- চন্দ্রসূর্য গ্রহণের বর্ণনাটি কি রাসূল (সা:) এর হাদীস? ১৮৯৪ সালের সেই গ্রহণ কাদিয়ান থেকেও কি দৃশ্যমান ছিল?
- একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ এর ঘটনা নিয়ে কাদিয়ানীদের বাড়াবাড়ি
প্রশ্নকর্তা : মাহদীয়তের আলামত একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হওয়া, এটি রাসূল (সা:) থেকে কিংবা কোনো সাহাবী থেকে বর্ণিত কোনো হাদীস? তাছাড়া ৬ ই এপ্রিল ১৮৯৪ সালে সংঘটিত গ্রহণ কাদিয়ান থেকেও দৃশ্যমান হওয়ার দাবীটা কতটুকু সত্য?
উত্তরদাতা : প্রথমত, মাহদীয়তের আলামত হিসেবে হাদীস নামক বর্ণনাটি ‘দারে কুতনী’ নামক হাদীসের একটি কিতাবে পাওয়া যায়। যেটি রাসূল (সাঃ)-এর কথা নয়, কোনো সাহাবীরও কথা নয়। হ্যাঁ এটি মুহাম্মদ বিন আলী বিন হোসাইন-এর নিজের একখানা বক্তব্য (তিনি আবূ জা’ফর আল-বাকের নামেও পরিচিত)। ‘দারে কুতনী’ কিতাবটির “বাবুল ছিফাতি সালাতিল খুসূফ” শীর্ষক পৃষ্ঠাটি খুলে দেখুন, সেখানেই দেখতে পাবেন যে, হাদীসটির সনদ (ধারাবাহিক সূত্র) মুহাম্মদ বিন আলী (রহঃ) পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়।
দ্বিতীয়ত, বর্ণনাটি বহু কারণে দলিল প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তার কারণ ইমাম বাকের এর নামে যেই সূত্রে (সনদ) এটি বর্ণিত হয়েছে সেটির Chain of narration তথা বর্ণনাসূত্র মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল। এ সম্পর্কে প্রমাণ্য কিছু উক্তি নিম্নরূপ –
- আমর ইবনে শামির : ইমাম ইবনে হাব্বান (রহ:) তিনি এর একজন রাবী তথা বর্ণনাকারী ‘আমর ইবনে শামির’-কে “শীয়া” আখ্যায়িত করে বলেছেন, এই লোক রাসূল (সা:)-এর সাহাবীদের গালমন্দ করত। দেখুন ইবনে হাব্বান (রহ:) রচিত ‘আল-মাজরূহীন মিনাল মুহাদ্দিসীন’। বিস্তারিত দেখুন ইমাম যাহাবী (রহ:) রচিত ‘মীযানুল ইতিদাল’ খন্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ২৬২।
ইমাম নাসাঈ (রহ:) ‘আদ-দ্বু’আফা ওয়াল মাতরূকীন’ কিতাবে লিখেছেন, এই ব্যক্তি মাতরূকুল হাদীস তথা হাদীসের জগতে পরিত্যাজ্য। ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রহ:) এবং ইমাম বুখারী (রহ:) উনারাও বলেছেন, এই লোক মুনকারুল হাদীস তথা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য। (দেখুন, ‘তালখিছুল মুসতাদরিক’ খন্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ২৪৬)।
এখানে বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনে হাজার আল-আসকালানী (রহঃ) রচিত ‘লিসানুল মীযান’ এর উদ্ধৃতি পেশ করছি। তিনি লিখেছেন : عمرو بن شمر الجعفي الكوفي الشيعي أبو عبد الله عن جعفر بن محمد وجابر الجعفي والأعشم روى عباس عن يحيى ليس بشيء وقال الجوزجاني زائغ كذاب وقال بن حبان رافضي يشتم الصحابة ويروي الموضوعات عن الثقات وقال البخاري منكر الحديث قال يحيى لا يكتب حديثه অর্থাৎ আমর ইবনে শামির (রাবী নং ১০৭৫) সে একজন শীয়া রাবী, সঙ্কীর্ণমনা, চরম মিথ্যাবাদী, রাফেজি, সাহাবাদের গালমন্দকারী, বিশ্বস্ত রাবীদের নাম ভেঙ্গে জাল হাদীস বর্ণনাকারী, মুনকারুল হাদীস, তার হাদীস লেখাযোগ্য নয় ইত্যাদি। অতএব, জ্ঞানীদের নিকট এখন আর গোপন থাকেনি যে, সূত্রে অবস্থিত এমন একজন রাবী তথা বর্ণনাকারী সম্পর্কে এইরকম ৮ প্রকারের জরাহ (আপত্তি) উল্লেখ থাকার পরে এটি কোনোভাবেই আর গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা!
- জাবের আল-জা’ফী : সনদের আরেকজন রাবী হচ্ছেন, জাবের আল-জা’ফী (মৃত : ১২৮ হিজরী)। ইমাম ইবনে হাব্বান (রহঃ) বলেছেন, এই ব্যক্তি ইহুদী বংশোদ্ভূত আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা এর দলভুক্ত ছিল। সে হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে পুনঃজন্ম হবার আকীদা রাখত। সে বলত, আলী দুনিয়াতে দ্বিতীয়বার জন্মিবেন । ইবনে হাব্বান রচিত ‘আল-মাজরূহীন, বাবুল আঈন দ্রষ্টব্য। (দেখুন, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) রচিত ‘তাহযীবুত তাহযীব’ খন্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ২৮৫) ।
ইমাম সুফিয়ান আস সাওরী, ইমাম হুমাইদী, ইমাম বুখারী, ইমাম মুহাম্মদ বিন সালমান বিন ফারিস প্রমুখ সবাই বলেছেন, এই ব্যক্তি “পুনঃজন্ম” মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। আর ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) তার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, “আমি জাবের আল-জা’ফী অপেক্ষা অতি মিথ্যাবাদী আর কাউকে দেখিনি।” (দেখুন, ইবনে আবী আদী রচিত ‘আল কামিল ফী দ্বু’আফায়ির রিজাল’ খন্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ১১৩)। এখন নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে বলুন তো এই ধরণের বর্ণনা কিরূপে দলিলপ্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে? সব চেয়ে বড় কথা হল, এটি না রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্য আর না কোনো সাহাবীর বক্তব্য; কারোর-ই বক্তব্য নয়।
তৃতীয়ত, তর্কের খাতিরে রেওয়ায়েতটি কিছুক্ষণের জন্য যদি সঠিক মেনে নিই, তবুও বিপত্তি থেকেই যায়। কারণ, বর্ণনাটির ভাষ্য হল “ইন্না লি-মাহদীনা আয়াতাঈনি লাম তাকূনা মুনযু খালক্বিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি”। ‘দারেকুতনী’র উল্লিখিত বর্ণনাটিতে পরিষ্কার লেখা আছে “আমাদের মাহদীর দুটি আলামত বা নিদর্শন এমন রয়েছে যা নভোমণ্ডল আর ভূমন্ডলের জীবন ইতিহাসে সংগঠিত হয়নি”। এবার লক্ষ্য করুন। যে দুটি নিদর্শন (একই রমযানে চন্দ্র এবং সূর্যগ্রহণ লাগা)—’র কথা বলা হচ্ছে সেটি যেন এইরূপ নিদর্শন যা ইতিপূর্বে আর কখনো সংঘটিত হয়েছে – এমন না।
অথচ ইতিহাস সাক্ষী, একই রমযানে চন্দ্রসূর্য গ্রহণ লাগার ঘটনা শত-সহস্রবার ঘটেছে। আপনি Encyclopedia of Britannica ছাড়াও আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র ওয়েব সাইটে গিয়েও দেখতে পারেন, সেখানে ‘গ্রহণ’ সম্পর্কে গবেষণাধর্মী বেশ কিছু তথ্য পাবেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭৬৩ বছর থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬৬৪ বছর অব্ধি চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের উপর বিশদ তথ্য-উপাত্ত দেখতে পাবেন। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা দাবী করেছে, প্রত্যেক ২২৩ বছর পরপর এইরূপ “গ্রহণ” এর পুনঃবৃত্তি বহুলাংশে ঘটে থাকে। ইতিপূর্বে এই ‘গ্রহণ’ যেই মাসে, যেই পদ্ধতিতে এবং যেই সময়টিতে হয়েছিল পরবর্তী ২২৩ বছর পরেও সেটি অভিন্ন নিয়মে ঘটে থাকবে। এই হিসেবে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, গত অষ্টাদশ শতাব্দীতে হিজরীর ১২৬৭ (১৮৫১ইং) হতে হিজরী ১৩১২ এর ভেতর মাত্র (১৩১২-১২৬৭) পয়তাল্লিশ বছরের ব্যবধানে একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের ঘটনা পাঁচবার (০৫) ঘটেছিল।
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের পাক্ষিক আহমদী সাময়িকির ১৫ই এপ্রিল ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ সংখ্যাতেও একথাগুলো উল্লেখ আছে। নিচে দেখুন-
(ক) ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে (১২৬৭ হিজরী মুতাবেক) চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। সে সময় চন্দ্রগ্রহণ হয় ১৩ই জুলাই এবং সূর্যগ্রহণ হয় ২৮ই জুলাই। তখন একমাত্র মাহদী দাবীদার ছিলেন ইরান বংশোদ্ভূত বাহায়ী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা আলী মুহাম্মদ বাব। তার মাহদীয়ত দাবির ৫ বছর পরেই এটি সংঘটিত হয়। কারণ তিনি ১৮৪৮ সালে নিজেকে ইমাম মাহদী দাবী করেন। মজার ব্যাপার হল, সেই শতাব্দীতে মুহাম্মদ আহমদ সুদানী (সুদান, আফ্রিকা) সাহেবও মাহদী দাবী করেছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তার বয়স যখন ২৮ বছরে পদার্পণ করে তখনো ১২৮৯ হিজরীতে (১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দ) একই রমযানে উভয়গ্রহণ সংঘটিত হয়। তেমনি পরের বছরও ১২৯০ হিজরীতে (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) উভয়গ্রহণ আবার সংঘটিত হয়। কিন্তু সেই সময় মাহদী দাবিদার কেউ ছিলনা। তবে হ্যাঁ পরবর্তীতে ১৮৮১ সালে তথা উভয়গ্রহণ সংঘটিত হবার পরবর্তী আট (৮) বছরের মাথায় মুহাম্মদ আহমদ সুদানী সাহেব নিজেকে ইমাম মাহদী দাবী করেন। সেই সময় মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ছিলেন মাত্র ১২ বছরের কিশোর। এ পর্যন্ত গ্রহণের তিনবারের তথ্য পাওয়া গেল।
(খ) তারপর ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রগ্রহণ হয় ২১ই মার্চ এবং সূর্যগ্রহণ হয় ৬ই এপ্রিল। তখন মাহদী দাবীদার ছিলেন ভারতের পাঞ্জাবের মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। এই সময় সূর্যগ্রহণ এশিয়ার নানা দেশসহ ভারতের নানা স্থান থেকে সামান্য দৃশ্যমান হলেও পাঞ্জাব (কাদিয়ান) থেকে সেটি মোটেও দৃশ্যমান ছিলনা। এটি আমার মুখের কথায় নয়, বরং নাসার বিজ্ঞানীদের ওয়েবসাইটে এইরকমই উল্লেখ পাওয়া যায়। (নাসার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের মানচিত্র দুটি দেখুন)। Click in here
(গ) তারপর ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ১১ই মার্চ চন্দ্রগ্রহণ হয় আর সূর্যগ্রহণ হয় ২৬ই মার্চ। সে সময় আমেরিকা বংশোদ্ভূত মিস্টার জোহন আলেকজান্ডার ডুঈ (মৃত ১৯০৭ ইং) সাহেব ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে নিজেকে মসীহ মওউদের অগ্রদূত বলে দাবী করেন। এই পর্যায় মিস্টার ডুঈ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী একথা ঠিক, কিন্তু আমার কথা সেখানে না; কথা হল, একই রমযানে উভয় গ্রহণ ১৮৯৫ সালেও সংঘটিত হওয়াতে কি পরিষ্কার হয়ে গেল না যে, এটি প্রকৃতির সাধারণ নিয়মই বটে, কোনো নিদর্শন তিদর্শন এগুলা কিচ্ছুনা !? নইলে প্রশ্ন আসবে,
(১) উক্ত গ্রহণ দুটি প্রকৃতপক্ষেই মাহদীয়তের বিশেষ কোনো নিদর্শন হলে তখন এইধরণের কোনো হাদীস সরাসরি রাসূল (সা:) কিংবা কোনো সাহাবী থেকেও কী কারণে বর্ণিত হয়নি?
(২) আরো প্রশ্ন আসবে, দারে কুতনী নামক কিতাবের বর্ণনাটির ভাষ্যমতে : آيتين لم تكونا (আয়াতাঈনি লাম তাকূনা) অর্থাৎ এই দুটি এমন নিদর্শন যা (ইতিপূর্বে আর) সংঘটিত হয়নি’- তাহলে রাসূল (সা:) এর যুগ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এটি কম করে হলেও প্রায় ১০৯ বার কী কারণে সংঘটিত হল? যদিও বা নাসা’র বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে আজ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক এই ধরণের গ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। এখন এর কী জবাব?
উল্লেখ্য, তাকূনা (تكونا) শব্দটি দ্বিবাচক স্ত্রীলিঙ্গ ক্রিয়াপদ। তার কারণ, তাকূনা শব্দটির মুবতাদা (উদ্দেশ্য/Subject) হচ্ছে (শুরুতে লাম হরফে যর-র কারণে যের এর অবস্থায়) ‘আইয়াতাঈনি’ (آيتين); যেটির বচন ও লিঙ্গও যথাক্রমে, দ্বিবাচক স্ত্রীলিঙ্গ। অতএব কাদিয়ানীরা শব্দটির ভুলভাল বিশ্লেষণ দিয়ে নিজেদের অবোধ অনুসারীদের বোকা বানাতে চাওয়ায় এখন তাদেরকে অনতিবিলম্বে ক্ষমা চাওয়া উচিত! আল্লাহ সবাইকে কথাগুলো নিরপেক্ষতার সাথে ভেবে দেখার তাওফিক দিন, আমীন!!
- লিখাটি লাইক/শেয়ার/কপি করে প্রচার করুন! অথবা আরো কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে কমেন্টে নক করুন!
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক