লেখরাম সম্পর্কে মির্যার ভবিষ্যৎবাণী যেসব শব্দচয়নে ছিল!
মির্যা কাদিয়ানীর ভবিষ্যৎবাণীতে পণ্ডিত লেখরাম (پنڈت لیکھرام) সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণীর শব্দচয়ন কীরকম ছিল? লেখরাম কবে এবং কিভাবে হত্যা হল? তার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মির্যায়ী ভবিষ্যৎবাণী পূর্ণতা পেয়েছে, এমন দাবী করা কেন ঠিক হবেনা? খারেক্বে আদত বলতে কী বুঝায়? ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আজকের এই লিখাটি আপনার জন্য!
আর্য সমাজের জনপ্রিয় ধর্মগুরু ও পণ্ডিত লেখরাম সম্পর্কে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ২০-০২-১৮৯৩ ইং ভবিষ্যৎবাণী করেছিল এভাবে যে, اگر اس شخص پر چھ برس کے عرصہ میںؔ آج کی تاریخ سے کوئی ایسا عذاب نازل نہ ہوا جو معمولی تکلیفوں سے نرالا اور خارق عادت اور اپنے اندر الٰہی ہیبت رکھتا ہو تو سمجھو کہ میں خدا تعالیٰ کی طرف سے نہیں অর্থাৎ এই ব্যক্তির উপর আজকের এই তারিখ থেকে আগামী ছয় বছরের মধ্যে যদি এমন কোনো আজাব নাযিল না হয়, যেটি সাধারণ যে কোনো শাস্তির উর্ধ্বে ও নজিরবিহীন (রহস্যময়) হবে আর তার অভ্যন্তরে ইলাহি ভীতি সঞ্চার করবে, তাহলে জেনে রেখো আমি খোদার পক্ষ হতে প্রেরিত নই। (রূহানী খাযায়েন ৫/৬৫০-৫১)। কিন্তু লেখরামের মৃত্যু হয় মির্যার এক দুর্বৃত্ত মুরিদের ছুরিকাঘাতে। (আর্যদের লেখিত পুস্তক হতেও একথাই প্রমাণিত)। মির্যার কথা ছিল নজিরবিহীন এমন এক আজাব তার উপর নাযিল হওয়া যেটি তার অভ্যন্তরে খোদায়ী ভীতি সঞ্চার করবে, কিন্তু তা সেভাবে হয়নি। কারণ দুনিয়ায় ছুরিকাঘাতে অসংখ্য লোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। ফলে এইরূপ মৃত্যু খারেক্বে আদত তথা নজিরবিহীন-এর পর্যায় পড়েনা। সুতরাং মির্যা কাদিয়ানীর ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি:–
নাতিদীর্ঘ ঘটনা : পণ্ডিত লেখরাম আর মির্যা কাদিয়ানীর মাঝে প্রথমে কলমি আন্দাজে অনেক তর্কবিতর্ক চলেছিল। দুইপক্ষই একে অন্যের জাতগুষ্ঠি পর্যন্ত উদ্ধার করে ছাড়ে! অকথ্য গালিগালাজ কারে কয়। কারো থেকে কেউ কোনো অংশে কম ছিল না। মনের জমানো রাগ-ক্ষোভ প্রশমিত করতে যাইচ্ছেতাই লিখে যেত। মির্যা সাহেব তো একবার আর্যদের ইশ্বর সম্পর্কে বেদ-এর নাম ভেঙ্গে এমন এক কথাও লিখে ফেলে, যার ফলে পাপিষ্ঠ পণ্ডিত লেখরাম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর পবিত্র সত্তায় উপর্যুপরি আঘাত হানতে শুরু করে। উম্মুল মুমিনীনদের নিয়েও অশালীন মন্তব্য করতে শুরু করে। আসলে এ সমস্ত দুর্ঘটনার জন্য মির্যাই দায়ী। সেই বরং এগুলোর জন্য তাকে প্ররোচিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে ইসলামের নবী এবং উম্মুল মুমিনীনদের শানে আর্য সমাজের পণ্ডিতরা আরও যতসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছিলো তার সবকয়টিই পণ্ডিত লেখরামের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে ছিল। অথচ আর্যগণ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারত যে, ইসলাম আর কাদিয়ানীজম দুটো পুরোপুরি আলাদা জিনিস! কাজেই মির্যাকে কাউন্টার দিতে গিয়ে ইসলামকে আক্রমণ করা তাদের বোকামী ছিল। যাইহোক, আর্য সমাজের ইশ্বর সম্পর্কে ‘বেদ‘ এর নাম ভেঙ্গে মির্যার মিথ্যাচারমূলক উক্তিটি ছিল এইরকম – پرمیشر ناف سے دس انگلی نیچے ہے. سمجھنے والے سمجھ لی অর্থ- পরমেশ্বর নাভীর দশ আঙুল নিচে। জ্ঞানীরা বুঝে নিও! (চশমায়ে মা’আরেফত, রূহানী খাযায়েন ২৩/১১৪)। ছিঃ! একটা মানুষ কত নোংরা মনের অধিকারী হলে অন্য ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে এভাবে আঘাত দিতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে!
