প্রশ্নঃ ইমাম মাহদী ‘কাদেয়া’ নামক গ্রাম থেকে বের হওয়া এবং জমিদার বংশীয় হওয়া এধরণের কথাবার্তার ভিত্তি আছে কি?
উত্তরঃ (এক) ইমাম মাহদী ‘কাদেয়া’ নামক গ্রাম থেকে বের হবেন, এমন কথার কোনো ভিত্তি নেই। শুনে অবাক হবেন, কাদিয়ানীদের ‘তাবলিগি পকেটবুক‘ নামক ছোট্ট একখানা বইয়ে লিখা আছে, ইমাম মাহদীর গ্রামের নাম কাদ’আ বা কাদেয়া (আরবী : كدعة) বলেই হাদীসে উল্লেখ আছে! আমরা উত্তরে বলি যে, এই ধরণের কোনো শব্দ কোনো দুর্বল বর্ণনাতেও উল্লেখ নেই। মির্যা কাদিয়ানীর ভাষ্যমতে “ইমাম মাহদী এমন একটি গ্রাম থেকে প্রকাশ পাবেন যে গ্রামের নাম থাকবে কাদ’আ। তার মাথায় থাকবে পাগড়ী। সেখানকার একজন আহ্বানকারী ডেকে বলবে, ইনি হলেন মাহদী। তোমরা তার অনুগত হও।” (মির্যা কাদিয়ানী তারপর লিখেন), এখানে যেই কাদ’আ শব্দ এসেছে তদ্দ্বারা পাঞ্জাবে (ভারত) ‘কাদিয়ান’ নামক গ্রামই উদ্দেশ্য। মির্যা কাদিয়ানীর রচনা ‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ এর মধ্যেও অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায়। এবার মূল আলাপে আসছি, প্রথমকথা হচ্ছে, আলোচ্য রেওয়ায়েতটি জাল ও বানোয়াট। হাদীসশাস্ত্রের প্রায় ১৬ জন বিশেষজ্ঞ যাঁরা মির্যা কাদিয়ানীর জন্মেরও শতশত বছর আগে জন্মগ্রহণকারী, প্রত্যেকে বর্ণনাটির সনদ (সূত্র) পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে পরিষ্কার বলে গেছেন যে ‘এটি জাল তথা বানোয়াট’ কথা। কারণ এর সূত্রে উল্লিখিত একজন বর্ণনাকারী হচ্ছে আব্দুল ওহাব বিন আল-জাহহাক। তার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের মতামত এই যে, ১. ইমাম বায়হাক্বী বলেন, সে হাদীসের জগতে পরিত্যাজ্য। ২. ইমাম আবু জা’ফর আল-আক্বিলী বলেন, সে হাদীসের জগতে মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য। ৩. ইমাম আবু হাতিম বলেন, সে মিথ্যা বলত। ৪. ইমাম ইবনে হিব্বান বলেন, তার হাদীস দ্বারা দলিল দেয়া বৈধ নয়। ৫. ইমাম আবুদাউদ বলেন, সে হাদীস জাল করত এবং সে বিশ্বস্ত নয়। ৬. ইমাম আবু জুর’আ বলেন, সে হাদীস তৈরি করত। ৭. ইমাম হাকিম নিশাপুরী বলেন, তার বর্ণিত হাদীসগুলো বানোয়াট। ৮. ইমাম আবু নাঈম আল ইস্পাহানী বলেন, তার হাদীসগুলো জাল। ৯. ইমাম আহমদ ইবনে শু’আইব আন নাসায়ী বলেন, তার নিকট বিস্ময়কর হাদীস থাকত এবং সে অবিশ্বস্ত ও পরিত্যাজ্য আর ইমাম হাতিম তাকে মিথ্যাবাদী বলতেন। ১০. ইমাম ইবনুল ইরক বলেন, সে হাদীস তৈরি করত এবং মিথ্যাবাদী হিসেবে সমালোচিত ছিল। ১১. ইমাম দারে কুতনী বলেন, সে পরিত্যাজ্য, দুর্বল এবং তার বহু বাতিল আর পরিবর্তিত রেওয়ায়েত ছিল। ১২. ইমাম ছালেহ বিন মুহাম্মদ জাজিরাহ বলেন, সে মুনকারুল হাদীস (বিশ্বস্ত রাবীর উল্টো বর্ণনাকারী) এবং তার বর্ণিত হাদীস সাধারণত মিথ্যা। ১৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল বুখারী বলেন, তার নিকট বহু পরিমাণে বিস্ময়কর বর্ণনা ছিল। (তাহযীবুল কামাল, মীযানুল ই’তিদাল ২/৬৭৯; রাবী নং ৫৩১৬; ইমাম যাহাবী রহ.)।
আফসোস! সাধারণ কাদিয়ানীদের পক্ষে কি আর এত গভীরভাবে তথ্য অনুসন্ধান করা সম্ভব? সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা হল, রেওয়ায়েতটিতে ঐ শব্দটি “কাদ’আ বা কাদেয়া” নয়, বরং শব্দটি হল “কার’আ” (كرعة), যার ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে আরবের ‘ইয়েমেন‘ নামক রাষ্ট্রের উল্লেখ রয়েছে। যেমন ইমাম জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী (রহ.) সংকলিত “আল আ’রফুল ওয়ারদি ফী আখবারিল মাহদী-العرف الوردي في أخبار المهدي নামক কিতাবে লিখা আছে, ((يخرج المهدي من قرية باليمن يقال لها كرعة)) অর্থাৎ মাহদী ইয়েমেন এর কার’আ নামক গ্রাম থেকে বেরুবেন (পৃ.-৫৬ দ্রষ্টব্য)। আফসোস! মির্যা গোলাম আহমদ জাল রেওয়ায়েতটির সম্পূর্ণ বিবরণ পাশকাটিয়ে যায় এবং কাটছাঁট করে মতলবসিদ্ধ কনসেপ্ট দাঁড় করে যায়! দুনিয়ার বুকে এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কী হতে পারে!!
পাঠকবৃন্দ! খেয়াল করলে দেখতে পাবেন যে, একই বর্ণনায় ইয়েমেন (يمن) শব্দও উল্লেখ রয়েছে। আরবি বাক্যটি একটু আগেই অর্থসহ দেখেছেন। যাদের সত্য খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে তারা একটু কষ্ট করে গুগলে সার্চ দিয়ে “কার’আ” নামীয় গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান দেখে নেবেন! তবেই ‘কার’আ’ গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন যে, و كرعة قرية في منطقة بني خَوْلان باليمن قرب صعدة অর্থাৎ “কার’আ” এটি ছ’দাহা নামক স্থানের নিকটতম ইয়েমেন এর বনী খাওলান অঞ্চলের একটি গ্রাম। আপনি অনলাইন থেকে আরো স্বচ্ছ তথ্য পাবেন যে, ইয়েমেনের একদম পশ্চিমে একটি সীমান্তবর্তী জেলার নাম Sadah (ছ’দাহা)। এটি রাজধানী San’a (সানা) হতে উত্তরে প্রায় ২৪৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কার’আ (كرعة) নামক গ্রামটি এই জেলার নিকটে এবং আল-হাদীদ শহরের দক্ষিণে ও Bayt al Faqih শহরের পূর্ব সীমান্তে দুটো পাহাড়ের মধ্যখানে অবস্থিত। গ্রামটি বর্তমানে ছোটছোট ৫ টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত। গ্রামগুলো হল- الظهرة, مكراع, الجروة, هاجرة, مرحلة (গুগল থেকে মানচিত্রসহ দেখে নিন)। উইকিপিডিয়া (আরবি ভার্সন) দ্রষ্টব্য।
(দুই) আপনি কাদিয়ানী লিটারেচারগুলো পড়লে আরও দেখতে পাবেন যে, তারা আরেক জায়গায় দাবী করে লিখে রাখছে যে, হাদীসে আসছে ইমাম মাহদী একজন ‘জমিদার বংশীয়’ হবেন! অথচ এধরণের কোনো হাদীসই দুনিয়ারবুকে খোঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু কথা হল, তাহলে তাদের ঐ কথার ভিত্তি কী? এর উত্তর হচ্ছে, মূলত তারা হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত একটি হাদীসের শব্দে ইচ্ছাকৃত বিকৃত অনুবাদ দ্বারাই এ ধরণের অলীক কথাবার্তা লিখে রেখেছে। এবার জেনে নেয়া যাক, হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসটির শব্দগুচ্ছে তারা কী রকম বিকৃতি ঘটিয়েছে! হাদীসটিতে একটি শব্দ হচ্ছে ‘আল হারিছ হাররাছ’ (الْحَارِثُ حَرَّاثٍ)। ফলে প্রশ্ন আসবে যে, তাহলে এই ‘হারিছ হাররাছ’টা কে? সুনানে আবুদাউদ গ্রন্থের “কিতাবুল মাহদী” অংশে একই বর্ণনাকারী থেকে হাদীসটির আরবী ইবারত ( Text) দেখলে বুঝা যায় যে, সেই ‘আল হারিছ হাররাছ’ নামক ব্যক্তিটি ইমাম মাহদীর যুগের এমন এক ভাগ্যবান মহাপুরুষ যিনি “ওরায়ুন্নাহার তথা মধ্য এশিয়া” থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে হযরত ইমাম মাহদীর সাহায্যে সম্মুখে এগিয়ে আসবেন। তার পূর্ণ নাম হবে আল হারিছ বিন হাররাছ (الْحَارِثُ بْنُ حَرَّاثٍ) তথা হাররাছের পুত্র হারিছ। এবার অনুবাদসহ সংশ্লিষ্ট হাদীসটি নিচে দেখুন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ((يَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ وَرَاءِ النَّهْرِ يُقَالُ لَهُ الْحَارِثُ بْنُ حَرَّاثٍ عَلَى مُقَدِّمَتِهِ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ مَنْصُورٌ يُوَطِّئُ أَوْ يُمَكِّنُ لآلِ مُحَمَّدٍ كَمَا مَكَّنَتْ قُرَيْشٌ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَجَبَ عَلَى كُلِّ مُؤْمِنٍ نَصْرُهُ . أَوْ قَالَ إِجَابَتُهُ)) অর্থাৎ ওরায়ুন্নাহার তথা মধ্য এশিয়া থেকে আল হারিছ বিন হাররাছ নামক এক ব্যক্তি বের হবেন। তাঁর আগে “মানছুর” নামের অপর এক ব্যক্তি বের হবেন। তিনি মুহাম্মদ (এখানে মুহাম্মদ বলতে ইমাম মাহদীকে বুঝানো উদ্দেশ্য। কেননা তার নামও মুহাম্মদ হবে)-এর অনুসারীর সাহায্যে এসে (বাহিনীতে) মিলিত হবেন ও তাঁকে শক্তিশালী করবেন; যেইরূপ কুরাইশরা রাসূল (সা.)-কে সাহায্য করেছিলো। (সেই সময়কার) সকল মুমিনের উচিত তাঁকে (ইমাম মাহদীকে) সাহায্য করা এবং তাঁর আহবানে সাড়া দেয়া।” রেফারেন্স, আবুদাউদ কিতাবুল মাহদী, হা/৪২৪০ [ইফা]; আরো দেখুন, ইমাম সুয়ূতী (রহ.) রচিত ‘আল আ’রফুল ওয়ারদী ফী আখবারিল মাহদী’ পৃষ্ঠা নং ২৭-২৮। হাদীসের মান, দুর্বল। যাইহোক, এবার দেখুন, কাদিয়ানীদের রচনাসমূহে উক্ত হাদীসটির ‘আল হারিছ বিন হাররাছ’ নামক ব্যক্তির পরিচয় বিলুপ্ত করে এবং সেটিকে বিকৃত করে কত নিকৃষ্টতম অপব্যাখ্যার তুফান ঘটিয়েছে! যেমন তারা লিখেছে, ইমাম মাহদী জমিদার বংশীয় হবেন, বিপাশা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ‘কাদিয়ান’ গ্রাম থেকে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। নাউযুবিল্লাহ।
যাইহোক, সুনানে আবুদাউদ শরীফের উক্ত হাদীস হতে আমরা পরিষ্কার ধারণা পাই যে, ‘হারিছ হাররাছ’ হচ্ছে আল হারিছ ইবনে হাররাছ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এবার ‘ওরায়ুন্নাহার’ (Wa’raun Nahar) এর ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে জেনে নেব। ওরায়ুন্নাহার (ইংরেজি : Central Asia) হল, মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ (বিশেষত, সমরকন্দ, বুখারা, তিরমিয, তাসখন্দ ইত্যাদি)’র ভূ-বেষ্টিত এলাকা! অঞ্চলটির সীমানার অনেকগুলো সংজ্ঞা আছে, যার কোনোটিই পুরোপুরি সর্বজনগৃহীত নয়। ঐতিহাসিকভাবে অঞ্চলটি বিভিন্ন যাযাবর জাতি ও সিল্ক রোডের সাথে সম্পর্কিত। ফলে অঞ্চলটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জাতি, দ্রব্য ও সাংস্কৃতিক ধারণাসমূহের আদানপ্রদানের অঞ্চল হিসেবে কাজ করেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আছে কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, এবং অন্যান্য ছোট ছোট রাষ্ট্র যেমন আজারবাইজান (কাস্পিয়ান সাগরের অপর পাড়ে অবস্থিত)। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকেও অনেক সময় এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। আল্লাহ আমাদেরকে আখেরি যামানার সকল ফেতনা ও ভণ্ডদের ভন্ডামি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী