সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি প্রশ্নোত্তরে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে
- জানাযার সালাতে সূরা ফাতেহা পড়া নিয়ে মতভেদ কী?
প্রশ্নের উত্তরে বলা হবে যে, একটা শ্রেণী প্রচার করে থাকেন যে, সূরা ফাতেহা ছাড়া অন্যান্য সালাত যেমন হয়না তেমনি জানাযার সালাতও সূরা ফাতেহা না পড়লে শুদ্ধ হবেনা। কিন্তু তাদের এই বিশ্বাস সঠিক নয়। প্রথমত, যে হাদীসে সূরা ফাতেহা ছাড়া সালাত হবেনা বলে উল্লেখ আছে সেটি একাকী সালাত আদায়কারী ব্যক্তির সালাত সম্পর্কে। (হাদীস) إذا صلى احدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الامام অর্থাৎ তোমাদের মধ্য থেকে যখন কেউ ইমামের পেছনে সালাত পড়বে তার জন্য ইমামের ক্বেরাতই যথেষ্ট। (আল মুয়াত্তা-এর শরাহ ‘আত-তামহীদ‘ ১২/৩৭, ইমাম ইবনে আব্দিল বার আল মালেকী, হাদীস সহীহ)! স্ক্রিনশট :
ছোট্ট একটা উপমা দিলে বুঝতে সহজ হবে। মনে করুন, আপনি অজু করে মসজিদে ঢুকেই দেখলেন যে ইমাম সাহেব রুকুতে চলে গেছেন। আপনিও ইমামের সাথে রুকুতে শামিল হয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় ইমাম সাহেব যখন সালাত শেষ করবেন তখন কি আপনি প্রথম রাকাত পাননি মনে করে দাঁড়িয়ে যাবেন? নিশ্চয়ই না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, সূরা ফাতেহা ছাড়া সালাত হবেনা—কথাটি সবক্ষেত্রে নয়, বরং শুধুমাত্র একাকী সালাত আদায়কারী ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, জানাযার সালাত মূলত একটি দোয়া মাত্র, অন্যান্য সালাতের মত কোনো সালাত নয়। যেজন্য সূরা ফাতেহা পড়ার আবশ্যকতা প্রমাণের জন্য অন্যান্য সালাতের প্রসঙ্গ টেনে আনা সম্পূর্ণ জেহালত বৈ কিছুই না। এবার দ্বিতীয় শ্রেণীর মতামত জানা যাক। দ্বিতীয় শ্রেণীর মতামত হচ্ছে, সূরা ফাতেহা পড়ার প্রমাণে সহীহ বুখারীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে একটি বর্ণনা উল্লেখ আছে। অনুরূপ আরও কয়েক জন সাহাবী থেকেও উল্লেখ আছে। তেমনিভাবে খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর (রা.) হযরত আলী (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এবং হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একদম টনটনে একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, উনারা কেউই জানাযার সালাতে সূরা ফাতেহা পড়তেন না। এমনকি রাসূল (সা.) হতেও কোনো মারফু সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসও পাওয়া যায়না যেখানে সূরা ফাতেহা পড়া সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়! সুতরাং এতে প্রমাণিত হয় যে, সূরা ফাতেহা পড়া ফরজ বা ওয়াজিব বা সুন্নাহ এধরণের কিছুই না; বড়জোর শুধুই হামদ-ছানাহ’র নিয়তে জায়েজ হতে পারে। কারণ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ব্যক্তিগত একখানা আমল দ্বারা তা প্রমাণিত। তবে ইবনে আব্বাস (রা.) সূরা ফাতেহাকে ক্বেরাত ধরেই পড়তেন না, বরং হামদ-ছানাহ (আল্লাহর প্রশংসা ও বন্দনা) স্বরূপ পড়তেন। আর একথার প্রমাণও একাধিক সহীহ সূত্র থেকে পাওয়া যায়। সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) রচিত ‘ফাতহুল বারী’-তে এর প্রমাণ হিসেবে যে তথ্যটি উঠে এসেছে তাতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তিনি জানাযায় একদা ‘فاتحة الكتاب’ (সূরা ফাতেহা) পাঠ করলেও সেটি মূলত হামদ-ছানাহ হিসেবেই করেছিলেন, ক্বেরাত হিসেবে নয়। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) লিখেন, ইমাম হাম্মাদ (রহ.) তিনি বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু হামজাহ (রহ.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি (আবু হামজাহ) বলেন, আমি তাঁকে (ইবনে আব্বাসকে) জিজ্ঞাসা করলাম, কা‘বার ভেতরে নামায কীভাবে পড়ব? তিনি উত্তরে বললেন, (আরবী) كما تصلي في الجنازة تسبح وتكبر ولا تركع ولا تسجد ثم عند أركان البيت سبح وكبر وتضرع واستغفر، ولا تركع ولا تسجد অর্থাৎ তুমি (সেভাবেই পড়বে) যেভাবে সালাতুল জানাযা পড়। (তথায়) তাসবীহ পড়বে, তাকবীর দিবে, তবে রুকু-সিজদা করবে না। এরপর বাইতের রোকনগুলোর কাছে তাসবীহ পাঠ করবে, তাকবীর দিবে, রোনাজারি করবে এবং ইস্তিগফার করবে। তবে রুকু-সিজদা করবে না। (ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী ৩ : ৪০৪ কিতাবুল হাজ্জ)। ইবনে হাজার আসকালানী লিখেন, এ বর্ণনার সনদ সহীহ। লক্ষণীয় হল, ইবনে আব্বাস (রা.) জানাযার সালাতের নিয়ম পদ্ধতি কেমন তা ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে সূরা ফাতেহার উল্লেখ করেননি। আশাকরি প্রকৃত বিষয়টি এবার বুঝতে পেরেছেন। এ সম্পর্কে ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)-এর লেকচারটি শুনা যেতে পারে। (প্রামাণ্য স্ক্রিনশট)
- জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার শরয়ী হুকুম কী? জানাযার সালাতে যারা সূরা ফাতেহা পড়তেন তাঁরা কী হিসেবে পড়তেন আর যাঁরা পড়তেন না তাঁদের বক্তব্য কেমন?
আগেই এর উত্তর দেয়া হয়ে গেছে অর্থাৎ, এর শরয়ী হুকুম বড়জোর জায়েজ, তবে শর্ত হচ্ছে হামদ-ছানাহ (supplication) স্বরূপ পড়বে কিন্তু তেলাওয়াত স্বরূপ পড়বেনা। কেননা সালাতুল জানাযা প্রকৃতপক্ষে সালাত নয়? তাহলে সালাতুল জানাযা কী? এর উত্তর হল, সালাতুল জানাযা (صلاة الجنازة) এর আভিধানিক অর্থ دعاء الميت বা মৃতের জন্য প্রার্থনা। অভিধানে সালাত (صلاة) শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দোয়া বা প্রার্থনা। আর জানাযা অর্থ মাইয়্যেত বা মৃত ব্যক্তি। কিন্তু তথাপি এটিকে ‘সালাত‘ নামে নামকরণ করার কারণ হিসেবে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, قال ابنُ حَجر: (قوله سمَّاها صلاة، أي: يُشتَرَط فيها ما يُشتَرَط في الصلاة، وإنْ لم يكن فيها ركوعٌ ولا سجودٌ، فإنَّه لا يُتكلَّم فيها، ويُكبَّر فيها، ويُسلَّم منها بالاتِّفاق). ((فتح الباري)) (3/190). অর্থাৎ এর নাম সালাত রাখার কারণ হচ্ছে, এতেও সেসব কর্ম শর্ত যা প্রকৃত সালাতের জন্য শর্ত, যদিও তার মধ্যে রুকু এবং সেজদা নেই। আর তাতে কথা বলা হয়না এবং সর্বসম্মতিক্রমে তার মধ্যে তাকবির বলা হবে এবং সালাম বলা হবে। (ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী খ-৩ পৃ-১৯০)। সালাতুল জানাযা (صلاة الجنازة) সম্পর্কে ইমাম মালেক (রহ.) একদম পরিষ্কার করে বলেছেন, إنما هو الدعاء অর্থাৎ ‘এ তো দোয়া মাত্র’! (সূত্র, আল মুদাওয়ানাতুল কোবরা [الكتاب: المدونة المؤلف: مالك بن أنس بن مالك بن عامر الأصبحي المدني (ت ١٧٩هـ)] ১ : ২৫১)। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সালাফ ও বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত আবুল আলিয়া (ابو الْعَالِيَةِ) (রহ.)-এর একটি বক্তব্য পেশ করছি। আবুল মিনহাল আল বছরী (ابو المنهال سيار بن سلامة البصري) বলেছেন, سَأَلْتُ أَبَا الْعَالِيَةِ عَنِ الْقِرَاءَةِ فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْجِنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَقَالَ: “مَا كُنْتُ أَحْسَبُ أَنَّ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ تُقْرَأُ إِلَّا فِي صَلَاةٍ فِيهَا رُكُوعٌ وَسُجُودٌ অর্থাৎ আমি আবুল আলিয়া (রা.)-কে সালাতুল জানাযায় ফাতেহা পাঠ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি (আশ্চর্য হয়ে) বললেন, আমার তো ধারণাই ছিল না যে, সূরা ফাতেহা রুকু-সিজদা বিশিষ্ট সালাত ছাড়া অন্য কোনো সালাতেও পড়া যেতে পারে! (সূত্র, আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৫২৪)। ইমাম ত্বহাবী (রহ.)-এর উপর আল্লাহ অজস্র ধারায় রহমতের বারিধারা বর্ষণ করুন। তিনি এই হাদীসের অংশবিশেষ থেকে অত্যন্ত চমৎকার একটি ফিকহের গোড়াপত্তন করতে সামর্থ্য হয়েছেন। তিনি এর রহস্য উদঘাটন করে লিখে গেছেন, لعل، قراءة من قرأ الفاتحة من الصحابة كان على وجه الدعاء لا على وجه التلاوة অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ (জানাযায়) ফাতেহা পাঠ করেছেন বলে যে নস (প্রমাণ) পাওয়া যায় সম্ভবত সেটি ছিল দোয়া হিসেবে, কুরআন তেলাওয়াত হিসেবে নয়। (সূত্র, উমদাতুল ক্বারী শরহে সহীহ বুখারী ৮/১৪১)। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য :
তিনি যেন বুঝাতে চাচ্ছেন, সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ঐ কর্মটা মূলত As a face of supplication বা বন্দনামূলক-ই ছিল, not on the face of recitation তথা তেলাওয়াতের নিয়তে ছিল না। সুতরাং বরেণ্য সালাফদের আমল দ্বারা বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, গুটিকয়েক সালফে সালেহীনকে বাদ দিলে বেশিরভাগেরই আমল ছিল খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের মত যাঁরা জানাযায় ক্বেরাত পাঠ থেকে বিরত ছিলেন। সালাফদের যে বা যারাই জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়তেন তারা কেউই জোরে জোরে পড়তেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না, বরং চুপেচুপে পড়ার কথাই বর্ণিত আছে। যেমন হযরত আবু উমামাহ (রা.) থেকে ‘দোয়া অধ্যায়ে‘ বর্ণিত আছে, أَخْبَرَنَا قُتَيْبَةُ، قَالَ حَدَّثَنَا اللَّيْثُ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، أَنَّهُ قَالَ السُّنَّةُ فِي الصَّلاَةِ عَلَى الْجَنَازَةِ أَنْ يَقْرَأَ فِي التَّكْبِيرَةِ الأُولَى بِأُمِّ الْقُرْآنِ مُخَافَتَةً ثُمَّ يُكَبِّرَ ثَلاَثًا وَالتَّسْلِيمُ عِنْدَ الآخِرَةِ অর্থাৎ কুতায়বা (রহ.) … আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জানাযার সালাতে সুন্নাহ হল প্রথম তাকবীরে সূরা ফাতেহা চুপেচুপে তেলাওয়াত করবে। অতঃপর আরো তিনটি তাকবীর বলবে; শেষ তাকবীরে সালাম ফিরাবে। (সূত্র, সুনানে নাসাঈ, কিতাবুল জানায়েজ হাদীস নং ১৯৯৩, হাদীস সহীহ)।
- সূরা ফাতেহা পড়া ছাড়া জানাযার সালাত শুদ্ধ হবে কি?
উত্তরে বলা হবে, অবশ্যই শুদ্ধ হবে। কেননা সহীহ বুখারীতে ইবনে আব্বাস (রা.) হতে এ সম্পর্কে যে হাদীসটি রয়েছে সেখানে পরিষ্কার করে লিখা আছে যে, لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ অর্থাৎ যাতে লোকেরা বুঝতে পারে যে, নিশ্চয়ই এটি সুন্নাহ। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১২৫৪; ইফা)। তবে এটি ঐরকম সুন্নাহ নয় যা রাসূল (সা.)-এর কর্ম দ্বারা সাব্যস্ত হয়। সুনানু তিরমিজি গ্রন্থে এই ‘সুন্নাহ’ শব্দটির ওয়াজাহাত (সুস্পষ্টকরণ) রয়েছে এভাবে যে, فَقَالَ إِنَّهُ مِنَ السُّنَّةِ أَوْ مِنْ تَمَامِ السُّنَّةِ . অর্থাৎ তিনি বললেন, এ হলো সুন্নাহ অথবা বলেন, এ হলো সুন্নাহ’র পরিপূর্ণতা বিধানের অন্তর্ভূক্ত। (তিরমিজী হাদীস নং ১০২৭ ;আল মাদানী প্রকাশনী)। বলাবাহুল্য যে, সুন্নাহ তরক করা দ্বারা কখনো কোনো আমল বাতিল হয়না, বেশি থেকে বেশি আমলটি ক্রুটিপূর্ণ হয়। অধিকন্তু রাসূল (সা.) নিজ সত্তার বাহিরে শুধুমাত্র খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মকে ‘সুন্নাহ’ বলেছেন, ঢালাওভাবে সব সাহাবীর কর্মকে আর যাইহোক অন্তত ‘সুন্নাহ’ বলেননি। ইবনে আব্বাসের উক্ত কথা থেকে সূক্ষ্মভাবে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার নিয়মটি পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিলনা বলেই ইবনে আব্বাস (রা.)-এর জন্য জানাযার সালাত শেষে ‘নিশ্চয়ই এটি সুন্নাহ’ (لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ) এভাবে বলে উপস্থিত সাহাবীদের সংশয় দূরীকরণ আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।
- সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়তেন তাঁরা কারা? আর যাঁরা পড়তেন না তাঁরা কারা?
যারা সূরা ফাতেহা জানাযায় পড়তেন : সাহাবীদের মধ্যে যাঁদের থেকে জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায় তাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) এবং হযরত আবু উমামাহ আল বাহিলী (রা.) অন্যতম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীসটি ইমাম তিরমিজি (রহ.) নিজেও তাঁর সুনান গ্রন্থে এনেছেন। হাদীসটি এইরকম, عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَوْفٍ، أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ، صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَقُلْتُ لَهُ فَقَالَ إِنَّهُ مِنَ السُّنَّةِ أَوْ مِنْ تَمَامِ السُّنَّةِ . অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনু বাশশার (রহ.) ….. আবদুল্লাহ ইবনু আওফ (রহ.) থেকে বর্ণিত যে, ইবনু আব্বাস (রা.) একবার সালাতুল জানাযা পড়েন এবং এতে সূরা ফাতেহা পাঠ করেন। এই বিষয়ে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, এ হলো সুন্নাহ অথবা বলেন, এ হলো সুন্নাহ’র পরিপূর্ণতা বিধানের অন্তর্ভূক্ত। (তিরমিজী হাদীস নং ১০২৭; আল মাদানী প্রকাশনী)। ইমাম আবু ঈসা (রহ.) বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ্।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেছেন, কতেক সাহাবী ও অপরাপর উলামায়ে কেরাম অনুরূপ আমল করেছেন (এতে বুঝা যাচ্ছে সবাই জানাযায় ফাতেহা পড়তেন না-লিখক)। প্রথম তাকবীরের পর সূরা ফাতেহা পাঠের বিধান তাঁরা গ্রহণ করেছেন। এটি ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ও ইসহাক (রহ.)-এর অভিমত। আবার কতেক উলামায়ে কেরাম বলেছেন, সালাতুল জানাযায় (সূরা ফাতেহা) পাঠ করা হবে না। এতো কেবল আল্লাহর হামদ-ছানাহ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ ও মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা। এটি ইমাম সুফিয়ান আস ছাওরী আর কুফাবাসী ফোকাহায়ে কেরামের অভিমত। ইমাম ইবনে বাত্তাল (রহ.) বলেন, وَمِمَّنْ كَانَ لَا يقْرَأ فِي الصَّلَاة على الْجِنَازَة وينكر: عمر بن الْخطاب وَعلي بن أبي طَالب وَابْن عمر وَأَبُو هُرَيْرَة، وَمن التَّابِعين: عَطاء وطاووس وَسَعِيد بن الْمسيب وَابْن سِيرِين وَسَعِيد بن جُبَير وَالشعْبِيّ وَالْحكم، وَقَالَ ابْن الْمُنْذر: وَبِه قَالَ مُجَاهِد وَحَمَّاد وَالثَّوْري، وَقَالَ مَالك: قِرَاءَة الْفَاتِحَة لَيست مَعْمُولا بهَا فِي بلدنا فِي صَلَاة الْجِنَازَة، অর্থাৎ যাঁরা জানাযায় ফাতেহা পড়তেন না, বরং পড়া থেকে বিরত থাকতেন, তাঁদের মধ্যে খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবী তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আবু হুরাইরা প্রমুখ অন্যতম। আর তাবেয়ীগণের মধ্যে ছিলেন, হযরত আত্বা ইবনে আবী রাবাহ, তা‘উস, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, ইবনে সিরীন, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, শা‘বী, হাকাম প্রমুখ অন্যতম। ইবনুল মুনযির (রহ.) বলেছেন, জানাযায় সূরা ফাতেহা না পড়ার এই মত পোষণ করতেন ইবনে আব্বাসের শিষ্য তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ, হাম্মাদ ও সুফিয়ান আস ছাওরী প্রমুখও। ইমাম মালেক (রহ.) বলেছেন, ليس ذلك بمعمول به ببلدنا إنما هو الدعاء، أدركت أهل بلدنا على ذلك অর্থাৎ জানাযায় ফাতেহা পড়ার এরকম কোনো আমল আমাদের শহরে (মদীনায়) নেই, যেহেতু এটি নিছক একটা দোয়া আর আমি আমাদের শহরবাসীকে এরই উপর পেয়েছি। (ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রচিত ‘উমদাতুল কারী’ শরহে বুখারী ৮/১৩৯)।
যাঁরা সূরা ফাতেহা জানাযায় পড়তেন না : (১) চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, قال ابن أبي شيبة : حدثنا محمد بن فضيل عن العلاء بن المسيب عن أبيه عن علي أنه كان إذا صلى على ميت يبدأ يحمد الله ويصلى على النبي صلى الله عليه وسلم ثم يقول : اللهم اغفر لأحيائنا و أمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا অর্থাৎ হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোনো মৃত ব্যক্তির জানাযার সালাত পড়তেন তখন প্রথমে আল্লাহর হামদ-ছানাহ (প্রশংসা-জ্ঞাপন) করতেন তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়তেন অতপর এই বলে দোয়া করতেন, اللهم اغفر لأحيائنا وأمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا (সূত্র, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৪৯৪)। তাহকীক, এই বর্ণনার রাবীগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য। হযরত আলী (রা.)-এর এই আমল (آثار) দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, জানাযার সালাতে সূরা ফাতেহা পড়া আবশ্যক নয়, সুন্নাহ-ও নয়।
(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, مالك عن نافع أن عبد الله بن عمر كان لا يقرأ في الصلاة على الجنازة অর্থাৎ হযরত নাফে (রহ.) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) জানাযার সালাতে (ক্বেরাত/কুরআন) পড়তেন না। (সূরা মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ৫২৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৫২২)। তাহকীক, এই আমটিও (آثار) বিশুদ্ধতম সনদে বর্ণিত। এখানেও স্পষ্টভাবে বলা হল, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) জানাযার সালাতে ক্বেরাত পড়তেন না।
(৩) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, لم يوقت لنا في الصلاة على الميت قراءة ولا قول كبر ما كبر الإمام وأكثر من طيب الكلام. أورده الهيثمي في مجمع الزوائد وقال : رواه أحمد ورجاله رجال الصحيح অর্থাৎ আমাদের জন্য জানাযার সালাতে কোনো ক্বেরাত (ফাতেহা) কিংবা কোনো বাক্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। ইমাম যখন তাকবির বলে তখন তুমিও তাকবির বল। আর অধিক পরিমাণে তার জন্য ভালো কথা বল। (সূত্র, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং ৪১৫৩)। তাহকীক, ইমাম নূরউদ্দীন আল হাইছামী (রহ.) বলেছেন, হাদীসটি ইমাম আহমদ উদ্ধৃত করেছেন এবং এর বর্ণনাকারীগণ সহীহ বুখারীর বর্ণনাকারী।
(৪) হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, سَأَلَ أَبَا هُرَيْرَةَ كَيْفَ تُصَلِّي عَلَى الْجَنَازَةِ ؟ فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ : ” أَنَا ، لَعَمْرُ اللَّهِ أُخْبِرُكَ . أَتَّبِعُهَا مِنْ أَهْلِهَا . فَإِذَا وُضِعَتْ كَبَّرْتُ ، وَحَمِدْتُ اللَّهَ . وَصَلَّيْتُ عَلَى نَبِيِّهِ ” . ثُمَّ أَقُولُ : ” اللَّهُمَّ إِنَّهُ عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ كَانَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ . وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُولُكَ . وَأَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ . اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ مُحْسِنًا ، فَزِدْ فِي إِحْسَانِهِ . وَإِنْ كَانَ مُسِيئًا ، فَتَجَاوَزْ عَنْ سَيِّئَاتِهِ . اللَّهُمَّ لَا تَحْرِمْنَا أَجْرَهُ ، وَلَا تَفْتِنَّا بَعْدَهُ ” অর্থাৎ আবু সাঈদ মাকবুরী থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কীভাবে জানাযার সালাত পড়েন? আবু হুরাইরা (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি তোমাকে বলব। আমি মৃত ব্যক্তির (ঘর থেকে) পরিবারের সাথে জানাযার সাথে সাথে যেতে থাকি। অতপর যখন জানাযাকে (মৃতকে) রাখা হয় আমি তাকবীর দিই এবং আল্লাহর হামদ-ছানাহ (বন্দনা) করি। তারপর নবীর উপর দরূদ পড়ি। অতপর এই দুআ করি… اللهم। (সূত্র, মুয়াত্তা মালেক, হাদীস নং ৫২১; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৪৯৫)। তাহকীক, এই বর্ণনার-ও (آثار) সকল রাবী তথা বর্ণনাকারী সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য। এতেও সাব্যস্ত হয় যে, জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার হুকুম হামদ-ছানাহ (বন্দনা) রূপে বড়জোর জায়েজ, কিন্তু সুন্নাহ (সুন্নাতে রাসূল) নয়। যেজন্য আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত জানাযার সালাতকে ভুল আখ্যা দেয়া কোনোভাবেই সুবিচার হবেনা, বরং অবিচার এবং জনমনে ফেতনা সৃষ্টি হিসেবেই গণ্য হবে।
মাসিক আল কাউসার এবং হাদীস বিডি.কম থেকে উপরে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর বস্তুনিষ্ঠভাবে ও সহজ ভাষায় তুলে ধরা হল! পাঠকবৃন্দ! ভালো মত বুঝার চেষ্টা করবেন, যাতে এধরণের নতুন নতুন যে কোনো মাসয়ালায় বিভ্রান্ত হতে না হয়! লিখাটি উপকারী মনে হলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে দিন বা কপি (Copy) করে পোস্ট করুন!
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী | লিখক ও গবেষক