কাদিয়ানীদের একটি প্রশ্ন ও আমার জবাব :
প্রিয় কাদিয়ানীবন্ধুরা! আমি চাই আমার এই লিখা আপনাদের কারো বদ-হজমের কারণ না হয়। কাজেই যাদের হজম শক্তি দুর্বল তারা দূরত্ব বজায় রাখবেন!
- কথায় আছে, আগের দিন বাঘে খাইছে। সবারই জানা, এখন সময় বদলে গেছে। সে সাথে শুধু জাগতিক শিক্ষাদীক্ষা আর প্রযুক্তির উন্নতি-ই হয়নি বরং দ্বীনি শিক্ষাদীক্ষারও খুবই উন্নতি হয়েছে। এখন প্রায় ঘরে ঘরে মওলানা মুফতি মুহাদ্দিস কিংবা দাওয়াত ও তাবলীগের দাঈ খুঁজে পাবেন। একদম সাধারণ থেকে সাধারণ মানুষও আগের মত এখন আর যাই বলবেন তাই মুখবুজে শুনে হজম করেনা, প্রশ্নও করে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, এখন এরাও দ্বীনি শিক্ষায় আগের মত পিছিয়ে নেই, মোটামুটি অগ্রসরমান। আর তাই অন্তত এটুকু হলেও বলতে শিখেছে, শায়খ বা হুজুর! হাদীসটি কি সহীহ না দ্বয়িফ? যদিও সে সহীহ আর দ্বয়িফের সংজ্ঞা ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারবেনা, ধারণা একটু হলেও আছে তা মানতে হবে। এটি খুবই ভালো দিক। আর এমনটি কেনই বা হবেনা, তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্বায়নের যুগেও কেউ কি স্বেচ্ছায় পিছিয়ে থাকতে পারে? পারেনা! তাই বলেছি, আগের দিন বাঘে খাইছে।
একথা বলার উদ্দেশ্য?
তাহলে শুনুন, সেই ১৯৯৪ কি ৯৫ সালের কথা। তাহাফফুজে খতমে নবুওয়তের আন্দোলন তখন গোটা দেশব্যাপী সাড়া জাগানিয়া ছিল। কিন্তু সেসব আন্দোলন কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা সচেতন জনতাই ভালো বলতে পারেন। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু এখন দীর্ঘ চিন্তাভাবনা শেষে আমি যা বুঝলাম তা এককথায় প্রকাশ করলে ওই সব আন্দোলনের সুফল ‘সামান্যই’ ছিল। যেহেতু তখন স্যোসাল মিড়িয়া ছিলনা, ছিলনা যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো উন্নতি। আর সে ‘সামান্যই’ হচ্ছে, দেশের বেশিরভাগ মানুষের কানে এটুকু পৌছানো যে, কাদিয়ানীরা কাফের! আসলে এইটুকুও বা কম কিসের?
কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ! খুশির খবর হল, বর্তমানে রদ্দে কাদিয়ানীয়তের উপর খতমে নবুওয়ত আন্দোলন এর নামে ভুঁইফোঁড় ব্যানারগুলো সমষ্টিগতভাবে যতটা খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন নাম-ঠিকানা ও ব্যানার বিহীন অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যাদের প্রায় সকলেই এই বিষয়ে পরিপূর্ণ অবিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত। আর তা সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র ইখলাস আর সুশৃঙ্খল মেহনতের মাধ্যমে। এককথায়, বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমেই তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছে। ফলে আমার হিসেবে গোটা বাংলাদেশে গত ২০১৬ সালের পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ এর বেশি কাদিয়ানী মির্যার ধোকা আর প্রতারণা বুঝতে পেরে স্বেচ্ছায় তাওবা পড়ে ইসলামে ফিরে এসেছে! এইজন্য মাঠ পর্যায়ে ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অবিজ্ঞ মু’আল্লিমদের অনেক বেশি দাওয়াতি কাজ করতে হয়েছে। আর তাই কাদিয়ানীদের ভাবা উচিত, আজকের সময়টা আর সেই ‘৯৪ এবং ‘৯৫ এক না। আরে আমি তো নিশ্চিত, আগামী আর কয়েকটা বছর পর বাংলাদেশের তাহাফফুজে খতমে নবুওয়তের ব্যানার বিহীন সংগ্রামীরা বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে খুব দ্রুতই একটা ইতিহাস সৃষ্টি করবে, ইনশাআল্লাহ। আর সেজন্যই বলেছি আগের দিন বাঘে খাইছে!
আসি মূলকথায়,
কাদিয়ানীদের কথিত খলীফাতুল মসীহ আউয়াল হেকিম নূরুদ্দীন এর ‘ফসলূল খেতাব’ (রচনাকাল ১৮৮৭ইং) পুস্তকের ২৮ নং পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট সহ উদ্ধৃতি দিয়ে গত লিখায় তাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম যে, দেখ দেখ সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নং আয়াতের ‘ক্বদ খালাত মিন কবলিহির রসুল’ এর অর্থে সেখানেও “বহু রাসূল গত হইয়াছে” লিখা আছে। বিস্তারিত আগের পোস্টে দেখুন। আগের পোস্ট এখানে
এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা একদম লা-জওয়াব ছিল। কিন্তু ইজ্জত বাঁচাতে শেষমেশ প্রসঙ্গ পাল্টে আমাকে প্রশ্ন করল, তাহলে মুহাম্মদ (সা:)-এর পূর্বে আরো বহু রাসূল যারা জীবিত তারা আর কে কে আছেন? আসুন তাদের এই প্রশ্নটিরও জবাব দিই!
আরও জীবিত “বহু রাসূল” কে কে আছেন?
প্রথমত, “বহু” এর প্রয়োগ এবং ব্যবহারিক তাৎপর্য বুঝতে হবে। সমস্ত আর বহু—এই দুইয়ের মাঝে আদৌ কোনো পার্থক্য আছে কি নেই! যদি কোনো পার্থক্য না থাকে তখন তো প্রশ্ন আসবে যে, তাহলে কাদিয়ানীদের অনুবাদকৃত কুরআনে তারা “বহু রাসূল” এর স্থলে “সমস্ত রাসূল” এইরূপ অর্থ কেন করল? অতএব পার্থক্য নিশ্চয়ই রয়েছে এটাই অনস্বীকার্য। তাহলে সে পার্থক্যটা কী? সেই পার্থক্যটা বুঝার আগে আমি এখানে ইংরেজি দুটো শব্দ দিচ্ছি। many আর All এই দুইয়ের পার্থক্য যাদের বুঝে আসবে তাদের জন্য ওই দুটোর পার্থক্য বুঝাও সহজ হবে।
এখানে বলে রাখতে চাই, হেকিম নূরুদ্দীন সাহেব উক্ত বইটি কাদিয়ানী মতাদর্শে দীক্ষিত হওয়ারও আরো প্রায় চার বছর পর ১৮৮৭ সালে স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীর নির্দেশে ও তারই তত্ত্বাবধানে লিখেছিলেন। একথাগুলো উক্ত বইয়ের (উর্দু) ১নং পৃষ্ঠাতেও রয়েছে। (স্ক্রিনশট-১)। তিনি বইটি খ্রিস্টানদের খন্ডন করতেই মোট চার খন্ডে লিখেছেন। জম্মুর মহারাজা তিনি হেকিম নূরুদ্দীনকে পুঞ্চের রাজপুত্রের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পুঞ্চে পাঠালে তিনি সেখানে প্রায় একবছর সময়ব্যাপী বইটি লিখেন এবং লিখার সময় তিনি পত্র ও লেখনীর মাধ্যমে মির্যার কাছ থেকে অব্যাহত নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা লাভ করেন। সকল বিষয়ে তিনি মির্যার পরামর্শ চাইতেন। এ সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন ‘হযরত মৌলভী নূরউদ্দীন (রা.) খলীফাতুল মসীহ আউয়াল’ পৃষ্ঠা নং ৭৪-৭৫; প্রথম সংস্করণ বাংলা ২৭ মে ২০০৮ইং। (স্ক্রিনশট-২)
দ্বিতীয়ত, উদাহরণ দিচ্ছি।
মনে করুন, প্রিন্সিপাল সাহেব ক্লাস নাইনের ছাত্রদের তার অফিসে আসতে নির্দেশ দিল। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ছাত্ররা এসে উপস্থিত হল। কিন্তু একজন ছাত্র যে কোনো কারণে তখনো এসে উপস্থিত হতে পারেনি। প্রিন্সিপাল সাহেব এমতাবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, সকলে বা সবাই কি এসেছো?
এখানে ওই যে একজন এখনো এসে উপস্থিত হলনা তজ্জন্য প্রিন্সিপালের উক্ত প্রশ্নের উত্তরটা এই পর্যায় কী হবে বলুন!
সকলে এসেছে—উত্তর কি কখনোই এটা হতে পারে? একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তির নিরপেক্ষ মন কী বলে?
এখানে প্রিন্সিপালের প্রশ্নের উত্তরে নিচের যে কোনোটাই সদুত্তর হতে পারে।
“অনেকে এসেছে” কিংবা “বহু সংখ্যক এসেছে“।
অতএব যেহেতু বহু মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীস বলছে যে, ঈসা (আ:) এখনো মৃত্যুবরণ করেননি সেহেতু সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নং আয়াতের “আর-রসুল” এর যেই অর্থ (বহু রাসূল) খোদ হেকিম নূরুদ্দীন সাহেবও নিয়েছেন সেটাই সঠিক এবং ব্যাকরণ সিদ্ধও বটে। আর সেজন্য বিপরীতে আরও “বহু রাসূল” জীবিত থাকা দাবী করবেনা। বরং “বহু রাসূল” অর্থ নেয়ার জন্য যে কোনো একজন রাসূলই জীবিত থাকা যথেষ্ট। অতএব কাদিয়ানীদের উপরিউক্ত যুক্তি পুরোটা অবান্তর। তবুও তাদের শান্তনার জন্য আমার কাছে একটা জবাব অবশ্যই রয়েছে। তা হল,
আগের সেই বহু রাসূল তারা কারা?
১. এর উত্তরে আমার জবাব হল, মির্যা কাদিয়ানী হযরত মূসা (আ:) সম্পর্কে লিখেছে ‘লাম ইয়ামুত’ (لم يمت) অর্থাৎ তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। দেখুন রূহানী খাযায়েন খন্ড নং ৮ পৃষ্ঠা নং ৬৮-৬৯। আরো দেখুন, হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা ৬২। অতএব আপনাদের বিচারে মূসা (আ:) এখনো জীবিত বুঝা গেল।
২. পবিত্র কুরআনে (১৯:১৯) আল্লাহতালা হযরত জিবরাইল (আ:)-কেও ‘রাসূল‘ শব্দে আখ্যা দিয়েছেন। যেমন হযরত মরিয়ম (আ:)-এর নিকট জিবরাইল (আ:)-কে পাঠানো হলে তিনি তাঁকে সম্বোধন করে যে কথা বলেছিলেন আল্লাহ তায়ালা সেটি পবিত্র কুরআনে হুবহু সেভাবেই উল্লেখ করে দিয়েছেন। জিবরাইল (আ:) বলেছেন, إنما انا رسول ربك অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রভুর একজন রাসূল বা বার্তাবাহক। এখানে জিবরাইল (আ:) “রাসূল” শব্দে আখ্যায়িত হয়েছেন। আর তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জন্মেরও পূর্ব থেকেই ছিলেন এখনো জীবিতই আছেন। সূরা হাজ্জ আয়াত নং ৭৫ দেখুন, আল্লাহ বলেছেন, الله يصطفى من الملائكة رسلا و من الناس অর্থ— তিনি ফেরেশতাদের মধ্য থেকে রাসূল মনোনীত করেন এবং মানুষের মধ্য থেকেও। এতেও বুঝা যাচ্ছে যে, من قبله الرسل এর মধ্যে ‘সমস্ত রাসূল’ অর্থ নেয়া ঠিক হবেনা। অন্যথা জিবরাইল (আ.) সহ অনেক ফেরেশতাকেও বর্তমানে মৃত্যুবরণকারী বিশ্বাস করতে হবে। অথচ বহু হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত রয়েছে যে, ফেরেশতাদের মৃত্যু কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্তেই হবে, আগে নয়।
৩. আমাদের মুসলিম উম্মাহার সর্বসম্মতিক্রমে “ঈসা” (আ:) এখনো জীবিত আছেন।
তাহলে কাদিয়ানীর মতে মূসা (আ.), পবিত্র কুরআনের কতেক আয়াত অনুযায়ী জিবরাইল এবং আরও বেশ কয়জন ফেরেশতা। কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঈসা আলাইহিমুস সালাম। অন্ততপক্ষে তিন বা ততোধিক ‘আল্লাহ’র রসুল‘ জীবিত সাব্যস্ত হলো কিনা? কাদিয়ানীদের জন্য আফসোস! তারা এর পরেও তোতাপাখির মত সে একই কথা বলে বেড়াবে যে, তাহলে আরও জীবিত বহু রাসূল তারা কারা? সংক্ষেপে লিখলাম।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক