মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওয়ত অর্জনের ভিত্তি ছিল “ফানা ফির রাসূল” বা রাসূলের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। কিন্তু এখানে আমার ২টি প্রশ্ন রয়েছে। যেমন,
১ মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের সেই “ফানা ফির রাসূল” ওয়ালা সাধনাগুলো কী ছিল, যা ইতিপূর্বে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার দ্বিতীয় কারো মধ্যে কল্পনা করাও অসম্ভব, যার দরুন মির্যা সাহেবকে সত্যিই ‘রাসূলের মধ্যে বিলীন’ হয়ে যাওয়ার কনসেপ্ট বাস্তব বলে প্রতীয়মান হবে?
২ ফানা ফির রাসূল দ্বারা নবুওয়তের মাকাম লাভ করা যায় এ ধরণের কোনো ইংগিত বা ফরমান কি কুরআন বা সুন্নাহতে পাওয়া যায়? উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বিগত চৌদ্দশত বছরের ইসলামের অথেনটিক সাহিত্য সমূহ এ সম্পর্কে আদৌ কি কিছু বলেছে?
উল্লেখ্য, পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে তাঁর রাসূলের পূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। আর তাঁর রাসূলের পূর্ণ অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা এবং Forgive বা ক্ষমা। (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৩১)।
Say: “If you love Allah, then follow me and Allah will love you and forgive your sins.” (Surah Al `Imran: 31)
প্রাসঙ্গিক আলোচনা :-
পবিত্র কুরআনের সূরা জুম’আ আয়াত নং ২ এবং ৩ এর শিক্ষা মতে,
- ہُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
অর্থ- তিনিই নিরক্ষরদের[১] মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রসূলরূপে, যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা, যদিও ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।
- শাব্দিক অনুবাদ– ہُوَ তিনি সেই সত্তা الَّذِیۡ যিনি بَعَثَ প্রেরণ করেছেন فِی মধ্যে/মাঝে الۡاُمِّیّٖنَ নিরক্ষরদের/উম্মীদের رَسُوۡلًا একজনকে রাসূল হিসেবে مِّنۡہُمۡ তাদেরই মধ্য থেকে।……… وَّ এবং তিনি প্রেরণ করেছেন اٰخَرِیۡنَ অন্যান্যদের (অনারবদের) মধ্যেও مِنۡہُمۡ তাদের لَمَّا یَلۡحَقُوۡا যারা এখনো মিলিত হয়নি بِہِمۡ ؕ তাদের (আরবের ঐ উম্মী সাহাবীদের) সাথে وَ আর ہُوَ তিনি (আল্লাহ) الۡعَزِیۡزُ পরাক্রমশালী الۡحَکِیۡمُ প্রজ্ঞাময়।
টিকাঃ [১] أُمِّيِّيْنَ (নিরক্ষর) থেকে এমন আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে, যাদের অধিকাংশ লেখাপড়া জানত না। এদেরকে বিশেষ করে উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, রসূল (সা.)-এর রিসালাত অন্যদের জন্য ছিল না। কিন্তু সর্বপ্রথম যেহেতু সম্বোধন তাদেরকেই করা হয়েছে, তাই তাদের উপর ছিল আল্লাহর বেশী অনুগ্রহ।
- وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
অর্থ- আর তাদের অন্যান্যদের[২] মধ্যেও (রসূল পাঠিয়েছেন), যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
টিকাঃ [২] আয়াতে اٰخَرِیۡنَ এর আ’তফ বা সংযোগ হল أُمِّيِّيْنَ এর সাথে এবং উভয়ই যের অবস্থায় বিদ্যমান (ফাতহুল বারী, ইবনু হাজার আসকালানী)। অর্থাৎ, بَعَثَ فِي آخَرِيْنَ مِنْهُمْ আর آخَرِيْنَ বলতে পারসীক এবং অন্যান্য অনারব লোক, যারা কিয়ামত পর্যন্ত রসূল (সা.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করবে। কেউ কেউ বলেন, আরব ও অনারবদের সেই সমস্ত লোক, যারা সাহাবাদের যামানার পর কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। এতে পারস্য, রোম, তুর্কিস্তান, মোগল, কুর্দিস্তান এবং চিন ও ভারত ইত্যাদি দেশের সমস্ত বাসিন্দা (বিশ্ববাসী)রা অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, রসূল (সা.)-এর নবুওয়ত সবার জন্য। তাই এরা সবাই তাঁর উপর ঈমান আনতে থাকবে। আর ইসলাম গ্রহণ করার পর এরা সবাই مِنْهُمْ (তাদের অন্যান্য) এর দলে শামিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ, প্রথম প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীরা أُمِّيِّيْن এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, সমস্ত মুসলমান হল একই উম্মত। এই (তাদের) সর্বনামের কারণে কেউ কেউ বলেন, ‘অন্যান্য’ বলতে পরে আগমনকারী আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, ‘তাদের’ সর্বনাম দ্বারা (আরব) ‘নিরক্ষরদের’ প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর, ইমাম আল্লামা শাওকানী রহঃ)।
ইমাম তাবারীও (রহ.) তাফসীরে তাবারী গ্রন্থে লিখেছেন যে,
يقول تعالى ذكره: وهو الذي بعث في الأميين رسولا منهم، وفي آخرين منهم لما يلحقوا بهم، فآخرون في موضع خفض عطفًا على الأميين.
