- নবীজী (সা:) এর ছায়া বা প্রতিবিম্ব :
প্রশ্নকর্তা : নবীজী (সা:)-এর ছায়া বা প্রতিবিম্ব ছিল কিনা?
উত্তরদাতা : নবীজী (সা:)-এর ছায়া বা প্রতিবিম্ব ছিল কিনা, এর চাক্ষুষ প্রমাণ কেবল মাত্র ওরাই দিতে পারেন যারা নবীজীকে কাছ থেকে দেখেছেন এবং দিবারাত্রি উনার পাশেই থেকেছেন! সে হিসেবে এই তালিকায় আমরা সর্বপ্রথম উনার (সা:) স্ত্রী তারপর উনার খুব কাছের সাহাবীদের স্থান দেব। উনাদের মাধ্যমে সহীহ ও মারফূ (তথা ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র নবীজী পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকা) সনদে কোনো একটি বর্ণনা দ্বারাও যদি প্রমাণিত হয় যে, উনার ছায়া মুবারক ছিল কিংবা ছিলনা; যেটাই হোক সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। কেননা ঈমানের দাবী হচ্ছে, দ্বীনের ব্যাপারে নিজকে নিরপেক্ষ রাখা ও সত্যকে বিনাবাক্যে লুফে নেয়া।
(ক) উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, হযরত যয়নব (রা:) তিনি নবীজীর ছায়া দেখা সম্পর্কে পরিস্কার বলেছেন : ‘ফা রাআইতু জিল্লাহু (فرأيت ظله)।’ অর্থাৎ আমি তাঁর ছায়া দেখেছি। (মুসনাদে আহমদ ৭/৪৭৪; হাদীস নং ২৬৩২৫ দ্রষ্টব্য)।
(খ) উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ বিনতে হোইয়াই (রা:) হতেও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন : ‘ইয্ আনা বি-জিল্লি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ববিলুন (ذ أنا بظل رسول الله صلى الله عليه وسلم مقبل)।’ অর্থাৎ ইত্যবসরে আমি আল্লাহ’র রাসুলের ছায়ার নাগাল পেয়ে গেলাম (মুসনাদে আহমদ ৬/১৩২); হাদীস নং ২৫০০২; হাদীসের সব রাবী ছিক্বাহ)।
(গ) নবীজী (সা:)-এর দীর্ঘ দশ বছরের খাদেম হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা:) হতে মারফূ সনদে ও একদম সহীহসূত্রে বর্ণিত আছে, নবীজী (সা:) কোনো এক ঘটনাপ্রেক্ষিতে বলেছেন : ‘রাআইতু জিল্লি ওয়া জিল্লাকুম ফীহা’ (رأيت ظلى و ظلكم فيها)। অর্থাৎ তার মধ্যে আমি আমার এবং তোমাদের ছায়া দেখেছি। সংক্ষেপে। (সহীহ ইবনে খোজায়মা ২/৫০, হাদীস নং ৮৯; মুসতাদরিক আল হাকেম ৫/৬৪৮; হাদীস নং ৮৪৫৬; হাদীসের মান, সহীহ)। ইমাম রাজী (রহ:) লিখেছেন, ‘ফী’ বর্ণটি অভিধানে ‘অতি নিকটে’ অর্থ বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন সূরা আন-নমল আয়াত নং ৮; মূসা (আ:) সম্পর্কে ‘আন বূরিকা মান ফীননার’ (অর্থাৎ বরকতময় হোক তিনি যিনি আগুনের মধ্যে আছেন…) উল্লেখ আছে। অথচ তূর পর্বতমালায় তখন তিনি আগুনের অভ্যন্তরে ছিলেন না, বরং অতি নিকটে বা কোনো এক পাশেই ছিলেন (তাফসীরে কাবীর ২৪/১৮৩)। কাজেই উক্ত হাদীসে ‘আগুনের মধ্যে’ মানে আগুনের অতি নিকটে বা আগুনের এক পাশে, এই অর্থই উদ্দেশ্য। হতে পারে তখন ছায়াগুলো নবীজীর পেছনে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ হাদীসে এও উল্লেখ আছে যে, নবীজী (সা:) নামাজ অবস্থায় আপনা পেছনেও তদ্রূপ দেখতে পান যেভাবে সামনে দেখেন। যেমন তিনি বলেছেন : ‘ইন্নী লা-আরাকুম মিন ওরায়ী কামা আরাকুম’। (উমাদাদুল ক্বারী শরহে সহীহ বুখারী, কিতাবুস সালাত, অধ্যায় নং ৪০)। সুতরাং এরপরেও যাদের বিশ্বাস যে, নবীজী (সা:)-এর ছায়া মুবারক থাকা সঠিক নয় তাদের নিরপেক্ষ বিবেকের নিকট প্রশ্ন, আপনারা ‘ছায়া না থাকা’ এর সমর্থনে অন্তত একটি হাদীসও কি দেখাতে পারবেন যেটির সনদ (সূত্র) ‘মারফূ’ এবং গয়রে মাজরূহ ও বিশুদ্ধ! অথচ উপরে উল্লিখিত হাদীসগুলোর সনদ যেমন গয়রে মাজরূহ ও বিশুদ্ধ তেমনি আনাস ইবনে মালেক (রা:)-এর বর্ণিত হাদীসের সনদ ‘মারফূ’ পার্যায়েরও। সংক্ষেপে।
প্রশ্নকর্তা : বহু বক্তা সাহেবকে তো ওয়াজ মাহফীলে বলতে শুনা যায় যে, সূর্যের কিরণে নবীজীর ছায়া পড়ত না কিবা দেখাও যেত না! তাহলে কি ওনারা এসব ভুল বলেন?
উত্তরদাতা : আচ্ছা বলুন দেখি! সূর্যের কিরণে নবীজীর ছায়া না পড়া কিংবা ছায়া দেখতে না পারার ব্যাখ্যা কি ‘ছায়া না থাকা’? নিশ্চয়ই ছায়া না থাকা নয়। বরং ছায়া থাকা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে তা মাটিতে না পড়াই ছিল নবীজীর মুজিজা। অন্যথা উল্লিখিত সহীহ হাদীসগুলোর প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ ছাড়া আর কিছুই না! সেযাইহোক, এবার সূর্যের কিরণে নবীজীর ছায়া মাটিতে না পড়ার অন্যতম কারণ কী ছিল তা তাফসীরে মাদারিক প্রণেতার কাছ থেকে জেনে নিন! তিনি লিখেছেন: ‘লি-আল্লা ইয়াক্বা’আ ইনসানু ক্বাদামাহু আলা যালিকাজ জিল্লি’ (لئلا يقع انسان قدمه على ذالك الظل)। অর্থাৎ আল্লাহতালা নবীজীর ছায়া মুবারক মাটিতে পতিত করেন না, যাতে কেউ উনার ছায়াকে মাড়াতে না পারে। (পারা নং ১৮ দ্রষ্টব্য)। এবার বলুন, বর্তমান যুগের এই সমস্ত বক্তাদেরকে বিশ্ববিখ্যাত ‘তাফসীরে মাদারিক’ প্রণেতার চেয়েও কি অধিক জ্ঞানী মানবেন?
লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক