ক্বদ খালাত মিন কবলিহির রসুল প্রসঙ্গে – পর্ব ৩

0
ক্বদ খালাত মিন কবলিহির রসুল প্রসঙ্গে – পর্ব ৩

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

অত্র বিষয়ে আর্টিকেল নং ১

অত্র বিষয়ে আর্টিকেল নং ২

পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৪৪ এর মধ্যে আল্লাহ তালা ইরশাদ করেছেন, (সঠিক অনুবাদ) :-

  • وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِہِ الرُّسُلُ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡہِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰہَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیَجۡزِی اللّٰہُ الشّٰکِرِیۡنَ

অর্থাৎ মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র; তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিবে? এবং কেহ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিলে সে কখনও আল্লাহ ক্ষতি করিতে পারিবে না; বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করিবেন।” [অনুবাদ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন/ইফা]।

কাদিয়ানীদের রচনায় : কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বইপুস্তকে উক্ত আয়াতের অনুবাদের ক্ষেত্রে লিখা আছে,…. তাঁর পূর্বের/পূর্বেকার সব রসূল গত হয়ে গেছেন।’ তারা এর ব্যাখ্যায় দাবী করে যে, এখানে ‘গত হয়ে গেছেন’ বলতে মারা গেছেন, এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। ফলে এই আয়াত ঈসা (আ.) সহ পূর্বেকার সব রাসূলকেই মারা গেছেন, বলে বুঝায়। স্ক্রিনশট-

কাদিয়ানীদের ৮ পাতার একটি লিফলেট থেকে।

কিন্তু তাদের ন্যায় অনুরূপ অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা ইসলামের গত ১৪শত বছরেও কোনো বরেণ্য তাফসীরকারক এবং আয়েম্মায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত নয়। খণ্ডনমূলক জবাব নিচে দেয়া হল।

খণ্ডনমূলক জবাব : উক্ত আয়াতের من قبله الرسل হতে ‘সমস্ত রাসূল’ অথবা ‘সব রাসূল’ এইভাবে যারা অর্থ নিয়ে থাকেন এবং সেই অর্থের উপর ভিত্তি করে যুক্তি দিয়ে দাবী করেন যে, এর দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বেকার সমস্ত রাসূল যেভাবে গত হইয়া গিয়াছেন, মানে মৃত্যুবরণ করেছেনই উদ্দেশ্য, তাদের মধ্যে হযরত ঈসা (আ.)ও শামিল। যেহেতু তিনিও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বেকার নবী রাসূলগণের একজন; তাদের এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই যে, প্রথমত, আয়াতটির من قبله الرسل হতে ‘সমস্ত রাসূল’ বা ‘সব রাসূল’ এইভাবে অর্থ নেয়াটাই ঠিক নয়, বরং এইভাবে অর্থ নেয়া ব্যকরণবিরুদ্ধ। যেহেতু আয়াতটির الرسل এর শুরুতে যুক্ত ال (আলিফ+লাম)-কে ‘আলিফ লাম আহদে খারেজি’ (عهد خارجى) হিসেবে গণ্য করা হবে। ফলে الرسل এর মর্মার্থে শর্তপ্রযোজ্য বুঝাবে। অর্থাৎ শব্দটি বহুবচন হওয়া সত্ত্বেও তার অভ্যন্তরে কিছু সংখ্যক রাসূলকে অন্তর্ভুক্ত করবেনা। অতএব আয়াতটির من قبله الرسل হতে সঠিক অর্থ দাঁড়াবে ‘তাঁঁর পূর্বে অনেক বা বহু রাসূল গত হইয়া গিয়াছে।’

এই পর্যায়ে কয়েকটি প্রশ্ন আসতে পারে। তা হল,

  • ১- الرسل এর মর্মার্থে ‘শর্ত প্রযোজ্য’ থাকার প্রমাণ কী?
  • ২- আয়াতটির الرسل (অনেক বা বহু রাসূল)-এর অর্থে আরও যাদেরকে শামিল করা হবেনা বলে বুঝায় তারা কারা? দলিল প্রমাণ আছে কি?

উল্লিখিত প্রশ্ন দুটির উত্তরে বলতে চাই। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় পৃথিবীতে শেষ যুগে হযরত ঈসা (আ.)-এর দ্বিতীয়বার আগমন সম্পর্কে ইংগিতে ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে। আল্লাহতালা যাকে ইতিপূর্বে বনী ইসরাইলের নিকট একজন রাসূল করে প্রেরণ করেছিলেন। তন্মধ্যে সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৪৬, সূরা তওবাহ আয়াত নং ৩৩, সূরা আল মায়েদা আয়াত নং ১১০ ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়া হযরত জিবরাঈল (আ.)-কেও পবিত্র কুরআনের বহু জায়গা রাসূল আখ্যা দেয়া হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে এসেছে, বিবি মরিয়মের উদ্দেশ্যে জিবরাঈল (আ.) বলেছিলেন (قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَامًا زَكِيًّا) ‘ক্বা-লা ইন্নামা আনা রাসূলু রাব্বিকি লিআহাবা লাকি গুলা-মান ঝাকিইইয়া’ অর্থাৎ সে বলল আমি তো কেবল তোমার রবের একজন রাসূল (তথা বার্তাবাহক), তোমাকে একজন পবিত্র পুত্র সন্তান দান করার জন্য এসেছি। (মরিয়াম/১৯:১৯); তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে, সূরা আল হাক্কাহ আয়াত নং ৪০ (إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই এই কুরআন একজন সম্মানিত রাসূলের বার্তা”-এর তাফসীরে ইমাম হাসান বছরী, কলবী এবং মুক্বাতিল প্রমুখের মতে ‘রাসূল‘ শব্দ হতে হযরত জিবরাঈল (আ.) উদ্দেশ্য। এমনকি বহু সংখ্যক ফেরেশতাও এমন রয়েছেন যাদেরকে আল্লাহতালা পবিত্র কুরআনে ‘রাসূল‘ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। যেমন সূরা হাজ্জ্ব এর ৭৫ নং আয়াতে এসেছে – (اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ) অর্থাৎ ‘আল্লাহতালা ফেরেশতাদের মধ্য থেকে রাসূল মনোনীত করেন এবং মানুষের মধ্য থেকেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’ আবার অপরদিকে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী লিখেছেন, সূরা আস-সিজদাহ আয়াত নং ২৩ (وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ فَلَا تَكُن فِي مِرْيَةٍ مِّن لِّقَائِهِ ۖ وَجَعَلْنَاهُ هُدًى لِّبَنِي إِسْرَائِيلَ) অর্থাৎ ‘আমি তো মূসাকে গ্রন্থ দিয়েছিলাম, অতএব তুমি তার সাক্ষাৎ বিষয়ে সন্দেহ করো না। আমি একে (তাওরাত) বনী ইসরাঈলের জন্য পথনির্দেশক করেছিলাম।’ এই আমাতের মধ্যে হযরত মূসা (আ.) জীবিত থাকার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। দেখুন, হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ৬২। স্ক্রিনশট –

মির্যা সাহেবের রচনাসমগ্র ২৩ খণ্ডে প্রকাশিত ‘রূহানী খাযায়েন’ এর ৮ নং খণ্ডের ৬৮-৬৯ নং পৃষ্ঠায় আরো লিখা আছে যে, فرض علينا ان نؤمن بانه حى فى السماء و لم يمت و ليس من الميتين. অর্থাৎ ‘আমাদের জন্য ফরজ হল, তিনি (মূসা) আকাশে জীবিত এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেননি, তিনি মৃতদের মধ্যেও শামিল নন বলে বিশ্বাস করা।’

.

সুতরাং অন্ততপক্ষে এটুকু তো প্রমাণিত হল যে, من قبله الرسل এর الرسل এর মর্মার্থে শর্ত প্রযোজ্য, সমস্ত রাসূল অন্তর্ভুক্ত নন, বরং কিছু রাসূল الرسل-এর মধ্যকার অন্তর্ভুক্তির বাহিরে। তাদের মধ্যে হযরত ঈসা (আ.), রূহুল কুদস হযরত জিবরাঈল (আ.) এবং বহু সংখ্যক ফেরেশতাও রয়েছেন। আর মির্যায়ী বিশ্বাস মতে হযরত মূসা (আ.)-কেও এঁদের মধ্যে গণনা করলে তখন তো একেবারেই সোনায় সোহাগা বলা যায়। যাইহোক, এই সমস্ত ক্বারীনা তথা প্রমাণ বা নিদর্শনের কারণেই আয়াতটির الرسل এর ال-কে আহদে খারেজি বলা হয়। ফলে এর তাৎপর্যে শর্ত প্রযোজ্য বুঝানো হবে। আহা! নির্বোধ কাদিয়ানীদের এ সমস্ত ইলমি বিষয়ে বুঝাতে পারে এমন সাধ্য কার? বহুবচনাত্মক শব্দেও ক্বারীনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বে ‘শর্ত প্রযোজ্য‘ এর বিধান প্রয়োগ হবার আরেকটি প্রমাণ নিম্নরূপ!

মির্যা কাদিয়ানীর একটি কথিত ইলহাম ও তার পরিপ্রেক্ষিতে আমার জিজ্ঞাসা :

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর একটি কথিত ইলহামে উল্লেখ আছে, আল্লাহ তালা তাকে নাকি উদ্দেশ্য করে বলেছেন, آسمان سے کئى تخت اترے مگر سب سے اوپر تيرا تخت بچھایا گیا অর্থাৎ আকাশ থেকে কয়েকটি সিংহাসন নাযিল হয়েছে। কিন্তু সবার উপরে তোমার সিংহাসনটি পাতা হয়েছে। (আরবাঈন [বাংলা] পৃষ্ঠা নং ৯৩, তাযকিরাহ ৩২৩ ইলহাম তাং ১৯০০ ইং, রূহানী খাযায়েন ১৭/৪২৮)। স্ক্রিনশট –

মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ সাহেব উক্ত কথিত ইলহামের ব্যাখ্যা করেছেন নিম্নরূপ –

”آسمان سے کئ تخت اترے پر تيرا تخت (رسول ص پاک کے بعد) سب سے اوپر بچھایا گیا” অর্থাৎ ‘আকাশ থেকে কয়েকটি সিংহাসন নাযিল হয়েছে। কিন্তু তোমার সিংহাসনটি (রাসূলেপাকের পর) সবার উপরে পাতা হয়েছে।’ (আল-ফজল, তারিখ ১৯ই আগস্ট ১৯৬১ ইং রাবওয়া হতে প্রকাশিত)। স্ক্রিনশট –

.

এখন এখানে মির্যার কথিত ইলহামে পরিষ্কার করে বলা হল যে, মির্যার সিংহাসনটি সবার উপরে (سب سے اوپر) পাতা হয়েছে। কিন্তু মির্যার পুত্র মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ ‘সবার উপরে’ এই কথার ব্যাখ্যায় লিখলেন ‘রাসূলেপাকের পরে’ সবার উপরে। এতে কি তিনি শর্ত প্রযোজ্যের বিধান প্রয়োগ করলেন না? অবশ্যই করেছেন। তাহলে সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৪৪ এর الرسل এর মধ্যেও অনুরূপ শর্ত প্রযোজ্যের এই অভিন্ন বিধান প্রয়োগ করে যদি অর্থ করা হয় যে, ‘তার পূর্বে (জিবরাঈল, অন্যান্য ফেরেশতা এবং ঈসা মসীহ ব্যতীত) সব রাসূল গত হইয়া গিয়াছেন’—ভুল হবে কেন? কাদিয়ানীদের নিকট এর নিরপেক্ষ ও গঠনমূলক জবাব চাচ্ছি! এই আর্টিকেলের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘মিন কবলিহির রসুল’-এর সঠিক তাৎপর্য কী ও কেন—এ সম্পর্কে। প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ নিয়ে দালিলিক আরও কিছু আর্টিকেল প্রস্তুত করা হয়েছে। উপরে উল্লিখিত আর্টিকেল দুটিও দেখা যেতে পারে। লিখাটি ভালো লাগলে সবাই শেয়ার করবেন। ওয়াসসালাম।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here