অর্থাৎ আল্লাহ তালার বাণী : ‘তিনি সেই সত্তা যিনি উম্মীদের জন্য তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাদের অন্যান্যদের জন্যও যারা তাদের সাথে এখনো মিলিত হয়নি’, অতএব آخرين এটি الاميين এর উপর আ’তফ বা সংযোগ হয়ে যের এর স্থলে রয়েছে। (তাফসীরে তাবারী সূরা জুম’আ)।

কিন্তু আহমদী তথা কাদিয়ানীদের এখানে মারাত্মক পর্যায়ের ভ্রান্তিটা হচ্ছে তারা آخَرِيْنَ শব্দকে أُمِّيِّيْنَ এর উপর আ’তফ বা সংযোগ মানেনা। তারা آخرين শব্দকে মাফউল বা কর্ম ধরেই একটি মনগড়া কনসেপ্ট দাঁড় করার চেষ্টা করে থাকে। আর সেই কনসেপ্টটা হচ্ছে, আয়াতটিতে আল্লাহ নাকি و آخَرِيْنَ ‘অন্যান্যদের’ বলে মুহাম্মদ (সা.)-কে বুরুজি রঙে দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে প্রেরণ করার সংবাদ দিয়েছেন! নাউযুবিল্লাহ। অথচ آخَرِيْنَ শব্দটি যের এর অবস্থায় রয়েছে এবং সেটি أُمِّيِّيْنَ এর উপর আ’তফ বা সংযোগ। ফলে অর্থ দাঁড়ায় بَعَثَ فِي آخَرِيْنَ مِنْهُمْ তথা আল্লাহ তা’য়ালা উম্মীদের মধ্যে এবং সেই অন্যান্য (অনারব লোক)দের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছেন, যারা কিয়ামত পর্যন্ত রসূল (সা.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করবে। لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ অর্থাৎ যারা এখনো উম্মীদের (আরবদের) সাথে মিলিত হয়নি। সহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন বর্ণনায় আয়াতটির ব্যাখ্যায় এসেছে,
- لو كان الإيمان عند الثريا لناله رجال او رجل من هؤلاء
অর্থাৎ যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের নিকটে থাকত তাহলেও এঁদের (সালমান ফারসীর বংশের দিকে ইংগিত) এক বা কতেক পুরুষ তা অর্জন করত। (বুখারী ৪৮৯৭, সাহাবী আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে)।
সম্পূর্ণ হাদীসটি এইরূপ,
كُنَّا جُلُوسًا عِنْدَ النَّبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم، فَأُنْزِلَتْ عليه سُورَةُ الجُمُعَةِ: {وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ} [الجمعة: 3]، قالَ: قُلتُ: مَن هُمْ يا رَسولَ اللَّهِ؟ فَلَمْ يُرَاجِعْهُ حتَّى سَأَلَ ثَلَاثًا، وفينَا سَلْمَانُ الفَارِسِيُّ، وضَعَ رَسولُ اللَّهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم يَدَهُ علَى سَلْمَانَ، ثُمَّ قالَ: لو كانَ الإيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا، لَنَالَهُ رِجَالٌ -أوْ رَجُلٌ- مِن هَؤُلَاءِ.
অর্থাৎ আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা নবী করীম (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম। এসময় তাঁর উপর সূরা জুম‘আ অবতীর্ণ হল, যার একটি আয়াত হল- ‘এবং তাদের অন্যান্যের জন্যও যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি’ (৬২/৩)। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারা কারা? তিনবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। আমাদের মাঝে সালমান ফারেসী উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.) সালমানের উপর হাত রেখে বললেন, ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের নিকট থাকলেও এদের কতেক লোক বা কোনো এক ব্যক্তি তা অবশ্যই পেয়ে যেতো’ (বুখারী হা/৪৮৯৭)।
মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, যদি দ্বীন সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের কাছেও থাকত, তবুও পারস্যের একজন ব্যক্তি তা নিয়ে আসত বা পারস্যের সন্তানদের কেউ কেউ তা পেয়ে যেত’ (মুসলিম হা/২৫৪৬)। সহীহ ইবনু হিব্বান এর বর্ণনায় আরো স্পষ্টভাবে এসেছে যে, রাসূল (সা.) এ সময় সালমানের উরুতে হাত মেরে বললেন, এ ব্যক্তি ও তাঁর জাতি (সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৭১২৩)।
হাদীসটির ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাসীর বলেন, অত্র হাদীস দলীল হল এ বিষয়ে যে, রাসূল (সা.) আরব-আ’জমের সকল মানুষের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন’। ত্বীবী বলেন, জাতি উল্লেখ করে সালমান ফারেসী (রা.)-কে বুঝানো হয়েছে। অথবা এর দ্বারা আরবের বিপরীতে অনারবদের বুঝানো হয়েছে (মিরক্বাত হা/৬২১২-এর ব্যাখ্যা)। যেমন বুখারী, মুসলিম সহ কুতুবে সিত্তাহর মুহাদ্দিসগণ সকলেই অনারব ছিলেন।
অন্যান্য বর্ণনায় এভাবেও এসেছে যে,
وَعَنْهُ قَالَ: كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم إِذْ نَزَلَتْ عَلَيْهِ سُورَةُ الْجُمُعَةِ فَلَمَّا قَرَأَ {وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُواْ بِهِمْ} قَالَ رَجُلٌ: مَنْ هؤُلَاءِ الَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا بِنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ فَلَمْ يُكَلَمْهُ حَتَّى سَأَلَهُ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلَاثاً. قَالَ: وَفِينَا سَلْمَانُ الْفَارِسِيُّ، فَوَضَعَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَدَهُ عَلَى سَلْمَانَ وَقَالَ: لَوْ كَانَ الْإِيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ هؤُلَاءِ
অর্থাৎ আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা নবী করীম (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম। এসময় তাঁর উপর সূরা জুম‘আ অবতীর্ণ হল, যার একটি আয়াত হল- ‘এবং তাদের অন্যান্যের জন্যও যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি’ (৬২/৩)। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারা কারা যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি’? দু’-তিনবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। বর্ণনাকারী বললেন, আমাদের মাঝে সালমান ফারেসী উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.) সালমানের উপর হাত রেখে বললেন, যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের নিকটেও থাকত তবু কিছু লোক তা অবশ্যই পেয়ে যেতো’ (মুসলিম, তিরমিজি)।
বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইমাম আ’ঈনী (রহ.) ‘উমদাতুল ক্বারী’ গ্রন্থে رجال من هؤلاء এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন,
(لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ هَؤُلَاءِ”)؛ أي: الفرس بقرينة سلمان الفارسيّ، وقال الكرمانيّ: أي: الفرس؛ يعني: العجم، وفيه نَظَر لا يخفى، ثم إنهم اختلفوا في:{وَآخَرِينَ مِنْهُمْ} ، فقيل: هم التابعون، وقيل: هم العجم، وقيل: أبناؤهم، وقيل: كل من كان بعد الصحابة، وقال أبو روق: جميع من أسلم إلى يوم القيامة، وقال القرطبيّ: أحسن ما قيل فيهم: أنهم أبناء فارس، بدليل هذا الحديث:”لناله رجال من هؤلاء”، وقد ظهر ذلك بالعيان، فإنهم ظهر فيهم الدين، وكثر فيهم العلماء، وكان وجودهم كذلك دليلًا من أدلة صدقه صلى الله عليه وسلم، قاله في “العمدة”
অর্থাৎ “’এদের অনেক লোক এটি অর্জন করতো’ এ থেকে সালমান ফারসীর প্রতি ইংগিত থাকার কারণে পারস্যের অনেক লোককে বুঝানো উদ্দেশ্য। শারেহে বুখারী ইমাম কিরমানী (রহ.) এর মতে, পারস্য বলে অনারবদের বুঝানো হয়েছে। অত:পর ‘ওয়া আখারীনা মিনহুম’ এর তাৎপর্য নিয়ে মতভেদ হয়ে যায়। কেউ বলেছেন, এ থেকে তাবেয়ীগণ উদ্দেশ্য। কেউ বলেন, অনারবগণ উদ্দেশ্য। কেউ বলেছেন, পারস্যের সন্তানগণ উদ্দেশ্য। কেউ বলেন, সাহাবীদের পরবর্তী সবাই উদ্দেশ্য। আবু রাওক্ব বলেন, কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুসলমান উদ্দেশ্য। ইমাম কুরতুবী বলেছেন, উত্তম মতটি হল, পারস্যের পুরুষগণ উদ্দেশ্য। হাদীসের দলীল ‘তাদের মধ্য হতে অনেক পুরুষ তা অর্জন করতো’ অনুসারে। বাস্তবতা তেমনই। নিশ্চয়ই তাদের মাধ্যমেই দ্বীনের প্রচারপ্রসার হয়েছে, বহু উলামায়ে কেরাম তাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ বাস্তবতাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর (ভবিষ্যৎবাণীকে) সত্য প্রমাণ করেছে।” (উমদাতুল ক্বারী)।
দীর্ঘ আলোচনা হতে স্পষ্টতই বুঝা গেল যে, এতে ভবিষ্যতে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির আগমনের ভবিষ্যৎবাণী ইংগিতেও করা হয়নি, কথিত বুরুজি মুহাম্মদ এর আগমন হবার কনসেপ্ট তো বহুত দূর কি বাত। বড়জোর সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটে চলে যাওয়া ঈমান বা দ্বীন বা ইলম অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। তাও এক বা একাধিক জনের জন্য। ফলে এটি সাহাবী সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বংশের ফযিলত বর্ণনা করাই হল। নতুবা ইমাম সুয়ূতী (রহ.) সহ বহু যুগ বিখ্যাত ইমাম লিখে যেতেন না যে, সেই পুরুষদের মধ্যে অন্যতম ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)। বলাবাহুল্য যে, রাদ্দুল মুহতারে ইমাম ইবনুল আবেদীন শামী (রহ.), তাবয়িদুস সহীফা গ্রন্থের ’তাবশীরুন নবী’ অধ্যায়ে ইমাম সুয়ূতী (রহ) এবং খায়রাতুল হিসান গ্রন্থে ইমাম ইবনু হাজার আল হায়তামী (রহ.) প্রমুখ এ মর্মে বলে গেছেন যে, এ হাদীস দ্বারা ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যাপারে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে (রাদ্দুল মুহতার ১/৫৩)।
সে যাইহোক, হুবহু কথাটির ন্যায় কুরআনেও আল্লাহ বলেছেন,
- لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ
অর্থাৎ যদি আসমান যমীনে আল্লাহ ব্যতীত বহু ইলাহ থাকত তাহলে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। সুতরাং তারা যা বলে আরশের রব তা থেকে পবিত্র। (সূরা আম্বিয়া আয়াত ২২)।
এখন এর মানে আসমান এবং যমীনে সত্যিকারের বহু ইলাহ বিদ্যমান থাকা জরুরি নয়। এটি কথার কথা। জ্ঞানীদের নিশ্চয়ই বুঝার বাকি থাকেনি যে, অনুরূপ সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটে ঈমান প্রকৃতপক্ষে চলেই যাবে, বিষয়টিও জরুরি নয়। বরং সেটিও সূরা আম্বিয়ার ২২ নং আয়াতের ‘যদি আসমান যমীনে বহু ইলাহ থাকত’ এরই ন্যায় কথার কথা মাত্র। আর এগুলো ভাষার অলংকার। যার বাস্তব প্রতিফলন জরুরি নয়। কিন্তু কাদিয়ানীরা তো আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে সূরা জুমার و آخرين منهم (ওয়া আখারীনা মিনহুম) এর অপব্যাখ্যা দিয়ে মুহাম্মদ (সা.) এর দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক আগমন অর্থাৎ তথাকথিত বুরুজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কনসেপ্ট দাঁড় করার চেষ্টায় মরিয়া। মূলত কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ সুরা জুম’আ এর অত্র আয়াতের চরম অপব্যাখ্যা থেকেই নিজের সত্তাকে কথিত বুরুজি মুহাম্মদ বলে দাবী করার প্রয়াস পায়। যা ছিল সম্পূর্ণ উদ্ভট দাবী ও বাতিল দর্শন। সত্যের সাথে যার লেশমাত্র সম্পর্কও নেই। ফলে এ গোষ্ঠীটির পুরো বুরুজি কনসেপ্টটাই ভ্রান্ত ও ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ। পবিত্র কুরআনে মারাত্মক বিকৃতি সাধন বৈ নয়।
আল্লাহ! তুমি প্রকৃত সত্যানুসন্ধানীকে সুবোধ দান কর।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী