Home Blog Page 33

ইমাম মাহদী একজন ‘জমিদার বংশীয়’ হবেন এটি কি হাদীস?

ইমাম মাহদী জমিদার বংশীয় হবেন, বিপাশা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ‘কাদিয়ান’ গ্রাম থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন, বলিয়া হাদীসের নামে কাদিয়ানীদের প্রতারণার জবাব:

প্রশ্নকর্তা : হাদীসের কোথাও ইমাম মাহদী একজন ‘জমিদার বংশীয়’ হবেন এইরূপ উল্লেখ আছে কি?

উত্তরদাতা : না, এইরূপ কোনো হাদীস খোঁজে পাওয়া যায়না। তবে নবুওয়তের মিথ্যাদাবীদার মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীদের বইতে এই ধরণের অনেক কিছুই উল্লেখ আছে, যা ভুল এবং বানোয়াট। মূলত তারা হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে নিজেদের ভুল অনুবাদ থেকেই এই রকমটি মনে করে থাকে। এবার জেনে নেয়া যাক, হযরত আলী (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীসটিতে এমন কী উল্লেখ আছে! হাদীসে একটি শব্দ এসেছে ‘হারিছ হাররাছ’। তাই প্রশ্ন আসবে, এই ‘হারিছ হাররাছ’টা কে? জবাবে বলা হবে যে, সুনানে আবুদাউদ এর “কিতাবুল মাহদী” অংশে একই বর্ণনাকারী থেকে হাদীসটির আরবী ইবারত ( Text) দেখলে বুঝা যায় ওই হারিছ হাররাছ নামীয় ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি ওই সময়ে আত্মপ্রকাশকারী হযরত ইমাম মাহদীর সাহায্যে “ওরায়ুন্নাহার তথা মধ্য এশিয়া” থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে আসবেন। তার পূর্ণ নাম হবে হারিছ বিন হাররাছ (الحارث بن حراث) তথা হাররাছ এর পুত্র হারিছ। এবার অনুবাদসহ সংশ্লিষ্ট হাদীসটি নিচে দেখুন! হাদীস :

قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏: يَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ وَرَاءِ النَّهْرِ يُقَالُ لَهُ الْحَارِثُ بْنُ حَرَّاثٍ عَلَى مُقَدِّمَتِهِ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ مَنْصُورٌ يُوَطِّئُ أَوْ يُمَكِّنُ لآلِ مُحَمَّدٍ كَمَا مَكَّنَتْ قُرَيْشٌ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَجَبَ عَلَى كُلِّ مُؤْمِنٍ نَصْرُهُ ‏.‏ أَوْ قَالَ إِجَابَتُهُ ‏

অর্থাৎ : রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন “ওরায়ুন্নাহার তথা মধ্য এশিয়া থেকে হারিছ বিন হাররাছ (الحارث بن حراث) নামীয় এক ব্যক্তি বের হবে। তাঁর আগে “মানছুর” নামের অপর এক ব্যক্তি বের হবে। তিনি মুহাম্মদ (এখানে মুহাম্মদ বলতে ইমাম মাহদীকে বুঝানো উদ্দেশ্য। কেননা তার নাম মুহাম্মদ হবে)-এর অনুসারীর সাহায্যে এসে (বাহিনীতে) মিলিত হবেন ও তাঁকে শক্তিশালী করবেন; যেইরূপ কুরাইশরা রাসূল (সা:)-কে সাহায্য করেছিলো। (সেই সময়কার) সকল মুমিনের উচিত তাঁকে (ইমাম মাহদীকে) সাহায্য করা এবং তাঁর আহবানে সাড়া দেয়া।” রেফারেন্স, আবুদাউদ কিতাবুল মাহদী, হা/৪২৪০ [ইফা]; আরো দেখুন, ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) রচিত ‘আল আ’রফুল ওয়ারদী ফী আখবারিল মাহদী’ পৃষ্ঠা নং ২৭-২৮। (অনুবাদ শেষ হল)। হাদীসের মান, জঈফ।

وراء النهر ‘ওরাউন নাহার’ এর ভৌগোলিক সীমারেখা দেখুন ক্লিক

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! সুনানে আবুদাউদ শরীফের এই হাদীস দ্বারা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল যে, হারিছ হাররাছ এটি হারিছ ইবনে হাররাছ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। মূলত হারিছের পুত্র হাররাছ-এরূপই বুঝানো উদ্দেশ্য। এবার ‘ওরায়ুন্নাহার’ এর ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে জেনে নিন!

  • ওরায়ুন্নাহার (Wa’raun Nahar) এর ভৌগলিক পরিচয় :

ওরায়ুন্নাহার (ইংরেজি : Central Asia) হল, মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ (বিশেষত, সমরকন্দ, বুখারা, তিরমিয, তাসখন্দ ইত্যাদি)’র ভূ-বেষ্টিত এলাকা! অঞ্চলটির সীমানার অনেকগুলো সংজ্ঞা আছে, যার কোনোটিই পুরোপুরি সর্বজনগৃহীত নয়। ঐতিহাসিকভাবে অঞ্চলটি বিভিন্ন যাযাবর জাতি ও সিল্ক রোডের সাথে সম্পর্কিত। ফলে অঞ্চলটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জাতি, দ্রব্য ও সাংস্কৃতিক ধারণাসমূহের আদানপ্রদানের অঞ্চল হিসেবে কাজ করেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আছে কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, এবং অন্যান্য ছোট ছোট রাষ্ট্র যেমন – আজারবাইজান (কাস্পিয়ান সাগরের অপর পাড়ে অবস্থিত)। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকেও অনেক সময় এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)।

আপনি গুগলে আরবীতে ‘ওরায়ুন্নাহার’ (وراء النهر) লিখে সার্চ দিয়ে দেখুন, শব্দটির পুরো ডিটেলস মানচিত্রসহ বেরিয়ে আসবে। তখন আপনি নিজেও জেনে অবাক হবেন যে, কাদিয়ানীরা মধ্য-এশিয়ার ভৌগলিক সীমানার হাত পা ভেঙ্গে ‘বিপাশা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত গ্রাম বলিয়া মির্যার জন্মস্থান কাদিয়ান’-কে কিভাবে অপব্যাখ্যার নিশানায় পরিণত করল! শুধু কি তাই? না না, তারা ‘হাররাছ ইবনে হারিছ’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘হাররাছ হারিছ’ শব্দকে জমিদার বংশীয় বলেও ব্যাখ্যা দিতে ভুলেনি!

আহা! এ কি নিকৃষ্ট বিকৃতি! কি সব উদ্ভট ব্যাখ্যা!! কি যে অসম্ভব ধোকা!!! অথচ রাসূল (সা:) হাদীসটির আলোকে ইমাম মাহদীর বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসা তদানীংকালের একটি মুসলিম সৈন্যদলের নেতৃত্বদানকারী হারিছের পুত্র হাররাছ নামীয় ব্যক্তির ভৌগলিক অবস্থান কোথায় হবে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে চাচ্ছিলেন! মধ্য এশিয়ার মানচিত্র (উইকিপিডিয়া হতে সংগৃহীত) দেখুন, চীন, পাকিস্তান আর ইন্ডিয়া এই দেশগুলো নির্দিষ্ট সীমারেখার সম্পূর্ণ বাহিরে ও বরাবরই এশিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত। এমতাবস্থায় ‘কাদিয়ান’ গ্রামটিও মধ্য এশিয়ার সীমানার বাহিরেই থাকল কিনা? অবশ্যই। উফ! ওরা কিভাবে এতবড় প্রতারণার খেল খেলতে পারল!!

শেষে শুধু এইটুকু বলব, এখনো সময় আছে, রাসূল (সা:)-এর হাদীস, ইসলামের ইতিহাস আর ভৌগলিক অবস্থানের ভুলভাল ব্যাখ্যার কবলে পড়ে আল্লাহর ওয়াস্তে আর বিভ্রান্ত হবেন না! ফিরে আসুন, ইসলামের পুরণো ছাতার নিচে; আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মূলস্রোতে!

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইমাম মাহদীর নামের শেষে ‘আলায়হেস সালাম’ বলা

  • ইমাম মাহদী যদি “নবী” না হন তাহলে তাঁর নামের পর ‘আলায়হেস সালাম’ (সংক্ষেপে আঃ) কেন লিখা হয় বা বলা হয়? কাদিয়ানীদের প্রশ্ন ও আমার জবাব :

আমার জবাব, পবিত্র কুরআন বলছে, ওয়া খাতামান নাবিয়্যীন (খতম করনে ওয়ালা নবীয়ুঁ কা [উর্দূ]) অর্থাৎ তিনি (মুহাম্মদ সাঃ) নবীগণের আগমনীধারা সমাপ্তকারী। সূরা আহযাব, আয়াত নং ৪০; অনুবাদ- রূহানী খাযায়েন খন্ড ৩ পৃষ্ঠা ৪৩১; মূল মির্যা কাদিয়ানী। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, ১ যদি আমার পরে কেউ নবী হত তাহলে উমর ইবনে খাত্তাবই নবী হত। অন্য জায়গায় তিনি সাঃ আরো ইরশাদ করেছেন, ২ আমি আখেরি নবী আর তোমরা আখেরি উম্মত। তিনি আঃ এও ইরশাদ করেছেন, ৩ আমার মাধ্যমে নবীগণের আগমনীধারা খতম করে দেয়া হয়েছে। তিনি আঃ আরেক জায়গায় ইরশাদ করেছেন, ৪ আমার পরে আর কোনো নবী নেই তবে অচিরেই বহু খলিফা হবে। তিনি আঃ এও ইরশাদ করেছেন, ৫ নিশ্চয়ই রেসালত এবং নবুওয়তের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আমার পর না কোনো নবী রয়েছে আর না কোনো রাসূল রয়েছে। সংক্ষেপে। সুতরাং বুঝা গেল, মুহাম্মদ সাঃ এর পরে নবুওয়তের ধারা বন্ধ, তাঁর পরে আল্লাহতালা আর কাউকে নবী বানাবেন না। উদ্ধৃতিগুলোর রেফারেন্স নিন্মরূপ!

রেফারেন্স :- ১ তিরমিজি শরীফ। ২ ইবনে মাজাহ, কিতাবুল ফিতান বাবুদ দাজ্জাল। ৩ সহীহ বুখারী। ৪ সহীহ বুখারী কিতাবুল মানাকিব। ৫ তিরমিজি শরীফ।

উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা বুঝতে পারলাম যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর পরে যে কোনো প্রকারের নবুওয়তের দাবীদার মিথ্যুক এবং দাজ্জাল তথা প্রতারক ও মুসাইলামা কাজ্জাবেরই উত্তরসূরী। সেযাইহোক, এখন প্রশ্ন আসে যে, তাহলে শেষযুগে প্রেরিত প্রতীক্ষিত ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল মাহদী ওয়াল ফাতেমি ওয়াল হাসানী ওয়াল কুরাইশী এর নামের শেষে কিজন্য ‘আলায়হেসসালাম’ লিখা হয় বা বলা হয়? তার কারণ কী?

উত্তর হচ্ছে, কুরআন কিংবা হাদীস থেকে কেউই দেখাতে পারবেনা যে, মাহদীর নামের শেষে ‘আলাইহেসসালাম’ লিখা হয়েছে। আমি চ্যালেঞ্জ করলাম, কেউ পারলে প্রমাণ করুন! আর সেজন্যই মাহদীর নামের শেষে দোয়াস্বরূপ ‘আলায়হেসসালাম’ লিখা বা বলার জন্য আপনার আর আমার মতই সাধারণ মানুষরাই দায়ী। যদিও বা কোনো কোনো যুগ ইমাম এবং মুজাদ্দিদ ইমাম মাহদীর নামের শেষে ‘আলাইহেসসালাম’ লিখা বা বলার পক্ষে ছিলেন না। মুজাদ্দিদে আলফে সানী হযরত শায়খ আহমদ সারহেন্দী (রহ:) তাদেরই মধ্যে অন্যতম। তিনি ইমাম মাহদীর নামের শেষে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’ লিখেছেন। প্রমাণ স্বরূপ তারই মাকতূবাত কিতাবের স্ক্রিনশট দেখুন (৪/৫৮৭; দপ্তরে আউয়াল, উর্দু এডিশন) । কিন্তু তিনি ‘আলায়হেসসালাম’ লিখতে কোথাও বারণ করেছেন কিনা তা জানা নেই।

কতিপয় মনীষীর নামের পরে ‘আলায়হেসসালাম’ লিখা বা বলা প্রসঙ্গে :

আমরা জানি, হযরত লোকমান হাকিম, হযরত খিজির, হযরত বিবি আছিয়া, হযরত বিবি মরিয়ম প্রমুখ এঁদের কেউই নবী ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এঁদের সকলের নামের শেষে ‘আলায়হেসসালাম’ বা ‘আলায়হাসসসালাম’ (লিঙ্গভেদে হি/হা যোগে) থাকে। তদ্রূপ হযরত ইমাম মাহদীর নামের শেষেও ‘আলায়হেসসালাম’ লিখার অর্থ এই নয় যে, তিনি নবী হবেন!

ইমাম মাহদীর নামের শেষে ‘আলায়হেসসালাম’ লিখার কারণ :

তার কারণ এইও হতে পারে যে, শেষ যুগে আগমনকারী ইমাম মাহদী নবী করীম সাঃ এর আহলে বাইয়েত হতে ও ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-র পুত্র হযরত হাসানের ওরশে কুরাইশ বংশে জন্মিবেন (সুনানু আবুদাউদ, কিতাবুল মাহদী অধ্যায়) বলেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তারও নামের শেষে ‘আলায়হেসসালাম’ লিখতে নিরুৎসাহিত করা হয়না। এই পর্যায়ে কেউ কেউ হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন যে, আহলে বাইয়েত এর সদস্যদের নামের শেষে ‘আলায়হেসসালাম’ লিখা বা বলার দলিল কোথায়?

উত্তরে বলতে চাই যে, সহীহ বুখারী শরীফের “কিতাবুল ফাজায়েলে সাহাবাহ” অধ্যায়ের (হাদিস নং ৩৭১১, অধ্যায় নং ৬২; আত-তাওহিদ প্রকাশনী) “বাবুল মানাক্বিবে ফাতিমা” শীর্ষক পর্বে নবীজীর কলিজার টুকরো হযরত ফাতিমার নামের শেষে ‘আলায়হাসসালাম’ (عليها السلام) ব্যবহার করা হয়েছে । একই হাদীস গ্রন্থের অর্থাৎ বুখারী শরীফের “বাবুল মানাক্বিবি ক্বরাবাতি রাসূলিল্লাহ ওয়া মানাক্বিবাতি ফাতিমা আলাইহাসসালাম বিনতে নবী” শীর্ষক আলোচনায় (পর্ব নম্বর-৪১/১২) “আলায়হাসসালাম” ব্যবহার করা হয়েছে। ইমাম বুখারী রহঃ এর কৃত অনুরূপ শিরোনামই প্রমাণ করে যে, আহলে বাইয়েত তথা নবী-পরিবারের সদস্যদের নামের শেষে ‘আলাইহেসসালাম’ (যার অর্থ, তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) লিখা বা বলার অনুমতি রয়েছে। তবে বলতেই হবে এইরূপ উৎসাহিত করা হয়নি। অন্যথা মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহঃ ইমাম মাহদীর নামের শেষে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’ লিখতেন না।

সুনানু তিরমিজি গ্রন্থে একটি পরিচ্ছেদ এর শিরোনাম আছে “মানাক্বিবুল হাসান ওয়াল হুসাইন আলায়হেমাসসাল্লাম”। তারই সংশ্লিষ্ট একটি হাদীসের (হাদীস নং ৩৭৭৪) খন্ডাংশ اذ جاء الحسن والحسين عليهما السلام যাইহোক, ইমাম হাসান আর হুসাইন এঁদের দুইজনের নামের শেষে (দ্বিবচনে) ‘আলায়হেমাসসালাম’ উল্লেখ থাকাটাও প্রমাণ করে যে, এটি আহলে বাইয়েত এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর শেষ যুগে আগমনকারী হযরত ইমাম মাহদী যেহেতু আহলে বাইয়েত থেকে কুরাইশ বংশে (আরবে তথা মদীনায়) জন্মিবেন সেহেতু ওই একই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাঁর নামের শেষেও ‘আলায়হেসসালাম’ লিখতে বা বলতে নিরুৎসাহিত করা হয়না। তবে মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহঃ এর লিখনী দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, উত্তম হল ‘রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’-ই লিখা বা বলা। ওয়াল্লাহু আ’লাম!

শেষকথা : কাদিয়ানী সম্প্রদায় মির্যা গোলাম কাদিয়ানীকে নবী সাব্যস্ত করতে ইমাম মাহদীর নামের শেষে ব্যবহৃত ‘আলায়হেসসালাম’ এর প্রসঙ্গ টেনে এনে যুক্তি দিতে চায়। অথচ উপরের দীর্ঘ আলোচনা হতে আমরা বুঝলাম যে, ইমাম মাহদীর নামের শেষে ‘আলায়হেসসালাম’ এর ব্যবহার তিনি ” নবী” একথা বুঝাতে নয়, বরং তিনি আহলে বাইয়েত এর মধ্য হতে এবং একজন কুরাইশী হবেন-এদিকেই ইংগিত করতে। অন্যথা হযরত লোকমান, হযরত খিজিরসহ তাঁদের সবাই এমনকি জিব্রাইল, মিকাইল, ইস্রাফিল ও আজরাইল ফেরেশতাগণও কাদিয়ানীদের একই যুক্তিতে নবী হয়ে যাচ্ছেন! আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দিন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

আখেরি যামানার আলেমরা ‘উলামাউহুম শাররুম’ হওয়া হাদীসের পর্যালোচনা

  • আখেরি যামানার আলেমরা ‘উলামাউহুম শাররুম’ হওয়া প্রসঙ্গে

কাদিয়ানীরা কথায় কথায় বলে আলেমরা নিকৃষ্ট! হাদীস শরীফে আখেরি যামানার আলেমদের “নিকৃষ্ট” বলা হয়েছে! কিন্তু তারা উক্ত হাদীসের কথাগুলোর প্রসঙ্গ কখনো খতিয়ে দেখেনা যে, হাদীসের “উলামাউহুম শাররুম—জাতীয় কথাগুলো প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের আগের না পরবর্তী যুগের সাথে সম্পর্কিত? চিন্তাশীলদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে। মনে করুন, ইমাম মাহদী এসে আবার চলেও গেছেন অথচ নিকৃষ্ট জীব খ্যাত দুষ্ট মৌলভীদের দৌরাত্ম পর্যায়ক্রমে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলছে, বন্ধ হচ্ছেনা; এমতাবস্থায় খুব সহজেই জনমনে প্রশ্ন দেখা দেবে যে, তাহলে ইমাম মাহদীর আগমনে ফায়দা হল কী? আকাশে সূর্য উদিত হলে পৃথিবী কোনোভাবেই কি অন্ধকারে ঢাকা পড়তে পারে? কখনো না। কাজেই, কাদিয়ানীদের বিশ্বাস, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ইমাম মাহদী, এটি নির্জলা মিথ্যা বৈ নয়।

এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা জুরুরি, যাদের চোখ আছে তারা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন এবং যাদের অন্তর আছে তারা অবশ্যই উপলব্ধি করবেন যে, উল্লিখিত ৪টি- যুগলক্ষণই কিন্তু প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের পূর্বের সময়কে ইংগিত দিচ্ছে। যথা, ইসলাম শুধু নামমাত্র থাকবে, কুরআনের শুুধুমাত্র পাণ্ডুলিপি অক্ষত থাকবে, মসজিদগুলো হিদায়াতশূন্য হয়ে যাবে আর তখন তোমাদের আলেমগণ আকাশের নিচে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হবে!

