প্রশ্ন : ইমাম বায়হাক্বী (রহ.)-এর সংকলন الاسماء و الصفات কিতাবে উল্লিখিত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে নাযিল হবেন (ينزل من السماء) শীর্ষক একই হাদীসটি সহীহ বুখারীতেও এসেছে, কিন্তু সেখানে ‘সামা’ বা আকাশ শব্দটি নেই! এখন ইমাম বায়হাক্বীর সনদে এই ‘সামা’ (আকাশ) শব্দ কোত্থেকে বা কিভাবে এলো? আসমাউর রিজালশাস্ত্রের গবেষক মুহাদ্দিসগণ থেকে এইধরনের বর্ণনার হুকুম সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : এখানে হাদীসটির সনদে ইমাম বুখারী (রহ.)-এর সনদ অপেক্ষা শেষের দিকে আরো তিনজন রাবী অতিরিক্ত রয়েছে। শায়খ আলবানী (রহ.) এর তাহকিক অনুসারে এখানে ‘সামা’ (আকাশ) শব্দটি এঁদেরই কারো থেকে বৃদ্ধিকৃত হবে যাকে উসূলে হাদীসের পরিভাষায় ‘যিয়াদাতুর রাবী’ (زيادة الراوى) বলা হয়। এই ক্যাটাগরির হাদীসকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। তন্মধ্যে প্রথম প্রকারের হাদীসকে ‘মাকবূল’ (শর্তমতে গ্রহণযোগ্য) বলা হয়। সহীহ বুখারীর আরবী ব্যাখ্যাকারক ও যুগ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) যিয়াদাতুর রাবী-এর অন্যতম ‘মাকবূল‘ (গ্রহণযোগ্য) হাদীসের সংজ্ঞায় লিখেছেন, زيادة الراوى ليست مقبولة مطلقا عند الجمهور من المحدثين، بل تكون مقبولة اذا لم تقع منافية لرواية من هو أوثق، لانها فى حكم الحديث المستقل الذى يتفرد بروايته الثقة و لا يرويه عن شيخه غيره. অর্থাৎ জামহুর মুহাদ্দেসীনের মতে যিয়াদাতুর রাবী মুক্তভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। (মুক্তভাবে গ্রহণযোগ্য নয় একথার অর্থ হল, যদি রাবীর যিয়াদাত (বৃদ্ধি) অন্য সিকাহ রাবীদের বর্ণিত রেওয়ায়েতের বিরোধী হয়, যার ফলে একটিকে গ্রহণ করলে অন্যটিকে রদ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে; তখন বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া রাবীর যিয়াদাত (বর্ণনাকারীর বৃদ্ধি) গ্রহণ করা যাবেনা। এক্ষেত্রে রাবীদের অবস্থা যাচাইবাচাই করে একটিকে প্রাধান্য আর অপরটিকে অপ্রাধান্য বলে সাব্যস্ত করতে হয়)। তবে যদি কোনো রাবীর যিয়াদাত (বৃদ্ধি) অন্য কোনো আওসাক (অধিক বিশ্বস্ত) রাবীর রেওয়ায়েত কৃত হাদীসের বিরোধী না হয়, তখন রাবী সিকাহ (বিশ্বস্ত) হলে তার রেওয়ায়েত গ্রহণ করা হবে এবং সিকাহ রাবীর রেওয়ায়েতকে পৃথক হাদীস ধরা হবে। (আর মনে করা হবে) আওসাক রাবী সেই অংশ তার নিজ শায়খ থেকে অন্য কোনো কারণে বর্ণনা করেননি। (বলেছেন, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ.)। দেখুন, ইবনে হাজার আসকালানী রচিত শরহে নুখবাতুল ফিকার, যিয়াদাতুর রাবী পর্ব দ্রষ্টব্য।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) সিকাহ রাবীর যিয়াদাতের হুকুম সম্পর্কে আরও বলেছেন, و زيادة راويهما مقبولة مالم تقع منافية لمن هو اوثق অর্থাৎ হাদীসে হাসান এবং সহীহ’র বর্ণনায় যিয়াদাত বা বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য, যে পর্যন্ত না বৃদ্ধিকৃত অংশটি ‘আওসাক’ (অপেক্ষাকৃত অধিক বিশ্বস্ত) রাবী’র বিপরীত হয়। (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রচিত নাখবাতুল ফিকার)। কিতাবটির উর্দূ ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘তুহফাতুদ দুরার’-তে “মুখালাফাতুল আওসাক” এর বিশ্লেষণ করে লিখা আছে, اور مخالفت ایسی ہو کہ اس زیادتی کو لینے کی صورت میں ارجح کی روایت کا رد کرنا لازم آئے অর্থাৎ মুখালাফাত এইরূপ হওয়া যে, এই ধরনের বৃদ্ধিকৃত অংশ গ্রহণের দ্বারা অপেক্ষাকৃত অধিক বিশ্বস্ত রাবীর বর্ণনাকে রদ বা বিরোধিতা করা হয়! (তুহফাতুদ দুরার-১৯; শায়খ সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.)। এখন আপত্তিকারীর উপরই দায়িত্ব বর্তাবে একথা প্রমাণ করা যে, বায়হাক্বীর সংকলিত সম্পূর্ণ ভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীসটির ‘মিনাস সামা’ (من السماء) শব্দের বৃদ্ধি দ্বারা অন্য কোন আওসাক রাবীর বর্ণিত রেওয়ায়েতের মুখালাফাত বা বিরোধিতা করা হয়েছে? এমন কোনো হাদীস কি দেখানো সম্ভব হবে যেখানে ঈসা (আ.)-এর নাযিল হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে ‘সামা’ (আকাশ) শব্দের বিপরীতধর্মী কোনো শব্দ দ্বারা রেওয়ায়ত বর্ণিত হয়েছে? আর তা একজন সহীহ সনদে অপর কোনো ‘আওসাক’ (اوثق) রাবী থেকেই হয়েছে?
বায়হাক্বীর সংকলন থেকে من السماء শীর্ষক হাদীস এর প্রামাণ্য স্ক্যানকপি,
- এবার সহীহ বুখারীর রাবীগণের বাহিরে অতিরিক্ত আরও যে তিনজন রাবীর উল্লেখ ইমাম বায়হাক্বীর উল্লিখিত সনদে (সূত্রে) রয়েছে তাদের ব্যাপারে জারহু ওয়াত-তাদীল এর বিখ্যাত গ্রন্থে কী লিখা আছে তা জেনে নিন! ইমাম যাহাবী (রহ.) লিখেছেন,
১- আবু আব্দুল্লাহ আল হাফিজ। উনার পুরো নাম- মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হামদাবিয়্যা ইবনে নাঈম ইবনে হিকাম। মৃত ৪০৫ হিজরী। তিনি একজন ছিকাহ (বিশ্বস্ত) রাবী ও হাফিজুল হাদীস। ইমাম বুখারী ও মুসলিম উনার থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। (তাহযীবুল কামাল, রাবী নং ২৯৭৯৫ দ্রষ্টব্য)।
২- আবুবকর ইবনে ইসহাক। উনার পূর্ণ নাম- আবুবকর আহমদ ইবনে ইসহাক ইবনে আইয়ুব ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে নূহ। তিনি ২৫৮ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত: ৩৪২ হিজরী। তিনি একজন বিশ্বস্ত ও উঁচু মাপের মুহাদ্দিস। ইমাম যাহাবী (রহ:) তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন : الإمام العلامة المفتي المحدث ، شيخ الإسلام أبو بكر أحمد بن إسحاق بن أيوب بن يزيد ، النيسابوري الشافعي المعروف بالصبغي অর্থাৎ আবুবকর আহমদ ইবনে ইসহাক তিনি একজন ইমাম, আল্লামা, মুফতি, মুহাদ্দিস ও শায়খুল ইসলাম। তিনি নিশাপুর শহরের অধিবাসী এবং “ছবগী” নামে প্রসিদ্ধ। (দেখুন, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৪৪৭; ঊনবিংশতিতম স্তরীয় রাবী)।
৩- আহমদ ইবনে ইবরাহিম। উনার পূর্ণ নাম, আহমদ ইবনে ইবরাহিম ইবনে মালহান। তিনি একজন ছিকাহ বা বিশ্বস্ত রাবী। ইমাম বুখারী মুসলিম দুজনই উনার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। এখানে তিনি হাদীসটি ইবনে বুকাইর এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। উল্লেখ্য, ইমাম ইবনে বুকাইর-এর পূর্ণ নাম ইয়াহিয়া ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বুকাইর। উনার উপনাম, আবু যাকারিয়া। মৃত: ২৩১ হিজরী। ইবনে হাব্বান (রহ:) উনাকে বিশ্বস্ত রাবীদের মধ্যে শামিল করেছেন। ইমাম বুখারী মুসলিম দুজনই উনার থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। (দেখুন, সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৬১৪; দ্বাদশ স্তরীয় রাবী)।
শেষকথা : বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ ও যুগ ইমাম আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)-এর সুস্পষ্ট অভিমত দ্বারা-ও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ইমাম বায়হাক্বীর হাদীসটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হাদীস হিসেবে গণ্য হবে এবং সনদের শেষাংশে অতিরিক্ত ৩জন রাবীই ছিকাহ, যাদের কোনো একজনের মাধ্যমেই من السماء টুকরাংশটি বৃদ্ধিকৃত; যা তার উর্ধতন শায়খ হয়ত বা অন্য কোনো কারণে বুখারীর রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেননি। আর এ ‘যিয়াদাতুর রাবী’ কর্মটি এ জায়গায় উসূলে হাদীসের প্রতিষ্ঠিত নিয়মের পরিপন্থী না হওয়ায় মাকবুল ও দলিল প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
মুহাম্মদ নূরুন্নবী।