প্রশ্নকর্তা : ঈসা (আ:) যদি আবার এসে নবী না হন (তথা নবুওয়তের দায়িত্বে না থাকেন) তাহলে মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে তাঁকে ‘নাবিউল্লাহ’ (আল্লাহর নবী) সম্বোধন করা হয়েছে কেন?
উত্তরদাতা : এর উত্তর হল, আগত ঈসা কোনো রূপক ঈসা নন, বরং বনী ইসরায়েলের জন্য ইতিপূর্বে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন শেষ যুগে তিনি-ই পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, এ কথাটি সুস্পষ্ট করে দিতেই হাদীসে “নাবিউল্লাহ” বলে ইংগিত দেয়া হয়েছে। যাতে রূপক ঈসা দাবীদারদের উদ্দেশ্যমূলক ও বিকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে প্রকৃত ঈসাকে বাদ দিয়ে কথিত রূপক ঈসার জালে বন্দী হয়ে না যায়!
আরেকটু বুঝিয়ে বলছি, মনে করুন, সাবেক দুই-একজন চেয়ারম্যান যারা বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলেও জীবিত, কিন্তু চেয়াম্যানের দায়িত্বে নেই। আর লোকজন তাদেরকেও চেয়ারম্যান শব্দে সম্বোধন করার অর্থ কি এই যে, তারাও নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান? অবশ্যই না। এবার একটি হাদীস দিয়ে বুঝিয়ে বলছি! কেয়ামত দিবসেও হযরত ঈসা (আ:)-কে ‘ইয়া ঈসা আন্তা রাসূলুল্লাহ’ (يا عيسى انت رسول الله) অর্থাৎ হে ঈসা আপনি আল্লাহর রাসূল, এইভাবে সম্বোধিত হবেন। (ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, কিতাবুর রিক্বাক, হাদীস নং ৬১৯৭)। এখন বুঝে থাকলে বলুন, ঈসা (আ:)-কে বিচার দিবসে ‘রাসূলুল্লাহ’ বলা হবে বলে তিনি কি সেই সময় পুনরায় রেসালতপ্রাপ্ত হবেন? অবশ্যই না। অনুরূপ আগমনকারী ঈসাকে ‘নাবিউল্লাহ’ বলা হয়েছে বলে তিনিও পুনরায় নবুওয়তের দায়িত্বে সমাসীন হবেন, বুঝায়নি।
মজার ব্যাপার হল, আগত ঈসা সম্পর্কে সহীহ বুখারীর (কিতাবুল আম্বিয়া অধ্যায়) হাদীসে রাসূল (সা.) ভবিষ্যৎবাণীতে কসম বাক্য সহকারে و الذى نفسى بيده ليوشكن ان ينزل فيكم ابن مريم (শপথ সে সত্তার যাঁর মুঠোয় আমার প্রাণ নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে মরিয়ম পুত্র নাযিল হবেন) শব্দচয়নে সংবাদ দেয়ার উল্লেখ রয়েছে। জেনে আশ্চর্য হবেন যে, মির্যা গোলাম আহমদের ভাষ্যমতে ‘যেসব হাদীসে কসম বাক্য সহ কোনো বিষয়ে সংবাদ দেয়া হবে সেটি কখনো রূপক অর্থে উদ্দেশ্য হবেনা, বরং প্রকৃত অর্থেই হবে।’ (মির্যা কাদিয়ানী রচিত, হামামাতুল বুশরা, বাংলা পৃ-২৭ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং মির্যা গোলাম আহমদের কথা অনুসারেও হাদীসে উল্লিখিত ‘ইবনু মরিয়ম’ হতে রূপক ইবনু মরিয়ম উদ্দেশ্য হওয়ার কথা নয়! সত্যানুরাগী কাদিয়ানীদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে!
একটি সংশয় নিরসন :
মুসলিম শরীফের ‘كتاب الفتن و اشراط الساعة’ অধ্যায়ে ঈসা নাবিউল্লাহ শীর্ষক হাদীসটি প্রায় দুই পৃষ্ঠাব্যাপী। হাদীসটিতে হযরত ঈসা (আ:) ফেরেশতার মাধ্যমে দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে শুভ্র মিনারার নিকটে অবতরণ করার কথাও উল্লেখ আছে। তিনি ইয়াজুজ আর মাজুজ গোষ্ঠীর অনিষ্টতা থেকে আত্মরক্ষার্থে আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী তথা ইলহাম প্রাপ্ত হয়ে আপনা সঙ্গী সাথীদের সাথে নিয়ে তূর পর্বতমালার চূড়ায় উঠে যাবেন মর্মেও উল্লেখ আছে।
ফলে মহাসমুদ্র হতে একফোঁটা পানি তুলে নেয়ার মতই উক্ত সম্পূর্ণ হাদীসটির একটি মাত্র শব্দ ‘নাবিউল্লাহ’-এর আশ্রয় নিয়ে কাদিয়ানীরা মির্যা গোলাম আহমদের ‘নবী’ দাবীর বৈধতা খোঁজার চেষ্টা করে, যেহেতু সে নিজেকে প্রতিশ্রুত মসীহ ঈসা দাবীও করেছে। অথচ তার মসীহ ঈসা দাবীটাই একটি উদ্ভট দাবী। ইসলামে কথিত রূপক মসীহ ঈসার কোনো ধারণাই নেই। মজার ব্যাপার হল, সে নিজেও লিখেছে যে, ‘আমার মসীহ দাবীর ভিত্তি কোনো হাদীস নয়।’ (রূহানী খাযায়েন ১৯/১৪০)। মুসলিম শরীফের নাবিউল্লাহ শীর্ষক সম্পূর্ণ হাদীসটি অর্থ সহ এখানে।
ওহী শব্দের আভিধানিক অর্থগুলো সম্পর্কে :
ওহী শব্দটি কখনো সখনো ‘ইলহাম’ (আল্লাহর পক্ষ হতে অন্তরে কোনো বিষয়ে ইলক্বা বা প্রক্ষেপণ) অর্থেও হয়ে থাকে। এধরণের ইলহাম আ’ম বা সাধারণ, নবুওয়তের দায়িত্বে সমাসীন নন—এমন পুরুষদের ক্ষেত্রে তো বটে; এমনকি আল্লাহ’র যে কোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। (দেখুন পবিত্র কুরআন ১৬:৬৮; ২০:৩৮; ২৮:০৭)। মজার ব্যাপার, মির্যা কাদিয়ানী তার ‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ (বাংলা) বইয়ের ৬২ নং পৃষ্ঠায় তদীয় শিষ্য সাহেবজাদা আব্দুল লতিফ ওহীর ভিত্তিতেও কথা বলতেন বলেই লিখে গেছেন (স্ক্রিনশট দেখুন)। কাদিয়ানীদের জিজ্ঞেস করা উচিত যে, তো এখানে এই ‘ওহী’ বলতে কী উদ্দেশ্য? নিশ্চয়ই ‘ওহীয়ে নবুওয়ত’ উদ্দেশ্য নয়! সুতরাং উক্ত হাদীসেও ঈসা (আ:) এর প্রতি যে ‘ওহী’ হবে বলা হয়েছে তদ্দ্বারাও ‘ওহীয়ে নবুওয়ত’ (الوحى النبوة) উদ্দেশ্য নয়, বরং ‘ওহীয়ে বেলায়ত’ (الوحى الولايت) তথা ইলহাম-ই উদ্দেশ্য।
মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়ত দাবী তারই বই থেকে :
কে জানি প্রশ্ন করেছিল যে, ওহীর আরেক অর্থ যেহেতু ইলহাম (অন্তরে প্রক্ষেপণ) সেহেতু মির্যা গোলাম আহমদ এর ওহী দাবীর ফলে তিনিও কিজন্য সমালোচনার পাত্র হবেন এবং ইসলাম থেকে খারিজ বলে গণ্য হবেন? এর উত্তর হল, মির্যা গোলাম আহমদ এর ওহী দাবী সাধারণ ওহীর পর্যায়ভুক্ত ছিলনা, বরং ওহীয়ে নবুওয়তেরই পর্যায়ভুক্ত ছিল। তাই তার ওহী দাবী আর অন্যান্য সাধারণ ওহী (ইলহাম) দুটো এক নয়। যেমন সে এক জায়গায় লিখেছে, ‘মোটকথা আমি মুহাম্মদ ও আহমদ (সা.) হওয়ার কারণে আমার নবুওয়ত ও রেসালত লাভ হয়েছে, স্বকীয়তায় নয়, ফানাফির রসূল হয়ে…।’ (দেখুন, একটি ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নং ৫)।
ঈসা (আ:) এর প্রতি ওহী করা সম্পর্কে আরেকটু খোলাসা :
কাদিয়ানীদের পক্ষ হতে কখনো সখনো এধরণের প্রশ্নও করা হয় যে, ঈসা (আ:) দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর যদি তিনি পুনরায় নবী না হন, তবে কিজন্য তাঁর প্রতি ওহী করার কথা উল্লেখ আছে? এর জবাব হচ্ছে, আপনি হয়ত “ওহী” শব্দের আক্ষরিক অর্থ আরো কী কী আছে সে সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই রাখেন না। হাদীসটিতে এ মর্মে বাক্যটি কিভাবে আছে লক্ষ্য করুন, إِذْ أَوْحَى اللَّهُ إلى عِيسَى (ইয আওহাল্লাহু ইলা ঈসা) অর্থাৎ…. ইত্যবসরে আল্লাহতালা ঈসার প্রতি ওহী করবেন….। এখানে ক্রিয়াপদ “আওহা” (أوحى) এসেছে। এর বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে। ‘ওহী করা’ কিংবা ‘ইলহাম বা ইলক্বা (অন্তরে প্রক্ষেপণ)‘ ইত্যাদী সবই তার অর্থ বহন করে।
- এই সম্পর্কে আমার নিজের একটি ভিডিও দেখুন, হাদীসে “ঈসা নাবিউল্লাহ” চার চার বার এসেছে, এইরূপ জালিয়াতিমূলক বয়ান দেয়ায় কাদিয়ানী আমীরের ইজ্জত শেষ! ভিডিও
তবে হাদীসটিতে শেষোক্ত অর্থই ধর্তব্য হবে এ জন্যই যে, এখানে প্রথমোক্ত অর্থটি উদ্দেশ্য নেয়া পূর্ব থেকে পরিত্যাজ্য। কারণ প্রতীক্ষিত ঈসা (আঃ) ‘নবুওতি ওহী‘র দ্বার ভাঙ্গতে আসবেন না, বরং শরীয়তে মুহাম্মদীর তাবলীগ করতে আসবেন। হাদীসটির অবিকল “আওহা” শব্দটি পবিত্র কুরআনেরও বহু স্থানে গায়রে নবীদের জন্য এসেছে যার একটিতেও তদ্দ্বারা “নবুওয়তি-ওহী” অর্থ কেউ নেয়নি। এমন কি কাদিয়ানী সম্প্রদায়ও নেয় না। যেমন পবিত্র কুরআনের সূরা আন নাহল এর ৬৮ নং আয়াত দেখুন। সেখানে মৌমাছির প্রতিও ওহী পাঠানোর কথা আছে। তো এর দ্বারা আপনি শেষোক্ত অর্থ বাদ দিয়ে কি প্রথমোক্ত অর্থ নেবেন? মৌমাছিকেও “নবী” বানাবেন? মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, اَوۡحٰی رَبُّکَ اِلَی النَّحۡلِ اَنِ اتَّخِذِیۡ مِنَ الۡجِبَالِ بُیُوۡتًا وَّ مِنَ الشَّجَرِ وَ مِمَّا یَعۡرِشُوۡنَ অর্থ- ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে ওহী (প্রত্যাদেশ) করেছেন যে, তুমি গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।’ (সূরা আন নাহল ৬৮)। তাফসীরের কিতাবে আয়াতটির ওহী (وحي) শব্দকে ইলহাম অর্থে ব্যাখ্যা দিয়ে লিখা আছে যে, এখানে ওহী থেকে ‘ইলহাম’ (অন্তরে প্রক্ষেপণ) বা এমন জ্ঞান-বুদ্ধি যা নিজ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য প্রত্যেক জীবকে দান করা হয়েছে। (আহসানুল বয়ান)।
এভাবে আরো দেখুন সূরা ক্বাছাছ, আয়াত নাম্বার ৭ এবং সূরা ত্বাহা, আয়াত নাম্বার ৩৮; পবিত্র কুরআন খুলে দেখুন সবখানে “আওহা” শব্দ পাবেন। কিন্তু সবাই এ থেকে অর্থ নিয়েছেন “ইলহাম করেছেন”। সুতরাং উক্ত হাদীসেও এ একই অর্থ ধরে নিতে হবে। তখন আর কোনো সন্দেহ জাগবেনা। ওয়াল্লাহু আ’লাম। আল্লাহ সবাইকে ভ্রান্তি থেকে বের করে শেষনবী মুহাম্মদে আরাবীর উম্মতে শামিল হওয়ার তাওফিক দিন।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক