‘আগমনকারী ইমাম মাহদীর-ই আরেক নাম ঈসা ইবনে মরিয়ম’ একটি মিথ্যা ও তার খন্ডন :
তাত্ত্বিক ও যুক্তিক খন্ডন : তাদের উপরিউক্ত বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনু মরিয়াম’ (যার অর্থ তাদের কৃত অনুবাদ অনুসারে) ‘প্রতিশ্রুত মাহদী (আ.) আগমনকারী ঈসা ইবনে মরিয়ম ছাড়া অন্য কেউ নন’। এই হিসেবে তাদের বিচারে, প্রতিশ্রুত ঈসা পূর্বের ঈসা নন, বরং এটি ইমাম মাহদীরই একটি পরিচয়। আর সেই কারণেই ইমাম মাহদী দাবিকারী মির্যা কাদিয়ানী একই সাথে রূপক অর্থে হযরত ঈসাও। (নাউযুবিল্লাহ)। আবার তাদের এও দাবী, হাদীসে দুই ঈসার বৃত্তান্ত রয়েছে। এবার তাদের দাবীগুলোর ধারাবাহিক খন্ডন করা হবে!
প্রথমত, উল্লিখিত ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনু মরিয়ম’ বর্ণনাটি কাদিয়ানিদের লিফলেটে যেইটুকু উল্লেখ আছে সেইটুকুতে শেষ নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ হাদীসটির মাত্র এক পঞ্চমাংশ। সম্পূর্ণ হাদীস দেখলে যে কেউই অনুধাবন করতে পারবে যে, উক্ত খন্ডিত অংশটি ধরে কাদিয়ানিরা যেই অর্থ নিয়ে থাকে তা পুরোপুরি ভুল ও বাতিল।
আমি তাদেরকে প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে ওই একই বর্ণনার মধ্যে ‘ওয়া লান নাসু ইল্লা শুহ্হান’ [ولا الناس إلا شحا]-এর কেমন অর্থ হবে? তার অর্থও কি ‘যত মানুষ রয়েছে তারা কৃপণ ছাড়া আর কেউ নন’ অনুরূপ হবে? তবে কি নবী রাসূলগণও কৃপণদের অন্তর্ভুক্ত? লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।
দ্বিতীয়ত, হাদীসটিতে শেষযুগের অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে। সেগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার পরেই বলা হয়েছে ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনু মরিয়ম’। এতে শুরুতে যেই ‘ওয়াও’ [و] রয়েছে সেটি আরবী ব্যাকরণের ভাষায় ‘ওয়ায়ে হালিয়াহ’ [الواو الحالية]। সেহিসেবে এর অর্থ দাঁড়াবে, তখন একমাত্র পরিপূর্ণ সুপথপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি ঈসা ইবনু মরিয়ম ছাড়া অন্য কেউ নন। উল্লেখ্য, প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর ইন্তিকালের পরেও ঈসা (আ.) কমবেশি আরো প্রায় চল্লিশ বছর বেঁচে থাকবেন। (আবুদাউদ, কিতাবুল মালাহিম)। এখানে ‘তখন’ বলে মূলত সেদিকেই ইংগিত করা হয়েছে। এই সম্পর্কে পূর্বেও প্রমাণ করা হয়েছে যে, ঈসা আর ইমাম মাহদী এঁরা মূলত দুইজনই। (দেখুন, সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)।
- আসল কথা হল, ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা’ এই হাদীস সনদের বিচারে সকলের নিকট এমনকি মির্যা কাদিয়ানীর নিকটেও দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। মির্যা কাদিয়ানী নিজেও তার ‘হামামাতুল বুশরা’ (ঊর্দূ)’র ১৭৮ নং পৃষ্ঠায় [বাংলা অনূদিত পৃ-১৬১] ‘ইবনে মাজাহ’-র হাদীসটির সনদ (সূত্র)-কে দুর্বল, ত্রুটিপূর্ণ এবং অনির্ভরযোগ্য বলে-ই স্বীকার করেছেন। স্ক্রিনশট দেখুন-
হাদীস শাস্ত্রের যুগ বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণও হাজার বছর আগেই বলে গেছেন যে, “ওয়া লাল মাহদী” ওয়ালা বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য নয়। স্ক্রিনশট দেখুন!
জেনে আশ্চর্য হবেন, একজন ‘মুলহাম’ এবং ‘ইমাম মাহদী’ দাবী করা অবস্থায় মির্যা কাদিয়ানী আপনা ‘তুহফায়ে গোলডবিয়া’ (প্রথম প্রকাশ, আগস্ট ১৯০২ইং) নামক বইতে লিখে গেছেন : اور ہم ثابت کر چکے ہیں کہ وہی رجل فارسی مہدی ہے اس لئے ماننا پڑا کہ مسیح موعود اور مہدی اور دجال تینوں مشرق میں ہی ظاہر ہوں گے اور وہ ملک ہند ہے۔ অর্থাৎ এবং আমি প্রমাণ করেছি যে, সেই পারস্যের পুরুষটি-ই মাহদী। যেজন্য মানতে হবে যে, মসীহ মওঊদ, মাহদী এবং দাজ্জাল তিনোজন পূর্বদিকেই প্রকাশিত হবে আর সেই রাষ্ট্রটি হচ্ছে হিন্দুস্থান।” (রূহানী খাযায়েন ১৭/১৬৭ দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট :
এবার ‘মসীহ আর মাহদী’ একই ব্যক্তি হলে ‘তিনো’ (উর্দূ) শব্দের কী মানে? তবে কি মসীহ + মাহদী + দাজ্জাল = একজন? পরিশেষে বলে রাখতে চাই, আক্ষরিক অর্থে চারো খলীফা ‘আল-মাহদী’ তথা সুপথপ্রাপ্ত [তিরমিযী শরীফ, কিতাবুল ইলম হা/২৬৭৬]। এই দিক থেকে নবীগণ সবাই ‘মাহদী’। এমনকি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ও ‘মাহদী’। এগুলো স্বয়ং মির্যা সাহেবই লিখে গেছেন। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১৪/৩৯৪)। সুতরাং বুঝা গেল, আক্ষরিক অর্থে ঈসা (আ:)-কে ‘মাহদী’ সম্বোধন করা হলেও সমস্যা নেই। তাতে দুইজনকে একই ব্যক্তি বুঝাবেনা। সব চে বড় কথা হল, “ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা” সংক্রান্ত হাদীসটি স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীর বইতেও ক্রুটিপূর্ণ, দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলেই লিখা আছে। তাই যে সমস্ত কাদিয়ানী ঈসা আর মাহদীকে একই চরিত্রের অভিন্ন সত্তা দাবী করে প্রমাণ স্বরূপ উক্ত বর্ণনাটি পেশ করেন তারা প্রকারান্তরে মির্যাকেও অস্বীকার করল!
- লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক