ঈসা (আ:)-এর কবর কোথায় হবে?

0
ঈসা (আ:)-এর কবর কোথায় হবে?

হযরত ইমাম বুখারী (রহ:) এর আকীদা ঈসা (আ:)-এর কবর হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর রাওজাতে হবে!

ইমাম বুখারী (রহ:) আপনা কিতাব “তারীখে কাবীর” এর মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) এর বর্ণনায় একটি হাদীস নিয়ে এসেছেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) রেওয়ায়েত করেন: ليدفنن عيسى بن مريم مع النبي صلى الله عليه وسلم في بيته উচ্চারণঃ লাইয়ুদ ফানান্না ঈসা ইবনু মরিয়াম মা’আন নাবিয়্যি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফী বাইতিহি। অর্থাৎ “নিশ্চিত ভাবেই হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর কবর নবী করীম (সা:)-এর রাওজাতে হবে।” ‘তারীখে কাবীর’ কিতাবের স্ক্রিনশট লিখাটির ভেতর দেখা যেতে পারে। ইমাম বুখারী সংকলিত “তারীখে কাবীর (التاريخ الكبير للبخاري) খন্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ১৬৩; কিতাবটি সর্বমোট ৯ খন্ডে প্রকাশিত।

  • একটি প্রশ্নোত্তর : হাদীসটিতে ‘ফী বায়তিহি’ শব্দ উল্লেখ থাকার কারণে ঈসা (আ:)-এর কবর রাসূল (সা:)-এর রাওজা শরীফের অভ্যন্তরে তথা রাওজা শরীফ খুঁড়ে তার ভেতরেই হওয়ার কথা বুঝাতে চাইল কিনা? অথচ এমনটি চিন্তা করাও অসম্ভব!

উত্তর : হাদীসে “ফী বাইতিহি” (فى بيته) শব্দ থাকায় রাসূলের রাওজা শরিফ খুঁড়ে তার অভ্যন্তরে ঈসাকে দাফন করা বুঝাল কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কারণ আরবী বর্ণ “ফী” (فى) কখনো সখনো অভিধানে “অতি নিকটে” অর্থেও ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা ‘আন নামল’ এর একটি আয়াতে মূসা (আ:) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে: فَلَمَّا جَاءهَا نُودِيَ أَن بُورِكَ مَن فِي النَّارِ وَمَنْ حَوْلَهَا অর্থাৎ “অতপর সে (মূসা) যখন (আগুনের) কাছে পৌছলো, তখন তাঁকে (অদৃশ্য থেকে) আওয়াজ দেয়া হল, বরকতময় হোক সে, যিনি এই আগুনের মধ্যে (তথা নিকটে) রয়েছে, বরকতময় হোক তারা যারা এর আশেপাশে রয়েছে।” (সূরা আন নামল, আয়াত নং ৮)। বলাই বাহুল্য, সবাই জানেন যে, তূর পর্বতমালায় তখন মূসা (আ:) আগুনের অভ্যন্তরে ছিলেন না, বরং আগুনের অতি নিকটে বা কোনো এক পাশে-ই ছিলেন। (তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাজীঃ ২৪/১৮৩)। তদ্রূপ উক্ত হাদীসেও “ফী বাইতিহি” (فى بيته) বলতে রাওজা শরীফ খুঁড়ে তার অভ্যন্তরে—এই অর্থ নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হল, রাওজা শরীফের অতিব নিকটে। অতএব দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ থাকল না।

অন্য আরেকটি হাদীসে ‘ফী ক্ববরী‘ অর্থাৎ ঈসার কবর আমার কবরে হবে—একথার তাৎপর্য কী তা বিশিষ্ট যুগ-ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:)-এর কিতাব ‘মেরকাত‘ (কিতাবুল ফিতান)-এর মধ্যে ‘ফী মাক্ববিরাতী’ তথা আমার গোরস্তানে, এইরূপ শব্দে উল্লেখ আছে। স্ক্রিনশট থেকে দেখুন!

হাদীসের সনদ সম্পর্কিত তথ্য :- হাদীসটি সূত্রের বিচারে এতটা শক্তিশালী যে, এটি ভিন্ন ভিন্ন ৩টি সনদে বর্ণিত হয়েছে। ‘আল-মু’জামুল কাবীর‘ কিতাবের খন্ড নং ১৩ পৃষ্ঠা নং ১৫৯ এর মধ্যে একই অর্থবোধক আরেকটি হাদীস ভিন্ন আরেক সনদে পাওয়া যায়। সনদসহ হাদীসটি এইরকম :

ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻣُﺤَﻤَّﺪُ ﺑْﻦُ ﺃَﺣْﻤَﺪَ ﺍﻟﺘَّﺮْﻣِﺬِﻱُّ ﺛَﻨَﺎ ﺑَﻜْﺮُ ﺑْﻦُ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟْﻮَﻫَّﺎﺏِ ﺛَﻨَﺎ ﻋَﺒْﺪُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺑْﻦُ ﻧَﺎﻓِﻊٍ ﺍﻟﺼَّﺎﺋِﻎُ ﻋَﻦْ ﻋُﺜْﻤَﺎﻥَ ﺑْﻦ ﺍﻟﻀَّﺤَّﺎﻙِ ﻋَﻦْ ﻣُﺤَﻤَّﺪِ ﺑْﻦِ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﺑْﻦِ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺑْﻦِ ﺳَﻼﻡٍ ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻴﻪِ ﻋَﻦْ ﺟَﺪِّﻩِ ﻗَﺎﻝَ : ﻳُﺪْﻓَﻦُ ﻋِﻴﺴَﻰ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺍﻟﺴَّﻼﻡُ ﻣَﻊَ ﺭَﺳُﻮﻝِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻭَﺻَﺎﺣِﺒَﻴْﻪِ ، ﻓَﻴَﻜُﻮﻥُ ﻗَﺒْﺮُﻩُ ﺭَﺍﺑِﻌَﺎً অর্থাৎ ‘আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) বলেছেন, ঈসা (আ:)-কে রাসূল এবং তাঁর দুই সাহাবী (আবুবকর, উমর)’র সাথে (একই কবরস্থানে) দাফন করা হবে। ফলে (সেখানে) তাঁর কবরটি চতুর্থতম কবর হবে।’ এই হাদীস উপরে উল্লিখিত হাদীসটির বিশ্লেষণকারী এবং ‘রাওজা শরীফ খুঁড়ে তার অভ্যন্তরে দাফন করার কথা বুঝাল কিনা’ সেই সংশয়টুকুরও তিরোহিতকারী। কেননা এই হাদীসে সুস্পষ্টই ‘ক্বাবরুহু রাবি’আন’ (ঈসার কবরটি সেখানে চতুর্থতম কবর) বলেই উল্লেখ রয়েছে।

ইমাম তিরমিযী (রহ:) তিনি এটি স্বীয় “আল-জামে” গ্রন্থে আগের ২টি সনদের বাহিরে ভিন্ন আরেক সনদেও উল্লেখ করে বলেছেন, এর সনদ হাসান এবং গরীব তথা সনদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণনাকারী অনূর্ধ্ব একজন। ইমাম তিরমিযী (রহ:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি এইরকম : ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺯَﻳْﺪُ ﺑْﻦُ ﺃَﺧْﺰَﻡَ ﺍﻟﻄَّﺎﺋِﻲُّ ﺍﻟْﺒَﺼْﺮِﻱُّ ﺛَﻨَﺎ ﺃَﺑُﻮ ﻗُﺘَﻴْﺒَﺔَ ﺳَﻠْﻢُ ﺑْﻦُ ﻗُﺘَﻴْﺒَﺔَ ﺣَﺪَّﺛَﻨِﻲ ﺃَﺑُﻮ ﻣَﻮْﺩُﻭﺩٍ ﺍﻟْﻤَﺪَﻧِﻲُّ ﺛَﻨَﺎ ﻋُﺜْﻤَﺎﻥُ ﺑْﻦُ ﺍﻟﻀَّﺤَّﺎﻙِ ﻋَﻦْ ﻣُﺤَﻤَّﺪِ ﺑْﻦِ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﺑْﻦِ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺑْﻦِ ﺳَﻼﻡٍ ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻴﻪِ ﻋَﻦْ ﺟَﺪِّﻩِ ﻗَﺎﻝَ : ﻣَﻜْﺘُﻮﺏٌ ﻓِﻲ ﺍﻟﺘَّﻮْﺭَﺍﺓِ ﺻِﻔَﺔُ ﻣُﺤَﻤَّﺪٍ ، ﻭَﺻِﻔَﺔُ ﻋِﻴﺴَﻰ ﺑْﻦِ ﻣَﺮْﻳَﻢَ ﻳُﺪْﻓَﻦُ ﻣَﻌَﻪُ . ﻓَﻘَﺎﻝَ ﺃَﺑُﻮ ﻣَﻮْﺩُﻭﺩٍ : ﻭَﻗَﺪْ ﺑَﻘِﻲَ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺒَﻴْﺖِ ﻣَﻮْﺿِﻊُ ﻗَﺒْﺮٍ . ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺑُﻮ ﻋِﻴﺴَﻰ : ﻫَﺬَﺍ ﺣَﺪِﻳﺚٌ ﺣَﺴَﻦٌ ﻏَﺮِﻳﺐٌ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) বলেছেন, তাওরাতের মধ্যে মুহাম্মদ (সা:)-এর গুণাগুণ লিপিবদ্ধ রয়েছে আর ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর গুণটি (এভাবে বর্ণিত আছে যে তা) হল, তাঁকে মুহাম্মদ (সা:)-এর (রাওজা শরীফের) সাথে দাফন করা হবে। অতপর (বর্ণনাকারী) আবু মওদূদ বলেন, (রাসূলের) রাওজাতে একটি কবরের স্থান (এখনও) খালি রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রহ:) বলেছেন, এই হাদীস হাসান (সহীহ) এবং গরীব (তথা সূত্রের কোনো স্তরে রাবীর সংখ্যা অনূর্ধ্ব একজন)।”

হযরত আয়েশা (রা:) হতেও বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন : يا رسول الله انى أرى اعيش من بعدك فتأذن لى ان ادفن إلى جنبك فقال و إنى لك بذالك الموضع؟ ما فيه إلا موضع قبرى و قبر أبى بكر و عمر و عيسى بن مريم অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল! আমার ধারণা যে, আমি আপনার পরেও জীবিত থাকব! তাই আপনার কবরের পাশেই আমি দাফন হবার কোনো অনুমতি আছে কি? উত্তরে রাসূল (সা:) বললেন, তুমি এমন একটি স্থানে দাফন কিভাবে হতে পার যেখানে আমার, আবুবকর, উমর আর ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) এর কবর থাকবে! (বর্ণনাকারী উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা, কিতাব : কাঞ্জুল উম্মাল খন্ড নং ৭ পৃষ্ঠা নং ২৬৮)।

পরিশেষঃ মির্যা কাদিয়ানীর নিকটও মাননীয় মুজাদ্দিদ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ফাতহুল বারী” কিতাবের ৭ম খন্ডের ৮২ নং পৃষ্ঠায় ঈসা (আঃ) এর কবর রাসূল (সা:)-এর রাওজা শরীফে হওয়া সম্পর্কে লিখেছেন : ﺇﻥ قبور الثلاثة ﻓﻲ ﺻﻔﺔ ﺑﻴﺖ ﻋﺎﺋﺸﺔ، ﻭﻫﻨﺎﻙ ﻣﻮﺿﻊ ﻗﺒﺮ ﻳُﺪﻓﻦ ﻓﻴﻪ ﻋﻴﺴﻰ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺴﻼﻡ অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রা:)-এর ঘরের শামিয়ানায় (তথা রাসূলের রাওজাতে) তিনটি কবর বিদ্যমান আছে। সেখানে আরেকটি কবরের স্থান (অবশিষ্ট) আছে যেখানে ঈসা (আ:) দাফন হবেন।

বলে রাখতে চাই, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:)-এর উক্ত ব্যাখ্যাকে ‘আল-মু’জামুল কাবীর‘ এর একটি হাদীসের খন্ডাংশ জোরালোভাবে সমর্থন করে। কারণ সেখানে লেখা আছে ﻓَﻴَﻜُﻮﻥُ ﻗَﺒْﺮُﻩُ ﺭَﺍﺑِﻌَﺎً অর্থাৎ ‘রাওজাতে ঈসা’র কবরটি চতুর্থতম হবে।‘

কাদিয়ানীদের অর্বাচীন যুক্তির কারণ : কাদিয়ানীরা হাদীসগুলো অমান্য করার অসৎ উদ্দেশ্যে নানা অর্বাচীন যুক্তি আর কাসুন্দির পিছু নিয়ে থাকে। তারা হাদীসগুলোর প্রকৃত মর্মার্থ ঘুরে দিতে জঘন্যতম ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। ‘ঈসা (আঃ)-কে রাসূলের রাওজাতে দাফন করলে নাকি রাওজা শরীফ খুঁড়তে হবে! আর তাই হাদীসগুলো বাদ দিতে হবে, এই হল কাদিয়ানীদের অর্বাচীন যুক্তি ! মূলত তাদের এই সমস্ত হাস্যকর কথাবার্তা মির্যা কাদিয়ানীর বই হামামাতুল বুশরা সহ অন্যান্য বই-পুস্তকেরই হান্ড্রেড পার্সেন্ট চর্বিতচর্বন। এই সমস্ত নিকৃষ্ট বোবা শয়তানদের জন্য দুঃসংবাদ যে, তাদের সেসব শয়তানী যুক্তি অপরাপর হাদীসগুলো আর যুগ ইমামদের বক্তব্যের আলোকে পুরোপুরি তিরোহিত হয়ে গেছে। তাই দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, ইতিপূর্বে যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদগণের আকীদা ছিল পুনঃ আগমনকারী ঈসা ইবনে মরিয়ম বলতে বনী ইসরাইলের সেই ঈসা-ই উদ্দেশ্য যিনি অচিরেই আগমন করবেন। অতপর মৃত্যুবরণ করবেন এবং রাসূল (সা:)-এর রাওজাতে দাফন হবেন। সেখানে তাঁর কবরটি হবে চতুর্থতম। জ্ঞানীদের সত্যটা বুঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। সংক্ষেপে এ পর্যন্ত। ওয়াসসালাম।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here