পণ্ডিত লেখরাম সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর ভবিষ্যৎবাণীর ভবিষ্যৎ :
- পণ্ডিত লেখরাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট আছে, মির্যা কাদিয়ানী তারই একজন অনুগত ঘাতক-দুর্বৃত্ত মুরিদকে দিয়ে তাকে হত্যা করিয়েছিল। পণ্ডিত লেখরাম ঐ ঘাতকের হাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন ৭ই-মার্চ ১৮৯৭ সালে। ইতিহাস একটু দীর্ঘ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, মির্যা কাদিয়ানী ১৮৮৪ সালের দিকে ৪ খণ্ডে ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ নাম দিয়ে বই লিখেন। সেখানে আর্য সমাজের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয় এবং যে এগুলো খণ্ডন করতে পারবে তাকে ১০ হাজার রুপি পুরষ্কার দেয়ার ঘোষণা করা হয়। পণ্ডিত লেখরাম সে সময়কার একজন আর্য সমাজের জনপ্রিয় পণ্ডিত, লিখক ও বিতার্কিক ছিল। আনুমানিক ৩২টি বই রচনা করে। সে একাধারে উর্দূ, আরবী এবং ফার্সী ভাষায়ও এক সমানে বলতে ও লিখতে পারত। সে মির্যার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এবং ‘তাকজীবে বারাহীনে আহমদীয়া‘ (বারাহীনে আহমদীয়ার মিথ্যাচার) বই লিখে মির্যাকে খণ্ডন করে। এই ঘটনায় মির্যা কাদিয়ানী অত্যাধিক রেগে আগুন হয়ে যান। তিনি আর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে গেলেন না। সিদ্ধান্ত করলেন লেখরাম সম্পর্কে মৃত্যুর ভবিষ্যৎবাণী করবেন। অথচ মানুষের হায়াত মউতের মালিক হলেন আল্লাহ, তিনি কখনো কাউকে বলে রাখেন না যে, কার মৃত্যু কখন এবং কিভাবে হবে? আমার বুঝে আসেনা, মির্যা কাদিয়ানী মানুষের হায়াত মউতের ভবিষ্যৎবাণী করার এই খোদায়ী ক্ষমতা পেলেন কোথা থেকে! অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কেও আল্লাহ এই ক্ষমতা এক মুহূর্তের জন্যও দেননি। যাইহোক, পণ্ডিত লেখরাম সম্পর্কে ১৮৯৩ সালের ২০ই ফেব্রুয়ারী মির্যার ভবিষ্যৎবাণী করা হয়ে গেল! আগামী ছয় বছরের মধ্যে কোনো এক ঈদের কাছাকাছি সময় লেখরামের মৃত্যু হয়ে যাবে। তবে সেই মৃত্যু خارق عادت [খারেক্বে আদত] (অর্থাৎ নজিরবিহীন ও রহস্যময়/mysterious) হবে। (আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম, রূহানী খাযায়েন ৫/৬৫০-৫১)। ইতিহাস সাক্ষী, মির্যা কাদিয়ানী যখন দেখল, ১৮৯৭ সাল-ও গত হয়ে যাচ্ছে। পণ্ডিত লেখরামের মৃত্যুর আলটিমেটাম শেষের দিকে। তবু তার খারেক্বে আদত কোনো মৃত্যু হচ্ছেনা। সে বছরই একজন দুর্বৃত্তকে দিয়ে তাকে ছুরিকাঘাতে চোরাগোপ্তা হত্যার ষড়যন্ত্র করা হল। মির্যা কাদিয়ানীকে সে সময় লেখরামের হত্যা মামলার প্রধান আসামীও করা হয়েছিল। কিন্তু সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সাথে তার জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় শেষমেশ ব্রিটিশ আদালত তাকে জামিন দিয়ে দেয়। এখন নিরপেক্ষভাবে যদি কোনো একজন আহমদীও ‘খারেক্বে আদত’ নিয়মে লেখরামের ধ্বংস সম্পর্কে মির্যার কৃত ভবিষ্যৎবাণীর বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে বলতে বাধ্য হবেন যে, দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে লেখরামের মৃত্যু হয়ে যাওয়ার সাথে মির্যা কাদিয়ানীর ভবিষ্যৎবাণী পূর্ণতা পাওয়ার কানাকড়ি সম্পর্কও নেই। এবার ‘খারেক্বে আদত’ বলতে কী বুঝায়, জেনে নিন! মির্যা কাদিয়ানী সাহেব ‘খারেক্বে আদত’ (خارق عادت) এর সংজ্ঞায় লিখেছেন, ظاہر ہے کہ جس امر کی کوئی نظیر نہ پائی جائے اسی کو دوسرے لفظوں میں خارق عادت بھی کہتے ہیں. অর্থাৎ প্রকাশ থাকে যে, যে ঘটনা নজিরবিহীন তাকে অন্য শব্দে খারেক্বে আদতও বলা হয়। (সুরমা চশমায়ে আরিয়া, রূহানী খাযায়েন ২/৬৭)। তিনি আরেক জায়গায় লিখেন, خارق عادت اسی کو تو کہتے ہیں کہ اس کی نظیر دنیا میں نہ پائی جائے অর্থ, খারেক্বে আদত বলা হয় যার কোনো দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। (হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/২০৪)।
কাজেই এখন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, পণ্ডিত লেখরাম তো ঘাতকের হাতে চোরাগোপ্তা হত্যা হল, خارق عادت [খারেক্বে আদত] বা নজিরবিহীন মৃত্যু হল না! উপরন্তু যে খুন-খারাপি মির্যাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করল, খুনের হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে হল; সেই হত্যাকাণ্ড কিভাবে মির্যার ভবিষ্যৎবাণীর পূর্ণতার নিদর্শন হতে পারে? এইভাবে দুর্বৃত্ত দিয়ে চোরাগোপ্তা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যে কেউই তো নিজের পক্ষে হুবহু মির্যার মত একটি ‘নিদর্শন’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তাই নয় কি? সারা দুনিয়া যেই কর্মের জন্য মির্যাকে পরোক্ষ একজন খুনি বলছে সেই একই কর্মকে তার অনুসারীরা খোদার নিদর্শন বলতে চাইলে বলুক! আচিরেই আল্লাহর সাথে তাদের বুঝাপড়া হবে!
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী