ত্রিশ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব

0
ত্রিশ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব

ত্রিশ আয়াতের অপব্যাখ্যা খণ্ডন-বইটি ডাউনলোড করুন।

ত্রিশ (৩০) আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব :

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

প্রথমে প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নের এডভান্স উত্তর দেয়া হবে। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বইতে লিখা আছে, ‘তাওয়াফফী’ এমন কোনো শব্দ নয় যার তাফসীর কেউ নিজ ইচ্ছেমতো করতে পারে। (হামামাতুল বুশরা ৯৯ [বাংলা])। তিনি এর ব্যাখ্যাকারী হিসেবে কুরআন, হাদীস এবং সাহাবাদের তাফসীরসহ যুগ-ইমামগণের মতের প্রয়োজন রয়েছে বলে লিখে গেছেন। সুতরাং এখানে শব্দটির বিশ্লেষণ অনুরূপভাবেই করা হবে যাতে কোনো কাদিয়ানী আপত্তি তুলতে না পারে।

বইটি কুরিয়ার সার্ভিস যোগে পাঠানো হয়। ০১৬২৯-৯৪১৭৭৩

প্রশ্ন হতে পারে যে, সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৫৫ এর ন্যায় শব্দের আগ-পাছ করে মর্মার্থ নেয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত কুরআন মাজীদে রয়েছে কিনা? এর উত্তর হল, জ্বী হ্যাঁ। এমনি ধরণের বিশেষ বিশেষ রহস্যের কারণে শব্দ আগে-পিছে হওয়ার ভুরি ভুরি নজির কুরআন মাজীদে রয়েছে। তন্মধ্যে সূরা আলে ইমরান এর ৪৩ নং আয়াত অন্যতম। আল্লাহতালা মরিয়ম (আ:) সম্পর্কে বলেন, واسجدى واركعى مع الراكعين অর্থাৎ তুমি সিজদা কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। এখানে প্রথমে সেজদা তারপর রুকুর কথা আসছে। রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (সা.) থেকেই শব্দ আগে-পিছে করে মর্মার্থ নেয়ার প্রমাণ রয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব তাফসীরগ্রন্থে।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তবে কেন আল্লাহতালা মুহাম্মদ (সা:)-কে আকাশে নেননি?

এর জবাব মির্যা কাদিয়ানীর বই থেকে দিচ্ছি। মির্যা সাহেব লিখেছেন : “মুহাম্মদ (সা:)-কে মে’রাজের রাতে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। সকল সাহাবীর এটাই বিশ্বাস।” (রূহানী খাযায়েন ৩/২৪৭)। সুতরাং বুঝা গেল, আল্লাহতালা তাঁর প্রিয় হাবীবকেও আকাশে নেননি বলা আপনার পুরোপুরি অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই না।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে আল্লাহতালা বিশেষভাবে ঈসা (আ:)-কে কেন এজন্য নির্বাচিত করলেন?

আমরা এর জবাব বিখ্যাত মুফাসসির আবুল লাইস সামরকন্দী (রহ:)-এর কিতাব থেকে জেনে নেব যিনি আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে ৩৭৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহান ইমাম কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত ‘তাফসীরে সামরকন্দী’ এর ১ম খন্ডের ২৭২ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে ‘ঈসা (আ:) আল্লাহর নিকট শেষনবীর উম্মত হতে চেয়ে দোয়া করেছিলেন। তাই আল্লাহতালা তাঁর উক্ত দোয়া কবুল করেছেন।’ (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৫৫ এর তাফসীর অংশ দ্রষ্টব্য)।

আপনি আরও প্রশ্ন করতে পারেন, ‘আল্লাহর দিক কোনটি? তিনি তাঁকে তাঁর কোন্ দিকে তুলিয়া লইয়াছেন?’

জবাব এই যে, পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে تعرج الملائكة و الروح اليه (তা’রুজুল মালা-ইকাতু ওয়াররূহু ইলাইহি) অর্থাৎ ফেরেশতারা এবং রূহ (জিবরাইল) আল্লাহর দিকে আরোহন করেন এমন একটি দিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর (সূরা মা’আরিজ/৭০:০৪)। এখানে ফেরেশতারা আল্লাহ’র কোন্ দিকে আরোহন করে বলা হল, বলুন! আশা করি জবাব পেয়ে গেছেন।

এই প্রশ্নের আরেকটি উত্তর হল, মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলীর সমষ্টি ‘রূহানী খাযায়েন’ (১৭:১০৮) এর মধ্যে পরিষ্কার লিখা আছে,  خدا کی طرف اور وہ اونچی ہے جسکا مقام انتہائے عرش ہے۔ -(বাংলা উচ্চারণ) : খোদা কি তরফ আওর উয়ো উঁচি হে জেসকা মোক্বাম ইনতিহায়ে আ’রশ হে। অর্থাৎ “খোদার দিক হল উপরের দিক। যেটির শেষ সীমানা আরশে আজীম।”

আপনি এও প্রশ্ন করতে পারেন যে, যদি মসীহ বর্তমান যুগ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ না করে থাকেন সেক্ষেত্রে এটাও সাব্যস্ত হবে, খ্রিস্টানরা আজ পর্যন্ত শিরিকে এবং পথ ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়নি যেভাবে ‘ফালাম্মা তাওয়াফফাইতানী কুনতা আন্তার রাকীবা আলাইহিম’ আয়াত থেকে প্রতিভাব হয়।

এর জবাব হচ্ছে প্রথমত, ঈসা (আ:) সংক্রান্ত توفى হতে যুগ-ইমামগণের কেউই ‘মৃত্যু’ অর্থ নেননি। বরং ইমাম শাওক্বানী (রহ.) ‘তাওয়াফফাইতানী’ এর মর্মার্থ সুস্পষ্ট করতে লিখেছেন, يعنى فلما رفعتنى الى السماء অর্থাৎ ‘যখন আপনি আমাকে আকাশে উঠিয়ে নিলেন।’ তাফসীরের কিতাবগুলোতে আরও উল্লেখ আছে, اى قبضتنى بالرفع الى السماء অর্থাৎ ‘আপনি আমাকে (যখন) আকাশে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে নিয়ে নিলেন।’ মনে রাখা উচিত, আয়াতটির পরেই উল্লেখ আছে ‘ওয়া ইন তাগফিরলাহুম ফা-ইন্নাকা আন্তাল আজীজুল হাকীম’ (অর্থাৎ যদি তুমি তাহাদিগকে ক্ষমা কর তাহা হইলে নিশ্চয় তুমিই মহা পরাক্রমশালী, পরম প্রজ্ঞাময়)। এখন নির্বোধরা এই আয়াতের ‘তাগফিরলাহুম’ (تغفرلهم) শব্দ নিয়েও কিজন্য চিন্তা করেনা? এখান থেকে তারা কেন শিক্ষা লাভ করেনা যে, ঈসা (আ:) কেয়ামত দিবসে যাদের পক্ষে সাক্ষী হবেন তারা শুধুমাত্র তাঁর ইহ-জীবদ্দশায় বিদ্যমান থাকা একত্ববাদী ঈসায়ীগণই উদ্দেশ্য! কারণ ঈসা (আ:) এমন কারো পক্ষে কখনোই আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হবেন না, যে মুশরিক কিংবা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী!

দ্বিতীয়ত, এবার প্রশ্নকর্তার প্রতিউত্তরে আসা যাক। সবার নিকট যে ব্যাপারটি পরিষ্কার তা হল, খ্রিস্টান ধর্ম-বিশ্বাসে ত্রিত্ববাদি মতবাদ সাধু সেন্ট পৌলই ঢুকিয়ে ছিল। মূলধারার সমস্ত মুসলমানের বিশ্বাস হল, ঈসা (আ.)-কে তাঁরই তেত্রিশ বছর বয়সে যখন সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় তারই পরবর্তী কোনো এক সময় সেন্ট পৌল খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসে ত্রিত্ববাদের মতবাদ ঢুকিয়ে দেয়। অধিকন্তু কাদিয়ানীদের মতবাদও তাই। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২০/৩৭৫)। তদুপরি তাদের (কাদিয়ানীদের) আরেকটি বিশ্বাস হচ্ছে, ঈসা (আ.) ১২০ বা ১২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই প্রশ্ন আসে, এমতাবস্থায় খ্রিস্টান ধর্ম-বিশ্বাসে বিকৃতির ঘটনা ঈসা (আ.)-এর ইহ-জীবদ্দশাতেই ঘটল না কিভাবে? সুতরাং দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, এই আয়াত (ফালাম্মা তাওয়াফফাইতানী) দ্বারাও ঈসা (আ.) মারা গিয়েছেন বলিয়া সাব্যস্ত হয় না। যাইহোক, আয়াতটির ঐ অংশের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে, ‘আর যখন আপনি আমাকে তুলিয়া লইলেন….’ (অনুবাদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। বিস্তারিত সামনে।

জনৈক কাদিয়ানীর প্রশ্ন, আল্লাহতালার বাণী: (অনুবাদ) সমস্ত আহলে কিতাব তাঁর (ঈসা) মৃত্যুর আগে আগেই তাঁর (ঈসা) প্রতি ঈমান আনবে (সূরা নিসা, আয়াত নং ১৫৯)। কিন্তু একথা সঠিক নয়। কেননা হাদীসে আছে যে, দাজ্জালের সাথে ৭০,০০০ আহ্‌লে কিতাব যোগ দেবে, আর সে নিজেও আহ্‌লে কিতাবের অন্তর্গত হবে। সে মসীহ্‌র প্রতি ঈমান আনবে না এবং কাফির অবস্থাতেই মারা যাবে। অতএব এ যুক্তি ভ্রান্ত, পক্ষান্তরে এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন। এখন এর কী উত্তর দেবেন! (উত্তর এখান থেকে পড়ুন)।

এবার দুইটি পালটা প্রশ্ন :

ক. ঈসা (আ:) ইতিপূর্বে ইন্তেকাল করে থাকলে উক্ত আয়াতে ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা “আহলে কিতাবীরা ঈমান আনবে” এ কথার কী মানে?

খ. আয়াতের ‘মওতিহি’ (موته) এর “হি” (هِ) (ইংরেজি : his) একবচনের সর্বনামপদটি ‘আহলে কিতাবী’র জন্য হয়ে থাকলে তবে ঐ আহলে কিতাবীর জন্য পরের আয়াতে ‘আলাইহিম শাহীদা’ (عَلَيْهِمْ شَهِيدًا)-এর মধ্যে কেন “হিম” (هم)  (ইংরেজি : they) বহুবচনাত্মক সর্বনাম নেয়া হল? অতএব যেহেতু একই বাক্যে একই উদ্দেশ্যের সর্বনাম বিভিন্ন হওয়া ব্যাকরণিক নীতির অন্তরায়, সেহেতু নিশ্চিতভাবে বলা যায় আয়াতে قَبْلَ مَوْتِهِ   অংশের শেষোক্ত “হি” সর্বনামটি দ্বারা আহলে-কিতাবীদের বুঝানো হয়নি, বরং এককভাবে হযরত ঈসা (আ:)-কেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে, ঈসা (আ.)-এর আগমন ‘নবী’ হিসেবে না হলে মুসলিম শরীফের হাদীসে ‘নাবিউল্লাহ’ শব্দে উল্লেখ হল কিজন্য? এর জবাবে বলব, আগমনকারী ঈসা বলতে রূপক কোনো ঈসা হবেন না, বরং তিনি বনী ইসরাইলি জাতির জন্য প্রেরিত হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)ই। যেজন্য রাসূল (সা.) তার আগমনী ভবিষ্যৎবাণীতে ‘আল্লাহর নবী ঈসা’ বলে সম্বোধন করে গেছেন, যাতে মসীহ দাবীদার ভন্ডরা সাধারণদের প্রতারিত করতে না পারে। উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বিশ্বাস হল, আগমনকারী ঈসা (আ.) নবুওয়তের দায়িত্বে থাকবেন না, বরং তিনি স্রেফ একজন “উম্মতি” হিসেবে আসবেন। কাজেই এখন কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে আমরা পালটা প্রশ্ন করতে চাই যে, আপনাদের মতানুসারে, হযরত ঈসা (আ.) এসে “নবী” হলে তখন কি তাঁর “উম্মত” ও হবেনা? অবশ্যই হবে! কারণ নবীর উম্মত থাকবেনা, এটা কিভাবে হতে পারে? এখন ‘ঈসা’ দাবীদার মির্যা কাদিয়ানীর অনুসারীরা কি নিজেদেরকে তার (অর্থাৎ মির্যা কাদিয়ানীর) উম্মত মনে করেন? কী জবাব দেবেন?

আপনি আরও প্রশ্ন করতে পারেন, ঈসা (আ:)-এর যুগে এবং তাঁরই মৃত্যুর আগে সমস্ত আহলে কিতাবী (ইহুদ-খ্রিস্টান) মুমিন হয়ে গেলে তখন পবিত্র কুরআনের ০৫:৬৪ আয়াত অনুসারে আহলে কিতাবীদের মাঝে الى يوم القيامة তথা ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ শত্রুতা সঞ্চারিত থাকে কিভাবে? (উত্তর এখান থেকে পড়ুন)।

ত্রিশ আয়াতের অপব্যাখ্যার খন্ডন শুরু হল :

মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীরা পবিত্র কুরআনের প্রায় ৩০টি আয়াতের অপব্যাখ্যা দ্বারা ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে গেছে বলে মিথ্যা দাবী করে থাকে। অথচ আয়াতগুলো নবী, সাহাবী, তাবেয়ীর সোনালী যুগেও ছিল। তাদের সকলে বিশ্বাস করতেন যে, ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু শেষ যুগে হবে। কেননা তাঁর জীবনকে আল্লাহ শেষ যামানা পর্যন্ত দীর্ঘ করে দিয়েছেন। কাজেই যে সমস্ত আয়াতের অপব্যাখ্যা দ্বারা কাদিয়ানীরা বর্তমানে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে গেছে বলে মিথ্যা দাবী করছে তারা কি তাদের উক্ত দাবীর মধ্য দিয়ে একথাও প্রমাণ করতে চাচ্ছে না যে, পবিত্র কুরআনের অনুবাদ কিংবা ব্যাখ্যা আগেকার যুগের কেউই বুঝেনি, মির্যা কাদিয়ানী আর তার বর্তমান যুগের মুরিদরাই শুধু বুঝেছেন! নাউযুবিল্লাহ।

সে যাইহোক, এখানে তাদের উল্লেখযোগ্য কিছু আয়াতের অপব্যাখ্যার খন্ডনপূর্বক সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

1 হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী ‘ইন্নী মুতাওয়াফফীকা ওয়া রাফিউকা ইলাইয়্যা’ (انى متوفيك و رافعك الى)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘হে ঈসা নিশ্চয় আমি তোমাকে নিয়ে নিচ্ছি এবং তোমাকে নিজের কাছে তুলিয়া লইতেছি….।’ (সূরা আলে ইমরান ৫৫, অনুবাদ, কাদিয়ানী খলীফা হেকিম নূরুদ্দীন কৃত ‘তাসদীকে বারাহীনে আহমদীয়া’ খ-১ পৃ-৮)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে “মুতাওয়াফফীকা” (متوفيك) শব্দটি বাবে তাফা’উল (تفعل) থেকে ইসমে ফায়েল এর ছিগাহ; অর্থ ‘তোমাকে নিয়ে নেব’ বা ‘তোমার মেয়াদকাল পূর্ণ করব’ (ভবিষ্যৎকালবাচক)। কেননা এর মূলধাতু (মাদ্দাহ) ‘ওয়াফইউ’ (وفى)। এখন জানার বিষয় হল, তাহলে ঐ নিয়ে নেয়ার ঘটনাটি কিরূপে সংঘটিত হয়েছিল? আল্লাহতালা সূরা নিসার ১৫৮ নং আয়াতে ‘রাফা’আহুল্লাহু ইলাইহি’ (رفعه الله اليه) দ্বারা সুস্পষ্টভাবে তার উত্তরও দিয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ তাঁকে উপরে (আকাশে) উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমেই নিয়ে নেয়া হয়েছে (অতিতকালবাচক)। তাই আয়াতটি দ্বারা ঈসা (আ.)-কে মৃত প্রমাণ করতে চাওয়া নিজেদের অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই না। তবে হ্যাঁ ‘তাওয়াফফা’ (توفى)-এর রূপক অর্থ মৃত্যু নেয়া হলে তখন তা বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাক্যের মধ্যে শব্দের تقديم-تأخير (আগ-পিছ)-এর নীতি গ্রহণ করতে হবে। আর তখন আয়াতটির অর্থ দাঁড়াবে, ‘ইয়ানি রাফেউকা ছুম্মা মুতাওয়াফফীকা ফী আখিরিয যামান’ (يعنى رافعك ثم متوفيك فى اخر الزمان) অর্থাৎ তোমাকে উঠিয়ে নেব অতপর শেষযুগে তোমাকে ওফাত (মৃত্যু) দেব। (ইমাম সুয়ূতী রচিত ‘দুররে মানছুর’ খ-৩ পৃ-৫৯৮; ‘মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাহ’ দ্রষ্টব্য)।

বলে রাখা জরুরী, সহীহ বুখারী’র কিতাবুল ইলম অধ্যায়ে (হা/ ৭৫ ইফা) একটি হাদীসে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা:) ইবনে আব্বাসের জন্য দোয়া করেছেন اَللَّهُمَّ عَلِّمْهُ الْكِتَابَ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে কুরআন শিখিয়ে দিন।’ এখন তাহলে চিন্তা করুন, ইবনে আব্বাস (রা.)-এর তাফসীর কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি বইয়ের সমষ্টি ও ২৩ খন্ডে প্রকাশিত রচনা-সমগ্রটির নাম ‘রূহানী খাযায়েন’ বা আধ্যাত্মিক ভান্ডার। মির্যা কাদিয়ানী সেটির প্রায় চার স্থানে ‘ইন্নী মুতাওয়াফফীকা’-এর অনুবাদের মধ্যে ‘তাওয়াফফা’ হতে ‘মৃত্যু’ অর্থ নেননি। অথচ সবখানেই শব্দটির কর্তা আল্লাহ এবং কর্ম (মাফউল) মানুষই ছিল। যথা-

  • ১. মে তুজকো পুরি নে’মত দোংগা [উর্দূ]। অর্থাৎ আমি তোমাকে পূর্ণ নেয়ামত দেব। (বারাহীনে আহমদীয়া, রূহানী খাযায়েন ১/৬২০)।
  • ২. মে তুজে কামেল আজর বখশোঁগা [উর্দূ]। অর্থাৎ আমি তোমাকে পরিপূর্ণ পুরষ্কার দেব। (বারাহীনে আহমদীয়া, রূহানী খাযায়েন ১/৬৬৪-৬৫)।
  • ৩. মে তুজে এসি যলীল অওর লা’নতি মউতুঁ চে বাছাঁওগা [উর্দূ]। অর্থাৎ আমি তোমাকে এমন অপমানকর ও অভিশপ্ত মৃত্যু হতে রক্ষা করব। (সিরাজে মুনীর, রূহানী খাযায়েন ১২/২৩)।

কিন্তু অধিকাংশ কাদিয়ানীর ‘তাওয়াফফা’ শব্দের ব্যাকরণিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার দরুন ভাবেন যে, তাদের কনসেপ্টই সঠিক, বিপরীতে সব ভুল। জেনে আরো অবাক হবেন, তাদের দৈনিক ‘আল ফজল’ [উর্দূ] (তাং ২১-আগস্ট-১৯১৭ইং) সংখ্যায় পরিষ্কার লিখা আছে যে, “কিছু মানুষ ভুলক্রমেই ‘তাওয়াফফা’র অর্থ করে মৃত্যু। কিন্তু এই অর্থ সঠিক না। বরং তার অর্থ ‘রূহ কবজ’ করা।”

কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, মির্যা সাহেব তার রচনার ঐ চার জায়গায় ‘রূহ কবজ’ অর্থটিও নেননি। ওহে আহমদী/কাদিয়ানীবন্ধুরা! একটু তো ইনসাফ করবেন!! অন্যান্য ক্ষেত্রে যে শব্দটির মৃত্যু অর্থ ত্যাগ করলেন আর সেই শব্দটিকে-ই ঈসা (আ.)-এর ক্ষেত্রে মৃত্যু অর্থে নিলেন! এটি আপনাদের কেমন ন্যায় বিচার?

কাদিয়ানীদের বইগুলোতে বাইবেল থেকে অনেক উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এখানে আমি শুধু সে হিসেবেই একটি উদ্ধৃতি টানছি। বাইবেলের নতুন নিয়মে লিখা আছে “যীশু যখন জৈতুন পর্বতমালার ওপর বসেছিলেন, তখন তাঁর শিষ্যরা একান্তে তাঁর কাছে এসে তাঁকে বললেন, আমাদের বলুন, কখন এসব ঘটবে, আর আপনার আসার এবং এযুগের শেষ পরিণতির সময় জানার চিহ্নই বা কি হবে? এর উত্তরে যীশু তাদের বললেন, ‘দেখো! কেউ যেন তোমাদের না ঠকায়। আমি তোমাদের একথা বলছি কারণ অনেকে আমার নামে আসবে আর তারা বলবে, ‘আমি খ্রীস্ট।’ আর তারা অনেক লোককে ঠকাবে।” (বাইবেল : মথি, অধ্যায় নং ২৪ পদ নং ৩-৫)। কাদিয়ানীদের নিকট বাইবেল যদি অথেনটিক কোনো সোর্স হয় তবে অন্তত যীশুর এই বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, আগমনকারী যীশুখ্রিস্ট ‘রূপক’ কেউ হবেন না।

2 হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী (بل رفعه الله اليه)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘বরং আল্লাহ তাহাকে তাহার নিকট তুলিয়া লইয়াছেন।’ (০৪:১৫৮,অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন/ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু সম্পর্কে ইংগিতেও কোনো কথা নেই। বরং এই আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহতালা নিজের অলৌকিক শক্তি দ্বারা ঈসা (আ.)-কে জীবিত অবস্থায় সশরীরে আকাশে তুলে নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল, আয়াতের কোথাও তো ‘আকাশ’ শব্দের উল্লেখ নেই, তাই এর ‘রাফা’ অর্থ শুধুমাত্র রূহ উঠিয়ে নেয়াই বুঝাল কিনা? তার জবাব হল, আয়াতের কনটেক্স বা প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করে দেখুন, এই আয়াতে ঈসাকে সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার কথাই বুঝিয়েছে। কারণ ইহুদীরা যখন উনার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র করল (কুরআন ০৩:৫৪) এবং পাকড়াও করতে তাকে ঘিরে সবাই সমবেত হল (তারীখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৭২; দুররে মানছূর ৩/৫৯৫); ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী মহান আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেন। তিনি জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাঁকে এইভাবেই সাহায্য করেন এবং সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নিতে নির্দেশ করেন।

বলে রাখা জরুরী যে, রূহ উঠিয়ে নেয়ার দায়িত্বে জিবরাইল (আ.) নন, বরং আজরাইল (আ.)। দেখুন সূরা আস-সিজদাহ আয়াত নং ১১; (قل يتوفكم ملك الموت)। অথচ ঈসা (আ.)-এর ‘রাফা’ জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে আকাশে হয়েছিল। দেখুন, সহীহ মুসলিম এর সমপর্যায়ের সনদে বর্ণিত হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর হাদীস (الْبَيْتِ إِلَى السَّمَاءِ وَرُفِعَ عِيْسَى مِنْ رَوْزَنَةِ فِيْ) অর্থাৎ ‘ঈসাকে বাড়ীর বায়ুপথ (Airspace) দিয়ে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর)।

তারপর হযরত ঈসা (আ.) শেষযুগে আকাশ থেকে নাযিল হবেন, একথাও সহীহ হাদীসে এসেছে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন ثم ينزل عيسى بن مريم من السماء অর্থাৎ ‘অতপর মরিয়ম পুত্র ঈসা আকাশ থেকে নাযিল হবেন।’ দেখুন মসনাদে বাজ্জার, হাদীস নং ৯৬৪২; বিশিষ্ট হাদীসবিশারদ ইমাম নূরউদ্দীন আল হাইছামী (রহ.) লিখেছেন و رجاله رجال الصحيح غير بن المنذر و هو ثقة অর্থাৎ হাদীসটির সূত্রে উল্লিখিত সকল বর্ণনাকারী সহীহ (বুখারী)’র শুধু আলী ইবনে আল মুনযির ছাড়া, তবে তিনিও একজন বিশ্বস্থ বর্ণনাকারী। (দেখুন, মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ-৭ পৃ-৩৪৯)। এভাবে একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা যাবে যে, আগমনকারী ঈসা ‘রূপক’ কেউ নন, বরং তিনি সেই ঈসা যার সম্পর্কে স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুইজন ফেরেশতার মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে (ফিলিস্তিনে) নিচে নেমে আসবেন বলেই ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন।

3 ঈসা (আ.) কেয়ামতের দিন আল্লাহতালাকে বলবেন (فلما توفيتنى)-এর সঠিক তাৎপর্য ।

আয়াত : ‘কিন্তু যখন তুমি আমাকে তুলিয়া লইলে তখন তুমিই তো ছিলে তাহাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক এবং তুমিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী।’ (০৫:১১৭/ অনুবাদ, ইফা)।

ব্যাখ্যা : কেয়ামত দিবসে মহান আল্লাহ’র একটি প্রশ্নের প্রতিউত্তরে হযরত ঈসা (আ.) বলবেন, فلما توفيتنى অর্থাৎ ‘যখন তুমি আমাকে তাওয়াফফা করলে তথা তুলিয়া লইলে’। মির্যা কাদিয়ানীর নিকটেও যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদ হিসেবে স্বীকৃত ইমাম আল্লামা শাওক্বানী (রহ.) উক্ত আয়াতাংশের তাফসীরে লিখে গেছেনو انما المعنى فلما رفعتنى الى السماء (ওয়া ইন্নামাল মা’না ফালাম্মা রফা’তানী ইলাস সামায়ি) অর্থাৎ ‘আয়াতাংশের শুধু এ অর্থই যে, আপনি যখন আমাকে আকাশে তুলিয়া লইলেন।’ কেননা পবিত্র কুরআনে ‘তাওয়াফফা’ শব্দটি তিনখানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথাক্রমে মৃত্যু (৩৯:৪২), ঘুম (০৬:৬০) এবং রাফা বা তুলিয়া নেয়া (০৩:৫৫, ০৫: ১১৭), দেখুন, ফাতহুল ক্বাদীর ৭/৪০৬; সূরা মায়েদা ১১৭। এই ক্ষেত্রে মৃত্যু, ঘুম এবং সশরীরে উঠিয়ে নেয়া, এই সমস্ত অর্থ রূপক আর ‘নিয়ে নেয়া বা পূর্ণকরা’ (কুরআন/০৪:১৫) তার প্রকৃত অর্থ। সুতরাং আয়াতটিও কাদিয়ানীদের মতের পক্ষে দলিল হয়নি।

4 ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর আগে আগে (قبل موته) তাঁর উপর প্রত্যেক আহলে কিতাবি ঈমান আনয়ন প্রসঙ্গে ।

আয়াত : কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর (ঈসা) মৃত্যুর পূর্বে তাঁহাকে বিশ্বাস করিবেই এবং কিয়ামতের দিন সে (ইতিপূর্বে যাহারা তাঁহাকে আল্লাহর পুত্র আখ্যা দিয়েছিলো) তাহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। (০৩: ১৫৯, অনুবাদ ফছলুল খেতাম, লিখক মির্যায়ী খলীফা হেকিম নূরউদ্দীন)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াত বরং ঈসা (আ.) বর্তমানেও জীবিত থাকার পক্ষেই মজবুত দলিল। কারণ যদি বলা হয় যে, ঈসা (আ.) পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন তখন প্রশ্ন আসবে যে, তবে কি বর্তমানে আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে ঈমান আনয়ন করে মুসলমান হয়ে গেল? কিন্তু নির্বোধদের বুঝানোর সাধ্য কার? কাদিয়ানীরা এই ধরণের প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্য আয়াতের অর্থ নেয় এই রূপ : ‘আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী ক্রুশীয় ঘটনার উপর ঈমান আনবে।’ কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, তারা নিজ নিজ ক্রুশীয় ঘটনার উপর তো এখনো বিশ্বাসী হয়ে আছে। তাহলে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ মৃত্যুর পূর্বে ক্রুশীয় ঘটনার উপর ঈমান আনয়নের অর্থ কি ঐ একই বিশ্বাসের উপর অটল থাকা? যদি তাই হয় তাহলে নিজেদের মৃত্যুর পূর্বের ঈমান আর জীবদ্দশাতে ধারণকৃত ঈমান এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়? সুতরাং এই আয়াত দিয়েও মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে চাওয়া পুরোপুরি বাতিল, সত্যের সাথে যার লেশমাত্র সম্পর্কও নেই। এই পর্যায় কাদিয়ানীদের প্রাসঙ্গিক বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি আমার ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখেছি। নিচে টীকা দ্রষ্টব্য।

5 ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী (وما المسيح ابن مريم)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : মারইয়াম তনয় মসীহ তো কেবল একজন রাসূল। তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে। (০৫: ৭৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু সম্পর্কে সরাসরি কিংবা ইংগিতেও কিছু বলা কওয়া নেই। বরং তার পরের আয়াতগুলো দ্বারা বুঝা যায় যে, খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদ খন্ডন করার জন্য এই আয়াতে ঈসা আর তাঁর মায়ের পানাহারের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা খ্রিস্টানরা তাঁদেরকে উপাস্য হিসেবে বিশ্বাস করে। অথচ সত্যিকারের উপাস্য যিনি তিনি সব সময় পানাহারের ঊর্ধ্বে, বরং ঊর্ধ্ব থেকেও ঊর্ধ্বে। উল্লেখ্য, কাদিয়ানী নির্বোধরা আয়াতটির শানে নুযূল তথা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় এবং নিজেদের মতবাদকে সামনে রেখে মতলবসিদ্ধ ব্যাখ্যার পেছনে দৌঁড়ায়। তারা বলে, যেহেতু ঈসা আর তাঁর মা উভয়ই পূর্বে খাবার গ্রহণ করতেন, এখন করেন না। কাজেই এর কারণ হল তারা এখন জীবিত নেই। অথচ আয়াতের প্রসঙ্গের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই।

6 পবিত্র কুরআনের বাণী (وما جعلناهم جسدا)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘এবং আমি তাহাদের এমন দেহবিশিষ্ট করি নাই যে, তাহারা আহার্য গ্রহণ করিত না, তাহারা চিরস্থায়ীও ছিল না।’ (২১:০৮ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতেও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু সম্পর্কে সরাসরি কিংবা ইংগিতেও কিছু বলা কওয়া নেই। বড়জোর এটি মক্কার মুশরিকদের একখানা প্রশ্নের জবাব মাত্র। কিন্তু কাদিয়ানী নির্বোধরা এই আয়াত দিয়ে যুক্তি দেয় যে, অত্র আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর কোনো প্রেরিত পুরুষই না খেয়ে বাঁচতে পারতেন না। অতএব ঈসা (আ.)ও আল্লাহর এই নিয়মের বিরুদ্ধে নন বলে তিনিও বেঁচে নেই, মারা গেছেন। কিন্তু আফসোস! এই নির্বোধরা যদি আয়াতের প্রসঙ্গ এড়িয়ে না যেত তাহলে তাদের পক্ষে এইরূপ জঘন্য মতলবসিদ্ধ ব্যাখ্যার খিস্তিখেউড় করা কোনোদিনও সম্ভব হত না। আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা এই যে, তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে, কাফেরদের আপত্তি ছিল, মুহাম্মদ (সা.) নবী হলে সাধারণ মানুষের মতই পানাহার করতেন না এবং জীবিকা উপার্জনের জন্য হাটবাজারে চলফেরা করতেন না। আলোচ্য আয়াতে তাদের উত্তর দেয়া হয়েছে যে, যেসব নবীকে তোমরা নবী ও রাসূল বলে স্বীকার করতে তারাও তো মানুষই ছিল, তারা মানুষের মত পানাহার করতেন এবং হাটবাজারে চলাফেরা করতেন। বুঝা গেল, পুরো ব্যাপারটাই ইহকালীন জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে ইহজগতের বাহিরে অবস্থানকারী ঈসা (আ.)-কে এর সাথে একীভূত করার প্রচেষ্টা মূর্খতা ছাড়া কিছুই না।

7 আল্লাহতালার বাণী (قد خلت من قبله الرسل)-এর প্রকৃত মর্মার্থ।

আয়াত : মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র, তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে। (০৩:১৪৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : মনে রাখতে হবে যে, “গত হওয়া” মানে মরে যাওয়াই নয়, বরং সশরীরে কোথাও স্থানান্তরিত হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিও “গত হওয়া” অর্থে শামিল। কুরআনে এর বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। দেখুন পবিত্র কুরআন ০২:১৪, ৩৫:২৪। তবে উক্ত আয়াতের শানে নুযূল দ্বারা বুঝা যায় যে, মুহাম্মদ (সা.) খোদা নন, বরং তিনি পূূর্বের নবী রাসূলগণের মতই একজন রাসূল, রাসূলগণের মত তাঁর জন্যও মৃত্যুর মাধ্যমে ইহজগত হতে পরজগতে স্থানান্তর হওয়া অবধারিত; তাই তাঁর মৃত্যুতে তোমাদের এত বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই, উক্ত আয়াত দ্বারা এটাই সবাইকে বার্তা দেয়া উদ্দেশ্য। কাজেই আয়াতের অর্থ দাঁড়াল ‘মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র, তাহার পূর্বে রাসূল-ই আগমন করিত।’ এভাবে অর্থ নেয়া হলে তখন নির্বোধদের পক্ষে আর কোনো কাসুন্দি করার সুযোগ থাকেনা। উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানী তার একটি রচনায় নিজেও قد خلت من قبله الرسل এর অর্থ করেছেন “আর তাঁর পূর্বে রাসূল-ই আগমন করিত।” (রূহানী খাযায়েন ৬/৮৯)।

রূহানী খাযায়েন ৬/৮৯; জঙ্গে মুকাদ্দাস।

পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতটি ‘খালাত’ (خلت) শব্দে না হয়ে ‘মাতাত’ (ماتت) শব্দেও হতে পারত! কুরআন কি এই ব্যতিক্রমী শব্দচয়ন দ্বারাও আমাদের বার্তা দিচ্ছে না যে, ঈসা (আ.) বর্তমানেও জীবিত, তিনি এখনো মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করেননি! অন্যথা ‘মাতাত’ এর পরিবর্তে ‘খালাত’ (خلت) শব্দের প্রয়োগের রহস্যটা কী?

কিন্তু কাদিয়ানীদের কোনো কোনো লিটারেচারে আয়াতটির ‘ক্বদ খালাত’ শব্দ দ্বারা ‘মারা গিয়াছে’ অর্থও নেয়া হয়েছে এমনকি ‘আর-রসুল’ দ্বারা ‘সমস্ত রাসূল’ অর্থও নেয়া হয়েছে। তাদের বিশ্বাস হল, এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঈসা (আ.) মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। এই মর্মে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে ইজমা (ঐক্যমত)-ও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তাদের এই কথার উত্তরে শুধু এটুকু বলতে চাই, লানাতুল্লাহি আলাল কাজেবীন।

এই পর্যায় তাদের উদ্দেশ্যে আমি প্রশ্ন করতে চাই যে, আপনাদের দাবী হচ্ছে من قبله الرسل এর মধ্যকার الرسل এর ال (আলিফ+লাম) নাহুর পরিভাষায় শুধুই الاستغراقى (আল ইস্তিগরাক্বি বা নিঃশর্তভাবে পুরোপুরি অন্তর্ভুক্তি) যা সমস্ত রাসূলকে ‘গত হওয়া মর্মে’ অন্তর্ভুক্ত করবে। সে হিসেবে আপনারা কি বিশ্বাস করবেন যে, হযরত জিবরাইল (আ.) সহ সমস্ত ফেরেশতাও মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন!? যেহেতু পবিত্র কুরআন অনুযায়ী জিবরাইল (আ.)ও একজন রাসূল বা বাণীবাহক (সূরা মরিয়ম আয়াত ১৯)। পবিত্র কুরআন অনুযায়ী মুক্তভাবে ফেরেশতাদেরও আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূল (বাণীবাহক) হিসেবে মনোনীত করার প্রমাণ রয়েছে (সূরা হাজ্জ আয়াত ৭৫)। এখন এর কী উত্তর?

তাদের জন্য দুঃসংবাদ যে, এই আয়াত নাযিল হওয়ার ছয় বছর পর অর্থাৎ হিজরী নবমবর্ষে যখন নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল রাসূল (সা.)-এর নিকট এলেন, তখন তিনি বললেন, “আপনারা কি জানেন যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব এবং মৃত্যু ঈসার নিকট আসবে?” (তাফসীরে তাবারী ৬/১৫৪, তাফসীরে ইবনে আবী হাতিম ৯/৪০৮ দ্রষ্টব্য)। এছাড়াও হযরত আলী (রা.)-এর খাস শিষ্য ও বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমাম হাসান বছরী (রহ.) থেকে একদম সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلْيَهُوْدِ إِنَّ عِيْسَى لَمْ يَمُتْ، وَإَنَّهُ رَاجِعُ إِلَيْكُمْ قَبْلَ يَوْمِ الْقِيَامَةِ অর্থাৎ রাসূল (সা.) জনৈক ইহুদীকে বলেছেন নিশ্চয় ঈসা মসীহ তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি নিশ্চয় কেয়ামতের পূর্বে তোমাদের নিকট ফিরে আসবেন। (সূত্র, সুনানে তাবারী ৩৩৩৮, হাদীস নং ৫৭৪৭; তাফসীরে দুররে মানছুর ২৬৪, ইমাম সুয়ূতী)। এই সম্পর্কে অন্য জায়গায় বিস্তারিত লিখা হয়েছে।

  • উল্লেখ্য, উপরের আয়াতটি কাদিয়ানীবাদের সব চেয়ে বড় দলিল! আর সেটির খণ্ডনে উপরে যেভাবে লিখা হয়েছে তাতে তারা কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হবেনা। সেজন্য এই টপিকের উপর আমি খণ্ডনমূলক যেভাবে জবাব দিয়ে থাকি সেটি একদমই ব্যতিক্রমী। এটি শুধুই দ্বিপাক্ষিক ডিবেটের সময়ই প্রয়োজন পড়বে। অথবা সেসব ব্রেইন ওয়াশ ঝগড়াটে ও আনাড়ি কাদিয়ানীদের মুখ বন্ধ করে দিতেই। পড়ুন : কাদিয়ানীবাদের ওফাতে মসীহ’র সব চেয়ে বড় দলিলের খণ্ডন

8 আল্লাহর বাণী (وما جعلنا لبشر من قبلك الخلد)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘আমি তোমার পূর্বেও কোনো মানুষকে অনন্ত জীবন দান করি নাই; সুতরাং তোমার মৃত্যু হইলে উহারা কি চিরস্থায়ী হইয়া থাকিবে?’ (২১:৩৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : কাদিয়ানী নির্বোধদের কথা কী আর বলব! তারা এই আয়াত থেকেও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর রসদ পাওয়ার দাবী করে। তাদের বিশ্বাস, এই আয়াত থেকেই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, রাসূল (সা.)-এর পূর্বেকার সকল নবীই ইন্তেকাল করেছেন বলে ঈসা (আ.)-ও তার ভেতর শামিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এরা আয়াতটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপটের দিকে একদমই দৃষ্টি দেয় না। যদি দৃষ্টি দিত তাহলে তারা নিজেদের কখনোই এমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিত না। এবার আয়াতটির নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট জেনে নিন। মক্কার কাফেররা রাসূল (সা.)-এর ব্যাপারে বলত, সে তো একদিন মারাই যাবে। আল্লাহতালা এরই প্রতিউত্তরে বলেন, মৃত্যু তো প্রত্যেক মানুষের জন্য অবধারিত, মুহাম্মদ (সা.)-ও এই নিয়ম বহির্ভূত নয়। কারণ সেও একজন মানুষ। আর আমি কোনো মানুষকে অমরত্ব দান করিনি। এখানে পুরো বিষয়টাই যেহেতু ইহ-জগত সংশ্লিষ্ট সেহেতু উক্ত আলোচ্যাংশে ঈসা (আ.)-কেও টেনে এনে মৃত সাব্যস্ত করতে চাওয়া আদতে কুরআনের উদ্দেশ্যকেই পরিবর্তন করার নামান্তর।

9 আল্লাহর বাণী (تلك الامة قد خلت لها ما كسبت)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘সেই ছিল এক উম্মত, তাহা অতীত হইয়াছে। তাহারা যাহা অর্জন করিয়াছে তাহা তাহাদের। তোমরা যাহা অর্জন কর তাহা তোমাদের। (০২:১৪১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতের আগের এবং পরের আয়াতগুলো দেখলে বুঝা যায়, এখানে একথাগুলো ইহুদীদের উদ্দেশ্যে ছিল। তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যারা আম্বিয়া ও সৎলোক ছিলেন তাদের সাথে সম্পর্ক জুড়ে তোমাদের কোনো লাভ নেই। রাসূল (সা.)-ও পরিষ্কার বলে রেখেছেন যে, ‘যার কার্যকলাপ তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না’ (সহীহ মুসলিম অধ্যায় যিকির ও দোয়া, পরিচ্ছেদ তেলাওয়াতে কুরআনের জন্য একত্রিত হওয়ার ফজিলত)। কাজেই উক্ত আয়াত যেন বলতে চাচ্ছে, পূর্বপুরুষদের নেকী দ্বারা তোমাদের কোনো লাভ হবেনা এবং তাঁদের পাপের কারণে তোমরা পাকড়াও হবেনা। তাঁদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে এবং তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবেনা। পবিত্র কুরআনে এসেছে ‘কেউ অপরের বোঝা বহন করবেনা।’ (সূরা ফাত্বির ৩৫:১৮)। ‘আর মানুষ তাই পায়, যা সে করে।’ (সূরা নাজম ৫৩:৩৯)। যাইহোক, কাদিয়ানীদের উদ্ধৃত এই আয়াতের সাথেও ঈসা (আ.) জীবিত না মৃত—এর কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই।

10 আল্লাহর বাণী (و اوصانى بالصلوة و الزكوة)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘যেখানেই আমি (ঈসা) থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করিয়াছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়াছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও যাকাত আদায় করিতে’। (১৯:৩১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর কোনো উল্লেখই নেই। এখানে যে বিষয়টি বলে রাখা জরুরী তা হল, আয়াতটিতে ঈসা (আ.)-এর প্রতি সালাত আর যাকাতের ওসীয়ত পালনের হুকুম শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের সাথেই সম্পর্কিত। কেননা সালাত আর যাকাত পালনের কোনো যোগ্যতাই আকাশে নেই। তাই যারা ঈসা (আ.) আকাশে থাকলে তিনি সেখানে সালাত কিভাবে পড়ছেন, যাকাত কিভাবে দিচ্ছেন ইত্যাদী উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির অন্তরালে তাঁকে মৃত সাব্যস্ত করতে চাচ্ছেন, তারা মূলত অন্ধকারেই রয়েছেন। তাদেরকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, সালাতের জন্য নির্দিষ্ট সময় আর যাকাতের জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা জরুরি কিনা?

উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে বলুন, আকাশের নিয়ম-কানুন কি ইহজগতের মত? সেখানকার সময় কি ইহজগতের মতই সূর্যের উদয় ও অস্ত যাওয়ার নিয়মের আওতায়? যদি তেমনটা না হয় তাহলে ঈসা (আ.) যে সালাত আদায় করতে ইহ-পরিমন্ডলে আদিষ্ট সেই সালাত তিনি আকাশেও কিভাবে পড়ছেন—এমন আজগুবি প্রশ্ন কেন? আর আকাশে তিনি যাকাত কাকে দেবেন? সুতরাং বুঝা গেল তাঁর সাথে এগুলোর সম্পর্ক শুধু ইহজগতের সাথে। কে জানি বলেছিল, ঈসা (আ.) আবার পৃথিবীতে আসলে তখন কি তাঁর বয়স কয়েক হাজার বছর হয়ে যাবেনা? এমন নির্বোধ প্রশ্নকারীকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, তিরমিজি শরীফে একটি হাদীস আছে, জান্নাতবাসী প্রত্যেক পুরুষ ابناء ثلاث و ثلاثين অর্থাৎ তেত্রিশ বছরের যুবক থাকবে। এখন এই জান্নাতি যুবকরা সেখানে কোটি কোটি বছর থাকার পরেও তেত্রিশ বছরের যুবক থাকতে পারলে হযরত ঈসা (আ.) ঐশী ভ্রমণ শেষে পুনরায় তেত্রিশ বছর বয়সে কেন ফিরতে পারবে না?

11 আল্লাহর বাণী (و يوم اموت و يوم ابعث حيا) সম্পর্কিত সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করিয়াছি, যেদিন আমার মৃত্যু হইবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হইব। (১৯:৩৩ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে এই আয়াত দ্বারাও একদম অপ্রাসঙ্গিক একটি যুক্তির অবতারণা করে বলে থাকে যে, আয়াতটিতে ঈসা (আ.)-এর জীবনের তিনটি ঘটনার কথা বলা হয়েছে। জন্ম, মৃত্যু আর পুনরুত্থান। এখানে তাঁর আকাশে যাওয়া এবং শেষ যুগে পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসার কথা নেই। অথচ এই দুইটি ঘটনাও তাঁকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র এক মর্যাদায় ভূষিত করে থাকে। ফলে প্রমাণিত হয় যে, এই উভয় ধারণাই মিথ্যা। তাদের এই বক্তব্যের উত্তর দিয়েছেন বিশিষ্ট যুগ ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.)। তিনি বলেছেন, ঈসা (আ.) মূলত এই কথাগুলোর মাধ্যমে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদের খন্ডন করে নিজেকে তাঁর বান্দা হওয়ার ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন। সংক্ষেপে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)। আয়াতে তাঁর জন্ম, মৃত্যু আর পুনরুত্থানের ব্যাপারটি উল্লেখ করার যেই প্রাসঙ্গিকতা তার সাথে অবশিষ্ট ঘটনা দুটির সম্পর্ক নেই বলেই তিনি তা উল্লেখ করেননি। আফসোস! কাদিয়ানী জ্ঞানপাপীরা এখানেও আয়াতের প্রসঙ্গ গোপন রেখে মনগড়া ব্যাখ্যার পিছু নিয়ে থাকে।

12 আল্লাহর বাণী -(و منكم من يرد الى ارذل العمر)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমাদের মধ্যে কাহারও কাহারও মৃত্যু ঘটান হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাহাকেও কাহাকেও প্রত্যাবৃত্ত করা হয় হীনতম বয়সে যাহার ফলে উহারা যাহা কিছু জানিত সে সম্বন্ধে উহারা সজ্ঞান থাকে না। (২২:০৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এখানে ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে নির্বোধদের যুক্তি এরকম, ঈসা (আ.) আজ প্রায় দুই হাজার বছর অব্ধি বেঁচে থাকতে পারেন না। বেঁচে থাকলে এই আয়াত অনুযায়ী তিনি নিশ্চয়ই দারুণভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছেন, জ্ঞানহারাও হয়ে পড়েছেন। অথচ কোনো নবীকে আল্লাহ এমন অথর্ব অবস্থায় উপনীত করেননি। কিন্তু কাদিয়ানীদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, তারা ইহলৌকিক সময়ের অবস্থা আর পারলৌকিক সময়ের অবস্থার সাথে কোনো পার্থক্য করেনা। অথচ আল কুরআনে (৭০:৪) আল্লাহর একদিন আমাদের গণনায় ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) বছর (كان مقداره خمسين الف سنة) বলেও উল্লেখ আছে। সে হিসেবে ঈসা (আ.) আরো অন্তত ৪৮ হাজার বছর অতিবাহিত করতে হবে যদি তাঁকে তাঁর ঐশী সফরে মাত্র একদিন অতিবাহিত করতে হয়। কিন্তু এই সূ² কথাগুলো ঐসব নির্বোধদের বুঝানোর সাধ্য কার? পরিশেষে কথা হল, উল্লিখিত আয়াত দ্বারা মূলত পার্থিব জীবনে মানুষের সৃষ্টির সূচনা ও শারিরীক হ্রাস বৃদ্ধির সাধারণ নিয়ম সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে। আমরাও বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করার পর তিনিও একটা সময় ইন্তেকাল করবেন। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা মোটেও সাব্যস্ত হয় না যে, তিনি বর্তমানেও মৃত, জীবিত নেই।

13 আল্লাহর বাণী -(ولكم فى الارض مستقر و متاع الى حين)এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আমি বলিলাম, তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নামিয়া যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রহিল (০২:৩৬ ইফা)।

ব্যাখ্যা : কাদিয়ানী নির্বোধদের দাবী হচ্ছে, এই আয়াত কোনো মানুষকে এই মাটির দেহ নিয়ে আকাশে যাওয়া এবং সেখানে থাকাকে প্রতিহত করছে। অথচ তাদের এই দাবীকে মেনে নিলে তখন মুহাম্মদে আরাবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক চির-বিস্ময়কর ঐশী ভ্রমণ (মেরাজ)-কে অস্বীকার করতে হয়। হযরত ইদরিস (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার যে কথা স্বয়ং কুরআনেই (মরিয়ম/১৯:৫৭) এসেছে সেটিও অমান্য করতে হয়। যা কখনো কোনো মুমিনের জন্য সম্ভব নয়। অধিকন্তু ইমাম ইবনে কাসীরও লিখেছেন যে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন رفع الى السماء الرابعة فمات بها অর্থাৎ ইদরিসকে চতুর্থ আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় অতপর তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। এবার আমি ঐ ব্রেইন ওয়াশ/কাল্টদের ভ্রান্তি নিরসনে বলতে চাই, উক্ত আয়াত হতে উদ্দেশ্য হল, ইবলিশ শয়তান কর্তৃক আদি পিতা-মাতা আদম হাওয়াকে জান্নাতে পদস্খলন করতে চাওয়ার বিষয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দেয়া। আয়াতটিতে এও উল্লেখ রয়েছে যে, বনী আদম পৃথিবীতে এসেছে সামান্য কিছুদিনের জন্য। এখন এখানে কোন্ শব্দে বুঝানো হয়েছে যে, মাটির দেহের কোনো মানুষ মোটেও ঐশী ভ্রমণে যেতে পারবেনা? সুতরাং এই আয়াত দ্বারাও তিনি (ঈসা) বর্তমানেই মৃত, তা মোটেই সাব্যস্ত হয় না।

14 আল্লাহর বাণী (ومن نعمره ننكسه فى الخلق) আয়াতের সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আমি যাহাকে দীর্ঘ জীবন দান করি প্রকৃতিগতভাবে তাহার অবনতি ঘটাই। তবুও কি উহারা বুঝে না? (৩৬:৬৮ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত উল্লেখপূর্বক দাবী করে যে, আয়াতটিও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু ঘটে যাওয়ার প্রতি ইংগিত। কারণ শারীরিক দিক থেকে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ দৈহিক শক্তি, তাকত ও ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মত দুরাবস্থায় উপনীত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করেছেন এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, উক্ত আয়াত হতেই যদি ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করা যেত তাহলে স্ববিরোধী নির্যা কাদিয়ানীর নিম্নোক্ত বক্তব্যের কোনো মানেই হয় না। এই যে, তিনি কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণ করেছেন ‘ঈসা (আ.)-এর দ্বিতীয়বারের আগমন করা এবং তাঁর মাধ্যমে ইসলাম সমগ্র দুনিয়ায় প্রচার প্রসার লাভ করার প্রতিশ্রুতিতে ফোরকানী ইশারা এই আয়াতে (সূরা আত-তওবাহ ৩৩) রয়েছে।’ দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১/৫৯৩। এবার নির্বোধদের সংশয় নিরসনে উত্তরে বলতে চাই, মূলত আয়াতটিতে পার্থিব জীবনে মানুষের শারীরিক হ্রাস বৃদ্ধির সাধারণ নিয়ম সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে। আমরাও বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.)ও ফিরে এসে যথাসময় উক্ত নিয়মের মুখোমুখি হবেন।

15 আল্লাহর বাণী (ثم جعل من بعد قوة ضعفا و شيبة)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আল্লাহ, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। (৩০:৫৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াতটিও উল্লেখ করে বলে থাকে যে, এই আয়াত দ্বারাই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, ঈসা (আ.)ও পরিণত বয়সে মারা গেছেন। কেননা কোনো মানুষই খোদার সৃষ্টি প্রাকৃতিক নিয়মের বাহিরে নন, তিনি সাধারণ কিবা নবী-রাসূল যেই হোন না কেন! অথচ নির্বোধদের জানা নেই যে, মির্যা কাদিয়ানীর একটি রচনায় উল্লেখ আছে যে, ‘খোদাতায়ালার যে খোদায়ী এবং খোদায়িত্ব তাঁর সীমাহীন কুদরত বা শক্তি এবং তাঁর অগণিত রহস্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাঁকে কানূনের আকারে কোনো সীমার মধ্যে আবদ্ধ করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।’ (আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলী পৃ-৫৭, প্রকাশকাল ২৭ মে ১৯৯৮ইং। যাইহোক, ঈসা (আ.) বর্তমানে আকাশে (ঐশী ভ্রমণ) থাকায় তিনি বর্তমানে ইহজাগতিক ও প্রাকৃতিক নিয়মের আওতাভুক্ত নন। ফলে তাঁকে এক্ষুণি প্রাকৃতিক নিয়মে আবদ্ধ করে ‘মৃত’ বলে সিদ্ধান্ত দেয়া নেহাতই মূর্খতা বৈ কিছুই না। অধিকন্তু আয়াতটির ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর শিষ্য বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কাতাদাহ (রহ.) বলেছেন, প্রথম দুর্বলতা হচ্ছে শুক্র আর শেষ দুর্বলতা হচ্ছে বৃদ্ধ বয়স যখন তার চুল সাদা হয়ে যেতে থাকে। (তাফসীরে তাবারী)। যাইহোক, আমরাও বিশ্বাস করি যে, ঈসা (আ.) আবার যখন পার্থিব জীবনে ফিরে আসবেন তখন আল্লাহ চাইলে তিনিও প্রকৃতির উক্ত নিয়মের বাহিরে থাকবেন না।

16 আল্লাহর বাণী -(انما مثل الحيوة الدنيا كماء انزلناه من السماء)এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : বস্তুত পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত এইরূপ যেমন আমি আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করি যদ্দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন-সন্নিবিষ্ট হইয়া উদগত হয়, যাহা হইতে মানুষ ও জীবজন্তু আহার করিয়া থাকে। (১০:২৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধরা আয়াতটি দ্বারাও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে যাওয়ার প্রমাণ এইভাবেই পেশ করে যে, এই আয়াতে বলা হয়েছে, পার্থিব জীবন প্রাকৃতিক নিয়মেরই অধীনে। এ প্রাকৃতিক নিয়ম লংঘন করার ক্ষমতা মানুষের নেই, ঈসা (আ.)-এরও ছিলনা। যে যুগে একজন মানুষের গড় আয়ু ধরুন নব্বই বছর ছিল। ঈসা (আ.) না হয় দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন কিন্তু সেই দীর্ঘায়ু তো শত শত বছর হতে পারে না। অতএব ঈসা (আ.) মারা গেছেন, বেঁচে নেই। (নাউযুবিল্লাহ)। উত্তরে বলতে চাই, এই নির্বোধরা কি হযরত আদম (আ.)-এর ৯৬০ বছর, নূহ (আ.)-এর ৯৫০ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা, আসহাবে কাহাফের ৩০৯ বছর সময় শুধু ঘুমেই কেটে যাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করতে পারবে? তারা কি বরেণ্য কোনো একজন যুগ ইমামের উদ্ধৃতি দিয়ে এগুলোর একটিও রদ করতে পারবে? আহা! এদের কথাবার্তা শুনলে যে কেউই বলতে বাধ্য হয় যে, এরা এতই ব্রেইনওয়াশ যে নিজের চিন্তাশক্তিটা পর্যন্ত এরা নষ্ট করে ফেলেছে! এরা এখানে ইহজগতের যে নিয়ম দ্বারা এমন একজনকে পরিমাপ করছে যে কিনা এই মুহূর্তে পার্থিব ইহজগতেরই বাহিরে।

17 আল্লাহর বাণী -(ثم انكم بعد ذالك لميتون)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ইহার পর তোমরা অবশ্যই মরিবে। (২৩:১৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত দিয়েও ঈসা (আ.)-কে কিভাবে মৃত সাব্যস্ত করছে দেখুন। তারা বলে যে, এই আয়াতেও প্রাকৃতিক নিয়মের অলঙ্গনীয়তার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। এই নিয়মের অধীনে সব কিছুই, প্রতিটি মানুষই। অতএব ঈসা (আ.)ও এই নিয়মের আয়ত্তে যথাসময় ইন্তেকাল করেছেন। জবাবে বলতে চাই, ঈসা (আ.) বর্তমানে যেহেতু প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের অধীনে নেই, সেহেতু এই মুহূর্তে উনার উপর প্রকৃতির এই নিয়ম-কানুন কোনোভাবেই প্রয়োগ হবেনা। উল্লেখ্য, বাহায়ী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা হোসাইন আলী নূরী বাহাউল্লাহও (১৮১৭-১৮৯২ইং) নিজেকে নবুওয়ত ও রেসালতের দাবী করার পাশাপাশি ১৮৬৩ সালে ইরান থেকে বাগদাদে নির্বাসনে থাকাবস্থায় ‘মসীহ’ হওয়ার দাবী করেছিলেন। তার কিতাবুল আকদাস পৃ-৭১ দ্রষ্টব্য। বাহাউল্লাহ ইরানী তার উক্ত দাবীর উপর প্রায় ২৯ বছর জীবিত ছিলেন। বর্তমানে পৃথিবীতে ২১৮টির অধিক রাষ্ট্রে প্রায় ৮০০ জাতি ও বর্ণের মানুষের মাঝে বাহায়ীধর্ম প্রচলিত। অতএব বুঝা গেল, মির্যার মত ইতিপূর্বে আরো অনেকে নিজেকে শুধু নিজেকে ‘রূপক ঈসা’ দাবী করার হীনস্বার্থেই ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল। কেউ সফল হয়নি, মির্যা কাদিয়ানীও না।

18 আল্লাহর বাণী (ثم يهيج فتراه مصفرا ثم يجعله حطاما)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করেন, অতপর উহা ভূমিতে নির্ঝররূপে প্রবাহিত করেন এবং তদ্দ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন, অতপর ইহা শুকাইয়া যায়। ফলে তোমরা ইহা পীতবর্ণ দেখিতে পাও, অবশেষে তিনি উহা খড়-কুটায় পরিণত করেন? ইহাতে অবশ্যই উপদেশ রহিয়াছে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য। (৩৯:২১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত দিয়েও ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করার জন্য বলে থাকে যে, এই আয়াতেও প্রাকৃতিক নিয়ম বা কানুনে কুদরতের কথা বলা হয়েছে, যা কেউ লঙ্গন করতে পারেনা। জবাবে বলব, প্রথমত এধরণের প্রশ্নের উত্তর একটু আগেই অন্যখানে বহুবার দেয়া হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এই আয়াতের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ইহকালীন অবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে এর সাথে ঈসা (আ.)-কে জড়ানো পুরোই অপ্রাসঙ্গিক। বরং অত্র আয়াতে বুঝানো হয়েছে যে, এই পার্থিব দুনিয়ার মুহাব্বত একদমই অনর্থক। কারণ অতি অল্প সময়ের মধ্যে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে। তার চাকচিক্য ও সতেজতা, তার শ্যামলতা ও সৌন্দর্য এবং তার আমোদ-প্রমোদ, আরাম-আয়েশ ক্ষণকালের জন্য।

19 আল্লাহর বাণী (الا انهم ليأكلون الطعام)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমার পূর্বে আমি যে সকল রাসূল প্রেরণ করিয়াছি তাঁহারা সকলেই তো আহার করিত ও হাটেবাজারে চলাফেরা করিত। হে মানুষ। আমি তোমাদের মধ্যে এক-কে অপরের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ করিয়াছি। তোমরা ধৈর্যধারণ করিবে কি? তোমার প্রতিপালক সমস্ত কিছু দেখেন। (২৫:২০ ইফা)।

ব্যাখ্যা : কাদিয়ানী নির্বোধরা এই আয়াত দ্বারাও বুঝাতে চায় যে, ঈসা (আ.)-এর ক্ষেত্রেও ইহজগতের এই সমস্ত খাবার-দাবার ইত্যাদীর কোনো প্রকার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অর্থাৎ তিনি এখন আর ইহজগতে নেই, ইহজগতের ন্যায় আহারও করেন না। তার মানে তিনি মারা গেছেন। প্রতিউত্তরে বলতে চাই, ঈসা (আ.) ইহজগতে আবার ফিরে আসার আগ পর্যন্ত এইভাবে কেয়াস করে তাঁকে মৃত সাব্যস্ত করা মস্তবড় পাগলামি ছাড়া কিছুই না। যেহেতু এই আয়াতের প্রেক্ষাপট বলছে যে, আয়াতটি ইসলামের প্রাথমিকযুগের মুশরিকদের কতেক ধারণাকে অহেতুক আখ্যা দিতেই নাযিল হয়েছিল। কারণ মুশরিকদের ধারণা ছিল যিনি নবী হন তিনি খাবার গ্রহণ করেন না, হাটেবাজারে চলাফেরা করেননা। আল্লাহতালা তাদের আপত্তি খন্ডন করে বলেন, মুহাম্মদ (সা.) সহ পূর্বের সমস্ত নবী রাসূল মানুষই ছিলেন, খাবারও গ্রহণ করেছেন, সাংসারিক প্রয়োজনে হাটে-বাজারেও গিয়েছেন। কাজেই এগুলো কোনোভাবেই নবুওয়তী মর্যাদার পরিপন্থী নয়, যেমনটি তোমরা অজ্ঞতাবশত ভাবছো (তাফসীরে কুরতুবী)।

এবার নির্বোধদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আসহাবে কাহাফ’ কুদরতে ইলাহীর মাধ্যমে ৩০৯ বছর যাবত পানাহার ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারলে এখন ঈসা (আ.) কিজন্য পারবেন না? অথচ রাসূল (সা.) বলেছেন يجزى اهل السماء من التسبيح و التقديس অর্থাৎ তাসবীহ এবং তাকদীস (আল্লাহর নামে যিকির আযকার) ঐশী জগতবাসীর খাবারের জন্য যথেষ্ট। (দেখুন, মেশকাত শরীফ হাদীস নং ৬২৯৪)। ইমাম ইবনু কাইয়ুম (রহ.) লিখেছেন, ‘মসীহ ইবনে মরিয়ম জীবিত, ইন্তেকাল করেননি আর (আকাশে) তাঁর খাবার দাবার ফেরেশতার মতই। (দেখুন, আত-তিবইয়ান ফী আক্বসামিল কুরআন পৃ- নং ২৫৫, ইবনু কাইয়ুম)।

20 আল্লাহর বাণী (اموات غير احياء وما يشعرون ايان يبعثون) -এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : উহারা আল্লাহ ব্যতীত অপর যাহাদের আহবান করে তাহারা কিছুই সৃষ্টি করে না, তাহাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়। তাহারা নিষ্প্রাণ নির্জীব এবং কখন তাহাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হইবে সে বিষয়ে তাহাদের কোনো চেতনা নাই। (১৬:২০-২১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীদের বক্তব্য হচ্ছে, এই আয়াত অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলছে যে, আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে উপাস্যরূপে ডাকা হয় সবাই নির্জীব ও নিষ্প্রাণ। সুতরাং ঈসা (আ.)ও এখন মৃত বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা খ্রিস্টানরা তাঁকে খোদারপুত্র খোদা বলেই ডাকে। প্রতিউত্তরে বলতে চাই যে, উক্ত আয়াতের اموات তথা নির্জীব শব্দ হতে মুশরিকদের হাতে বানানো জড়পদার্থ প্রতিমাগুলোই বিশেষভাবে উদ্দেশ্য। এতে পথভ্রষ্ট আহলে কিতাবীদের উপাস্য সেসব সম্মানীত ব্যক্তিবর্গ শামিল নন যাঁদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত। যেমন বিবি মরিয়ম, আল্লাহর নবী হযরত উজায়ের, ঈসা। এই সম্পর্কে আল্লাহতালা বলেন ان الذين سبقت لهم منا الحسنى اولئك عنها مبعدون অর্থাৎ ‘আমার পক্ষ থেকে যাদের জন্য পূর্বেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে (২১:১০১)।’ এতেই প্রমাণিত হয় যে, আয়াতে اموات বা নির্জীব শব্দটি ‘খাস’; ‘আম’ নয়। কিন্তু যদি আয়াতটির اموات হতে বিনা ব্যতিক্রমে সবাইকে উদ্দেশ্য নেয়া হয় তখন নিচের প্রশ্নগুলোর কোনোই জবাব থাকেনা।

১. যেহেতু ঐ আয়াতেই এসেছে ‘পুনরুত্থান সম্পর্কে যাদের কোনো খবর নেই’। তাই প্রশ্ন হল, তবে কি নবীগণও পুনরুত্থান সম্পর্কে বেখবর তথা অসচেতন? নাউযুবিল্লাহ।

২. সূরা আম্বিয়া আয়াত নং ৯৮ এর মধ্যে আল্লাহতালা সে সমস্ত উপাস্যকেও জাহান্নামের জ্বালানি বলেছেন মুশরিকরা যাদের উপাসনাকারী। তাই প্রশ্ন হল, তবে কি কাদিয়ানীরা এ হিসেবে উজায়ের এবং ঈসাকেও জাহান্নামের জ্বালানি মনে করবে? নাউযুবিল্লাহ।

21 আল্লাহর বাণী (ولكن رسول الله و خاتم االنبيين)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নয়; বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং নবীগণের আগমনীধারা সমাপ্তকারী। (৩৩:৪০)। ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ অর্থ নবীগণের সমাপ্তকারী (রূহানী খাযায়েন ৩/৪৩১, লিখক মির্যা কাদিয়ানী)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীদের বক্তব্য হল, ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ সংক্রান্ত এ আয়াতে একথা ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মহানবীর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী নবীগণের আগমনের সিলসিলাহ বা ধারাক্রম শেষ হয়ে গেছে। অতএব ঈসা (আ.) এর পুনরাগমনের ধারণাটা কল্পিত প্রসূত। অর্থাৎ তিনি মারা গেছেন, আর আসবেন না। এই নির্বোধরা আসলে জানেই না যে, ‘শেষনবী’ এর সংজ্ঞায় কী বলা হয়েছে? যদি তারা তা জানত তাহলে ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমনের বিশ্বাসকে কখনোই ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ শীর্ষক আয়াতের বিরোধী মনে করত না। এবার তাহলে জেনে নিন, “শেষনবী” এর সংজ্ঞায় ইমাম যামাখশারী (মৃত. ৪৬৭ হিজরী) কী লিখেছেন। তিনি লিখেছেন ‘আমি মনে করি, মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী—একথার অর্থ হল তাঁর পরে আর কাউকে নবী বানানো হবেনা, আর ঈসা (আ.)-কে তো তাঁর আগেই নবী বানানো হয়েছে। আর তিনি যখন পুনরাগমন করবেন তখন তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর শরীয়তের উপর একজন আগমনকারী হবেন এবং তাঁর কেবলার দিকেই সালাত আদায়কারী হবেন, যেমন নাকি তিনিও অপরাপর উম্মতগণের মত একজন উম্মতই।’ (তাফসীরে কাশশাফ খ-২২ সূরা আহযাব ৪০)।

তাছাড়া তাফসীরে সমরকান্দী-এর ১ম খন্ডের ২৭২ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে ‘ঈসা (আ.) আল্লাহর নিকট শেষনবীর উম্মত হতে চেয়ে দোয়া করেছিলেন। তাই আল্লাহতালা তাঁর উক্ত দোয়া কবুল করেছেন।’ (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৫৫ এর তাফসীর)। মির্যা কাদিয়ানীর বইতেও লিখা আছে, “আগমনকারী মসীহ’র জন্য আমাদের নবী করীম (সা.) নবুওয়ত শর্ত করেননি।” (রূহানী খাযায়েন ৩/৫৯)।

সুতরাং প্রমাণিত হয়ে গেল যে, ঈসা (আ.)-এর পুরনাগমন নবুওয়তের দায়িত্ব সহকারে হবেনা, শুধুমাত্র একজন উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে হবে। যেহেতু তাঁর পুনরাগমনে নবুওয়তের দরজায় ধাক্কা লাগবেনা। ফলে ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ সংক্রান্ত আয়াত কোনোভাবেই ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমনের বিরোধিতা করেনা।

22 আল্লাহর বাণী (وما ارسلنا من قبلك الا رجالا نوحى اليهم)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমার পূর্বে আমি ওহীসহ পুরুষই প্রেরণ করিয়াছিলাম, তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞাসা কর। (১৬:৪৩ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াতের মর্মার্থ বাইবেলের নাম ভেঙ্গে উপস্থাপন করে বলে থাকে যে, এই আয়াতের নির্দেশ মতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের কিতাবগুলোর মধ্যে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, পূর্ববর্তী কোনো নবীর পুনরাগমন হতে রূপকভাবে অন্য কারো আগমনকে বুঝায়। কেননা ইহুদীদের বিশ্বাস ছিল, আকাশ হতে ইলিয়া নবীর আগমন হবে, তার পূর্বে ‘মসীহ’ আসতে পারেনা। কিন্তু যীশু (ঈসা) এসে বলেছিলেন যে, যাকারিয়ার পুত্র যোহন বা ইয়াহ্ইয়াই হলেন ইলিয়া (এলিজা বা এলিয়াস)।

উত্তরে বলতে চাই, প্রকৃতপক্ষে এই আয়াত দ্বারা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, ইতিপূর্বে যত রাসূলই প্রেরিত হয়েছিলেন তারা প্রত্যেকে মানুষ ছিলেন। অতএব যদি মুহাম্মদও একজন মানুষ হন তাহলে এটা কোনো নতুন কথা নয় যে, তোমরা তাঁর মানুষ হওয়ার কারণে তাঁর রেসালতকে অস্বীকার করবে। কিন্তু কাদিয়ানীরা নিজেদের উদ্দেশ্যকে পোক্ত করতে কিভাবে দরাকে সরা বানিয়ে দিল তা নিশ্চয়ই দেখেছেন। যাইহোক, এবার তথাকথিত ‘ইলিয়া’ নবী নিয়ে তাদের কাসুন্দির পোস্টমর্টেম করছি।

প্রথমত, বাইবেলের সবকয়টি সংস্করণই বর্তমানে বিকৃত ও পরিবর্তিত। দ্বিতীয়ত, ইউহান্নাহ বা যোহনের ইঞ্জিলেই লেখা আছে, “তদানিংকালের জেরুজালেমের নেতৃস্থানীয় ইহুদী নেতাদের প্রশ্নের উত্তরে ইউহান্নাহ তথা যোহন নিজেই ইলিয়া হওয়া অস্বীকার করেছেন।” মির্যা কাদিয়ানীও একথা স্বীকার করে লিখে গেছেন। দেখুন রূহানী খাযায়েন ২১/৪২-৪৩। কাজেই ইলিয়া সংক্রান্ত বাইবেলের উক্ত তথ্যটি সত্য নয়, বরং মিথ্যা। কেননা যোহন বা ইয়াহ্ইয়া (ইউহান্নাহ) যদি নিজেই নিজের ‘ইলিয়া’ হওয়া অস্বীকার করে থাকেন তাহলে এটাও নিশ্চিত সত্য যে, ঈসা (আ.) কখনো যোহনকে ‘ইলিয়া’ আখ্যা দেননি। অন্যথা দুইজনের যে কোনো একজন মিথ্যাবাদী হয়ে যাচ্ছেন, যা কখনো নবীর বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। সুতরাং ইলিয়া সংক্রান্ত পুরো ঘটনাটিই জাল ও বাতিল। ফলে এর উপর কথিত রূপক মসীহর ভিত্তি স্থাপন করতে চাওয়া এবং তারই কিয়াস করে শেষযুগে আগমনকারী ঈসাকে (আ.) রূপক দাবী করা সম্পূর্ণরূপে বাতিল।

23 আল্লাহর বাণী -(يأيتها النفس المطمئنة ارحعى الى ربك راضية مرضية)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : হে প্রশান্তচিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়া আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হইয়া। (৮৯:২৭-৩০ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত হতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু আবিষ্কার করে কিভাবে জেনে নিন। তাদের বক্তব্য হল, এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, মৃত্যুর পরে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা জান্নাতের মধ্যে জান্নাতবাসীগণের সঙ্গী হয়। মৃত্যুর পূর্বে কেউ জান্নাতবাসী হয় না। মেরাজের বিবরণে বুখারীর হাদীসে বলা হয়েছে যে, মহানবী (সা.) হযরত ঈসা (আ.)-কে জান্নাতবাসীগণের মধ্যে দেখেছেন। অতএব, বুঝা গেল মৃত্যুর পরেই ঈসা (আ.) জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। এখন এর জবাবে আমার পাল্টা চ্যালেঞ্জ থাকল, ঈসা (আ.)-কে দেখেছেন ‘জান্নাতে বা জান্নাতবাসীগণের মধ্যে’ এইরূপ শব্দচয়নে কোনো কথা নেই, এটি বরং কাদিয়ানীদের বানানো কথা। যদি কারো সাহস থাকে তাহলে দশ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। দ্বিতীয়ত, ইবনে মাজাহ এর ৪০৮১ নং হাদীসে মেরাজ সংক্রান্ত একটি হাদীসে রয়েছে যে, فَرُدَّ الْحَدِيْثُ اِلَى عِيْسَى ابْنِ مَرْيَمَ قَالَ قَدْ عُهِدَ اِلَى فِيْمَا دُوْنَ وَجْبَتُهَا فَاَمَّا وَجْبَتُهَا فَلَا يَعْلَمُهَا اِلَّا اللهِ عَزَّ وَ جَلَّ “…অতপর কেয়ামতের বিষয়টি ঈসা (আ.)-এর নিকট পেশ করা হলে তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দুনিয়ায় ফেরার প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু কেয়ামতের সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নেই।”

পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ৪৬ নং আয়াত ويكلم الناس فى المهد و كهلا এর মধ্যে ‘ইয়ুকাল্লিমু’ (তিনি কথা বলবেন) ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা ঈসা (আ.) প্রৌঢ় বয়সেও মানুষের সাথে কথা বলবেন মর্মে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতিটাও তাঁর দুনিয়ায় ফিরে আসার সমর্থনে শক্তিশালী ইংগিতবিশিষ্ট। উল্লেখ্য, প্রাচীন আরবী অভিধানগ্রন্থ ‘লিসানুল আরব’-এর মধ্যে রয়েছে, ‘কাহল’ বা প্রৌঢ় বয়স বলতে ৩৪ থেকে ৫১ বছরের মধ্যবর্তী বয়সকেই বুঝানো হয়। আর ইসলামিক সমস্ত অথেনটিক সোর্সগুলো ঘেঁটে দেখুন, ঈসা (আ.)-এর জীবন-ইতিহাস ৩৩ বছরের বাহিরে খুঁজে পাবেন না।

24 আল্লাহর বাণী (الله الذى خلقكم ثم رزقكم ثم يميتكم ثم يحييكم)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছেন, অতপর তোমাদেরকে রিযিক দিয়াছেন, তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাইবেন ও পরে তোমাদেরকে জীবিত করিবেন। (৩০:৪০ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীদের বক্তব্য হচ্ছে আয়াতটিতে মানব-জাতির চারটি পর্যায় বা অবস্থার কথা বলা হয়েছে। এটাই আল্লাহ’র সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম। সবাই এ নিয়মের আওতায়। জন্মগ্রহণ, বুদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, মৃত্যুবরণ করা এবং পুনরুত্থিত হওয়া। এর ব্যতিক্রম ঘটবেনা। ঈসা (আ.)-এর জীবনেও না। সুতরাং ঈসা (আ.)ও এই নিয়মের আওতায় হিসেবে তিনি এখন আকাশে থাকতে পারেন না, বরং মৃতুবরণ করে কবরে রয়েছেন। জবাবে বলতে চাই যে, আচ্ছা ঈসা (আ.)-এর জন্মটা তো পিতা বিহীন এবং কোনো ইনসানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়াই হয়েছিল। তাহলে প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো না কিভাবে? খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদের খন্ডনের জন্য কি এটুকুই যথেষ্ট নয় যে, প্রকৃত ঈশ্বর জন্ম হন না; অথচ তারা যাঁকে ঈশ্বর বানিয়ে বসে আছে তিনি জন্ম নিয়েছেন?

আহা আফসোস! নির্বোধ কাদিয়ানীরা বুঝলো না যে, আল্লাহর প্রতিটি কাজই হেকমতপূর্ণ। তাঁর কোনো কাজই অনর্থক নয়। আর তিনি আপনা সিদ্ধান্তে স্বাধীন, কোনো নিয়মই তাঁকে আটকাতে পারেনা। আসল কথা হল, ঈসা (আ.)-এর পুরো জীবনটাই দুনিয়ার মানুষদের জন্য একটি পরীক্ষা। বিনা পিতায় সৃষ্টি হওয়ায় চির দুশমন ইহুদী-জাতি তাঁকে জারজ সন্তান আখ্যা দিয়ে নিজেদের পরকাল ধ্বংস করেছে। খ্রিস্টানরা তাঁকে ঈশ্বরপুত্র বলে নিজেদের বিচারবুদ্ধি আর পরকাল দুটোই নষ্ট করেছে। পৃথিবীর শেষ লগ্নে এসে মুসলিম জাতির মধ্যে কাদিয়ানী, বাহায়ী সম্প্রদায় তাঁর সশরীরে ঐশী ভ্রবণ ও দুনিয়ায় আবার ফিরে আসাকে অমান্য করে শুধু ইসলামের মূলধারা থেকে বেরিয়ে যায়নি, বরং খতমে নবুওয়তের আকীদাকেও অস্বীকার করে বসেছে। ফলে তারা ইসলামের গন্ডি থেকে আপনা-আপনি বহিষ্কৃত হয়ে গেছে।

এবার ঈসা (আ.)-কে আল্লাহ কিভাবে পরীক্ষামূলক হিসেবে সৃষ্টি করলেন তার একটি প্রমাণ সূরা আলে ইমরান এর ৮১ নং আয়াত থেকে নিন। এখানে আল্লাহতালা রূহের জগতে সমস্ত নবী রাসূল থেকে শেষনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন ও আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেয়ার কথা রয়েছে, যেমন و اذ اخذ الله ميثاق النبيين অর্থাৎ যখন আল্লাহ নবীগণ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলেন…। নবীগণও সে সময় আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি গ্রহণপূর্বক বলেছিলেন اقرارنا তথা ‘আমরা স্বীকার করলাম’। হযরত ইবনে আব্বাস এবং আলী প্রমুখ থেকেও এইধরণের মতামত প্রমাণিত। (তাফসীরে তাবারী দ্রষ্টব্য)। আল্লাহতালা হযরত ঈসা (আ.)-কে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন যাতে দুনিয়ায় আবার ফিরে আসার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়ত এবং রেসালতের উপর ঈমান গ্রহণ ও তার শরীয়ত বরণ দ্বারা রূহের জগতে গৃহীত প্রতিশ্রুতি অন্যান্য সকল নবী রাসূলের পক্ষ হতে বাস্তবায়িত হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে বিষয়গুলো এত পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকার পরেও নির্বোধরা সাত অন্ধের হাতি দেখা অন্ধ বধিরদের মতই আচরণ করছে। পরিতাপের বিষয় যে, তারা তাদের পন্ডিতদের এগুলো জিজ্ঞেসও করেনা!

25 আল্লাহর বাণী -(كل من عليها فان و يبقى وجه ربك)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ভূপৃষ্ঠে যাহা কিছু আছে সবই নশ্বর (ধ্বংসশীল), অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের সত্তা যিনি মহিমাময় মহানুভব। (৫৫:২৬-২৭ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াত দিয়ে কাদিয়ানীরা যে খোঁড়া যুক্তির জোড়াতালি প্রদর্শন করে সেটি হল, এই আয়াত দ্বারা বুঝা গেল পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্ট সবই ধ্বংসশীল। সৃষ্টির এই ধ্বংসধারার একটা পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর সঙ্গে, সেই মৃত্যু যে কোনোভাবেই হোক। সবাই এই প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায়। হযরত ঈসা (আ.)ও এর বাহিরে নন। অতএব তাঁরও দেহ গঠনের পূর্ণত্বে পৌঁছার পর ক্ষয়েরধারা থেকে মুক্ত ছিলনা বলে তাও প্রাকৃতিক নিয়মে যথাসময়ে ক্ষয়প্রাপ্তির স্তরে পৌঁছে গেছে অর্থাৎ তিনি (ঈসা) মারা গেছেন। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। উত্তরে বলতে চাই, জ্বী হ্যাঁ; আমরা মুসলমানরাও বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.) যখন ফিরে আসবেন তখন যথাসময় মৃত্যুবরণও করবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তো তিনি ইহজগতের ধরাছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাহিরে।

26 আল্লাহর বাণী -(ان المتقين فى جنة و نهر)এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : মুত্তাকীরা থাকিবে স্রোতস্বিনী বিধৌত জান্নাতে, যোগ্য আসনে, সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী আল্লাহর সান্নিধ্যে। (৫৪:৫৪-৫৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা আয়াতটির মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে চায়, জান্নাতে প্রবেশ করে মানুষ মৃত্যুর দুয়ার দিয়েই, অন্য কোনো উপায়ে নয়। অতএব ‘বাল রাফা’আহুল্লাহু ইলাইহি’ এর অর্থ যখন করা যে, ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর সান্নিধ্যে তুলে নেয়া হয়েছে তখন তো এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি (আ.) মৃত্যুর পরেই আল্লাহর দিকে উন্নীত হয়েছেন। যেহেতু ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি’ এর ‘ইলাইহি’ এবং ‘বাল রাফা’আহুল্লাহু ইলাইহি’ এর ‘ইলাইহি’ সমার্থক ও সমান তাৎপর্যবহ। আর খোদার দিকে উন্নীত হয়ে কেউ আর পৃথিবীর দিকে পতিত হয় না। সুতরাং ঈসা (আ.) খোদার দিকে উন্নীত হয়েছেন বলেই তাঁর আর পৃথিবীর দিকে পতিত হওয়ার সুযোগ নেই অর্থাৎ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। জবাবে বলতে চাই, নির্বোধদের কি জানা নেই যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর রাফা অর্থাৎ তুলে নেয়ার ঘটনা যদি ফেরেশতা আজরাইলের মাধ্যমে ঘটত তবেই না তাঁর ‘রাফাহুল্লাহু’ আর ইন্নালিল্লাহি-এর ‘ইলাইহি (اليه)’ একই তাৎপর্য বহনকারী হত! এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে করা হয়ে গেছে। সূরা নিসা’র ৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় [ক্রমিক নং ২] দেখুন!

27 আল্লাহর বাণী (ان الذين سبقت لهم منا الحسنى اولئك عنها مبعدون)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : যাহাদের জন্য আমার নিকট হইতে পূর্ব হইতে কল্যাণ নির্ধারিত রহিয়াছে তাহাদেরকে উহা (জাহান্নাম) হইতে দূরে রাখা হইবে। (২১:১০১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধরা এখানেও কাসুন্দির ত্যানা পেঁচিয়ে বলে যে, এখানে ঈসা (আ.)-এর ন্যায় উজায়ের (আ.)-এর কথাও উল্লেখযোগ্য। যেহেতু ইহুদীরা উজায়ের (আ.)-এরও পূজা করত এবং আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করত। অথচ তাদের কেউই নিজেদের উপাস্য হবার দাবী করেননি। ফলে উজায়ের যেমন জান্নাতি হয়েছেন মৃত্যুর পরে, ঈসা (আ.)ও অনুরূপ জান্নাতি হয়েছেন মৃত্যুর পর। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। উত্তরে বলতে চাই যে, আয়াতটির প্রসঙ্গ নিয়ে যারাই চিন্তা করে থাকেন তাদের নিকট গোপন থাকেনি যে, নির্বোধরা কত হীন কায়দায় আয়াতের বিষয়বস্তুকে বিকৃত করেছে। অথচ আয়াতের মানশা বা উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো কোনো মানুষের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে ঈসা, উজায়ের, ফেরেশতা ও বহু সৎলোকেরও তো উপাসনা করা হয়ে থাকে, তাহলে এরাও কি তাদের ইবাদতকারীদের সাথে জাহান্নামে যাবে? আল্লাহতালা তাদের এই শঙ্কা দূর করতেই আয়াতটি নাযিল করেছেন। আসলে সত্যি বলতে কোনো গোষ্ঠী দলিল-প্রমাণে একদমই দেউলিয়া হয়ে গেলে অবস্থা যা হয় কাদিয়ানীদেরও হুবহু তাই হয়েছে!

28 আল্লাহর বাণী (اين ما تكونوا يدرككم الموت و لو كنتم فى بروج مشيدة)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাইবেই, এমনকি সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করিলেও। (০৪:৭৮ ইফা)।

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াত হতে নির্বোধ কাদিয়ানীরা যে যুক্তি দাঁড় করে সেটি হচ্ছে, আয়াতটি দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, মৃত্যুর হাত থেকে কারো রেহাই নেই। এখনও কেউ নিস্তার পাচ্ছেনা, ভবিষ্যতেও পাবেনা, অতীতেও কেউ পায়নি। ঈসা (আ.)ও না। কেননা আল্লাহর চিরন্তন রীতি বা নিয়মে কোনো ব্যতিক্রম নেই। সুতরাং ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পক্ষে এই আয়াত অত্যন্ত বলিষ্ঠ দলিল। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। উত্তরে জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আচ্ছা উক্ত আয়াতের সঠিক মর্মার্থ হযরত মুহাম্মদ (সা.) ভালো জানতেন নাকি কাদিয়ানীরা ভালো জানে? একজন প্রকৃত শিক্ষিত মুসলমান অবশ্যই বিশ্বাস করবে যে, পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা ও মর্মবাণী মুহাম্মদ (সা.)ই সবার চেয়ে ভালো বুঝতেন। তাহলে এবার শুনুন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ঈসা (আ.)-এর দীর্ঘ-জীবন সম্পর্কে কী বলে গেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন مَدَّ فِىْ عُمْرِهِ حَتَّى اَهْبَطَ مِنَ السَّمَاءِ اِلَى الْاَرْضِ وَ يَقْتُلُ الدَّجَالَ অর্থাৎ আল্লাহতালা তাঁর (ঈসা) হায়াত দীর্ঘায়িত করে দিয়েছেন, যাতে তিনি আকাশ থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন এবং দাজ্জালকে হত্য করেন। (দেখুন ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রহ. সংকলিত ‘দুররে মানছূর’ খ-২ পৃ-৩৫০)। সুতরাং বুঝা গেল, আল্লাহর সুন্নাহ বা রীতিনীতিকে কাদিয়ানীরা যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে তা পুরোপুরি সঠিক নয়।

29 আল্লাহর বাণী وما اتاكم الرسول فخذوه و ما نهكم عنه فانتهوا-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : রাসূল তোমাদিগকে যাহা দেয় তাহা তোমরা গ্রহণ কর এবং যাহা হইতে তোমাদিগকে নিষেধ করে তাহা হইতে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ তো শাস্তিদানে কঠোর। (৫৯:০৭ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধরা এই আয়াত দিয়েও কাসুন্দি করে বেড়ায়। বলতে পারেন সে কাসুন্দিটা কী রকম? তাহলে শুনুন, তারা বলে যে, এই আয়াতের দাবী হল, মানুষের হায়াত মউতের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কী বলেছেন তা আমাদের দেখা উচিত। এই ব্যাপারে একটি হাদীসে এসেছে, এই পৃথিবীর বুকে (على ظهر الارض) এমন কেউ নেই যে, শত বছর গত হয়ে যাবে তবু জীবিতই থেকে যাবে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হল যে, ঈসা (আ.)ও আর বেঁচে নেই। কারণ তিনি বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স দুই হাজার বছর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)।

জবাবে এই নির্বোধদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে, হাদীসটির সাথে হযরত ঈসা (আ.)-এর সম্পর্ক কোথায়? তাঁর অবস্থান কি পৃথিবীর বুকে না বাহিরে? তাঁর অবস্থান যে পৃথিবীর বুকে নন, বরং বাহিরে; একথার প্রমাণের জন্য কি আল্লাহ এবং তাঁর শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বক্তব্য আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? এখানে আরেকটি কথা ক্লিয়ার করা দরকার যে, দুনিয়ার নিয়ম কানুনের সাথে ঐশী জগতের নিয়ম কানুনকে যারা তুলনা করে বলতে চাচ্ছেন যে, হযরত ঈসা (আ.) বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স দুই হাজার বছর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে তারা মূলত অন্ধাকারেই আছেন। কারণ সময় বা ঞরসব ঐশী জগতে গতিশীল নয়, বরং স্থীর। তাই সেখানে ঈসা (আ.)-এর বয়স বাড়বেনা বরং আগের জায়গায় অর্থাৎ তেত্রিশই থাকবে। মুসলিম শরীফের হাদীসের খন্ডাংশ اذا طأطأ رأسه قطر (তিনি যখন মাথা নিচু করবেন তখন সদ্য গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তির মাথা থেকে যেভাবে পানি ঝরতে থাকে সেভাবে তার মাথা থেকে পানির ফোটা ঝরতে থাকবে) ঐশী জগতে সময় দুনিয়ার ন্যায় গতিশীল নয়, সে কথার দিকেই ইংগিত। (মুসলিম শরীফ, কিতাবুল ফিতান)। উল্লেখ্য, ঈসা (আ.)-কে যখন আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল তিনি তখন সদ্য গোসলখানা থেকে গোসল সেরে বের হয়েছিলেন… (وَرَأسُهُ يَقْطُرُ مَاءُ), (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।

30 আল্লাহর বাণী (او ترقى فى السماء و لن نؤمن لرقيك حتى تنزل علينا كتابا نقرؤه) -এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘অথবা তোমার একটি স্বর্ণ নির্মিত গৃহ হইবে, অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করিবে, কিন্তু তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনও ঈমান আনিব না যতক্ষণ তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ না করিবে যাহা আমরা পাঠ করিব। বল (হে মুহাম্মদ)! পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক। আমি তো হইতেছি কেবল একজন মানুষ; একজন রাসূল।’ (১৭:৯৩)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ আর প্রতারকের দল উক্ত আয়াতটি দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে এই বলে ধোকা দেয় যে, এই আয়াতে কারীমা থেকে জানা যায় যে, কাফেররা মহানবী (সা:)-কে সশরীরে আকাশে উঠে যেতে বলেছিল এবং সেখান থেকে একটি কিতাব নিয়ে অবতীর্ণ হতে বলেছিল। কিন্তু তিনি (সা.) তাদেরকে সেই নিদর্শন দেখাতে অস্বীকার করেছিলেন এই বলে যে, তিনি আল্লাহর রাসূল বটে, কিন্তু তিনি তো মানুষ মাত্র। আর মানুষের পক্ষে তো নিজে নিজেই আকাশে উঠে যাওয়া সম্ভব নয় আর আল্লাহও এভাবে কাউকে সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেন না। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)।

জবাবে বলতে চাই যে, এই জ্ঞানপাপীর দল আয়াতের মূল কনসেপ্ট আড়াল করার জন্য বরাবরের মত এখানেও প্রতারণা জাল সেঁটেছে। তারা কাফেরদের আরও যে সমস্ত দাবী ছিল সেগুলো চোখবুঁজে এড়িয়ে যায়। কাফেরদের আপ টু বটম দাবীগুলোর উপর চোখ বুলালে একজন সচেতন মানুষ মাত্র কাদিয়ানীদের প্রতারণা বুঝতে পারবে। এই দেখুন, কাফেরদের দাবীগুলো এই রকম ছিল যে,

১. ভুমি হতে এক প্রস্রবণ উৎসারিত করতে হবে।

২. খেজুর ও আংগুরের বাগানের ফাঁকে ফাঁকে নদী-নালা প্রবাহিত করতে হবে।

৩. আকাশকে খন্ড বিখন্ড করে তাদের (কুরাইশ কাফেরদের) উপর ফেলতে হবে।

৪. আল্লাহ এবং ফেরেশতাদেরকে তাদের সামনে উপস্থিত করতে হবে।

৫. মহানবী (সা.)-এর জন্য একটি স্বর্ণ-নির্মিত প্রাসাদও থাকতে হবে।

তার পরেই আল্লাহতালা আয়াত নাযিল করেছেন এই বলে যে, ‘কুল সুবহানা রাব্বী হাল কুনতু ইল্লা বাশারার রাসূলা’। অর্থাৎ বল (হে মুহাম্মদ)! পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক। আমি তো হইতেছি কেবল একজন মানুষ; একজন রাসূল।’ এই আয়াতে মুশরিকরা শুধুমাত্র আকাশে আরোহণের প্রস্তাব দিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকেনি, বরং তাদের সম্পূর্ণ দাবীটা ছিল এরকম যে, “তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনও ঈমান আনিব না যতক্ষণ তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ না করিবে যাহা আমরা পাঠ করিব।” খুব খেয়াল করুন!

  • মক্কার কাফেররা পরিষ্কার বলেছিল যে, “(و لن نؤمن لرقيك) ‘ওয়া লান নু’মিনা লি-রুকিয়্যিকা অর্থাৎ তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনও ঈমান আনিব না”

তাহলে প্রশ্ন আসে, কাফেরদের মূল দাবীটা কী ছিল? কাদিয়ানীরা কত নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদী আর প্রতারক হলে কাফেরদের মূল দাবীকে আড়াল করে কত সূ²ভাবে আমাদের গোমরা করতে পারে চিন্তা করুন!

এই জন্যই আমি বলি যে, কোনো গবেষক বা অবিজ্ঞ আলেম ছাড়া কাদিয়ানীদের এই সমস্ত প্রতারণা সহজে সবার পক্ষে ধরা সম্ভব নয়।

এবার পাঠকবৃন্দ! নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, এই প্রতারকের দল কত সূক্ষ্ম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আয়াতের খন্ডিত বক্তব্যে দুনিয়াকে বোকা বানাতে চাচ্ছে?

এখন তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম যে, ঐ আয়াত ‘আল্লাহ কাউকে সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেন না’ বলেই কনসেপ্ট দেয়, যদি তাই হয় তাহলে আদম এবং হাওয়া দুইজনকে জান্নাত (আকাশ) থেকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া সম্পর্কে আল্লাহর কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটির কী ব্যাখ্যা দেবেন? পবিত্র কুরআনে এসেছে,

‘হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদের বিভ্রান্ত না করে, যেভাবে সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল; সে তাদের পোশাক টেনে নিচ্ছিল, যাতে সে তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখাতে পারে। নিশ্চয় সে ও তার দলবল তোমাদেরকে দেখে যেখানে তোমরা তাদেরকে দেখ না। নিশ্চয় আমি শয়তানদেরকে তাদের জন্য অভিভাবক বনিয়েছি, যারা ঈমান গ্রহণ করে না।’ (সূরা আ’রাফ ২৭)।

শেষকথা,

এখানে শুধুমাত্র তাদের অপব্যাখ্যার খন্ডন মূলক জবাব দেয়া হল, আমাদের আকীদার সপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণই দেয়া হয়নি।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here