বিনিময় নিয়ে ধর্মকর্ম

0
বিনিময় নিয়ে ধর্মকর্ম

বিনিয়ম নিয়ে ধর্ম-কর্ম

না না, ট্রেডিশনাল কোনো কথা লিখতে বসিনি। একটু সমালোচনার ঢঙ্গে আবার একটু বিজ্ঞান আর যুক্তি যুক্ত সহকারে লিখব, যেখানে কুরআন সুন্নাহ থেকেও রসদ থাকবে, ইনশাআল্লাহ। যারা ইতিপূর্বে সজল রোশনদের খপ্পরে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন লিখাটি তাদের জন্য। অনেক লম্বা লিখা পাঠকদের ধৈর্য্য কুলায়না। তাই যথাসাধ্য সংক্ষেপ করে লিখব, তবু দীর্ঘ হয়ে গেলে আমি দায়ী নই। কারণ পাঠকদের তাগিদেই কিন্তু লিখতে বসেছি!

কথায় আছে, যত দোষ হুজুরের! হুজুর এত খায় কেন? হুজুর এত সাজগোছ করে কেন? হুজুরের বৌ অত সুন্দরী কেন? হুজুরের ঘর পাকা কেন? হুজুরের জামাটা এত দামী কেন? হুজুর এত দৌড়াচ্ছে কেন? হুজুর মানুষ, এত টাকা দিয়ে করবেটা কী? হুজুর ইংলিশ বলে কেন? হুজুর এত হাদিয়া নেয় কেন? হুজুর হেলিকপ্টার চড়ে কেন?….এই কেন কেন….তালিকাটা যে কবে শেষ পর্যন্ত পৌছবে আমার জানা নেই! সত্য বলতে এগুলো এক ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ। যাদের মন অতিব সংকীর্ণ এগুলো তাদের কথা। কসম করে কেউ বলতে পারবেনা, উপরের কোনো একটি “কেন?” এর ভেতর হুজুরের দোষ ধরার কোনো সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া একজন সাধারণ নাগরিকের পক্ষে অপর একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মত আইনী কোনো ধারা আছে কিনা, সেটাও প্রশ্ন রাখবে। চলি মূল কথায়,

সজল রোশনদের খপ্পরে পড়েছেন অনেক যুবক। তারা হয়ত ভেবেছেন, সজল রোশন আমেরিকা বসে বসে যেগুলো ইউটিউবে আপলোড দিচ্ছেন তা তার নিজের আবিষ্কার। আসলে সজল রোশন সহ আরও যতজনের নাম বলিনা কেন প্রায় প্রত্যেকে ইসলামী ইতিহাস এবং কুরআনের তাফসির আর উসূলে হাদীস বিষয়ে পুরোদস্তুর অজ্ঞ ও নেহাত মূর্খ তো বটে, সে সাথে চরম মিথ্যাবাদীও। আমি তার অনেকগুলো ক্লিপ দেখেছি। তার আলোচনার সাথে আমি আমার সুদীর্ঘ ১৬ বছরের একাডেমিক শিক্ষা-দীক্ষার কোনো রকম মিল খোঁজে পাই না। তারা হাদীসকে পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহের মুখোমুখি দাঁড় করে যে কায়দায় হাদীসের উপর আঙুল উঠায়, সেই একই কায়দায় কুরআনের আয়াতকেও অপরাপর আয়াতের মুখোমুখি দাঁড় করে নাস্তিক আর খ্রিস্টান মিশনারীরাও কুরআনকে বাতিল করার জোর চেষ্টা চালায়। কাজেই সজল রোশনদের উদ্দেশ্যমূলক এ সমস্ত ভুজুংভাজুং যুক্তি থেকে যারা সবক নিচ্ছেন তাদের উচিত, ইসলামের মূলধারার শিক্ষা-দীক্ষায় ফিরে এসে ইসলামকে আহলে সুন্নাহর স্কলারদের নির্দেশিত পন্থায় বুঝতে পড়াশোনা শুরু করা। বিশেষ করে কুরআনের প্রসিদ্ধ তাফসীর আর উসূলে হাদীস নিয়ে। তবেই সজল রোশনদের যাদুবিদ্যার মুখোশ উন্মোচন করতে দেরি হবেনা।

পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটির কেমন বিকৃত উপস্থাপন দ্বারা দরাকে সরা বানিয়ে সজল রোশনরা সাধারণদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে, দেখুন। প্রথমে আয়াতের আরবী অংশ সহ সঠিক অনুবাদ, আল্লাহতালা বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَ الرُّہۡبَانِ لَیَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ یَکۡنِزُوۡنَ الذَّہَبَ وَ الۡفِضَّۃَ وَ لَا یُنۡفِقُوۡنَہَا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۙ فَبَشِّرۡہُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ অর্থ, হে মুমিনগণ! নিশ্চয় অনেক পন্ডিত-পুরোহিত মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায় উপায়ে ভক্ষণ করে এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। [১] আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও (কুরআন/৯:৩৪)। [২]

সংক্ষিপ্ত তাফসীর,

[১] أحبَار শব্দটি حِبْر এর বহুবচন। এটা এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কথাকে খুব সুন্দর করে পেশ করার দক্ষতা রাখে। আর সুন্দর ও নকশাদার পোশাককেও ثَوبٌ مُحَبِّر বলা হয়ে থাকে। এখানে উদ্দেশ্য ইয়াহুদী উলামা। رُهبَان শব্দটি رَاهِب এর বহুবচন যার উৎপত্তি رهبنة শব্দ থেকে। এ থেকে উদ্দেশ্য নাসারা উলামা। কারো কারো নিকটে এ থেকে উদ্দেশ্য হল, নাসারাদের সুফীগণ। উলামার জন্য তাদের নিকট বিশেষ শব্দ قسّيسين রয়েছে। এই উভয় শ্রেণীর ধর্মধ্বজীরা এক তো আল্লাহর কালামকে বিকৃত ও পরিবর্তিত করে লোকদেরকে তাদের ইচ্ছা মোতাবেক ফতোয়া ও বিধান দিত এবং এইভাবে তাদেরকে আল্লাহর পথ হতে বাধা প্রদান করত। আর দ্বিতীয়তঃ এই পন্থায় তারা তাদের নিকট হতে অর্থ উপার্জন করত; যা তাদের জন্য হারাম ও বাতিল ছিল।

[২] আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেন যে, এটা যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বের আদেশ। যাকাতের হুকুম অবতীর্ণ হওয়ার পর যাকাত দ্বারা আল্লাহ তাআলা মাল-ধনকে পবিত্র করার মাধ্যম বানিয়েছেন। এই জন্য উলামাগণ বলেন, যে মাল থেকে যাকাত বের করা হবে সে মাল (আয়াতে নিন্দনীয়) ‘জমা করে রাখা’ মাল নয়। আর যে মাল থেকে যাকাত বের করা হবে না, সে মালই হবে ‘জমা করে রাখা’ ধনভান্ডার; যার জন্য রয়েছে এই কুরআনী ধমক।

  • প্রশ্ন হল, আয়াতের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে হাদীস অস্বীকারকারী মিশনারী সদস্য সজল রোশনরা যেগুলো বললেন অর্থাৎ ইমামতি, মুয়াজ্জিনি, মক্তব-মাদরাসায় পড়িয়ে, ওয়াজ করে বিনিময় গ্রহণ হারাম বা কুরআনী শিক্ষার পরিপন্থী ইত্যাদি; এসবের সাথে পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতের الۡاَحۡبَارِ وَ الرُّہۡبَانِ শব্দদ্বয়ের সম্পর্ক কোথায়? (পোস্টের লিংক) এটা তো এক জায়গার পানি আরেক জায়গায় ঢালা হল! কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে কি সজল রোশনদের এ সমস্ত তেলেসমাতি ধরতে পারা সম্ভব!?
হাদীস অস্বীকারকারী সজল রোশনদের জনৈক অনুসারীর পোস্ট থেকে নেয়া

পাঠকবৃন্দ! কুরআনের উপর একাডেমিক শিক্ষা যার নেই তার পক্ষেই সম্ভব এরকম কিছু আয়াত কালেক্ট করে নিজের মতকে আয়াতের উপর চাপিয়ে দেয়া। কোনো ঘটনার যেমন প্রেক্ষাপট থাকে তেমনি আয়াতগুলোর সাথেও নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট আর শর্ত যুক্ত রয়েছে। যেজন্য সজল রোশনদের দৃষ্টিতে আয়াতগুলো মুক্ত অর্থে ধর্ম-কর্ম-এর বিনিময় গ্রহণকে নিন্দা করার নির্দেশ দিলেও বিশেষজ্ঞ মুফাসসিরগণের দৃষ্টিতে এগুলো ভিন্ন রকম তাৎপর্য ও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মাযহাবের মুফতাবিহি কওল সহ প্রায় সকল মুজতাহিদ ইমামের মতে, ইসলামি খিলাফত যখন কায়েম থাকবেনা তখন স্থানীয় মুসল্লিদের উপরই দায়িত্ব বর্তাবে সালাতের ইমামতের জন্য বেতনভুক্ত একজন নিয়মিত ইমাম নিয়োগ দেয়া। নইলে ফরজ সালাতের জামাতের শৃঙ্খলা অটুট থাকবেনা। দেখুন, হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহতার, ইবনে আবেদীন আশ-শামী (আরবী) ৬/৩৩৯,


আরবী- قال في الهداية: وبعض مشايخنا رحمهم الله تعالى استحسنوا الاستئجار على تعليم القرآن اليوم لظهور التواني في الأمور الدينية، ففي الامتناع تضييع حفظ القرآن، وعليه الفتوى اه‍. وقد اقتصر على استثناء تعليم القرآن أيضا في متن الكنز و مواهب الرحمن وكثير من الكتب، وزاد في مختصر الوقاية ومتن الاصلاح تعليم الفقه، وزاد في متن المجمع الإمامة، ومثله في متن الملتقى ودرر البحار، وزاد بعضهم: الأذان والإقامة والوعظ، وذكر المصنف

সারকথা হল, ইসলামী শরীয়াহ’র বিশেষজ্ঞগণ কতেক ধর্মকর্মে বিনিময় বা اجرة নেয়া বৈধ বলেছেন কেবল ঐ সব ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে, যা ضروريات دين তথা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত। যেমন, দ্বীন শিখানো (মক্তব-মাদরাসা), ইমামতি, মুয়াজ্জিনি, ওয়াজ-মাহফীল। এছাড়া আর কোনো ধরণের ধর্মকর্মে বিনিময়ে বা اجرة গ্রহণ বৈধ নয়। এ হচ্ছে, সঠিক ও মীমাসিংত মাসয়ালা।

এখন প্রশ্ন হল, সজল রোশনরা আরো যেসব আয়াত দ্বারা মুক্তভাবে ভুজুংভাজুং ব্যাখ্যা দিয়ে হারাম হারাম কইয়া মুখে ফেনা তুলছে, সে সমস্ত আয়াত কি ঐ ইসলামী শরীয়াহ’র বিশেষজ্ঞ ইমামদের সময় পবিত্র কুরআনে ছিলনা? নাকি ইমামগণ আয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন বলবেন? আমি সজল রোশনদের অনুরোধ করছি, আপনারা আমেরিকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন রেখে মসজিদগুলোর ইমামতি গ্রহণে সূরা-ক্বেরাত শুদ্ধ করে ও প্রয়োজনীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষালাভ করে এগিয়ে আসুন অথবা আপনাদের ফলোয়ারদের এগিয়ে আসতে বলুন। তবেই এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক থাকবেনা, হুজুররাও আর নিজের খেয়েদেয়ে অন্যের বকুনি শুনতে হবেনা। আপনাদের জন্য শুধু শুধু ধর্মব্যবসায়ী বলে হুজুরদের মানহানি করা ও পেছনে লেগে মজা করারও প্রয়োজন পড়বেনা।

শেষ কথা হল, একাডেমিক শিক্ষা না থাকলে অবস্থা এমনি হয়। আল্লাহ এদের ধোকা থেকে আমাদের রক্ষা করুন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here