তোমরা তা কামড়ে ধরো, হাদীসের এ খণ্ডিতাংশের কী তাৎপর্য ও একটি আপত্তির উত্তর,

0

ইমাম বুখারীর ‘আল আদাবুল মুফরাদ’ হাদীস নং ৯৬৩ হতে, (সনদ সহ) নিম্নরূপ,

حَدَّثَنَا عُثْمَانُ الْمُؤَذِّنُ، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا عَوْفٌ، عَنِ الْحَسَنِ، عَنْ عُتَيِّ بْنِ ضَمْرَةَ قَالَ‏:‏ رَأَيْتُ عِنْدَ أُبَيٍّ رَجُلاً تَعَزَّى بِعَزَاءِ الْجَاهِلِيَّةِ، فَأَعَضَّهُ أُبَيٌّ وَلَمْ يُكْنِهِ، فَنَظَرَ إِلَيْهِ أَصْحَابُهُ، قَالَ‏:‏ كَأَنَّكُمْ أَنْكَرْتُمُوهُ‏؟‏ فَقَالَ‏:‏ إِنِّي لاَ أَهَابُ فِي هَذَا أَحَدًا أَبَدًا، إِنِّي سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ‏:‏ مَنْ تَعَزَّى بِعَزَاءِ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَعِضُّوهُ وَلا تَكْنُوهُ‏.‏

وفي رواية: إذا الرجل تعزى بعزاء الجاهلية، فأعضوه بهن أبيه، ولا تكنوا .

অর্থ- আমি উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর নিকট এক ব্যক্তিকে দেখেছি, যে নিজেকে (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের গুণে গুণান্বিত করলে, উবাই তাকে মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরতে বলেন। তিনি তা ইংগিতে বলেননি (অর্থাৎ তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন)। তাই তার সঙ্গীরা তার দিকে তাকাল। তিনি বললেন, ‘মনে হচ্ছে তোমরা এ কথা অপছন্দ করলে!’ তারপর তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কখনোই কাউকে শঙ্কা প্রকাশ করব না। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, যে নিজেকে (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের গুণে গুণান্বিত করে, সে যেন তা শক্তভাবে কামড় দেয় এবং তোমরা (এ কথা) অস্পষ্ট করে বলবেনা। (আল আদাবুল মুফরাত)।

মুসনাদে আহমদ এবং নাসাঈ এর আস-সুনানুল কোবরা গ্রন্থে অন্য বর্ণনায় আ’উফ ইবনে আবী জামীলাহ আল আ’রাবীর সূত্রে হাসান বছরী থেকে একটু পরিবর্তিত মতনে বর্ণিত আছে, “যে নিজেকে (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের গুণে গুণান্বিত করে, সে যেন তার পিতার প্রজননতন্ত্র কামড় দেয় (অর্থাৎ নিজেকে পুর্বপুরুষের বংশীয় গরিমা থেকে সমূলে উপড়ে ফেলে) এবং তোমরা (এ কথা) অস্পষ্ট করে বলবেনা।”

সনদের তাহকিকঃ হাদীসটির সনদে উ’তাই ইবনু দ্বমরাহ (মৃত. ১৪৭ হি.) সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মদনী (রহ.) বলেছেন, ((مجهول، سمع من أبى كعب، لا نحفظها إلا من طريق الحسن، و حديثه يشبه حديث أهل الصدق وإن كان لا يعرف)) অর্থাৎ “সে অপরিচিত। সে উবাই ইবনু কা’ব থেকে শ্রবণ করেছে। তবে আমরা সেগুলো হাসান বছরীর সূত্রে ছাড়া সুরক্ষিত পাই না। আর তার বর্ণিত হাদীসগুলো সত্যবাদীদের হাদীসের ন্যায়, যদিও সে অপরিচিত।” (শরহে মেশকাত, ইমাম ত্বীবী ৯/১৬৭ দ্রষ্টব্য)। হ্যাঁ, ইমামগণের বেশিরভাগই তাকে তাওসীক্ব করেছেন। শায়খ আলবানী বলেছেন, এর সনদ সহীহ। যাইহোক, হাসান বছরীর সূত্রে আরেক সনদে হাদীসটির “মতন” এইরূপ, ((من سمعتموه يدعو بدعوى الجاهلية فأعضوه بهن أبيه ولا تكنوا)) অর্থাৎ, তোমাদের যে ব্যক্তি জাহিলিয়াত যুগের কৃষ্টি-কালচারের দিকে আহবান করবে সে যেন তার পিতার প্রজননতন্ত্র কামড় দেয় (অর্থাৎ নিজেকে পুর্বপুরুষের বংশীয় গরিমা থেকে সমূলে উপড়ে ফেলে) এবং তোমরা (এ কথা) অস্পষ্ট করে বলবেনা।”

বিশ্লেষণঃ মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) হাদীসটির মর্মবাণী বুঝিয়ে দিয়েছেন এভাবে যে,

مَعْناهُ مَنِ انتَسَبَ وانْتَمَى إلى الجاهِليَّةِ بإحْياءِ سُنَّةِ أهْلِها، وابْتِداعِ سُنَّتِهِم في الشَّتْمِ واللَّعْنِ والتَّعْييرِ، ومُواجَهَتِكُم بالفَحْشاءِ والتَّكبُّرِ، فاذْكُروا له قَبائِحَهُ أو قَبائِحَ أبيهِ من عِبادةِ الأصْنامِ، والزِّنا، وشُربِ الخَمْرِ، ونَحوِ ذلك ممَّا كان يُعيَّرُ به مِن لُؤمٍ ورَذالةٍ صَريحًا لا كِنايةً؛ كي يَرتَدِعَ عن التَّعرُّضِ لأعْراضِ النَّاسِ. اهـ. من مرقاة المفاتيح.

এর অর্থ হল, এমন কেউ যিনি (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের যুগের লোকদের কৃষ্টি-কালচারকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং অভিশাপ করা, গালমন্দ, অন্যকে তিরস্কার, অশ্লীলতা ও অহংকার প্রদর্শনের নিয়ম পদ্ধতি উদ্ভাবন করে…. তাহলে তোমরা সেই ব্যক্তিকে মদ্যপান, জেনা-ব্যভিচার এবং মূর্তিপূজা ইত্যাদি বিষয়ে পূর্বপুরুষের কুৎসিত কার্যকলাপগুলো স্মরণ করিয়ে দাও। (মেরকাত শরহে মেশকাত, মোল্লা ক্বারী)।

উল্লেখ্য, আরবী ভাষায় أَعِضُّو (তোমরা কামড়ে ধরো), এক ধরনের ভাষা অলংকার; যেটি বাগধারারই অংশ। এর তাৎপর্য হচ্ছে, তোমরা বংশীয় গৌরব সমূলে উপড়ে ফেলো। ইসলামে বংশীয় গৌরব নিন্দনীয়, পূর্বপুরুষদের নিয়ে অহংকার করা আরও জঘন্য। পূর্বপুরুষদের নিয়ে অহংকারীদের সতর্ক করতেই এভাবে বলা হয়ে থাকে।

সহীহ মুসলিম গ্রন্থে এ ধরনের আরও একটি আরবীয় বাগধারা رغم انف (রাগিমা আনফু অর্থাৎ নাক ধূলোয় ধূসরিত হয়ে যাক) উল্লেখ রয়েছে, যার রূপক অর্থ- ‘সে ক্ষতিগ্রস্ত’। হাদীসটি এই যে,

رغم أنف، ثم رغم أنف، ثم رغم أنف من أدرك أبويه عند الكبر أحدُهما أو كلاهما فلم يدخل الجنة

অর্থাৎ সে ক্ষতিগ্রস্ত অত:পর সে ক্ষতিগ্রস্ত অত:পর সে ক্ষতিগ্রস্ত যে তার পিতামাতা দুজনকেই বা কোনো একজনকে বৃদ্ধ বয়সে জীবিত পেল তবু সে (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি। – মুসলিম।

অবশ্যই এন্টি ইসলাম নাস্তিক(!)দের নিকট আরবী শব্দগুচ্ছ গুলোয় আপত্তি থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু তারা জাহিলিয়াত যুগ সম্পর্কে যেমন অজ্ঞ, ঠিক তেমনি আরবী ভাষার অলংকার বা বাগধারায়ও গণ্ডমূর্খ।

যাইহোক, এ জাতীয় শব্দগুচ্ছ যে আরবী ভাষায় প্রচলিত বাগধারারই অংশ তা অনুধাবন করতে হলে হুদায়বিয়ার সন্ধি মুহূর্তে কোরাইশের পক্ষ হতে আগত বার্তাবাহককে উদ্দেশ্য করে হযরত আবূবকর (রা.)-এর ঐতিহাসিক উক্তিটি মনে রাখতে হবে। তিনি কোরাইশের পক্ষ থেকে আসা বার্তাবাহককে বলেছিলেন أمضض بظر اللات (আমদ্বিদ বাঝারাল লাত) অর্থাৎ তুমি লাত এর প্রজননতন্ত্র কামড় দাও অর্থাৎ গায়রুল্লার প্রভাব প্রতিপত্তিকে এবার বিদায় জানাও।

রাসূল (সা.) অত্যাধিক লাজুক বলেই শুধুমাত্র أَعِضُّو (তোমরা কামড়ে ধরো) এটুকু বলে বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষিতদের জন্য বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে দিতে বর্ণনাকারীদের কোনো একজন এটিকে পূর্ণবাক্যে فَأَعِضُّوهُ بِهنِ أبِيهِ রেওয়ায়েত করে দিয়েছেন, উসূলে হাদীসের পরিভাষায় এধরণের অতিরঞ্জনকে ذيادة بالراوى (যিয়াদাত বির-রাবী) বলা হয়। সুতরাং যারা ভাষাবিদ ও পড়াশোনা জানা ব্যক্তি, তাদের নিকট এখন পুরো বিষয়টি পরিষ্কার, আলহামদুলিল্লাহ।

শেষকথা– রাসূল (সা.)-এর أَعِضُّو সংক্ষিপ্ত উক্তির দীর্ঘ বাক্যে প্রকাশ হচ্ছে فأعضوه بهن أبيه (ফা-আ’ইদ্দূহু বিহানি আবীহি)। আর সেটি আরবীয় ভাষা অলংকার। তাই একে গালি বা অশ্লীলতা বলা মূর্খতা। যদি এটি গালি বা অশ্লীলতা হত, তাহলে আরবীয় নাস্তিক বা ইসলাম বিদ্বেষীরাই সবার আগে আপত্তি তুলতো। আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন।

লিখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here