Home Blog Page 14

ইমামের পেছনে সূরা ফাতেহা পড়া ও বিতর্ক সমাধান

প্রশ্ন : ইমামের পেছনে ফাতেহা না পড়লে সালাত হবে না—কথাটি কি ঠিক?

উত্তর : ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতেহা না পড়লে সালাত হবে না—কথাটা একদম ঠিক না। ছোট্ট একটা উপমা দিলে বুঝতে সহজ হবে। মনে করুন, আপনি অজু করে মসজিদে ঢুকেই দেখলেন যে ইমাম সাহেব রুকুতে চলে গেছেন। আপনিও ইমামের সাথে রুকুতে শামিল হয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় ইমাম সাহেব যখন সালাত শেষ করবেন তখন কি আপনি প্রথম রাকাত পাননি মনে করে দাঁড়িয়ে যান? নিশ্চয়ই না। এখন যদি বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার আলখেল্লা পরা কথিত অমুক-তমুকের কথা আমরা সঠিক মেনেও নিই তখন স্রেফ রুকু পাওয়া মুসল্লির সালাতের কী হবে? কারণ সে তো প্রথম রাকাত না পাওয়ার কারণে ফাতেহাও পড়তে পারেনি!

সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, সূরা ফাতেহা ছাড়া সালাত হবেনা—কথাটি সবক্ষেত্রে নয়, বরং শুধুমাত্র একাকী সালাত আদায়কারী ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একথা কোনো মোল্লামুন্সীর নয়, বরং একথা একদম টনটনে সহীহ হাদীস থেকেই নেয়া। দেখুন (হাদীস)

إذا صلى احدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الامام

অর্থাৎ তোমাদের মধ্য থেকে যখন কেউ ইমামের পেছনে সালাত পড়বে তার জন্য ইমামের ক্বেরাতই যথেষ্ট। (আল মুয়াত্তা-এর শরাহ ‘আত-তামহীদ‘ ১২/৩৭, ইমাম ইবনে আব্দিল বার আল মালেকী, হাদীস সহীহ)! স্ক্রিনশট :

এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, টিভি মিডিয়ার কতিপয় আলখেল্লা পরা অমুক-তমুক সাহেবদের উপস্থাপনায় পদস্খলনটা কোথায়? আপনি তাদেরকে একটা কথা সচরাচর বলতে শুনবেন যে, সুরা ফাতেহা হলো সালাতের রুকুন। রাসুল (সা.) হাদীসে বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা ফাতেহা পড়ল না তার সালাত হবে না। সুতরাং ঈমামের পেছনে হোক আর একা হোক সূরা ফাতেহা আপনাকে পড়তেই হবে। এটিই সঠিক বক্তব্য। যা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এটা নিয়ে আলেমদের যত কথাই থাকুক না কেন রাসুল (সা.)-এর বক্তব্যটাই অবশ্যই আগে। তিনি স্পস্ট করে দিয়েছেন বিষয়টি। তাই সুরা ফাতেহা পড়াটা বাধ্যতামূলক। (বক্তব্য শেষ হল)।

আমি প্রতিউত্তরে বলি, ঠিক আছে; আপনার কথা মত, আলেমদের কথাই বাদ দিলাম। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে “তোমরা যখন ক্বেরাত শুনবে তখন ধ্যান লাগিয়ে তোমরা তা চুপ থেকে শ্রবণ করবে”।তাফসীরে ইবনে কাসীরে আয়াতটি সম্পর্কে পরিষ্কার লিখা আছে,

وقال علي بن أبي طلحة ، عن ابن عباس قوله : ( وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا ) يعني : في الصلاة المفروضة.

অর্থাৎ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا আয়াতটি ফরজ সালাত সমূহে ক্বেরাত পাঠ (মুহূর্তে চুপচাপ থেকে শ্রবণ করা) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে (ইবনে কাসীর, সূরা আ’রাফ আয়াত নং ২০৪)। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এবং ইবনে তাইমিয়া (রহ.) দুইজনও বলেছেন যে, এই আয়াত নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। (মুগনী, ইবনে কুদামাহ ১/৬০৫; ফতুয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া ২/৪১২)। উল্লেখ্য, ১৫ খণ্ডে রচিত আল মুগনী (المغنى لابن القدامة) কিতাবের রচয়িতা আল্লামা ইবনে কুদামাহ আল-মাকদীসী মুয়াফফাক আল দ্বীন আবু মুহাম্মদ-আবদুল্লাহ বিন আহমদ বিন মুহাম্মদ (জন্ম-মৃত্যু : ১১৭৪-১২২৩ খ্রিস্টাব্দ) যাকে প্রায়শই ইবনে কুদামাহ বা সংক্ষেপে ইবনে কুদামা নামে অভিহিত করা হয়, ছিলেন একজন আহলে সুন্নাহ’র স্কলার ও ফকীহ আলেম। জন্ম ফিলিস্তিনে। হাম্বালী মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ রচনাসহ ফিকহ ও ধর্মীয় মতবাদের উপর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। যাইহোক, এবার কি কুরআনের উপরও আমল বাদ দিতে সাধারণদের নসিহত করবেন?

  • সূরা আ’রাফ আগে নাযিল হয় নাকি নামাযের ফরজিয়ত সংক্রান্ত হুকুম আগে নাযিল হয়?

এবার একটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর দেব, এ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার জন্য একটু ইতিহাসে ফিরে যাওয়া যাক। হযরত খাদিজা (রা.) মারা যান ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই রমাযান। আবু তালিব মারা যান ৬২০ খ্রিস্টাব্দের ৭ ই রামাযান। সূরা আ’রাফ নাযিল হয় মক্কায় সূরা আন’আমের পরে অথবা সমসাময়িক একই বছর। আর একথা পরিষ্কার যে, সূরা আন’আম যে বছর নাযিল হয় সে বছরটি ছিল হিজরতে খুব সন্নিকটবর্তী এবং সে সময় হযরত খাদিজা এবং আবু তালিব তাদের কেউই জীবিত ছিলেন না। আর রাসূল (সা.)-এর মেরাজের মধ্য দিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের ফরজিয়ত সংক্রান্ত হুকুম নাযিল হয়েছিল আবু তালিবের মৃত্যুর পূর্বে ৬২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে রজব। এখন এই ইতিহাস যদি ভুল না হয় তাহলে প্রমাণিত হবে যে, সূরা আ’রাফ নাযিল হবার অনেক আগেই মেরাজ সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের ফরজিয়ত উম্মাহার উপর বিধিবদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং একথা দাবী করা সঠিক হবেনা যে, সূরা আ’রাফ বা সূরাটির ২০৪ নং আয়াত নাযিলের আগে নামায ফরজ ছিলনা। অধিকন্তু ইবনে আব্বাস (রা.) থেকেও পরিষ্কার বর্ণিত আছে যে, সূরা আ’রাফের ২০৪ নং আয়াত জুমার সালাত অনুষ্ঠিতকালে মক্কায় নাযিল হয়।

আসুন, এবার টিভি মিডিয়ার ঐ আলখেল্লা পরা অমুক ইবনে তমুক সাহেবদের চরম ইলমি দৈন্যতার কারণ জেনে নিই। এরা যদিও নিজেদের কথিত সালাফি বলে দাবী করে (অথচ চার মাযহাবের মুকাল্লিদগণই প্রকৃত সালাফী দাবী করার হকদার-লিখক) কিন্তু আসলে এরা সালাফীদের পথ থেকেও ষোল আনা বিচ্যুত। কারণ জানলে আকাশটা আপনার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা হবে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর একটা বক্তব্য পেশ করে চলমান টপিকে আলোচনার ইতি টানছি। তিনি বলেছেন,

ما سمعنا أحداً من أهل الإسلام يقول: إن الإمام إذا جهر بالقراءة لا تجزئ صلاة من خلفه إذا لم يقرأ

অর্থ-“আমরা কোনো আহলে ইসলামকে (বিশেষজ্ঞকে) এটা বলতে শুনিনি যে, যখন ইমাম উচ্চঃস্বরে ক্বেরাত পাঠ করেন এবং মুক্তাদী তার পেছনে ক্বেরাত পাঠ না করেন তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে।” (আল মুগনী, ইবনে কুদামাহ ১/৬০)। আল্লামা জফর আহমাদ উসমানী (রহ.) রচিত ইলাউস সুনান (৪/১২৮) কিতাব থেকে স্ক্রিনশট-

এবার সহজেই প্রশ্ন আসবে যে, আজকের দিনে যেসব আলখেল্লা পরা কথিত অমুক ইবনে তমুকরা ইমামের পেছনে সূরা ফাতেহা না পড়লে সালাত বাতিল বলে ফতুয়া কপচে বেড়াচ্ছেন তাদের ইলম, তাকওয়া আর যোগ্যতা কি ইসলামের প্রথম তিন-চার শতাব্দীর বরেণ্য আয়েম্মায়ে কেরাম থেকেও বেশি হয়ে গেল? অপ্রিয় হলেও সত্য, ডিজিটাল ক্যামরার সামনে আর স্যোসাল মিডিয়ায় একাকী পাণ্ডিত্য জাহির করা খুব সহজ হলেও টেবিল টকশো অত সহজ না। যেজন্য ঐ সমস্ত অমুক ইবনে তমুকদের কখনোই টেবিল টকশোতে দেখা মেলেনা, আর যাদেরই ভুলক্রমে একবার টেবিল টকশোতে দেখা মেলে তাদেরকে একপর্যায়ে বলতে শুনা যায় : আমরা কি আর এত প্রস্তুতি নিয়ে আইছি! এই নির্বোধরা কি তাহলে পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়াই ফতুয়া কপচাইত? রঙ্গিন দুনিয়ার এই সমস্ত শায়খরা তারপর থেকে দ্বিতীয়বার টেবিল টকশোর নামও আর মুখে নেন না! কিন্তু রঙ্গিন দুনিয়ার এই সমস্ত ডিজিটাল শায়খদের ইলমি দৌড় যে কতটা লজ্জাজনক তা আমাদের জেনারেল শিক্ষিতদের বুঝানোর সাধ্য কার? আমাদের অজপাড়া গাঁয়ের নান্নুমিয়া আর চক্ষুমিয়াদের কথা আর না হয় না-ই বললাম! এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম তা সাধারণদের জন্য। এবার আলেমদের জন্য একটু ইলমি আলোচনা করতে চাই, দয়া করে এই আলোচনায় যাদের উসূলে হাদীসের উপর একাডেমিক পড়াশোনা নেই তারা প্রবেশ করবেন না!

  • কিন্তু কোনো কোনো বর্ণনাতে তো خلف الإمام (ইমামের পেছনে) শব্দযোগেও বর্ণনায় এসেছে যে, لا صلوة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب অর্থাৎ যে ফাতেহাতুল কিতাব ছাড়া….। এর সমাধান কী?

এর উত্তরে আমি আমার শিক্ষার আলোকে বলতে পারি যে, হাদীস পড়া আর হাদীস বুঝা দুটো দুই জিনিস। যেজন্য হাদীস সংকলনকারীদের মুহাদ্দিস বলা হয় আর হাদীসের উপর জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাঁড় করার যোগ্যতাসম্পন্নদের ফকিহ বলা হয়। যুগে যুগে মুহাদ্দিস অগণিত থাকলেও ফকিহ ছিলেন হাতেগনে অল্পকয়জন। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন আবু হানিফা, ইমাম মালেক, সুফিয়ান আস ছাওরী, আওযায়ী, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান, ইমাম যুফার, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইমাম শাফেয়ী প্রমুখ। সাধারণদের বুঝার সহজার্থে এভাবেও বলা যায় যে, মুহাদ্দিসগণ হলেন ঔষধ দোকানদারগণের মত আর ফকিহগণ হলেন প্রেসক্রিপশন সহ ঔষধ সরবরাহকারী এমবিবিএস ডাক্টারের মত। যেজন্য হাদীসের বুঝ বা ব্যাখ্যার জন্য ফকিহদের উপর উম্মাহ যুগে যুগে নির্ভর করতেন। উপরের দুই শ্রেণীর বাহিরে তৃতীয় আরেকটা শ্রেণীও ছিলেন তাদেরকে ‘আয়েম্মায়ে জারহু ওয়াত তা’দীল’ বলা হয়। অর্থাৎ হাদীসের সনদ বিশেষজ্ঞ স্কলারশিপ। তাদের মধ্যে ইমাম যাহাবী, ইবনে হাজার আসকালানী, নূরুদ্দীন হাইছামী, আবু যুর’আ, ইবনে হাব্বান, ইবনে জওযী, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন প্রমুখ অন্যতম। এবার মূলকথায় ফিরে আসছি। ঐ যে একটা বর্ণনায় ‘ইমামের পেছনে সূরা ফাতেহা পড়া...’ সংক্রান্ত দলিল পেশ করা হয় সেটি সম্পর্কে কিতাবে লিখা আছে যে, বর্ণনাটির সূত্রে ইমাম যুহরী (রহ.) রয়েছেন। তিনি নিজেই পরের দিকের আরেকটি বর্ণনায় বলেছেন যে, সূরা আ’রাফ আয়াত ২০৪ (وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا) নাযিল হওয়ার পূর্বে সাহাবায়ে কেরাম ইমামের পেছনে ক্বেরাত পড়তেন। ইমাম যুহরী (রহ.) সহীহ বুখারীর অন্যতম একজন শক্তিশালী রাবী। তাঁর উক্ত বক্তব্য হতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, ইমামের পেছনে ইতিপূর্বে ফাতেহা পড়া প্রচলিত থাকলেও ঐ আয়াত নাযিলের পর ইমামের পেছনে সূরা ফাতেহা পড়ার আগেকার নিয়ম রহিত হয়ে যায় অর্থাৎ আগে পড়লেও পরবর্তীতে কেউ আর পড়তেন না, বরং আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী সবাই ইমামের পেছনে চুপচাপ থেকে ক্বেরাত শ্রবণ করতেন। এই হচ্ছে মুটামুটি কথা। এখানে বিজ্ঞ আলেমদের জ্ঞাতার্থে আরেকটু ইলমি আলোচনা করা জরুরি। সুনানে বায়হাক্বী থেকে ইমাম যুহরী (রহ.)-এর সনদে যে রেওয়ায়েতটি পেশ করা হয় সেটি ইমাম যুহরী থেকে তার ছাত্রদের আরও প্রায় ১৩ জন বর্ণনা করেছেন কিন্তু তাদের কারো বর্ণনায় خلف الأمام (ইমামের পেছনে) শব্দটি নেই। সেই একমাত্র ছাত্র ইউনুসই এটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু একই সনদে ইমাম দারেমী তার সুনান গ্রন্থে বর্ণনাটি উল্লেখ করা সত্ত্বেও তিনি সেখানে বর্ণনাটিতে خلف الإمام শব্দ আনেননি। ইমাম বায়হাক্বী (রহ.) একই কিতাবের ২৩ নং পৃষ্ঠায় ইউনুস ইবনে উমরের সূত্রে প্রায় একই বর্ণনা উল্লেখ করা সত্ত্বেও তিনিও خلف الإمام শব্দ আনেননি (Click)। এখানে আরও অবাককরা বিষয় হল, ইউনুসের সূত্রে তারও ছাত্রদের যে ৩জন এটি বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে শুধুমাত্র উসমান বিন উমর ছাড়া বাকি কারো বর্ণনাতেও শব্দটি নেই। আবার উসমান বিন উমর-এর সূত্রে তার দুই ছাত্র এটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সে দুইজনের একজন হাসান ইবনে মুকরিমের বর্ণনাতেও শব্দটি নেই। শুধুমাত্র আবু ইবরাহীম মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আছ-ছিপার (ابو ابراهيم محمد بن يحيى الصفار) নামীয় তার এক ছাত্র অতিরিক্ত শব্দটি সহ বর্ণনা করতে দেখা যায়। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি :

মজার ব্যাপার হল, সনদ বিশেষজ্ঞ স্কলারশিপ (রিজালশাস্ত্রের ইমামগণ) কেউ তাকে (মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া) সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য বলেননি (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর ‘ফাতহুল বারী’ দ্রষ্টব্য)। এমতাবস্থায় কুরআনের শিক্ষার বিপরীতে এবং অন্যান্য অসংখ্য হাদীসের বিরুদ্ধে ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের উল্লিখিত সাক্ষ্যপ্রমাণ উপেক্ষা করে কিভাবে এমন একটি বর্ণনার অতিরিক্ত ঐ উপবাক্যটির উপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়? অথচ বর্ণনার অতিরিক্ত শাজ (شاذ) অংশটি রাসূল (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণী হওয়াও নিশ্চিত নয়। তাকওয়ার দাবী তো প্রবৃত্তির অনুসরণ না করে বরং সালফে সালেহীনের পথ অনুসরণ করা, দলাদলির উর্ধ্বে থেকে শুধুই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য দ্বীন পালন করা, তাই নয় কি? বলাবাহুল্য, এই নাতিদীর্ঘ বিচার বিবেচনা আর সমন্বয় করে মুটামুটি সমস্ত হাদীসের উপর আমল করার বিস্তৃত এই বৈচিত্র্যকেই এককথায় ফিকহ বলা হয়। যাকে আরেক কথায় ‘মাযহাব‘ (ইখতিলাফি বিষয়ে গবেষণালব্ধ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত) বলা হয়।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।

জানাযার সালাতে সূরা ফাতেহা

0

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি প্রশ্নোত্তরে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে

  • জানাযার সালাতে সূরা ফাতেহা পড়া নিয়ে মতভেদ কী?

প্রশ্নের উত্তরে বলা হবে যে, একটা শ্রেণী প্রচার করে থাকেন যে, সূরা ফাতেহা ছাড়া অন্যান্য সালাত যেমন হয়না তেমনি জানাযার সালাতও সূরা ফাতেহা না পড়লে শুদ্ধ হবেনা। কিন্তু তাদের এই বিশ্বাস সঠিক নয়। প্রথমত, যে হাদীসে সূরা ফাতেহা ছাড়া সালাত হবেনা বলে উল্লেখ আছে সেটি একাকী সালাত আদায়কারী ব্যক্তির সালাত সম্পর্কে। (হাদীস) إذا صلى احدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الامام অর্থাৎ তোমাদের মধ্য থেকে যখন কেউ ইমামের পেছনে সালাত পড়বে তার জন্য ইমামের ক্বেরাতই যথেষ্ট। (আল মুয়াত্তা-এর শরাহ ‘আত-তামহীদ‘ ১২/৩৭, ইমাম ইবনে আব্দিল বার আল মালেকী, হাদীস সহীহ)! স্ক্রিনশট :

আত তামহীদ, ইবনে আব্দিল বার

ছোট্ট একটা উপমা দিলে বুঝতে সহজ হবে। মনে করুন, আপনি অজু করে মসজিদে ঢুকেই দেখলেন যে ইমাম সাহেব রুকুতে চলে গেছেন। আপনিও ইমামের সাথে রুকুতে শামিল হয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় ইমাম সাহেব যখন সালাত শেষ করবেন তখন কি আপনি প্রথম রাকাত পাননি মনে করে দাঁড়িয়ে যাবেন? নিশ্চয়ই না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, সূরা ফাতেহা ছাড়া সালাত হবেনা—কথাটি সবক্ষেত্রে নয়, বরং শুধুমাত্র একাকী সালাত আদায়কারী ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, জানাযার সালাত মূলত একটি দোয়া মাত্র, অন্যান্য সালাতের মত কোনো সালাত নয়। যেজন্য সূরা ফাতেহা পড়ার আবশ্যকতা প্রমাণের জন্য অন্যান্য সালাতের প্রসঙ্গ টেনে আনা সম্পূর্ণ জেহালত বৈ কিছুই না। এবার দ্বিতীয় শ্রেণীর মতামত জানা যাক। দ্বিতীয় শ্রেণীর মতামত হচ্ছে, সূরা ফাতেহা পড়ার প্রমাণে সহীহ বুখারীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে একটি বর্ণনা উল্লেখ আছে। অনুরূপ আরও কয়েক জন সাহাবী থেকেও উল্লেখ আছে। তেমনিভাবে খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর (রা.) হযরত আলী (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এবং হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একদম টনটনে একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, উনারা কেউই জানাযার সালাতে সূরা ফাতেহা পড়তেন না। এমনকি রাসূল (সা.) হতেও কোনো মারফু সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসও পাওয়া যায়না যেখানে সূরা ফাতেহা পড়া সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়! সুতরাং এতে প্রমাণিত হয় যে, সূরা ফাতেহা পড়া ফরজ বা ওয়াজিব বা সুন্নাহ এধরণের কিছুই না; বড়জোর শুধুই হামদ-ছানাহ’র নিয়তে জায়েজ হতে পারে। কারণ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ব্যক্তিগত একখানা আমল দ্বারা তা প্রমাণিত। তবে ইবনে আব্বাস (রা.) সূরা ফাতেহাকে ক্বেরাত ধরেই পড়তেন না, বরং হামদ-ছানাহ (আল্লাহর প্রশংসা ও বন্দনা) স্বরূপ পড়তেন। আর একথার প্রমাণও একাধিক সহীহ সূত্র থেকে পাওয়া যায়। সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) রচিত ‘ফাতহুল বারী’-তে এর প্রমাণ হিসেবে যে তথ্যটি উঠে এসেছে তাতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তিনি জানাযায় একদা ‘فاتحة الكتاب’ (সূরা ফাতেহা) পাঠ করলেও সেটি মূলত হামদ-ছানাহ হিসেবেই করেছিলেন, ক্বেরাত হিসেবে নয়। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) লিখেন, ইমাম হাম্মাদ (রহ.) তিনি বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু হামজাহ (রহ.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি (আবু হামজাহ) বলেন, আমি তাঁকে (ইবনে আব্বাসকে) জিজ্ঞাসা করলাম, কা‘বার ভেতরে নামায কীভাবে পড়ব? তিনি উত্তরে বললেন, (আরবী) كما تصلي في الجنازة تسبح وتكبر ولا تركع ولا تسجد ثم عند أركان البيت سبح وكبر وتضرع واستغفر، ولا تركع ولا تسجد অর্থাৎ তুমি (সেভাবেই পড়বে) যেভাবে সালাতুল জানাযা পড়। (তথায়) তাসবীহ পড়বে, তাকবীর দিবে, তবে রুকু-সিজদা করবে না। এরপর বাইতের রোকনগুলোর কাছে তাসবীহ পাঠ করবে, তাকবীর দিবে, রোনাজারি করবে এবং ইস্তিগফার করবে। তবে রুকু-সিজদা করবে না। (ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী ৩ : ৪০৪ কিতাবুল হাজ্জ)। ইবনে হাজার আসকালানী লিখেন, এ বর্ণনার সনদ সহীহ। লক্ষণীয় হল, ইবনে আব্বাস (রা.) জানাযার সালাতের নিয়ম পদ্ধতি কেমন তা ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে সূরা ফাতেহার উল্লেখ করেননি। আশাকরি প্রকৃত বিষয়টি এবার বুঝতে পেরেছেন। এ সম্পর্কে ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)-এর লেকচারটি শুনা যেতে পারে। (প্রামাণ্য স্ক্রিনশট)

ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী
  • জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার শরয়ী হুকুম কী? জানাযার সালাতে যারা সূরা ফাতেহা পড়তেন তাঁরা কী হিসেবে পড়তেন আর যাঁরা পড়তেন না তাঁদের বক্তব্য কেমন?

আগেই এর উত্তর দেয়া হয়ে গেছে অর্থাৎ, এর শরয়ী হুকুম বড়জোর জায়েজ, তবে শর্ত হচ্ছে হামদ-ছানাহ (supplication) স্বরূপ পড়বে কিন্তু তেলাওয়াত স্বরূপ পড়বেনা। কেননা সালাতুল জানাযা প্রকৃতপক্ষে সালাত নয়? তাহলে সালাতুল জানাযা কী? এর উত্তর হল, সালাতুল জানাযা (صلاة الجنازة) এর আভিধানিক অর্থ دعاء الميت বা মৃতের জন্য প্রার্থনা। অভিধানে সালাত (صلاة) শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দোয়া বা প্রার্থনা। আর জানাযা অর্থ মাইয়্যেত বা মৃত ব্যক্তি। কিন্তু তথাপি এটিকে ‘সালাত‘ নামে নামকরণ করার কারণ হিসেবে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, قال ابنُ حَجر: (قوله سمَّاها صلاة، أي: يُشتَرَط فيها ما يُشتَرَط في الصلاة، وإنْ لم يكن فيها ركوعٌ ولا سجودٌ، فإنَّه لا يُتكلَّم فيها، ويُكبَّر فيها، ويُسلَّم منها بالاتِّفاق). ((فتح الباري)) (3/190). অর্থাৎ এর নাম সালাত রাখার কারণ হচ্ছে, এতেও সেসব কর্ম শর্ত যা প্রকৃত সালাতের জন্য শর্ত, যদিও তার মধ্যে রুকু এবং সেজদা নেই। আর তাতে কথা বলা হয়না এবং সর্বসম্মতিক্রমে তার মধ্যে তাকবির বলা হবে এবং সালাম বলা হবে। (ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী খ-৩ পৃ-১৯০)। সালাতুল জানাযা (صلاة الجنازة) সম্পর্কে ইমাম মালেক (রহ.) একদম পরিষ্কার করে বলেছেন, إنما هو الدعاء অর্থাৎ ‘এ তো দোয়া মাত্র’! (সূত্র, আল মুদাওয়ানাতুল কোবরা [الكتاب: المدونة المؤلف: مالك بن أنس بن مالك بن عامر الأصبحي المدني (ت ١٧٩هـ)] ১ : ২৫১)। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সালাফ ও বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত আবুল আলিয়া (ابو الْعَالِيَةِ) (রহ.)-এর একটি বক্তব্য পেশ করছি। আবুল মিনহাল আল বছরী (ابو المنهال سيار بن سلامة البصري) বলেছেন, سَأَلْتُ أَبَا الْعَالِيَةِ عَنِ الْقِرَاءَةِ فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْجِنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَقَالَ: “مَا كُنْتُ أَحْسَبُ أَنَّ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ تُقْرَأُ إِلَّا فِي صَلَاةٍ فِيهَا رُكُوعٌ وَسُجُودٌ অর্থাৎ আমি আবুল আলিয়া (রা.)-কে সালাতুল জানাযায় ফাতেহা পাঠ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি (আশ্চর্য হয়ে) বললেন, আমার তো ধারণাই ছিল না যে, সূরা ফাতেহা রুকু-সিজদা বিশিষ্ট সালাত ছাড়া অন্য কোনো সালাতেও পড়া যেতে পারে! (সূত্র, আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৫২৪)। ইমাম ত্বহাবী (রহ.)-এর উপর আল্লাহ অজস্র ধারায় রহমতের বারিধারা বর্ষণ করুন। তিনি এই হাদীসের অংশবিশেষ থেকে অত্যন্ত চমৎকার একটি ফিকহের গোড়াপত্তন করতে সামর্থ্য হয়েছেন। তিনি এর রহস্য উদঘাটন করে লিখে গেছেন, لعل، قراءة من قرأ الفاتحة من الصحابة كان على وجه الدعاء لا على وجه التلاوة অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ (জানাযায়) ফাতেহা পাঠ করেছেন বলে যে নস (প্রমাণ) পাওয়া যায় সম্ভবত সেটি ছিল দোয়া হিসেবে, কুরআন তেলাওয়াত হিসেবে নয়। (সূত্র, উমদাতুল ক্বারী শরহে সহীহ বুখারী ৮/১৪১)। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য :

উমদাতুল ক্বারী কিতাবুল জানায়েজ

তিনি যেন বুঝাতে চাচ্ছেন, সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ঐ কর্মটা মূলত As a face of supplication বা বন্দনামূলক-ই ছিল, not on the face of recitation তথা তেলাওয়াতের নিয়তে ছিল না। সুতরাং বরেণ্য সালাফদের আমল দ্বারা বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, গুটিকয়েক সালফে সালেহীনকে বাদ দিলে বেশিরভাগেরই আমল ছিল খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের মত যাঁরা জানাযায় ক্বেরাত পাঠ থেকে বিরত ছিলেন। সালাফদের যে বা যারাই জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়তেন তারা কেউই জোরে জোরে পড়তেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না, বরং চুপেচুপে পড়ার কথাই বর্ণিত আছে। যেমন হযরত আবু উমামাহ (রা.) থেকে ‘দোয়া অধ্যায়ে‘ বর্ণিত আছে, أَخْبَرَنَا قُتَيْبَةُ، قَالَ حَدَّثَنَا اللَّيْثُ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، أَنَّهُ قَالَ السُّنَّةُ فِي الصَّلاَةِ عَلَى الْجَنَازَةِ أَنْ يَقْرَأَ فِي التَّكْبِيرَةِ الأُولَى بِأُمِّ الْقُرْآنِ مُخَافَتَةً ثُمَّ يُكَبِّرَ ثَلاَثًا وَالتَّسْلِيمُ عِنْدَ الآخِرَةِ অর্থাৎ কুতায়বা (রহ.) … আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জানাযার সালাতে সুন্নাহ হল প্রথম তাকবীরে সূরা ফাতেহা চুপেচুপে তেলাওয়াত করবে। অতঃপর আরো তিনটি তাকবীর বলবে; শেষ তাকবীরে সালাম ফিরাবে। (সূত্র, সুনানে নাসাঈ, কিতাবুল জানায়েজ হাদীস নং ১৯৯৩, হাদীস সহীহ)।

  • সূরা ফাতেহা পড়া ছাড়া জানাযার সালাত শুদ্ধ হবে কি?

উত্তরে বলা হবে, অবশ্যই শুদ্ধ হবে। কেননা সহীহ বুখারীতে ইবনে আব্বাস (রা.) হতে এ সম্পর্কে যে হাদীসটি রয়েছে সেখানে পরিষ্কার করে লিখা আছে যে, لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ অর্থাৎ যাতে লোকেরা বুঝতে পারে যে, নিশ্চয়ই এটি সুন্নাহ। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১২৫৪; ইফা)। তবে এটি ঐরকম সুন্নাহ নয় যা রাসূল (সা.)-এর কর্ম দ্বারা সাব্যস্ত হয়। সুনানু তিরমিজি গ্রন্থে এই ‘সুন্নাহ’ শব্দটির ওয়াজাহাত (সুস্পষ্টকরণ) রয়েছে এভাবে যে, فَقَالَ إِنَّهُ مِنَ السُّنَّةِ أَوْ مِنْ تَمَامِ السُّنَّةِ ‏.‏ অর্থাৎ তিনি বললেন, এ হলো সুন্নাহ অথবা বলেন, এ হলো সুন্নাহ’র পরিপূর্ণতা বিধানের অন্তর্ভূক্ত। (তিরমিজী হাদীস নং ১০২৭ ;আল মাদানী প্রকাশনী)। বলাবাহুল্য যে, সুন্নাহ তরক করা দ্বারা কখনো কোনো আমল বাতিল হয়না, বেশি থেকে বেশি আমলটি ক্রুটিপূর্ণ হয়। অধিকন্তু রাসূল (সা.) নিজ সত্তার বাহিরে শুধুমাত্র খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মকে ‘সুন্নাহ’ বলেছেন, ঢালাওভাবে সব সাহাবীর কর্মকে আর যাইহোক অন্তত ‘সুন্নাহ’ বলেননি। ইবনে আব্বাসের উক্ত কথা থেকে সূক্ষ্মভাবে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার নিয়মটি পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিলনা বলেই ইবনে আব্বাস (রা.)-এর জন্য জানাযার সালাত শেষে ‘নিশ্চয়ই এটি সুন্নাহ’ (لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ) এভাবে বলে উপস্থিত সাহাবীদের সংশয় দূরীকরণ আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।

  • সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়তেন তাঁরা কারা? আর যাঁরা পড়তেন না তাঁরা কারা?

যারা সূরা ফাতেহা জানাযায় পড়তেন : সাহাবীদের মধ্যে যাঁদের থেকে জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায় তাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) এবং হযরত আবু উমামাহ আল বাহিলী (রা.) অন্যতম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীসটি ইমাম তিরমিজি (রহ.) নিজেও তাঁর সুনান গ্রন্থে এনেছেন। হাদীসটি এইরকম, عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَوْفٍ، أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ، صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَقُلْتُ لَهُ فَقَالَ إِنَّهُ مِنَ السُّنَّةِ أَوْ مِنْ تَمَامِ السُّنَّةِ ‏.‏ অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনু বাশশার (রহ.) ….. আবদুল্লাহ ইবনু আওফ (রহ.) থেকে বর্ণিত যে, ইবনু আব্বাস (রা.) একবার সালাতুল জানাযা পড়েন এবং এতে সূরা ফাতেহা পাঠ করেন। এই বিষয়ে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, এ হলো সুন্নাহ অথবা বলেন, এ হলো সুন্নাহ’র পরিপূর্ণতা বিধানের অন্তর্ভূক্ত। (তিরমিজী হাদীস নং ১০২৭; আল মাদানী প্রকাশনী)। ইমাম আবু ঈসা (রহ.) বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ্।

ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেছেন, কতেক সাহাবী ও অপরাপর উলামায়ে কেরাম অনুরূপ আমল করেছেন (এতে বুঝা যাচ্ছে সবাই জানাযায় ফাতেহা পড়তেন না-লিখক)। প্রথম তাকবীরের পর সূরা ফাতেহা পাঠের বিধান তাঁরা গ্রহণ করেছেন। এটি ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ও ইসহাক (রহ.)-এর অভিমত। আবার কতেক উলামায়ে কেরাম বলেছেন, সালাতুল জানাযায় (সূরা ফাতেহা) পাঠ করা হবে না। এতো কেবল আল্লাহর হামদ-ছানাহ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ ও মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা। এটি ইমাম সুফিয়ান আস ছাওরী আর কুফাবাসী ফোকাহায়ে কেরামের অভিমত। ইমাম ইবনে বাত্তাল (রহ.) বলেন, وَمِمَّنْ كَانَ لَا يقْرَأ فِي الصَّلَاة على الْجِنَازَة وينكر: عمر بن الْخطاب وَعلي بن أبي طَالب وَابْن عمر وَأَبُو هُرَيْرَة، وَمن التَّابِعين: عَطاء وطاووس وَسَعِيد بن الْمسيب وَابْن سِيرِين وَسَعِيد بن جُبَير وَالشعْبِيّ وَالْحكم، وَقَالَ ابْن الْمُنْذر: وَبِه قَالَ مُجَاهِد وَحَمَّاد وَالثَّوْري، وَقَالَ مَالك: قِرَاءَة الْفَاتِحَة لَيست مَعْمُولا بهَا فِي بلدنا فِي صَلَاة الْجِنَازَة، অর্থাৎ যাঁরা জানাযায় ফাতেহা পড়তেন না, বরং পড়া থেকে বিরত থাকতেন, তাঁদের মধ্যে খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবী তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আবু হুরাইরা প্রমুখ অন্যতম। আর তাবেয়ীগণের মধ্যে ছিলেন, হযরত আত্বা ইবনে আবী রাবাহ, তা‘উস, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, ইবনে সিরীন, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, শা‘বী, হাকাম প্রমুখ অন্যতম। ইবনুল মুনযির (রহ.) বলেছেন, জানাযায় সূরা ফাতেহা না পড়ার এই মত পোষণ করতেন ইবনে আব্বাসের শিষ্য তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ, হাম্মাদ ও সুফিয়ান আস ছাওরী প্রমুখও। ইমাম মালেক (রহ.) বলেছেন, ليس ذلك بمعمول به ببلدنا إنما هو الدعاء، أدركت أهل بلدنا على ذلك অর্থাৎ জানাযায় ফাতেহা পড়ার এরকম কোনো আমল আমাদের শহরে (মদীনায়) নেই, যেহেতু এটি নিছক একটা দোয়া আর আমি আমাদের শহরবাসীকে এরই উপর পেয়েছি। (ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রচিত ‘উমদাতুল কারী’ শরহে বুখারী ৮/১৩৯)।

যাঁরা সূরা ফাতেহা জানাযায় পড়তেন না : (১) চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, قال ابن أبي شيبة : حدثنا محمد بن فضيل عن العلاء بن المسيب عن أبيه عن علي أنه كان إذا صلى على ميت يبدأ يحمد الله ويصلى على النبي صلى الله عليه وسلم ثم يقول : اللهم اغفر لأحيائنا و أمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا অর্থাৎ হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোনো মৃত ব্যক্তির জানাযার সালাত পড়তেন তখন প্রথমে আল্লাহর হামদ-ছানাহ (প্রশংসা-জ্ঞাপন) করতেন তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়তেন অতপর এই বলে দোয়া করতেন, اللهم اغفر لأحيائنا وأمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا (সূত্র, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৪৯৪)। তাহকীক, এই বর্ণনার রাবীগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য। হযরত আলী (রা.)-এর এই আমল (آثار) দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, জানাযার সালাতে সূরা ফাতেহা পড়া আবশ্যক নয়, সুন্নাহ-ও নয়।

(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, مالك عن نافع أن عبد الله بن عمر كان لا يقرأ في الصلاة على الجنازة অর্থাৎ হযরত নাফে (রহ.) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) জানাযার সালাতে (ক্বেরাত/কুরআন) পড়তেন না। (সূরা মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ৫২৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৫২২)। তাহকীক, এই আমটিও (آثار) বিশুদ্ধতম সনদে বর্ণিত। এখানেও স্পষ্টভাবে বলা হল, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) জানাযার সালাতে ক্বেরাত পড়তেন না।

(৩) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, لم يوقت لنا في الصلاة على الميت قراءة ولا قول كبر ما كبر الإمام وأكثر من طيب الكلام. أورده الهيثمي في مجمع الزوائد وقال : رواه أحمد ورجاله رجال الصحيح অর্থাৎ আমাদের জন্য জানাযার সালাতে কোনো ক্বেরাত (ফাতেহা) কিংবা কোনো বাক্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। ইমাম যখন তাকবির বলে তখন তুমিও তাকবির বল। আর অধিক পরিমাণে তার জন্য ভালো কথা বল। (সূত্র, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং ৪১৫৩)। তাহকীক, ইমাম নূরউদ্দীন আল হাইছামী (রহ.) বলেছেন, হাদীসটি ইমাম আহমদ উদ্ধৃত করেছেন এবং এর বর্ণনাকারীগণ সহীহ বুখারীর বর্ণনাকারী।

(৪) হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর জানাযার সালাত পড়ার নিয়ম সহীহ হাদীস থেকে, سَأَلَ أَبَا هُرَيْرَةَ كَيْفَ تُصَلِّي عَلَى الْجَنَازَةِ ؟ فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ : ” أَنَا ، لَعَمْرُ اللَّهِ أُخْبِرُكَ . أَتَّبِعُهَا مِنْ أَهْلِهَا . فَإِذَا وُضِعَتْ كَبَّرْتُ ، وَحَمِدْتُ اللَّهَ . وَصَلَّيْتُ عَلَى نَبِيِّهِ ” . ثُمَّ أَقُولُ : ” اللَّهُمَّ إِنَّهُ عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ كَانَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ . وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُولُكَ . وَأَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ . اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ مُحْسِنًا ، فَزِدْ فِي إِحْسَانِهِ . وَإِنْ كَانَ مُسِيئًا ، فَتَجَاوَزْ عَنْ سَيِّئَاتِهِ . اللَّهُمَّ لَا تَحْرِمْنَا أَجْرَهُ ، وَلَا تَفْتِنَّا بَعْدَهُ ” অর্থাৎ আবু সাঈদ মাকবুরী থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কীভাবে জানাযার সালাত পড়েন? আবু হুরাইরা (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি তোমাকে বলব। আমি মৃত ব্যক্তির (ঘর থেকে) পরিবারের সাথে জানাযার সাথে সাথে যেতে থাকি। অতপর যখন জানাযাকে (মৃতকে) রাখা হয় আমি তাকবীর দিই এবং আল্লাহর হামদ-ছানাহ (বন্দনা) করি। তারপর নবীর উপর দরূদ পড়ি। অতপর এই দুআ করি… اللهم। (সূত্র, মুয়াত্তা মালেক, হাদীস নং ৫২১; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ১১৪৯৫)। তাহকীক, এই বর্ণনার-ও (آثار) সকল রাবী তথা বর্ণনাকারী সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য। এতেও সাব্যস্ত হয় যে, জানাযায় সূরা ফাতেহা পড়ার হুকুম হামদ-ছানাহ (বন্দনা) রূপে বড়জোর জায়েজ, কিন্তু সুন্নাহ (সুন্নাতে রাসূল) নয়। যেজন্য আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত জানাযার সালাতকে ভুল আখ্যা দেয়া কোনোভাবেই সুবিচার হবেনা, বরং অবিচার এবং জনমনে ফেতনা সৃষ্টি হিসেবেই গণ্য হবে।

মাসিক আল কাউসার এবং হাদীস বিডি.কম থেকে উপরে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর বস্তুনিষ্ঠভাবে ও সহজ ভাষায় তুলে ধরা হল! পাঠকবৃন্দ! ভালো মত বুঝার চেষ্টা করবেন, যাতে এধরণের নতুন নতুন যে কোনো মাসয়ালায় বিভ্রান্ত হতে না হয়! লিখাটি উপকারী মনে হলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে দিন বা কপি (Copy) করে পোস্ট করুন!

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী | লিখক ও গবেষক

কেয়ামতে শিঙ্গা ফুঁকা : দু’বার না তিনবার?

0

কেয়ামতে শিঙ্গা ফুঁকা : একটা পর্যালোচনা

বিশুদ্ধ মতানুসারে ২টা শিঙ্গা ফুঁকা হবে। প্রথম শিঙ্গা ফুঁকার সাথে সাথে সমগ্র বিশ্বে মহাপ্রলয় ঘটে যাবে, সব কিছু ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে যাবে শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যা অক্ষত রাখতে চান তা ব্যতীত। সূরা আত তাকভীর (৮১:১-২৯) পড়লে এ সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এটা পছন্দ করে যে, কেয়ামতের দৃশ্যকে স্বচক্ষে দেখবে সে যেন সূরা তাকভীর, সূরা ইনফিতার ও সূরা ইনশিকাক পাঠ করে। (তিরমিযী হাদীস নং ৩৩৩৩ সহীহ, السلسلة الصحيحة لالبانى হাদীস নং ১০৮১ তাহকীক, শায়খ আলবানী রহ.)। কারণ সূরা তাকভীরে এসেছে- (পড়তে ক্লিক করুন)।

(আয়াতের অনুবাদ) ‘যখন সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে {আবু হোরাইরাহ রা. হতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন, الشَّمْسُ وَالقَمَرُ مُكَوَّرَانِ يَوْمَ القِيَامَةِ অর্থাৎ কেয়ামতের দিন সূর্য ও চন্দ্রকে গুটিয়ে নেয়া হবে। সহীহ বুখারী হাদীস নং ৩২০০}, আর নক্ষত্ররাজি যখন পতিত হবে, আর পর্বতগুলোকে যখন সঞ্চালিত করা হবে (এর উদ্দেশ্য, তখন পাহাড় সমূহ মাটির উপর ভেঙ্গে পড়বে ও সারা পৃথিবী প্রকম্পিত হবে), আর যখন দশমাসের গর্ভবতী উটনীগুলো উপেক্ষিত হবে (এখানে দশমাসের গর্ভবতী উটনীকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল, যদি কেয়ামতের দিন কোনো মানুষের এরূপ মূল্যবান সম্পদ থাকত তাহলে এরূপ মূল্যবান সম্পদও ছেড়ে দিত, কেয়ামতের ভয়াবহতা দেখে তার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করত না।), যখন বন্য পশুগুলিকে একত্রিত করা হবে (এখানে এর উদ্দেশ্য হল, পশুগুলোকে কিসাস আদায় করার জন্য পুনর্জীবিত করে একত্রিত করা হবে । ফলে দুনিয়াতে যে পশুর শিং ছিল না আর তাকে শিংওয়ালা পশু শিং দ্বারা আঘাত করেছিল সে পশু কেয়ামতের দিন শিংওয়ালা পশুকে অনুরূপ আঘাত করে কিসাস আদায় করে নেবে। পরে তারা আবার মাটিতে পরিণত হয়ে যাবে), যখন সমুদ্রগুলোকে অগ্নিউত্তাল করা হবে, আর যখন আত্মাগুলোকে (সমগোত্রীয়দের সাথে) মিলিয়ে দেয়া হবে, আর যখন জীবন্ত কবরস্থ কন্যাকে (জাহেলিয়াতের যুগে কন্যাশিশুকে মাটিতে জীবন্ত পুঁতিয়া ফেলা হত) জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে? আর যখন আমলনামাগুলো প্রকাশ করে দেয়া হবে (মৃত্যুর সময় মানুষের আমলনামা গুটিয়ে দেওয়া হয়। পুনরায় কেয়ামতের দিন হিসাবের জন্য তা খোলা হবে। যা প্রতিটি ব্যক্তি তা প্রত্যক্ষ করবে। বরং প্রত্যেকের হাতে তা ধরিয়ে দেওয়া হবে, সূরা ইসরা আয়াত নং ১৪-তেও একই কথা বলা হয়েছে), আর যখন আসমানকে আবরণমুক্ত করা হবে (অর্থাৎ আকাশ ভেঙ্গে ফেলা হবে যেমন ছাদ ভেঙ্গে ফেলা হয়)… ইত্যাদি’ (আয়াত নং ১-১১ অনুবাদ সমাপ্ত হল)।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহতালা দুটি শিঙ্গা ফুঁকা সম্পর্কে বলেন, وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ إِلا مَنْ شَاءَ اللَّه ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ অর্থ- আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেন তারা ছাড়া আসমানসমূহে যারা আছে এবং পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই বেহুঁশ হয়ে পড়বে। তারপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে। (সূরা যুমার, আয়াত ৬৮)। অধিকন্তু সহীহ বুখারী মুসলিম সহ বিশুদ্ধ সনদে প্রাপ্ত অন্যান্য হাদীস সমূহ দ্বারাও মাত্র ২টা শিঙ্গা ফুঁকা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, ما بين النفختين أربعون অর্থাৎ (কেয়ামতে শিঙ্গা দুইবার ফুঁকা হবে) দুই শিঙ্গার মধ্যবর্তী সময়ের বিশালতা চল্লিশ। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৪৬৫১, সহীহ মুসলিম হাদীস নং ২৯৫৫)। হাদীসটির ‘চল্লিশ’ সংখ্যাটির প্রকৃত তাৎপর্য অস্পষ্ট। তাই বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মাঝে এর মর্মার্থ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। চল্লিশ দিন, মাস কিবা বছর ইত্যাদি যে কোনোটা হতে পারে। এ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান মহান আল্লাহই রাখেন।

তবে কুরআন এবং গুটিকয়েক হাদীসের ইংগিতসমূহ একত্রিত করে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কেয়ামতে ৩টা শিঙ্গা ফুঁকা হবে। প্রথমটির মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী এক মহা ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হবে। কিন্তু সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) ৩টা শিঙ্গা ফুঁকা সংক্রান্ত রেওয়ায়েত সম্পর্কে লিখেছেন وهو حديث ضعيف مضطرب অর্থাৎ এই বর্ণনা দুর্বল এবং মুদতরিব [বিশৃঙখল জনিত] (ফাতহুল বারী ১১/৩৬৯, ইমাম কুরতুবী সংকলিত তাযকিরাহ পৃ-১৮৪)। সুতরাং কেয়ামতে শিঙ্গা দুইবার ফুঁকা সংক্রান্ত শিক্ষাই বিশুদ্ধ ও অথেনটিক। আল্লাহু আ’লাম।

  • টিকা– হাদীসে মুদতরিব বলে, যে হাদীসের মাঝে সাধারণত রাবীর পরিবর্তন নিয়ে অর্থাৎ সনদের এ স্তরে প্রকৃত রাবী কে—এ নিয়ে অথবা মতন নিয়ে অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে প্রকৃত মতন কোনটি অথবা উভয়ের পরিবর্তন নিয়ে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় আর এ ব্যাপারে দৃঢ়তার দিক থেকে সবগুলো রেওয়ায়েতই সমান মর্যাদার; কোনো একটিকে অপরটির উপর অগ্রাধিকার দেয়া যায় না, এমন হাদীসকে مضطرب বা মুদতরিব বলা হয়। দেখুন, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) রচিত شرح نخبة الفكر বা শরহে নুখবাতুল ফিকার। সকল মুহাদ্দিসীন একমত যে, মুদতরিব হাদীস অথেনটিক নয়।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।

আব্দুর রহমান লখভী ও মির্যা কাদিয়ানী

মির্যা কাদিয়ানীর মিথ্যাচার

মির্যা কাদিয়ানী অতি চালাকি করে নিজেই নিজের কথায় কিভাবে ধরা খেল দেখেন….

মরহুম মওলানা আব্দুর রহমান লখভীর সাথে মির্যা কাদিয়ানীর ঐতিহাসিক একটি চমৎকার বিতর্ক নিয়ে একটু লিখব। আব্দুর রহমান লখভী (রহ.) মির্যার সমসাময়িক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেম ছিলেন। ১৮৯১ সাল। মির্যা কাদিয়ানী যখন মানুষকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করলো, কখনো মাহদী কখনো বা মসীহ মওউদ আবার কখনো নবী দাবী, কখনো বা নবী দাবী অস্বীকার করে নবী শব্দকে ‘মুহাদ্দাস’ অর্থে উদ্দেশ্য ইত্যাদি বলে একেক সময় একেক রকম বয়ান দিতে লাগলো এবং মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলতে শুরু করলো তখন মওলানা আব্দুর রহমান লখভী (রহ.) মির্যার নিকট পত্র প্রেরণ করে জানালেন, আমার নিকট ইলহাম হয়েছে যে,

ان فرعون و هامان و جنودهما كانوا خاطئين

(অর্থাৎ নিশ্চয়ই ফেরাউন আর হামান আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা মিথ্যা) এই ইলহামে ইলাহিতে ফেরাউন দ্বারা মির্যাকে এবং হামান দ্বারা (মির্যার উপদেষ্টা) নুরউদ্দীনকে বুঝানো উদ্দেশ্য । পত্রের কথাগুলো মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের লিখনীতেও স্থান পেয়েছে। দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২২/৩৬৭-৬৮ (নিচে স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য)।

মির্যা কাদিয়ানী পত্রটি হাতে নিয়ে পড়লেন এবং মন্তব্য করে বললেন যে, এই ইলহামের ভেতর তো আমার নাম নেই! তারপর মওলানা আব্দুর রহমান লখভী সাহেব কিছুদিন পর মির্যাকে নতুন আরেকটা ইলহামের সংবাদ দিলেন। তিনি মির্যাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিলেন, আমার নিকট ইলহাম আসছে যেখানে একদম পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, “মির্যা কাদিয়ানী ফেরাউন আর মিয়া নূরউদ্দিন হামান”। আর একথাগুলো মুসলিম উম্মাহার কল্যাণকামীতার উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেয়া আমার জন্য জরুরী ছিল। একথার পর মির্যা কাদিয়ানী চুপ হয়ে যান। তারপরের ইতিহাস আরও দারুন।

১৩১৪ হিজরী। মওলানা আব্দুর রহমান লখভী সাহেবের ইন্তেকাল হয়ে গেল। মির্যা কাদিয়ানী খুশিতে বগলদাবা করতে লাগলেন। তিনি সাথে সাথে আব্দুর রহমান লখভী সাহেবের উপর একটা টাটকা মিথ্যাচার শুরু করে দিলেন। তিনি বললেন, লখভী সাহেব আমাকে ফেরাউন আখ্যা দিয়েছেন আর নিজেকে মূসা সাব্যস্ত করেছেন।

মির্যা সাহেব এবার উপরের মিথ্যাচারের উপর যুক্তি পেশ করে বলতে লাগলেন, আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ফেরাউন এখনো বেঁচে আছে অথচ মূসা মরে কবরে চলে গেছে, দুনিয়ায় তার নাম নিশানাও বাকি নেই! মির্যা কাদিয়ানী কত ধূর্ত প্রকৃতির মিথ্যাবাদী হলে এধরণের মিথ্যাও প্রচার করতে পারে, তা চিন্তা করতেও মাথা নিচু হয়ে যায়! আহা! একজন ইমাম মাহদী দাবীদার কিভাবে এত জঘন্য মিথ্যাবাদী হয়!! অথচ মওলানা আব্দুর রহমান লখভী সাহেবের পত্রের কোথাও নিজেকে “মূসা” শব্দ ইংগিতেও উল্লেখ নেই।

যাইহোক মির্যা সাহেব বোধহয় ধরেই নিয়েছিলেন যে, কেউ কাউকে ফেরাউন আখ্যা দিলে বা ইলহামের মাধ্যমে কারো পক্ষ হতে কেউ ফেরাউন আখ্যা ফেলে তখন প্রতিপক্ষ আপনাপনি মূসা সাব্যস্ত হয়ে যাবেন, যদিও তিনি মূসা দাবী করেন বা না করেন ! কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্যখানে। মির্যা কাদিয়ানী সাহেব থেকেও অন্যকে ফেরাউন আখ্যা দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

দুঃসংবাদ হল, মির্যা সাহেবের মৃত্যুটা আগে হয়ে যায় আর তার ফেরাউন আখ্যা পাওয়া ব্যক্তি তার মৃত্যুর পর আরও প্রায় ১০ বছরেরও অধিক সময় বেঁচে ছিলেন। মির্যা কাদিয়ানী সাহেব অতি পাণ্ডিত্ব দেখাতে গিয়ে এভাবেই নিজের কথায় নিজে পাকড়াও হন। তিনি অতি চালাকি দেখাতে গিয়ে বহু স্থানে আরও বহু ধরা খেয়েছেন। ইউজে আসেফ সম্পর্কে তিনি সারা দুনিয়ার চোখে ধূলো দিয়ে পরে এমনভাবে ধরা খেয়েছেন যা বর্ণনাতীত। এ সম্পর্কে বিস্তারিত এখান থেকে পড়ুন (ক্লিক)।

তিনি ভুলেও চিন্তা করেননি যে, স্যোসাল মিডিয়ার যুগ আসন্ন। তখন তথ্য-উপাত্তের সয়লাব হবে। মিথ্যাবাদীরা সহজেই ধরা পড়তে থাকবে।

আগের কথায় আবার ফিরে আসলাম, মওলানা আব্দুর রহমান লখভী সাহেবের ইলহামকে ভুল সাব্যস্ত করতে মির্যা সাহেব মিথ্যার আশ্রয় তো নিলেন, মনগড়া যুক্তিও পেশ করে নিজেকে রক্ষায় চেষ্টা করলেন। কিন্তু আল্লার মাইর দুনিয়ার বাহির—বাংলায় এই প্রবাদটি তার সাথে এভাবে একাকার হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ! মির্যা সাহেব তার লিখনীর এক জায়গায় মওলানা হোসাইন বাটালভি (রহ.)-কে “ফেরাউন” আখ্যা দিয়েছেন এবং সেই যুগের অন্য আরেক বিজ্ঞ আলেম মওলানা নজির হোসাইন (রহ.)-কে “হামান” আখ্যা দিয়েছিলেন। (রূহানী খাযায়েন ১২/১৩০, মালফুযাত ৪/২৪৪)।

মজার ব্যাপার হল, মির্যা সাহেব তার লিখনীর এক স্থানে নিজেকে সুস্পষ্টভাবে মূসা বলেও দাবী করে লিখে গেছেন। (রূহানী খাযায়েন ১৮/৫৩০)।

এখন প্রশ্ন হল, এমতাবস্থায় মির্যা কাদিয়ানী সাহেব নিজেই নিজের মিথ্যাচার আর মনগড়া যুক্তির কারণে নিজেই ধরা খেলেন কিনা? মওলানা আব্দুর রহমান লখভী সাহেব নিজে মূসা দাবী না করেও তিনি যদি মির্যার মৃত্যুর আগে ইন্তেকাল করাটা আপত্তিকর হয় তাহলে মির্যা কাদিয়ানী সাহেব নিজেকে “মূসা” দাবী করা সত্ত্বেও তারই ফেরাউন আখ্যা পাওয়া মওলানা হোসাইন বাটালবী (রহ.)-এর অনেক আগেই তিনি মারা গেলেন কেন? মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর অভিশাপ। আল্লাহ আমাদের ঈমান ও দ্বীনকে এইরকম জঘন্য মিথ্যাবাদী থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

কুরআনের মাপকাঠিতে হাদীস গ্রহণের নীতি কেন পরিত্যাজ্য

এই বিষয়ে লিখতে হবে আগে কখনো ভাবিনি। সম্প্রতি কথিত আহলে কুরআন তথা হাদীস অস্বীকারকারী এক নব্য ফেতনার উদ্ভব হয়েছে, যদিও এই ফেতনা আগেও ছিল; তবে তারা আগে একদমই বিস্তার লাভ করেনি, বড়জোর ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরের ফ্রেমে বন্দী ছিল। স্যোসাল মিডিয়ার এই সময়টিতে এই ফেতনা যেন কোমরে গামছা বেঁধে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে হাদীসকে বাতিল সাব্যস্ত করতে।

এবার দেখুন, হাদীস বিরোধী অপপ্রচারকারীদের সম্পর্কে যুগশ্রেষ্ঠ আয়েম্মায়ে কেরাম কী বলে গেছেন। ইমাম খাত্তাবী (রহ.) তার শরহে সুন্নাহ কিতাবে বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, যারা বলে কুরআনের মাপকাঠিতে হাদীস গ্রহণ করতে হবে, নিশ্চয়ই তাদের এইধরণের কথা যিনদীক তথা ধর্মদ্রোহীরাই গড়েছে (দেখুন, শরহে সুন্নাহ ৪/২৯৯, ইমাম খাত্তাবী)।

অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, এধরণের অপপ্রচার আজ নতুন নয়, প্রত্যেক যুগেই হাদীসের উপর আক্রমণ হয়েছিল, সামনেও হতে থাকবে, শুধু আক্রমণের ধরন পাল্টিবে। কাজেই কোনো মুসলমানের জন্য উচিত হবেনা তাদের অপপ্রচারে কান দেয়া। এ বিষয়ে অনেক পূর্ব থেকে আয়েম্মায়ে কেরাম দুনিয়াকে সাবধান করে গেছেন।

ইমাম খাত্তাবী (রহ.)-এর কিতাব থেকে স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য।

وفي الحديث دلالة على أنه لا حاجة بالحديث إلى أن يعرض على الكتاب؛ فإنه مهما ثبت عن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان حجة بنفسه، و اما ما رواه بعضهم انه قال اذا جاءكم الحديث فأعرضوه على كتاب الله فإن وافقه فخذوه و إن خالفه فدعوه فإنه حديث باطل لا اصل له. و قد حكى زكريا ابن يحيى الساجى عن يحيى ابن معين انه قال هذا حديث وضعته الزنادقة.

অর্থাৎ হাদীসের প্রামাণিকতার জন্য তাকে কুরআনের মুকাবিলায় উপস্থাপন করার কোনোই প্রয়োজন নেই। নিশ্চয়ই এটি রাসূল (সা.) হতে যখনি সাব্যস্ত হয়ে যাবে তখনি তা নিজেই প্রমাণযোগ্য হয়ে যাবে। তবে কেউ কেউ বলেছে যে, যখন তোমাদের নিকট হাদীস পেশ হবে তখন তোমরা তা কিতাবুল্লাহ’র মুকাবিলায় উপস্থাপন করবে। তারপর সেটি কিতাবুল্লাহ’র মুতাবেক হলে তোমরা গ্রহণ করবে আর যদি বিরোধী হয় তখন তোমরা তা পরিত্যাগ করবে, কেননা এমতাবস্থায় এই হাদীস বাতিল ও ভিত্তিহীন। অথচ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (রহ.) হতে যাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া আস সাজি বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই এইধরণের কথা যিনদীক তথা ধর্মদ্রোহীরাই গড়েছে

ইমাম ইবনে হাজম (রহ.)ও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে কোনো সহীহ হাদীসই কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।

ليس في الحديث الذي صح شيء يخالف القرآن الكريم ولا سبيل إلى وجود خبر صحيح مخالف لما في القرآن أصلاً، وكل خبر شريعة فهو إما مضاف إلى ما في القرآن ومعطوف عليه ومفسر لجملته، وإما مستثنى منه لجملته، ولا سبيل إلى وجه ثالث

অর্থাৎ সহীহ হাদীসের কোনো কিছুই কুরআনুল কারীমের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কুরআনের বিপরীতে এমন কোনো সহীহ হাদীসের কখনো অস্তিত্বই থাকার সুযোগ নেই। শরীয়ত সংক্রান্ত যত বর্ণনা রয়েছে তা হয়ত কুরআনের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত ও সংযোজিত এবং বিশ্লেষণকারী, অথবা কুরআনের বিষয়বস্তুর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। এর বাহিরে তৃতীয় আর কোনো পথ নেই। (দেখুন, আল আহকাম ফী উসূলিল আহকাম ২/২১৫-২১৬)।

সর্বসাধারণ মুসলিম উম্মাহার খেদমতে কিছু কথা বলে রাখা জরুরি। তা হচ্ছে, ইসলাম মানে শুধু কুরআন হলে আল্লাহ বলতেন না ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো।’ (সূরা মায়িদাহ, আয়াত ৯২)। ‘যে রাসূলের আনুগত্য করলো সে আল্লাহর আনুগত্য করলো।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৮০)।

আমাদের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত যে, মহান আল্লাহ শুধু কিতাব পাঠাননি, তিনি কিতাবের সাথে ব্যাখ্যাতাও (রাসূল সা.) পাঠিয়েছেন।

সুতরাং একটি মেনে অপরটি অস্বীকার করা মানে ইসলামকে আংশিক মানা আর আংশিক অস্বীকার করা। বরং হাদীস অস্বীকার করলে কুরআন অস্বীকারের রাস্তাই খুলে যায়। হাদীস অস্বীকারকারীরা কুরআনের সাথে যেভাবে হাদীসের সাংঘর্ষিকতা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেন, ঠিক একইভাবে কুরআনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের সাংঘর্ষিকতা দেখানো যায়। একজন কোনো বই থেকে শিখেছে, দুই যোগ দুই চার হয়। হঠাৎ সে একই বইয়ে তিন যোগ এক চার হওয়ার কথা জেনে আশ্চর্য হওয়া মানুষের মতো অনেকটা হাদীস অস্বীকারকারীদের দশা। হাদীস অস্বীকারকারীদের একটা ধূর্ততা হলো, তারা সরাসরি হাদীস অস্বীকারের কথা বলে না। কুরআনের সাথে হুবহু মিলে এমন হাদীসগুলো মানার কথা বলেন তারা। মূলত শুধু এই শ্রেণীর হাদীস গ্রহণ করা আর না করার মধ্যে পার্থক্য থাকে না। শুধু কুরআন থেকে সালাতের কোনো বিবরণ তো পরের কথা সালাতের আগের কাজ—আযান ও পবিত্রতার পদ্ধতিও প্রমাণ করা যাবে না। প্রয়োজন হবে হাদীসের। যাকাত ও অন্য সব বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য।

মূলত, কুরআনকে যদি থিওরি বলা হয় তাহলে হাদীসকে তার প্র্যাক্টিক্যাল বলা যায়। সারা বিশ্বের সব যুগের সব আলিম ও ইমাম হাদীস অস্বীকারকারীদের ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার ব্যাপারে একমত। হাদীস সংকলন, রিজালশাস্ত্র ও জরাহ-তা’দীল প্রভৃতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখা কোনো মানুষ হাদীসের প্রামাণ্যতা অস্বীকার করতে পারে না। ইসলামের প্রথম দুই শতকে কেউ হাদীসকে শরীয়তের দলিল হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানায়নি। হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষের দিকে এসে সর্বপ্রথম মুতাযিলা সম্প্রদায় হাদিসকে অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখায়।

পরবর্তী যুগের অস্বীকারকারীরা এক্ষেত্রে মূলত মুতাযিলাদেরকেই অনুসরণ করছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হাদীস অস্বীকারকারী নামধারী আহলে কুরআনের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।

মুহাম্মদ (সা.) দ্বিতীয়বার জীবিত হয়ে দুনিয়ায় আসা

মির্যা কাদিয়ানীর পুত্র ও তার তথাকথিত মুসলেহ মওউদ মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ এ কি লিখলেন দেখুন,

بلکہ قرآنی اصطلاح میں ہم کہہ سکتے ہیں کہ محمد صلی الله علیہ وسلم دوبارہ زندہ ہو کر تشریف لے آئے اور یہ ایک بہت بڑے عزت کی بات ہے

অর্থাৎ বরং কুরআনের পরিভাষায় আমরা বলে থাকি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার জীবিত হয়ে (দুনিয়ায়) আগমন করবেন এবং এটি (তাঁর জন্য) অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার। (খুতুবাতে মাহমুদ পৃ-২৭৫, সন ১৯৪০ ইং, মির্যাপুত্র মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

পরিশেষে আমি শপথ করে বলতে পারি, কাদিয়ানী মতবাদের সাধারণ অনুসারীরা কাদিয়ানীবাদের এ সমস্ত কুফুরী সম্পর্কে জানেই না। ফলে তারা ইমাম মাহদীর কনসেপ্ট-এর উপর সম্পূর্ণ চোখবন্ধ করেই মির্যায়ীদের দলে যোগ দিয়েছে। অথচ আল্লাহর রাসূল (সা.) ইমাম মাহদী সংক্রান্ত যতগুলো হাদীসে ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে গেছেন তন্মধ্যে একটি হাদীসও মির্যা কাদিয়ানীর সাথে যায়না। মোটকথা, কাদিয়ানী মতবাদ এক দিকে জঘন্য কুফুরী মতবাদ, অপরদিকে ইসলামের মূলধারার শিক্ষা থেকে পুরোপুরি খারিজ। আমার অনুরোধ রইল, দয়া করে ব্যাপারটিতে সবাই সিরিয়াস হবেন এবং সত্যটা যাচাই-বাছাই করে তাবৎ ধোকা এবং প্রতারণার পথ থেকে ফিরে আসবেন। ওয়ামা আ’লাইনা ইল্লাল বালাগ।

  • মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী থেকে পবিত্র কুরআনের সূরা জুম’আ এর ২ এবং ৩ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা দ্বারাও মুহাম্মদ (সা.) দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় ফিরে আসার দলিল ও আমাদের পক্ষ হতে তার খণ্ডনমূলক উত্তর এখানে দেখুন!

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ঈসা (আ.) এই টেকনোলজির যুগে আসলে এগুলো শিখবেন কার কাছ থেকে?

প্রশ্ন : আগের সেই ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আবার যদি আসেন তাহলে তো তাঁকে আধুনিক যুগের সব নিয়ম-কানুন নতুন করে শিখতে হবে, তিনি হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন, আর এখন সেই ভাষা প্রায় বিলুপ্ত; তাহলে তিনি আবার এলে নতুন কোনো ভাষা শিখবেন কার কাছ থেকে? ইত্যাদি ইত্যাদি!

উত্তর : প্রথমত, প্রশ্নকারীর প্রশ্নটাই সঠিক নয়। কেননা কোনো ধার্মিক বা বিশ্বাসীর পক্ষে এমন ধরণের চিন্তা করাই অসম্ভব, বরং এধরণের প্রশ্ন শুধুই নাস্তিক কিবা ধর্মদ্রোহী অবিশ্বাসীদের পক্ষেই মানায়। জনৈক প্রশ্নকর্তা কাদিয়ানী মতবাদের অনুসারী হয়ে এধরণের প্রশ্ন যখন করেন তখন তিনি কিজন্য নিজেদের ঐ বিশ্বাসটিও ভুলে যান যে, ঈসা (আ.) জেরুজালেম ছেড়ে ভারতের কাশ্মীরের শ্রীনগরেও গিয়েছিলেন এবং আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। এমতাবস্থায় তাদের উদ্দেশ্যে একই প্রশ্ন তো আমাদেরও যে, হিব্রুভাষী হযরত ঈসা (আ.) কাশ্মীরে গিয়ে কোন ভাষায় কথা বলেছিলেন? অবশ্যই হিব্রু ভাষায় নয় বরং কাশ্মীরীদের ভাষায় কথা বলেছিলেন! তো কাশ্মীরী ভাষা তিনি কার কাছ থেকে শিখলেন?

  • প্রসঙ্গত, ১৯২২ সালে হিব্রু ব্রিটিশ প্যালেস্টাইনের সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়। ইসরায়েলে প্রায় ৫০ লক্ষের বেশি লোক হিব্রু ভাষায় কথা বলেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রায় কয়েক লক্ষ লোক হিব্রুতে কথা বলেন। বর্তমানে আরবির পাশাপাশি হিব্রু ইসরায়েলের সরকারি ভাষা। সুতরাং হিব্রু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমন দাবী কাদিয়ানীদের হয়ত অজ্ঞতা আর নয় কাঁচা মিথ্যাচার! (ফেইসবুক থেকে)।

আসুন, প্রশ্নকারীর যুক্তির প্রতিউত্তরে এবার দুই-এক্কান কথা বলি! আল্লাহতালা এক রাত্রিতেই প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীকে নেতৃত্বের যোগ্য করে পাঠানোর কথা সহীহ হাদীসে (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৩১৬) (يُصْلِحُهُ اللَّهُ فِي لَيْلَةٍ) বর্ণিত থাকাই কি ইংগিত করেনা যে, তিনি হযরত ঈসা (আ.)-কেও যুগের দাবী মোতাবেক যোগ্য করে যথাসময়ে আকাশ থেকে ফেরেশতাদ্বয়ের মাধ্যমে দুনিয়ায় পাঠাবেন! জ্ঞানীদের জন্য নবীকরীম (সা.)-এর ইংগিতপূর্ণ বাণীসমূহের আলোকে শিক্ষা লাভ করা যথেষ্ট নয় কি? আহা! নির্বোধরা আল্লাহর কুদরতেরও পরীক্ষা নিতে চায়! নাউযুবিল্লাহ।

তর্কের খাতিরে মানলাম যে, ঈসা (আ.) আধুনিক এই যান্ত্রিক যুগে আগমন করলে তিনি এগুলা শিখবেন কার কাছ থেকে? প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য হল, এইধরণের যুক্তি দিয়ে বনী ইসরাইলের প্রতি প্রেরিত ঈসা (আ.)-কে মৃত বলে সাব্যস্ত করা ও তদস্থলে মির্যা কাদিয়ানীকে রূপক ঈসা বলে প্রতিষ্ঠিত করা। মনে হচ্ছে যুক্তিতে তিনি অক্করে শিরোপা জিত্তা ফেলাইছেন!

এবার আপনাকে আমার প্রশ্ন, হযরত ঈসা (আ.)-এর আগমন যে আধুনিক এই যান্ত্রিক যুগেই হবে, আপনি এই সংবাদটা আমদানি করলেন কোত্থেকে? আধুনিক এই যান্ত্রিক সভ্যতার যে কখনো বিলুপ্তি হবেনা এবং এই যুগটা যে তীর ধনুক আর বর্শার যুগে উপনীত হবেনা; আপনারে এমন গ্যারান্টি কে দিল?

ঈসা (আ.) তীর ধনুক আর বর্শার সভ্যতার যুগেই দুনিয়ায় ফিরে আসবেন বলে হাদীস শরীফে পরিষ্কার ইংগিত দেয়া হয়েছে। যেমন, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,

فعند ذلك ينزل أخي عيسى ابن مريم من السماء على جبل أفيق، إماماً هادياً، وحكماً عادلاً، عليه برنس له بيده حربة يقتل الدجال فإذا قتل الدجال تضع الحرب أوزارها

অর্থাৎ এমন সময় হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) আকাশ থেকে একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম আর ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে (দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে শ্বেত মিনারার নিকটে) সমতল একটি পাহাড়ের উপর অবতরণ করবেন। যার পরণে থাকবে লৌহবর্ম এবং হাতে থাকবে (বর্শা বা বল্লম ধরনের) যুদ্ধাস্ত্র। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তিনি যখন দাজ্জালকে হত্যা করবেন তখন যুদ্ধ তার সমস্ত সরঞ্জাম গুটিয়ে নেবে। (তারীখে দামেস্ক ৪৭/৫০৫ ইবনে আসাকীর, কাঞ্জুল উম্মাল ১৪/৪১৯)।

এখন আমরা কি আপনার যুক্তি মেনে রাসূল (সা.)-এর উক্ত তীর ধনুক আর বর্শার সভ্যতার যুগেই (عليه برنس له) ঈসার আগমনী কনসেপ্ট বা ভবিষ্যৎবাণীকে মিথ্যা আখ্যা দেব? নাউযুবিল্লাহ। স্ক্রিনশট :-

জাবালে আফিক বা সমতল পাহাড় প্রসঙ্গ :

উল্লিখিত হাদীসে ‘জাবালে আফিক’ একখানা উপবাক্য রয়েছে। আসুন জেনে নিই এটির ভৌগোলিক অবস্থান কোথায়? উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ (রা.) এর বর্ণনা হতে এর পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে বর্ণিত আছে যে, এটি এমন একটি সমতল পাহাড় যেখান থেকে আল্লাহতালা ঈসা (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। অনুবাদসহ হাদীসটি এই যে,

عن صفية أم المؤمنين رضي الله عنها أنها كانت إذا زارت بيت المقدس، وفرغت من الصلاة في المسجد الأقصى: صعدت على جبل زيتا فصلت عليه وقالت: هذا الجبل هو الذي رفع منه عيسى عليه السلام إلى السماء، وكانت النصارى يعظمون ذلك الجبل، وكذلك اليوم يعظمونه. {التصريح بما تواتر في نزول المسيح (ص: 258) للهندي}

অর্থাৎ একদা উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ (রা.) বায়তুল মোকাদ্দাস পরিদর্শনে যান। মসজিদে আকসায় সালাত শেষে তিনি সুদূর দিগন্তে অবস্থিত একটি সমতল পাহাড়ে আরোহন করে সেখানেও সালাত আদায় করেন। তিনি (সাক্ষ্য দিয়ে) বলেন, এটি সেই পাহাড় যেখান থেকে ঈসা (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। খ্রিস্টান জাতি এই পাহাড়টির খুবই সম্মান করেন এবং বর্তমানেও তারা পাহাড়টিকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। {আত তাসরীহ বিমা তাওয়াতারা ফী নুযূলিল মাসীহ, পৃষ্ঠা নং ২৫৮ (সাইয়েদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. আল-হিন্দী)}।

উম্মুল মুমিনীন (রা.)-এর উল্লিখিত সাক্ষ্য হতেও সুস্পষ্ট হয় যে, ঈসা (আ.)-এর অবতরণ স্থল দামেস্কের ভূখণ্ডেই ও বায়তুল মোকাদ্দাস এলাকার সুদূর দিগন্তে অবস্থিত একখানা সমতল পর্বতমালা। সত্যান্বেষণকারীদের জন্য সত্য উপলব্ধি করতে এটুকুই যথেষ্ট নয় কি?

সহীহ বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়া পর্বে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) শপথ বাক্য সহ (والذى نفسي بيده) ঈসা (আ.) এর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী দিয়েছেন। এখন আপনি কি বলতে চান যে, তিনি (সা.) ঐ ভবিষ্যৎবাণী দ্বারা দুনিয়াকে মিথ্যা বার্তা দিয়ে গেছেন? নাউযুবিল্লাহ। গত দুই হাজার বছরধরে পৃথিবীর প্রায় সবাই নবীগণের কবর সম্পর্কে তথ্য দিয়ে গেলেও সবাই ঈসা (আ.)-এর কবর না থাকা সম্পর্কে একমত।

এতে কী বুঝা যায়? এখন দুনিয়ার এই শেষ সময় এসে এমন কোনো মতবাদ দাঁড় করতে চাওয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত যা পূর্বেকার প্রতিটি যুগের মানুষের সর্বসম্মত বিশ্বাসের বিরোধী! আছে কি কেউ এই কথাগুলোর যৌক্তিক জবাব দেবেন?

কিন্তু এরপরেও যারা বুঝতে চায় না, বুঝার ইচ্ছেও নেই যাদের; আমি তাদেরকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করছি।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

ইমামগণের রচনায় খতমে নবুওয়ত প্রসঙ্গ ও ভ্রান্তি নিরসন

ইমামগণের কিতাব থেকে কাদিয়ানীদের কিছু প্রসঙ্গবহির্ভূত উদ্ধৃতি ও আমাদের পর্যবেক্ষণ

কাদিয়ানীদের রচনা হতে,

[১] হযরত ইমাম আব্দুল ওয়াহাব শি’রানি (রহ.) বলেন, قَوْلُہٗ صَلَّی اللّٰہُ عَلَیْہِ وَ سَلَّمَ فَلَا نَبِیَّ بَعْدِیْ وَلَا رَسُوْلَ الْمُرَادُ بِہٖ مُشْرِعَ بَعْدِیْ অর্থ নবীকরীম (সা.)-এর “আমার পর আর কোনো নবী নেই, রাসূলও নেই” (فَلَا نَبِیَّ بَعْدِیْ وَلَا رَسُوْلَ) একথার অর্থ হল, আমার পর শরীয়তধারী আর কোনো নবী নেই। (আল-ইয়াওয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খণ্ড ২ পৃষ্ঠা ২৪)।

[২] সাইয়েদ আব্দুল করিম জিলানী (রহ.) বলেন, فَانْقَطَعَ حُکْمُ نُبُوَّۃِ التَّشْرِیْعِ بَعْدَہٗ وَکَانَ مُحَمَّدٌ ﷺ خَاتَمَ النَّبِیّیْنَ لِاَنَّہٗ جَآءَ بِالْکَمَالِ وَلَمْ یَجِیئْ اَحَدٌ بِذٰلِکَ অর্থ নবুওয়তে তাশরিয়ীর বিধান তাঁর (সা.) পরে শেষ হয়ে গেছে। অধিকন্তু মুহাম্মদ (সা.) নবীগণের খাতাম (সমাপ্তি) ছিলেন। কারণ তিনি শরীয়তের পূর্ণতা দিতে এসেছেন। এভাবে আর কেউই (ইতিপূর্বে) আসেনি। (আল ইনসানুল কামেল ১/৭৫, অধ্যায় নং ৩৬)।

[৩] হযরত মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন, فَلاَ یُنَاقِضُ قَوْلُہٗ خَاتَمَ النَّبِیِّیْنَ اِذِ الْمَعْنَی اَنَّہٗ لاَ یَاتِیْ نَبِیٌّ یَنْسَخُ مِلَّتَہٗ وَ لَمْ یَکُنْ مِنْ اُمَّتِہٖ অর্থ… তাঁর (সা.) ঐ ভবিষ্যৎবাণী খাতামান্নাবীঈনের অর্থে কোনো বিরোধ সৃষ্টি করেনা। কেননা এর অর্থ হল, নবীকরীম (সা.) এর পর এমন কোনো নবী আসবেন না যিনি মহানবী (সা.)-এর দ্বীনকে রহিত করবেন, যেহেতু তিনি (অর্থাৎ ঈসা) তাঁর উম্মতের মধ্য থেকে নন। (মওযুআতে কবীর [তথা জাল হাদীসের বিশাল সংকলন ভাণ্ডার], পৃষ্ঠা: ৫৮-৫৯)।

[৪] হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) বলেন, خُتِمَ بِہِ النَّبِیُّوْنَ اَیْ لَا یُوْجَدُ بَعْدَہٗ مَنْ یَأمُرُہُ اللّٰہُ سُبْحَانَہٗ بِالتَّشْرِیْعِ عَلَی النَّاسِ অর্থ নবীকরীম (সা.) এর মাধ্যমে সকল নবীর (আগমনী ক্রমধারা) শেষ হয়ে গেছে অর্থাৎ, তাঁর পর কোনো এমন ব্যক্তি আর হবেনা যাকে আল্লাহতালা শরীয়তসহ মানুষের কাছে প্রেরণ করবেন। (তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ, তাফহীম নং ৫৪, পৃষ্ঠা ৮৫)।

[৫] হযরত মুহিউদ্দিন ইবনে আরবী (রহ.) বলেন, وَ ھٰذَا مَعْنٰی قَوْلِہٖ ﷺ اِنَّ الرَّسَالَۃَ وَالنُّبُوَّۃَ قَدِ انْقَطَعَتْ فَلَا رَسُوْلَ بَعْدِیْ وَ لَا نَبِیَّ اَیْ لَا نَبِیَّ بَعْدِیْ یَکُوْنُ عَلٰی شَرْعٍ یُخَالِفُ شَرْعِیْ بَلْ اِذْ کَانَ یَکُوْنُ تَحْتَ حُکْمِ شَرِیْعَتِیْ۔ অর্থ নবুওয়ত এবং রিসালাতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সুতরাং আমার পর কোনো রসূল নেই, নবীও নেই। এর মর্মার্থ হল, আমার পর এমন কোনো নবী নেই, যে আমার শরীয়তের বিপরীতে (নতুন শরীয়তের অনুসারী) হবেন। বরং যখন হতে যাবে (ঈসার আগমনের দিকে ইংগিত) তাহলে তিনি আমার শরীয়তের অধীনে হবেন। (ফতুহাতে মক্কীয়াহ্, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩)।

[৬] ইমাম তাহের পাটনী (রহ.) বলেছেন, وَھٰذَا اَیْضًا لَا یُنَافِیْ حَدِیْثَ لَانَبِیَّ بَعْدِیْ لِاَ نَّہٗ اَرَادَ لَا نَبِیَّ یَنْسَخُ شَرْعَہٗ অর্থ এই হাদীসও ‘আমার পর আর কোনো নবী নেই’ কথাটির বিরোধী নহে। কেননা একথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাঁর শরীয়ত রহিত করতে পারে এমন নবী নেই। (মাজমাউল বিহারিল আনওয়ার পৃষ্ঠা ৮৫)।

ইমামগণের খণ্ডিত উক্তি সমূহ হতে কাদিয়ানীদের প্রমাণ করা উদ্দেশ্য হল, মির্যা কাদিয়ানীও একজন নবী, তবে তিনি শরীয়তবাহক নবী নন। যেহেতু হাদীসে শুধুমাত্র শরীয়তবাহক নবী আগমনকেই নিষেধ করে! নাউযুবিল্লাহ।

আমাদের পর্যবেক্ষণ :

এবার আমরা তাদের উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলোর উপর পাঠকদের সাথে পর্যবেক্ষণমূলক প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ফিরে যেতে চাই! তার আগে নবুওয়তের ধারাক্রম অব্যাহত থাকার দাবীদার কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি সহীহ হাদীস পেশ করব এবং তারই ভিত্তিতে কয়েকটি প্রশ্ন রাখব!

[১] হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, وَأُرْسِلْتُ اِلی الْخَلْقِ کَافَّةً، وَخُتِمَ بِیَ النَّبیُّوْنَ অর্থ আমি সমগ্র সৃষ্টির জন্য প্রেরিত হয়েছি এবং আমার মাধ্যমে নবীগণের সমাপ্তি ঘটেছে। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল মাসাজিদ, হাদীস নং ১০৫৪)।

[২] হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, كَانَتْ بَنُوْ إِسْرَائِيْلَ تَسُوْسُهُمْ الأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِيْ وَسَيَكُوْنُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُوْنَ অর্থ বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের উম্মাতকে শাসন করতেন। যখন কোনো একজন নবী মারা যেতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোনো নবী নেই। তবে অনেক খলীফাহ্ হবে। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া হাদীস নং ৩৪৫৫, তাওহিদ প্রকাশনী)।

[৩] হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন, سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لَمْ يَبْقَ مِنْ النُّبُوَّةِ إِلاَّ الْمُبَشِّرَاتُ অর্থ আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মুবাশশ্বিরাত ব্যতীত নবুওয়তের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৯০)। এই ‘মুবাশ্বশিরাত’ (مُبَشِّرَاتِ) এর মর্মার্থ সুস্পষ্ট করে আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, لَمْ يَبْقَ مِنَ النُّبُوَّةِ إلَّا المُبَشِّراتُ. قالوا: وما المُبَشِّراتُ؟ قالَ: الرُّؤْيا الصَّالِحَةُ অর্থাৎ মুবাশ্বশিরাত ব্যতীত নবুওয়তের আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মুবাশ্বশিরাত কী? তিনি (সা.) বললেন, সত্য স্বপ্ন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৯০)।

[৪] হযরত আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, یٰا أَبَا ذَرٍ أَوَّلُ الْاَنْبِیَاء آدَمُ وَآخِرُہ مُحَمَّدٌ অর্থ ‘হে আবু যর! সর্বপ্রথম নবী ছিলেন আদম আর সর্বশেষ নবী হচ্ছে মুহাম্মদ।’ ইমাম দায়লামী (রহ.) সংকলিত আল-ফেরদাউস বি-মাছূরিল খিতাব (الفردوس بمأثور الخطاب للدیلمی), ১/৩৯, হাদীস নং ৮৫।

[৫] হযরত উকবাহ ইবনে আমের (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, لَوْ كَانَ بَعْدِي نَبِيٌّ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ অর্থ আমার পরবর্তীতে কেউ নবী হলে অবশ্যই উমর ইবনুল খাত্তাবই নবী হতেন। (তিরমিযি হাদীস নং ৩৬৮৬, সহীহ)।

আকীদায়ে খতমে নবুওয়ত সম্পর্কিত ২০টি সহীহ হাদীস পড়তে এখানে ক্লিক করুন!

প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো :

প্রশ্নগুলো এই যে, উপরে উল্লিখিত হাদীসগুলোর উপর আপনাদের যদি বিশ্বাস থাকে তাহলে বলুন তো, রাসূল (সা.) খোদ নিজেই যেখানে মুক্ত অর্থে নিজেকে শেষনবী বলে আমাদের সংবাদ দিয়ে গেলেন, সেখানে নবুওয়তের ক্রমধারা অব্যাহত বলার স্পর্ধা দেখাতে পারে এমন সাধ্য কার? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিক্ষার বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলেও তাতে কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিক্ষা বাতিল হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই না। তাহলে আপনারা রাসূল (সা.)-এর শিক্ষার বিপরীতে এমন সব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উপর কিভাবে আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারলেন যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিক্ষাকে বাতিল করে দেয়? বলাবাহুল্য, রাসূল (সা.) এর যুগেও কয়েকজন নবুওয়তের দাবী করেছিল। মুসায়লামা তন্মধ্যে একজন। তার সম্পর্কে বর্ণনায় এসেছে যে, তার অনুসারীদের আযান এবং সালাতেও ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ‘ উচ্চারিত হত (প্রমাণ এখানে)। এর মানে এটা পরিষ্কার কথা যে, মুসায়লামা নিজেও শরীয়তবিহীন নবী দাবীদার ছিল। তা সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম তাকে ক্ষমা করেননি, তার নবুওয়ত দাবীর ব্যাখ্যা চাননি; তলোয়ারের ভাষায় তাকে সমুচিত জবাব দেয়া হয়। কাজেই, এবার শরীয়তবিহীন নবী আসার এই কাদিয়ানী-কনসেপ্ট উক্ত ঘটনা হতেও বাতিল হয়ে গেল কিনা? (সহজে কাদিয়ানী চেনার উপায় জানুন)।

এবার হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন যে, তাহলে কি ইমামগণ ঐ সমস্ত ব্যাখ্যায় ভুল করেছেন? উত্তরে বলব, আপনি কি ঐ সকল ইমামের সম্পূর্ণ বক্তব্য পড়ে দেখেছেন? দেখেননি! এমনকি আপনি ঐ সমস্ত ইমামের কিতাবগুলো থেকে আকীদায়ে খতমে নবুওয়ত সংক্রান্ত আলোচনাও পড়ে দেখেননি যে, তারা খতমে নবুওয়তের উপর উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ইজমা কীরূপ শব্দচয়নে লিখে গেছেন! তাহলে জেনে নিন, মুহাম্মদ (সা.)-এর পর নবুওয়ত দাবীদারগণ উম্মতে মুসলিমার ইজমা মতে ‘কাফের’ হওয়া সম্পর্কে,

ইমাম ইবনে হাজার আল হাইছামী (الإمام ابن حجر الهيتمي) (রহ.) উম্মতে মুসলিমার ইজমা উল্লেখপূর্বক লিখেছেন, من اعتقد وحيًا من بعد محمد صلى الله عليه وآله وسلم كان كافرًا بإجماع المسلمين অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.)-এর পর যে ব্যক্তি নবুওয়তে ওহী লাভ করার বিশ্বাস পোষণ করবে সে মুসলিম উম্মাহার সর্বসম্মতভাবে কাফের। (আল ফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাতুল কোবরা [الفتاوى الفقهية الكبرى] ৪/১৯৪, আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া হতে প্রকাশিত)।

সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল, যাদের খণ্ডিত বক্তব্যে আপনি/আপনারা বিভ্রান্তি ছড়ান তাদের প্রত্যেকের বিশ্বাস ছিল যে, ঈসা (আ.) জীবিত, আল্লাহ তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। শেষযুগে তিনিই যথাসময়ে ফিরে আসবেন। মূলত সে কথারই খোলাসা করতে তারা উপরিউক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অবতারণা করেছেন! আফসোস যে, আপনারা প্রসঙ্গ এড়িয়ে তাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছেন! আপনারা শায়খ ইবনে আরাবী (রহ.)-এর ‘ফতুহাতে মাক্কিয়াহ’ গ্রন্থের যে পৃষ্ঠার খণ্ডিত বক্তব্যে নবুওয়তের ক্রমধারা অব্যাহত থাকার দলিল দেন সেই একই পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ বক্তব্যটি পড়ে দেখলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে, আপনারা (অর্থাৎ কাদিয়ানীরা) কিভাবে দরাকে সরা বানিয়ে দুনিয়ার সহজ সরল মানুষদের ঈমান নষ্ট করছে!

শায়খ ইবনে আরাবী (রহ.) লিখেছেন, وهذا معنى قوله صلى الله عليه وسلم إن الرسالة والنبوة قد انقطعت فلا رسول بعدي ولا نبي أي لا نبي بعدي يكون على شرع يخالف شرعي بل إذا كان يكون تحت حكم شريعتي ولا رسول أي لا رسول بعدي إلى أحد من خلق الله بشرع يدعوهم إليه فهذا هو الذي انقطع وسد بابه لا مقام النبوة فإنه لا خلاف إن عيسى عليه السلام نبي ورسول وأنه لا خلاف أنه ينزل في آخر الزمان حكما مقسطا عدلا بشرعنا لا بشرع آخر ولا بشرعه الذي تعبد الله به بني إسرائيل من حيث ما نزل هو به بل ما ظهر من ذلك هو ما قرره شرع محمد صلى الله عليه وسلم ونبوة عيسى عليه السلام ثابتة له محققة فهذا نبي ورسول قد ظهر بعده صلى الله عليه وسلم وهو الصادق في قوله إنه لا نبي بعده

অর্থাৎ রাসূল (সা.)-এর বাণী إن الرسالة والنبوة قد انقطعت فلا رسول بعدي ولا نبي (অর্থাৎ নিশ্চয়ই নবুওয়ত এবং রেসালতেরধারা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আমার পর আর কোনো রাসূল নেই, নবীও নেই)—একথার অর্থ হচ্ছে, আমার পর কোনো প্রকারের শরীয়তবাহক নবী নেই যে আমার শরীয়তের বর-খেলাফ করবেন বরং যখনই হতে যাবে তখন সে আমার শরীয়তের বিধিবিধানের অধীনে হবে এবং ‘ওয়া লা রাসূলা বা’দী’—একথার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ’র সৃষ্টির প্রতি এমন কোনো রাসূলও আর নেই যিনি স্বতন্ত্র শরীয়ত দ্বারা তাদেরকে তাঁর দিকে দাওয়াত দেবেন। যেহেতু এটি (নবুওয়ত এবং রেসালতেরধারা) বন্ধ এবং তার দ্বারও চিরতরে রূদ্ধ, (এখন) নবুওয়তের আর কোনো প্রকারের মাক্বাম (স্তর)-ই অবশিষ্ট নেই। ফলে ঈসা (আ.) একজন নবী ও রাসূল থাকাটা (লা নাবিয়্যা বা’দী’ শীর্ষক হাদীস অংশের) বিরুদ্ধে যায় না। নিশ্চয়ই ঈসা (আ.) একজন ন্যায়পরায়ন শাসক হিসেবে শেষ যামানায় আমাদের শরীয়তের উপরই নাযিল হবেন। তিনি ভিন্ন কোনো শরীয়ত কিবা ওই শরীয়ত নিয়েও আসবেন না, যা তার প্রতি নাযিল হয়েছিল এবং ইসরাইল জাতি যেই শরীয়তের উপর আল্লাহ’র ইবাদত বন্দেগী করেছিল। বরং তাঁর পক্ষ থেকে শরীয়তে মুহাম্মদী-ই প্রকাশ পাবে যেটি তাঁর জন্য (পূর্ব থেকে) স্থির রয়েছে। পক্ষান্তরে নবুওয়তে ঈসা (তাঁর দ্বিতীয়বার আগমনের পর) স্থির ও বহাল থাকবে। কেননা তিনি-ও একজন নবী ও রাসূল ছিলেন। তাঁর পরেই হযরত সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আবির্ভাব ঘটেছিল। যিনি স্বীয় বাণী : إنه لا نبي بعده (অর্থাৎ নিশ্চয়ই তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই) বাণীতে একজন সত্যবাদী।” (অনুবাদ শেষ হল)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি :-

শায়খ মহী উদ্দিন ইবনে আরাবী (রহ.) এর সম্পূর্ণ বক্তব্যের খোলাসা দাঁড়ায় :

(ক) فهذا هو الذي انقطع وسد بابه لا مقام النبوة অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের পর নবুওয়তের আর কোনো প্রকারের মাক্বাম (স্তর)-ই অবিশিষ্ট নেই। কেননা তাঁর নবুওয়তপ্রাপ্তির মাধ্যমে বর্তমানে সকল প্রকারের নবুওয়ত ও রেসালতের দ্বার চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।

(খ) فإنه لا خلاف إن عيسى عليه السلام نبي ورسول وأنه لا خلاف أنه ينزل في آخر الزمان حكما مقسطا عدلا بشرعنا لا بشرع آخر ولا بشرعه الذي تعبد الله به بني إسرائيل من حيث ما نزل هو به অর্থাৎ ফলে ঈসা (আ.) একজন নবী ও রাসূল থাকাটা (লা নাবিয়্যা বা’দী’ শীর্ষক হাদীস অংশের) বিরুদ্ধে যায় না। নিশ্চয়ই ঈসা (আ.) একজন ন্যায়পরায়ন শাসক হিসেবে শেষ যামানায় আমাদের শরীয়তের উপরই নাযিল হবেন। তিনি ভিন্ন কোনো শরীয়ত কিবা ওই শরীয়ত নিয়েও আসবেন না, যা তার প্রতি নাযিল হয়েছিল এবং ইসরাইল জাতি যেই শরীয়তের উপর আল্লাহ’র ইবাদত বন্দেগী করেছিল।

পাঠকবৃন্দ! ইবনে আরাবীর সম্পূর্ণ বক্তব্য কাদিয়ানীরা কিজন্য আপনাদের সামনে পেশ করতে চায় না তা এবার নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন!

পরিশেষে আমি বলতে পারি যে, ইবনে আরাবীর বক্তব্যটিকে প্রসঙ্গ ছাড়াই কাদিয়ানীরা পেশ করে থাকে। যাতে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে দলে টানতে পারে ও মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়ত দাবীকে হালাল করতে পারে! আমি এখানে শুধুমাত্র ইবনে আরাবী (রহ.)-এর নামে তারা যে ভ্রান্তি ছড়ায় সেটিরই জবাব দিয়েছি। সত্য কথা হল, কাদিয়ানীরা এভাবেই অন্য প্রায় সকল উলামায়ে কেরামের বক্তব্যের আগপাছ বাদ দিয়ে কিংবা প্রসঙ্গ এড়িয়ে উদ্ধৃতি পেশ করে থাকে। যাতে অল্প শিক্ষিত ও জেনারেল শ্রেণীর মানুষদের বিশ্বাসে সন্দেহ তৈরি করে কাছে টানতে পারে! আল্লাহ আমাদের সবাইকে এদের যাবতীয় অপপ্রচার থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
শিক্ষাবিদ ও গবেষক
তাং ১৩/১১/২০২২ইং

শাহজাদা ইউয আসেফ

আজকের এই লিখাটি পড়ে বুঝার আগে পাঠকের জন্য আরেকটি বিষয়ে জ্ঞান রাখা অপরিহার্য। সেটি হল, মির্যা কাদিয়ানীর দাবী হচ্ছে হযরত ঈসা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তাঁর কবর হল কাশ্মীরের শ্রীনগরে! প্রশ্ন করা হল, তাহলে সেখানকার কোন কবরটি ঈসা (আ.)-এর কবর? মির্যা কাদিয়ানীর ভাষ্যমতে, সেখানকার খানইয়ার মহল্লায় সমাহিত ‘ইউজে আসেফ’ নামীয় ব্যক্তিটাই মূলত ঈসা (আ.); তার কবরটাই হযরত ঈসা (আ.)-এর কবর! কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী সাহেব পরবর্তীতে নিজেই নিজের ঐ সমস্ত কথাবার্তার কারণে কিভাবে পাকড়াও হলেন তা জানতে সংক্ষিপ্ত লিখাটি পড়ুন! (মুসলমানদের আকীদা ঈসা মসীহকে আল্লাহ সশরীরে জীবিত উঠিয়ে নিয়েছেন, তিনি এখনও মৃত্যুবরণ করেননি)।

কে এই ইউজে আসেফ?

প্রাচীন যুগের কিছু বইপুস্তক হতে এই ইউজে আসেফ (Yuz Asef) নামীয় ব্যক্তির ধারণা পাওয়া যায়! সে একজন মুসলিম ধর্মপ্রাণ ও বুযূর্গ খোদাভীরু হিন্দুস্তানী রাজপুত্র (কামালুদ্দিন পৃ-৫২৭, আরবী নোসখা)। হিন্দুস্তানের প্রাচীন ইতিহাস বলে, তার পিতা ছিল ভারতবর্ষের প্রভাবশালী একজন মূর্তিপূজক। সে ছিল পিতার একমাত্র পুত্র যে কিনা পিতার পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করে একত্ববাদী খোদারধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেন। তার একত্ববাদী ধর্মের প্রতি ঝোঁকটা ছিল প্রাকৃতিকভাবে। যদিও কাকতালীয়ভাবে তৎকালীন হাকিম বলোহর নামীয় জনৈক ধর্ম-পণ্ডিত দ্বারা তিনি পরে খুব বেশি প্রভাবিত হন। আনুমানিক হিজরী প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীর এই ঘটনা।

বলাবাহুল্য, মির্যা কাদিয়ানী সাহেব ইউজে আসেফ বা ইউযে আসেফ নামীয় ব্যক্তিটির বিস্তারিত পরিচয় জানতে যে কিতাব দুটির রেফারেন্স দিয়ে গেলেন তন্মধ্যে ফার্সি ভাষার ‘আ’ইনুল হায়াত‘ কিতাবটি অন্যতম। সেটির এক স্থানে উল্লেখ আছে যে,

اسی زمانہ میں بادشاہ کے فرزند نرینہ تولد ہوا اور اتنی مسرت ہوئی کہ قریب مرگ ہوگیا۔ اور یقین ہوگیا کہ بت پرستی کا عطا کردہ یہ انعام ہے – ملک کا تمام خزانہ زینت و آرائش میں ختم کردیا – لوگوں کو ایک سال تک خوشی٫ شادی عیش و نشاط کا حکم عام ہو گیا – فرزند ارجمند کا نام یوز آسف رکھا۔

অর্থাৎ এমন সময় রাজার একটি হৃষ্টপুষ্ট পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এতে তিনি এতই খুশি হন যে, যেন মারা যাবেন! তার বিশ্বাস এই যে, এটি তার মূর্তিপূজার জন্য প্রদত্ত পুরস্কার। তিনি রাজ্যের সমস্ত ধন-সম্পদ ভোগ বিলাসে উজাড় করে দেন। জনগণের জন্য পূর্ণ এক বছর আমোদ ফুর্তি আর খুশি উদযাপনের ফরমান জারি করেন। সেই সুদর্শন সন্তানটির নাম রাখা হয় ইউজে আসেফ। (রূহুল হায়াত উর্দু তরজুমা আ’ইনুল হায়াত, পৃষ্ঠা ৩৬৪, মূল-মোল্লা মুহাম্মদ বাকের মজলিসি)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি :-

  • প্রশ্ন, মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের কোন বইতে তিনি লিখেছেন যে, ইউযে আসেফ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ‘কামালুদ্দিন’ (كمال الدين و تمام النعمة) কিতাবটি পড়ে দেখ!?

উত্তর, ইউযে আসেফ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা লাভ করতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত প্রাচীনকালের একখানা কিতাব ‘কামালুদ্দীন ওয়া তামামুন নি’মাহ‘ পড়তে পরামর্শ দেন মির্যা কাদিয়ানী সাহেব। যেমন তার বইতে লিখা আছে,

و ان كنت تطلب التفضيل فاقرأ كتابا سمى بإكمال الدين تجد فيه كل ما تسكن الغليل

অর্থাৎ “আর তুমি যদি বিস্তারিত জানতে চাও তাহলে ‘কামালুদ্দীন‘ নামীয় কিতাবটি পড়তে পার! তুমি সেখানে এমন সব (তথ্য) পাবে যা প্রবল তৃষ্ণাকেও শান্ত করে দেবে।” (‘আল-হুদা’ এবং রূহানী খাযায়েন ১৮/৩৬২ দ্রষ্টব্য)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি :-

আসলে মির্যা কাদিয়ানী সাহেব স্বপ্নেও ভাবেননি যে, একটা সময় তিনি তার যাবতীয় গোজামিল আর মিথ্যার জন্য পাকড়াও হবেন! তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, আজ থেকে এগার/বারো শত বছর আগেকার রচিত বইগুলো সংগ্রহ করে তার উদ্ধৃতির সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখবে এমন সাধ্য কার! কারই বা এত সময় আছে! মুরিদদের ব্রেইন ওয়াশ করে দেয়ার পর সে কি কখনো চিন্তাও করতে পরে যে, আমার এসমস্ত দাবী দাওয়ায় কোনো রূপ ভেজাল আছে কিনা?

৩০শে এপ্রিল ২০১০ ইং তারিখে প্রকাশিত বিবিসি (আরবী)-এর একটি অনুসন্ধানী নিউজ দেখলাম। সেখানে ইউজে আসেফ এর কবরের ছবি উল্লেখ করে নিচে লিখা হয়েছে,

اما السكان المحليون فيتعبرون ان المزار هو قبر لاثنين من العلماء المسلمين توفيا منذ قرون: يوزا آصف والسيد نصير الدين.

অর্থাৎ, এখানকার স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে, নিশ্চয়ই এই দুটো কবর দুইজন মুসলিম দরবেশের, এঁরা কতেক শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন ইউজে আসেফ আর অন্যজন সাইয়েদ নাসির উদ্দীন। বিবিসি (আরবী) নিউজ পোর্টালের লিংক দেখুন (নিচে স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য)।

বর্তমান ভারতের কাশ্মীরের খানইয়ার মহল্লায় সাইয়েদ নাসির উদ্দীন শাহ (রহ.)-এর কবরের পাশেই তার সমাধি। এ সম্পর্কে পড়া যেতে পারে ‘কামালুদ্দীন ওয়া তামামুন নি’মাহ’ (আরবী) এবং ‘আ’ইনুল হায়াত’ (রূহুল হায়াত নামীয় ফার্সি বইয়ের উর্দূ অনুবাদ) দুইখানা কিতাব। আরো বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এই লিংকটিতে

এ সম্পর্কিত ২১টি পর্ব ফেসবুক ফেজ থেকে সুস্পষ্ট স্ক্রিনশট সহ পড়তে ক্লিক করুন

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

হাদীস অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে স্বয়ং নবীজীর সতর্কবাণী

হাদীস অস্বীকারকারী | কথিত আহলে কুরআন দাবীদার

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।

ইন্নাল হামদা লিল্লাহ ওয়াসসালাতু ওয়াস-সালামু আ’লা রাসূলিল্লাহ! আম্মাবা’দূ…..! প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোনেরা! আমরা এখন পুরোপুরি একটি ফেতনার যুগে অবস্থান করছি! আজকে আপনাদের খেদমতে আমার একটি সতর্কবার্তা! তা হল, হাদীস অস্বীকারকারী (আহলে কুরআনদের) থেকে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। নইলে ওরা যে কোনো মুহূর্তে হাদীসে নববীর প্রতি আপনার মনে সংশয় তৈরি করে আপনাকে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে পারে। আর কখনো যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যান তাহলে আপনাকে অবশ্যই কোনো বিজ্ঞ ও গবেষক আলেমের সান্নিধ্যে গিয়ে সঠিকটা বুঝে নিতে হবে। আসলে যারা হাদীসে নববীর অস্বীকারকারী তারা মূলত ওহীর এক বিরাট অংশ ‘অপঠিত ওহী’ (وحى غير متلو) এবং একি সাথে রাসূল (সা.)-এর সীরাতেরও অস্বীকারকারী। অথচ কুরআন আমাদের ডেকে ডেকে বলছে, তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ (لقد كان لكم فى رسول الله اسوة حسنة)। সুবহানাল্লাহ!

বলাবাহুল্য, ইদানীং মুসলমান ছদ্মবেশী খ্রিস্টান (কথিত ঈসায়ী মুসলিম দাবীদার), শীয়া-রাফেজী, বাহায়ী ও কাদিয়ানীরাও হাদীস অস্বীকারকারীদের পেছন থেকে মদদ জোগাচ্ছে। অনলাইনে হাদীস অস্বীকারকারী লিখক ও প্রচারকদের ৯০% শীয়া এবং খ্রিস্টান মিশনারী! কিন্তু কিছুই বুঝে উঠার সুযোগ নেই। সে যাইহোক, এদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) নিজেই চৌদ্দশত বছর আগেই সতর্ক করে গেছেন। এখানে শুধুমাত্র একখানা সহীহ হাদীস উল্লেখ করছি। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي رَافِعٍ، وَغَيْرُهُ، رَفَعَهُ قَالَ ‏ “‏ لاَ أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيهِ أَمْرٌ مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُولُ لاَ أَدْرِي مَا وَجَدْنَا فِي كِتَابِ اللَّهِ اتَّبَعْنَاهُ “

অর্থ, আবূ রাফে‘ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমি যেন তোমাদের মধ্যে কাউকে এমন অবস্থায় না পাই যে, সে তার সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসে থাকবে এবং তার নিকট যখন আমার আদিষ্ট কোনো বিষয় অথবা আমার নিষেধ সম্বলিত কোনো হাদীস উত্থাপিত হবে তখন সে (তাচ্ছিল্যভরে) বলবে, আমি তা জানি না, আল্লাহতালার কিতাবে আমরা যা পাই, তারই অনুসরণ করবো।’ (জামে’ আত তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৬৩; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৩২৪৯)।

আল্লাহতালা আমাদেরকে হাদীস অস্বীকারকারী এই নিকৃষ্ট ফেতনাবাজদের তাবৎ বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুক। কুরআন এবং সহীহ হাদীসের আলোকে জীবনকে পরিচালনা করার তাওফিক দান করুক। আমীন।

  • এই বইগুলো ডাউনলোড করুন,

আমরা হাদীস মানতে বাধ্য (আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক)

হাদীস সংকলনের ইতিহাস (মওলানা আব্দুর রহীম)

হাদীস কেন মানতে হবে? (কামাল আহমাদ)

হাদীস কি আল্লাহর ওহী? (মুহাম্মদ ইকবাল ফাখরুল)

হাদীসের প্রামাণিকতা (সানাউল্লাহ নজির আহমদ)

হাদীসের প্রামাণিকতা (ডক্টর মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব)

লিখক,
শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী