কুরবানীর শর’ঈ হুকুম ইখতিলাফ ও পর্যালোচনা

0
কুরবানীর শর’ঈ হুকুম ইখতিলাফ ও পর্যালোচনা

কুরবানী বা الأضحية এর শর’ঈ হুকুম, ইখতিলাফ ও পর্যালোচনা

কুরবানী حكما (নির্দেশগত) ওয়াজিব, طريقة (আদর্শগত) সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, এভাবে-ও توضيح বা ক্লিয়ারেন্স দেয়া যায়, তাহলে কোনো মতবিরোধ থাকেনা, বলাবাহুল্য, রাসূল (সা.) আজীবন “কুরবানী” এর বিধান পালন করে গেছেন, জীবনে একবারের জন্যও তিনি মিস করেননি। এটাও প্রমাণ করে যে, কুরবানী বিধানগত ওয়াজিব বা আবশ্যক, প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে কুরবানী দিতে হবে। ইবনে মাজাহ (হাসান, তাহকিক আলবানী) এর একটি হাদীসে (فلا يقربنّ مصلانا) এসেছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী দিবেনা সে যেন আমাদের মুসাল্লা-এর (তথা ঈদগাহের) নিকটবর্তীও না হয়। কুরবানীর বিধান পবিত্র কুরআন (فصلِّ لربِّك وانحر) দ্বারা সাব্যস্ত। আবূ দাউদ শরীফের (হা-২৪৮৭, সহীহ) একখানা হাদীস (يا أيها الناس إنّ على أهل كل بيتٍ أضحيةً في كل عام) দ্বারাও বুঝা যায় যে, কুরবানী প্রত্যেক বছর বিধিবদ্ধ। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) এ ধরনের বিভিন্ন দলীল ও প্রমাণের ভিত্তিতে “কুরবানী” ওয়াজিব (والأظهر وجوبها), এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হন। দেখুন, মাজমূ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ খ-২৩ পৃ-১৬২।

শেষকথা হল, কুরবানী বিধানগত “ওয়াজিব” এটাই স্বীকৃত ও চূড়ান্ত, তবে কুরবানী ইবরাহীম (আ.) এর ঐতিহাসিক স্মৃতি স্মারক হিসেবে শরীয়তে মুহাম্মদীয়ায় আমাদের জন্য (سنة ابيكم ابراهيم) “সুন্নাতে ইবরাহীম” হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত। আরও সহজ করে বললে কুরবানী হচ্ছে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নাহ। আমাদের দেশে গয়ের মুকাল্লিদ শায়খদের কেউ কেউ “কুরবানী”-কে হয়ত সেই সূত্রে ‘সুন্নাহ’ বলতে চান। শায়খ উসাইমিন (রহ.)ও এ মতের প্রবক্তা। ডক্টর মঞ্জুর ইলাহী হাফিজাহুল্লাহ’র কথাটি খুব চমৎকার লেগেছে, তিনি ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.)-এর তাহকিককেই প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, কুরবানী “ওয়াজিব” এটাই সঠিক রায়। যুক্তিও বলে যে, কুরআনে যে সমস্ত নির্দেশ ইংগিতে থাকে আর হাদীস সেটিকে শর্তসাপেক্ষ (নেসাব, অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন থেকে মুক্ত হওয়া শর্তে) বিধিবদ্ধ করে, সে সমস্ত নির্দেশ “ওয়াজিব”-কেই নির্দেশ করবে, সুন্নাহ হওয়াকে নয়।

শরীয়তের একটি মাসয়ালাও রয়েছে যে, সুন্নাহ-কে কেউ অস্বীকার করলে সে বড়জোর ফাসেক হবে, কাফের হবেনা কিন্তু কুরবানীকে অস্বীকার করলে ব্যক্তি “কাফের” হয়ে যাবে। কেননা কুরবানীকে অস্বীকার করার অর্থই হল পবিত্র কুরআনকে আংশিক (فصلِّ لربِّك وانحـر) অস্বীকার করা, যা সুস্পষ্ট কুফুরী। কেননা কুরআনের সূরা মায়েদা, আয়াত-২৭, সূরা আনআম, আয়াত ১৬২-১৬৩, সূরা হজ, আয়াত ৩৪-৩৫ এবং সূরা হজ, আয়াত ৩৬, সূরা হজ, আয়াত ৩৭-৩৮, সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২, সূরা কাউসার, আয়াত ২, কুরবানী সম্পর্কেই বিধৃত হয়েছে।

সুতরাং কুরবানী “ওয়াজিব” এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধান প্রধান মুজতাহিদ ইমামগণের মধ্যে আবূ হানীফা, মালিক (ইমাম মালিকের দুটি মত : সুন্নাহ এবং ওয়াজিব, কিন্তু জাহেরি রেওয়ায়েত বা চূড়ান্ত মতানুযায়ী ‘ওয়াজিব‘ – মাজমু’ ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়াহ ২৩/১৬২) এবং আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম আওযা’ঈ, লাইছ প্রমুখ সকলের মতে এটি ওয়াজিব

প্রামাণ্য স্ক্যানকপি

কিছু সংখ্যক সাহাবীর ব্যাপারে বলা হয় যে, তারা কোনো কোনো বছর কুরবানী করা থেকে বিরত ছিলেন। এর উত্তর হচ্ছে, কুরবানী একটি শর্তসাপেক্ষ শর’ঈ হুকুম। হয়ত বা উনারা সেই শর্তে ঐ বছর গুলোতে উত্তীর্ণ হননি, অথবা তারা সুনির্দিষ্ট কোনো ইল্লাত বা কারণকে সামনে রেখে ইজতিহাদ করায় সেই কারণের ভিত্তিতে তারা ঐ বছরগুলোতে কুরবানী থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। সেই ইল্লাত বা কারণটি ছিল, সাধারণ মানুষের কুরবানীর হুকুমকে অলঙ্ঘনীয় বিধান ভেবে যেন পদস্খলন না ঘটে (وبلغنا أن أبا بكر وعمر رضي الله عنهما كانا لا يضحيان كراهية أن يُرَى أنها واجبة), কিন্তু তাদের এ ইজতিহাদ সমসাময়িক কাউকে প্রভাবিত করেনি, করার প্রমাণও নেই। ইমাম শাফেয়ী (রহ.)ও তাঁদের সে ইজতিহাদের উপরই সিদ্ধান্তে উপনীত হন বিধায় তাঁর ফিকহ মতে কুরবানী “সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ”।

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামগণের ফিকহ এবং রাসূল (সা.)-এর “সীরাত” (জীবন ও কর্ম) কী বলে তাও দেখার বিষয়! আমরা জানি যে, রাসূল (সা.) কখনো কুরবানী মিস করেননি। তিনি মদনী জীবনে প্রায় দীর্ঘ ১০ বছর সময় অতিবাহিত করেছেন, এক বছরের জন্যও কুরবানী থেকে বিরত থাকেননি। মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি এর হাদীস (أقام النبي صلي الله عليه وسلم بالمدينة عشر سنين يُضحي) সে কথারই সাক্ষ্য দেয়। আরও দেখুন, ফাতহুল বারী ১৩/৬৫, ইবনে হাজার। কাজেই “কুরবানী” এর শর’ঈ হুকুম ওয়াজিব, আর এ মতটিই প্রাধান্য মত। পরিশেষে কথা হল, এ ফেতনার যুগে পরিচিত কিবা অপরিচিত অনেককে দেখা যাবে যে, ফিকহি মীমাংসিত বিষয়গুলোয় বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছে ও জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই এসবে কান দেয়ার কোনো দরকার নেই। নইলে বিভ্রান্ত হবার আশংকা থাকবে। আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ সমঝ দান করুন। আমীন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here