সুতরাং বর্তমানে যেহেতু বহু আলেম দুনিয়া লোভী, খেয়ানতকারী ও হাদীসের ভাষায় ‘উলামাউহুম শাররূম’ হওয়াই দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করছে সেহেতু পরিষ্কার হয়ে গেল, প্রকৃত ইমাম মাহদী (মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল মাহদী ওয়াল ফাতেমি ওয়াল হাসানী ওয়াল কুরাইশী)’র আগমন এখনো বাকি। তবে ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই তাঁর আগমন হবে। ওয়াল্লাহু আ’লাম।

শেষকথা, সব বাতিল মতবাদের অনুসারীরাই নিজেদের ইসলাম পরিপন্থী মতবাদ টিকিয়ে রাখতে সর্বাগ্রে উলামায়ে কেরামের উপর চড়াও হয়। নির্বিচারে সব আলেমকে ঘৃণা আর সমালোচনার নিশানা বানায়। যাতে তাদের বিভ্রান্ত অনুসারীরা আলেমদের কাছে না যায়। মূলত আলেমদের কাছ থেকে তাদের বিপথগামী অনুসারীদের দূরে রাখার অসৎ উদ্দেশ্যেই তারা নির্বিচারে হাদীসগুলো প্রসঙ্গ ছাড়াই উদ্ধৃত করে! আল্লাহ তাদের সহীহ বুঝ দিন। আমীন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইউনুছ ইবনে মাত্তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নন, হাদীসের ব্যাখ্যা

  • মির্যা কাদিয়ানীর স্ববিরোধী কথাবার্তার বদনাম ঘোচাতে রাসূল (সাঃ) এর হাদীসের উপর কাদিয়ানীদের আপত্তি ও তার খন্ডন!

কাদিয়ানীদের আপত্তিমূলক প্রশ্নটি হল, হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা:) বলেছেন, যে আমাকে ইউনুছ ইবনে মাত্তা অপেক্ষা উত্তম বলবে সে মিথ্যা বলল । (তিরমিযী হা/৩২৪৫)। অথচ তিনি (সা:) আরেক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, আমি সমস্ত বনী আদমের সর্দার কিন্তু তাতে আমার নিজের কোনো গৌরব নেই… (তিরমিযী হা/৩৬১৫)। বাহ্যিকভাবে তিনি (সা:) স্ববিরোধী উক্তি করলেন কিনা? এমতাবস্থায় মির্যা কাদিয়ানীর ক্ষেত্রে কিজন্য স্ববিরোধী উক্তির আপত্তি করা হবে??

জবাব ও খন্ডনঃ উপরের বক্তব্য দু’টির জবাব বিশিষ্ট যুগ ইমাম ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) এর কিতাব “মেরকাত শরহে মেশকাত” থেকে নিচে অনুবাদ আকারে তুলে ধরছি।

(مَنْ قَالَ: أَنَا خَيْرٌ) أَيْ: فِي النُّبُوَّةِ (مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّى لَقَدْ كَذَبَ) : لِأَنَّ الْأَنْبِيَاءَ كُلَّهُمْ مُتَسَاوُونَ فِي مَرْتَبَةِ النُّبُوَّةِ، وَإِنَّمَا التَّفَاضُلُ بِاعْتِبَارِ الدَّرَجَاتِ، وَخُصَّ يُونُسُ بِالذِّكْرِ لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى وَصَفَهُ بِأَوْصَافٍ تُوهِمُ انْحِطَاطَ رُتْبَتِهِ حَيْثُ قَالَ: (فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ)

অর্থাৎ, রাসূল (সা:) এর বাণী “যে বলবে আমি ইউনুছ ইবনে মাত্তা অপেক্ষা উত্তম…”—এই কথাটি মূলত শুধুই নবুওয়তের ক্ষেত্রে ধর্তব্য হবে। ফলে তার অর্থ দাঁড়ায়, যে ব্যক্তি বলবে আমি ইউনুছ ইবনে মাত্তা অপেক্ষা নবুওয়তের ক্ষেত্রেও উত্তম তবে সেই ব্যক্তি মিথ্যা বলল। কেননা নবীগণের সকলে নবুওয়তের মর্যাদায় এক ও অভিন্ন। তবে কতিপয় সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষত্ব নিশ্চয়ই রয়েছে। এক্ষেত্রে ইউনুছ (আ:) এর বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, আল্লাহতালা পবিত্র কুরআনে তাঁকে নানা বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করে তাঁর মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ অর্থাৎ সে (ইউনুছ) মনে করেছিল আমি তাঁর উপর (পৃথিবীটা) কখনোই সংকীর্ণ করব না। (মেরকাত শরহে মেশকাত : ৯/৩৬৪৫)।

  • মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকেও রাসূল (সা:) এর উল্লিখিত হাদীস দুইখানার পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন যথাক্রমে ২টি আয়াত :

আল্লাহতালা বলেন: لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ অর্থঃ তাহারা বলে, আমরা তাহার রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করিনা (সূরা বাক্বারা ২৮৫)। অন্য জায়গায় এসেছে, আল্লাহ বলেন: تلك الرسل فضلنا بعضهم على بعض অর্থঃ এই রাসূলগণ, তাহাদের মধ্যে কাহাকেও কাহারও উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছি (সূরা বাকারা ২৫৩)।

খুব খেয়াল করুন, সূরা বাক্বারার ২৮৫ নং আয়াতে নবীদের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ না করা সম্পর্কে উল্লেখ আছে। তারপর অন্য আয়াতে নবীগণের মাঝে পরস্পর অপেক্ষা বিশেষভাবে মর্যাদাবান বলেও উল্লেখ রয়েছে। তাই মোল্লা আলী কারী (রহ:) একজন যুগ ইমাম হিসেবে যেই ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন সেটি পবিত্র কুরআনের আলোকেই দিয়ে গেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানী নিজেও লিখেছে, মুজাদ্দিদ ব্যক্তি কুরআনের বুঝপ্রাপ্ত হন এবং ঐশী নিদর্শনসহ আগমন করে থাকেন। (রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮) সুতরাং আপনাদের উত্থাপিত আপত্তি পুরোপুরি অসার সাব্যস্ত হল। বিশিষ্ট মুফাসসীর, ইমাম কুরতুবী (রহ:) এর বক্তব্য হতেও হুবহু এমন ব্যাখ্যাই পাওয়া যায়। নিচে দেখুন!

ইমাম কুরতুবী (রহ:) লিখেছেন: ‘আন্নাল মান’আ মিনাত তাফদ্বীল। ইন্নামা হুয়া মিন জিহাতিন নাবুওয়্যাতি আল্লাতি হিয়া খাছলাতুন ওয়াহিদাতুন। লা তাফাদ্বালা ফীহা। ওয়াত তাফদ্বীলু ফী যিয়াদাতিল আহওয়াল ওয়াল খুছূছ ওয়াল কারামাত ওয়াল আল-ত্বাফ।’ অর্থাৎ অবশ্যই নবীগণের এককে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিতে নিষেধ রয়েছে। আর তা নিশ্চিতভাবে ও শুধু কেবল নবুওয়তের ক্ষেত্রে। যেহেতু নবুওতের ক্ষেত্রে সবার মান সমান। তাতে কেউ অন্যের উপর শেষ্ঠত্ব রাখেনা। অধিকন্তু শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে, কতেক বিশেষত্ব, সম্মান আর দয়ার আধিক্যতার ক্ষেত্রে। (আল মুয়াসসাসাতুল ফিকহিয়্যাহ : ৪০/৪৯)। আশাকরি যুগ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী আর ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুমাল্লাহু দুইজনের জ্ঞানগর্ভ সামঞ্জস্যতার বিধান ও বিশ্লেষণ দ্বারা সমাধান পেলেন।

জ্ঞানীদের নিকট পরিস্কার যে, মূলত হাদীস দুটির ভেতরে কোনো স্ববিরোধিতা নেই। কাজেই মির্যা কাদিয়ানীর স্ববিরোধী কথাবার্তা হালাল করতে হাদীসের উপর আক্রমণ করার চেষ্টা পুরোপুরি বৃথা গেল! সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।

আকাশে মৃতদের সাথে জীবিত ব্যক্তিও থাকতে পারা

প্রশ্নকর্তা : ঈসা (আঃ) দ্বিতীয় আসমানে জীবিত আছেন, এর দলিল দিন! তারপর একটি প্রশ্নের উত্তর দিন, ঈসা (আঃ) যদি দ্বিতীয় আসমানে জীবিত থেকে থাকেন তাহলে তো মানতে হবে যে, আসমানে অন্যান্য মৃতদের সাথেই জীবিত রয়েছেন! অথচ মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা! এর কী জবাব?

উত্তর : আপনার প্রশ্নের উত্তরে একটু পরে আসছি। তার আগে আমাকে দুটি প্রশ্নের উত্তর দিন! (১) মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা, এই কথার দলিল কী? কুরান হাদীসে কি এমন কোনো কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও এসেছে? (২) তর্কের খাতিরে মানলাম যে, আকাশে মৃতদের সাথে জীবিতরা একত্র হওয়া সম্ভব না! এমতাবস্থায় মেরাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কি মৃত ছিলেন যে, ফলে তাঁর পক্ষে সাত আসমানে মৃত নবীগণের সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়েছিল!?

এবার প্রাসঙ্গিক আলোচনায় চলুন! হযরত ঈসা (আঃ) দ্বিতীয় আসমানে থাকা মর্মে সহীহ বুখারীতে এসেছে “ছুম্মা ছ’য়িদা হাত্তা আতাস সামায়াছ ছানিয়াহ” অর্থাৎ অতপর (জিবরাইল আমাকে নিয়ে) দ্বিতীয় আকাশে এসে পৌঁছলেন। (রাসূল সাঃ আরো বলেন) “ফালাম্মা খালাছতু ফা ইযা ইয়াহইয়া ওয়া ঈসা ওয়া হুমা ইবনা খা-লাতিন।” অর্থাৎ এরপর আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন সেখানে ইয়াহইয়া এবং ঈসা আলাইহিমাস সালাম-কে দেখলাম। তাঁরা উভয়ই খালাত ভাই। দেখুন, সহীহ বুখারী কিতাবু আ-হাদীসিল আম্বিয়া, অধ্যায় ৫০; হা/৩১৮৯ (ইফা)।

প্রাপ্ত শিক্ষা ও কাদিয়ানী যুক্তির খন্ডন : উপরের হাদীস আমাদের বলছে, ঈসা আঃ বর্তমানে দ্বিতীয় আকাশে স্বশরীরে জীবিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, তবে কি অন্যান্য নবীগণও আকাশে স্বশরীরে জীবিত?

উত্তরে বলব, না, বরং শুধুমাত্র ঈসা (আঃ)-ই দ্বিতীয় আকাশে স্বশরীরে জীবিত! তার কারণ প্রথমত বহু সহীহ হাদীসে এসেছে আল্লাহতালা ঈসা (আঃ)-কে স্বশরীরে আকাশে জীবিত উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তিনি শীঘ্রই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন (আত-ত্ববকাতুল কোবরা লি-ইবনে সা’আদ ১/৩৬-৩৭ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু এইভাবে কোনো কথাই অন্যান্য নবীগণ সম্পর্কে কোনো হাদীসে পাওয়া যায়না। দ্বিতীয়ত, মেরাজের আরেকটি হাদীসে পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে, হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর কাছ থেকে দুনিয়াতে পুনরায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। একথা সুনানু ইবনে মাজাহ’র হাদীসেও এসেছে। হাদীসের ভাষ্য : “ফা-রুদ্দাল হাদীসু ইলা ঈসা ইবনে মরিয়ম ফা-ক্বলা ক্বদ ও’হিদা ইলাইয়্যা ফী-মা দূনা ওয়াজবাতিহা ফা-আম্মা ওয়াজবাতুহা ফা-লা ই’য়ালামুহা ইল্লাল্লাহু”। অর্থাৎ অতপর (কেয়ামতের) বিষয়টি ঈসা বিন মরিয়ম (আঃ)-এর নিকট পেশ করা হলে তিনি বলেন, আমার থেকে কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু কেয়ামতের সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নেই। (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪০৮১)। কিন্তু অন্য আর কোনো নবী-ই এইধরনের কোনো কথা বলেননি। এই সমস্ত কারণে কাদিয়ানীদের উক্ত প্রশ্ন – তবে কি অন্যান্য নবীগণও স্বশরীরে জীবিত, এটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল। সংক্ষেপে।

তাদের আরেকটি যুক্তি হল, মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা। তাই ইয়াহইয়া (আঃ) আর সাথে অবস্থানকারী ঈসা (আঃ) তিনিও মৃত প্রমাণিত! আমার জবাব, (১) পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে উল্লেখ আছে, মৃতরা কেয়ামতের আগে পুনরায় ফিরে আসবেনা। অথচ রাসূল (সাঃ) সহীহ বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়া অংশে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে শপথ করে ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে বলেছেন, ঈসা (আঃ) অচিরেই নাযিল হবেন। সুনানে ইবনে মাজাহ’র উক্ত হাদীসেও আপনারা দেখেছেন, ঈসা (আঃ) নিজেই নিজের পুনরায় ফিরে আসা সম্পর্কে প্রতিশ্রুতির কথা জানান দিয়েছেন। এখন মির্যায়ী উক্ত যুক্তি বাতিল না হলে তখন কাদিয়ানীদের নিকট নিচের প্রশ্নটির আর কোনো জবাব থাকেনা! প্রশ্নটি হল, তবে কি প্রতিশ্রুত সেই ঈসা ইবনে মরিয়ম পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য আকাশে আবার জীবিত হবেন? (২) তর্কের খাতিরে মানলাম, দ্বিতীয় আকাশে ইয়াহইয়া (আঃ) আর ঈসা (আঃ) দুইজনই মৃত, কিন্তু সেই দুই মৃত ব্যক্তির সাথে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাক্ষাৎ কিভাবে সম্ভব হল? নাকি এবার মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাক্ষাতকেও অস্বীকার করে বসবেন? দয়া করে ধূর্ত মির্যায়ী উগরানো বমি অন্ধের মতো না ছেঁটে নিজের মগজটা এবার একটু খাটাবেন! সত্য বলতে, মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা, মির্যায়ী এই অপযুক্তি মূলত রাসূল (সাঃ) এর হাদীসকে অমান্য করার বড় চালাকি বৈ কিছুই না!

সেযাইহোক, আপনাদের উল্লিখিত যুক্তির খন্ডনে আমি শুধু একটি প্রশ্ন করব।

আপনাদের যুক্তি হল, মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা! তাই আমার পাল্টা প্রশ্ন, আপনাদের উক্ত যুক্তি যদি সঠিক হয় তাহলে বায়তুল মুকাদ্দাসে আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ)-এর পক্ষে আপনা জীবিত অবস্থায় সেখানে মৃত্যুবরণকারী অন্যান্য নবীগণের সাথে একত্রিত হওয়া কিভাবে সম্ভব হল? তিনি (সাঃ) তো বায়তুল মুকাদ্দাসে আগত সমস্ত নবীর নামাযের ইমামতিও করেছিলেন। ফলে তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ উপাধিতে ভূষিত হন। কাজেই মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা, এটি একটি বাতিল ও দুর্বল যুক্তি বৈ নয়।

এবার প্রাসঙ্গিক বিষয়ে একজন যুগ ইমামের উদ্ধৃতি তুলে ধরব। শায়খ ইবনুল কাইয়্যুম রহঃ লিখেছেন :

أُسْرِىَ برسول الله ـ صلى الله عليه وسلم ـ بجسده على الصحيح من المسجد الحرام إلى بيت المقدس، راكبًا على البُرَاق، صحبة جبريل ـ عليهما الصلاة والسلام ـ، فنزل هناك، وصلى بالأنبياء إمامًا، وربط البراق بحلقة باب المسجد‏، ثم عرج به تلك الليلة من بيت المقدس إلى السماء الدنيا

অর্থাৎ সহীহ হাদীস অনুসারে রাসূল সাঃ এর ইসরাহ (ঊর্ধ্ব জগত ভ্রমণ) হযরত জিবরাঈল আঃ এর সাহচর্যে থেকে স্বশরীরে ও মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত বোরাক যোগে আরোহন অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল। অতপর তিনি বোরাক থেকে নিচে অবতারণ করেন এবং বোরাককে মসজিদুল আকসার এক কোণে বেধে (সেই বরকতময় রাতে সম্মিলিত) নবীগণকে নিয়ে ইমামতির মাধ্যমে তিনি সালাত আদায় করেন। অতপর তিনি জিবরাইলের সাথে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে প্রথম আসমানের উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বাকাশে পাড়ি দেন। (রেফারেন্স : যাদুল মা’আদ পৃষ্ঠা নং ৪৭)। এবার হয়ত প্রসঙ্গ এড়িয়ে আপনা জান ছুটাতে আপনারা মেরাজ স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হওয়া-ও অস্বীকার করতে পারেন। তখন উত্তরে বলব, এই সম্পর্কে আপনাদের নিকটেও মুজাদ্দিদ ও যুগ ইমাম হিসেবে মাননীয় শায়খ ইবনুল কাইয়্যুম (রহঃ) এর উদ্ধৃতি দ্বারা একটু আগেই মেরাজ স্বশরীরে হওয়ার প্রমাণ দেখেছেন। এই পর্যায় আপনাদের মির্যা কাদিয়ানীর মেরাজ সংক্রান্ত একটি উদ্ধৃতি পেশ করে আজকের মত আলোচনা এখানেই শেষ করব, ইনশাআল্লাহ।

মেরাজ সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানী তার “মালফূযাত” বইতে লিখেছেন,

উর্দু উচ্চারণ : হামারা ইয়ে মাযহাব হারগেয নিহি কে উয়ো এক খাব থা ইয়া স্রেফ রূহ গী, বলকে হাম তু কাহাতে হেঁ কে রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কো আঈনে বিদারী মে মেরাজ হুয়া আওর এক লতিফ জিসিম বিহি সাথ থা। “অর্থাৎ মেরাজ স্বপ্নযোগে বা আধ্যাত্মিকভাবে হয়েছিল এটা আমাদের মতামত নয়, বরং আমরা তো বলে থাকি যে, মেরাজ জাগ্রত অবস্থায় হয়েছিল এবং সূক্ষ্মতর একটি শরীরও সাথে ছিল।” (মির্যা কাদিয়ানীর রচিত মালফূযাত [উর্দু] খন্ড ৫ পৃষ্ঠা ১৩৪; নতুন এডিশন)।

এখানে বলে রাখা দরকার, মির্যার উল্লিখিত বক্তব্যে মেরাজ যে, স্বপ্নযোগে ছিলনা, বরং জাগ্রত অবস্থায়ই ছিল; অন্তত এইটুকু তো পরিষ্কার হল। তারপর বাকি থাকল “সূক্ষ্ণতর শরীর” বিষয়টি। আমি বলি, সূক্ষ্মতর শরীর এর ব্যাখ্যা আর যাইহোক না কেন, অন্ততপক্ষে মেরাজ যে “জাগ্রত অবস্থায়”-তেও হয়েছিল তা কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না! আল্লাহ আমাদেরকে সত্যটা যতই কঠিন হোক তা যেন সহজেই বুঝার এবং গ্রহণ করার তাওফিক দিন, আমীন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

আযানের আগে সালাত ও সালাম পাঠ করার বিধান কী?

  • আযানের আগে পরে সালাত ও সালাম :

প্রশ্নকর্তা : আযানের আগে সালাত ও সালাম পাঠ করার বিধান কী?
উত্তরদাতা : ইমাম ইবনে হাজার আল-হায়সামী (রহ.)-এর কিতাব {الفتاوى الكبرى} ‘আল ফাতাওয়াল কোবরা’ এর ১ম খন্ডের ১৩১ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে ان الصلاة و السلام على نبى قبل الآذان ليست السنة ‘আন্নাস সালাতা ওয়াস সালামা আলান নাবিয়্যি কবলাল আযান লাইছাত সুন্নাতুন।’ অর্থাৎ আযানের পূর্বে নবী করীম (সা.)-এর প্রতি সালাত ওয়া সালাম পাঠকরা সুন্নাত নয়। (ফেইসবুক থেকে পড়ুন)
প্রশ্নকর্তা : তাহলে দেশের কোথাও কোথাও এটি কোন্ দলিলে প্রচলিত?
উত্তরদাতা : আল্লাহই ভাল জানেন। তবে যতটুকু জানা যায় তা হল, আযানের পরে উচ্চৈঃস্বরে (মাইকে) সালাত ওয়া সালাম পাঠের প্রচলন হয়েছিল ৭৯১ হিজরীতে সুলতান নাসির সালাউদ্দিন ইবনে আইয়ুবের শাসনামলে এবং তারই নির্দেশে। এর প্রমাণ ইমাম আবুল আব্বাস ইবনে হাজার আল হাইছামী রচিত ‘আল ফাতাওয়াল কুবরা‘ এর আযান অধ্যায়ের ১৯১ নং পৃষ্ঠায় রয়েছে (নিচে স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য)। এই তথ্য ইমাম সাখাবী (রহ.) থেকে তাঁরই রচিত {القول البديع فى الصلاة على الحبيب الشفيع} ‘আল ক্বওলুল বাদী ফিস-সালাতি আলাল হাবীবিশ শাফী’ কিতাবেও রয়েছে। কিন্তু ইমাম জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী (রহ.) থেকে এই তারিখ ৭৮১ হিজরী উল্লেখ রয়েছে। (দেখুন ইমাম সুয়ূতী রচিত {حسن المحاضرة فى تاريخ مصر و القاهرة} হুসনুল মুহাযারাহ ফী তারীখে মিশর ওয়াল কাহেরাহ)। সুতরাং বুঝা গেল, এটি সুন্নত নয়। আরো বুঝা গেল, এটি অন্ততপক্ষে সাহাবায়ে কেরামের যুগেরও প্রায় ৬৭১ বছর পরে ফেতনা ফাসাদের যুগে উদ্ভাবন হয়। তাই জ্ঞানীদের উচিৎ হবে, বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে সাধারণ মানুষকে আন্তরিকতার মাধ্যমে যথাসাধ্য বুঝিয়ে আদিম ও সহজ সরল পন্থায় ফিরে আনতে চেষ্টা করা। প্রয়োজনে দুই পক্ষের বিজ্ঞ আলেম উলামাগণ দ্বারা উত্তম বিতর্ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংশয় নিরসনে উদ্যোগ নেয়া। তবে কিন্তু যেখানে বুঝাতে গেলে ঝগড়া বাধার সম্ভাবনা থাকবে সেখানে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ছবর আর দোয়ার মাধ্যমে নিরব থাকাই উত্তম। কেননা পবিত্র কুরআন বলছে, {الفتنة اشد من القتل} আল ফিতনাতু আশাদ্দু মিনাল ক্বাতলি। অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হত্যা থেকে জঘন্য।

বাবুল আযান, পৃষ্ঠা ১৯১, ইমাম ইবনে হাজার আল হাইছামী
  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

নবীজী (সা:)-কে হাজির নাজির বিশ্বাস করা যাবে কিনা?

  • হাজির নাজির :

প্রশ্নকর্তা : নবীজীকে হাজির নাজির বিশ্বাস করা যাবে কিনা?
উত্তরদাতা : আগে বলুন হাজির নাজির কাকে বলে?
প্রশ্নকর্তা : আমার জানা মতে, যিনি কোথাও উপস্থিত হন এবং সব কিছু দেখেন তাকে হাজির নাজির বলে।
উত্তরদাতা : কিন্তু পবিত্র কুরআন তো বলছে, মৃত্যুর পর কেয়ামতের পূর্বে আর কারো জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসার অনুমতি নেই! (সূরা মুমিনূন ৯৯-১০৩)। এখন আপনি কি মনে করেন যে, নবীজী পবিত্র কুরআনের এই বিধান লঙ্গন করবেন? নাউযুবিল্লাহ।
প্রশ্নকর্তা : না, কিন্তু আহলে সুন্নাহ’র পবিত্র বিশ্বাস তো এই যে, নবীজী (সা:) বরযখী তথা দুনিয়া আর কেয়ামতের মধ্যবর্তী জগতে জীবিত এবং রিযিকপ্রাপ্ত। তাহলে তো তিনি বরযখী জগতের বাহিরেও আল্লাহ্ চাহিলে বিশেষ কোনো পন্থায় নিশ্চয়ই যাওয়া আসা করার অনুমতি পাবেন, তাই নয় কি?
উত্তরদাতা : আপনার কথার সাথে আমিও একমত। কিন্তু আল্লাহ্ যে চাহিবেন না, সে কথা তো আগেই ‘কাল্লা ইন্নাহা কালিমাতুন হুয়া ক্বায়েলুহা’ (২৩:১০০) আয়াতে বলে দিয়েছেন। সেযাইহোক, তিনি (সা:) যে বরযখী জগতের বাহিরে আসতে অনুমতি পেয়েছেন তার কী দলিল আছে? তর্কের খাতিরে কিছুক্ষণের জন্য যদি মেনে নিই, নবীজী (সা:) বরযখী জগতের বাহিরেও যাওয়া আসা করেন; তখন তো প্রশ্ন আসবে, তিনি রাওজা শরীফ ত্যাগ করে বাহিরে কোথাও চলে গেলে সেই মুহুর্তে যেসব হাজী সাহেব মদীনায় নবীজীর রাওজা শরীফে উপস্থিত হয়ে ‘ওয়াস সালাতু ওয়াস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ’ পাঠ করবেন তখন কি তারা জনমানবহীন একটি খালি কবরকে সালাম করছেন না? উম্মতে মুহাম্মদিয়ার জন্য এর চেয়ে বড় কষ্টদায়ক আর কী হতে পারে? এই অবস্থায় কোটি কোটি উম্মতে মুহাম্মদিয়া অস্বস্তিকর অবস্থায়ও পড়বে কিনা?
প্রশ্নকর্তা : কোনো কোনো বক্তা তো বলে থাকেন, নবীজী মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানগুলোতে আসা যাওয়া করেন!
উত্তরদাতা : না এটি তাদের মনগড়া কথাবার্তা, যা সঠিক দলিল প্রমাণ আর যুক্তির কষ্টিপাথরে একদমই টিকেনা। সেযাইহোক, আচ্ছা যেসব বক্তা এমন কথা বলেন তাদেরকে আজই জিজ্ঞেস করবেন তারা নিজেদেরকে নবীজীর ‘সাহাবী’ মনে করেন কিনা? কেননা নবীজী যখন মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে আসবেন তখন তো তিনি তাদেরকেও দেখবেন, তাই নয় কি? কারণ, সাহাবীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যারা ঈমানের সহিত নবীজীর সোহবত (সাহচর্য) লাভ করবে এবং ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করবে তারা সাহাবী। ফলে বুঝা গেল, সাহাবী হতে হলে নবীকে চর্মচোখে দেখা জুরুরি নয়, বরং নবীজীর সাহচর্য পাওয়াই জুরুরি। কেননা বহু সাহাবী এমনও ছিলেন যারা জন্মান্ধ। যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা:) প্রমুখ। এখন এর কী জবাব?
প্রশ্নকর্তা : পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে ‘ইয়াকূনুর রাসূলু আলাইকুম শাহীদা’ (০২:১৪৩) তাহলে বলুন, তিনি হাজির নাজির না হয়ে কেয়ামতের দিন স্বীয় উম্মতের পক্ষে সাক্ষ্যদানকারী কিভাবে হবেন?
উত্তরদাতা : এখানে ‘শাহীদান’ বলতে সাক্ষ্যদানকারী বুঝায়নি, বরং ‘সত্যায়নকারী’ বুঝানো হয়েছে। কারণ কেয়ামতের দিন নবীগণের পক্ষে ও তাঁদের উম্মতদের দায়েরকৃত অভিযোগ খন্ডনে উম্মতে মুহাম্মদিয়ার ঐতিহাসিক সাক্ষ্যদানের পর্বটি নবীজী কর্তৃক সত্যায়িত হবে। তাই এই আয়াতে ‘শাহীদান’ অর্থ ‘সাক্ষ্যদানকারী’ নেয়া আয়াতের পটভুমি (Context)’র বিচারে সঠিক নয়। (দেখুন সহীহ বুখারী ২/৬৪৫, আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণিত হাদীস)। আচ্ছা, আল্লাহতালা তো কোনো এক ঘটনা-প্রেক্ষিতে নবীজী সম্পর্কে এও বলেছেন ‘ওয়া মা কুনতা মিনাশ শাহিদীন’ (ক্বাছাছ ৪৪)। অর্থাৎ আর আপনি (তখন) শাহিদ ছিলেন না। এবার এই ‘শাহিদ’ এর কী হবে?
প্রশ্নকর্তা : কবরের ভেতর নবীজির দিকে সম্বোধন করে মাইয়্যেতকে ফেরেশতা প্রশ্ন করবেন ‘ওয়া মান হাযার রাজুল’ ( و من هذا الرجل)? এখানে ‘হাযা’ (This/هذا) শব্দটি তো নিকটবর্তী কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে বুঝাতে আসে!
উত্তরদাতা : কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করার কারণে অনেক সময় প্রচলিত ব্যাকরণের বিরুদ্ধেও চলে যায়। তার অন্যতম উদাহরণ, হযরত ইবরাহিম (আ:) কর্তৃক ‘হাযা’ শব্দ দ্বারা চন্দ্র-সূর্যের দিকে ইংগিত করা। যেমন, তিনি বলেছিলেন ‘হাযা রাব্বী’ (কুরআন ৬:৭৮)। অর্থাৎ ইহা আমার প্রভু। এখানেও কিন্তু ‘মুশারুন ইলাইহি’ (সম্বোধিত বস্তু) চন্দ্র। যা নিকটে নয়, বরং দূরে। উল্লেখ্য, এটি নবুওতপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেকার ঘটনা, তাই এই জন্য তিনি অভিযুক্ত হবেন না।

  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

নবীজী (সা:)-এর ছায়া বা প্রতিবিম্ব ছিল কিনা?

  • নবীজী (সা:) এর ছায়া বা প্রতিবিম্ব :

প্রশ্নকর্তা : নবীজী (সা:)-এর ছায়া বা প্রতিবিম্ব ছিল কিনা?

উত্তরদাতা : নবীজী (সা:)-এর ছায়া বা প্রতিবিম্ব ছিল কিনা, এর চাক্ষুষ প্রমাণ কেবল মাত্র ওরাই দিতে পারেন যারা নবীজীকে কাছ থেকে দেখেছেন এবং দিবারাত্রি উনার পাশেই থেকেছেন! সে হিসেবে এই তালিকায় আমরা সর্বপ্রথম উনার (সা:) স্ত্রী তারপর উনার খুব কাছের সাহাবীদের স্থান দেব। উনাদের মাধ্যমে সহীহ ও মারফূ (তথা ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র নবীজী পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকা) সনদে কোনো একটি বর্ণনা দ্বারাও যদি প্রমাণিত হয় যে, উনার ছায়া মুবারক ছিল কিংবা ছিলনা; যেটাই হোক সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। কেননা ঈমানের দাবী হচ্ছে, দ্বীনের ব্যাপারে নিজকে নিরপেক্ষ রাখা ও সত্যকে বিনাবাক্যে লুফে নেয়া।

(ক) উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, হযরত যয়নব (রা:) তিনি নবীজীর ছায়া দেখা সম্পর্কে পরিস্কার বলেছেন : ‘ফা রাআইতু জিল্লাহু (فرأيت ظله)।’ অর্থাৎ আমি তাঁর ছায়া দেখেছি। (মুসনাদে আহমদ ৭/৪৭৪; হাদীস নং ২৬৩২৫ দ্রষ্টব্য)।

(খ) উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ বিনতে হোইয়াই (রা:) হতেও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন : ‘ইয্ আনা বি-জিল্লি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ববিলুন (ذ أنا بظل رسول الله صلى الله عليه وسلم مقبل)।’ অর্থাৎ ইত্যবসরে আমি আল্লাহ’র রাসুলের ছায়ার নাগাল পেয়ে গেলাম (মুসনাদে আহমদ ৬/১৩২); হাদীস নং ২৫০০২; হাদীসের সব রাবী ছিক্বাহ)।

(গ) নবীজী (সা:)-এর দীর্ঘ দশ বছরের খাদেম হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা:) হতে মারফূ সনদে ও একদম সহীহসূত্রে বর্ণিত আছে, নবীজী (সা:) কোনো এক ঘটনাপ্রেক্ষিতে বলেছেন : ‘রাআইতু জিল্লি ওয়া জিল্লাকুম ফীহা’ (رأيت ظلى و ظلكم فيها)। অর্থাৎ তার মধ্যে আমি আমার এবং তোমাদের ছায়া দেখেছি। সংক্ষেপে। (সহীহ ইবনে খোজায়মা ২/৫০, হাদীস নং ৮৯; মুসতাদরিক আল হাকেম ৫/৬৪৮; হাদীস নং ৮৪৫৬; হাদীসের মান, সহীহ)। ইমাম রাজী (রহ:) লিখেছেন, ‘ফী’ বর্ণটি অভিধানে ‘অতি নিকটে’ অর্থ বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন সূরা আন-নমল আয়াত নং ৮; মূসা (আ:) সম্পর্কে ‘আন বূরিকা মান ফীননার’ (অর্থাৎ বরকতময় হোক তিনি যিনি আগুনের মধ্যে আছেন…) উল্লেখ আছে। অথচ তূর পর্বতমালায় তখন তিনি আগুনের অভ্যন্তরে ছিলেন না, বরং অতি নিকটে বা কোনো এক পাশেই ছিলেন (তাফসীরে কাবীর ২৪/১৮৩)। কাজেই উক্ত হাদীসে ‘আগুনের মধ্যে’ মানে আগুনের অতি নিকটে বা আগুনের এক পাশে, এই অর্থই উদ্দেশ্য। হতে পারে তখন ছায়াগুলো নবীজীর পেছনে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ হাদীসে এও উল্লেখ আছে যে, নবীজী (সা:) নামাজ অবস্থায় আপনা পেছনেও তদ্রূপ দেখতে পান যেভাবে সামনে দেখেন। যেমন তিনি বলেছেন : ‘ইন্নী লা-আরাকুম মিন ওরায়ী কামা আরাকুম’। (উমাদাদুল ক্বারী শরহে সহীহ বুখারী, কিতাবুস সালাত, অধ্যায় নং ৪০)। সুতরাং এরপরেও যাদের বিশ্বাস যে, নবীজী (সা:)-এর ছায়া মুবারক থাকা সঠিক নয় তাদের নিরপেক্ষ বিবেকের নিকট প্রশ্ন, আপনারা ‘ছায়া না থাকা’ এর সমর্থনে অন্তত একটি হাদীসও কি দেখাতে পারবেন যেটির সনদ (সূত্র) ‘মারফূ’ এবং গয়রে মাজরূহ ও বিশুদ্ধ! অথচ উপরে উল্লিখিত হাদীসগুলোর সনদ যেমন গয়রে মাজরূহ ও বিশুদ্ধ তেমনি আনাস ইবনে মালেক (রা:)-এর বর্ণিত হাদীসের সনদ ‘মারফূ’ পার্যায়েরও। সংক্ষেপে।

প্রশ্নকর্তা : বহু বক্তা সাহেবকে তো ওয়াজ মাহফীলে বলতে শুনা যায় যে, সূর্যের কিরণে নবীজীর ছায়া পড়ত না কিবা দেখাও যেত না! তাহলে কি ওনারা এসব ভুল বলেন?

উত্তরদাতা : আচ্ছা বলুন দেখি! সূর্যের কিরণে নবীজীর ছায়া না পড়া কিংবা ছায়া দেখতে না পারার ব্যাখ্যা কি ‘ছায়া না থাকা’? নিশ্চয়ই ছায়া না থাকা নয়। বরং ছায়া থাকা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে তা মাটিতে না পড়াই ছিল নবীজীর মুজিজা। অন্যথা উল্লিখিত সহীহ হাদীসগুলোর প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ ছাড়া আর কিছুই না! সেযাইহোক, এবার সূর্যের কিরণে নবীজীর ছায়া মাটিতে না পড়ার অন্যতম কারণ কী ছিল তা তাফসীরে মাদারিক প্রণেতার কাছ থেকে জেনে নিন! তিনি লিখেছেন: ‘লি-আল্লা ইয়াক্বা’আ ইনসানু ক্বাদামাহু আলা যালিকাজ জিল্লি’ (لئلا يقع انسان قدمه على ذالك الظل)। অর্থাৎ আল্লাহতালা নবীজীর ছায়া মুবারক মাটিতে পতিত করেন না, যাতে কেউ উনার ছায়াকে মাড়াতে না পারে। (পারা নং ১৮ দ্রষ্টব্য)। এবার বলুন, বর্তমান যুগের এই সমস্ত বক্তাদেরকে বিশ্ববিখ্যাত ‘তাফসীরে মাদারিক’ প্রণেতার চেয়েও কি অধিক জ্ঞানী মানবেন?

লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

নবীজী (সা:) কি গায়েব জানতেন?

নবীজী (সা:)-এর গায়েব জানা প্রসঙ্গ :

প্রশ্নকর্তা : নবীজী (সা:) কি গায়েব জানতেন?

উত্তরদাতা : আগে বলুন, গায়েব কাকে বলে?

প্রশ্নকর্তা : তাফসীরে কাবীর গ্রন্থের ২য় খন্ডের ১৭৪ নং পৃষ্ঠায় ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ:) লিখেছেন : গায়েব হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়শক্তির বহির্ভূত অদৃশ্যবস্তু।

উত্তরদাতা : তাহলে এবার আপনিই বলুন, উক্ত সংজ্ঞামতে রাসূল (সা:) এর গায়েব জানা বস্তুগুলো কী কী?

প্রশ্নকর্তা : কেন! জান্নাত জাহান্নাম সহ আরো তো কত কিছু!! আপনি কি মনে করেন এগুলো গায়েবী বিষয় নয়?

উত্তরদাতা : তা অবশ্যই। কিন্তু রাসূল (সা:) তো এগুলো আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমেই জেনেছেন! (পবিত্র কুরআনের সূরা আন নাজম আয়াত নং ৩-৪ দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ এগুলো তো তিনি ওহীর মাধ্যমেই জেনেছিলেন!

প্রশ্নকর্তা : তাতে কী! ওহীর মাধ্যমে জানলে কি সেটি ‘গায়েব’ হবেনা?

উত্তরদাতা : না, গায়েব হবেনা। তখন নাম পবিরর্তন হয়ে ‘ইলমে ওহী’ হয়ে যাবে। আপনি তাফসীরে রূহুল বয়ান এর ২১ নং পারা থেকে দেখুন। সেখানে সুস্পষ্টভাবে লিখা আছে, নবীগণ হতে যে সব অদৃশ্যের সংবাদ বর্ণিত আছে তা শুধুমাত্র بطريق الوحى অর্থাৎ ওহীর প্রক্রিয়ায় ছিল। অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত অদৃশ্যবস্তুকে ইলমে ওহী তথা ঐশীলব্ধ জ্ঞান-ই বলা হবে! যেমন হাদীসের ইলমকে ‘ইলমে হাদীস’ এবং ফিকহের ইলমকে ‘ইলমে ফিকহ’ বলা হয়। আরো সহজ করে বলতে গেলে, যে জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহর নিকটেই সংরক্ষিত তা গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞান; কিন্তু যখন তা কোনো গায়রুল্লাহ’র নিকট প্রকাশিত হবে তখন তা ‘গায়েব’ ছাড়া ভিন্নভিন্ন নামে নামকরণ হবে।

প্রশ্নকর্তা : আচ্ছা নবীজী (সা:) গায়েব জানেন, এইরকম বিশ্বাস রাখা কেমন?

উত্তরদাতা : নবীজী (সা:) গায়েব জানেন, এইরকম বিশ্বাস রাখা অন্যায়। আপনি পবিত্র কুরআনের সূরা নামাল এর ৬৫ নং আয়াতটির অনুবাদ দেখুন। আল্লাহ নিজেই বলছেন, ‘লা ইয়া’লামু মান ফিছ ছামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্বিল গাইবা ইল্লাল্লাহু।’ অর্থাৎ আসমান আর জমিনে যা কিছু রয়েছে তারা কেউই গায়েব জানেনা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। তো এবার কী বুঝলেন? তাছাড়া হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠ ফকিহ্ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, ইমাম সাহেব এমন ব্যক্তির ব্যাপারে কুফুরীর ফতুয়া দিয়েছেন যে নবীজী (সা:)-কে গায়েব জান্তা মনে করে। দেখুন ফিকহে আকবর এর ব্যাখ্যামূলক কিতাব ‘শরহে ফিকহে আকবর’ (পৃষ্ঠা নং ৮৫; মোল্লা আলী ক্বারী)। সংক্ষেপে। তবে হ্যাঁ, নবীজী (সা:) সম্পর্কে আমাদের আকীদা বড়জোর এমন হতে পারে যে, তিনিই (সা:) একমাত্র খুব জান্তা, তবে সব জান্তা নন। কারণ সব জান্তা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’লা।

লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

রাসূল (সা:) কিসের সৃষ্টি? নূরের না মাটির?

রাসূল (সা:)-এর সৃষ্টিমূল উপাদান!

(যাদের সময় কম তারা এই লিখাটি পড়তে পারেন)

প্রশ্নকর্তা : রাসূল (সা:) কিসের সৃষ্টি? নূরের না মাটির?

উত্তরদাতা : পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহা এর ৫৫ নং আয়াত দেখুন। সেখানে সুস্পষ্টভাবে ‘মিনহা খালাক্বনাকুম’ (منها خلقناكم) অর্থাৎ তোমাদেরকে এই মাটি থেকেই সৃষ্টি করেছি, উল্লেখ আছে; অনুবাদ, ফতুয়ায়ে আফ্রিকা পৃ ৮২; ঊর্দূ ভার্সন। আয়াতটির ‘কুম’ (كم/You) বহুবচনাত্মক শব্দটি আম বা ব্যাপকার্থক। এর তাৎপর্যে বিনা ব্যতিক্রমে নবী, গয়রে নবী সকল কবর পথযাত্রী অন্তর্ভুক্ত। অতএব রাসূল (সা:) তিনিও যেহেতু একজন কবর পথযাত্রী ছিলেন সেহেতু তাঁর (সা:) শরীর মুবারকের সৃষ্টিমূল উপাদানও মাটি ছিল প্রমাণিত।

প্রশ্নকর্তা : কিন্তু বহু মওলানা সাহেব তো বলে থাকেন, আল্লাহতালা সর্বপ্রথম রাসূল (সা:)-এর নূর মুবারক সৃষ্টি করেছেন!

উত্তরদাতা : এর উত্তর আমি আমার পক্ষ থেকে না দিয়ে বরং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও মেশকাতুল মাসাবীহ্ কিতাবের ব্যাখ্যাকারক হযরত মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) এর উদ্ধৃতিতে দিতে চাই। তিনি লিখেছেন: সর্বপ্রথম রাসূল (সা:) এর নূর মুবারক সৃষ্টি করা হয়েছে বলে যে কথা বর্ণিত আছে তদ্দ্বারা উদ্দেশ্য হল আল্লাহতালা সর্বপ্রথম তাঁর রূহ মুবারক সৃষ্টি করেছেন। (মেরকাত শরহে মেশকাত, কিতাবুল ঈমান, ঈমান বিল কদর অধ্যায়, হা/৯৪; স্ক্রীনশট দ্রষ্টব্য)।

তবে ইমাম সুয়ূতী (রহ:) বলেছেন, সর্বপ্রথম রাসূলের নূর সৃষ্টি করা সম্পর্কিত বর্ণনাটির নির্ভরযোগ্য কোনো সনদ (ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র) নেই। (আল-হাভী লিল ফাতাওয়া ১/৩২৫, ফাতাওয়াল কুরআনিয়্যা, সূরা মুদ্দাসসির অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট দেখুন।

তাই শুধুমাত্র নূর এর রেওয়ায়েতগুলোর সনদের খোঁজ পাওয়া ও তা সহীহ প্রমাণিত হওয়া শর্তেই নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে যে, রাসূল (সা:)-এর রূহ মুবারক-ই সর্বপ্রথম সৃষ্ট! তবে সহীহ এবং দ্বয়িফ মিলে বহু বর্ণনা দ্বারা প্রথম সৃষ্টির বহু কিছুই উল্লেখ রয়েছে। সেক্ষেত্রে জবাব হল, সেই প্রথম সৃষ্ট বস্তুগুলো তাদেরই সমজাতীয় বস্তুর মধ্য থেকেই উদ্দেশ্য। যেমন রূহ সমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম সৃষ্ট মুহাম্মদ (সা:)-এর রূহ মুবারক, যাকে সম্মানসূচক ‘নূর’ বলা হয়। মোল্লা আলী ক্বারী লিখেছেন : ‘আন্না কুল্লা ওয়াহিদিন মিম্মা যুকিরা খুলিক্বা ক্বাবলু মা হুয়া মিন জিনসিহি।’ সংক্ষেপে। (মেরকাত, কিতাবুল ঈমান)।

প্রশ্নকর্তা : কিন্তু আলা হযরত আহমদ রেজাখাঁ বেরলভী (আলাইহির রাহমাহ্) কর্তৃক লেখিত কিতাব ‘আসসানিয়াতুল আনীফা ফী ফতুয়ায়ে আফ্রীকা’ নামক কিতাবের একস্থানে লিখা আছে “হুজুরপাক (সা:) আল্লাহর নূর হতে সৃষ্ট।” যেমন ‘মুঝে আপনে নূর চে পয়দা কিয়া’। অর্থাৎ আমাকে তিনি স্বীয় নূর হতে সৃষ্টি করেছেন। একই পৃষ্ঠার আরেকটু নিচে হাদীসের উদ্ধৃতিতে লিখা আছে, হুজুর আকদাস নে ফরমাইয়া… মে আওর আবুবকর ওয়া উমর এক মেট্টি চে বনে উসি মে দফন হোঁ গি। অর্থাৎ হযরত আক্বদাস (সা:) ইরশাদ করেছেন… আমি এবং আবুবকর আর উমর তিনোজন একই (গোরস্তানের) মাটি হতে সৃষ্ট এবং তাতেই দাফন হবো।’ (রেফারেন্স ‘ফতুয়ায়ে আফ্রিকা’ পৃষ্ঠা নং ৮২, মাসয়ালা নং যথাক্রমে ৬২-৬৩, ঊর্দূ ভার্সন, মাকতাবায়ে নূরিয়া রেজভিয়া, ফয়সালাবাদ; স্ক্রীনশট দ্রষ্টব্য)।


উত্তরদাতা : হ্যাঁ, আমি নিজেও কিতাবটি পড়েছি। উনার বক্তব্য দুটি বাহ্যত স্ববিরোধী। তাই উচিত, মতভেদপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-এর নিকটই সমর্পণ করা। পবিত্র কুরআন (৪:৫৯) আমাদের এটাই শিক্ষা দেয়। তাই আলা হযরত (আলাইহির রহমাহ্) কোথায় কী লিখলেন আর না লিখলেন সেটি প্রকৃত বিচারে মোটেও গুরুত্ব রাখেনা। কেননা তিনি না আল্লাহ আর না তাঁর প্রেরিত কেউ! আল্লাহ উনাকে ক্ষমা করুন।

প্রশ্নকর্তা : প্রত্যেক নবজাতক শিশু মৃত্যুর পর যেই স্থানে দাফন হবে ফেরেশতা সেই স্থানের মাটির কিছু অংশ নিয়ে এসে মাতৃগর্ভস্থিত নোতফার উপর ছিটিয়ে দেন। তারপর সেই মৃত্তিকা থেকেই তাকে সৃষ্টি করা হয়-এমন কথাও তো আলা হযরতের কিতাবে লিখা আছে! (দেখুন, পৃষ্ঠা নং ৮৩, মাসয়ালা নং ৬৩)।

উত্তরদাতা : জ্বী হ্যাঁ। তিনি একখানা হাদীসের উদ্ধৃতিতে এবং বে-গয়রে ইসতিছনা তথা বিনা ব্যতিক্রমেই এইরূপ বয়ান দিয়েছেন। তবে হাদিসটির সূত্র (Chain) কতটা সহীহ তা আল্লাহপাকই সব চে ভাল জানেন। এ থেকেও প্রমাণ মিলে যে, রাসূল (সা:)-এর সৃষ্টিমূল উপাদানে আপনা কবরের মাটি মিশ্রিত ছিল। পার্থক্য শুধু এইটুকু, উনার কবরের মাটি নিঃসন্দেহে ‘রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ’ হিসেবে জান্নাতি মহামূল্যবান মাটি আর আমাদেরটা সাধারণ মাটি।

প্রশ্নকর্তা : হযরত উসমান (রা:)-এর উপাধী ছিল ‘যুন্নূরাঈন’ অর্থাৎ দুই নূরের (রুকাইয়্যাহ্, কুলছুমাহ্) অধিপতি। তাই প্রশ্ন আসে, নবীজি (সা:) নূরের তৈরী না হলে তাঁর মেয়েদের ‘নূর’ বলার কী মানে?

উত্তরদাতা : এখানে নবীজির কন্যাদ্বয়কে শুধুমাত্র সম্মানসূচক কারণেই ‘নূর’ বলা হয়েছে। যেমন কা’বা শরীফকে সম্মানসূচক কারণে আল্লাহ’র দিকে সম্বন্ধযুুুক্ত করে ‘বায়তুল্লাহ’ তথা আল্লাহ’র ঘর বলা হয়। যাদের পেটে কথা থাকেনা বাংলাভাষার বাগধারায় তাদের বলা হয় ‘পেটপাতলা’। আরবীভাষার তেমনি কোনো বাগধারার নিয়মেই হযরত উসমানও ‘যুন্নূরাঈন’ শব্দে ভূষিত হয়েছেন বলা যায়। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন।

প্রশ্নকর্তা : রাসূল (সা:)-কে সাধারণ মানব বলা কুফুরী হবে কিনা?

উত্তরদাতা : এমন কোনো কথা বেয়াদবির নিয়তে বলা নিঃসন্দেহ কুফুরী এবং নবী অবমাননার শামিল।

প্রশ্নকর্তা : সূরা কাহাফ এর ১১০ নং আয়াত তো পরিষ্কার বলছে, কুল ইন্নামা আনা বাশারুম মিছলুকুম। অর্থাৎ বলুন! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ।

উত্তরদাতা : উক্ত আয়াতের Context বা পটভুমি দেখে নিন। তবেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, আল্লাহর এই কথার পেছনে উদ্দেশ্য কী? সূরা মুমিনূন এর ৩৩-৩৪ আয়াত দুটোও দেখুন। মুহাম্মদ (সা:) রাসূল হয়ে থাকলে তিনি খাওয়া দাওয়া, হাটবাজার ইত্যাদি কেন করবেন! এই ছিল মুশরিকদের আপত্তি! মূলত, তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ আপত্তিকে খন্ডন করতেই ‘ইন্নামা আনা বাশারুম মিছলুকুম’ নাযিল হয়েছিল। অথবা সহীহ বুখারীর ৪০১ নং হাদীসটাও দেখতে পারেন। রাসূল (সা:) ‘আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ’ একথা বলার পরে তিনি নিজেই এর তাৎপর্য বুঝিয়ে দিতে বলেছেন ‘আন্সা কামা তানসাওনা’ (أنسى كما تنسون) অর্থাৎ তোমরা যেমন ভুলে যাও তেমনি (মানবীয় কারণে) আমিও ভুলে যাই। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে আরো বলা যায় যে, মানবীয় কারণে যেহেতু মানুষের অভ্যাস ভুলে যাওয়া, অপারগ ও অসুস্থ হওয়া, ক্ষুধা-তৃষ্ণা লাগা, বিবাহ করা, সন্তান-সন্ততি হওয়া ইত্যাদি। মুহাম্মদে আরাবী (সা:) তিনিও একজন মানব ছিলেন বিধায় মুশরিকদের অজ্ঞতাপূর্ণ আপত্তির খন্ডনপূর্বক আল্লাহতালা বলেছেন, বলুন! আমিও তোমাদের মতই মানুষ।… এই ছিল পটভুমি। কে জানি বলেছিল, আয়াতে ‘আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ’ একথা শুধু নবীজীকেই বলতে বলা হয়েছে! যুক্তি হচ্ছে, ‘কুল’ (قل) অর্থাৎ আপনি বলুন (একবচনে)। কিন্তু এই যুক্তি ভুল। কেননা সূরা ইখলাসের মধ্যে হুবহু ‘কুল’ শব্দ দ্বারাই নবীজীকে বলতে আদেশ করা হয়েছে যে, বলুন! হুয়াল্লাহু আহাদ। অর্থাৎ আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তো এর মানে কি আল্লাহ একজন তা আমরা বলতে পারব না?

প্রশ্নকর্তা : রাসূল (সা:)-কে ‘নূর’ বলা যাবে কি?

উত্তরদাতা : জ্বী হ্যাঁ, অবশ্যই। সূরা মায়েদা আয়াত নং ১৫ দেখুন। আল্লাহ বলেছেন, মিনাল্লাহি নূর। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হতে একখানা নূর তথা জ্যোতি। আল্লাহতালা নবীজিকে নূর আখ্যা দিয়েই থেমে যাননি, বরং পরের আয়াতে ‘ইয়াহ্দি বিহিল্লাহু’ (يهدى به الله) অর্থাৎ যার মাধ্যমে তিনি হিদায়াত দিয়ে থাকেন, এভাবে উল্লেখ আছে। বুঝা গেল, উনাকে জাতি নূর বলে বুঝাননি, বরং বাংলা ব্যাকরণের বাগ্ধারার নিয়মে সত্যের দিকে পথপ্রদর্শনকারী হিসেবে একখানা হিদায়াতী নূর বুঝানো হয়েছে। যাকে আরবী ভাষায় ‘সিফাতি নূর’ বলে। একথা সহীহ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকারক কাজী ইয়াজ (রহ:) তার ‘ইকমালুল মুসলিম’ কিতাবের ৩য় খন্ডের ১২৫-২৬ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘মা’নান্নূরি হুনা বয়ানুল হাক্কি ওয়াল হিদায়াতু ইলাইহি’ (معنى النور هنا بيان الحق والهداية اليه)। অর্থাৎ এখানে নূর এর তাৎপর্য হল সত্য ও হিদায়াতের দিকে পথপ্রদর্শনকারী। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বলি, সোনার বাংলাদেশ। এখানে আর যাইহোক অন্তত বাংলাদেশকে সোনার তৈরী বুঝায়নি! অনুরূপ মক্কা হতে ৬ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত গারে হেরা-কে বলা হয় ‘জাবালে নূর’ বা নূরের পাহাড়! তার মানে এই নয় যে, ওই পাহাড়টি নূরের তৈরী! সংক্ষেপে।

প্রশ্নকর্তা : বহু আলেম তো বলে থাকেন, এর মানে তিনি (সা:) নূরের তৈরী!

জবাবদাতা : তা আমিও জানি। কিন্তু গ্রহণযোগ্য দলিল প্রমাণ তো থাকতে হবে! আচ্ছা বহু আলেম তো এটাও বলেন যে, নবী সৃষ্টি না হলে কিছুই সৃষ্টি হত না! তাই সে সমস্ত আলেমকে আজই প্রশ্ন করবেন, নবী নূরের তৈরী হলে তখন সৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘নবী’ আগে না ‘নূর’ আগে? কেননা, যে জিনিস দ্বারা তৈরী করা হবে সেটি অবশ্যই আগে হতে হয়? সহীহ মুসলিম শরীফের ২৭৮৯ নাম্বার হাদীসে উল্লেখ আছে : ‘ওয়া খালাক্বান নূরা ইয়াওমাল আরবা’আয়ি’ (ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻨﻮﺭ ﻳﻮﻡ ﺍﻷﺭﺑﻌﺎﺀ )। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা বুধবারে নূর সৃষ্টি করেছেন। ভাবিয়ে তুলে কিনা? তাই আবেগপ্রবণ হয়ে যাইচ্ছেতাই বলা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কেননা আমরা যাই বলিনা কেন, একদিন সব কিছুরই হিসেব দিতে হবে।

প্রশ্নকর্তা : যদি বলেন ‘মাটির তৈরী’ তখনও তো একই প্রশ্ন দাঁড়াবে?

উত্তরদাতা : জ্বী হ্যাঁ, এই জন্যই বলতে হবে যে, নবী কীসের সৃষ্টি-প্রাইকারী হারে প্রশ্নটাই ভুল। এতদ্ব্যতীত আহলে সুন্নাহ’র সব মানহাজের কলেমা গো মুসলমানগণ সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন যে, অপরাপর নূর সমুহের ন্যায় প্রিয় নবীর রূহ মুবারকও মহান আল্লাহর নিকট একখানা নূর তুল্য। মূলত এই জন্যই লোকমুখে প্রসিদ্ধ আছে : ‘লাও লা-কা লামা খালাক্বতুল আফলাক্ব।’ তাই সঠিক প্রশ্নটি হল ‘নবীজির শরীর মুবারক সৃষ্টির মূল উপাদান মাটিও ছিল কিনা?’ উল্লেখ্য, মানব সৃষ্টির মূল উপাদানে শুধুই মাটি ছিলনা, বরং অগ্নি, অক্সিজেন এবং পানিও ছিল। তাই সারসংক্ষেপ উত্তর হল, একজন মানুষ হিসেবে আমাদের প্রিয় নবীজির শরীর মুবারক মাটিরই নির্যাস থেকে সৃষ্ট। কারণ মানুষের সৃষ্টিমূল উপাদান সম্পর্কে পবিত্র কুরআন বলছে, সুলালাতিম্ মিন ত্বীন।’ অর্থাৎ মানুষ মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্ট (সূরা মুমিনূন ১২)।

প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ইতিটানার আগে একখানা অপ্রিয় তথ্য জানান দেব। অনুরোধ থাকবে পাঠকবৃন্দ ধৈর্য্য হারা হবেননা! ইমাম হাকিম (রহ:) সংকলিত ‘মুসতাদরিক আলা আস-সহীহাঈন’ এর ২য় খন্ডের ৭২২ নং পৃষ্ঠার দীর্ঘ একটি হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহতালা হযরত আদমকে কোনো এক ঘটনাপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞেস করেন, তুমি মুহাম্মদকে কিভাবে চিনলে? ‘ওয়া লাম আখলুক্বহু’ অথচ আমি তাঁকে [এখনো] সৃষ্টিই করেনি (আরবী: و لم اخلقه)। হাদীসের মান, সহীহ। হাদীসটি বায়হাক্বী এবং তাবারানী প্রভৃতি হাদীসগ্রন্থেও উল্লেখ আছে। এই হাদীস আমাদের পরিষ্কার ঈংগিত দিচ্ছে, রাসূল (সা:)-এর শরীর মুবারক আপনা মাতৃগর্ভে সকল নবী রাসূলের পরে ‘সুলালাতিম মিন ত্বীন’ হিসেবে মাটির নির্যাস হতেই সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যথা, হাদীসে কুদসী: ‘অথচ আমি তাঁকে (এখনো) সৃষ্টিই করেনি’-এর কী মানে? জ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলে কিনা? সারকথা, নবীজির রূহ মুবারক সম্মানসূচক কারণে “নূর” শব্দে ভূষিত (الاضافة إضافة تشريف)। (শরহে মাওয়াহিব আয্-যুরকানী ৯০)।

প্রশ্নকর্তা : জনৈক বক্তা বলেছেন, হাদীসে নাকি আছে : আউয়ালু মা খালাক্বাল্লাহু নূরী মিন নূরিহি! মানে, সর্বপ্রথম আল্লাহর নূর হতে নবীর নূর সৃষ্টি করা হয়েছে।

উত্তরদাতা : এর জবাব উপরে দেয়া হয়েছে যে, ইমাম সুয়ূতী (রহ:) সহ বহু হাদীস বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এটি ভিত্তিহীন কথা। কিন্তু তার আরেকটি জবাব হচ্ছে, উল্লিখিত বর্ণনাটি প্রায় দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ একটি বর্ণনা। যেখানে এও লিখা আছে, ওয়া খালাক্বা কুল্লা শাইয়িম মিন নূরী। অর্থাৎ আল্লাহতালা সব কিছু আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন (ফতুয়ায়ে আফ্রিকা, মাসআলা নং ৬২ দ্রষ্টব্য)। তো এবার সব কিছুই যদি নূরের সৃষ্টি হয় তাহলে মাটি আর আগুনের সৃষ্টি কারা? ভাবিয়ে তুলে কিনা? কাজেই বক্তা সাহেবদের আরো ভেবেচিন্তে কথা বলা দরকার।

লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক