মৃত ব্যক্তিকে দাফনকালে ‘মিনহা খালাক্বনাকুম’ পড়ার বিধান কী?

0
মৃত ব্যক্তিকে দাফনকালে ‘মিনহা খালাক্বনাকুম’ পড়ার বিধান কী?

জানাযাকে কবর দেয়ার সময় ‘মিনহা খালাক্বনাকুম…’ আয়াতটিকে ৩ ভাগ করে পড়া এবং তিন মুষ্টি করে মাটি দেয়ার শরয়ী বিধান সম্পর্কে,

প্রশ্ন, উল্লিখিত পদ্ধতি নাকি ভিত্তিহীন ও বিদয়াত? জনৈক ব্যক্তি বলেছেন, এ সম্পর্কে নাকি কোনো হাদীস পাওয়া যায় না!

উত্তর, আলোচ্য বিষয়ে বলা হয় যে, উপরে উল্লিখিত জিজ্ঞাসায় ‘কোনো হাদীসই পাওয়া যায় না’ একথা সঠিক নয়। তবে ইনসাফের দৃষ্টিতে বলা যেতে পারে যে, এ সংক্রান্ত কোনো বর্ণনাই সূত্রের বিচারে সহীহ নয়, বড়জোর দুর্বল। বলাবাহুল্য, কখনো কখনো কোনো হাদীসের প্রতি সহীহ হওয়ার হুকুম লাগানো হয় যখন তা উম্মাহার আয়েম্মায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসীন কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করেন। যদিও তার কোনো সহীহ সনদ না থেকে থাকে। হাফেয সাখাবী (রহ.) ফাতহুল মুগীছ (فتح المغيث بشرح ألفية الحديث) গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন, إذا تلقت الأمة الضعيف بالقبول يعمل به على الصحيح حتى أنه ينزل منزلة المتواتر في أنه ينسخ المقطوع به ولهذا قال الشافعي رحمه الله في حديث لا وصية لوارث إنه لا يثبته أهل الحديث ولكن العامة تلقته بالقبول وعملوا به حتى جعلوه ناسخا لآية الوصية له অর্থাৎ উম্মত যখন কোনো জঈফ হাদীসকে কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করে তখন তার উপর আমল করা হবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী। এমনকি তা মুতাওয়াতের এর পর্যায়ে পৌছে যায়। ফলে তা অটাক্যভাবে প্রমাণিত কোনো বিষয়কেও রহিত করে দেয়। এজন্যই ইমাম শাফেয়ী (রহ.) “ওয়ারিসের জন্য কোনো ওসিয়ত নেই” এই হাদীসের ব্যপারে বলেছেন, মুহাদ্দিসীনে কেরাম উক্ত হাদীসটি সহীহ সনদে মেনে নেননি। তবে উম্মত তা গ্রহণ করেছেন এবং তার উপর আমল করেছেন। এমনকি কুরআনের ওসিয়তের আয়াতকে পর্যন্ত তা রহিত করে দিয়েছে “। (হাফেয সাখাবী, ফাতহুল মুগীছ খণ্ড ১ পৃষ্ঠা নং ৩১২)। মূলত সেই উসূল বা নীতির প্রেক্ষিতে আরব বিশ্বের বিখ্যাত মুফতিয়ে আজম, শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজ (রহ.) লিখেছেন, মৃত ব্যক্তিকে কবরে নামিয়ে মাটি দেয়া মুহূর্তে পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহা আয়াত নং ৫৫ এর ‘মিনহা খালাক্বনাকুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তা-রাতান উখরা’ তিন ভাগ করে পড়া এবং সে সাথে ‘বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’ (مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى) পড়া সুন্নাহ। (মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতে শায়খ বিন বাজ খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ১৯৬)। সুতরাং বুঝা গেল, উম্মাহার মাঝে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা আমলটিকে যারা বিদয়াত বলছেন তারা স্বল্প জ্ঞান, সংকীর্ণ গবেষণা ও চিন্তার চরম দুর্বলতার শিকার। অন্যথা যেখানে বরেণ্য ইমাম শায়খ বিন বাজ (রহ.) এর মত বিখ্যাত মুফতিয়ে আজমের ফতুয়া বিদ্যমান, সেখানে পরবর্তীতে নতুন করে এ বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য দেয়া উম্মাহকে বিভ্রান্ত করার শামিল বৈ নয়।

  • এবার সম্পর্কিত আরও যা উল্লেখ করতে যাচ্ছি তা হল,

উল্লিখিত মাসয়ালাটি বর্তমানে যে বা যারা বিদয়াত বলে জনমনে সংশয় তৈরি করার চেষ্টা করছে তাদের বিপরীতে নির্ভরযোগ্য ইমামগণের রচনায় কী উল্লেখ আছে দেখুন! (১) ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.) তাফসীরে ইবনে কাসীর গ্রন্থে লিখেছে, (আরবী) وفي الحديث الذي في السنن أن رسول الله صلى الله عليه وسلم حضر جنازة ، فلما دفن الميت أخذ قبضة من التراب فألقاها في القبر ثم قال ( منها خلقناكم ) ثم أخذ أخرى وقال : ( وفيها نعيدكم ) . ثم أخذ أخرى وقال : ( ومنها نخرجكم تارة أخرى ) অর্থাৎ সুনান গ্রন্থগুলোর হাদীসে উল্লেখ আছে যে, রাসূল (সা.) অবশ্যই জানাযায় হাজির হতেন অত:পর মাইয়্যেতকে দাফন করতে মুষ্টিময় মাটি নিতেন। এরপর তিনি যখনি কবরে মাটি ঢালতেন তখন পড়তেন منها خلقناكم এরপর আবার মাটি নিতেন এবং পড়তেন وفيها نعيدكم এরপর তিনি আবার মাটি নিতেন এবং পড়তেন ومنها نخرجكم تارة أخرى {তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা ত্বহা ৫৫ দ্রষ্টব্য }। (২) ইমাম শায়খ বিন বাজ (রহ.) লিখেছেন, (আরবী) س: ما حكم قول: مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى. [طه:٥٥] عند الدفن؟ ج: هذا سنة، ويقول معه: بسم الله والله أكبر. (مجموع فتاوى ومقالات الشيخ ابن باز ١٣/ ١٩٦) অর্থাৎ প্রশ্ন, দাফনের সময় ‘মিনহা খালাক্বনাকুম’…পড়ার শরয়ী বিধান কী? উত্তর, এটি সুন্নাহ, আর সে সাথে বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার পড়বে। (৩) এবার বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু উমামাহ (রা.) হতে বর্ণিত একটি মারফূ হাদীস উল্লেখ করছি। (আরবী) لما وضعت أم كلثوم بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم في القبر قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : منها خلقناكم وفيها نعيدكم ومنها نخرجكم تارة أخرى অর্থাৎ, রাসূল (সা.)-এর কন্যা উম্মে কুলছুমকে যখন কবরে রাখলেন তখন রাসূল (সা.) ‘মিনহা খালাক্বনাকুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তা-রাতান উখরা’ পড়েছেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৬৫১৭)। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) হাদীসটি স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে যে সনদে এনেছেন সেটি জঈফ (দুর্বল) বলে উল্লেখ রয়েছে। তথাপি হানাফী, শাফেয়ী এবং মালেকি মাযহাবের ফাকিহগণ হাদীসটির কন্টেন্টকে আমলে নিয়েছেন এবং আমল ও ফাজায়েল সংক্রান্ত বিষয়ে সূত্রে কিছুটা দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সেটিকে শর্তমতে ন্যূনতম মুস্তাহাব হবার দলিল হিসেবেই বেছে নিয়েছেন। আমরা এই সংক্রান্ত অপরাপর আরও বহু দলিল প্রমাণ পেশ করতে পারব। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) স্বীয় ‘মুসনাদে শাফেয়ী’ গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন এইরূপ (আরবী) وعن جعفر بن محمد عن أبيه , { أن رسول الله صلى الله عليه وسلم حثى على الميت ثلاث حثيات بيديه جميعا } অর্থাৎ নিশ্চয়ই রাসূল (সা.) মৃত ব্যক্তিকে উভয় হাতে তিন মুষ্টি করে মাটি দিয়েছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকেও একই আমল প্রমাণিত। হাদীসের ভাষ্য হল (আরবী) وروي عن ابن عباس , أنه لما دفن زيد بن ثابت حثى في قبره ثلاثا অর্থাৎ ইবনে আব্বাস (রা.) যায়েদ বিন সাবেতকে দাফন করতে যখন আসলেন তিনি তখন তাঁর কবরের উপর তিন মুষ্টি করে মাটি ঢেলেছেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদীস নং ৬৪৭৯)। কাজেই এই বিষয়ে উম্মাহার সর্বজন বরেণ্য ফকিহগণের ফতুয়া থাকায় বর্তমান এই ফেতনার যুগে ঐ মীমাংসিত ফিকহের বিপরীতে নতুনভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা প্রকারান্তরে ফেতনা করারই নামান্তর। এবার শারেহে মুসলিম ইমাম নববী (রহ.) এর রচিত ‘আল-মাজমু’ শরহুল মুহাজ্জাব’ (المجموع شرح المهذب) থেকে উদ্ধৃত করছি, তিনি লিখেছেন (আরবী) يستحب لكل من على القبر أن يحثي عليه ثلاث حثيات تراب بيديه جميعا بعد الفراغ من سد اللحد, وهذا الذي ذكرته من الحثي باليدين جميعا نص عليه الشافعي في الأم, واتفق الأصحاب عليه অর্থাৎ কবরের উপর প্রত্যেকের জন্য এটি বাঞ্ছনীয় যে কবর সমাপ্ত করার পরে উভয় হাতে তিন মুঠো মাটি ঢেলে দেওয়া। আর উভয় হাতে মাটি ঢেলে দেয়ার পুরো যে ব্যাপারটা আমি উল্লেখ করলাম তা ইমাম শাফেয়ী (রহ.) স্বীয় “আল-উম্ম” (الام) কিতাবে প্রমাণ করেছেন। তাঁর এই প্রমাণের উপর সমস্ত হাদীসবিশারদ একমত পোষণ করেছেন। (৪) ইমাম ইবনুল কুদামাহ আল হাম্বলী (রহ.) স্বীয় আল-মুগনী (المغنى) কিতাবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন, (আরবী) أنه حضر جنازة , فلما ألقي عليها التراب , قام إلى القبر , فحثى عليه ثلاث حثيات অর্থাৎ “তিনি (আহমদ ইবনে হাম্বল) একদা একটি জানাযায় হাজির হন, যখন মাটি দেয়ার সময় হল তিনি কবরের নিকটে দাঁড়ান এবং তিন মুষ্টি করে কবরে মাটি দেন।” এভাবে আরও বহু দলিল প্রমাণ পেশ করা যাবে। সুতরাং সালফে সালেহীনের আমল দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য বিষয়ে নস বা দলিল প্রমাণ অবশ্যই মজুদ রয়েছে। নইলে সালাফদের ঐ সমস্ত কাজকেও কি বিদয়াত বলবেন? লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ!

প্রমাণ্য স্ক্রিনশট

ফাতহুল মুগীছ, ইমাম সাখাবী ১/৩১২
শায়খ বিন বাজ (রহ.) এর ফতুয়া
তাফসীরে ইবনে কাসীর

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here