গাদীরে খুম কী? শীয়াদের না জানা এমন কিছু তথ্য
প্রশ্নঃ রাসূল (সা.) সত্যই কি গাদীরে খুমে হযরত আলী (রা.)-কে বেলায়াত দিয়ে গিয়েছেন?
উত্তরঃ বিগত ১৪শত বছর ধরে শীয়া সম্প্রদায় এই একখানা হাদীস দেখিয়ে আহলে সুন্নাহর অনুসারীদের ভুল বুঝিয়ে আসছে। এতে সাধারণ মানুষ তো বটে বরং অনেক বড় বড় শিক্ষিতরাও ভটকে যান। আজকের এই লিখাটি পড়া দ্বারা শীয়া সম্প্রদায়ের মধ্যেও টনক নড়বে। তাদের কাছেও মনে হবে যে, হায় হায় এতকাল কোন ঘোর অন্ধকারে ছিলাম!
প্রিয় ভাই ও বোনেরা! প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে, আহলুস সুন্নাহর হাদীসগ্রন্থেও এমনি একটি হাদীস পাওয়া যায়, যেখানে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,
“আমি (নবী মুহাম্মদ সা.) যার মওলা, আলী তাঁর মওলা।”
হাদীসের মানঃ
ইমাম তিরমিজি : সহীহ ও হাসান।
শায়খ আলবানী : সহীহ।
ইমাম যাহাবী : সহীহ।
ইমাম যায়লা’ঈ : দুর্বল।
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ : দুর্বল।
এই কথাটি তিনি বলেছিলেন ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে। এই একটি মাত্র হাদীসকে কেন্দ্র করে শীয়াগণ দাবী করে থাকেন যে,
ঐ দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকি মওলা আলী (রা.)-কে তাঁর পরবর্তী খলীফা নিযুক্ত করে গিয়েছেন।
অথচ ঐ হাদীসের প্রাধান্যযোগ্য একটি তাৎপর্য মুহাদ্দিসগণ থেকে এভাবে উল্লেখ আছে যে,
مَنْ كُنْت أُحِبُّهُ فِعْلِيٌّ يُحِبُّهُ
অর্থ- “আমার (অর্থাৎ রাসূল সা.-এর) কর্ম বা কার্যকলাপ যার নিকট প্রিয় সেই তাঁকে (অর্থাৎ আলীকে) ভালোবাসে।” (তুহফাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিজি)।
যাইহোক, এই হাদীস দিয়ে শীয়ারা আরও প্রমাণ করতে যান যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর নাকি সাহাবীগণ মুরতাদ হয়ে যান। (নাউযুবিল্লাহ)। আর ক্ষমতার লোভে হযরত আবুবকর, উমর এবং উসমান (رضوان الله عليهم أجمعين)-গণ মওলা আলীর ক্ষমতা জবর দখল করেন। নাউযুবিল্লাহ।
গাদীরে খুম এর ঘটনাঃ
মুসলিম উম্মাহা ঐতিহাসিক ‘বিদায় হজ্জ’ থেকে ফেরার পথে গাদীর খুমের ঘটনাটি সংঘটিত হয়। শীয়া-বিশ্বাসমতে, একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পরিবেশনের জন্য রাসূল (সা.)-এর নিকট কুরআনের একটি আয়াত নাযিল হয়। ফলে সবাইকে একত্র করে তিনি একটি দীর্ঘ ভাষণ দেন। ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি সেই বিখ্যাত বিবৃতি প্রদান করেনঃ “মান কুনতু মওলাহু ফা-আলীউন মওলাহু” ((مَنْ کُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلاَهُ)) অর্থাৎ, আমি যার মওলা ছিলাম, আলীও তার মওলা। শীয়ারা এই বাক্যকে রাসূল (সা.) কর্তৃক আলীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনয়ন বলে ব্যাখ্যা করেন, যদিও সুন্নিরা এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। সংক্ষেপে।
কিন্তু সত্য হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন হযরত আলী (রা.)-কে কোনো প্রকার জাহেরী অথবা বাতেনী কোনো প্রকার বেলায়াত বা খেলাফত প্রদান করার প্রমাণ নেই। বলে রাখা দরকার যে, উল্লিখিত হাদীসটির ন্যায় এমন কোনো একটা রেওয়ায়েতও শীয়া সম্প্রদায় দেখাতে পারেনা যেটি নিচের ৩টি শর্তের আওতায় থাকবে। যথা,
১. হাদীসটির অনুরূপ শব্দচয়নে।
২. শীয়া সোর্স থেকে বিশ্বস্ত রাবীদের সত্যায়িত সনদে।
৩. শীয়াদের নির্ভরযোগ্য কিতাবে।
এভাবেই এই হাদীসখানা তাদের নিকট পুরোপুরি অনুপস্থিত। আর যা আছে, তাতে এই তিন শর্তের কোনো না কোনো একটা অবশ্যই অনুপস্থিত। এজন্যেই তারা বারবার আহলুস সুন্নাহর কিতাব থেকে হাদীসখানা পেশ করেন। অথচ তারা আহলুস সুন্নাহর সকল হাদীসকেই অস্বীকার করে থাকেন। প্রিয় ভাই আমার!
এবার একটা হাদীস শুনুন, মওলা আলী (রা.) কী বলেছেন,
عَنْ مَنْصُورٍ، عَنْ رِبْعِيِّ بْنِ حِرَاشٍ، أَنَّهُ سَمِعَ عَلِيًّا رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يَخْطُبُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَكْذِبُوا عَلَيَّ، فَإِنَّهُ مَنْ يَكْذِبْ عَلَيَّ يَلِجِ النَّارَ
অর্থ, মওলা আলী (রা.) যখন খুতবাহ প্রদান করতেন, তখন তিনি বলতেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা আমার উপর মিথ্যারোপ করো না। আমি যা বলি নি, তা আমার নামে প্রচার করো না। সন্দেহাতীত ভাবে সে জাহান্নামে যাবে যে আমার উপর মিথ্যারোপ করলো।”
(সূত্রঃ সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বরঃ ০২)।
উল্লিখিত হাদীস পরিষ্কার আমাদেরকে সতর্ক করছে যে, নবীজিকে নিয়ে মিথ্যাচার করা যাবে না। তিনি তাঁকে (আলী) এরূপ কোনো জাহেরি অথবা বাতেনী বেলায়াত প্রদান করেন নি। কেউ যদি বলে, করেছেন; তাহলে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে। তা না হলে, সে আল্লাহর নবীর উপর মিথ্যারোপ করলো। এবার দেখুন, প্রমাণ বা উপযুক্ত দলিল কতখানি গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস! মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে,
وحَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ عَبَّادٍ، وَسَعِيدُ بْنُ عَمْرٍو الْأَشْعَثِيُّ جَمِيعًا عَنِ ابْنِ عُيَيْنَةَ، قَالَ سَعِيدٌ: أَخْبَرَنَا سُفْيَانُ، عَنْ هِشَامِ بْنِ حُجَيْرٍ، عَنْ طَاوُسٍ، قَالَ: جَاءَ هَذَا إِلَى ابْنِ عَبَّاسٍ – يَعْنِي بُشَيْرَ بْنَ كَعْبٍ – فَجَعَلَ يُحَدِّثُهُ، فَقَالَ لَهُ ابْنُ عَبَّاسٍ: عُدْ لِحَدِيثِ كَذَا وَكَذَا [ص:13]، فَعَادَ لَهُ، ثُمَّ حَدَّثَهُ، فَقَالَ لَهُ: عُدْ لِحَدِيثِ كَذَا وَكَذَا، فَعَادَ لَهُ، فَقَالَ لَهُ: مَا أَدْرِي أَعَرَفْتَ حَدِيثِي كُلَّهُ، وَأَنْكَرْتَ هَذَا؟ أَمْ أَنْكَرْتَ حَدِيثِي كُلَّهُ، وَعَرَفْتَ هَذَا؟ فَقَالَ لَهُ ابْنُ عَبَّاسٍ: «إِنَّا كُنَّا نُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ لَمْ يَكُنْ يُكْذَبُ عَلَيْهِ، فَلَمَّا رَكِبَ النَّاسُ الصَّعْبَ وَالذَّلُولَ، تَرَكْنَا الْحَدِيثَ عَنْهُ
অর্থ-বশির ইবনে কাব হযরত ইবন আব্বাস (রা.) এর নিকটে আগমন করেন এবং তাকে হাদীস শোনাতে থাকেন। হযরত ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, অমুক অমুক হাদীসগুলো আবার বলো তো? তার সামনে পুনরায় তা পাঠ করা হয়। তিনি আবার বলেন, অমুক হাদীসখানা আবার শোনাও! তিনি যখন সেই হাদীসখানা তাঁকে পড়ে শোনান এবং বলেন, আপনি কি আমার হাদীসগুলো বুঝতে পেরেছেন? এখন আপনি এই হাদীসগুলোর মাঝে এই একটা হাদীসকে মুনকার মনে করেন নাকি সবগুলো হাদীসকে? হযরত ইবন আব্বাস (রা.) তাঁকে বলেন, যখন নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যাচার করা হতো না, তখন আমরা সরাসরি সনদ ছাড়া রাসূলুল্লাহ থেকে হাদীস বর্ণনা করতাম। কিন্তু মানুষ যখন সহজ ও কঠিন উভয় বাহনে সওয়ার হতে লাগলো (অর্থাৎ নিজের সুবিধা মত নবীজির নামে জাল হাদীস বানাতে লাগলো) তখন থেকে আমরা সরাসরি নবীজির থেকে হাদীস বর্ণনা ছেড়ে দেই। অর্থাৎ সনদ ছাড়া হাদীস বর্ণনা করাই ইবনে আব্বাস ছেড়ে দেন।
(সূত্রঃ সহীহ মুসলিম। হাদীসঃ ১৯)।
সনদের গুরুত্ব কতটা?
সহীহ মুসলিমের মুকাদ্দমায় (ভুমিকাতে) উল্লেখ আছে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, সনদ হলো দ্বীন। হ্যাঁ ভাই, ইসলাম কিতাব আর সনদের মাধ্যমে এসেছে। শুধুই কারোর সীনায় সীনায় আসে নি। এখন আপনার সামনে দুটি রাস্তা খোলা। সনদ দ্বারা আসা দ্বীনকে আপনি মানবেন? নাকি মানুষের মনগড়া, অলীক মিথ্যাচার, শোনা শোনাভাবে চলে আসা ইলম মানবেন? আপনি যদি বলেন, সনদ মানব। তাহলে আমার এই লিখাগুলো আপনার হেদায়াতের পাথেয় হবে। ইনশাআল্লাহ। আর যদি বলেন, সনদ মানি না; বুজুর্গ যা বলেছেন, যা তাঁদের সীনায় সীনায় এসেছে তা ছাড়া কিছুই মানি না। তাহলে এই লিখা পড়লে আপনার শুধুই সময় নষ্ট হবে।
এবার আসুন, সেই মূল হাদীসখানা আগে দেখে নেই যার জন্য এতো আলোচনা ও সমালোচনা,
عَنْ شُعْبَةَ، عَنْ سَلَمَةَ بْنِ کُهَيْلٍ، قَالَ : سَمِعْتُ أَبَا الطُّفَيْلِ يُحَدِّثُ عَنْ أَبِيْ سَرِيْحَةَ . . . أَوْ زَيْدِ بْنِ أرْقَمَ، (شَکَّ شُعْبَةُ). . . عَنِ النَّبِيِّ، قَالَ : مَنْ کُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلاَهُ. رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ. وَ قَالَ هَذَا حَدِيْثٌ حَسَنٌ صَحِيْحٌ. (قَالَ : ) وَ قَدْ رَوَی شُعْبَةُ هَذَا الحديث عَنْ مَيْمُوْنٍ أبِيْ عَبْدِ اﷲِ عَنْ زَيْدِ بْنِ أرْقَمَ عَنِ النَّبِيِّ صلی الله عليه وآله وسلم.
অর্থ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যার মওলা আমি তাঁর মওলা আলী।” এই হাদীসখানা ইমাম তিরমিজি (রহ.) বর্ণনা করে বলেন, এই হাদীসটি হাসান ও সহীহ। এই হাদীসটি আরও বহু হাদীসের কিতাবে এসেছে। এখন সে দিকে যাওয়ার মত এত সময় বা ধৈর্য্য কোনটাই নেই।
এখন এই হাদীসে শুধু এতোটুকু শব্দ এসেছে যে, আমি যার মওলা আলী তাঁর মওলা। এবার আসুন, ভুল বুঝাবুঝি দূর করে দিই! প্রশ্ন করতে পারেন যে,
১. রাসূল (সা.) কথাটি কেন বললেন?
২. কোথায় বললেন?
৩. কাদেরকে বললেন?
৪. কিসের পরিপ্রক্ষিতে বললেন?
৫. তিনি কোন সময় বললেন?
৬. কী অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে বললেন?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব এই টুকরো করা হাদীসের মধ্যে নেই। এই প্রশ্নগুলোর জবাব জানতে হলে, এই হাদীসটি যতগুলো সনদে, যতগুলো কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, তা সংগ্রহ করে পড়ে দেখতে হবে যে, আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলেছেন! ভয় নেই আমি এই হাদীসের প্রায় সমস্ত সনদ ও মতন সংগ্রহ করে মিলিয়ে দেখেছি। পৃথিবীর কতগুলো কিতাবে তা এসেছে তাঁর নাম সহ ঠিকানা আমার সংগ্রহে। আমি সব খুলে খুলে সবাইকে বলে দিব। মূল মতন যখন দেখিয়ে দেব তখন সব অজানা গোমর কথা ফাঁস হয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী ইবন আবী তালেব (রা.)-কে কোনো ধরনের বেলায়াত প্রদান করার প্রমাণ কোথাও নেই, না সুস্পষ্টভাবে আর না ইংগিতে; কোনোভাবেই কেউ তা প্রমাণ করতে পারবেনা।
এখন কথা হল একটাই, আপনি যদি কুরআন আর হাদীস মেনে থাকেন, তাহলে আপনি বাধ্য হবেন সত্য মেনে নিতে। আরেকটি কথা, হযরত আলী (রা.)-এর সাথে আমার আপনার দুশমনি কেন থাকবে? রাসূল (সা.) সত্যিই যদি তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন তবে তো সেটির সুস্পষ্ট প্রমাণও থাকবে। এমন তো আর হতে পারেনা যে, রাসূল (সা.) লোকচক্ষু অন্তরালে কোনো কাজ করে যাবেন যার দরুন পরবর্তীতে মানুষের মাঝে সংশয় আর বিতর্ক জন্ম নেবে! আল্লাহর একজন রাসূল কি কখনো এমন কাজ করবেন বলে আপনি মনে করেন? মোটেও না। তাছাড়া হযরত আলী (রা.) নিজেও তো কোথাও বা কখনো এমন কথা বলে যাননি!
সুতরাং, এই সমস্ত অনিশ্চিত আর সন্দেহজনক বিষয়ে বাড়াবাড়ি কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। বরং এতে করে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মাঝে অনৈক্য আর বিদ্বেষই জন্ম দেবে!
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ
সার্বিক সহযোগিতায় Tayeff Hasan Khan