Home উম্মতিনবী কুরআনের যেসব আয়াত দিয়ে মির্যা কাদিয়ানীর নবী দাবীকে বৈধতা দিতে চায় সে সম্পর্কে

কুরআনের যেসব আয়াত দিয়ে মির্যা কাদিয়ানীর নবী দাবীকে বৈধতা দিতে চায় সে সম্পর্কে

0
কুরআনের যেসব আয়াত দিয়ে মির্যা কাদিয়ানীর নবী দাবীকে বৈধতা দিতে চায় সে সম্পর্কে

হাদীসের নাম ভেঙ্গে কথিত উম্মতিনবীর দলিল ও তার খন্ডন পড়ুন

সূরা আলে ইমরান ৮১, আল মুমিনূন ৫১, আহযাব ০৭, আন নাহল ০২, আ’রাফ ৩৫, আলে ইমরান ১৬৪, নিসা ৬৯, সূরা হাজ্জ ৭৫, সূরা জুমা ২-৩, সূরা রা’আদ ৭ ইত্যাদি আয়াত সমূহের অপব্যাখ্যা খন্ডন :

অপ্রিয় হলেও বাস্তব সত্য কথা, ৯৯% কাদিয়ানী মু’আল্লিমের ইসলাম সম্পর্কে ফান্ডামেন্টাল কোনো নলেজই নেই। এদের জ্ঞানের দৌড় পাকি কাদিয়ানী মুরুব্বি আব্দুর রহমান খাদিম রচিত আহমদীয়া পকেটবুক পর্যন্তই। আর মিস্টার আব্দুল আউয়াল সাহেব থেকে যতটুকু শুনেন ততটুকুই। তাই কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট নিয়ে বিতর্ক করার আগে নিচের লিখাটি ভালো করে বুঝে পড়ুন। যাতে পবিত্র কুরআন থেকে তাদের ইজরায়ে নবুওয়ত এর কনসেপ্ট আবিষ্কার করার পূর্বে এই নকশার দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। ঠিক আছে, এবার শুরু করা যাক!

তাদের মু’আল্লিমদের প্রথমে জিজ্ঞেস করে জবানবন্দি নিবেন এভাবে যে,

মির্যা কাদিয়ানীর “নবী” দাবী কুরআন হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত, এই তো? তাহলে প্রথমেই জেনে নেয়া যাক মির্যা সাহেবের রচনাবলীতে তার “নবী” দাবীটা কেমন শব্দচয়নে উল্লেখ আছে!

১- মির্যা কাদিয়ানীর মতে তিনিই একমাত্র ও সর্বশেষ উম্মতিনবী। যেমন তার ‘হাকীকাতুল ওহী’ বইয়ের ৩৩০-৩১ নং পৃষ্ঠায় (বাংলায় অনূদিত) লিখা আছে, “মোটকথা খোদার ওহী ও অদৃশ্য বিষয়ের এই বিপুল অংশের জন্য এই উম্মতে আমি-ই একমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি। আমার পূর্বে এই উম্মতে যত আউলিয়া, আবদাল ও কুতুব চলিয়া গিয়াছেন তাহাদিগকে এই পুরস্কারের বিপুল অংশ দেওয়া হয় নাই। অতএব এই কারণে “নবী” নাম পাওয়ার জন্য আমাকেই নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। অন্য সকল লোক এই নামের যোগ্য নয়।…. সহীহ হাদীস অনুযায়ী এই রূপ ব্যক্তি একজনই হইবেন এবং এই ভবিষৎবাণী পূর্ণ হইয়াছে। (আরো দেখুন রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৬-৭)।

২- আরো লিখা আছে, নবী তিন (৩) প্রকার। হাকিকি নবী, মুস্তাকিল নবী এবং উম্মতিনবী। মির্যা সাহেবদের মতে, হাকিকি আর মুস্তাকিল এই দুই প্রকারের নবী আর হবেনা কিন্তু জিল্লি [উম্মতি] নবী’র আগমনীধারা বন্ধ হয়নি। (মির্যাপুত্র বশির আহমদ এম.এ রচিত ‘কালিমাতুল ফসল’ পৃ-২৩ প্রথম অধ্যায়)। তবে জিল্লি [উম্মতি] নবী শুধুমাত্র একজনই হবেন। আর তিনি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সাহেব নিজেই।

৩। অন্যত্রে লিখা আছে, মির্যা কাদিয়ানীর দাবীকৃত ‘নবুওয়ত’ আগের নবীগণের মত আল্লাহপ্রদত্ত নয়, বরং তা মুহাম্মদে আরাবী (সা.)-এর আনুগত্য দ্বারাই অর্জিত। (দেখুন হাকীকাতুুন নবুওয়ত ১/৫৪২)।

৪। অন্যত্রে আরো লিখা আছে, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘রাসূল’ (رسول) শব্দটি আ’ম (عام) বা ব্যাপক অর্থবোধক যার অর্থের মধ্যে নবী, রাসূল এবং মুহাদ্দাসও অন্তর্ভুক্ত। (রূহানী খাযায়েন ৫/৩২২)।

৫। অন্যত্রে এও লিখা আছে যে, عام لفظ کو خاص معنی میں محدود کرنا صریح شرارت ہے ((আ’ম লফজ কো খাস মা’নি মে মাহদূদ করনা ছরীহ শারারত হে)) অর্থাৎ ‘আম’ (عام) শব্দকে খাস (خاص) অর্থে সীমাবদ্ধ করা সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। (রূহানী খাযায়েন ৯/৪৪৪)। তদুপরি মির্যাপুত্র মির্যা বশির আহমদ এম. এ সাহেবের রচনার ভাষ্যমতে, পবিত্র কুরআনের কোথাও এই তৃতীয় প্রকারের (জিল্লি/বুরুজি/উম্মতি) নবী শব্দ উল্লেখ নেই। (কালিমাতুল ফছল ২৭, প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

(তারপর বলবেন)

এবার আপনাদের উত্থাপিত আয়াত আর হাদীসগুলোর উপর একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। কেননা আপনারা ভবিষ্যতেও নবী-রাসূল আগমনীধারা অব্যাহত থাকার দলিল হিসেবে সাধারণত নিচের আয়াতগুলোই প্রদর্শন করে থাকেন। যেমন:-


১। “আর যখন আল্লাহ নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা দান করছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রসূল আসবে, তখন নিশ্চয় তোমরা তাকে বিশ্বাস ও সাহায্য করবে” (আলে ইমরান ৮১)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- প্রথমত, উক্ত আয়াতে যেই ‘রাসূল’ সম্পর্কে আলোচনা তার থেকে মির্যা কাদিয়ানীকে উদ্দেশ্য নেয়া শুধু মূর্খতা আর পাগলের প্রলাপ নয় বরং সুস্পষ্ট হটকারিতাও। আয়াতের শানে নুযূল বলছে, এখানে উল্লিখিত “রাসূল” বলতে হযরত মুহাম্মদ (সা:)-কেই বুঝানো হয়েছে। আল্লাহতালা রূহের জগতে সমস্ত নবী রাসূলকে একজন অত্যাসন্ন ‘রাসূল’ এর আবির্ভাব সম্পর্কে অবহিত করেছেন। অত্র আয়াতে রূহের জগতে সমস্ত নবী রাসূলকে সম্বোধন করে ‘লাতু-মিনুন্নাহ বিহী‘ (لتؤمنن به তথা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে) শব্দও বলা হয়েছে। কাজেই এখন যদি ঐ মীছাক-ওয়ালা রাসূল (নাউজুবিল্লা) মির্যা কাদিয়ানীই হন তখন কিন্তু বহু অসঙ্গতির কবলে পড়তে হবে! মির্যা কাদিয়ানী নিজেও একথা তার বইতে লিখে গেছেন। দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১৮/৬৭৫। স্ক্রিনশট –
.

১- আয়াতের “রাসূল” শব্দটি আ’ম হওয়া সত্ত্বেও সেটি খাস (উম্মতি/বুরুজি) অর্থে গৃহীত হচ্ছে, যা সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। যেজন্য সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে হবে যে, অত্র আয়াতে উল্লিখিত “রাসূল” শব্দটি স্রেফ বুরুজি বা উম্মতি অর্থেই খাস, হাকিকি বা মুস্তাকিল ধরনের কোনো অর্থ তাতে নিহিত নয়।

২- মির্যার কথিত উম্মতি বা বুরুজি কনসেপ্টও ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ আয়াতটিতে ঐ আগমনকারী রাসূলের উপর অবশিষ্ট সমস্ত নবী রাসূলকে ঈমান আনতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠে, মির্যা কি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার স্তরে উন্নীত যে, তার উপর ঈমান আনতে স্বয়ং মুহাম্মদ (সা:)ও আদিষ্ট? নাউযুবিল্লাহ।

৩- মির্যায়ীদের জন্য সব চেয়ে বড় দুঃসংবাদ হল, মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ) নিজেই হাদীসে বলে গেছেন لو كان بعدى نبى لكان عمر ابن الخطاب (লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লাকা-না ওমর ইবনুল খাত্তাব) অর্থাৎ যদি আমার পরে কোনো নবী হত তাহলে সে ওমর ইবনুল খাত্তাব-ই হত। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ৩৬৮৬)। এখন প্রশ্ন হল, পবিত্র কুরআনেই নতুন কোনো নবী-রাসুলের আগমনী সংবাদ সত্যিই যদি থাকবে তাহলে মহানবী (সা:) কিজন্য উমর (রা:) সম্পর্কে ঐ ধরনের বাণী রেখে গেলেন? অথচ পবিত্র কুরআনের সঠিক মর্মার্থ উনার (সা:) থেকে বেশি বুঝার দাবী করার দুঃসাহস কারো নেই! জ্ঞানীদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে।


২। ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হইতে আহার কর ও সৎকর্ম কর; তোমরা যাহা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (আল মুমিনূন ৫১; ইফা)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- এই আয়াত কিভাবে আগামীতে আরো নতুন নবী রাসূল আগমন করবেন বলে বুঝাল তা বোধগম্য নয়। উল্লেখ্য, এখানে “হে রাসূলগণ” বলে বহু রাসূলকে সম্বোধন করা হয়েছে। এখন যদি ওদের কথাই সঠিক ধরি তাহলে মানতে হবে যে, অত্র আয়াতে কমপক্ষে তিন বা ততোধিক রাসূলের আগমনের ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে। ফলে এটি মির্যা কাদিয়ানীর ‘এই উম্মতে নবী নাম পাওয়ার জন্য আমিই একমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি’—কথা মিথ্যা এবং বাতিল হয়ে যাচ্ছে বৈ নয়!

৩। ‘স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়ম তনয় ঈসার নিকট হইতেও – তাহাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।’ (আহযাব ৭; অনুবাদ-ইফা)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- আয়াতটির সঠিক তাৎপর্য কী এ নিয়ে বহু কাদিয়ানী জ্ঞানপাপী আজও দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিপতিত। ফলে তাদের অধিকাংশই মনে করছে যে, বোধহয় আয়াতটি নতুন একজন নবীর আগমনের বার্তা দিচ্ছে!! নাউযুবিল্লাহ। অথচ অত্র আয়াতে নতুন নবীর আগমনের বিন্দুমাত্র কোনো ইংগিতই নেই। প্রথমে আয়াতের অর্থ :- وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِنَ النَّبِیّٖنَ مِیۡثَاقَہُمۡ وَ مِنۡکَ وَ مِنۡ نُّوۡحٍ وَّ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسَی ابۡنِ مَرۡیَمَ ۪ وَ اَخَذۡنَا مِنۡہُمۡ مِّیۡثَاقًا غَلِیۡظًا অর্থ- স্মরণ কর, আমি নবীদের নিকট হতে, তোমার নিকট হতে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, মরিয়ম-তনয় ঈসার নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম; গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে এই দৃঢ় অঙ্গীকার বলতে কি বুঝানো হয়েছে? উত্তরে বলতে পারি, এটি ঐ অঙ্গীকার, যার বর্ণনা সূরা (الشورى) আশ-শূরার ৪২:১৩ নং আয়াতে রয়েছে এবং তা এই যে, اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡہِ অর্থ—”দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে বিভক্ত হয়ো না।এবার সূরা আশ-শূরার ১৩ নং আয়াতের অনুবাদ :- شَرَعَ لَکُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا وَصّٰی بِہٖ نُوۡحًا وَّ الَّذِیۡۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ وَ مَا وَصَّیۡنَا بِہٖۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰۤی اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡہِ ؕ کَبُرَ عَلَی الۡمُشۡرِکِیۡنَ مَا تَدۡعُوۡہُمۡ اِلَیۡہِ ؕ اَللّٰہُ یَجۡتَبِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یُّنِیۡبُ অর্থ- তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে, আর যা আমরা ওহী করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ‘ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে বিভেদ সৃষ্টি কর না।

আয়াতটিতে মুহাম্মদ (সা:)-এর নাম প্রথমে থাকার কারণ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) নিজেই হাদীসে ইরশাদ করে গেছেন। তাফসীরে তাবারী-তে এসেছে, তিনি বলেছেন كنت اولهم فى الخلق و آخرهم فى البعث (কুনতু আউয়ালুহুম ফিল খালকি ওয়া আখিরুহুম ফিল বি’ছি) অর্থ আমি (যদিও) আবির্ভাবের দিক থেকে সবার শেষে (তবে কিন্তু) আমি সৃষ্টির দিক থেকে সবার প্রথম।

এখন বিস্ময়কর কথা হল, মহানবী (সা:) যে আয়াত দ্বারা নিজের খতমে নবুওয়তের প্রমাণ দিয়ে গেছেন সেই আয়াত দ্বারা কাদিয়ানীরা নবুওয়ত জারি থাকার প্রমাণ দিচ্ছে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পবিত্র কুরআনের সঠিক মর্মবাণী মহানবী (সা:)-এর চেয়েও কাদিয়ানীরা খুব ভালো বুঝে! নাউযুবিল্লাহ।


৪। “তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে ওহী (প্রত্যাদেশ) সহ ফিরিশতা অবতীর্ণ করেন, এই মর্মে যাতে তোমরা সতর্ক করো, আমি ছাড়া কোনো (সত্য) উপাস্য নেই; সুতরাং তোমরা আমাকে ভয় করো।” (আন-নাহল ০২)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- আয়াতটিতে মুদারের (الفعل المضارع) ছিগাহ যোগে ينزل ক্রিয়াপদ থাকায় ভবিষ্যতেও আরো নবী রাসূলের আগমন ঘটবে বলে ধারণা করা নিতান্তই চরম পর্যায়ের মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না। কারণ ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ চলমান এবং পুরো ঘটিত দুইভাবেই অর্থ প্রদান করে থাকে। উক্ত আয়াতে ‘ওহী প্রেরণ করাটা’ সময়সাপেক্ষ পুরো ঘটিত একটি ক্রিয়া মাত্র, ভবিষ্যতেও এর ধারা চলমান থাকবে বুঝায়নি। পবিত্র কুরআনে এর আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, সূরা তওবা আয়াত নং ৭১ এর মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে তাদের পূর্ণ আনুগত্যের উপর মুদারের ছিগাহ যোগেই উল্লেখ আছে, و يطيعون الله و رسوله (অর্থাৎ এবং তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করিয়াছেন)। এখন এর মানে কি বর্তমানেও তাদের সেই আনুগত্যের ধারা অব্যাহত? আসলে আরবী ব্যকরণজ্ঞানে শূন্য নির্বোধদের বুঝাতে পারে এমন সাধ্য কার?

নির্বোধদের কথা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও বিপত্তি থেকেই যাচ্ছে। কেননা আয়াতটির ভেতর ان انذروا (অর্থাৎ যাতে তোমরা সতর্ক করো) বহুবচনাত্মক পদ এসে যেন নির্দেশ করছে যে, আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাদের প্রতি ওহীসহ ফেরেশতা নাযিল করবেন তাদের সংখ্যা কোনোভাবেই একক কোনো ব্যক্তির ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। পক্ষান্তরে মির্যা কাদিয়ানীর দাবী হল,সহীহ হাদীস অনুযায়ী এই রূপ ব্যক্তি একজনই হইবেন এবং এই ভবিষৎবাণী পূর্ণ হইয়াছে।(দেখুন রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৬-৭)। এখন সমীকরণ কিভাবে মিলাবেন? সুতরাং নির্বোধগুলোর ঐ দাবী মিথ্যা ও বাতিল। এখানে মির্যার হাকীকাতুল ওহী বইয়ের ৩৩০ নং পৃষ্ঠা থেকে দেখুন,

.

৫। ‘হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে কোনো রাসূল (বার্তাবাহক) আগমন করেন, তোমাদেরকে আমার আয়াতসমূহ শুনায়, তাহলে যে ব্যক্তি সংযত হয় এবং সৎকাজ করে; তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা।’ (আ’রাফ ৩৫)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- প্রথমত, এখানে ‘তোমাদের মধ্য থেকে রসূলগণ’ আগমন করবে বলা হয়েছে। কাজেই প্রশ্ন আসবে যে, এ আয়াত যদি ভবিষ্যতেও নবী রাসূল হওয়ার দিকে ইংগিত হয় তাহলে তো মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের পরেও কেয়ামত পর্যন্ত আরও অসংখ্যা-অগণিত নবী রাসূল হওয়ার কথা। আরও প্রশ্ন আসবে যে, আয়াতটির “রাসূল” শব্দের সাথে মির্যা কাদিয়ানীর কী সম্পর্ক? যখন তিনি নিজেই লিখে গেলেন যে, তার নবুওয়ত আগের নবী রাসূলদের মত আল্লাহপ্রদত্ত নয়! অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটা জিনিস যাকে ‘মুহাদ্দাস’ অর্থে অভিহিত করা হবে। অধিকন্তু মির্যা সাহেব এর ‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ (বাংলা অনূদিত) বইয়ের ৮২ নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার করে একথাও লিখা আছে, মুহাম্মদী সিলসিলায় শেষনবী এই অধম (অর্থাৎ মির্যা কাদিয়ানী)। এখন কোনো ভাবেই তো এ আয়াত মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের নবুওয়তকে সাব্যস্ত করল না!

দ্বিতীয়ত, অত্র আয়াত নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট যাদের জানা, তারা নিশ্চয়ই মির্যা কাদিয়ানী ও তার মুরিদদের কথাবার্তায় হেসে খুন হবেন। কেননা এর শানে নুযূল (প্রেক্ষাপট) বলছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন “হে আদম সন্তানেরা! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে রসূলগণ আগমন করে তোমাদেরকে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনায়..” কথাটি রূহের জগতে সমস্ত বনী আদমকে লক্ষ্য করেই বলেছিলেন। তখনো কিন্তু পৃথিবীতে নবী রাসূলের আগমনীধারা শুরুই হয়নি (আয়াতটির শানে নুযূল বা প্রেক্ষাপট জানুন! ক্লিক করুন)। অতএব, অত্র আয়াত দিয়ে বর্তমানেও নবী রাসূলের আগমনীধারা অব্যাহত থাকার বিশ্বাস সুস্পষ্ট কুরআন-বিকৃতির শামিল। রেফারেন্স : তাফসীরে তাবারী, সূরা আল আ’রাফ; হাদীস নং ১৪৫৫৪, তাফসীরকারক বিশিষ্ট যুগ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃত : ৩১০ হিজরী)। আশাকরি এবার বুঝতে পেরেছেন।


৬। জনৈক কাদিয়ানীর প্রশ্ন, সূরা আলে ইমরান এর ১৬৪ নং আয়াতে লিখা আছে, “ইয বা’আছা ফীহিম রাসূলাম মিন আনফুসিহিম” অর্থাৎ যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে এক রাসূল আবির্ভূত করলেন…”। এর দ্বারা কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্য হতেই একজন রাসূলের কথাই বুঝিয়েছেন। আর তিনিই হলেন মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। কারণ মুহাম্মদ (সা:)-এর আবির্ভাব ‘মুমিনদের মধ্য হতে হয়নি’ বরং ‘উম্মীদের মধ্য হতে হয়েছে’। দেখুন সূরা জুম’আ আয়াত নং ২-৩।

  • ভ্রান্তি নিরসন:– না, এই আয়াতে উল্লিখিত ‘রাসূল’ দ্বারা হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর আগমনেরই সংবাদ দেয়া হয়েছে। মির্যাপুত্র মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদও একই কথা লিখে গেছেন (বারাকাতে খিলাফত পৃ-৯; অনলাইন এডিশন) । কেননা আয়াতে ‘বা’আছা’ (بعث) শব্দটি অতীতকালবাচক ক্রিয়াপদ। ফলে আয়াতের ঐ কথা পরবর্তীতে নতুন কোনো রাসূল সম্পর্কে নয়, বরং এমন এক রাসূল সম্পর্কে যিনি অতীতকালে আবির্ভূত হয়ে গেছেন। তর্কের খাতিরে মানলাম যে, এখানে ‘রাসূল’ শব্দটি দ্বারা মির্যা কাদিয়ানীর আবির্ভাবকেই বুঝিয়েছে। তাহলে নিচের এই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন!

প্রথমত, ঐ একই আয়াতে কিন্তু و يعلمهم الكتاب (উচ্চারণ : ওয়া ইয়ু’আল্লিমুহুমুল কিতাব) অর্থাৎ তিনি তাদেরকে কিতাব শিক্ষা দেবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। তাহলে মির্যা কাদিয়ানীর সেই কিতাবটি কী যার শিক্ষা তিনি তার উম্মতদের দিয়ে গিয়েছিলেন? আর হ্যাঁ, আপনাদের জন্য ঐ ‘কিতাব’ হতে কুরআন শরীফ উদ্দেশ্য নেয়ার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ আয়াতে শব্দটি নবী নয় বরং ‘রাসূল’। আর রাসূল কখনো নতুন বিধি-বিধান ব্যতীত আবির্ভূত হন না।

উল্লেখ্য, কোনো কোনো নির্বোধ এখানে বলতে পারে যে, নবী আর রাসূল তো একই। আমি এর জবাবে বলতে চাই, তাহলে হাশরের ময়দানে হযরত নূহ (আ:) হাশরবাসীদস্র দ্বারা يا نوح انت اول الرسل অর্থাৎ হে নূহ! আপনি প্রথম রাসূল—এইরূপ শব্দচয়নে কেন আহূত হবেন? (সহীহ বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া হাদীস ৩৩৪০ দ্রষ্টব্য)। অথচ নূহ (আ:)-এর আগেও বহু নবী ছিলেন! এটাই প্রমাণ করে, প্রত্যেক রাসূল একই সাথে নবী বটে, কিন্তু প্রত্যেক নবী একই সাথে রাসূল নন। যাইহোক, এখন ঐ আয়াতের রাসূল দ্বারা মির্যাকে উদ্দেশ্য নিতে গেলে তাকে নতুন শরীয়তবাহক নবী হওয়াও মানতে হচ্ছে! তো ঐ নির্বোধরা কি তাকে নতুন শরীয়তবাহকও মেনে নিলো?

দ্বিতীয়ত, আয়াতটির “রাসূল” শব্দ হতে মির্যাকে উদ্দেশ্য নিলে তখন সেটি আ’ম হওয়া সত্ত্বেও খাস (উম্মতি/বুরুজি) অর্থে গৃহীত হচ্ছে, যা সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। যেজন্য সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে হবে যে, অত্র আয়াতে উল্লিখিত “রাসূল” শব্দটি স্রেফ বুরুজি বা উম্মতি অর্থেই খাস, হাকিকি বা মুস্তাকিল ধরনের কোনো অর্থ তাতে নিহিত নয়। এবার আপনাকে একখানা হাদীস শুনাব।

হাদীসে এসেছে রাসূল (সা:) বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই নবুওয়ত এবং রেসালত বন্ধ, আমার পর না কোনো রাসূল আছে আর না কোনো নবী আছে।’ (তিরমিযী ২/৪৫৫, আনাস ইবনে মালেক হতে বর্ণিত)। হাদীসের মান : হাসান ও সহীহ। আশাকরি আপনাদের ভুলটি কোথায় এবং কিভাবে তা নিঃসন্দেহে বুঝতে পেরেছেন!


৭। জনৈক কাদিয়ানীর বক্তব্য, উম্মতে মুহাম্মদীয়ার কোনো ব্যক্তি ‘নবী’ হতে পারবেন, একথার উল্লেখ সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে এভাবে আছে যে, “এবং যারা আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য করবে তারা ঐ সকল লোকদের মধ্যে শামিল হবে যাদেরকে আল্লাহ পুরস্কার দান করেছেন অর্থাৎ নবীগণ এবং সিদ্দীকগণ এবং শহীদগণ এবং সালেহগণের মধ্যে। এবং এরাই সঙ্গী হিসেবে উত্তম।” (০৪:৬৯) এই আয়াতে কারীমায় একথাই বলা হয়েছে যে, রসূলেপাক (সা:)-এর উম্মতের মধ্যে এমন উম্মতীও হতে পারবেন যিনি সিদ্দীকের স্তর অতিক্রম করে যাবেন এবং নবীর স্তরে উন্নীত হবে। (উম্মতিনবী পৃষ্ঠা নং ১০; চতুর্থ সংস্করণ মার্চ, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ; প্রকাশনায় : আহমদীয়া মুসলিম জামাত, বাংলাদেশ)। স্ক্রিনশট :-

.
  • ভ্রান্তি নিরসন:– আয়াতের শানে নুযূল নিয়ে চিন্তা করলে একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষও বুঝতে পারে যে, আয়াতটি কখনো তথাকথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট ধারণ করেনা। যারা আয়াতটির শানে নুযূল নিয়ে ভাবতে প্রস্তুত নন তাদেরকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই!

১- ঐ আয়াতে তো ‘নবী’ এর বহুবচন ‘নাবিয়্যীন’ (অর্থাৎ নবীগণ) শব্দ রয়েছে। তাহলে কি কথিত ‘উম্মতীনবী’ আরো হবে বিশ্বাস করেন? যদি আরো হবে বিশ্বাস করেন তাহলে মির্যা কাদিয়ানী তার বইতে (হাকীকাতুল ওহী [বাংলা] পৃষ্ঠা নং ৩৩০) ‘এই উম্মতে আমিই একমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি’ বলে শুধুমাত্র একজনই উম্মতিনবী হবে, কেন লিখলেন?

হাকীকাতুল ওহী ৩৩০

২- আয়াতের অনুবাদ “যারা আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য করবে তারা ঐ সকল লোকদের মধ্যে শামিল হবে…”—এরকম হলে তখন و حسن اولئك رفيقا (ওয়া হাছুনা উলা-ইকা রফীকা) অর্থাৎ এবং এরাই সঙ্গী হিসেবে উত্তম, (অনুবাদ, উম্মতিনবী, পৃষ্ঠা নং ১০) একথার কী মানে?

৩- আনুগত্যকারী ব্যক্তি যেসব নবীর মধ্যে শামিল হচ্ছেন সেসব নবীকেও তথাকথিত ‘উম্মতীনবী’ মানা হচ্ছে কিনা? অন্যথা তাদের মধ্যে শামিল হবে কেমনে?

৪- যদি আয়াতের مع الذين انعم الله عليهم من النبيين الخ এর ‘মা’আ’ (مع) অর্থ শামিল বা অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে لا تحذن ان الله معنا (লা-তাহযান ইন্নাল্লাহা মা’আনা)-এর ‘মা’আ’ (مع) কী অর্থে দাঁড়াল? আশাকরি কথিত বুরজি/জিল্লি/ উম্মতিনবী’র কনসেপশনটাই বাতিল হওয়ার প্রমাণ পেলেন! আসুন, এবার উক্ত আয়াতের সঠিক তাৎপর্য কী জেনে নিই!

উক্ত আয়াতের সঠিক তাৎপর্য হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারী নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলে পরকালে (কেয়ামত দিবসে) শ্রেণীভেদে নবী, সিদ্দিক, শহীদ এবং পুণ্যবানদের সঙ্গী (সঙ্গ লাভকারী) হবে। তাফসীরে ইবনে কাসীর সহ প্রায় সমস্ত তাফসীরগ্রন্থে আয়াতটির Context বা শানে নুযূলের প্রেক্ষিতে বিশুদ্ধ বর্ণনার আলোকে এটাই লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর এই জন্যই আয়াতটির শেষাংশে ‘তাহারা কতই না উত্তম সঙ্গী’ বলে উল্লেখ রয়েছে, যাতে কেউ এই স্থলে মা’আ (مع) শব্দের অর্থ ভুলক্রমে শামিল বা অন্তর্ভুক্ত না নেয়।


৮। “আল্লাহতালা ফেরেশতাদের মধ্য হতে বাণীবাহক মনোনীত করেন, মানুষের ভেতর থেকেও (তিনি বাণীর গ্রহীতা বাছাই করেন); অবশ্যই আল্লাহতালা সবকিছু শোনেন ও সব কিছু দেখেন।” (সূরা আল হাজ্জ ৭৫)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- প্রথমত, আয়াতটিতে উল্লিখিত رسل বা রাসূলগণ হতে স্রেফ বুরুজি রঙ্গের নবী-রাসূলই উদ্দেশ্য—এর দলিল কী? কারণ মির্যা সাহেবের মত অনুযায়ী পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘রাসূল’ (رسول) শব্দটি আ’ম (عام) বা ব্যাপক অর্থবোধক যার অর্থের মধ্যে নবী, রাসূল এবং মুহাদ্দাসও অন্তর্ভুক্ত। (রূহানী খাযায়েন ৫/৩২২)।

দ্বিতীয়ত, আয়াতে یَصۡطَفِیۡ শব্দ দেখে ধোকা খাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আয়াতটির শানে নুযূল নিয়ে চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে, মুদারের এই ছিগাহ পুরো ঘটিত বর্তমানকালের জন্যই এসেছে। বিশিষ্ট যুগইমাম আল্লামা সুয়ূতী (রহ:) তাফসীরে জালালাইনের ভেতর এর শানে নুযূল উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এখানে রাসূলগণের মনোনীত করা সময়সাপেক্ষ একটা বিষয় মাত্র। এর মানে ভবিষ্যতেও নবী-রাসুল মনোনীত করতে থাকবেন—এমনটা উদ্দেশ্য নয়। নির্বোধদের বুঝার জন্য বলতে হয় যে, মির্যা কাদিয়ানী লিখেছেন, ‘সামান্য কিছুদিন পর মুন্সী এলাহী বখশ এর নিকট ইলহাম হয় يريدون ان يروا طمثك অর্থাৎ এই লোকেরা তোমার (মির্যা) ঋতুস্রাবের খুন দেখতে চাচ্ছে।’ (রূহানী খাযায়েন ১৭/৪৫২)। তো নির্বোধরা কি মনে করে যে, লোকেরা মির্যা সাহেবের ঋতুস্রাবের (হায়েজ) খুন কেয়ামত পর্যন্ত দেখতে চাচ্ছে? যতসব হাস্যকর!!

তৃতীয়ত, এখানেও رسل শব্দটি رسول এর বহুবচন। অর্থ বার্তাবাহক, প্রেরিত রাসূল। এখানেও সেই পূর্বের ন্যায়ই প্রশ্ন আসবে যে, মির্যা কাদিয়ানীর মত অনুযায়ী বুরুজি রঙ্গের নবী শুধু একজনই হবেন। এ সম্পর্কে উপরে আবার দেখা যেতে পারে। সুতরাং এই আয়াতও তথাকথিত বুরুজি রঙ্গের নবীর আগমনের দলিল নয়। অন্যথা তখন বুরুজি রঙ্গের নবী কমপক্ষে তিনজনই হওয়ার কথা! যাইহোক, ফেরেশতা ও মানুষের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা আল্লাহতালা বার্তাবাহক হিসেবে চয়ন করেন। বার্তাবাহক হিসেবে ফেরেশতাদের কাজ হল নবীদের কাছে ওহী পৌঁছে দেয়া, এ কাজগুলো করত জিবরাইল (আ:)। আর বার্তাবাহক হিসেবে নবীদের কাজ হল তাদের উপর আগত ওহী অনুসারে মানুষদেরকে দাওয়াত দেয়া, ওহীর বাণী পৌঁছে দেয়া। আশাকরি জবাব পেয়েছেন।


৯। সূরা জুম’আ এর ২ ও ৩ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে কাদিয়ানীরা দাবী করে যে, পৃথিবীতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর দ্বিতীয়বার আগমন ঘটবে! নাউযুবিল্লাহ। অথচ এই দাবী সম্পূর্ণ অসার, মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। এবার আসুন, প্রথমে আয়াত দুটির অনুবাদ জেনে নিই। আল্লাহতালা বলেন, هوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡن অর্থ- তিনিই নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রসূলরূপে যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা, যদিও ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে। (পরের আয়াত) وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡم অর্থ- আর তাদের (اٰخَرِیۡنَ) অন্যান্যদের মধ্যেও যারা এখনো তাদের সাথে (لَمَّا یَلۡحَقُوۡا) মিলিত হয়নি। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

  • বিভ্রান্তি নিরসন :– প্রথমত, এই আয়াতে أُمِّيِّيْنَ (নিরক্ষর) থেকে এমন আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে যাদের অধিকাংশই লেখাপড়া জানত না। অত্র আয়াতের সম্পূর্ণ বিষয়টির সংযোগ হল أُمِّيِّيْنَ এর সাথে। মানে, بَعَثَ فِي آخَرِيْنَ مِنْهُمْ (অর্থাৎ তিনি রসূল পাঠিয়েছেন তাদের অন্যান্যদের মধ্যেও)। আর آخَرِيْنَ বলতে পারসীক (বিশেষত, হযরত সালমান ফারসীর বংশধরেরা) এবং অন্যান্য অনারব লোক, যারা কিয়ামত পর্যন্ত রসূল (সা:)-এর উপর ঈমান আনয়ন করবে। এই সম্পর্কে সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে একটি হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আরব ও অনারবদের সেই সমস্ত লোক, যারা সাহাবাদের যামানার পর কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। আর ঈমান গ্রহণ করার পর এরা সবাই مِنْهُمْ (তাদের অন্যান্য) তথা সাহাবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রথম প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীরা أُمِّيِّيْن এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা সমস্ত মুসলমান একই উম্মত। এই (তাদের) সর্বনামের কারণে কেউ কেউ বলেন, ‘অন্যান্য’ বলতে পরে আগমনকারী আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, ‘তাদের’ সর্বনাম দ্বারা (আরব) ‘নিরক্ষরদের’ প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (বিশিষ্ট যুগ ইমাম আল্লামা শাওক্বানী রচিত, ফাতহুল ক্বাদীর দ্রষ্টব্য)।

দ্বিতীয়ত, ‘আখারীনা’ (آخرين) শব্দটি উম্মিয়্যীন (اميين) এর উপর আতফ (عطف) হওয়ায় সেটি যের-এর অবস্থায় হয়েছে। একথা বলেছেন, সহীহ বুখারী’র ব্যাখ্যাকারক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (ان يكون مجرورا عطفا على الاميين)। [ফাতহুল বারী, কিতাবু তাফসীরিল কুরআন দ্রষ্টব্য]। যার ফলে আখারীনা শব্দকে বা’আছা’ এর দ্বিতীয় মাফউল (object/কর্ম) ধরে এভাবে অর্থ নেয়া যাবেনা যে, আল্লাহ অন্যান্যদের পাঠিয়েছেন! এখানে দুইটা বিষয় খুবই লক্ষণীয়। একটি হল, ‘আখারীনা’ শব্দটি بعث এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে নসবের অবস্থায় হয়নি, বরং اميين এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে মাজরূরের (যের-এর) অবস্থায় হয়েছে। অপরটি হল, এখানে بعث পদটি ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ নয়, বরং অতীতকাল বাচক ক্রিয়াপদ। যদ্দরুন পরবর্তীতে কারো আবির্ভাবের কনসেপ্ট এখানে অনুপস্থিত। সুতরাং আপনাদের (কাদিয়ানীদের) বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে মুহাম্মদ (সা:)-এর পুনরায় আগমনের কোনো কথারই লেশমাত্র সম্পর্ক থাকবে তো দূরের কথা, ভবিষ্যতে দ্বিতীয় কারো আসার কোনো কনসেপ্টই এখানে নেই।

  • এই সম্পর্কে চমৎকার আরেকটি লিখা Click করুন

১০। “যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে, ‘তার প্রতিপালকের নিকট হতে তার নিকট কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ করা হয় না?’ তুমি তো শুধুমাত্র একজন সতর্ককারী। আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পথ প্রদর্শক রয়েছে।” (সূরা রা’আদ, ৭)।

  • ভ্রান্তি নিরসন : এখানে নবীর আগমনীধারা অব্যাহত রয়েছে বলে দাবীদারদের যুক্তি হল, আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, وَ لِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ মানে, ‘আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পথ প্রদর্শক রয়েছে।’ সুতরাং নবীর আগমনীধারা বন্ধ হয়নি। এর উত্তর হল, এই আয়াতে আল্লাহতালা আপনা কানূনে কুদরত (বিধিবিধান) সম্পর্কে জানান দিয়েছেন মাত্র। সেটি হল, তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নির্দেশনার জন্য তাদেরই ভাষাভাষী একজন সতর্ককারী বা নবী প্রেরণ করে থাকেন। আর সেই সতর্ককারী বা নবীদের প্রেরণের ধারাক্রম ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। সূরা ফাতিরের ২৪ নং আয়াতে ‘খালা’ (خَلَا) অতিতকালবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা সে কথার পরিষ্কার ইংগিতও রয়েছে। যেমন আল্লাহতালা বলেন, وَ اِنْ مِّنْ اُمّةٍ اِلَّا خَلَا فِيْهَا نَذِيْرٌ (ওয়া ইম্মিন উম্মাতিন ইল্লা খালা ফীহা নাযীর) অর্থাৎ ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট সতর্ককারী অবশ্যই এসেছে।’ এখন জানার বিষয় হল, কোন্ নবীর মাধ্যমে আল্লাহ সতর্ককারীদের ক্রমধারা পূর্ণ করলেন? এর উত্তরে সূরা আহযাব আয়াত নং ৪০ এর وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ (ওয়া খাতামান নাবিয়্যীন) এর ঘোষণাই যথেষ্ট। কারণ এখানে আল্লাহ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদ (সা.)-ই সেসব সতর্ককারীদের ক্রমধারা সমাপ্তকারী। সুনানু তিরমিজীর হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) নিজেই ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ এর মর্মার্থ পরিষ্কার করে দিয়ে বলেছেন لَا نَبِيَّ بَعْدِىْ (লা নাবিয়্যা বা’দী) অর্থাৎ ‘আমার পরে আর কোনো নবী নেই’।

খুব বেশি ব্যস্ততার কারণে বিস্তারিত লিখা সম্ভব হয়নি। সংক্ষেপে আজ এই পর্যন্ত। জ্ঞানীরা নিশ্চয়ই লিখাটি নিয়ে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করবেন এবং সত্যটা উন্মুক্ত মন নিয়ে খোঁজে নেবেন। আল্লাহ আমাদের বিভ্রান্ত ভাইবোনদের ঈমান হেফাজত করুন। আমীন।

সূরা নিসা আয়াত ৬৯ এর শানে নুযূল সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।

লিখাটি ফেইসবুক পেইজ থেকে পড়ুন

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ
এডমিন, www.markajomar.org
তারিখ ১৩/১০/২০২১ইং

Previous article মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (হাফিঃ)
Next article সূরা নিসা’র ৬৯ নং আয়াতটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! এটি সম্পূর্ণ দ্বীনি ও অলাভজনক একটি ওয়েবসাইট। প্রতি বছর এটির ডোমেইন ও হোস্টিং ফি হিসেবে আমাকে এর ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। যদি উক্ত ব্যয় বহন করতে অপারগ হই তাহলে এই সাইটটি নিশ্চিত বন্ধ হয়ে যাবে। সেহেতু আপনাদের সবার নিকট আবেদন থাকবে যে, আপনারা সাইটটির উক্ত ব্যয় বহনে এতে বিজ্ঞাপন দিতে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করবেন এবং নিজেরাও সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন। বিনীত এডমিন! বিকাশ : ০১৬২৯-৯৪১৭৭৩ (পার্সোনাল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here