কাদিয়ানীদের দাবীর মূল ভিত্তি হযরত ঈসা (আ:)-এর মৃত্যু :
এই কথা সবাই জানেন যে, মুসলিম উম্মাহার মূল আপত্তি হল, মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়ত দাবী। কিন্তু তার অনুসারীরা সেদিক থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে ‘ওফাতে ঈসা’ সম্পর্কিত বিষয়কে বরাবরই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে, যা একদমই অপ্রসঙ্গিক একটি বিষয়। এখানে বলে রাখা দরকার যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় ঈসা (আ:)-কে মৃত সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যই হল আগত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর কুরসিতে মির্যা কাদিয়ানীকে একজন নকল ঈসারূপে বসানো! মূলত এইজন্যই তারা ঈসা (আ:)-কে যে কোনো মূল্যে মৃত প্রমাণ করতে এক পায়ে খাড়া। প্রয়োজনে তারা পবিত্র কুরআনকেও মনগড়া ব্যাখ্যার নিশানা বানাতে কুণ্ঠিতবোধ করবেনা। তারা বিশেষত, পবিত্র কুরআনের (আলে ইমরান/০৩:৫৫ এবং ১৪৪) এবং (আল মায়েদা/০৫:১১৭) আয়াতগুলো বিকৃত অনুবাদ ও মনগড়া ব্যাখ্যাসহ পেশ করে থাকে।
এখানে শুধুমাত্র সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৪৪ এর জবাব দেব, ইনশাআল্লাহ। প্রথমে আয়াতটির সঠিক অনুবাদ,
(আরবী) وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِہِ الرُّسُلُ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡہِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰہَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیَجۡزِی اللّٰہُ الشّٰکِرِیۡنَ
অর্থাৎ মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র; তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিবে? এবং কেহ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিলে সে কখনও আল্লাহ ক্ষতি করিতে পারিবে না; বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করিবেন।” (অনুবাদ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন/ইফা)। বলে রাখা দরকার যে, কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা হেকিম নূরউদ্দীনও আয়াতটির ‘আর-রসুল’ (الرسل) হতে ‘বহু রাসূল’ (بہت رسول) অর্থ নিয়েছেন। (দেখুন, ফাছলুল খিতাব লি-মুকাদ্দিমাতি আহলিল কিতাব [উর্দূ] পৃষ্ঠা ২৮; রচনা ১৮৮৭-৮৮ইং দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট সহ আর্টিকেল নং ২ দ্রষ্টব্য। দেখুন।
ব্যাখ্যা-মূলক জবাব : এই আয়াত ঈসা (আ:) সহ পূর্বেকার কোনো নবী রাসূলকে মৃত কিবা জীবিত কোনোটাই সাব্যস্ত করার জন্য নাযিল হয়নি। আয়াতের প্রেক্ষাপট দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয়। মনে রাখতে হবে যে, গত হওয়া মানে শুধু মরে যাওয়া বুঝায় না, দায়িত্বে বর্তমান নেই অথবা একস্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকেও এই অর্থে অন্তর্ভুক্ত করবে। তার স্থানান্তরিত হওয়াটা হোক মৃত্যুর মাধ্যমে কিংবা সশরীরে রাফা বা উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। উভয় অবস্থায় এই ক্ষেত্রে খালা/খালাত (خلا، خلت) শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। একজন জ্ঞানী মাত্রই বুঝতে পারে যে, এই আয়াতে আল্লাহতালা ‘মউত’ (قد ماتت) শব্দের পরিবর্তে ‘খালা’ (قد خلت) শব্দের উল্লেখের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে! এমন ব্যতিক্রমী শব্দ-প্রয়োগের মধ্যে মহান রাব্বুল আলামীনের কী রহস্যটা লুকায়িত! হ্যাঁ, এখানে রহস্যটা এই যে, ‘খালা’ শব্দ-প্রয়োগের কারণে এমন সব রাসূলকেও ‘গত হয়ে যাওয়া’ অর্থে শামিল করতে পারে, মৃত্যুর মাধ্যমে যাদের স্থানান্তর হওয়া জরুরি নয়; বরং রাফা বা উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমেও স্থানান্তরের ঘটনা ঘটা যথেষ্ট।পবিত্র কুরআনে এমন সব ‘গত হয়ে যাওয়া’ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ‘খালা’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে যাদের ‘গত হয়ে যাওয়াটা’ মউতের মাধ্যমে ঘটেনি। যেমন আল্লাহতালা বলেন, (আরবী) اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ بِالۡحَقِّ بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا ؕ وَ اِنۡ مِّنۡ اُمَّۃٍ اِلَّا خَلَا فِیۡہَا نَذِیۡرٌ অর্থাৎ আমি তো তোমাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; এমন কোনো সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি (সূরা ফাতির/৩৫:২৪)। অন্য এক জায়গায় এসেছে, (আরবী) وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قَالُوۡۤا اٰمَنَّا ۚۖ وَ اِذَا خَلَوۡا اِلٰی شَیٰطِیۡنِہِمۡ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا مَعَکُمۡ ۙ اِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَہۡزِءُوۡنَ অর্থাৎ যখন তারা বিশ্বাসীগণের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা বিশ্বাস করেছি। আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তান (মুনাফিক দলপতি)দের সাথে (গিয়ে) মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তো তোমাদের সাথেই রয়েছি; আমরা শুধু তাদের সাথে পরিহাস করে থাকি (সূরা বাকারা/০২:১৪)। অতএব বুঝা গেল যে, সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৪৪ এর মধ্যেও যে ‘খালা’ (মাসদার/ক্রিয়ামূল الخلو) রয়েছে সেটি ‘আম’ বা ব্যাপক অর্থকে নির্দেশ করবে। চাই তো ‘গত হয়ে যাওয়া’ ব্যক্তিটি মারা যাক কিংবা রাফার মাধ্যমে সশরীরে কোথাও স্থানান্তরিত হয়ে যাক!
নির্বোধ কাদিয়ানীদের প্রতি আমার শুধু একটি প্রশ্ন। পবিত্র কুরআনের সূরা হাজ্জ, আয়াত নং ৬৬ এর মধ্যে এসেছে, (আরবী) وَ هوَ الَّذِیۡۤ اَحۡیَاکُمۡ ۫ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡکُمۡ ؕ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَکَفُوۡرٌ অর্থাৎ তিনিই তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন; অতঃপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পুনরায় তোমাদেরকে জীবন দান করবেন। নিশ্চয় মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ (সূরা হাজ্জ/২২:৬৬)। আয়াতটিতে আল্লাহতালা মৃত্যু অর্থের জন্য সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘মউত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অথচ তিনি সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৪৪ এর ক্ষেত্রে ‘মউত’ শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করেছেন ‘খালা’ শব্দ যেটি দ্বৈত অর্থের নির্দেশকারী। অর্থাৎ রাফা বা উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে যিনি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যান তাকেও সেই অর্থে শামিল করে থাকে। আল্লাহর এই ব্যতিক্রমী শব্দচয়নের উদ্দেশ্য কী? জানি কোনো উত্তর নেই! বলাবাহুল্য যে, আল্লাহর এইরূপ ব্যতিক্রমী শব্দচয়ন দ্বারাই সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে তখন من قبله الرسل এর ভেতর الرسل হতে ‘সমস্ত রাসূল’ অথবা ‘সব রাসূল’ অর্থ গ্রহণ করলেও অন্তত আয়াতটির ‘খালা’ (قد خلت) শব্দ দ্বারা সমস্ত রাসূলের গত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘মৃত্যু’ বুঝানো জরুরি নয়। বড়জোর শব্দটির রূপক অর্থ হিসেবে ‘মউত’ বা মৃত্যু নেয়া সত্ত্বেই কতিপয় রাসূল ব্যতীত বাকি সমস্ত রাসূলকে মৃত বুঝাতে পারে! কেননা الرسل এর শুরুতে যুক্ত ال-কে ‘আহদে খারেজি’ বলা হয়। যার অর্থ, বিভিন্ন কারীনা বিদ্যমান থাকায় এখানে শর্ত প্রযোজ্য। মির্যায়ীদের নানা লিটারেচার-ও একথার সাক্ষী। প্রমাণের জন্য এখানে ক্লিক করুন। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে অত্র বিষয়ে লেখিত আর্টিকেলগুলোও পড়া যেতে পারে। উপরে লিংক দেয়া হয়েছে, দেখুন।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক