Home কাদিয়ানী মতবাদ খণ্ডন সমস্ত রাসূল গত হইয়া গিয়াছে-এর তাৎপর্য

সমস্ত রাসূল গত হইয়া গিয়াছে-এর তাৎপর্য

0

সূরা আলে ইমরান আয়াত ১৪৪, আল্লাহ বলেছেন, “তাহার পূর্বে রাসূলগণই গত হইয়া গিয়াছে।” কিন্তু কাদিয়ানী তথা আহমদীয়াদের কৃত অনুবাদ হলো, তাহার পূর্বেকার সমস্ত রাসূল গত হইয়া গিয়াছে।

কাদিয়ানীদের সাথে এ নিয়ে যতবারই তর্ক হয়েছে তাদের বক্তব্য একটাই, ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে যাওয়াটা কুরআনের উক্ত আয়াতটি দ্বারা সাব্যস্ত। কিভাবে? তাদের বক্তব্য হলো, আল্লাহ এখানে মুহাম্মদ (সা.) এর পূর্বে সমস্ত রাসূল গত হয়ে গেছেন, এ কথা হতে তারা প্রত্যেকে মৃত্যুবরণ করেছেন, বলে বুঝিয়েছেন। কেননা, আয়াতে উল্লিখিত الرُّسُلُ শব্দের শুরুতে যুক্ত আলিফ-লামকে ‘ইস্তিগরাকি’ বলা হয়, যা গত হয়ে যাওয়া রাসূলগণের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করবে। আর যদি তেমনটা না হয় তাহলে এতে দলীল অসম্পূর্ণ থাকবে। কেননা, যদি গত হয়ে যাওয়ার অর্থ থেকে কোনো একজনও বাহিরে থাকে তাহলে কুরআনের যে দাবী ও দলীল উত্থাপন করার ছিল তা আয়াত হতে পরিপূর্ণতা পাবেনা। মির্যা গোলাম আহমদ রচিত ‘ইযালায়ে আওহাম’ গ্রন্থে এসব লিখা আছে। তার রচনাসমগ্র রূহানী খাযায়েন ৩:৫৮৮ দ্রষ্টব্য।

কাদিয়ানীদের বইগুলোতে আরও লিখা আছে যে, আয়াতটিতে খুব খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, পূর্বেকার গত হয়ে যাওয়া সমস্ত রাসূলের জন্য মৃত্যুবরণ করাই উদ্দেশ্য। কারণ, একই আয়াতে গত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া মাত্র দুটিই বলা হয়েছে। যথা মৃত্যু অথবা নিহত হওয়া। এখন যেহেতু গত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা পরবর্তীতে উল্লিখিত মৃত্যু আর কতলের সাথে নির্দিষ্ট হয়ে গেল, তখন তৃতীয় কোনো কিছুই এতে উদ্দেশ্য নেয়ার সম্ভাবনা থাকল না।

এবার কাদিয়ানীদের যুক্তি ও দলীলের খন্ডনমূলক জবাব দেয়া হবে। প্রথমতঃ উক্ত আয়াত হতে পূর্বেকার রাসূলগণের সবাইকে মৃত্যুবরণকারী সাব্যস্ত করার মধ্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কী উদ্দেশ্য? আল্লাহ কেন এধরণের কোনো আয়াত অবতীর্ণ করলেন? এতে তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য কী শিক্ষা রয়েছে? প্রশ্নগুলো নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেই কাদিয়ানীদের তথাকথিত দলীল প্রমাণের নামে সস্তা যুক্তিতর্কের হাকিকত উন্মোচিত হয়ে যাবে। আসুন, প্রথমে আয়াতটির অনুবাদ দেখে নিই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,

وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِہِ الرُّسُلُ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡہِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰہَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیَجۡزِی اللّٰہُ الشّٰکِرِیۡنَ

অর্থাৎ মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র; তাঁর আগে রাসূলগণই গত হয়ে গেছেন। কাজেই যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? আর কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহ্‌র ক্ষতি করবে না; আর আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবে।”

ব্যাখ্যামূলক তাৎপর্যঃ এ আয়াতে হুঁশিয়ার করা হয়েছে যে, রাসূল (সা.)-এর পরও মুসলিমদের দ্বীনের উপর অটল থাকতে হবে। এতে আরো বুঝা যায় যে, উহুদের যুদ্ধের সময় সাময়িক বিপর্যয়ের সময় রাসূল (সা.) আহত হওয়া এবং তার মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার পেছনে যে রহস্য ছিল, তা হলো তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সাহাবায়ে-কেরামের সম্ভাব্য অবস্থার একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলা, যাতে তাদের মধ্যে কোনো ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে রাসূল (সা.) স্বয়ং তা সংশোধন করে দেন এবং পরে সত্যসত্যই যখন তাঁর মৃত্যু হবে, তখন যেন সম্বিত হারিয়ে না ফেলেন। বাস্তবে তাই হয়েছে। রাসূল (সা.) এর ওফাতের সময় যখন প্রধান প্রধান সাহাবীগণও শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন, তখন আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এ আয়াত তেলাওয়াত করেই তাদের শান্তনা দেন। [দেখুন, বুখারীঃ ১২৪১, ১২৪২, ৪৪৫৩, ৪৪৫৪]।

আয়াতটির শানে নুযূল তথা প্রেক্ষাপটের বিচারে এটা মোটেও তার দাবী বলা যায় না যে, পূর্বেকার গত হয়ে যাওয়া প্রত্যেক রাসূলকেই আয়াতটি মৃত সাব্যস্ত করতে চাচ্ছে। কেননা আয়াতের মূলভাব ছিল, রাসূল (সা.) এর মৃত্যুবরণ করার কারণে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যেন কোনো ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত না হয় এ কথা ভেবে যে, মুহাম্মদ (সা.) মৃত্যুবরণ করতে পারেন না! আর যেহেতু তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন সেহেতু তিনি কেমন ধরনের রাসূল? এরই প্রতিউত্তর স্বরূপ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মুমিন বান্দাদের সতর্ক করে দিয়েছেন এ বলে যে, মুহাম্মদ (সা.) তো শুধুই আল্লাহর একজন রাসূল মাত্র, তিনি তো খোদা নন যে চিরঞ্জীব হবেন! তাই তাঁর মৃত্যুবরণ করার সংবাদে তোমাদের শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, তোমাদের নিশ্চয়ই জানা থাকা উচিত যে, তাঁর পূর্বেও রাসূলগণই গত হয়ে গিয়েছেন। কাজেই তিনিও তাঁদেরই ন্যায় একজন রাসূল মাত্র। তাই তাঁদের মত তাঁর ইহকাল ত্যাগ করে চলে যাওয়াতে তোমাদের অবাক হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারেনা। আয়াতের মূলভাব এটাই। কাজেই, ‘অনেক রাসূল অথবা সমস্ত রাসূল’ এ ধরনের অনর্থক শব্দচয়ন নিয়ে ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই।

ইতিহাস প্রমাণ করে যে, হযরত উমর (রা.) এর মত বিশিষ্ট সাহাবীও নবী করীম (সা.)-এর মর্মান্তিক মৃত্যুর সময় চরম উত্তেজনার শিকার হয়ে তাঁর মৃত্যুকে অস্বীকার করে বসেন। আবূ বকর (রা.) বড়ই কৌশল অবলম্বন করে রাসূল (সা.)-এর মিম্বারে দাঁড়িয়ে এই আয়াত তেলাওয়াত করে শোনান। যাতে উমর (রা.) প্রভাবিত হন এবং তাঁর অনুভব হয় যে, যেন এই আয়াত এখনই অবতীর্ণ হল। কাজেই প্রশ্ন আসে, এমতাবস্থায় মৃত্যু এবং কতল বা নিহত হওয়ার নির্দিষ্ট ঐ দুইখানা প্রক্রিয়া যা নবী করীম (সা.) এর সাথেই খাস বা নির্দিষ্ট, সেটির সাথে গত হয়ে যাওয়া রাসূলগণের প্রাসঙ্গিকতা কী? কাদিয়ানীরা এ সমস্ত ধোকাবাজি কেন করে তা আল্লাহই মালুম। অথচ আয়াতে উল্লিখিত ‘খালাত’ (خلت) শব্দটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশেষ রহস্যের কারণেই ব্যবহার করেছেন। আর সেটি হলো, পূর্বেকার গত হয়ে যাওয়া রাসূলগণের মধ্যে বিশেষভাবে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) এর ‘গত’ হবার ধরণ যে ভিন্ন ছিল, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে তিনি শামিল নন; ব্যতিক্রমী এ রহস্যের জট খুলতেই ‘খালাত’ এর মত একটি সাধারণ শব্দ ব্যবহার করেছেন। নইলে তিনি শব্দটির পরিবর্তে সরাসরি মৃত্যু অর্থ বুঝাতে ‘মউত’ (ماتت) শব্দ ব্যবহার করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি! আরবীতে প্রবাদ আছে, فعل الحاكم لا يخلو عن الحكمة অর্থাৎ জ্ঞানীর কোনো কাজ রহস্য বিনে হয় না। জ্ঞানী যারা তাদেরকে বিষয়টি নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় ইরশাদ করেছেন, يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَٰكُم مِّن ذَكَرٍۢ وَأُنثَىٰ “হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে একজন নর এবং নারী থেকে সৃষ্টি করেছি।” (আল-হুজুরাত ১৩)। এখন আপনি যদি এ থেকে “সমস্ত মানুষ” উদ্দেশ্য নেন এবং তাতে নানা কারীনা বা ইংগিতের ভিত্তিতে তাখছীছের (ব্যতিক্রমের) নীতি না মানেন, তাহলে বলতে হবে যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মও একজন নর এবং নারী উভয় থেকেই হয়েছিল! অথচ এটি পবিত্র কুরআনের শিক্ষার সুস্পষ্ট বিরোধী। অন্য আরেক জায়গায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের জন্য মৃত, রক্ত এবং শুয়োরের মাংস হারাম করা হয়েছে।” (সূরা মায়েদা ০৩)। এখন নানা কারীনা থাকা সত্ত্বেও আপনি যদি এতেও তাখছীছের নীতি না মানেন, তাহলে বলতে হবে যে, সমস্ত মৃত প্রাণীই হারাম, সেটা হোক মাছ বা টিড্ডি। অথচ মাছ যদি মৃতও হয় তবু সেটি হালাল, কেউই হারাম মনে করেনা। কাদিয়ানীদের ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত যে, তেমনি সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৪৪ এর মধ্যেও الرُّسُلُ শব্দের শুরুতে যুক্ত ‘আলিফ-লাম’ যদি ‘ইস্তিগরাকি’ বলেও ধরে নেয়া হয়, তথাপি শব্দটির অর্থেও তাখছীছের নীতি গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু ঈসা (আ.)-কে উঠিয়ে নেয়া এবং শেষ যামানায় ফিরে আসা সম্পর্কে সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৪৬ এবং ৮১, সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৮-৫৯, সূরা যুখরুফ ৬১ সহ বহু ইংগিতস্বরূপ প্রমাণ রয়েছে, যাকে উসূলের পরিভাষায় ইশারাতুন নস বলা হয়। উল্লেখ্য, ইশারাতুন নসও কাতি’ঈ বা অকাট্য জ্ঞান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৮, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, “বরং তিনি তাঁকে (ঈসাকে) তার দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন।”

বলাবাহুল্য যে, বহু সহীহ হাদীস এবং সাহাবী ও তাবেয়ীর তাফসীর হতে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বিদ্যমান আছে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ঈসা (আ.)-কে উঠিয়ে নিয়েছিলেন রুহুল কুদস জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে। সূরা আল মায়েদা আয়াত নং ১১০ وَإِذْ كَفَفْتُ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَنكَ إِذْ جِئْتَهُم بِالْبَيِّنَاتِ “তুমি স্মরণ কর যখন আমি তোমার কাছ থেকে বনী ইসরাইলীদের নিবৃত রেখেছিলাম, যখন তুমি তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছিলে” এখানে আল্লাহর এ কথা সে সময়ের সাথে সম্পর্কিত যখন তিনি ঈসাকে ইহুদীদের কবল থেকে মুক্ত করে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন (ইমাম সুয়ূতী), সহ অসংখ্য সহীহ হাদীস তারই সমর্থনে সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবিশিষ্ট। ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে ইমাম ইবনু কাসীর তেমনি একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন এইরূপ যে, لما أراد الله أن يرفع عيسى إلى السماء، خرج على أصحابه “ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, আল্লাহ যখন ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নিতে চাইলেন তখন তিনি (ঈসা) তাঁর সাথীদের দিকে বেরিয়ে এলেন।” হাদীসটি অনেক দীর্ঘ। ইবনে কাসীর (রহ.) এর সনদ সম্পর্কে বলেছেন, ইবনে আব্বাস পর্যন্ত এর বর্ণনাসূত্র সহীহ। সুতরাং কাদিয়ানীদের এখানে যে বক্তব্যটি শুনা যায় যে, ঈসাকে আল্লাহ “রাফিউকা ইলাইয়্যা” বলে অন্য সকল রাসূলের ন্যায় মৃত্যুর পর আধ্যাত্মিক উন্নীত করেছেন, শারীরিকভাবে তুলে নেননি—কাদিয়ানীদের এ সমস্ত কথাবার্তা কিছুতেই যুক্তিক নয়, বরং পুরাই আন্দাজে কথাবার্তা। কেননা জিবরাইল (আ.) কখনো কাউকে মৃত্যু দেন না, বরং এ কাজ শুধুই মালাকুল মউত আজরাইল (আ.) এরই। কিন্তু নির্বোধ কাদিয়ানীদেরকে এ সুক্ষ্ম বিষয়গুলো বুঝানোর সাধ্য কার!

পরিশেষে সর্বজন স্বীকৃত যুগ ইমাম, হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস আদ-দেহলভী (রহ.)-এর একটি বক্তব্য দিয়েই আজকের মত আলোচনা শেষ করব। তিনি তাঁর তাফসীরগ্রন্থে লিখেছেন : فَظَنُّوْا رَفْعَهُ إِلَي السَّمَاءِ قَتْلًا “ফলে তারা (ইহুদীরা) তাঁকে (ঈসাকে) আকাশে উঠিয়ে নেয়াকে হত্যা করার ধারণা করেছিল”। (আল-ফাওযুল কাবীর [আরবী] ৩৮; দারুল গাওছানী লিদ-দিরাসাতিল কুরআনিয়্যা, দামেস্ক হতে প্রকাশিত)। আল্লাহতালা আমাদেরকে আহমদীয়া তথা কাদিয়ানী এ দাজ্জালী ফেতনা থেকে পুরোপুরি রক্ষা করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here