কাদিয়ানীদের বিভ্রান্তিকর দাবীর খণ্ডনে
কাদিয়ানীদের মতে ঈসা (আ.)-এর ইহলৌকিক বয়স ১২০ বছর ছিল, এটি সঠিক নয় কেন?
কাদিয়ানীদের মতে ঈসা (আ.)-এর বয়স হয়েছিল ১২০ বছর! আর একথার প্রমাণ হিসেবে তারা একখানা হাদীসও উল্লেখ করে থাকে। তাদের জন্য আফসোস হল, তারা কখনো যাচাইও করে দেখেনি যে, তাদের উল্লিখিত হাদীসটি সূত্র এবং মতনের দিক থেকেও অথেনটিক কিনা? ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.)-এর উদ্ধৃতিতে কাদিয়ানীরা নানা সময় নানা কিছু পেশ করে থাকে। সেই হিসেবে উক্ত প্রসঙ্গে ইবনে কাসীর (রহ.)-এর নিজেস্ব একটি বক্তব্য এখানে পেশ করতে চাই, তিনি (রহ.) তাঁর রচিত ‘আল জামেউল মাসানিদ ওয়াস সুনান‘ (جامع المسانيد والسنن) গ্রন্থে (৩২৭০) লিখেছেন, أن يكون عيسى بن مريم – عليه السلام – قد عُمر قبل رفعه مائة وستًّا وعشرين سنة، وهذا خلاف المشهور من أنه رفع وله ثلاث وثلاثون سنة، অর্থাৎ ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)-এর বয়স তাঁকে উঠিয়ে নেয়ার পূর্বে ১২৬ বছর ছিল মর্মে কথাটি সুপ্রসিদ্ধ মতের বিরোধী। কারণ প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, তাঁকে উঠিয়ে নেয়ার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল তেত্রিশ বছর। তাছাড়া শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহ.)ও পরিষ্কার করে লিখে গেছেন যে, এই ধরনের বর্ণনা সূত্রের বিচারে খুবই দুর্বল। ইমাম বুখারী তো পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, لا يكاد يتابع فى حديثه অর্থাৎ ‘এর সনদে উল্লিখিত মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে উসমান নামীয় বর্ণনাকারীর হাদীসটির অনুসরণ করার মত কোনো গ্রহণযোগ্যতাই তার নেই।’ (আস-সিলসিলাতুয য’য়ীফাহ ৯/৪২৫; ক্রমিক নং ৪৪৩৪; শায়খ আলবানী রহ.)। অনুরূপ আরও যারা উক্ত রাবী তথা বর্ণনাকারীর উপর জরাহ (আপত্তি) করেছেন, তাদের মধ্যে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (ফাতহুল বারী ৬/৩৮৪), ইমাম নাসাঈ, ইমাম ইবনে আসাকির, ইমাম যাহাবী ও ইমাম বাজ্জার প্রমুখ অন্যতম। স্ক্রিনশট দেখুন!
বলে রাখতে চাই, মির্যা কাদিয়ানীর বইতে লিখা আছে, যে হাদীস ইমাম বুখারীর কৃত শর্তের বিপরীত সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন খণ্ড ১৭ পৃষ্ঠা নং ১১৯-২০)। এখন কি তারপরও ঐ ১২০ বছর ওয়ালা বর্ণনাটির চর্বিতচর্বণ করতে থাকবেন? নিজের উপর একটু তো ইনসাফ করবেন! মজার ব্যাপার হল, উল্লিখিত স্কলারদের সবাই বলেছেন, ঈসা (আ.)-কে যখন উঠিয়ে নেয়া হয় তখন তার বয়স ছিল ৩৩ বছর। উল্লিখিত ১২০ বছর ওয়ালা বর্ণনা হেতু ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) লিখেছেন, যখন তাঁকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে তখন তাঁর বয়স কত ছিল তা নিয়ে মতবিরোধ হয়ে গেল। কারো মতে তেত্রিশ বছর আবার কারো মতে (এই বর্ণনার কারণে তাঁর ইহলৌকিক বয়স) ১২০ বছর। হাফেজুল হাদীস ইমাম ইবনে আসাকির (রহ.) লিখেছেন, বিশুদ্ধ কথা হল, ان عيسى لم يبلغ هذا العمر অর্থাৎ নিশ্চয়ই ঈসা এই বয়সে পৌঁছেননি। কিন্তু এরপরেও কাদিয়ানী সম্প্রদায় বলতেই থাকবে যে, না না; ঈসা (আ.)-এর ইহলৌকিক বয়স ১২০ বছরই হয়েছিল! যেমন জনৈক কাদিয়ানী মতের অনুসারী জনাব Nasim Ahmed তাদের মধ্যে অন্যতম। যেজন্য আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, আপনি যদি ১২০ বছরের ঐ দুর্বল সূত্রের বর্ণনাটিকে চেপে ধরে বসে থাকতে চান, তাহলে নিচের প্রশ্নটির কী উত্তর? প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ ১২০ বছর ওয়ালা বর্ণনার শুরুতে কিন্তু এও উল্লেখ আছে, “লাম ইয়াকুন নাবিয়্যুন কানা বা’দাহু নাবিয়্যুন ইল্লা আ’শা নিছফা উমরিন আল্লাজী কানা ক্ববলাহু” (لم يكن نبى كان بعده نبى الا عاش نصف عمر الذى كان قبله) । অর্থাৎ ‘প্রত্যেক নবী তাঁর পূর্বের নবীর অর্ধেক আয়ুষ্কাল অবশ্যই পেয়েছেন (অনুবাদ, হামামাতুল বুশরা [বাংলা] ৩৬)।’ সে হিসেবে আমার প্রশ্ন হল, হযরত ইদরীস (আ:) এর পরেই হযরত নূহ (আ:)-এর আগমন হয়। আর হযরত ইদরীস (আ.)-এর বয়স হয়েছিল মাত্র ৮২ বছর। অপরদিকে নূহ (আ:)-এর বয়স ছিল ৯৫০ বছর। এখন ঐ ১২০ বছর ওয়ালা বর্ণনাটি যদি গ্রহণযোগ্যই হয় তাহলে সে হিসেবে হযরত নূহ (আ.)-এর বয়স কেন হযরত ইদরীস (আ.)-এর বয়সের অর্ধেক মাত্র ৪১ বছর হল না?
এভাবে প্রশ্ন করা শুরু করলে শেষ হবেনা। কারণ হযরত আদম (আ.) ১০৬০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছিলেন। এখন প্রত্যেক নবী তাঁর পূর্ববর্তী নবীর বয়সের অর্ধেক পেয়ে থাকার বর্ণনা সঠিক হলে তখন আদম (আ.)-এর বয়স লক্ষ নয়, বরং কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি, আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। সে হিসেবে উনার পূর্ববর্তী নবীর বয়স তাঁর দ্বিগুণ হতে গেলে তা কোনোভাবেই ১২৬ বছরের কম হতে পারবেনা। একই ভাবে তাঁরও পূর্ববর্তী নবীর বয়স তাঁর অপেক্ষা দ্বিগুণ ধরলে হবে ২৫২ বছর। এভাবে উপর দিকে যথাক্রমে ৫০৪ বছর, ১০০৮ বছর, ২০১৬ বছর, ৪০৩১ বছর, ৮০৬২ বছর দাঁড়াবে। একটা পর্যায়ে ১ লক্ষ বা ২ লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী রাসূলগণের বয়স সীমা পেরিয়ে আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর বয়স কয়েক কোটি হয়ে যাবে কিনা? আফসোস! কাদিয়ানীরা কখনো এই সমস্ত অসঙ্গতি চিন্তাও করেনা!
যদি মূসা এবং ঈসা জীবিত থাকত তাহলে…
ওহে কাদিয়ানীবন্ধু! এরপরেও কি নিজের সুস্থ মস্তিষ্কের সাথে বুঝাপড়া করবেনা?
মজার ব্যাপার হল, ঐ হাদীসটিকে যদি মির্যা সাহেবের মতে সহীহ ধরা হয় তাহলে কিন্তু মির্যা সাহেব আরো একবার মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হবেন। কেননা তখন একই প্রশ্ন মির্যা ক্ষেত্রেও আসবে। আর তা হল, এই জ্যামিতিক হিসাবে নবী দাবীদার খোদ মির্যার বয়সটিও হওয়া উচিত ছিল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৬৩ বছরের অর্ধেক অর্থাৎ ন্যূনতম ৩১ বছর। কিন্ত আফসোস এটাও সম্ভবপর হয়নি! বরং মির্যা কাদিয়ানী (১৮৩৯/৪০-১৯০৮) মারা যান ৬৮/৬৯ বছর বয়সে! তো সমীকরণ কিভাবে মিলাবেন? মির্যা কাদিয়ানীর জন্ম তারিখ তারই রচনাতে দেখুন।
সত্য বলতে, কাদিয়ানীরা এর সঠিক উত্তর কখনো দেবেনা। কেননা এতে তাদের ১২০ বছর ওয়ালা অগ্রহণযোগ্য বিশ্বাসের কবর রচিত হবে! যাইহোক, এই ধরণের অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো কথা অন্তত আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ কখনো বলবেন না, এমনটাই স্বাভাবিক। তাই বলা যায় যে, এটি প্রকৃতপক্ষে ঐ বর্ণনারই একজন রাবী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে উসমানেরই নিজেস্ব ও বানোয়াটি ছিল। মূলত এর অসঙ্গতির কারণ এটাই।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক