তর্ক শুরু হলেই কাদিয়ানী পণ্ডিতগণ মনস্তাত্ত্বিকভাবে মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করার জন্য বিশেষতঃ দুটি বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করে। একটি হল, আরে বর্তমান দুনিয়ার মুসলমানদের অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখো, তাদের অবস্থা কতটা শোচনীয়, তারা কেমন নিপীড়িত ও বঞ্চিত। তাদের আলেমরা আকাশের নীচে সর্বনিকৃষ্ট জীব, একে অন্যে দলাদলিতে লিপ্ত। বর্তমানে ইসলামের আলো যেন নিভু নিভু অবস্থা! এ অবস্থায় আল্লাহ যদি দুনিয়ায় কোনো মহাপুরুষ প্রেরণ না করেন তবে আর কখন প্রেরণ করবেন? তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, সেই ব্রিটিশ পিরিয়ডে ইসলামের দুর্দিনে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রতিশ্রুত মসীহ এবং মাহদী হিসেবে আল্লাহর একজন প্রেরিত নবী। (নাউযুবিল্লাহ)।
দ্বিতীয় অস্ত্র হল, ঈসা (আ.) জীবিত নেই, আর একথা কুরআন দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। সুতরাং আগত ঈসা ইবনে মরিয়ম দ্বারা ‘রূপক ঈসা’-ই উদ্দেশ্য, আর তিনিই হলেন মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (মৃত. ১৯০৮ ইং)। কেননা দুই হাজার বছর পূর্বের ঈসা (আ.) বর্তমানে বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কেননা এ বয়সের কেউই সাধারণত বেঁচে থাকেন না, বেঁচে থাকা অসম্ভব! (নাউযুবিল্লাহ)।
কাদিয়ানীদের যুক্তিগুলো বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু একটু গভীর থেকে চিন্তা করলে যে কেউ সহজেই ধরতে পারবে যে, তাদের ঐ সমস্ত যুক্তিতর্কের মূল উদ্দেশ্য একটাই, সেটি হল- মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম আর হযরত ইমাম মাহদী হিসেবেই দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া। তাই আপতত কোনো ধরণের বিতর্কে না গিয়েই আমরা তাদেরকে মাত্র কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই!
তর্কের খাতিরে মেনে নিচ্ছি যে, আপনাদের কথা অনুসারে হযরত ঈসা (আ.) জীবিত নেই এবং দুনিয়ার সব আলেম উলামা গোমরাহ, পথভ্রষ্ট। কিন্তু তাই বলে কি মির্যা কাদিয়ানী নিজ দাবীতে সত্য হয়ে যাবে? কারণ বাহায়ী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ও মসীহ দাবীকারী মির্যা হুসাইন আলী নূরী তথা বাহাউল্লাহ ইরানীও (জন্ম-মৃত্যু ১৮১৭-১৮৯২) হযরত ঈসা (আ.)-কে মৃত দাবী করার মাধ্যমে নিজেকে ‘মসীহ’ (ঈসা) বলে দাবী করে গেছেন।
দুনিয়ার বর্তমান আদর্শিক অবস্থা গত একশ বছর চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। যে কেউ একথা স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু আখেরি নবী মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পরেও দুনিয়ার অবস্থা খারাপ হলেই কি আল্লাহ একেরপর এক নবী রাসূল পাঠাতেই থাকবেন? তাহলে এ শতাব্দীতেও যারা নবী রাসূল দাবী করবে আপনারা কি তাদেরকেও নবী রাসূল মেনে নেবেন?
আল্লাহতালা দুনিয়ায় ঈসা মসীহ এবং ইমাম মাহদী দুইজনকেই যথাসময় প্রেরণ করার কথা যদি সত্যিই বলে থাকেন, তাহলে সেটির বিবরণ পবিত্র কুরআনে অথবা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলোয় অবশ্যই থাকবে। কিন্তু কোনো একটি হাদীসও কি আপনারা মির্যা কাদিয়ানীর সাথে মিলাতে পেরেছেন? পারেননি। দয়াকরে আমাদেরকে গ্রহণযোগ্য দলিলের ভিত্তিতে অবশ্যই প্রমাণ করে দেখাবেন যে, মির্যা কাদিয়ানী কিভাবে মসীহ হলেন? কিভাবে ইমাম মাহদী হলেন? কিভাবে তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে একজন নবীও হলেন?
কাদিয়ানী মিশনারীদের নিকট এ প্রশ্নগুলোর কোনো সঠিক উত্তর আছে কি?
১ আমরা মুসলিম উম্মাহ বিশ্বাস করি যে, ঈসা (আ.)-এর পুনঃ আগমনের বিশ্বাস কুরআন দ্বারা ইংগিতে এবং সহীহ হাদীসগুলো দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে সাব্যস্ত। কিন্তু কাদিয়ানী সম্প্রদায়ও বিশ্বাস করে যে, কুরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছে যে, ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আবার আসবেন! (রূহানী খাযায়েন ১:৫৯৩)। শুধু পার্থক্য হচ্ছে, কাদিয়ানীদের মতে, আগত সেই ঈসা হতে পাঞ্জাব প্রদেশের কাদিয়ান পল্লীর নবী দাবীদার গোলাম আহমদ উদ্দেশ্য। তাই প্রশ্ন আসবে, কুরআনের সেই আয়াত কী কী যেখানে আগত সেই ঈসা বলতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই উদ্দেশ্য? কিভাবে তা বুঝিয়ে দিন!
উল্লেখ্য, মুসলিম উম্মাহ বিশ্বাস করেন, ঈসা (আ.) আবার আসবেন ঠিকই, কিন্তু তিনি রূপক কেউ নন, বরং তিনি প্রকৃত ঈসা ইবনে মরিয়ম-ই। আর এর প্রমাণ কুরআনে [3:46] ইংগিতে (وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلا وَمِنَ الصَّالِحِينَ) অর্থাৎ (মরিয়মের প্রতি কৃত ইলহাম, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে) আর তিনি (ঈসা) দোলনায় মানুষের সাথে কথা বলবেন এবং প্রৌঢ় বয়সেও বলবেন এবং তিনি নেককারদের মধ্য হতে একজন। হাদীস বলছে (وَالَّذِي نَفْسِي بيَدِهِ، لَيُوشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمُ ابنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلًا) অর্থাৎ শপথ সেই সত্তার যার হাতের মুঠোয় আমার প্রাণ, তোমাদের মাঝে মরিয়ম পুত্র একজন ন্যায়বিচারক ও শাসক হিসেবে অবশ্যই নেমে আসবেন। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া দ্রষ্টব্য।
২ আগমনকারী ঈসা ‘রূপক ঈসা‘ হবেন, এর মজবুত এমন কোনো দলীল কি কুরআনে বা হাদীসে রয়েছে, যা দ্বারা গত তেরশত বছর ধরে প্রতি শতাব্দীর সকল যুগ-ইমাম ও মুজাদ্দিদ, মুফাসসির এবং হাদীস বিশারদগণও আপনাদের মতোই মনে করতেন!?
উল্লেখ্য, কাদিয়ানীদের ‘মহা সুসংবাদ’ নামের একটি বইয়ের শেষে আঠারো জন যুগ ইমামের নাম-তালিকা উল্লেখ আছে। অন্তত তাদের কোনো একজন-ও কি আপনাদের অনুরূপ কোনো কনসেপ্ট রাখতেন? প্রামাণ্য স্ক্যানকপি সহ দেখাবেন!
৩ এমন একটি হাদীস বা কুরআনের আয়াত কি নির্ভরযোগ্য কোনো পুরনো তাফসীর বা ব্যাখ্যা সহকারে দেখাতে পারবেন যেখানে আগমনকারী ঈসা আর প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী তারা দু’জনই একজন হবেন বলে উল্লেখ রয়েছে?
৪ সহীহ মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে প্রায় চার চার বার আগত ঈসাকে ‘নবীউল্লাহ ঈসা‘ অর্থাৎ আল্লাহর নবী হযরত ঈসা নাযিল হবেন, উল্লেখ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, সেই ‘নবীউল্লাহ ঈসা’ দ্বারা মির্যা কাদিয়ানী উদ্দেশ্য হলে তিনি কিজন্য নিজেকে সরাসরি ‘নবী’ দাবী করার পরিবর্তে বিভিন্ন বিশেষণমূলক শব্দ (উম্মতি-বুরুজি-জিল্লি)কে আশ্রয় নিলেন? তাকে এ অনুমতি কে দিয়েছে? আল্লাহ দিয়েছেন? তার কোনো লিখনীতে কি একথা পরিষ্কার করে উল্লেখ আছে যে, সে সমস্ত বিশেষণের আশ্রয় নিতে আল্লাহ-ই তাকে বলেছেন!? দয়া করে তার বই থেকে দলীল দেখাবেন!
৫ মনে করুন, আল্লাহ-ই তাকে ‘নবী‘ নামে নামকরণ করেছেন! যদি তার এ কথা সঠিক হত তাহলে সে কিজন্য তার আরেকটা লিখায় মানুষের উদ্দেশ্যে লিখেছে যে,
তোমরা আমার লিখায় আমার সম্পর্কে যেখানেই ‘নবী’ শব্দ দেখতে পাবে তোমরা সে নবী শব্দটি কর্তিত ধরে নেবে আর নবী শব্দের জায়গায় ‘মুহাদ্দাস’ শব্দ উদ্দেশ্য নেবে! (আনওয়ারুল উলূম ২:৫৪১, উর্দূ – আনলাইন এডিশন)।
সনদের তাহকিক সহ ইমামে আ’যম আবূ হানীফা (রহ.) সম্পর্কে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হিজরী)-এর অভিমত,
ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন (রহ.)-এর শিষ্য আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে ইবরাহীম আদ-দাওরাক্বি বলেন ((قَالَ (أَبُو يَعْقُوب) وَنا أَحْمَدُ بْنُ الْحَسَنِ الْحَافِظُ قَالَ نَا عبد الله بْنُ أَحْمَدَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ الدَّوْرَقِيُّ قَالَ سُئِلَ يَحْيَى بْنُ مَعِينٍ وَأَنَا أَسْمَعُ عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ فَقَالَ ثِقَةٌ مَا سَمِعْتُ أَحَدًا ضَعَّفَهُ هَذَا شُعْبَةُ بْنُ الْحَجَّاجِ يَكْتُبُ إِلَيْهِ أَنْ يحدث ويأمره وَشعْبَة شُعْبَة)) অর্থ ❝ইয়াহইয়া ইবন মা’ঈনকে আবূ হানীফা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আমি শুনতে পেলাম, তিনি বলেছেন, তিনি একজন সিকাহ (অর্থাৎ তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত)। কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন বলে আমি শুনিনি। এ তো শু’বাহ ইবনুল হাজ্জাজ, তিনি আবূ হানীফাকে হাদীস বর্ণনা করতে লিখে পাঠান এবং অনুরোধ করেন। আর শু’বাহ তো শু’বাহ-ই।❞ (ইমাম ইবনু আব্দিল বার, আল-ইনতিকা পৃ. ১২৭)। – সহীহ। রাবীগণ সকলে বিশ্বস্ত।
তাহকিক ও রাবীর সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত
1 ইমাম ইবনু আব্দিল বার মালেকি (গ্রন্থকার) জন্ম: ৩৬৮-মৃত্যু: ৪৬৩ হিজরী। ইমাম যাহাবী লিখেছেন ((كان إماما دينا ، ثقة ، متقنا ، علامة ، متبحرا ، صاحب سنة واتباع)) অর্থাৎ একজন একনিষ্ঠ ইমাম, সিকাহ, সুপুরুষ, আল্লামা, বিশাল পণ্ডিত ও সুন্নাহর অনুসারী। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৮:১৫৮ ইমাম যাহাবী)।
2 ইবনু আব্দিল বার (রহ.)-এর শায়খ ইমাম আবূ ইয়াকুব। ইমাম যাহাবী তার মৃত্যুসন ৩৮৮ হিজরী বলে উল্লেখ করেছেন (দেখুন তারীখুল ইসলাম ৮:৬৪৩)। পূর্ণ নাম, ইউসুফ ইবনে আহমদ আস-সয়দালানী আল মাক্কী, উপনাম আবূ ইয়াকুব। তিনি বলেছেন ((نا أَحْمَدُ بْنُ الْحَسَنِ الْحَافِظُ)) এ কথা আমাকে আহমদ ইবনুল হাসান আল হাফিয বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনু আব্দিল বার (রহ.) সহ অনেক ইমাম তাঁকে তাওসীক্ব করেছেন (দেখুন আল ইস্তিযকার ১:২১)। তাছাড়া শায়খ আবুল ফাওযান কিফায়াতুল্লাহ আস-সানাবিলী তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন ((ابو یعقوب یوسف بن احمد بن يوسف الصيدلانی … … ثقہ ہیں)) ❝আবু ইয়াকুব আস-সয়দালানী একজন সিকাহ।❞ (দেখুন, আনওয়ারুল বদর, পৃ-৩৩৩)।
3 আহমদ ইবনুল হাসান হাফিয (পূর্ণ নাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আদ-দিনাওয়ারী), উপনাম আবূবকর, পেশা আদ্দাররাব (الضَرّابَ), নিসবত আদ-দিনাওয়ারী। একজন সিকাহ রাবী। ইমাম খতীব বাগদাদী লিখেছেন ((قدم بَغْدَاد وحدث بها، وكان ثقة. مات يوم الأربعاء لأربع عشرة خلت من جمادى الأولى سَنَة ثمان وعشرين وثلاثمائة ببَغْدَاد)) অর্থাৎ তিনি বাগদাদ গমন করেন এবং তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করা হয়। তিনি একজন সিকাহ ছিলেন। তিনি জুমাদাল উলা মাসের ১৪ তারিখে বুধবার ৩২৮ হিজরীতে বাগদানে ইন্তেকাল করেন। (তারীখে বাগদাদ ৪:৪২৭ খতীব বাগদাদী, তারীখুল ইসলাম ২৪:২২৪ ইমাম যাহাবী, মু’জামু ইবনিল মুক্বরি ৫০৩)।
উল্লেখ্য, এ আহমদ ইবনুল হাসান আল হাফিয নামে দু’ ব্যক্তি রয়েছে। একজনের নামের শেষে السُّكّريّ রয়েছে, তার মৃত্যু-সন ২৬১ হতে ২৭০ হিজরীর মধ্যে (তারীখুল ইসলাম ৬:২৬২ ইমাম যাহাবী), আরেকজনের নামের শেষে الدينورى রয়েছে; কিন্তু উক্ত সনদে الدينورى নামীয় ব্যক্তিই উদ্দেশ্য যিনি ৩২৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। আর একথার প্রমাণ আছে ইবনুল বার (রহ.)-এর কিতাব ‘আল ইন্তিক্বা’ এর ১৪৫ নং পৃষ্ঠায় উল্লিখিত অপর একটি বর্ণনার সনদে।
4 আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে ইবরাহীম আদ-দাওরাক্বি। উপনাম আবূ আব্দিল্লাহ। কেউ কেউ তাঁর মৃত্যু সন ২৪৬ হতে ২৭৬ হিজরীর মধ্যে বলে লিখেছেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) তার মৃত্যু সন ২৭৬ হিজরী বলেই উল্লেখ করেছেন (দেখুন, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৩:১৫৪)। ইমাম যাহাবী (রহ.) লিখেছেন ((وكان صدوقا. وثقه الدارقطني)) ইমাম আবূ হাতিম তাঁকে সত্যবাদী (صدوق) বলেছেন এবং দারা কুতনী তাকে সিকাহ বলেছেন। তাঁর কাছ থেকে ইমাম মুসলিম সহ অনেক মুহাদ্দিস হাদীস বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখ্য, গয়ের মুকাল্লিদরা উক্ত বর্ণনার সনদের উপর انقطاع এর যে অভিযোগ উত্থাপন করে সেটি তাদের ক্রুটিপূর্ণ তাহকিক আর অজ্ঞতা থেকেই করে থাকে। তারা রাবীগণের সঠিক পরিচয় নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বেশকিছু শাওয়াহিদ-شواهد ও মুতাবি’ ইমাম ইবনে মা’ঈন (রহ.) থেকে তাঁরই একাধিক শিষ্যের যৌথ বর্ণনা হতে নিম্নরূপ,
❝ইমাম মিয্যি (রহ.) এর তাহযীবুল কামাল ৭০৩২, ইমাম যাহাবীর তারীখুল ইসলাম ৬:৯৯১ এর তথ্য অবলম্বনে…❞
((محمد بن سعد العوفى سمعت ابن معين يقول: كان ابو حنيفة ثقة الخ))
1 মুহাম্মদ ইবনে সা’আদ আল আ’ওফী (২৭২ হিজরী) থেকে…। তাঁর ব্যাপারে ইমাম আবূ আব্দিল্লাহ হাকিম উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ইমাম দারা কুতনী (রহ.)-কে বলতে শুনেছেন ((لا بأس به)) অর্থাৎ তার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। (তারীখে বাগদাদ ২:৩৬৮)।
ইমাম ইবনু হিব্বান বলেন ((لا يجوز به اذا انفرد)) অর্থাৎ তার একক বর্ণনা দ্বারা দলিল দেয়া বৈধ নয়। (আল মাজরূহীন)।
ইবনে মা’ঈন (রহ.) বলেন ((ليس بمتين)) অর্থাৎ সে সুদৃঢ় নন। ইমাম আবূ যুর’আ (রহ.) বলেছেন ((لين الحديث)) সে হাদীসের ক্ষেত্রে কোমল। (তাহযীবুল কামাল, রাবী ক্রমিক নং ৫১৫০)।
((و قال صالح بن محمد الأسدى الحافظ سمعت يحيى ابن معين يقول: كان ابو حنيفة ثقة فى الحديث الخ)) ((قال صالح بن جزرة وغيره سمعنا ابن معين يقول : أبو حنيفة ثقة الخ))
2 সালেহ ইবনে মুহাম্মদ আল আসদী আল হাফিয (২০৫-২৯৩ হিজরী) থেকেও…। তাঁর সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন ((الامام الحافظ الكبير الحجة)) তিনি একজন ইমাম, বড়মাপের হাফিয ও হুজ্জত। ইমাম দারা কুতনী (রহ.) বলেন ((و كان ثقة حافظا غازيا)) অর্থাৎ তিনি একজন সিকাহ, হাফিয এবং গাযী। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪:২৪ ইমাম যাহাবী)।
ইবনে মা’ঈন (রহ.) থেকে আবূ হানীফা (রহ.) সম্পর্কে নিচের বর্ণনাগুলো জাল ও বানোয়াট যে কারণে,
1 ইবনে আবী মরিয়াম বলেন ((سألت يحيى بن معين عن أبي حنيفة، فقال: «لا يكتب حديثه)) অর্থ- আমি ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈনকে আবূ হানীফা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তাঁর হাদীস লিখাযোগ্য নয়। (ইমাম ইবনু আদী সংকলিত আল কামিল ৮:২৩৬)।
দুর্বল।
কারণ এর সনদে ابن أبي مريم নামীয় রাবী অনির্ভরযোগ্য। ইমাম যাহাবী লিখেছেন ((ضَعَّفَهُ: أَحْمَدُ بنُ حَنْبَلٍ، وَغَيْرُهُ، مِنْ قِبَلِ حِفْظِه.)) অর্থাৎ ইমাম আহমদ সহ অন্যান্যরা তাকে তার স্মরণশক্তির ক্রুটির কারণে দুর্বল বলেছেন। তিনি আরও লিখেছেন ((وَقَالَ ابْنُ عَدِيٍّ: أَحَادِيْثُه صَالِحَةٌ، وَلاَ يُحْتَجُّ بِهِ)) অর্থাৎ ইমাম ইবনু আদী বলেন, তার হাদীসসমূহ সঠিক, তবে তা দ্বারা দলিল দেয়া যাবেনা। ইমাম ইবনে হিব্বান বলেন ((هُوَ رَدِيْءُ الحِفْظِ)) অর্থ- সে স্মরণ শক্তির দিক থেকে প্রত্যাখ্যাত। ইয়াযিদ ইবনে আব্দ রাব্বিহ বলেন, সে ১৫৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করে। (ইমাম যাহাবীর সিয়ারু আলামিন নুবালা দ্রষ্টব্য)।
2 মুহাম্মদ ইবনে উসমান ইবনে আবী শায়বাহ বলেন ((سمعت يحيى بن معين وسئل عن أبي حنيفة، قال: «كان يضعف في الحديث)) অর্থ- আমি ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন থেকে শুনেছি তাঁকে আবূ হানীফা (রহ.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেন, তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল ছিলেন (উ’ক্বাইলীর সংকলন আদ-দ্বু’আফা ৪:২৮৪)।
জাল।
কারণ এর সনদে محمد بن عثمان بن أبي شيبة (মৃত. ২৯৭ হিজরী) নামীয় রাবী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে ছিল ((كذاب يضع الحديث)) একজন মহা মিথ্যাবাদী এবং হাদীস জালকারী। ইমাম যাহাবী লিখেছেন ((وأما عبد الله بن أحمد بن حنبل فقال : كذاب. وقال عبد الرحمن بن خراش : كان يضع الحديث)) অর্থ- আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন, সে ছিল একজন মহা মিথ্যাবাদী। ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে খারাস বলেন, সে হাদীস জালকারী ছিল (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪:২২, ইমাম যাহাবী)।
আলোচনা শেষ করব ইমাম ইবনু আব্দিল বার মালেকী (রহ.)-এর একটি চমৎকার উক্তি দিয়ে। তিনি লিখেছেন ((الذين رووا عن أبي حنيفة ووثقوه وأثنوا عليه أكثر من الذين تكلموا فيه)) অর্থাৎ ❝যারা ইমামে আ’যম থেকে বর্ণনা করেছেন সকলে তাঁকে সিকাহ বলেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। আর তাদের সংখ্যা ঐ সকল লোকের চেয়ে বেশি যারা তাঁর সমালোচনা করেছে।❞ (জামে বায়ানিল ইলম ২/১৪৯)।
❝তুমি যখন কোনো লোককে দেখবে যে, সে আবূ হানীফা এবং তাঁর রায়কে ভালোবাসে অথচ তাতে (সে) ক্রুটি করে, তাহলে তুমি এমন ব্যক্তির প্রতি একদমই প্রশান্তচিত্ত হবে না। আর এমন ব্যক্তির প্রতিও (প্রশান্তচিত্ত হবে না) যে তাঁর মাযহাব গ্রহণ করেছে বটে, (তবে) সে তাঁর ফাতাওয়া (মানার) ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করে অথচ সে তাঁকে (নিজের) ইমাম হিসেবে গ্রহণ করেছে।❞ (শারহু উসূলি ইতিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ- ১/১৮৫, হাফিয হিবাতুল্লাহ আলকাঈ মৃত. ৪১৮ হিজরী)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য।
ইমাম আলী ইবনুল মদনী (রহ.)-এর পক্ষ হতে সহীহ সনদে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর ব্যাপারে সুস্পষ্ট তাওসীক্ব (توثيق) নিম্নরূপ,
2 যেমন ইমাম আলী ইবনুল মাদীনি (রহ.) বলেন ((وَقَالَ عَلِيُّ بْنُ الْمَدِيْنِيْ: أَبُوْ حَنِيْفَةَ رُوِيَ عَنْهُ الثَّوْرِيُّ وَاِبْنُ الْمُبَارَكِ وَحَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ وَهَشِيْمٌ وَوَكِيْعُ بْنُ الْجَرَّاحِ وَعَبَّادُ بْنُ الْعَوَّامِ وَجَعْفَرُ بْنُ عَوْنٍ وَهُوَ ثِقَةٌ لَا بَأْسَ بِهِ)) অর্থাৎ ❝আবূ হানীফা (রহ.)-এর কাছ থেকে সুফিয়ান আস-সওরী, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, হাম্মাদ ইবনে যায়িদ, হাশিম, ওয়াকী’ ইবনে জাররাহ, আব্বাদ ইবনুল আ’ওয়াম প্রমুখ সকলে (হাদীস-আছার) রেওয়ায়েত করেছেন। তিনি একজন সিকাহ (বিশ্বস্ত), তার ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই।❞ (জামে’ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাজলিহি, ইমাম ইবনে আব্দিল বার মালেকি – ২/১৪৯। আরো দেখা যেতে পারে ((اَلْجَوَاهِرُ الْمُضِيَّةُ فِىْ طَبَقَاتِ الْحَنَفِيَّةِ)) আল জাওয়াহিরুল মুদিয়্যাহ ফী তাবাক্বাতিল হানাফিয়্যাহ – ১/২৯)।
শেষকথা – আবূ হানীফা বিদ্বেষী কতিপয় উগ্র গয়ের মুকাল্লিদ ইমাম আলী ইবনুল মাদীনি (রহ.)-এর কথার বিকৃত অনুবাদ করে এবং সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়ে থাকে। তাদের বিকৃত অনুবাদ দেখে আপনি অবাক হবেন! তাদের সেই বিকৃত ও খিয়ানতপূর্ণ অনুবাদটি হুবহু নিচে তুলে ধরা হল!
ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ এর উস্তাদ ইমাম আলী ইবনুল মাদীনি রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ
❝তুমি ঐ সমস্ত ব্যক্তির উপর একদম ভরসা (বিশ্বাস) রাখবে না, যারা আবু হানিফার প্রতি মুহাব্বত রাখে কিংবা তার মাজহাবের সাথে এবং তার রায়সমূহের দিকে নজর দেয়৷ আর ঐ সমস্ত ব্যক্তির ওপর ভরসা (বিশ্বাস) রাখবে না, যারা আবু হানিফার মাজহাবের ওপর চলে এবং তাতে বাড়াবাড়ি করে। আর (ওই ব্যক্তির ওপরেও ভরসা করবে না) যে আবু হানিফাকে নিজের ইমাম হিসেবে গ্রহন করে বা গন্য করে❞।
(শারহু উসূলি ইতিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ- ১/১৮৫)।
মজার ব্যাপার হল, কিতাবটিতে ইমাম আলী ইবনুল মাদীনির কথাটির কোনো সনদ নেই। কিন্তু তথাপি ইমামে আযম বিদ্বেষী গয়ের মুকাল্লিদ ও শীয়ারা সনদ বিহীন কথাটি বিকৃত অনুবাদ সহ প্রচারের সময় ❝সনদ সহীহ❞ লিখেই প্রচার করে, হয়ত তাদের অন্ধ অনুসারীরা এর বাস্তবতা কখনো যাচাই করার-ও প্রয়োজন মনে করেনি। কিতাবটির অনলাইন ভার্সন Click in here.
1 গ্রন্থকার হাফিয ইমাম আবুল কাশিম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ আস সা’দী ❝ইবনু আবীল আ’ওয়াম❞ নামে প্রসিদ্ধ ((ابو القاسم عبدالله إبن محمد إبن أحمد إبن يحيى إبن الحارث السعدى، ابن أبى العوام))। মৃত্যু: ৩৩৫ হিজরী।
উল্লেখ্য বিশিষ্ট মুহাক্কিক শায়খ লতিফুর রহমান আল- বাহরাইজি লিখেছেন (( أصل الكتاب لابى القاسم جد ابى العباس…و ابو العباس روى عنه بواسطة ابيه أبى عبدالله محمد ابن عبدالله )) অর্থাৎ কিতাবটির মূল লিখক আবুল কাশিম হচ্ছেন আবুল আব্বাসের দাদা…এবং আবুল আব্বাস সেটি তার পিতা আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ থেকে রেওয়ায়েত করেছেন। (মানাকিবু আবী হানীফা – পৃষ্ঠা নং ৭, ভুমিকা দ্রষ্টব্য)।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘উ’কূদুল জুমান’ রচিতা ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আস সালেহী (মৃত. ৯৪২ হিজরী) বলেছেন ((كلهم حنفيون ثقات اثبات نقاد)) অর্থাৎ তারা সকলেই বিশ্বস্ত হানাফি স্কলার। (মানাকিবু আবী হানীফা – পৃষ্ঠা নং ৬, ভুমিকা দ্রষ্টব্য)।
ইমাম আব্দুল কাদির মুহাম্মদ ইবনে নাসরুল্লাহ আল কারশী (মৃত. ৬৯৬ হিজরী) লিখেন ((أَحْمد بن مُحَمَّد بن عبد الله بن مُحَمَّد بن أَحْمد بن يحيى بن الْحَارِث أَبُو الْعَبَّاس عرف بِابْن أبي الْعَوام السَّعْدِيّ يَأْتِي أَبوهُ وَعبد الله جده من بَيت الْعلمَاء الْفُضَلَاء وَأحمد هَذَا أحد قُضَاة مصر مولده بهَا سنة تسع وَأَرْبَعين وَثَلَاث مائَة روى عَن أَبِيه عَن جده روى عَنهُ أَبُو عبد الله مُحَمَّد بن سَلامَة الْقُضَاعِي)) অর্থাৎ ❝আহমদ ইবনে মুহাম্মদের পিতা এবং দাদা (মিশরীয়) শীর্ষস্থানীয় আলেমগণের বাসায় যাওয়া আসা করতেন। ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ নিজেও স্বীয় জন্মস্থান মিশরের অন্যতম একজন বিচারপতি ছিলেন। তিনি ৩৪৯ হিজরীবর্ষ থেকে নিজ পিতা এবং দাদার কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে সালামাহ আল-কুদা’ঈ।❞
হাফিয ইমাম আবুল কাশিম ইবনু আবীল আ’ওয়াম (রহ.) এর সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত জানতে পড়ুন ‘আল জাওয়াহিরুল মুদিয়্যাহ’ ১/২০৯।
2 তিনি (হাফিয ইমাম আবুল আবুল কাশিম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ) বলেন, ❝আমি এ তথ্য পেয়েছি আবূ আলী আল হাসান ইবনু হাম্মাদ ইবনে কুসাইব আল হাযরামী ((أبو علي ، الحسن بن حماد بن كسيب الحضرمي البغدادي)) এর হাদীসগ্রন্থে, আর আমি তার সূত্রে এটি বর্ণনা করছি।❞ ইমাম যাহাবী তার সম্পর্কে বলেছেন ((قلت : كان من جلة العلماء وثقاتهم في زمانه)) আমি বলি, তিনি উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন একজন আলেম ও সমসাময়িক অন্যতম একজন সিকাহ তথা বিশ্বস্ত ব্যক্তি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১১/৩৯৩)। মৃত্যু: ২৪১ হিজরী।
3 তিনি বলেন, এটি আমাকে বর্ণনা করেছেন আবূ কুতন আমর ইবনুল হাইসাম আল যুবায়দী ((أبو قطن عَمْرو بن الْهَيْثَم الزبيدِيّ))। জন্ম-মৃত্যু: ১২১-১৯৮ হিজরী। একজন সিকাহ। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন বলেন, ((إن أبا قطن اسمه عمرو بن الهيثم بن قطن بن كعب وانه ثقة)) তিনি একজন সিকাহ। (আল জারহু ওয়াত তা’দীল’ ৬/২৬৮ ইমাম ইবনে আবী হাতিম আর-রাযী)। তিনি সহীহ মুসলিম-এরও একজন রাবী। তিনি ইমাম শু’বাহ ইবনুল হাজ্জাজ থেকেও বর্ণনা করেছেন। (তাহযীবুল কামাল ফী আসমাইর রিজাল খ-৩৪ পৃ-২০২ ইমাম মিজ্জি)।
সনদের মানঃ সহীহ ও মুত্তাসিল।
প্রশ্ন, উল্লিখিত রেওয়ায়েতটির দ্বিতীয় কোনো বিশুদ্ধ মুতাবা’আত (সমর্থন) আছে কিনা?
উত্তর জ্বী হ্যাঁ, আছে। হিজরী দ্বিতীয় শতকের বিখ্যাত হাফিযুল হাদীস ও শায়খুল মুহাদ্দিসীন উপাধীতে ভূষিত ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন (রহ.) বলেন ((أَحْمَدَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ الدَّوْرَقِيُّ قَالَ سُئِلَ يَحْيَى بْنُ مَعِينٍ وَأَنَا أَسْمَعُ عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ فَقَالَ ثِقَةٌ مَا سَمِعْتُ أَحَدًا ضَعَّفَهُ هَذَا شُعْبَةُ بْنُ الْحَجَّاجِ يَكْتُبُ إِلَيْهِ أَنْ يحدث ويأمره وَشعْبَة شُعْبَة)) অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে ইবরাহীম আল-দাওরাকী বলেন, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈনকে আবূ হানীফা (রহ.) সম্পর্কে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন আমি শুনছিলাম। উত্তরে তিনি বললেন “আবূ হানীফা সিক্বাহ (বিশ্বস্ত)। কেউ তাঁকে জঈফ (দুর্বল) বলেছেন বলে আমি শুনিনি। এ তো ইমাম শু’বাহ ইবনুল হাজ্জাজ (রহ.) তাঁকে চিঠি লিখে হাদীস বর্ণনা করার আদেশ করেছেন। আর ইমাম শু’বাহ তো শু’বাই।” – সনদ সহীহ। (ইমাম ইবনু আব্দিল বার মালেকী’র ‘আল-ইনতিকা’ [الانقاء], পৃষ্ঠা নং ১২৭)।
প্রথমোক্ত বর্ণনায় ইমাম শু’বাহ (রহ.)-এর কাছ থেকে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর নিকট পত্র প্রেরণ করার যে ঘটনার উল্লেখ আছে সেটাই যেন অত্র বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে ইবরাহীম আল-দাওরাকী (রহ.) ইমাম ইবনে মা’ঈনের সূত্রে বলা হল। সুতরাং পূর্বোক্ত বর্ণনায় বিশুদ্ধতার দিক থেকে শক্তি দ্বিগুণ বৃদ্ধি হল।
তথ্য-সংগ্রাহক মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ এডমিন ফিকহ মিডিয়া
1 ইমাম আলাউদ্দীন আল-কাসানী আল হানাফী (মৃত. ৫৮৭ হিজরী) সংকলিত ❝আল বাদাউ আস সানাউ (البدائع الصنائع)❞ কিতাবুস সালাত অধ্যায় (খণ্ড ২ পৃষ্ঠা ৪৮) হতে ((وروي عن ابن عباس رضي الله عنهما أنه قال إن العشرة الذين شهد لهم رسول الله صلى الله عليه وسلم بالجنة ما كانوا يرفعون أيديهم إلا لافتتاح الصلاة وخلاف هؤلاء الصحابة قبيح. وفي المشاهير أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : لا ترفع الأيدي إلا في سبع مواطن عند افتتاح الصلاة، وفي العيدين ، والقنوت في الوتر ، وعند استلام الحجر، وعلى الصفا والمروة ، وبعرفات وبجمع وعند المقامين عند الجمرتين))
❝ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন রাসূল (সা.) যে দশ জন সম্পর্কে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন তাদের কেউই সালাতের শুরুতে ব্যতীত (সালাতের আর কোথাও) হাত উঠাতেন না। কাজেই এ সকল সাহাবীর বিপরীত আমল নিন্দনীয়। ‘আল মাশাহীর’ কিতাবে এসেছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, সাতটি জায়গায় রাফউল ইয়াদাইন অর্থাৎ হাত তুলতে হয়, যথা নামাযের শুরুতে ও দুই ঈদের সালাতে, বিতিরের দোয়ায়ে কুনূতে, হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুম্বনকালে, ছাফা মারওয়া পাহাড়ে উঠলে, আরাফার ময়দানে, মুযদালিফায় জমায়েত হলে এবং হাজরে আসওয়াদের সামনে।❞
বর্ণনাটির একজন রাবী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা (৭০-১৪৮ হিজরী)। তিনি একজন তাবেয়ী। তাঁর সম্পর্কে “জরাহ” (আপত্তি) যেমন রয়েছে, তেমনি তা’দীল-ও রয়েছে।
তাঁকে ইমামগণ “দুর্বল” বলেছেন শুধুমাত্র তাঁর বয়সঘটিত স্মৃতিভ্রমের কারণে । কেউ কেউ তাঁকে একই কারণে مضطرب الحديث বলেও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমামগণের বড় একটি অংশ তার প্রশংসাও করেছেন। যেমন ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেছেন ((حديثه فى وزن الحسن)) অর্থাৎ তাঁর হাদীস ❝হাসান হাদীসের পর্যায়ভুক্ত❞। (তাযকিরাতুল হুফফায ১:১৭১)। ইমাম ইবনু কাইয়ুম (রহ.) এবং ইমাম নুরউদ্দীন আল হাইছামী (রহ.) উভয়ই বলেছেন ((حديثه حسن ان شاء الله)) অর্থাৎ তাঁর হাদীস হাসান, ইনশাআল্লাহ (মাযমাউয যাওয়ায়েদ ৩:৩৮)। ইমাম যাহাবী (রহ.) তাঁর সম্পর্কে ‘সিয়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন ((محمد بن عبد الرحمن بن أبي ليلى . العلامة ، الإمام ، مفتي الكوفة وقاضيها أبو عبد الرحمن الأنصاري ، الكوفي)) ❝মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা একজন আল্লামা, ইমাম, কূফার একজন মুফতী এবং বিচারপতি❞ (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬:৩১১)। ইমাম যাহাবী লিখেছেন, তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন ((شعبة ، وسفيان بن عيينة ، وزائدة ، والثوري ، وقيس بن الربيع)) ইমাম শো’বাহ, সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নাহ, যায়েদাহ, সুফিয়ান আস-সওরী এবং কায়েস ইবনুর রবী’ঈ প্রমুখ। ইমাম যাহাবী আরও লিখেছেন ((وكان نظيرا للإمام أبي حنيفة في الفقه)) ❝তিনি ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর দৃষ্টান্ত ছিলেন।❞ ইমাম যাহাবী আরও লিখেছেন ((كان يحيى بن سعيد يضعف ابن أبي ليلى . قال أحمد : كان سيئ الحفظ ، مضطرب الحديث ، وكان فقهه أحب إلينا من حديثه)) ❝ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (আল ক্বাত্তান) ইবনু আবী লায়লাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম আহমদ বলেছেন, তিনি স্মৃতিশক্তিতে দুর্বল আর মুদতারিবুল হাদীস ছিলেন, তবে আমাদের নিকট তাঁর ফিকহ অত্যাধিক প্রিয়।❞
ইমাম যাহাবী লিখেছেন ((وروى أبو حاتم عن أحمد بن يونس قال : ذكر زائدة ابن أبي ليلى فقال : كان أفقه أهل الدنيا)) ইমাম আবূ হাতিম আহমদ ইবনে ইউনুস থেকে বর্ণনা করে বলেন, (ইবনু আবী লায়লার শিষ্য) যায়েদাহ বলেছেন, তিনি দুনিয়াবাসীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ ছিলেন।
ইমাম যাহাবী আরও লিখেছেন ((قال العجلي : كان فقيها صاحب سنة ، صدوقا ، جائز الحديث . وكان قارئا للقرآن ، عالما به)) অর্থাৎ ইমাম আ’জলী বলেন, তিনি ছিলেন একজন ফকীহ এবং সুন্নাহর অনুসারী ও সত্যবাদী আর হাদীসের বাহক এবং কুরআনের ক্বারী ও তৎ সম্পর্কে একজন অবিজ্ঞ।
ইমাম যাহাবী আরও লিখেছেন ((قال أبو زرعة : هو صالح ، ليس بأقوى ما يكون . وقال أبو حاتم : محله الصدق ، وكان سيئ الحفظ ، شغل بالقضاء ، فساء حفظه ، لا يتهم)) অর্থাৎ ইমাম আবূ যুর’আ বলেন, তিনি একজন সৎ, তবে তার কর্ম অত্যাধিক শক্তিশালী নয়। আবূ হাতিম বলেছেন, তাঁর অবস্থান সত্যনিষ্ঠ। তবে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেয়েছিল, তিনি বিচারকার্যে ব্যস্ত থাকতেন, তিনি মিথ্যার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত নন।
ইমাম যাহাবী আরও লিখেছেন ((قلت : لم نرهما تركاه ، بل لينا حديثه . وقد قال حفص بن غياث : من جلالة ابن أبي ليلى أنه قرأ القرآن على عشرة شيوخ)) অর্থাৎ ❝আমি মনে করি, আমরা তাঁদের দু’জনকে (ইমাম আহমদ এবং ইবনে মা’ঈনকে) তাঁকে ত্যাগ করতে দেখিনি, বরং তাঁর হাদীসের ক্ষেত্রে তারা উভয়ই নমনীয়তা অবলম্বন করেছেন। হাফস ইবনে গিয়াস বলেছেন, ইবনে আবী লায়লার অন্যতম বিশেষত্ব এই যে, তিনি দশজন শায়খের কাছ থেকে কুরআন পাঠ করেছিলেন।❞ (সিয়ার ৬:৩১৫ যাহাবী)।
ইমাম ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ানও বলেছেন ((ثقة عدل)) তিনি একজন সিকাহ ও ন্যায়পরায়ণ। ইমাম তিরমিজিও বলেছেন, তার হাদীস সহীহ। সে যাইহোক, অপরাপর শাওয়াহেদ থাকার কারণে ইবনু আবী লায়লা’র বর্ণনাটি ❝হাসান❞ হাদীসের পর্যায়ভুক্ত বলা যেতে পারে। ((ফিকহ মিডিয়া গ্রুপ থেকে – Click))
2 হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) হতে তিনি বলেন ((عَنِ الْبَرَاءِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلاَةَ رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَى قَرِيبٍ مِنْ أُذُنَيْهِ ثُمَّ لاَ يَعُودُ))
❝রাসূল (সা.) যখন নামায আরম্ভ করতেন তখন তাঁর হস্তদ্বয় কর্ণদ্বয় পর্যন্ত উত্তোলন করতেন। অতঃপর আর তা করতেন না।❞ (সুনানু আবী দাউদ, হাদীস নং ৭৫০, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং ১৬৮৯, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদীস নং ২৪৫৫)।
3 ইমামে আযম হযরত ইমাম আবূ হানীফা (৮০-১৫০ হিজরী) বলেন ((قال ابو حنيفة : حدثنا حماد عن ابراهيم عم علقمة والاسود عن عبدالله ابن مسعود أن رسول الله عليه وسلم كان لا يرفع يديه الا عند افتتاح الصلاة ولا يعود لشيئ من ذلك))
❝আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন “নিশ্চিয়ই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুধু মাত্র সালাতের শুরুতে রাফউল ইয়াদাইন (উভয় হাত উত্তোলন) করতেন। এরপর আর কখনো পুনরাবৃত্তি করতেন না।❞ – সহীহ।
(মুসনাদু আবী হানীফা বি-রেওয়ায়েতে আবূ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে হারিছ আল হারিছি, হাদীস নং ৩৭৪)।
4 হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন ((عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ « مَا لِى أَرَاكُمْ رَافِعِى أَيْدِيكُمْ كَأَنَّهَا أَذْنَابُ خَيْلٍ شُمْسٍ اسْكُنُوا فِى الصَّلاَةِ))
❝রাসূল (সা.) নামাযের সময় আমাদের নিকট আসলেন এবং বললেন তোমাদের কী হল যে, আমি তোমাদেরকে দেখতে পাচ্ছি দুষ্ট ঘোড়ার লেজের ন্যায় তোমাদের হাতগুলো উঠানামা করছে! তোমরা নামাযে শান্ত ও ধীর হও।❞ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৯৬, সুনানু আবী দাউদ, হাদীস নং ১০০২, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ১৮৭৮, মুসনাদে আবী আ’ওয়ানা, হাদীস নং ১৫৫২, মুসনাদে আবী ই’য়ালা, হাদীস নং ৭৪৮০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২০৯৯৮, মুসনাদুর রাবী, হাদীস নং ৯১২, মুসনাদে ত্বয়ালিসী, হাদীস নং ৭৮৬, তাহাবী শরীফ, হাদীস নং ২৪২৮)।
5 হযরত সালেম বিন আব্দুল্লাহ (রহ.) তাঁর পিতা (আব্দুল্লাহ ইবনে উমর) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন ((قال أخبرني سالم بن عبد الله عن أبيه قال : رأيت رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا أفتتح الصلاة رفع يديه حذو منكبيه وإذا أراد أن يركع وبعد ما يرفع رأسه من الركوع فلا يرفع ولا بين السجدتين)) ❝আমি রাসূল (সা.)-কে দেখেছি, তিনি যখন নামায শুরু করতেন তখন কাঁধ বরাবর হাত উঠাতেন। আর যখন রুকু করতে চাইতেন এবং রুকু থেকে উঠতেন, তখন হাত উঠাতেন না। দুই সেজদার মাঝেও না।❞ (মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং ৬১৪)।
6 হযরত আসওয়াদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, ((رأيت عمر بن الخطاب يرفع يديه أول تكبيرة ثم لا يعود)) তিনি বলেন ❝আমি হযরত উমর (রা.)-কে দেখেছি, তিনি শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফউল ইয়াদাইন করতেন, পরে আর কোথাও করতেন না।❞ (তাহাবী শরীফ ১:১৬৪)
বিশ্ববিখ্যাত ইমাম, ইমাম আবূ জা’ফর আত-ত্বহাবী রাহিমাহুল্লাহ (২৩৮-৩২১ হিঃ) চতুর্থ খলীফা হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রা.)-এর ‘তরকে রাফউল ইয়াদাইন’ (রাফউল ইয়াদাইনের আমল পরিত্যাগ করা) সংক্রান্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করে লিখেছেন ((فإن عليا لم يكن ليرى النبي صلى الله عليه و سلم يرفع ثم يترك هو الرفع بعده إلا وقد ثبت عنده نسخ الرفع))
❝রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাফউল ইয়াদাইন করতে দেখার পরেও তাঁর ইন্তেকালের পর আলী (রা.) রাফউল ইয়াদাইন এর আমল পরিত্যাগ করাই প্রমাণ করে যে, তাঁর নিকট এটি মানসূখ তথা রহিত হবার প্রমাণ ছিল।❞ (তহাবী শরীফ ১:১১০, বাজলুল মাজহুদ শরহে আবী দাউদ ৪:৪০৭ আরবী নোসখা))
আল্লামা যায়লা’ঈ (৭৬২-৮৫৫ হিজরী) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সহীহ বুখারী’র বিখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)ও বর্ণনাটির সকল রাবীকে সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন। ‘আল-জাওহারুন নাকী আ’লা সুনানিল বায়হাকী‘ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, হাদীসটির সনদ সহীহ মুসলিমের সনদের মতো শক্তিশালী।
7 আছেম ইবনে কুলাইব নিজ পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন, ((أنّ عليا رضي الله عنه كان يرفع يديه في أول تكبيرة من الصلاة، ثم لا يعود يرفعه)) ❝নিশ্চয়ই হযরত আলী (রা) নামাযে প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন এরপর আর কোথাও হাত উঠাতেন না।❞ (সুনানে বায়হাকী ২:৮০)। ইমাম তহাবী (রহ.) বলেন, ((هو أثر صحيح)) ❝এটি সহীহ আছার।❞
8 তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ((صليت خلف ابن عمر فلم يكن يرفع يديه إلا في التكبيرة الأولى من الصلاة)) ❝আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর পেছনে নামায পড়েছি। তিনি প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্য কোথাও রাফউল ইয়াদাইন করতেন না।❞ – হাসান।
❝ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, সালাতের শুরুতে ছাড়া তার অন্য কোনো তাকবীরে কিংবা ওঠা-নামা মুহূর্তে রাফউল ইয়াদাঈন সংক্রান্ত কোনো বিধি-বিধান (আছে বলে) আমার জানা নেই।❞- সনদ সহীহ ও মুত্তাসিল।
ফিকহে মালেকীর শক্তিশালী অভিমত কী, এ সম্পর্কে ইমাম আব্দুস সালাম বিন সাঈদ আল-তানুখী (২৪০ হিঃ/৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন (( قَالَ ابْنُ الْقَاسِمِ : وَكَانَ رَفْعُ الْيَدَيْنِ عِنْدَ مَالِكٍ ضَعِيفًا إلَّا فِي تَكْبِيرَةِ الْإِحْرَامِ)) অর্থাৎ ❝[ইমাম মালেকের খাস ছাত্র] ইবনুল কাসিম বলেন, সালাতের প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে রাফউল ইয়াদাঈন করার বিধান ইমাম মালিক (রহ.)-এর নিকট দুর্বল।❞ (প্রাগুক্ত)।
সম্পর্কিত সনদ ও গ্রন্থ পরিচিতিঃ
আল-মুদাওয়ানাতুল কুবরা (المدونة الكبرى) হল ফিকহে মালেকির উপর আইনশাস্ত্র বিষয়ক প্রশ্ন-উত্তর মূলক একটি সংকলন, যা ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ)-এর পক্ষ হতে বর্ণিত ফিকহগুলোর সংকলন ও আব্দুস সালাম বিন সাঈদ আল-তানুখী, ডাকনাম সুহনুন [عبد السلام بن سعيد التنوخي الملقب بسحنون] (২৪০ হিঃ/৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক বর্ণনাকৃত। তিনি এটি সংগ্রহ ও সংকলন করেছেন আব্দুর রহমান বিন আল-কাসিম আল-আতকি [عبد الرحمن بن القاسم العتقي] (১৯১ হিজরি / ৮০৬ খ্রিস্টাব্দ)-এর কাছ থেকে, আর তিনি ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন। এজন্য বইটি برواية سحنون বা ইমাম সুহনুন এর রেওয়ায়েতে ইমাম মালেক (রহ.)-এর সাথে সম্পর্কিত। (সূত্রঃ আল্লামা ইবনু নাজী [ابن ناجي] রচিত معالم الإيمان في تاريخ قيروان في ترجمة سحنون والتعلايف بالمدونة পৃষ্ঠা নং ১০১)।
বিশিষ্ট ফকীহ আবূ আব্দিল্লাহ আল মুশদালি আল মালেকি-محمد بن أحمد بن عمر الوانوغي أبو عبد الله محمد بن أبي القاسم بن محمد المشدالي أبو عبد الله (৮০৪-৮৬৬ হিঃ) কিতাবটির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থও রচনা করেছেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন شرح عن مدونة سحنون (শরহু আ’ন মুদাওয়ানাতি সুহনুন), পূর্ণ নাম تكملة المشدالي على تعليقة أبي مهدي الوانوغي على المدونة-তাকমিলাতুল মুশদালি আ’লা তা’লীকাতি আবী মাহদীল ওয়ানুগী আ’লাল মুদাওয়ানাহ।
10 প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নিমাভী (মৃত. ১৩২২ হিজরী) খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা বিষয়ক বর্ণনাগুলো পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে তাঁরা শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফউল ইয়াদাইন করতেন, অন্য আর কোথাও রাফউল ইয়াদাইন করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। (আসার আস সুনান-آثار السنن ১:১৫৮)।
11 ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন, ((فكان يرفع يديه أول مرة ثم لا يعود)) ❝হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর রাফউল ইয়াদাইন না করা সংক্রান্ত হাদীস ‘হাসান’ পর্যায়ে উত্তীর্ণ এবং অনেক আহলে ইলম : সাহাবা এবং তাবেয়ীন এ মতই পোষণ করতেন। ইমাম সুফিয়ান আস-সওরী (রহ.) এবং কুফাবাসী ফকীহগণের ফাতাওয়াও এটা।❞ (জামে তিরমিযী : ১:৩৫)।
12 মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ও হাদীস বিশারদ আল্লামা ইবনু আব্দিল বার আন্দালুসি আল-কুরতুবি আল-মালেকী (৩৬৮-৪৬৩ হিজরী) রাফউল ইয়াদাইন সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থান তুলে ধরে লিখেছেন ❝হযরত হাসান (রহ.) সাহাবায়ে কেরামের কর্মনীতি সম্পর্কে বলেছেন, তাদের মধ্যে যারা রাফউল ইয়াদাইন করতেন তারা রাফউল ইয়াদাইন পরিত্যাগকারীদের উপর আপত্তি করতেন না। এ থেকে বোঝা যায়, রাফউল ইয়াদাইন জরুরি কিছু নয়।❞ (আত-তামহীদ ৯:২২৬)।
খোলাসাঃ হানাফী এবং মালেকী মাযহাবের ফিকহের অনুসারীরা রাফউল ইয়াদাইনের আমলটি পরিত্যাগ করার কারণ, তাঁদের ইজতিহাদ তথা গবেষণামতে সালাতে শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমার সময় ব্যতীত অন্যান্যস্থানে রাফউল ইয়াদাইনের আমলটি মানসুখ বা “রহিত”। আর মানসুখ আমলের হাদীস যতই সহীহ হোক, তা আমলযোগ্য নয়। যেমন, নিকাহে মুত’আ, বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় ইত্যাদী। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
প্রশ্নকর্তা: হযরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে দুর্নীতির অভিযোগে প্রাদেশিক গভর্ণর হযরত আবূ হোরায়রা (রা.)-কে পদচ্যুত করা হয়েছিলেন বলে শীয়াদের অভিযোগ কি সত্য?
উত্তরদাতা: দুর্নীতির অভিযোগে নয়, বরং অন্য অভিযোগের কারণে উমর (রা.) প্রশাসনিক শৃংখলা রক্ষা এবং জনগণকে শান্ত রাখার জন্য তদন্তের পূর্বেই হযরত আবূ হোরায়রা (রা.)-কে বাহরাইনের গভর্ণরের দায়িত্ব হতে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছিলেন, যেমন সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.)-কে কূফার গভর্ণরের দায়িত্ব থেকে অনুরূপ অব্যাহতি দিয়েছিলেন (ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী ২/২৩৮, হা/৭৫৫-এর ব্যাখ্যা)। পরে তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। এজন্য হযরত উমর (রা.) পরে সে দায়িত্ব আবারো হযরত আবূ হোরায়রা (রা.)-কে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।
অভিযোগ কী ছিল?
তাবেয়ী হযরত ইবনু শিরীন (রহ.) বলেন, উমর (রা.) হযরত আবূ হোরায়রা (রা.)-কে বাহরাইনের গভর্ণর নিযুক্ত করার পর তিনি ১০ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা উপার্জন করেন। তিনি একদা ১০ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা সঙ্গে নিয়ে হযরত উমর (রা.)-এর নিকট উপস্থিত হলে হযরত উমর (রা.) তাঁকে বলেন, তুমি এত সম্পদ কোত্থেকে অর্জন করলে?
হযরত আবূ হোরায়রা (রা.) বললেন ((خيلٌ لي تناتجت، وغلةٌ رقيقٍ لي، وأُعطيةٌ تتابعت علي)) অর্থ-এসব এসেছে আমার ঘোড়ার বংশ বৃদ্ধি, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ ও আমার কাজের সীমিত প্রতিদান গ্রহণের মাধ্যমে। অত:পর হযরত উমর (রা.) তাঁকে (তদন্তের আগ পর্যন্ত) বাহরাইনের গভর্ণরের দায়িত্ব হতে সাময়িক অব্যাহতি দেন।
তদন্তে নির্দোষ প্রমাণ
❝হযরত আবূ হোরায়রা (রা.)-এর বিরুদ্ধে উক্ত অভিযোগ তদন্তের পরে তিনি হযরত আবূ হোরায়রা (রা.)-এর কথারই সত্যতার প্রমাণ পান এবং তাঁকে ন্যায়পরায়ণ হিসেবেই দেখতে পান (অর্থাৎ সন্দেহ/অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়)। তখন হযরত উমর (রা.) পুনরায় তাঁকে গভর্ণরের দায়িত্ব প্রদানের জন্য ডেকে পাঠালে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তখন উমর (রা.) বলেন, তোমার থেকে তো উত্তম ব্যক্তি দায়িত্ব পালনে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন!!! জবাবে হযরত আবূ হোরায়রা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কে? উমর (রা.) বললেন, ইউসুফ (আ.)। হযরত আবূ হোরায়রা (রা.) উত্তরে বললেন, ইউসুফ (আ.) নিজে আল্লাহর নবী এবং নবীর পুত্র ছিলেন। আর আমি উমায়মার পুত্র আবূ হোরায়রা।❞
সনদ সহ সম্পূর্ণ হাদীসটি ((মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২০৬৫৯)) এই,
أخبرنا عبد الرزاق ، عن معمر ، عن أيوب ، عن ابن سيرين ، أن عمر بن الخطاب استعمل أبا هريرة على البحرين ، فقدم بعشرة آلاف ، فقال له عمر : استأثرت بهذه الأموال يا عدو الله ، وعدو كتابه ، قال أبو هريرة : ” لست عدو الله ، ولا عدو كتابه ، ولكني عدو من عاداهما ” ، قال : فمن أين هي لك ؟ قال : ” خيل لي تناتجت ، وغلة رقيق لي ، وأعطية تتابعت علي ” فنظروه ، فوجدوه كما قال ، قال : فلما كان بعد ذلك ، دعاه عمر ليستعمله ، فأبى أن يعمل له ، فقال : أتكره العمل وقد طلب العمل من كان خيرا منك يوسف ؟ قال : ” إن يوسف نبي ابن نبي ابن نبي ، وأنا أبو هريرة ابن أميمة أخشى ثلاثا واثنين ” ، قال له عمر : أفلا قلت : خمسا ؟ قال : ” لا ، أخشى أن أقول بغير علم ، وأقضي بغير حكم ، ويضرب ظهري ، وينتزع مالي ، ويشتم عرضي
শেষকথা: হাদীসের দীর্ঘ বিবরণ হতে বুঝা যায় যে, খিয়ানতের কারণে তাঁকে অপসারণ করার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। কারণ, উমর (রা.) তাঁকে আবারো দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। বলে রাখা জরুরি যে, হযরত আবূ হোরায়রা (রা.)-এর বিরুদ্ধে সনদ বিহীন অনেক বর্ণনা রয়েছে সেগুলো দ্বারা প্রতারিত হওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে।
আলোচ্য বিষয় ২টা, এ দুটি আলোচ্য বিষয় নিয়ে আজকে মুসলমান Vs কাদিয়ানী দ্বিপক্ষীয় সংলাপ চলুক!
(বলে রাখা দরকার, কাদিয়ানীরা কখনোই উসূল বা নিয়ম মেনে বিতর্ক করবেনা, তারা এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে দৌড়ায়…আর ঈসা আলাইহিস সালামকে ❝মৃত❞ সাব্যস্ত করতে নিজেদের পুরনো কাসুন্দিতেই চলে যেতে চায়…তাই প্রথমেই মূলনীতি ঠিক করা হল এবং সে আলোকেই ডিবেট/সংলাপ…)।
মুসলমানঃ ১ মুসলমানদের জন্য মির্যা কাদিয়ানীর ❝মূল দাবী❞ কী কী? ২ মির্যা কাদিয়ানীর ❝ইমাম মাহদী❞ দাবী কোন দলীলের ভিত্তিতে ছিল?
কাদিয়ানীঃ যুগ ইমাম, মুজাদ্দিদ, মসীহে মওউদ, ইমাম মাহদী ও উম্মতিনবী ইত্যাদি।
মুসলমানঃ মির্যা কাদিয়ানীর ❝মসীহে মওউদ❞ দাবীটা মুসলমানদের জন্য ছিলনা!
কাদিয়ানীঃ তাহলে কাদের জন্য ছিল? প্রমাণ কী?
মুসলমানঃ মির্যা কাদিয়ানীর ❝মসীহে মওউদ❞ দাবীটা শুধুই খ্রিস্টানদের জন্য ছিল, যেমনভাবে আর্যদের (হিন্দুদের) জন্য সে নিজেকে ❝কৃষ্ণের অবতার❞ হওয়া দাবী করেছিল! প্রমাণ এই, মির্যা কাদিয়ানীর পুত্র ও তাদের জামাতের দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ তার পিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ❝অতএব হে হিন্দু ভাইয়েরা! এই যুগের অবতারও কোনো জাতি বিশেষের নয়। তিনি প্রতিশ্রুত মাহদী, কারণ তিনি মুসলমানদের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছেন; ‘তিনি খ্রিস্টানদের জন্য ঈসা, কারণ তিনি তাদের পথ প্রদর্শনের উপকরণ এনেছেন।’ হে হিন্দু ভাইয়েরা! তিনি নিষ্কলঙ্ক অবতারও বটে, কেননা তিনি পরম পিতা পরমেশ্বরের পক্ষ হতে আপনাদের জন্য প্রেমের উপহার এনেছেন।❞ (রেফারেন্স- তিনিই আমাদের কৃষ্ণ, মূল মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ; ভাষান্তর মোজাফফর উদ্দিন চৌধুরী, প্রকাশকাল জানুয়ারী ২০১২ ইং)।
এখানে তিনি পরিষ্কার করে লিখে গেছেন, মির্যা কাদিয়ানীর ❝ঈসা❞ দাবীটা খ্রিস্টানদের জন্য, সে মুসলমানদের জন্য শুধুই “ইমাম মাহদী”। কাজেই আপনাদের সাথে শুধুমাত্র “ইমাম মাহদী” টপিকেই মুসলমানদের বিতর্ক করা উচিত! বলাবাহুল্য যে, মির্যা কাদিয়ানীর বইতে ঈসা (আ.) সম্পর্কে লিখা আছে, ❝এতে বুঝা গেল যে, মসীহ’র (খ্রিস্টীয়) উম্মতগণের অযাচিত কর্মকাণ্ডের দরুন মসীহ’র রূহানীয়তের জন্য এটাই স্থির ছিল যে, তিনি তিনবার দুনিয়াতে নাযিল হবেন।❞ (রূহানী খাযায়েন ৫/৩৪৬)। এখন মির্যার এ সমস্ত কথার ব্যাখ্যা চেয়ে প্রশ্ন করতে পারেন শুধুমাত্র ওরাই, যাদের জন্য তিনি ঈসা (আ.) হয়ে আসার দাবী করেছেন!
কাদিয়ানীঃ…. (আর কোনো সদুত্তর নেই)।
মুসলমানঃ মুসলমানদের জন্য মির্যা কাদিয়ানীর অন্যতম একটা দাবী ছিল ❝ইমাম মাহদী❞। তাই আমার জানার ইচ্ছে, তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী দাবী করলেন কোন সোর্সের ভিত্তিতে?
কাদিয়ানীঃ হাদীসে এসেছে, ইমাম মাহদীর যুগ নিদর্শন হবে, তার সময় একই রমাযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হবে। ১৮৯৪ সালে এধরণের চন্দ্র সূর্য গ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল।
মুসলমানঃ আপনি বললেন ❝হাদীসে এসেছে❞….। অথচ আমি দেখতে পেলাম যে, চন্দ্র সূর্য গ্রহণের ঐ বর্ণনাটি ইমাম বাকেরের (আসল নাম মুহাম্মদ বিন আলী বিন হুসাইন বিন আলী) নিজেস্ব একটি বক্তব্য মাত্র, যেটির সনদে উল্লিখিত দুইজন রাবী-ই মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত। আপনি জানতে চাইলে তখন পুরোপুরি প্রমাণ আপনাকে দেয়া হবে। এখন আপনাকে আমার প্রশ্ন, তাহলে আপনি এধরণের কোনো বর্ণনাকে ❝হাদীস❞ বলতে পারেন কিভাবে? এটা তো হাদীসের সংজ্ঞার সাথে যায় না! তারপর এর সনদে দুইজন রাবী-ই মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ায় কিভাবে নিশ্চিত হতে পারলেন যে, এটি ইমাম বাকের (রহ.)-এর বক্তব্য-ও হতে পারে? অথচ এধরণের রেওয়ায়েত হাদীস বিশারদদের সর্বসম্মতিক্রমে ❝জাল❞ ও বানোয়াট।
কাদিয়ানীঃ (….আর কোনো সদুত্তর নেই, আর কোনো হাদীসও উল্লেখ করেননি)।
মুসলমানঃ হয়ত আপনি আর কোনো হাদীস উল্লেখ করার সাহস পাচ্ছেন না। আর তা না পারারও কথা। কেননা, মির্যা কাদিয়ানী স্বভাবতই ছিল নিকৃষ্ট একজন মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। এর বহু প্রমাণ দেয়া যাবে। আমি এখানে মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলী থেকে প্রধান প্রধান কয়েকটি উদ্ধৃতি কোড করছি। মির্যা কাদিয়ানীর বইতে লিখা আছে, ❝মাহদী ও প্রতিশ্রুত মসীহ সম্বন্ধে আমার ও আমার জামাতের বিশ্বাস এই যে, মাহদীর আগমন সংক্রান্ত এ ধরণের হাদীসসমূহ কোনো মতেই আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার মতে এই গুলোর উপর তিন ধরণের আপত্তি আছে।❞ (হাকীকাতুল মাহদী [বাংলা] পৃষ্ঠা নং ০৭; অনুবাদক সালেহ আহমদ, মুরব্বী সিলসিলাহ্ আলীয়া আহমদীয়া। প্রকাশকাল, অক্টোবর ২০০১ ইং)। তার অন্য আরেক বইতে লিখা আছে, ❝অন্যদিকে মাহদীর হাদীসসমূহের এই অবস্থা যে, ইহাদের কোনোটিই ক্রুটিমুক্ত নহে। কোনোটিকেই সহী হাদীস বলা যায় না। অতএব যেভাবে ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশিত হইয়াছে এবং যাহা কিছু প্রতিশ্রুত মীমাংসাকারী ফয়সালা করিয়াছেন উহাই সঠিক।❞ (হাকীকাতুল ওহী পৃ-১৭৩ বাংলা)। এখন আমার জিজ্ঞাসা, এমতাবস্থায় মির্যা কাদিয়ানীর ❝ইমাম মাহদী❞ দাবী (Claim) করার অথোরিটি কোথায়?
কাদিয়ানীঃ (এর-ও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি, শুধু এলোমেলো কিছু প্রসঙ্গ টেনে আনার চেষ্টা করা হল)।
(জনৈক কাদিয়ানী মু’আল্লিমের সাথে আমার অনলাইন ডিবেট এর চম্বুকাংশ তুলে ধরলাম)।
ইমাম ❝মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ শায়বানী❞ (রহ.) (জন্ম-মৃত্যু ১৩২-১৮৯ হিঃ) সম্পর্কে “কাজ্জাব” তথা মহা মিথ্যাবাদী হবার অভিযোগ কতটুকু বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত? তিন (৩)টি রেওয়ায়েত উল্লেখপূর্বক তাহকিকি উত্তর,
❝খতীবে বাগদাদী (ক)❞
((أخبرنا محمد بن أحمد بن رزق قال نا أحمد بن علي بن عمر بن حبيش الرازي قال سمعت محمد بن أحمد بن عصام يقول سمعت محمد بن سعد بن محمد بن الحسن بن عطية العوفي يقول سمعت يحيى بن معين – وسألته عن محمد بن الحسن فقال: كذاب))
অর্থাৎ… মুহাম্মদ ইবনে সা’দ ইবনে হাসান বলেন, আমি ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈনকে বলতে শুনেছি, তাকে মুহাম্মদ ইবনে হাসান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সে কাজ্জাব। (তারীখে বাগদাদ ২/৫৭০)।
খণ্ডনমূলক উত্তরঃ এ বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা সনদে উল্লিখিত ❝মুহাম্মদ ইবনে সা’দ ইবনে হাসান ইবনে আ’তিয়া আল আ’ওফি❞ খুবই দুর্বল এবং মুনকার। কাজেই একজন বরেণ্য ও সুপ্রসিদ্ধ মুজতাহিদ ও ফকিহ ইমামের বিরুদ্ধে এধরণের দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য মানুষের সাক্ষী প্রত্যাখ্যাত।
1 ইমাম যাহাবী (রহ.) এর কিতাব ❝সিয়ারু আলামিন নুবালা❞ (৫/৩২৬) এর মধ্যে তার সম্পর্কে লিখা আছে, সে একজন দুর্বল এবং সে ছিল একজন শীয়া।
2 ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন বলেছেন ((كان ضعيفًا في القضاء. ضعيفًا في الحديث)) সে হাদীস এবং বিচার ব্যবস্থা উভয় ক্ষেত্রে দুর্বল।
3 ইমাম ইবনু সা’দ ‘আত তবক্বাত’ (الطبقات) কিতাবে লিখেছেন ((وقد سمع سماعًا كثيرًا، وكان ضعيفًا في الحديث)) সে অনেক শুনা কথা ধরে আর সে ছিল হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল।
4 ইমাম নাসাঈ এবং আবূ হাতিম উভয়ই তাকে দুর্বল বলেছেন।
5 ইবনে হিব্বান তাকে “আল মাজরূহীন” কিতাবে (منكر الحديث) “মুনকারুল হাদীস” আখ্যা দিয়েছেন। আর বলেছেন, ((ولا يجوز الاحتجاج بخبره)) তার বর্ণনাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা নাজায়েজ। আর সে ২০১ হিজরীতে মারা যায়। (লিসানুল মীযান ২/২৭৮ দ্রষ্টব্য)।
উল্লেখ্য ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ইমাম আবূ হানীফার শিষ্য ও উপদেষ্টা ছিলেন। ইমাম আবূ ইউসুফের পরে তিনিই ছিলেন একজন যোগ্য শিষ্য। শিক্ষকের কাজ ও মতামতগুলো লিপিবদ্ধ ও সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। হানাফী ফকীহদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম পর্যায়ের মুজতাহিদ ইমাম। তিনি ইমাম মুহাম্মদ হিসাবে পরিচিত। তাঁর অনেক রচনা আইনশাস্ত্র ও আইনশাস্ত্রের ভিত্তির উপর রচিত। ইমাম ইবনে মা’ঈন কিংবা আবূ ইউসুফের নাম ভেঙে আজকে যারা কতেক শাজ ও মুনকার রেওয়ায়েত দ্বারা প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে, আজ থেকে অনেক আগেই ইমাম যাহিদ আল-কাউসারী (রহ.) দুই-দুইটি কিতাব ((تانیب الخطیب এবং بلوغ الامانی)) রচনা করে সেগুলোর দাঁতভাঙা উত্তর দিয়ে গেছেন।
ইমাম যাহাবী লিখেছেন, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ শায়বানী (রহ.) ইমাম শাফেয়ীর প্রিয় শায়খ ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী ষাট দিনার ব্যয় করে ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর কিতাবপত্র সংগ্রহ করেন ((أنفقت على كتب محمد ابن الحسن ستين دينارا)) এবং সেখান থেকে ইলম অর্জন করা সহ তিনি দীর্ঘ সময়ব্যাপী ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর সোহবতে থেকে ফিকহশাস্ত্র আত্মস্থ করেন। ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, ((و قد كتبت عنه حمل بختى)) অর্থাৎ ❝আমি তাঁর কাছ থেকে এক উট-বোঝাই পরিমাণ লিপিবদ্ধ করেছি।❞ (মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহি পৃষ্ঠা ৮১, ইমাম যাহাবী)। ইমাম আহমদও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) থেকে ফিকহের জটিল মাসয়ালাগুলো রপ্ত করার প্রয়াস পান। এ সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (রহ.) ❝সিয়ার❞ গ্রন্থে (৯/১৩৬) লিখেছেন ((قال إبراهيم الحربي: قلت للإمام أحمد: من أين لك هذه المسائل الدقاق؟قال: من كتب محمد بن الحسن)) ইবরাহীম আল হারবী বলেছেন, ❝আমি ইমাম আহমদকে জিজ্ঞেস করলাম, এ সূক্ষ্মতর মাসয়ালাগুলো আপনার নিকট কোত্থেকে এলো? তিনি উত্তরে বললেন, মুহাম্মদ ইবনে হাসানের কিতাবসমূহ থেকে।❞ এখন প্রশ্ন হল, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমদ কিজন্য ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রহ.)-এর কিতাব থেকে ইলম নিবেন যদি না তিনি সত্যবাদী হন?
ইমাম ইবনু নাদীম (রহ.) ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর মোট ২৭টি রচনা থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে আল-মাবসূত (المبسوط), আল জামেউস সগীর (الجامع الصغير), তিনি কিতাবটি ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছিলেন। আল জামেউল কাবীর (الجامع الكبير), আস-সিয়ারুল কাবীর (السيرالکبیر), আস-সিয়ারুস সগীর (السيرالصغیر), যিয়াদাত (الزیادات), উল্লিখিত ৬টি কিতাবকে ❝জাহিরুর রিওয়ায়াত❞ বলে। এগুলো হানাফী ফিকহের বুনিয়াদি রচনা। এছাড়াও তিনি রচনা করেন মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ (مؤطا امام محمد); এখানে রেওয়ায়েতগুলো তিনি ইমাম মালেক থেকে একত্রিত করেছেন, কিতাবুল আসার (كتاب الأثار); এখানে রেওয়ায়েত গুলো তিনি ইমামে আ’যম থেকে একত্রিত করেছেন, যিয়াদাতুয যিয়াদাত (زیادات الزیادات), আমালি (الامالى), আল-আসল (الأصل), আল-মাখারিজ ফিল হাইল (المخارج فی الحيل), আল-হুজ্জাহ আ’লা আহলিল মাদীনা (الحجة على اهل المدينة), কিতাবুল কাসবি (کتاب الکسب) অনুবাদগ্রন্থ, ইত্যাদি অন্যতম।
❝খতীবে বাগদাদী (খ)❞
((قرأت على الحسن بن أبي بكر، عن أحمد بن كامل القاضي قال أخبرني أحمد بن القاسم، عن بشر بن الوليد قال قال أبو يوسف قولوا لهذا الكذاب – يعنى محمد بن الحسن – هذا الذي يرويه عني سمعه مني؟))
অর্থাৎ… বিশর ইবনে ওয়ালিদ বলেছেন, আবূ ইউসুফ (রহ.) বলেছেন “তোমরা এ কাজ্জাবটিকে অর্থাৎ মুহাম্মদ বিন হাসানকে জিজ্ঞাসা করো যে, সে আমার কাছ থেকে যা বর্ণনা করছে তা কি সে আমার কাছ থেকে শুনেছে? (তারীখে বাগদাদ ২/৫৭১)।
খণ্ডনমূলক উত্তরঃ বর্ণনাটির সনদে উল্লিখিত ❝বিশর ইবনে ওয়ালিদ ((بشر بن الوليد الكندي))❞ এর জন্ম ১৫০ হিজরীতে, আর মৃত্যু ২৩৮ হিজরীতে। (সিয়ার ১০/৬৭৬ ইমাম যাহাবী)। তার সম্পর্কে জারহ এবং তা’দীল (সমালোচনা এবং প্রশংসা) উভয়ই রয়েছে। কিন্তু মোটের উপর চিন্তা করলে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, রাবী বিশর ইবনে ওয়ালিদের বর্ণনাটিও প্রমাণযোগ্য নয়। কেননা মুহাদ্দিসগণের কেউ কেউ তার বিরুদ্ধেও ❝অনির্ভরযোগ্যতা❞ এর অভিযোগ তুলেছেন, তাকে কল্পিতমনা ও রাফেজী বলেছেন, মুহাদ্দিসগণ তাকে পরিত্যাগ করার কথাও রয়েছে।
প্রোপাগাণ্ডাকারীদের হয়ত জানা নেই যে, ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-এর কাছ থেকেও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর ব্যাপারে অনেক প্রশংসা রয়েছে। ইমাম যাহাবী (রহ.) ❝ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর মানাকিব❞ উল্লেখ করে লিখেছেন, সিরিয়ার “রাক্কা” নগরীতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) তৎকালীন খলীফা হারুনুর রশীদকে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রহ.)-এর ব্যাপারে প্রস্তাব দেন আর তখন তিনি ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। (অন্যখানে বিস্তারিত লিখব, ইনশাআল্লাহ)।
জারহ ও তা’দীলঃ 1 ইমাম সালেহ বিন মুহাম্মদ বলেন, ❝বিশর ইবনে ওয়ালিদ❞ সত্যবাদী, যদিও একজন আহলুর রায়। আরেকবার বলেন, তিনি সত্যবাদী কিন্তু তিনি মনে রাখতে পারেন না যে তিনি কী বলছেন, তিনি ছিলেন বয়োবৃদ্ধ ((صالح بن محمد جزرة : صدوق إلا أنه من أصحاب الرأي، ومرة: صدوق ولكنه لا يعقل ما يحدث به كان قد خرف))।
2 আবূবকর আল বুরক্বানী বলেন, সে বিশুদ্ধতার শর্তে উত্তীর্ণ নন ((أبو بكر البرقاني : ليس هو من شرط الصحيح))।
3 ইমাম দারে কুতনি (রহ.) তাকে সিকাহ বলেছেন ((الدارقطنى ثقة))।
4 ইমাম আবূ দাউদ আস সিজিস্তানী বলেন, সে সিকাহ তথা বিশ্বস্ত ছিল না ((أبو داود السجستاني : لم يكن ثقة))।
5 ইমাম ওবায়দুল্লাহ ইবনে সাঈদ আস সারাখছি বলেন, সে ছিল কল্পিতমনা ব্যক্তি, যুক্তিবাদী এবং রাফেজী মতাদর্শের। ((عبيد الله بن سعيد السرخسي : من أهل الأهواء من أهل الرأي والرافضة))।
6 মুহাম্মদ ইবনে সা’দ কাতিব আল ওয়াক্বিদী বলেন, যখন সে বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয় এবং কুরআন সৃষ্ট কি অসৃষ্ট-এ বিষয়ে মন্তব্য করলে তখন হাদীস বিশারদগণ তাকে পাকড়াও করেন এবং পরিত্যাগ করেন। ((محمد بن سعد كاتب الواقدي : لما كبرت سنة وتكلم بالوقف أمسك أصحاب الحديث عنه وتركوه))।
রেফারেন্স – তাকরীবুত তাহযীব, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী।
((محمد بن الحسن صاحب أبي حنيفة كوفي حدثنا أحمد بن محمد بن صدقة قال: سمعت العباس بن محمد البصري، يقول سمعت يحيى بن معين، يقول: محمد جهمي كذا.))
অর্থাৎ…আব্বাস ইবনে মুহাম্মদ আল বছরী বলেন, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন (রহ.) বলেছেন, মুহাম্মদ একজন জাহমী এবং কাজ্জাব। (আদ্ব-দু’আফাউল কাবীর, ক্রমিক নং ১৬০৬)।
খণ্ডনমূলক উত্তরঃ 1 প্রোপাগাণ্ডাকারীরা ইবনে মা’ঈন (রহ.) এর নাম ভেঙে এ ধরণের জরাহ/সমালোচনা যখন প্রচার করে এবং ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর ন্যায়পরায়ণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তখন তারা ভুলে যায় যে, ইমাম ইবনে মা’ঈন (রহ.) নিজেও ছিলেন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রহ.)-এর শিষ্য বা ছাত্র (দেখুন, মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহি পৃষ্ঠা ৮০, ইমাম যাহাবী)। এমনকি ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন (রহ.) স্বীয় উস্তাদ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসানের রচিত ❝আল জামেউস সগীর❞ কিতাবটি সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ করেন। এ সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (রহ.) লিখেছেন, ((عباس ابن محمد سمعت ابن معين يقول كتبت عن محمد ابن الحسن الجامع الصغير)) অর্থাৎ আব্বাস ইবনে মুহাম্মদ বলেন, আমি ইবনে মা’ঈন থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি মুহাম্মদ ইবনে হাসান থেকে “আল জামেউস সগীর” কিতাবটি লিপিবদ্ধ করেছি। (মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহি পৃষ্ঠা ৮১)। এর প্রমাণ বিশুদ্ধ সনদ সহ দেখুন ❝তারীখে বাগদাদ❞ খণ্ড ২ পৃষ্ঠা নং ১৭২। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন (রহ.) থেকে পরিষ্কার বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন ❝আমাদের সাথী (হাদীসবিশারদ)গণ আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের ক্ষেত্রে বেশি বাড়াবাড়ী করেছেন।❞ (ইবনুল বার মালেকী রচিত ‘জামেউ বয়ানিল ইলম ওয়া ফাজলিহি-২৬০১, সহীহ)।
কাজেই, প্রশ্ন দাঁড়ালো, এমতাবস্থায় আমরা ❝আব্বাস ইবনে মুহাম্মদ আল বছরী❞র বর্ণনার উপর কিভাবে আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারি? আমরা কিভাবে মনে করতে পারি যে, এমন একজন ইমাম সম্পর্কে ইমাম ইবনে মা’ঈন (রহ.) ❝কাজ্জাব❞ এবং ❝জাহমী❞ মন্তব্য করতে পারেন যিনি তাঁরই উস্তাদ ছিলেন এবং উস্তাদের রচিত কিতাব থেকে ইলম অর্জন করেছিলেন!?
সব চেয়ে বড় কথা হল, যে রাবী (বর্ণনাকারী) এধরণের জরাহ (সমালোচনা) ইবনে মা’ঈন (রহ.) থেকে পেশ করেছেন তিনি তার علة তথা ❝জরাহ’র কারণ❞ পেশ করেননি। অথচ উসূলে হাদীসশাস্ত্রের মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, হাদীসের মতন সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে ((صحة سنده وانتفاء علته وعدم شذوذه ونكارته وأن لا يكون روايه قد خالف الثقات أو شذ عنهم)) হাদীসের সূত্রের বিশুদ্ধতা, ইল্লাত-علة (জারহ’র কারণ) অনুপস্থিত না থাকা, শাজ (দুর্লভ বর্ণনা) না হওয়া, মুনকার না হওয়া এবং এমন কোনো রাবী না হওয়া যিনি অনেক সিকাহ রাবীর বিপরীতে বর্ণনাকারী কিংবা সিকাহ (বিশ্বস্ত) রাবীগণের সূত্রে শাজ বর্ণনাকারী। (আল ফুরূসিয়্যাতুল মুহাম্মদীয়্যাহ ১/১৮৬, ইমাম ইবনুল কাইয়ুম)।
2 ধারণা করা যাচ্ছে যে, উকায়লীর বর্ণনায় উল্লিখিত ❝আব্বাস ইবনে মুহাম্মদ আল বছরী❞র কথাটি ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর খাস শিষ্য ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) সম্পর্কে ছিলনা, বরং অন্য কারো সম্পর্কে ছিল। আল্লাহু আ’লাম।
শেষকথাঃ অপরাপর প্রায় সকল ইমামের মতই ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রহ.)-এর বিরুদ্ধেও যেমন সমালোচনা রয়েছে, তেমনি অনেক প্রশংসাও রয়েছে। আর যে সব সমালোচনা পাওয়া যায় সেগুলো প্রধান প্রধান মুহাদ্দিসগণ গুরুত্ব দেননি। কেননা যে সব ইমাম ন্যায়পরায়ণতা আর বিশ্বস্ততার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন তাদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন কারো কোনো জরাহ/সমালোচনা কখনো প্রভাব ফেলবেনা। এটাই উসূলে হাদীসবিদগণের স্বীকৃত মূলনীতি। নতুবা ইমাম বুখারী (রহ.)-এর বিরুদ্ধেও মারাত্মক যেসব জরাহ বর্ণিত আছে সেগুলোর কোনো উত্তর থাকেনা। আর তাই ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর বিরুদ্ধে কোনো ইমাম থেকে “কাজ্জাব” শব্দে জরাহ সাব্যস্ত হলেও কোনো প্রভাব ফেলবেনা। অধিকন্তু উপরের বর্ণনাগুলোর একটিও সূত্রের বিচারে সহীহ নয়। কাজেই এ সমস্ত সমালোচনা/আপত্তি আমাদের নিকট দু’ পয়সার মূল্যও নেই।
সহীহ বুখারী সহ অসংখ্য জায়গায় রাফউল ইয়াদাইন সংক্রান্ত হাদীসগুলো ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, কিন্তু ইবনে উমর (রা.) নিজেই পরবর্তীতে সেই আমল পরিত্যাগ করেছেন। ইবনে উমর (রা.)-এর দুজন শিষ্য মুজাহিদ এবং আব্দুল আজীজ ইবনে হাকিমের সাক্ষ্য মতে এ কথা প্রমাণিত।
ইতিপূর্বে ইবনে উমর (রা.) এর শিষ্য মুজাহিদ (রহ.)-এর সূত্রে এর একটি টনটনে বিশুদ্ধ বর্ণনা পড়ে এসেছেন। অত্র লিখার সংশ্লিষ্ট ও সংযুক্ত স্ক্যানকপি (ক্রমিক 1) থেকেও পুনরায় দেখে নিতে পারেন। আজকে মুজাহিদ (রহ.)-এর উক্ত বর্ণনার অন্যতম শাহেদ (সমর্থক) হিসেবে অপরাপর শিষ্য আব্দুল আজীজ ইবনে হাকিমের আরেকটা রেওয়ায়েত সনদ ও সনদের তাহকিক সহ তুলে ধরছি। হাদীসটি ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ শায়বানী (রহ.)-এর সংকলন ❝মুয়াত্তা মুহাম্মদ❞ ((مؤطا محمد)) হাদীস নং ১০৮ থেকে উৎকলিত, ((সনদ)) ((أخبرنا: محمد بن أبان بن صالح عن عبد العزيز بن حكيم قال: رأيت ابن عمر يرفع يديه حذاء أذنيه فى أول تكبيرة افتتاح الصلاة، ولم يرفعهما فيما سوى ذلك))
অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, আমাকে মুহাম্মদ ইবনে আবান ইবনে সালেহ বর্ণনা করেছেন, তিনি আব্দুল আজীজ ইবনে হাকিমের কাছ থেকে আর তিনি বলেছেন আমি হযরত ইবনে উমর (রা.)-কে দেখেছি যে, তিনি সালাতের শুরুতে প্রথম তাকবীরে নিজ দু’ কানের লতি পর্যন্ত দুই হাত উঠিয়েছেন, তিনি এ ছাড়া আর কোথাও দুই হাত উঠাননি। (শাওয়াহেদ থাকার কারণে এর মান : হাসান)।
রাবীঃ
1 ❝মুহাম্মদ ইবনে আবান ইবনে সালেহ❞ সম্পর্কে আল্লামা জফর আহমদ উসমানী (রহ.) তাঁর এ’লাউস সুনান’ কিতাবে লিখেছেন ((ٱن كان ضعيفا لكنه ليس ممن يكذب، و حديثه يكتب فيعتضد به حديث مجاهد)) ❝তাকে (শুধুমাত্র ‘মুরজিয়া‘ মতাবলম্বী আখ্যা দেয়ার নিমিত্ত) দুর্বল বলা হলেও কিন্তু সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না আর তার হাদীস লিপিবদ্ধ রাখার উপযোগী ছিল আর মুজাহিদের বর্ণিত হাদীস তার হাদীসটিকে সমর্থন করে।❞ (এ’লাউস সুনান পৃষ্ঠা নং ৭৪)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি
2 উক্ত বর্ণনার মূল রাবী ❝আব্দুল আজীজ ইবনে হাকিম (عبد العزيز بن حكيم)❞ একজন সিকাহ এবং তাবেয়ী। ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) তাঁকে সিকাহ তাবেয়ীগণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ((عبد العزيز بن حكيم الحضرمي كنيته أبو يحيى يروي عن ابن عمر عداده في أهل الكوفة روى عنه الثوري وإسرائيل مات بعد سنة … هـ وهو الذي يقال له ابن أبي حكيم . انتهى . وفي ” ميزان الاعتدال ” قال ابن معين : ثقة وقال أبو حاتم : ليس بالقوي))।
অর্থাৎ আব্দুল আজীজ ইবনে হাকিম আল হাযরামী, যার উপনাম আবূ ইয়াহইয়া। তিনি ইবনে উমর থেকে বর্ণনা করেছেন আর তাকে কূফাবাসীর মধ্যে গণ্য করা হয়। তার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন ইমাম আস-সাওরী, ইসরাইল প্রমুখ। তিনি ১৩০ হিজরীর পর ইন্তেকাল করেছেন। তাকে ইবনু আবী হাকীমও বলা হয়। ‘মীযানুল ই’তিদাল’ গ্রন্থে এসেছে, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন বলেছেন, সে একজন সিকাহ বা বিশ্বস্থ [ইমাম আবূদাউদ-ও বলেছেন, সে একজন সিকাহ] আর ইমাম আবূ হাতিম বলেছেন, সে শক্তিশালী নয়। (কিতাবুস সিকাত-كتاب الثقات ১/১২৫ ইবনে হিব্বান)।
❝প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল গুলো আপনার জন্য❞
সালাতে রাফউল ইয়াদাইন সংক্রান্ত হাদীস কতগুলো? Click