জনৈক বিদয়াতি নির্বোধ বক্তা ‘তাহযীরুন্নাস‘ (تحذير الناس) কিতাবের নামে ভুল আর বিকৃত উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, কাসেম নানুতবী সাহেব নাকি ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ অর্থ শেষনবী নয়, বলেছেন!
- (এ সংক্রান্ত এ লিখাটিও পড়া যেতে পারে। এখানে ক্লিক করুন – https://markajomar.org/?p=6212)
উত্তর, তাহযীরুন্নাস কিতাবটি ফার্সি ভাষায়। অনেকে উর্দূ ভাষায়ও কনভার্ট করেছেন। আসুন তাহলে মাজলুম মওলানা সাহেবের কিতাবে এই বিষয়টি কিভাবে উল্লেখ আছে জেনে নিই। (আরও সংক্ষেপে ফেইসবুক থেকে পড়ুন)।
মওলানা নানুতবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মওলানা কাসেম নানুতুবী (১৮৩২-১৮৮০) ছিলেন উপমহাদেশের একজন মুসলিম পণ্ডিত। তিনি বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের নিকট নানুতা নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ শহরে তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি দেওবন্দ যান এবং মৌলভী মাহতাব আলীর মাদরাসায় শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি শাহারানপুর যান। সেখানে তার নানার সাথে অবস্থান করেন। শাহারানপুরে মৌলভী নওয়াজের তত্ত্বাবধানে তিনি আরবী ব্যাকরণ বিষয়ে প্রাথমিক গ্রন্থাদী পাঠ করেন। ১৮৪৩ সালের শেষের দিকে মামলুক আলী (রহ.) তাকে দিল্লি নিয়ে যান। সেখানে তিনি কাফিয়া ও বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি মাদরাসা গাজিউদ্দিন খানে ভর্তি হন। তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুলউলুম দেওবন্দ-এর প্রতিষ্ঠাতা।
মওলানা নানুতবী (রহ.) সাহেব লিখেছেন : اگر بالفرض آپ کے زمانہ میں بھی کہیں اور کوئی نبی ہو جب بھی آپ کا خاتم ہونا بدستور باقی رہتا ہے۔ অর্থাৎ “বিল-ফারজ তথা যদি ধরে নেয়া হয় যে, হুজুর (সা:)-র যামানায়ও কোথাও কেউ নবী হয়েছে তবুও হুজুর (সা:)-এর ‘খাতাম’ থাকা বরাবরই বহাল থাকবে।” (তাহযীরুন্নাস পৃ. ৩৮; হুজ্জাতুল ইসলাম একাডেমী ওয়াক্বফে দারুলউলুম দেওবন্দ, সাহারানপুর হতে প্রকাশিত)।
এতে বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে যে, মওলানা নানুতবী সাহেব (রহ.) বোধহয় বর্তমানেও নবী হবে অথবা নবী হওয়া সম্ভব বুঝাতে চেয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ সমালোচনাকারীদের জন্য দুঃসংবাদ হল, তিনি নিজ বইটির ৩৭ নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার এও লিখেছেন যে, اطلاق خاتم اس بات کو مقتضی ہے کہ تمام انبیاء علیہم السلام کا سلسلہ نبوت آپ پر ختم ہوتا ہے অর্থাৎ “খাতাম (خاتم)-এর প্রয়াগ এই কথারই দাবী রাখে যে, হুজুর (সা:)-এর উপরই সমস্ত নবীর নবুওয়তেরধারা শেষ হয়ে গেছে।” এবার মওলানা’র বিরুদ্ধে আরোপিত উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যামূলক উত্তর নিচে উল্লেখ করছি,
প্রথমত, তাঁর (মওলানা কাসেম নানুতবী) বক্তব্যের শুরুতেই ‘বিল-ফারজ’ (بالفرض) শব্দ উল্লেখ রয়েছে। যার তাৎপর্য হল- “যদি ধরে নেয়া হয়”। অর্থাৎ মওলানা’র কথাটি প্রকৃতার্থে ছিলনা, বরং ফারজী বা ‘যদি ধরে নেয়া হয়’ এরকম ছিল। পবিত্র কুরআনেও ফারজী অর্থে আল্লাহতালা বলেছেন, لو كان فيهما آلهة الا الله لفسدتا অর্থাৎ ‘যদি আসমান জমিনে আল্লাহ ছাড়াও কোনো ইলাহ থাকত তাহলে উভয়ই নিশ্চিত ধ্বংস হয়ে যেত।’ কিন্তু কোনো নির্বোধও এইজন্য একথা মনে করেনা যে, আল্লাহ ছাড়াও দ্বিতীয় কোনো ইলাহ বোধহয় থাকতে পারে!
দ্বিতীয়ত, উক্ত বক্তব্যটিতে বিদ্যমান ‘খাতাম’ (خاتم) শব্দটি মওলানা’র শুধুমাত্র ‘খাতামিয়তে মুরতাবী’ বিশ্লেষণের আলোকেই ছিল। যেহেতু তাঁর মতে খাতামিয়তে মাকানী, যামানী এবং মুরতাবী–সবদিক থেকে নবীজি (সা.) খাতামুন নাবিয়্যীন। তিনি যেন বুঝাতে চাচ্ছেন, মুহাম্মদ (সা.) শুধুই শেষনবী ছিলেননা।কারণ, শেষে হওয়ার মধ্যে মূলত স্বতন্ত্র কোনো ফজিলত থাকেনা। তাই মওলানা সাহেব ‘খাতাম’ শব্দের মর্মার্থকে ‘খাতামিয়তে যামানী’-এর সাথে খাস করাকে স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন সাধারণ মানুষদের ধারণা বলে আখ্যা দেন।
উল্লেখ্য, মওলানা নানুতবী সাহেব তার বক্তব্যে ‘খাতাম’ শব্দকে দার্শনিক উপায়ে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন মাত্র। ফলে নির্বোধ আর মাথামোটাদের নিকট তার বক্তব্যের উদ্দেশ্য বুঝা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। মূলত বিদয়াতীরা এ থেকেই ছিদ্র খুঁজতে শুরু করে। পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা ভুলে গিয়ে ইচ্ছেমতো অপপ্রচার শুরু করে।
যাইহোক, মওলানা’র উল্লিখিত বক্তব্যের তাৎপর্য দাঁড়াচ্ছে, ‘যদি ধরে নেয়া হয় যে, নবীজি (সা.)-র যামানায়ও কোথাও কেউ নবী হয়েছে তবু হুজুর (সা.)-এর ‘খাতাম’ (অর্থাৎ খাতামীয়তে মুরতাবী বা সর্বোচ্চ মর্যাদার শেষ মার্গে অধিষ্ঠিত থাকা) বরাবরই বহাল থাকবে।’
পাঠকবৃন্দ, এবার নিজেরাই চিন্তা করুন নির্বোধ মাথামোটারা কিভাবে মওলানার বক্তব্যকে নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করে দরাকে সরা বানিয়ে ফেললো! অথচ মওলানা নানুতবী এখানে ‘খাতাম‘ শব্দ থেকে ‘মুরতাবী‘ (مرتبى) অর্থই উদ্দেশ্য নিয়েছেন, ‘যামানী’ বা ‘মাকানী’ অর্থকে উদ্দেশ্য নেননি। যার ফলে তাদের উল্লিখিত আপত্তি ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যমূলক। অপ্রিয় হলেও সত্য, বিদয়াতীদের একটা অংশ (বিশেষত বেরেলিরা) মওলানার বিরুদ্ধে এই প্রপাগাণ্ডা মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলি থেকেই লুপে নিয়েছিল।
আল্লাহতালা এইধরনের মিথ্যাচারকারীদের সহীহ বুঝ দিন। নয়ত ধ্বংস করে দিন।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক