভবিষ্যৎবাণীর ভিত্তিতে বললেন “হে আমার চাচা আব্বাস! আপনি খাতামুল মুহাজিরীন তথা শেষ হিজরতকারী। রাসূল (সা.) তাঁকে ‘খাতামুল মুহাজিরীন’ বলে যেন বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত যেই হিজরত মুসলমানদের উপর আবশ্যক (ওয়াজিব) ছিল আপনি-ই হলেন সেই অত্যাবশ্যকীয় হিজরতের সমাপ্তকারী। এই ছিল ‘খাতামুল মুহাজিরীন’ এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। উল্লেখ্য, সেই বছরই তথা ৮ম হিজরী সালের ১০ রমযান তারিখে রাসূল (সা.) ১০,০০০ মুসলিম বাহিনীর এক বিরাট কাফেলা নিয়ে মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কোনোরূপ রক্তপাত ছাড়াই মক্কা নগরী জয় করেছেন।
দলিল ৮ :
নবী করীম (সা.) বলেছেন, “আনা খাতামুল আম্বিয়া ওয়া আনতা ইয়া আলী খাতামুল আওলিয়া” (শীয়া মতাবলম্বী মুহসিন আল কাশানী’র (মৃত. ১০৯১ হিজরী) ‘তাফসীরে সাফী’ দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ আমি খাতামুল আম্বিয়া এবং হে আলী তুমি খাতামুল আওলিয়া।
জবাব : না, এটি হাদীস হিসেবে প্রমাণিত নয়। যতটুকু জানা যায়, ‘খতমুল বেলাদত’ গ্রন্থের রচিতা বিশিষ্ট সাধক আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আলী-ই প্রথম এই বাক্যাংশের প্রবর্তক ছিল। সংক্ষেপে তাঁকে হাকিম তিরমিযী বলে। শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ:)-এর কিতাব থেকে জানা যায়, সাধক আবু আব্দুল্লাহ (রহ:) ইতিপূর্বে নিজেকে ‘খাতামুল আওলিয়া’ মনে করত। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি এজন্য ভুল স্বীকার করেছেন এবং ভীষণ অনুতপ্তও হয়েছেন।
হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর যুগ ইমাম, আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ:) এ সম্পর্কে তাঁর ‘মাজমু’ ফাতাওয়া’ গ্রন্থের ১১তম খন্ডের ৪৪৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন : وكذا خاتم الأولياء لفظ باطل لا أصل له. وأول من ذكره محمد بن علي الحكيم الترمذي. وقد انتحله طائفة كل منهم يدعي أنه خاتم الأولياء: كابن حموي، وابن عربي، وبعض الشيوخ الضالين بدمشق وغيرها অর্থাৎ অনুরূপভাবে ‘খাতামুল আওলিয়া’ এটি এমন একটি শব্দ যার কোনো ভিত্তি নেই। এটি প্রথম উল্লেখ করেছিলেন, মুহাম্মদ ইবনে আলী আল হাকিম তিরমিযী। একটি দল এটিকে অবলম্বন করেই তাদের প্রত্যেকে নিজেকে ‘খাতামুল আওলিয়া’ দাবি করত। এদের মধ্যে ইবনে হামাভী, মুহী উদ্দিন ইবনে আরাবীসহ দামেস্ক ইত্যাদি শহরের কিছু সংখ্যক বিপথগামী ছূফীও রয়েছে।” অতএব প্রমাণ পাওয়া গেল যে ‘খাতামুল আওলিয়া’ শীর্ষক শব্দটি মূলত কোনো হাদীসের অংশ নয়। বরং শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর প্রদত্ত তথ্যমতে এটি ‘খতমুল বেলাদত’ গ্রন্থের রচিতা আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আলীর-ই প্রবর্তিত মাত্র। (রেফারেন্স, প্রাগুক্ত)। তাই অসংখ্য সহীহ হাদীস আর ইজমায়ে উম্মতের মুকাবেলায় কে কী লিখল তা নিয়ে ভাবার দরকার কী? খতমে নবুওয়তের মত এমন একটি চির মীমাংসিত বিষয়ের খেলাফ কারো ব্যক্তিগত কোনো কথার গুরুত্বটাই বা কী?
দলিল ৯ :
সুনানু তিরমিযী শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে أن الرسالة و النبوة قد انقطعت فلا رسول بعدى ولا نبى অর্থাৎ নিশ্চয়ই রেসালত এবং নবুওয়ত বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আর কোনো রাসূল নেই, নবীও নেই। (হাদীসটি সহীহ)। কিন্তু কাদিয়ানিদের বই পুস্তকে শায়খ ইবনে আরাবী (রহ.) এর নাম ভেঙ্গে হাদীসটির একখানা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, “হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরে নবুওয়ত এবং রেসালতেরধারা বন্ধ—একথার অর্থ হল, কেবল তাশরীয়ী (শরিয়তবাহক) নবুওয়ত ও রেসালত-ই বন্ধ। তাই মুহাম্মদ (সা.)-এর পরে যিনি আগমন করবেন তিনি এমন কেউ নন যিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর শরীয়তের বিপরীতে হবেন। বরং তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর আনিত শরীয়তের-ই অধীনে হবেন।” (ফতুহাতে মাক্কিয়া ২/৩ দ্রষ্টব্য)।
উত্তর : শায়খ ইবনে আরাবী’র উক্ত ব্যাখ্যার সঠিক মর্মার্থ কী তা একই পৃষ্ঠার শেষের দুই-তিন লাইনে নিজেই পরিস্কার করে দিয়েছেন এই বলে যে “যার ফলে ঈসা (আ:) একজন নবী ও রাসূল থাকাটা লা নাবিয়্যা বা’দী’ শীর্ষক হাদীস অংশের বিরুদ্ধে যায় না।” সুতরাং প্রমাণিত হয়ে গেল যে, ইবনে আরাবীর উপরিউক্ত বক্তব্যের ইংগিত নুযূলে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) এর প্রতিই ছিল। তাই তাঁর বক্তব্যটিকে ব্যাপকার্থে ধরে নিয়ে বর্তমানেও নবুওয়ত জারি থাকার আকিদা সাব্যস্ত করতে চাওয়া পুরোপুরি বাতিল। এই সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন এখানে।
‘উম্মতি’ শব্দকে আশ্রয় করে মির্যা কাদিয়ানীর “নবী” দাবীর গোমর ফাঁস : Click
দলিল ১০ :
ألا انه خليفة فى امتى ألا انه ليس بينى و بينه نبى অর্থাৎ সাবধান! নিশ্চয়ই তিনি (ঈসা) আমার উম্মতের মাঝে একজন খলীফা হবেন এবং তাঁর ও আমার মাঝে আর কোনো নবী নেই। (সুনানু তাবারানী)।
জবাব : না, এই হাদীস দ্বারাও নবুওয়তে মুহাম্মদীর পর নবুওয়তেরধারা অব্যাহত থাকা বুঝায়নি। বড়জোর, এটি শেষ যামানায় প্রতিশ্রুত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) এর দ্বিতীয়বার আগমন কী হিসেবে হবে তা “আন্নাহু খালীফাতু” শুব্দগুচ্ছের আলোকে সুস্পষ্ট করে দেয়ার জন্যই বর্ণিত হয়েছে। এখানে খুবই লক্ষণীয় ব্যাপার হল, অত্র বর্ণনায় শব্দটি উল্লেখ হবার ধরণ! অর্থাৎ এখানে “খালীফাতু ফী উম্মাতি” (আমার উম্মতের মাঝে একজন খলীফা) চয়িত হয়েছে, কিন্তু “খালীফাতু মিন উম্মতি” (আমার উম্মতের মধ্য থেকে একজন খলীফা) চয়িত হয়নি। ফলে একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আগত ঈসা দ্বারা এই উম্মতের মধ্য হতে রূপক কেউ হবেনা, বরং “সহীহ মুসলিম শরীফ” এর কিতাবুল ফিতান অধ্যায়ের বর্ণনানুসারে আগত ঈসা দ্বারা বনী ইসরাইলী ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)-ই উদ্দেশ্য, যিনি দুইজন ফেরেশতার দুই পাখার উপর আপনা দুই বাহু রেখে এই উম্মতের মাঝে [আকাশ থেকে] আবির্ভূত হবেন। সংক্ষেপে। এই সম্পর্কে উপরে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। দেখে নিন। ওয়াস-সালাম।
দলিল ১১ :
হাদীসে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন : قالوا : يا رسول الله ! متى وجبت لك النبوة ؟ قال : وآدم بين الروح والجسد رواه الترمذي অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম (একদা নবীজীকে) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার জন্য নবুওয়ত কবে থেকে নির্ধারিত? তিনি (সা.) প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, যখন আদম রূহ এবং শরীরের মাঝে নিহিত [তখন থেকে আমার জন্য নবুওয়ত নির্ধারিত]। (মেরকাত শরহে মেশকাত, খন্ড নং ১০; হাদীস নং ৫৭৫৮, কিতাবুল ফাজায়েল ওয়াশ শামায়েল)। এই হাদীস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে খাতাম অর্থ ‘শেষ’ নয়, বরং ‘শ্রেষ্ঠ’। সুতরাং মুহাম্মদ (সা.)-এর পরে নবুওয়ত বন্ধ থাকেনি, বরং বিদ্যমান রয়েছে।
জবাব : না, এই হাদীসও নবুওয়তে মুহাম্মদীর পরে ‘ওহীয়ে নবুওয়ত’ জারি থাকার পক্ষে কোনোই ইংগিত করেনা। যেহেতু বিষয়টি আমরা হযরত ইরবাছ ইবনে সারিয়াহ (রা.) হতে আরেকটি হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট করে নিতে পারি। হাদীসের ভাষ্য, أنه قال إني عند الله مكتوب : خاتم النبيين অর্থাৎ রাসূল (সা:) বলেছেন নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর নিকটে খাতামুন নাবিয়্যীন হিসেবে লিপিবদ্ধ ছিলাম (আল-মেশকাতুল মাসাবীহ, কিতাবুল ফাজায়েল ওয়াশ শামায়েল)। খুব খেয়াল করুন, এখানে বলা হয়েছে مكتوب (মাকতূব) অর্থাৎ লিপিবদ্ধ ছিলাম। হাদীস কিন্তু বলছেনা যে, রাসূল (সা.) স্বীয় জন্মের পূর্ব থেকেই নবুওয়ত লাভ করেছেন বরং বলছে, খাতামুন নাবিয়্যীন হিসেবে লিপিবদ্ধ ছিলাম (যা পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হবে)। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি :-
দলিল ১২ :
লিখক শিক্ষাবিদ ও গবেষক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী