(সূরা মুমিনুন, আয়াত ৫০) ‘এবং আমি মরিয়ম পুত্র (ঈসা) ও তাঁর মাকে করেছিলাম এক নিদর্শন। তাঁদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এক নিরাপদ ও প্রস্রবণবিশিষ্ট উচ্চ ভূমিতে।’
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াতে ঈসা এবং তাঁর মা মরিয়মকে আল্লাহর ক্ষমতার এক নিদর্শন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা আল্লাহতায়ালা মরিয়মকে বিনা স্বামীতে গর্ভবতী করে ঈসা (আ:)-কে বিনা পিতায় সৃষ্টি করেছেন যা আল্লাহতায়ালারই ক্ষমতার অন্যতম এক নিদর্শন। তারপর আয়াতটিতে রাবওয়াহ (উচ্চভূমি) শব্দও উল্লেখ রয়েছে। যার অর্থ এমন উচ্চভূমি যা সমতল এবং আশপাশের এলাকা থেকে উঁচু। এটি বায়তুল মুকাদ্দাসেরই একটি স্থানকে বুঝানাে হয়েছে। আরেকটি শব্দ এসেছে ‘মা’ঈন’ (বহমান ঝর্ণা) । আরবীতে মা’ঈন বলতে সেই ঝর্ণাকে বুঝানাে হয়েছে যা মহান আল্লাহ ঈসা (আ:)-এর জন্মের সময় মরিয়ম (আ:)-এর পদতলে অলৌকিকভাবে প্রবাহিত করেছিলেন যেমনটি সূরা মরিয়মে (১৯:২৪) উল্লেখ রয়েছে। আয়াতের আরবী, فَنَادَاهَا مِن تَحْتِهَا أَلَّا تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا অর্থ, ‘অত:পর তিনি (জিবরাইল) তাঁকে (মরিয়ম) তাঁর নিম্ন দিক (-এর পাহাড়ের পাদদেশ) থেকে আহবান করে বললেন, তুমি চিন্তিত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার (পদতলে) নিচ দিয়ে একটা বহমান ঝর্ণা সৃষ্টি করে দেবেন।’ তাফসিরে ইবনে কাসীর। কিতাবটি পড়তে ক্লিক করুন।
এখানে বলে রাখা জরুরি, সূরা মরিয়মের ২৩ নং আয়াত সাক্ষী, উক্ত নিরাপদ ও প্রস্রবণ বিশিষ্ট উচ্চভূমিতে তাঁদের দু’জনের আশ্রয়-মুহূর্তে বিবি মরিয়ম (আ:) গর্ভবতী ছিলেন। ফলে প্রসব-বেদনার দরুন তিনি জেরুজালেমের নিকটস্থ উঁচু ও সমতল কোনাে নিরিবিলি জায়গায় খেজুর গাছের কান্ডের কাছে চলে গিয়েছিলেন।
নাতি-দীর্ঘ বিশ্লেষণ : এই পর্যায় আয়াতটির রাবওয়াহ এবং মা’ঈন শব্দদুটি নিয়ে একটু কথা বলব। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে যাহহাক (রহ:) বর্ণনা করেন যে, রাবওয়াহ বলা হয় ঐ উঁচু ভূমিকে যা সবুজ-শ্যামল ও কৃষি কাজের উপযােগী (দুররে মানছুর ৬/১০০)। হযরত মুজাহিদ, ইকরিমাহ, সাঈদ ইবনে যােবাইর এবং কাতাদাহ প্রমুখও অনুরূপ বলেছেন (তাফসীরে তাবারী ৫/৫৩৬-৩৭)। মা’ঈন সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন, এটি হল ভূমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির প্রবাহ (তাফসীরে তাবারী ১৯/৩৮)। মুজাহিদ, ইকরিমাহ, সাঈদ ইবনে যােবাইর এবং কাতাদাহ প্রমুখও অনুরূপ বলেছেন। সে যাইহােক আয়াতে রাবওয়াহ বলে প্রকৃতপক্ষে আরবের কোন স্থানটিকে বুঝানাে উদ্দেশ্য সে সম্পর্কে তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে এখানে উল্লেখ করছি। তাফসীরে তাবারীর (১৯/৩৭) মধ্যে ইবনে আবী হাতেম হতে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব (রহ:) এর সূত্রে জায়গাটির নাম ‘দামেস্ক’ উল্লেখ আছে। আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম, হাসান বসরী, যায়িদ ইবনে আসলাম এবং খালিদ ইবনে মাদানও প্রায় অনুরূপ বলেছেন। লাইস ইবনে আবী সুলাইম (রহ:) তিনি মুজাহিদ (রহ:) হতে বর্ণনা করেছেন, আয়াতাংশে ঈসা (আ:) এবং তাঁর মা মরিয়ম দামেস্কের [বর্তমান জেরুজালেম দামেস্কের প্রাচীন ভৌগোলিক সীমানারই অন্তর্ভুক্ত – লিখক] কোনাে এক সমতল ভূমিতে আশ্রয় নেয়ার কথাই বলা হয়েছে (দুররে মানছুর ৬/১০০)। আব্দুর রাজ্জাক (রহ:)-এর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে হযরত আবু হােরায়রা (রা:) হতে ফিলিস্তিনের ‘রামাল্লা’ এলাকার কথা বলা হয়েছে। তবে সব চেয়ে বেশি নির্ভরযােগ্য যে বিবরণ পাওয়া যায় তা হল, ইবনে আব্বাস (রা:) হতে প্রাপ্ত আল আউফী’র বর্ণনা। ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন, আয়াতের অর্থ হচ্ছে প্রবাহিত পানি এবং ঐ ঝর্ণা যা “ক্বদ জা’আলা রাব্বুকি তাহতাকি ছারিইইয়া” অর্থাৎ তােমার প্রভু তােমার পদতলে একটি ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন (সূরা মরিয়ম/১৯:২৪) আয়াতে আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এটা হল জেরুজালেম (ফিলিস্তিন) এর একটি স্থান। তবে এই আয়াতটি যেন ঐ আয়াতেরই তাফসীর। আর পবিত্র কুরআনের তাফসীর প্রথমত: কুরআন দ্বারা, তারপর হাদীস দ্বারা এবং এরপর আছার (বিশেষজ্ঞ সাহাবীদের তাফসীর) দ্বারা করা উচিত (তাফসিরে ইবনে কাসীর, সূরা মুমিনুল আয়াত নং ৫০ এর তাফসীর অংশ দ্রষ্টব্য) । উল্লেখ্য, জেরুজালেম প্রাচীন যুগের শাম বা দামেস্কের ভৌগােলিক সীমানারই অংশ বিশেষ।
একটি হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) ‘রাবওয়া’ শব্দ হতে ফিলিস্তিনের “রামাল্লাহ” শহরকেই উদ্দেশ্য নিয়েছিলেন। এইভাবে আরো দলিল প্রমাণ সহ জানতে ক্লিক করুন এখানে। ক্লিক
শেষকথা : পবিত্র কুরআনে পরিষ্কারভাবে জায়গার নাম উল্লেখ না থাকায় বিশেষজ্ঞ যুগ ইমামগণের মাঝে ‘রাবওয়াহ’ বলতে জেরুজালেমের কোন স্থানকে বুঝানো উদ্দেশ্য তা নিয়ে মতানৈক্য হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবাই একমত যে, উল্লিখিত আশ্রয় লাভের ঘটনা হযরত ঈসার (আ:) ভুমিষ্টকালীন সময়েই ঘটেছিল এবং সেটি আরবের কোনাে এক স্থানেই। তবে সব চেয়ে নির্ভরযােগ্য বর্ণনামতে এমনকি ইবনে আব্বাস হতে অন্য আরেকটি সূত্রে সেই স্থানটি জেরুজালেমের (বর্তমান ফিলিস্তিন) রামাল্লা নামক স্থানই ছিল। রাসূল (সা.) হতে মারফূহ সূত্রে এটি প্রমাণিতও বটে। হাদীসটির স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য।
সুতরাং মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীদের দাবী : উক্ত আয়াতে ঈসা (আ:) আর তাঁর মা মরিয়ম কাশ্মীরে আগমন করার কথাই বলা হয়েছে, এটি সর্বান্তকরণে মিথ্যা, অপব্যাখ্যা ও পবিত্র কুরআনের নিকৃষ্টতম বিকৃতির শামিল। কেননা তখন প্রশ্ন আসবে, তবে কি ঈসা (আ:) ভারতের কাশ্মীরেই ভূমিষ্ট হয়েছিলেন? আরাে প্রশ্ন আসবে, বিবি মরিয়ম তিনি ঈসা (আ:)-কে প্রসব করার জন্য আপনা বসতি থেকে প্রায় ৪৬৬০ কিলােমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুদূর ভারতের কাশ্মীরে কিভাবে গেলেন আর কেনই বা যাবেন? ভাবিয়ে তুলে কিনা! আশাকরি কাদিয়ানী সম্প্রদায় মির্যা কাদিয়ানীর ন্যায় একজন সিজোফ্রেনিয়া রুগীর যতসব উদ্ভট দর্শন নিয়ে শেষবারের মত ভেবে দেখবেন। মির্যা কাদিয়ানীর সিজোফ্রেনিয়া রোগ থাকা সম্পর্কে এখানে পড়ুন।
‘ক্বদ খালাত মিন কবলিহির রসুল’ এর সঠিক তাৎপর্য ও কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন :
সূরা আলে ইমরান এর যে আয়াতটির অপব্যাখ্যা দিয়ে কাদিয়ানী সম্প্রদায় হযরত ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে চায় সেটির সঠিক তাৎপর্য নিয়ে আজকে ২ নং আর্টিকেল নিয়ে লিখতে বসছি। এই পর্যায় অত্র আর্টিকেলে যে কয়টি পয়েন্ট নিয়ে লিখব,
১. আয়াতটির من قبله الرسل এর الرسل শব্দের অনুবাদ স্বয়ং কাদিয়ানীদেরই কোনো কোনো লিটারেচারে ‘বহু রাসূল‘ মর্মে গ্রহণ করা!
২. আয়াতটির الرسل এর মর্মার্থে ‘শর্ত প্রযোজ্য‘-এর রীতি না মানলে যে সমস্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এবং যে সমস্ত প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দেয়া সম্ভব হবেনা!
হেকিম নূরউদ্দিন এর বই থেকে : আমরা মুসলিম উম্মাহা উক্ত আয়াতটির যেরূপ অর্থ গ্রহণ করে থাকি হুবহু সেই অর্থই গ্রহণ করেছেন কাদিয়ানী খলীফা হেকিম নূরুউদ্দীনও। তার উর্দূ গ্রন্থ থেকে বাংলায় অনুবাদটি এইরূপ, (অর্থ) ‘মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র; তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে।’ (কুরআন ০৩:১৪৪)। বলাবাহুল্য, হেকিম নূরউদ্দীন ‘আর-রসুল’ (الرسل) হতে ‘বহু রাসূল’ (بہت رسول) অর্থ নিয়েছেন। (দেখুন, ফাছলুল খিতাব লি-মুকাদ্দিমাতি আহলিল কিতাব [উর্দূ] পৃষ্ঠা ২৮; রচনা ১৮৮৭-৮৮ইং দ্রষ্টব্য)। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, তিনিও আয়াতটির الرسل এর শুরুতে যুক্ত ال-কে ‘আহদে খারেজি’ হিসেবেই মনে করতেন। ফলে আয়াতটির الرسل এর অর্থে শর্ত প্রযোজ্য হবার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। স্ক্রিনশট :-
বইটি মির্যা কাদিয়ানীর তত্ত্বাবধানে লিখা : এখানে বলে রাখতে চাই, হেকিম সাহেব বইটি জম্মুর মহারাজার রাজপুত্রকে চিকিৎসা দেয়ার উদ্দেশ্যে পুঞ্চে অবস্থানকালে খ্রিস্টানদের রদ করতে লিখেছিলেন। বইটি লিখার সময় তিনি সকল বিষয়ে মির্যা কাদিয়ানীর পরামর্শ চাইতেন। একথা লিখা আছে ‘হযরত মৌলভী নূরউদ্দীন (রা.) খলীফাতুল মসীহ আউয়াল’ নামীয় পুস্তকের ৭৪-৭৫ পৃষ্ঠায়।
ইস্তিগরাকি অর্থেও শর্ত প্রযোজ্য বিধানযোগ্য : কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতাসহ তার বেশিরভাগ অনুসারী, قد خلت من قبله الرسل -এর মধ্যকার الرسل -এর ال-কে ইস্তিগরাকি (ব্যাপক অন্তর্ভুক্তকারী) ধরে অর্থ করে থাকেন ‘সমস্ত রাসূল’ বা ‘সব রাসূল’। অথচ তাদের এই অনুবাদ নানা শক্তিশালী কারীনার বিরুদ্ধে যাওয়ায় সুস্পষ্ট ভুল। পরন্তু তাদের এই ধরণের কনসেপ্ট উসূলে ফিকহ শাস্ত্রের স্বতসিদ্ধ উসূল তথা নিয়ম-নীতির পুরোপুরি বিরোধী। বরং তাদের নিয়ম-নীতি পরিপন্থী এই ধরনের উদ্দেশ্যমূলক অর্থ ও ব্যাখ্যা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকবে। এই সম্পর্কে একটু পরেই লিখা হবে, ইনশাআল্লাহ। তাদের জন্য দুঃসংবাদ হল, তাদের এই মনগড়া অর্থ হেকিম নূরউদ্দিনের উল্লিখিত অনুবাদ এমনকি একখানা উসূলেরও সম্পূর্ণ বিরোধী। তা এই যে,
হেকিম নূরউদ্দিন সাহেব কৃত ‘তাসদীকে বারাহীনে আহমদীয়া’ পুস্তকটির ১০৪ নং পৃষ্ঠায় চমৎকার একটি উসূল (নীতিমালা) উল্লেখ আছে এভাবে যে, الف و لام اگرچہ عموم اور استغراق کے معنی بھی دیتا ہے مگر خصوصیت کے معنی بھی دیتا ہے- ہر دو معنی اپنے اپنے موقع پر لے جاتے ہیں অর্থাৎ ‘আলিফ লাম যদিও আম এবং ইস্তিগরাকের অর্থও প্রদান করে কিন্তু শর্ত প্রযোজ্য অর্থও প্রদান করে থাকে। উভয় অর্থ যথোপযুক্ত স্থানে গ্রহণ করা হবে।’ (তাসদীক বারাহীনে আহমদীয়া – ১০৪; অনলাইন এডিশন)। এখন তাহলে আপনাদেরই দাবী অনুসারে الرسل-এর আলিফ লাম ‘ইস্তিগরাকি’ হলেও সেখানে এখন শর্ত প্রযোজ্য এর বিধান প্রয়োগের সুযোগ থাকল না কিভাবে? স্ক্রিনশট –
মির্যা বশির উদ্দিন এর রচনা থেকে : মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ সাহেব তার পিতা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর কথিত একখানা ইলহামের ব্যাখ্যা করেছেন নিম্নরূপ, (উর্দূ) آسمان سے کئ تخت اترے پر تيرا تخت (رسول ص پاک کے بعد) سب سے اوپر بچھایا گیا অর্থাৎ ‘আকাশ থেকে কয়েকটি সিংহাসন নাযিল হয়েছে। কিন্তু তোমার সিংহাসনটি (রাসূলেপাকের পর) সবার উপরে পাতা হয়েছে।’ (আল-ফজল, তারিখ ১৯ই আগস্ট ১৯৬১ ইং রাবওয়া হতে প্রকাশিত)। মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ ‘সবার উপরে‘ শব্দটিতে ইস্তিগরাকের অর্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি এখানে ‘তাখছীছ’ এর বিধান প্রয়োগ করলেন কিভাবে যদি না শর্ত প্রযোজ্যের নিয়ম না থাকবে? তিনি কিন্তু বিশেষভাবে একজনকে ‘সবার উপরে’ অর্থের ব্যাপকতার বাহিরে রেখেছেন। তিনি এর মধ্য দিয়ে যেন বুঝাতে চাইলেন, ইস্তিগরাকি অর্থেও শর্ত প্রযোজ্যের নিয়ম বিধানযোগ্য। এটি স্ক্রিনশট সহ ৩ নং আর্টিকেল থেকে দেখে নিন!
এবার আলোচনা করা হবে যে, আলিফ লাম-কে ইস্তিগরাকি ধরে অনুবাদ করার ফলে কাদিয়ানী সম্প্রদায় কী কী প্রশ্নের সম্মুখীন হবে?
কে জানি প্রশ্ন করেছিল যে, পুরো আয়াতখানা পড়ে দেখুন, শেষে উল্লেখ আছে, أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ এতে বোঝা যাচ্ছে, এখানে ‘খালাত’ অর্থ মৃত্যু বা হত্যা। এ দুই অর্থের সাথেই শব্দটি নির্দিষ্ট। উত্তরে বলতে চাই যে, এই আয়াতের قد خلت ফে’লকে প্রকৃত অর্থ থেকে বের করে রূপক অর্থে তথা ‘মৃত্যু’ অর্থে গ্রহণ করলে তখন শব্দটির নিজেস্ব গুণাগুণ তথা ইশতিরাক্ব (অর্থের দ্বৈততা) আর অবশিষ্ট থাকেনা। তাছাড়া আয়াতটির أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ এর মৃত্যু আর হত্যা উভয়টাই শুধুমাত্র রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্যেই ছিল বলে ‘খাস’ এর হুকুমে নিহিত। যার ফলে এগুলোকে ‘আম’ অর্থে ধরে নতুন কোনো ব্যাখ্যার পিছু নেয়া সুস্পষ্ট দুষ্টুমি ও নীতিবিরুদ্ধ বৈ কিছুই না।
যে প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই :
১। সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৪৪ এর من قبله الرسل এর الرسل এর মর্মার্থে শর্ত প্রযোজ্যের নিয়ম মেনে অর্থ ও ব্যাখ্যায় যাওয়া আবশ্যক। যেহেতু পবিত্র কুরআনের অপরাপর আয়াত সমূহ দ্বারা বুঝা যায় যে বহু রাসূল এখনো জীবিত। যেমন, সূরা নিসা আয়াত নং ৫৪, আলে ইমরান আয়াত নং ৪৬, সূরা তওবাহ আয়াত নং ৩৩, সূরা মায়েদা আয়াত নং ১১০, সূরা যুখরুফ আয়াত নং ৬১ ইত্যাদি আয়াত সমূহের সুস্পষ্ট ইংগিত দ্বারা হযরত ঈসা রাসূলুল্লাহ (আ.) জীবিত প্রমাণিত। সূরা মরিয়াম আয়াত নং ১৯ দ্বারা হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূল নামে আখ্যায়িত। সূরা হাজ্জ আয়াত নং ৭৫ দ্বারা আরও বহু ফেরেশতা রাসূল নামে আখ্যায়িত। এই সম্পর্কে আর্টিকেল নং ৩ দেখা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হল, قد خلت من قبله الرسل শীর্ষক আয়াতে ‘সমস্ত রাসূল’ গত হইয়া গিয়াছে বলে ‘সমস্ত রাসূল’-ই মৃত্যুবরণ করেছেন- এই উদ্দেশ্য হলে তখন কি উল্লিখিত রাসূলগণকেও মৃত বলা হল না? অথচ এদের সকলেই এখনো জীবিত!
২। সূরা মায়েদা আয়াত নং ৩ (حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ) “তোমাদের উপর মৃত, রক্ত এবং শুয়োরের মাংস হারাম করা হয়েছে”- দ্বারা সমস্ত ‘মৃত জন্তু’-এর মধ্যে মৃত মাছও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল কিনা? এখন কাদিয়ানীরা যদি এই সমস্ত ক্ষেত্রে হাদীসের বর্ণনাগুলোর আলোকে আয়াতের এই সমস্ত অর্থে শর্ত প্রযোজ্যের নিয়ম না মানেন তাহলে তাদের পক্ষে মৃত মাছ খাওয়াও বৈধ হয় কিভাবে? কেননা ‘সমস্ত মৃত’ বলতে ‘মৃত মাছ’-ও তার মধ্যে শামিল। এবার শর্ত প্রযোজ্য-এর নিয়ম লঙ্ঘন করে মৃত মাছ খাওয়া হালাল করুন! উল্লেখ্য, যারা মনে করেন যে, কুরআন দ্বারা যে কথা সাব্যস্ত হবে সেটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য হাদীসে যাওয়ার দরকার নেই, তারা এই জিজ্ঞাসার কী সমাধান দেবেন!
৩। সূরা আল ফাতির আয়াত নং ২৮ (إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ) “নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমগণই তাঁকে ভয় করে”- দ্বারাও সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁকে প্রকৃতপক্ষে ভয় করেন আলেমগণই। কিন্তু আমরা সচরাচর দেখি যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় কথায় কথায় আলেম উলামাকে ‘আকাশের নিচে নিকৃষ্ট জীব’ বলে কটুক্তি করে থাকে। অথচ আয়াতটিতে আলেমদের সম্পর্কে আল্লাহতালার উক্ত প্রশংসা বাণী الْعُلَمَاءُ (আল-উলামা) বহুবচনাত্মক শব্দেই এসেছে। ফলে সমস্ত আলেমই উক্ত শব্দে শামিল হওয়াতে একজন আলেম সম্পর্কেও কটুক্তি করার কোনো সুযোগ থাকেনি কাদিয়ানীদের জন্য, যে পর্যন্ত না শর্ত প্রযোজ্যের নিয়ম তারা মানবে! এখন এর সুরাহা কিভাবে করবেন?
৪। সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৮১ (سَنَکۡتُبُ مَا قَالُوۡا وَ قَتۡلَہُمُ الۡاَنۡۢبِیَآءَ بِغَیۡرِ حَقٍّ) “অচিরেই আমি তারা যা বলেছে তা এবং নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করার বিষয় লিখে রাখব”- দ্বারাও বাহ্যত সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, বনী ইসরাঈলি সমস্ত নবী তাদের হাতে হত্যা হয়েছেন। কারণ আয়াতে শব্দটি বহুবচনে الْأَنبِيَاءَ (আন আম্বিয়া) এসেছে। এখন এক্ষেত্রেও শর্ত প্রযোজ্য নিয়ম না মানার অর্থই হল, ইয়াকুব, ইউসুফ, শু’আইব, আইয়ুব, মূসা এবং ঈসা (عليهم السلام) সহ সমস্ত ইসরাঈলী নবীকে হত্যা করা হয়েছিল বলেই বিশ্বাস করতে হবে। এখন এর কিভাবে সমাধান করবেন?
৫। সূরা আল-হুজুরাত আয়াত নং ১৩ (يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ) “হে মানবমন্ডলী! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি”- দ্বারাও বাহ্যত সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, সমস্ত মানুষের ন্যায় হযরত আদম, হাওয়া এবং ঈসাও একই নর এবং নারী হতে সৃষ্ট। আসলে কি তাই? নিশ্চয়ই না। বরং এখানে শর্ত প্রযোজ্য এর নিয়ম মেনে বিশ্বাস করতে হবে যে, এঁদের তিনজনই কুরআনের উক্ত ঘোষণার (مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ) তথা একজন নর এবং নারী থেকে সৃষ্টির প্রচলিত নিয়মের অন্তর্ভুক্তির বাহিরে। এখন কাদিয়ানীরা কি শর্ত প্রযোজ্য এর নিয়ম লঙ্ঘন করে এখানেও সমস্ত মানুষকে একই নর নারী থেকে সৃষ্ট বলবে?
৬। সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৮৫ (كُلُّ نَفْسٍۢ ذَآئِقَةُ ٱلْمَوْتِ) অর্থাৎ ‘প্রতিটি নফসকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে’ দ্বারা সকল নফস বা সত্তা মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবেই। অথচ এখানেও ‘শর্ত প্রযোজ্য‘-এর নিয়ম বিধানযোগ্য। অন্যথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালাকেও মরণশীল বিশ্বাস করতে হয়, যেহেতু সূরা আল মায়েদার আয়াত নং ১১৬ (تَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِي وَلَآ أَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِكَۚ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّٰمُ ٱلۡغُيُوبِ)-এর মধ্যে আল্লাহ’র জন্যও ‘নফস‘ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। এখন কাদিয়ানীরা কি আল্লাহকেও মরণশীল বলবে? নাউযুবিল্লাহ।
৭। তর্কের খাতিরে মানলাম যে, আয়াতটির الرسل হতে ‘সমস্ত রাসূল মৃত্যুবরণ করেছে’ এ অর্থই সঠিক; এমতাবস্থায় আপনারা সূরা মায়েদার ৭৫ নং আয়াতের ‘الرسل’ হতেও কি ‘সমস্ত রাসূল মৃত্যুবরণ করেছে’—এমন অর্থ নেবেন? যদি এমন অর্থ নেন তখন কি মুহাম্মদ (সা:)-এর নবুওয়ত ও রেসালতেরও অস্বীকার করা হল না? কেননা যদি বলা হয় যে, মসীহ ইবনে মরিয়মের পূর্বেই সমস্ত রাসূল মৃত্যুবরণ করিয়াছেন, তখন মসীহ (আ:)-এর পর আগমনকারী মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-কে আপনারা একজন রাসূল হিসেবে কিভাবে স্বীকার করলেন?
বলে রাখা দরকার যে, আয়াতটির মধ্যে قبل শব্দটি মুদাফ (مضاف)। আর ব্যাকরণের একটি নিয়ম হল, মুদাফ-এর অর্থ নেয়ার ক্ষেত্রে ‘র’ কিংবা ‘এর’ ধরণের ষষ্ঠী বিভক্তি উল্লেখ থাকতে পারবেনা। কাজেই কাদিয়ানী নেতা জনাব আব্দুল আউয়াল সাহেব কর্তৃক গৃহীত অনুবাদ – তাঁর পূর্বেকার সমস্ত রাসূল গত হইয়া গিয়াছে‘ – ব্যাকরণ বিরুদ্ধ ও পরিত্যাজ্য। অথচ এক্ষেত্রে ব্যাকরণসিদ্ধ অনুবাদ হল – তাঁর পূর্বে। শব্দের শেষাংশে ‘র’ বিভক্তি থাকবেনা। যেমন, يد الله على الجماعة ; فوق كل ذى علم عليم ; رسول الله اسوتنا ; এখানে যথাক্রমে يد; فوق এবং رسول শব্দগুলো নিজ নিজ বাক্যে মুদাফ (مضاف) হওয়ায় অনুবাদের ক্ষেত্রে এগুলোতে “র” বা “এর” ধরণের ষষ্ঠী বিভক্তি উল্লেখ ছাড়া অনুবাদ হবে এভাবে – আল্লাহর সাহায্য জামাতের উপর; প্রত্যেক জ্ঞানীর উপর জ্ঞানী আছে; আল্লাহর রাসূল আমাদের আদর্শ। অনুরূপ من قبله الرسل এর من قبله -তে অনুবাদ করতে হবে ‘তার পূর্বে‘। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন।
ঈসা (আ.) জীবিত ও ইজমা প্রতিষ্ঠা : উক্ত আয়াত দ্বারা ঈসা (আ:) বেঁচে নেই, মৃত্যুবরণ করিয়াছেন মর্মে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে ইজমা (ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, এমন ধারণা যাদের, তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই যে, বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারক বরেণ্য স্কলার ও যুগ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) ঈসা (আ.)-এর সশরীরে আকাশে জীবিত থাকা মর্মে (انه رفعه بدنه حيا) ‘আন্নাহু রাফা’আহু বি-বাদানিহি হাইয়ান’ অর্থাৎ আল্লাহতালা নিশ্চয়ই তাঁকে সশরীরে জীবিত উঠিয়ে নিয়েছেন, কেন লিখে গেলেন? (রেফারেন্স, ইবনে হাজার রচিত ‘আত-তালখীছুল হাবীর’ কিতাবুত তালাক, খন্ড ৩ পৃষ্ঠা ৪৬২)। তেমনিভাবে শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) তিনিও বা কেন লিখলেন যে (واجمعت الامة على ان الله عز و جل رفع عيسى اليه الى السماء) ‘ওয়াজমা’আতুল উম্মাতু আ’লা আন্নাল্লাহা আ’জ্জা ওয়া জাল্লা রাফা’আ ঈসা ইলাইহি ইলাস-সামায়ি’ অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদীয়া এইমর্মে সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন যে, নিশ্চয় আল্লাহতালা ঈসা (আ:)-কে নিজের নিকট আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন? (রেফারেন্স, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়্যা’ ৪/৪৫৭)। কিতাবটি ডাউনলোড করুন
এরা দুইজনও স্বীকৃত মুজাদ্দিদ : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী আর শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ তারা দুইজনই মির্যা কাদিয়ানীর নিকটেও মুজাদ্দিদ ও যুগ ইমাম হিসেবে স্বীকৃত। (দেখুন, মির্যা কাদিয়ানীর শিষ্য মির্যা খোদাবক্স কাদিয়ানী রচিত ‘আছলে মুছাফফা’ [উর্দূ] খন্ড ১ পৃষ্ঠা নং ১৪২-৪৫; প্রথমপ্রকাশ ১৯০১ইং, কাদিয়ান থেকে)। স্ক্রিনশট –
মুজাদ্দিদ সম্পর্কে মির্যার দৃষ্টিভঙ্গি : মির্যা কাদিয়ানী লিখেছেন, মুজাদ্দিদগণ দ্বীনের মধ্যে কোনোরূপ বেশকম করেননা বরং হারানো দ্বীন পুন: প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৪৪) স্ক্রিনশট দেখুন। এখন এর সুরাহা কিভাবে করবেন?
ওয়াহদাতুল উজূদ (وحدةالوجود) এর ব্যাখ্যা কী? ওয়াহদাতুল উজূদের আক্বীদা কি সঠিক?
ওয়াহদাতুল উজূদের দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে। যার একটি সঠিক অপরটি ভুল।
প্রথম ব্যাখ্যাটি হলো : আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বই একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর সামনে পুরো জগতের অস্তিত্ব এতটাই অসম্পূর্ণ, যেনো তা অস্তিত্বহীন। যেমন বলা হয় অমুক বড় আলেমের সামনে অমুক সাধারণ ব্যক্তি তো কিছুই না। সূর্যের সামনে মোমবাতির আলো অস্তিত্বহীন। অথবা যেমন বলা হয় সমুদ্রের বিশাল অস্তিত্বের সামনে তার মাঝে বিদ্যমান ক্ষুদ্রাকৃতির ফেনাগুলোর যেনো কোনো অস্তিত্বই নেই।
ঠিক আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বের সামনে পুরো জগতকে সুফিয়ায়ে কেরাম তেমনই অস্তিত্বহীন ভাবেন। এর অর্থ এই নয় যে, কোনো জিনিসের অস্তিত্বই নেই। বরং এর অর্থ হলো, আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বই একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যদের অস্তিত্ব আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টির দ্বারা সৃষ্ট। স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
ওয়াহদাতুল উজূদের এ ব্যাখ্যাটি সঠিক। এটাই সুফিয়ায়ে কেরাম ও দেওবন্দীদের আক্বীদা।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হল : ওয়াহদাতুল উজূদের দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাখ্যা এমন করা হয় যে, আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কারো কোনো ধরণের অস্তিত্বই নেই। সব কিছুর মধ্যেই আল্লাহ তা’আলা হুলূল করে আছেন। যেটা হিন্দুদের সর্বেশ্বরবাদের বিশ্বাসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ওয়াহদাতুল উজূদের এ দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি ভুল। শুধু ভুল নয় বরং এ আক্বীদা কোনো মুসলিম পোষণ করতে পারেন না।
দুঃখের বিষয় হলো, কিছু ভাইয়েরা ওয়াহদাতুল উজূদের এই ভুল ব্যাখ্যাটি দিয়ে সুফিয়ায়ে কেরাম এবং ওলামায়ে দেওবন্দের উপর অপবাদ দিয়ে থাকে। যা তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতার প্রমাণ। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন। আমীন।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহঃ)-এর নামে কাদিয়ানীদের মিথ্যাচারের জবাব
প্রশ্ন : ইমামে রাব্বানী সাইয়িদ আহমদ সারহিন্দী (রহঃ) এর কিতাবে কি লেখা আছে যে, শেষ যুগে আলেমগণ ইমাম মাহদীকে গ্রহণ করতে চাইবেনা?
জবাব : আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। অপ্রিয় হলেও সত্য, কাদিয়ানীরা ইমামে রাব্বানী সাইয়িদ আহমদ সারহিন্দী (রহঃ)-এর প্রতি নিজেদের কথাকেই তাঁর কথা বলে চালিয়ে দেয় মূলত মির্যা কাদিয়ানীর “ইমাম মাহদী” দাবীকে হালাল করার জন্য। নিচে মুজাদ্দিদে আলফে সানী’র খণ্ডিত বক্তব্যের উপর তাদের অতিব খেয়ানতপূর্ণ মন্তব্যের খন্ডন করা হল!
প্রিয়পাঠক! প্রথমে মুজাদ্দিদ সাহেবের নাম ভেঙ্গে প্রচারিত কাদিয়ানীদের লেখাটি পড়ুন। জনৈক কাদিয়ানী মতাবলম্বী লিখেছেন :
“হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-কে আরব অঞ্চলের (নামধারী) উলামাগণ গ্রহণ করেন না কেন? বার’শ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ হযরত শায়খ আহমদ সারহিন্দী (রহঃ) লিখেছেন: “বর্ণিত আছে, হযরত মাহদী রাযিআল্লাহু আনহু তাঁর রাজত্ব কালে যখন ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং সুন্নতকে সঞ্জীবিত করবেন, তখন মদীনার আলেম যে কি-না বেদাতের উপর আমল করা নিজ অভ্যাসে পরিণত করেছে এবং এটি (বেদাত)-কে ধর্মের অংশ বানিয়েছে, আশ্চার্যান্বিত হয়ে বলবে, এই ব্যক্তি আমাদের ধর্মকে দূরে ঠেলে দিয়েছে আর আমাদের ধর্ম ও মিল্লাতকে হত্যা এবং বিনষ্ট করেছে।” (মাকতুবাতে ইমাম রাব্বানী, মাকতুবাত নং-২৫৬, উর্দূ তরজমা, ২য় খণ্ড)।
(উক্ত কাদিয়ানী উম্মত তিনি মুজাদ্দিদ সাহেবের খন্ডিত বক্তব্যের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে তারপর লিখেছেন) অর্থাৎ আরব অঞ্চলের ‘নামধারী আলেমগণ’ ইমাম মাহদীর বিরোধীতা করবে তা বুযুর্গানে দ্বীন জানতেন। আর আজ তাই ঘটছে।” (কাদিয়ানিদের লেখাটি শেষ হল)।
এবার খন্ডনমূলক আলোচনা :
হিজরী দশম শতাব্দীর বরেণ্য মুজাদ্দিদ ইমামে রাব্বানী সাইয়েদ আহমদ সারহিন্দী (রহঃ) এর সম্পূর্ণ বক্তব্য সামনে রাখলে আপনি একজন নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে বুঝতে পারবেন যে, মির্যা কাদিয়ানী আর তার অন্ধভক্তরা কিভাবে সাতপাঁচ ব্যাখ্যা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকেন! কিভাবে তারা সম্পূর্ণ বক্তব্যের আগপাছ বাদ দিয়ে খন্ডিত বক্তব্য দ্বারা অশিক্ষিত ও সহজ সরল আহমদীদের বোকা বানিয়ে যাচ্ছেন!! এবার ইমামে রাব্বানীর লেখা থেকে যেসব বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে তা নিচে দেখানো হল-
(১) ইমামে রাব্বানীর বক্তব্য দ্বারা পরিষ্কার হচ্ছে যে, প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী শাসক হবেন। কারণ ইমামে রব্বানি (রহঃ) তার বক্তব্যে “সুলতানত” শব্দ উল্লেখ করেছেন। অভিধান দেখুন, সুলতানত অর্থ বাদশাহি।
(২) ইমামে রাব্বানী (রহঃ) এর বক্তব্যের ভেতর তিনি ইমাম মাহদীর নামের শেষে “রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু” শব্দ উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা গেল, প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী যিনি হবেন তিনি স্রেফ একজন মুজাদ্দিদ হবেন কিন্তু নবুওত পেয়ে “নবী” হবেন না। কারণ নবুওয়তপ্রাপ্ত যারা তাদের নামের শেষে “রাদ্বিয়াল্লাহু” হয় না।
(৩) হযরত ইমামে রাব্বানী (রহঃ) এর সাথে মদীনার কতিপয় বিদয়াতী আলেমের সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব হতে পারে “বিদয়াত” বিষয় নিয়ে। আর এমনটি হওয়া-ই স্বাভাবিক। এখনো বহু আলেম নানাভাবে বিদয়াতে লিপ্ত। যা আজ কারো অজানা নয়। কেয়ামতের শেষ সময় এই ধারা হয়ত আরো প্রকট আকার ধারণ করার দিকে তিনি ইংগিত করতে চেয়েছিলেন।
(৪) ইমামে রাব্বানী (রহঃ) তার একই পৃষ্ঠার একই বক্তব্যের তৃতীয় লাইনের শেষের দিকে এটাও লিখেছেন “হযরত ইমাম মাহদী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নে উস আলেম কো ক্বতল করনে কা হুকুম ফরমায়ে গে।” অর্থাৎ ইমাম মাহদী তখন ওই [মদীনার বিদয়াতি] আলেমকে হত্যার নির্দেশ দেবেন।” এতে আরো পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সে সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকবে ইমাম মাহদীর হাতে। তাই দেশের কাউকে তখন হত্যার নির্দেশ দেয়ার অধিকার তাঁর থাকবে। লিখাটির সংশ্লিষ্ট স্ক্রিনশট নিচে দেখুন
এবার আসুন, মির্যা কাদিয়ানির সাথে উপরের ৪টি বিষয় কিভাবে মিলাবেন?
মির্যা সাহেব কি নবুওয়তের দাবি করেননি? করেছেন। নামের শেষে কি “আলাইহিস সালাম” লিখত না? অবশ্যই লিখত। তাহলে বুঝা গেল কী? ইমামে রাব্বানীর বক্তব্যে যার চরিত্রের উল্লেখ আছে তিনি-ই যদি আজকের মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সাহেব হন তাহলে তার নামের শেষে “রাদ্বিয়াল্লাহু” কোথায়? নাকি ইমামে রাব্বানী ভুল করে গেছেন? যদি ভুল করেন তাহলে উনার নাম ভেঙ্গে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য কী? তাদের এধরণের ফাজলামি কে শিখাল? সাধারণ মানুষকে কাদিয়ানী বানানোর অপচেষ্টা নয় তো?
মির্যা সাহেব কি নির্দিষ্ট কোনো ভুখন্ডের শাসক ছিলেন? অবশ্য না। যেজন্য ধূর্ত মির্যা আজীবন নিজেকে দুনিয়ার বাদশাহ এর স্থলে “আসমানি বাদশাহ” হবার বুলি আওড়াতেন। কেননা কথিত আসমানি বাদশাহ হতে নির্দিষ্ট ভুখন্ড লাগেনা। যেমন বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজেদের “জ্বীনের বাদশাহ” দাবী করে মানুষকে প্রতারিত করছে।
মির্যায়ীরা সব কিছুতে রূপক খোঁজে। তাই তারা মির্যাকে প্রকৃত অর্থে শাসক না বলে বরং রূপকার্থে শাসক মানতে চায়। তা হল, আসমানি শাসক। কেননা তারা জানে যে, রূপক অর্থের আশ্রয় না নিলে মির্যার ভাঁওতাবাজিও ধোপে টিকেনা।
যাইহোক মির্যা সাহেবের সাথে মদীনার আলেমগণসহ সারা দুনিয়ার ইসলামি স্কলার ও মুফতী মাশায়েখদের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত বিশেষত তার নবুওয়ত দাবীর কারণেই। পক্ষান্তরে ইমামে রাব্বানী (রহঃ) লিখে গেছেন ভিন্ন কথা। অর্থাৎ দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ হতে পারে ‘বিদয়াত বা কুসংস্কার বিষয়াবলী’ নিয়ে। তাহলে…?
মির্যা সাহেবকে ইমামে রাব্বানী (রহঃ)-এর উপরিউক্ত বক্তব্যের চরিত্রের সাথে কিভাবে খাপ খাওয়াবেন যেখানে মির্যা সাহেব না নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন, না শাসনকর্তা হিসেবে মদীনার কোনো বিদয়াতি আলেমকে হত্যার হুকুম দিতে পেরেছেন? বিপরীতে মির্যাকেই সবাই হত্যার ফতুয়া দিয়ে রেখেছেন।
ইতিহাস সাক্ষী, মির্যার বংশটাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন করার জন্য। মির্যা সাহেবের লেখিত বই পুস্তক খুলে দেখুন। তিনি ব্রিটিশের কেমন সেবাদাস ছিলেন তা বুঝে আসবে। খোদার প্রেরিত কোনো পয়গম্বর কি কোনো বিধর্মী দখলদার জালিম শাহীর গোলামী করতে পারে?
এর কোনো জবাব আহমদীদের নিকট নেই। শুধু এটুকু স্বীকার করা ছাড়া যে, মূলত ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদ সাইয়েদ আহমদ সারহিন্দী (রহঃ) এর বক্তব্যের সাথে ভারতীয় ভন্ড মাহদী মির্যা কাদিয়ানীর ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। ইনিয়েবিনিয়ে এবং জোড়াতালি দিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যাই হল তাদের শেষরক্ষা।
আল্লাহতালা এসব অর্ধ শিক্ষিত ও বিবেকহীন কাদিয়ানিদের সত্য উপলব্ধি করার তাওফিক দিন। ওয়াসসালাম।
(লিখাটি একজন সাবেক কাদিয়ানীর (যিনি এক সময় ঢাকা মিরপুর ৬ নং সেক্টরে কাদিয়ানী জামাতের প্রেসিডেন্ট পদাধিকারীও ছিলেন), নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক এই নও মুসলিম এ সমস্ত প্রশ্নের কোনো জবাব না পেয়ে পরবর্তিতে কাদিয়ানী ত্যাগ করেন)।
“নবুওয়তের সকল পথ রুদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু একটি পথ সীরাতে সিদ্দিকীর (সিদ্দিকীয়তের রাস্তা) খোলা আছে, যাকে ফানাফির রাসূল বলে। সুতরাং এ পথ দিয়ে যে ব্যক্তি খোদার নিকটবর্তী হয়, তাকে প্রতিচ্ছায়ারূপে মুহাম্মদী নবুওতের বসনেই ভূষিত করা হয়”। স্কিনশট দ্রষ্টব্য।
এবার নিচের প্রশ্নগুলো খেয়াল করুন-
(১) ‘একটি ভুল সংশোধন’ বইয়ের কথাটি দ্বারা তিনি যেন বুঝাতে চেয়েছেন যে, যখন নবুওয়তের সকল পথ রুদ্ধ তখন কীভাবে বুরূজী নবীও হওয়া যায়? এখন প্রশ্ন হলো তাহলে বর্তমানকালে তার অনুসারীরা কেন সূরা নিসার ৬৯ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন (নবী সিদ্দিক শহীদ সালেহ)? মির্যা সাহেব কি সূরা নিসা’র এই আয়াত তার নবুওয়ত বিষয়ক এ বইটিতে উল্লেখ করেছেন? যদি না করে থাকেন তাহলে কেন এই আয়াত এখন তার অনুসারীরা উল্লেখ করেন? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সূরা নিসার ৬৯ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় কোথাও কি বলে গেছেন আরো হাজার হাজার নবী আসবেন?
(২) দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে আমরা জানি তিনি সিদ্দিক ছিলেন। এটা তার টাইটেল। যদি প্রকৃতপক্ষে কেউ ফানাফির রাসূল হয় তাহলে তো তিনিই হওয়ার কথা। যিনি তাঁর জীবনের সব কিছু ত্যাগ করলেন তিনি কি সিদ্দিকীয়তের রাস্তা দিয়ে খোদার নিকটবর্তী হননি? হয়ে থাকলে তিনি নবুওয়তের বসনে ভূষিত হননি কেন?
(৩) মির্যা সাহেব বলেছেন উম্মতে মুহাম্মদীয়া সৌভাগ্যবান হতে পারেন না, যদি নবুওয়ত জারি না থাকে। কারণ মূসা নবীর শরীয়তের অধীনে অনেক নবী এসেছেন তাহলে আমাদের নবীর অধীনে এ নেয়ামত বঞ্চিত থাকবে কেন (সূরা ফাতেহার ইহ্দিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম, সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম -এর ব্যাখ্যায়)? যদি নেয়ামতের শর্ত নিয়ে আসা হয় তাহলে এখন প্রশ্ন হল, নবীজির পর দীর্ঘ আরো ১৪০০ বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হলো কেন?
নেয়ামতের হিসাব করলে তো একের পর এক নবী আসা উচিত। আমরা কেন ১৪০০ বছর ধরে এই নেয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকলাম?
(৪) মির্যা কাদিয়ানী সাহেব ১৮৭৯ – ‘৮০ সালের দিকে যদি নবী হয়ে থাকেন তাহলে ১৮৮১ – ‘৮২ তে আবার মুজাদ্দিদ হন কীভাবে? যাদের ভেবে দেখার প্রয়োজন তারা ভেবে দেখবেন!
প্রশ্ন ১. ঈসা আলাইহিসসলামের ‘রাফা’ কোন ফেরেশতার মাধ্যমে হয়েছিল? (ক) আজরাইল? (খ) জিবরাইল?
নোট : মুসলমানদের বিশ্বাস, ঈসা (আ:)-এর ‘রাফা’ হযরত জিবরাইল (আ:)-এর মাধ্যমেই হয়েছিল। পবিত্র কুরআনের ০৩:৫৫ আয়াতের পটভূমিও আমাদের ডেকে ডেকে বলছে, ঈসা (আ:)-এর উক্ত ‘রাফা’ সেই সময় হয়েছিল যখন ইহুদী সন্ত্রাসীরা হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ঈসার বাড়ীর আশেপাশে সমবেত হয়েছিল। এ সম্পর্কে হাদীসটি অনুবাদসহ এই, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, لما اجتمع اليهود على عيسى عليه السلام ليقتلوه و أتاه جبرائيل … فاَوْحَى اللهُ الى جبرائيلَ اَنِ ارْفَعْ اِلَيَ عَبْدِيْ অর্থাৎ যখন ইহুদীরা ঈসা (আ:)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছিল তখন জিবরাইল (আ:) তাঁর নিকট আগমন করেন….. আল্লাহতায়ালা তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার বান্দা [ঈসা]-কে আমার নিকট উঠিয়ে নিয়ে এসো। (রেফারেন্স, তারীখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৭২; তারীখে বাগদাদ ১১/৩৭৯)।
প্রশ্ন ২. ঈসা আলাইহিসসালামের ‘রাফা‘ কখন হয়েছিল? (ক) ক্রুশীয় ষড়যন্ত্রের ৮৭ বছর পর (খ) ক্রুশীয় ষড়যন্ত্র চলা মুহূর্তে।
নোট : মুসলমানদের বিশ্বাস, ঈসা (আ:)-এর ‘রাফা’ তথা উঠিয়ে নেয়ার ঘটনা ক্রুশীয় ঘটনা চলা মুহূর্তেই জেরুজালেমেই ঘটেছিল। কেননা বিশিষ্ট যুগ ইমাম আল্লামা জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী (রহ:) সংকলিত ‘দুররে মানছূর’ কিতাবে সুস্পষ্টভাবে লিখা আছে, ورفع وهو ابن أربع وثلاثين سنة من ميلاده অর্থাৎ ঈসাকে উঠিয়ে নেয়া হয় যখন তিনি ৩৪ বছর বয়সী যুবক।
নোট : মুসলমানদের বিশ্বাস, ঈসা (আ:)-এর বিরুদ্ধে ঈহুদী সন্ত্রাসী কর্তৃক হত্যার সেই ষড়যন্ত্র তাঁর যৌবনকালেই জেরুজালেমে ঘটেছিল, প্রৌঢ়কালে নয়। কেননা, প্রৌঢ়কাল বলতে ৩৪ হতে ৫১ বছরের মাঝামাঝি বয়সী ব্যক্তিকে বুঝায় (লিসানুল আরব) । কিন্তু ঈসা (আ:) সেই সময় উক্ত বয়সে পৌঁছেননি।
প্রশ্ন ৪. ঈসা আলাইহিসসালামের বিরুদ্ধে ‘হত্যা’-র ষড়যন্ত্র এবং তাঁর ‘রাফা’ উভয়ই হয়েছিল…..! (ক) হিন্দুস্তানে। (খ) ফিলিস্তিনে।
নোট : মুসলমানদের বিশ্বাস, ঈসা (আ:)-এর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং রাফা তথা উঠিয়ে নেয়ার ঘটনা উভয়ই ঘটেছিল ফিলিস্তিনে। এটি একটি মুতাওয়াতির বিষয় যা নতুন করে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই ।
প্রশ্ন ৫. আরবী মা/ما (না-বােধক) বর্ণযুক্ত বাক্যের পর খ্রিস্টানদের রদ করতে যেখানে-ই বাল’ (بل) শব্দটি ব্যবহার হয়েছে সেখানে-ই দেখা যায়…! (ক) ‘বাল’ (بل) শব্দের পূর্বের বাক্যের কর্ম আর পরের বাক্যের কর্ম একইকালে সংঘটিত হয়নি। (খ) ‘বাল’ (بل) শব্দের পূর্বের বাক্যের কর্ম আর পরের বাক্যের কর্ম একইকালে সংঘটিত হয়েছে।
নোট : জ্বী হ্যাঁ, এটি সর্বজন স্বীকৃত একটি আরবী ব্যাকরণগত নিয়ম যে, ‘বাল’ (بل) শব্দের পূর্বের বাক্যের কর্ম আর পরের বাক্যের কর্ম একইকালে সংঘটিত হয়ে থাকবে। কাজেই এই কথা বিশ্বাসকরা ঠিক হবেনা যে, ঈসা (আ:)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র ফিলিস্তিনে (বায়তুল মুকাদ্দাস) হলেও তাঁর রাফা’র (কাদিয়ানীদের মতে আয়াতটির ওই রাফা—র অর্থ ঈসার মৃত্যুর পর তাঁর রূহ উঠিয়ে নেয়া) ঘটনা একইকালে ঘটেনি বরং আরো ৮৭ বছর পর কাশ্মীরের শ্রীনগরে ঘটেছিল। (নাউযুবিল্লাহ)।
মির্যা কাদিয়ানীর আরো বহু দাবী দাওয়া রয়েছে। তার দাবীগুলোর সামান্য কিছু দেখতে ক্লিক করুন।
আসলে মির্যা কাদিয়ানীর মত এমন একজন সিজোফ্রেনিয়া রোগী থেকে এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়! পবিত্র কুরআন নিয়েও বুঝি মির্যা কাদিয়ানীর তামাশা করার বাকি ছিল?
এই যে, দেখুন সে কী লিখল : –
(উর্দু উচ্চারণ) : “মাই তো বস কুরআন হি কি তরেহ হোঁ, আওর আনক্বরিব মেয়েরে হাত পর জাহের হোগা যু কুচ্ছ ফোরকান চে জাহের হুয়া”।
বাংলা অনুবাদ : (মির্যার কথিত ইলহাম) আমি তো কুরআনের মতই। আর অচিরেই ফোরকান (কুরআন) হতে যাই প্রকাশিত হয়েছে তাই আমার কাছ থেকেও প্রকাশিত হবে।
রেফারেন্স : তাযকিরাহ (উর্দু) পৃষ্ঠা নং ৫৭০; চতুর্থ এডিশন।
কাজেই কাদিয়ানীরা যখন আমাদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ করে যে, কুরআন থেকে প্রমাণ দিন ঈসা (আ:) আকাশে স্বশরীরে জীবিত আছে, তখন যদি তাদেরকে মির্যা কাদিয়ানীর বই “বারাহীনে আহমদীয়া” থেকে তাদের উক্ত চ্যালেঞ্জ এর জবাব দিই তাহলে কি আমাদের ভুল হবে? যেহেতু মির্যা কাদিয়ানীর কথিত ওহী বা ইলহাম হল, সে নিজেই একটি কুরআন বা কুরআনের মত!! হয়ত জান ছুটাতে এখানেও রূপকের কাসুন্দি নিয়ে হাজির হয়ে যাবেন! কাদিয়ানিরা এর কী জবাব দেবেন?
সাধারণ কাদিয়ানীদের জন্য এই লিখাটি পড়া খুবই জুরুরী :
কাদিয়ানী নেতারা যে কয়টি কথা দিয়েই সাধারণ কাদিয়ানীদের ভুলিয়ে রাখে এবং নিজেরাও অহংকারে বাঁচেনা এখানে তারই কিছু কথা তুলে ধরে জবাব দেয়া হল। মূলত তারা এই কয়টি কথা দিয়েই তাদের চোখের ও মনের উপর পর্দা ফেলে রাখে। যেকেউ-ই উত্তরগুলো নিয়ে ভাবলে তার জন্য তাদের মিথ্যা আর ধোকা থেকে বাঁচতে সহজ হবে, ইনশা-আল্লাহ।
১. মোল্লা মৌলভীর পক্ষে সম্ভব না মির্যা কাদিয়ানীর কথার মর্ম বুঝা! মির্যা সাহেব এর আধ্যাত্মিক কথাবার্তার মর্ম বুঝতে হলে হৃদয় ও মন দুইটাই পবিত্র হতে হবে।
আমার বক্তব্য : নাউযুবিল্লাহিমিন যালিক। যারা এই ধরণের কথা বলেন তারা মির্যাকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা:) থেকেও বড় বুঝাতে চাচ্ছেন! নতুবা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার মর্ম বুঝা সহজ হওয়া সত্ত্বেও মির্যা কাদিয়ানীর কথার মর্ম বুঝা কেন কঠিন হবে? সুতরাং শীঘ্র তাওবা করুন।
২. মির্যা সাহেব হাদীসের ভবিষ্যৎবাণী অনুসারে প্রতিশ্রুত “মসীহ মাওউদ” হিসেবে আগমন করেছেন। তাই অন্যরা ভুল করলেও মির্যা সাহেব ভুল করতে পারেন না। কেননা রাসূল (সা:) মসীহে মাওউদ সম্পর্কে “হাকামান আদালান” অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক হবেন, বলে গেছেন। সুতরাং অন্যদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর মির্যা সাহেবের ব্যাখ্যাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
আমার বক্তব্য : প্রথমে তো প্রমাণ করা চাই যে, মির্যা সাহেবই হাদীসে বর্ণিত সেই প্রতিশ্রুত মসীহ মাওঊদ কিনা? কারণ, বুখারী শরীফের “কিতাবুল আম্বিয়া” পর্বে ৩২৬৪ নং হাদীসে এসেছে, والذي نفسى بيده ليوشكن ان ينزل ابن مريم فيكم حكما عدلا অর্থাৎ “কসম সেই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ, অচিরেই মরিয়ম পুত্র (ঈসা) তোমাদের মাঝে একজন ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক হিসেবে অবশ্যই নাযিল হবেন।” এখানে মোটা দাগে কয়েকটি পয়েন্ট লক্ষণীয়। (১) আগমনকারী ব্যক্তিটি মরিয়মপুত্র হযরত ঈসা (আ:)-ই হবেন, এইকথা কসম বা শপথ করে বলা (২) নাযিল হওয়া (৩) ইবনে মরিয়ম হওয়া এবং (৪) ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রপ্রশাসক হওয়া। যেহেতু তিনি রাষ্ট্রীয় কর মওকুফ করবেন। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রীয় কর (টেক্স) মওকুফ করতে পারে শুধুমাত্র যিনি রাষ্ট্র প্রধান তিনিই। তাই প্রশ্ন আসবে, এসবের একটিও কি মির্যা গোলাম আহমদের সাথে মিল পাওয়া যায়? চিন্তা করে দেখুন তো! এখানে বলে রাখা দরকার, মির্যা কাদিয়ানী নিজেই কিন্তু লিখে গেছেন, কসম খেয়ে কোনো কথা বললে তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়না, বরং আক্ষরিক অর্থে-ই বহাল থাকে। (হামামাতুল বুশরা উর্দূ- পৃষ্ঠা ১৪; রূহানী খাযায়েন ৭/১৯২)। এমতাবস্থায় “ইবনে মরিয়ম” দ্বারা ইবনে চেরাগবিবি মির্যা কাদিয়ানী কিভাবে উদ্দেশ্য হয়?
৩. সত্যের বিরোধীতা আগেও ছিল এখনো হচ্ছে আগামীতেও হবে। সুতরাং অন্য ফেরকার মুসলমান কর্তৃক কাদিয়ানীদের বিরোধীতা হওয়াই স্বাভাবিক। আর এটি তাদের সত্য হওয়ারই দলিল!
আমার বক্তব্য : অন্ততপক্ষে সহীহ বুখারীর মানদণ্ডে-ও মির্যা কাদিয়ানীর মসীহ হবার দাবী যেখানে মিথ্যা সাব্যস্ত হল সেখানে তাকে (মির্যা) “মিথ্যুক” প্রমাণ করার আর কী বাকি? পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৫৯ নং আয়াতে ঈসা (আ:) এর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর প্রতি আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে ঈমান আনা প্রসঙ্গে ক্ববলা মওতিহি অর্থাৎ ঈসা (আ:)-এর মৃত্যুর পূর্বে… শব্দ উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও ঈসা (আ:)-কে মির্যা কাদিয়ানী মৃত বলে চেঁচামেচি করার কে? বর্তমানে কি আহলে কিতাবিদের সবাই ঈমান এনে মুসলমান হয়ে গেছে বলতে চান? অন্যথা আমরা মহান আল্লাহকে ছেড়ে মির্যাকে কিরূপে সত্যবাদী মেনে নিতে পারি? উল্লেখ্য, অন্য আরেকটি মতে “মওতিহি” এর একবচনের সর্বনামপদ দ্বারা ‘আহলে কিতাবী’-কে বুঝানো উদ্দেশ্য। কিন্তু এটি সর্বসম্মত মতের বিরোধী ও বিচ্ছিন্ন একখানা মত মাত্র। সহীহ বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়া অংশে হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে ثم يقول ابو هريرة واقرأو ان شئتم শীর্ষক হাদীস দ্বারাও পরিষ্কার বুঝা যায় যে, আয়াতটির ‘মওতিহি’ শব্দ দ্বারা ‘ঈসা (আ:)-এর মৃত্যুর পূর্বে’ বুঝানোই উদ্দেশ্য। সংক্ষেপে।
৪. হাদীসে এসেছে উম্মতে মুহাম্মদীয়া ৭৩ ফেরকা হবে। এদের ৭২ ফেরকা দোজখে যাবে আর ১টি মাত্র ফেরকা বেহেশতি। সুতরাং ৭২ ফেরকার লোকেরা এই ১টি ফেরকাকে অর্থাৎ “আহমদীয়ত”কে কুফুরী জামাত বলবে এটাই স্বাভাবিক।
আমার বক্তব্য : কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী নিজেই ‘জামাতে আহমদীয়া’ নামের নতুন এই দলটিকে তার বইয়ের এক জায়গায় উম্মতে মুহাম্মদীয়া’র ৭৩ ফেরকার বহির্ভূত সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি গোষ্ঠী বলেই সুস্পষ্ট ইংগিত দিয়ে গেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন : تمہارے ہاتھ میں کیا ہے؟ بجز ان حدیثوں کے جو تہتر فرقوں نے بوٹی بوٹی کرکے باہم تقسیم کر رکہی ہیں ۔ অর্থাৎ তোমাদের হাতে সেসব হাদীস ছাড়া আর কিবা আছে যেগুলো ৭৩ ফেরকার লোকেরা টুকরো টুকরো করে ভাগ ভাটোয়ারা করে রেখেছে! (রূহানী খাযায়েন খণ্ড নং ১৭ পৃষ্ঠা নং ৪৫৬)। তাছাড়া “পাক্ষিক আহমদী” নামের সাময়িকীতেও মির্যার সেই কথারই প্রতিধ্বনি হিসেবে লিখা হয়েছে যে “এই যে তেয়াত্তর দল এই তেয়াত্তর দলই আহমদীয়া জামাতকে কাফির বলিয়া গণ্য করে”। (রেফারেন্স পাক্ষিক আহমদী ৩১ ডিসেম্বর,২০১৮ ঈসাব্দ পৃষ্ঠা নং ৩৮; ০৪/০৯/১৪৪০ হিজরী)। আরো মজার ব্যাপার হল, খোদ মির্যা কাদিয়ানীর বইতেও লিখা আছে, উম্মতে মুহাম্মদীয়া তৃতীয় শতাব্দির পরে তেয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হইয়া গিয়েছে। (দেখুন, হাকীকাতুল ওহী [বাংলা] ৩৬)। তাহলে তারও প্রায় এক হাজার বছর পরে এসে কাদিয়ানী জামাত এই উম্মতের তেয়াত্তর ফেরকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কিভাবে? সুতরাং কাদিয়ানিরা ৭৩ দলের বাহিরে সম্পূর্ণ নতুন একটি গোষ্ঠী হওয়াই পরিষ্কার হয়ে গেল।
৫. দুনিয়ার ২১৩টি রাষ্ট্রে আহমদীয়া জামাত (কাদিয়ানীরা) বিজলির গতিতে পৌছে গেছে। এটাই প্রমাণ করে যে, এটি আল্লাহর জামাত। এটিকে ধ্বংস করা কারো সাধ্য নেই। আরেকটি কথা এই যে, মির্যা সাহেব মিথ্যা হলে তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারলেন কীভাবে?
আমার বক্তব্য : বিজলির গতিতে কোনো জামাত বা গোষ্ঠী সারা দুনিয়ায় পৌছে যাওয়াই সেটি “সত্য” হওয়ার যুক্তি সঠিক হলে তখন নিচের প্রশ্নটির কোনো-ই জবাব থাকবেনা! আপনি কি বাহাউল্লাহ সম্পর্কে জানেন? উইকিপিডিয়া (আরবী) আমাদের তথ্য দিচ্ছে, মির্যা হুসাইন আলী নূরী তথা বাহাউল্লাহ তিনি ১৮৬৩ সালে ‘মসীহ’ দাবী করার পর আরো ২৯ বছর বেঁচে ছিলেন! দ্য ব্রিটানিকা বুক অফ দ্য ইয়ার (১৯৯২-বর্তমান) বইটি ২০০২ সালে দেশের উপস্থিতির সংখ্যাকে ভিত্তি করে ধর্মের বর্ধনশীলতার একটি হার প্রকাশ করেছে। এই জরিপ অনুসারে বাহাই ধর্ম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বর্ধনশীল স্বাধীন ধর্ম। ব্রিটানিকা দাবি করেছে বিশ্বের ২২১টি দেশ ও স্থানে এই ধর্মের অস্তিত্ব আছে। সেই সাথে বিশ্বে প্রায় ২,১০০ জাতিগত, বর্ণভিত্তিক ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ধর্মের অনুসারী রয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৮০০টি ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে এই ধর্মের অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং সবমিলিয়ে বিশ্বব্যাপী এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। ২০০৭ সালে এফপি ম্যাগাজিনের এক জরিপ অনুসারে বিশ্বে বাহাই ধর্মের অনুসারী বৃদ্ধির হার ১.৭%। Click
এবার বাহায়ী জামাতকে কী বলবেন? বাহাউল্লাহ কিংবা তার জামাতকে কি সত্য বলবেন? আর যদি বাহাউল্লাহ মিথ্যা হয় তাহলে আপনাদের দাবী আর যুক্তি অনুসারে সে অল্প কয়দিন পরেই ধ্বংস হয়ে গেল না কেন? কেন সে মসীহ দাবী করে আরও ২৯ বছর দীর্ঘ জীবন লাভ করল? আরেকটি কথা হল, অপরাধীর শাস্তি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন (সূরা কাহফ/১৮:৫৮) আমাদের বলছে, আল্লাহ অপরাধীদের নিশ্চয়ই সাথে সাথে পাকড়াও করেন না বরং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন অতপর নির্ধারিত সময়ে তাদের পাকড়াও করবেন! মজার ব্যাপার হল, মির্যার ছেলে মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, মির্যা সাহেবের উপর নবুওয়তের মাসয়ালা ১৯০০ বা ১৯০১ সালের পরেই খুলেছিল। তিনি আরো লিখেছেন, ১৯০১ সালের পূর্বে তিনি তার দাবীকৃত নবুওয়তকে ‘মুহাদ্দাসিয়ত’ শব্দে তাবীল করেছেন এবং আপনা দাবীকৃত নবুওয়তকে জুঝী নবুওয়ত বা অসম্পূর্ণ নবুওয়ত বলে আখ্যা দিতেন। মির্যাপুত্র রচনাবলীর সমষ্টি ‘আনওয়ারুল উলূম’ ২/৪৪৪-৪৫ দ্রষ্টব্য। এমতাবস্থায় মির্যা কাদিয়ানী নবুওয়তের দাবী করে মাত্র ৭ বা ৮ বছরই বেঁচেছিলেন বলা যেতে পারে! তো এটাই কি তার দীর্ঘ জীবন লাভ করা?
৬. অ-আহমদীরা যতই বিরোধিতা করবে ততই আহমদীয়ত সারা বিশ্বে বৃদ্ধি হতে থাকবে। এই বছর-ও প্রায় ছয় লক্ষ নতুন করে বাইয়েত নিয়েছে। তাই আহমদীয়ত সত্য! সারা দুনিয়াতে আহমদীরা (কাদিয়ানীরা) বর্তমানে ২৬ কোটির ঊর্ধ্বে। সুতরাং আমরাই সত্য!
আমার বক্তব্য : আহমদীয়ত যে মিথ্যা এবং সুস্পষ্ট মডারেট ধোকা তা উপরেই দলিল-প্রমাণের আলোকে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন বাকি থাকল, ছয় লক্ষ বাইয়েতের দাবী! আমি এর প্রতিউত্তরে তাদেরই একজন সাবেক কাদিয়ানী মুরুব্বী পাকিস্তানের লাহোরের জেহলম জেলার সাবেক কাদিয়ানী নায়েবে আমীর প্রফেসর মালিকমনোয়ার আহমেদ এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করব। তিনি ২০০১ সালে ইসলাম কবুল করে সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন “২০০০ সালে আমাকে কেন্দ্র থেকে ৩০০ গয়রে আহমদীকে বাইয়েতের জন্য টার্গেট করতে বলা হল। আমি মাত্র তিনজনকে প্রস্তুত করতে পারলাম। কিন্তু ইউ.কে জলসায় ৪১৩০৮৯৭৫ (চার কোটি ১৩ লক্ষ) নতুন বিশ্ব বাইয়েতের খবর প্রকাশ করা হয় এবং আমাকে জানানো হয় ‘আপ কা টার্গেট পুরা হো গী’ (অর্থাৎ আপনার টার্গেট পূর্ণ হয়ে গেছে)। তারপরের বছর অর্থাৎ ২০০১ সালে আমাকে সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০০ জনকে বাইয়েতের টার্গেট করতে বলা হল। আমি একজনকেও রাজি করতে পারিনি। কিন্তু ওদিকে বিশ্ব বাইয়েত থেকে ৮১০০৬৭২১ (আট কোটি দশ লক্ষ) জনের নতুন বাইয়েতের ঘোষণা দিয়ে দেয়া হল (দৈনিক আল ফজল, ৩রা আগস্ট ২০০৫ ইং সংখ্যা দ্রষ্টব্য)। আমি আশ্চর্য হলাম। জেলা আমীরকে প্রশ্ন করলাম। আমাকে উত্তর দেয়া হল, তুম খামুশ রাহো (অর্থাৎ তুমি চুপ থাক)। জামাতের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবানা খবরদার! তিনি আমাকে যুক্তি দিলেন, যদিও তোমার এখান থেকে কেউ বাইয়েত হয়নি, কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য জায়গা থেকে তো হয়েছে! তখন আমি বললাম, আমি আমার আশেপাশেও খবর নিয়েছি। সব জায়গায় আমার মতই অবস্থা এবং সবাই আপনার মতই একই শান্তনামূলক কথা বলে আত্মপ্রসাদ নিচ্ছে!” প্রমাণ হিসেবে প্রফেসর মালিক মনোয়ার আহমদ এর মুখ থেকেই শুনে নিন Click তারপরই তিনি ২০০১ সালে কাদিয়ানীদের বিশ্ব বাইয়েতের এই ড্রামা’র মুখোশ উন্মোচন করে ইসলামে ফিরে আসেন। সুতরাং আপনাদের নিকট কুরআন হাদীস বাদ দিয়ে বিশ্ব বাইয়েতি ড্রামা খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা আমাদের নিকট কোনোই গুরুত্ব রাখেনা।
৭. সব নবীই বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাই মির্যা কাদিয়ানীও বিরোধীতার সম্মুখীন হবেন এমনটাই স্বাভাবিক। আর আল্লাহ তাকে ওহী(?) দ্বারা জানিয়ে দিয়েছেন যে, সারা দুনিয়ায় তিনি তার জামাতকে পৌঁছিয়ে দেবেন। আজ তাই হচ্ছে।
আমার বক্তব্য : কাদিয়ানীদের কথাতেই পরিষ্কার হয় যে, তারা মির্যাকে “নবী” হিসেবেই মান্য করে। নতুবা “সব নবীই বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছিলেন” এইধরণের উদাহরণ টানার মানে কী? যাইহোক, কোনো দাবীদার ব্যক্তি বিরোধীতার সম্মুখীন হওয়াই তার সত্য হওয়ার প্রমাণ নয়। বরং সত্যতার প্রমাণ হল, কুরআন হাদীস ও ইজমায়ে সাহাবা। কেননা ইতিহাস সাক্ষী, বহু মিথ্যাবাদী তাদের ভন্ডামীর কারণে জনরোষের স্বীকার হয়েছিল এমনকি হত্যা পর্যন্ত হয়েছিল। সাহাবাদের যুগে মুসাইলামা কাজ্জাব আর অষ্টাদশ শতাব্দীর ইরানী বংশোদ্ভূত আলী মুহাম্মদ বাবী তারই দৃষ্টান্ত বহন করে। ১৮৫১ সালে ইরান সরকার “বাবী জামাত” এর প্রতিষ্ঠাতা আলী মুহাম্মদ বাবকে ‘ইমাম মাহদী’ দাবীর পর ফায়ারিং স্কোয়াডে অমানুষিক কায়দায় হত্যা করেন। অনুরূপ বাহায়ী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ও মসীহ এবং রাসূল দাবীদার বাহাউল্লাহ ইরানীও প্রথমে ইরান থেকে ইরাক নির্বাসিত হন। তার কিছু দিন পর ইরানী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আমৃত্যু জেল খাটেন। তার মৃত্যুর পর তার সেই বাহায়ী জামাত আজ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় ২২১ টি রাষ্ট্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখানে কী বলবেন?
৮. মির্যার সত্যতা জানতে চাহিলে খোদার নিকট দোয়া করুন আর ইস্তিখারাহ করুন। দেখবেন চল্লিশ দিনের মধ্যেই ফল পেয়ে যাবেন।
আমার বক্তব্য : ইস্তিখারাহ সম্পর্কে ইসলামের একটি বিধান রয়েছে। তা হল, শরীয়তের পূর্ব মীমাংসিত কোনো বিষয়ে কনফিউশন হয়ে ইস্তিখারাহ করা নাজায়েজ ও হারাম। বুখারী শরীফের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকারক, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) লিখেছেন, فإن الواجب و المستحب لا يستخار فى فعلهما و الحرام والمكروه لا يستخار فى تركهما . فتح البارئ كتاب الدعوات অর্থাৎ ওয়াজিব এবং মুস্তাহাব বিষয়ে তা পালন করা আর না করার ক্ষেত্রে ইস্তিখারাহ বিধিবদ্ধ নয়। কোনো হারাম বা মাকরূহ বিষয়ে তা বর্জন করা আর না করার ক্ষেত্রেও ইস্তিখারাহ বিধিবদ্ধ নয়। (সূত্র : ফাতহুল বারী শরহে বুখারী : কিতাবুদ দাওয়াত, বাব ৪৮; খন্ড ১৪ পৃষ্ঠা ৪১৮)। এতে বুঝা যায়, ইস্তিখারাহ হতে হবে দুনিয়াবী বিষয়ে। ইসলামের আলোকে যেই বিষয়টি পূর্ব থেকে মীমাংসিত ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত সেই বিষয়ে কনফিউশন হওয়া ও নতুন করে সমাধান চাওয়ার নিয়তে ইস্তিখারাহ করা নাজায়েজ এবং হারাম। উদাহরণস্বরূপ, আপন ভাইয়ের সাথে বোনের বিয়ে হারাম, এটি পূর্ব মীমাংসিত বিষয়। তাই এই বিষয়ে কনফিউশন হওয়া এবং ইস্তিখারাহ করা নাজায়েজ। তদ্রুপ নবুওয়তের দরজায় সীল লেগে যাওয়া এবং ঈসা (আ:) জীবিত থাকা ও তাঁর দ্বিতীয়বারে আগমন করার বিষয়েও ইস্তিখারাহ করা হারাম। কেননা এগুলো ইসলামের পূর্ব মীমাংসিত বিষয়। তাই এসবে অস্বীকারকারী মির্যা কাদিয়ানী সম্পর্কে ইস্তিখারাহ করার অর্থই হল নিজকে নিজে ইসলামের গন্ডি থেকে খারিজ করে দেয়া। ফলে বিতাড়িত শয়তানের পক্ষে সহজ হয়ে যায় স্বপ্নযোগে তার চোখে মির্যাকে সত্যবাদীরূপে দর্শন করানো। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ইস্তিখারাহ এর শরয়ী বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বহু সরলমনা মুসলমান ধোকা খেয়ে কাদিয়ানী হয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম ঘটেনি। তাই আপনাদের মির্যা কাদিয়ানীর বিষয়ে ইস্তিখারাহ করার উক্ত পরামর্শ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য ও বাতিল।
৯. আমরা আহমদীরা (কাদিয়ানীরা) সারা দুনিয়াতে এক ও অভিন্ন জামাত। আমাদের খলিফা আছে। আমাদের বায়তুলমাল আছে। আর অপর দিকে অন্যরা নানা ফেরকায় বিভক্ত। সুতরাং আমরাই সঠিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমার বক্তব্য : যারা ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই রাখেনা তাদের মহলে আপনাদের এই সমস্ত ইমোশনালি কথাবার্তা খুবই গুরুত্ব রাখবে তা ঠিক। আপনি বললেন যে, আপনাদের নাকি খলিফা রয়েছে! যদি তাই হয় তাহলে বলুন, ইসলামের দৃষ্টিতে “খলিফা” এর সংজ্ঞা কী? সুনির্দিষ্ট কোনো ভুখন্ড ছাড়া কেউ “খলিফা” দাবী করা পাগলের প্রলাপ নয় কি? আমরা জানি, ইসলামের সকল খলিফার যুগে নির্দিষ্ট ভুখন্ডের উপর তাদের প্রত্যেকেরই দখল ছিল। তাদের নির্দিষ্ট সামরিক ফোর্স ছিল। তার পরেই বায়তুলমাল ইত্যাদীর প্রশ্ন আসবে। তার চেয়ে বড় কথা, কাদিয়ানী জামাত তো ইসলামেরই কেউ না। এমতাবস্থায় খলিফার প্রসঙ্গটাও আরো বহু পরের সাবজেক্ট, তাই নয় কি? আরেকটি অপ্রিয় সত্য হল, ২০০৮ সালের ভেতরেই কাদিয়ানী জামাত কম বেশি প্রায় ১০টি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে, লাহোরী গ্রুপ, জামাতে আহমদীয়া ইছলাহ পছন্দ, জামাতে আহমদীয়া আল মুসলিমীন, গ্রীন আহমদীয়ত, জামাতে সহীহ ইসলাম এবং জামাতে আহমদীয়া হাকিকি অন্যতম। সংক্ষেপে। সুতরাং দয়া করে এই বিশ্বায়নের যুগে এসেও আর মিথ্যা বলবেন না!
১০. একমাত্র আহমদীরাই ঈসা (আ:)-কে মৃত প্রমাণের মাধ্যমে খ্রিষ্টান ধর্মকে মৃত সাব্যস্ত করে থাকে। অপর দিকে অন্যান্য মুসলমান ঈসা (আ:)-কে জীবিত বিশ্বাস করে। ফলে তারা খ্রিষ্টানদের নবী ঈসা (যিশুখ্রিস্ট)কে জীবিত রেখে ঈসায়ী ধর্মকেও জীবিত রাখতে চাচ্ছে। সুতরাং আমরাই সঠিক ইসলামের অনুসারী।
আমার বক্তব্য : মির্যা কাদিয়ানী তার ‘নূরুল হক’ বইয়ের ১ম খন্ডের ৫০ নং পৃষ্ঠায় মূসা (আ:) সম্পর্কে লিখেছেন و فرض علينا أن نؤمن بأنه حيي فى السماء و لم يمت و ليس من الميتين অর্থাৎ আমাদের উপর একথা বিশ্বাস রাখা ফরজ যে, নিশ্চয়ই তিনি (মূসা) আকাশে জীবিত, তিনি মৃত্যুবরণ করেননি এবং মৃতদের অন্তর্ভুক্তও নন। (রূহানী খাযায়েন ৮/৬৮-৬৯ দ্রষ্টব্য)। সম্পূর্ণ পৃষ্ঠাটি পড়ে দেখুন। উপরে মূসা (আ:) এর দীর্ঘ আলোচনা শেষে পরের পৃষ্ঠায় তাঁর (আ:) সম্পর্কে মির্যা সাহেব এইধরণের কথা লিখে গেছেন। আসুন! এবার আপনার যুক্তিতে ফিরে আসি। খ্রিষ্টানদের নবী ঈসা (যিশুখ্রিস্ট)কে জীবিত রাখার অর্থ যদি ঈসায়ী ধর্মকে জীবিত রাখা হয় তাহলে মূসা (আ:)-কে জীবিত রাখার বিশ্বাসের কী অর্থ দাঁড়াল? শুনুন! ধোকা আর প্রতারণা করারও একটা লিমিট আছে!!
১১. ইসলামের প্রাথমিককালেও অনেকে মুরতাদ হয়ে যায়। জনৈক কাতেবে ওহীও মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। কাজেই আরব আহমদী খলিফা খ্যাত ডক্টর হানী তাহের, ইংল্যান্ড আহমদী খলীফার মসজিদুল ফতূহ এর নায়েবে ইমাম ইকরামা নজমি, মিশরের আহমদী মু’আল্লিম ইনসার্জ ও লাহোরের জেহলম জেলার নায়েবে সদর আমীর প্রফেসর মালিক মনোয়ার আহমদ প্রমুখ তারাও কাদিয়ানীয়ত ত্যাগ করে মুরতাদ হয়েছেন বলে বিরোধীদের এত খুশি হওয়ার কারণ নেই। মরা পাতা ঝরে গেলেই ভাল!
আমার বক্তব্য: শরীয়তের পরিভাষায় সাধারণ অর্থে মুরতাদ বলতে বুঝানো হয় ধর্ম-ত্যাগী ব্যক্তিকে। এখন কেউ কাদিয়ানীয়ত ত্যাগ করার কারণে কাদিয়ানীদের দৃষ্টিতে মুরতাদ হওয়ার অর্থ ‘কাদিয়ানীয়ত’ যে আলাদা একটি ধর্ম তা কি প্রমাণ করা নয়? অবশ্যই। এমতাবস্থায় অ-কাদিয়ানীদের (মুসলমানদের) পক্ষ হতে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অমুসলিম সংখ্যালুঘু’ ঘোষণার দাবী ১০০% যুক্তিক বলেই সাব্যস্ত হল কিনা? সেযাইহোক, কাতেবে ওহী সাহাবীটির নাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সা’আদ ইবনে আবু সারাহ (রা:) তিনি (আয়াত): “ফা তাবারাকাল্লাহু আহসানুল খালিকীন” -কে কেন্দ্র করে মনে মনে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। তারপর তিনি কিছুদিনের জন্য ইসলাম ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান। অতপর মক্কা বিজয়ের আগ মুহূর্তে নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বেচ্ছায় তাওবা করেন এবং রাসূল (সা.)-এর হাতে ইসলামের উপর বয়াত গ্রহণ করেন। ইমাম আবু জা’ফর মুহাম্মদ বিন জারির আল তাবারী (৮৩৮-৯২৩) তার “জামিউল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন” বইয়ে বর্ণনা করেন : “ইসলামের নবী মক্কা বিজয়ের কিছু আগেই আব্দুল্লাহ ইবনে সা’আদ ইবনে আবু সারাহ (রা:) ইসলাম পুনরায় গ্রহণ করেন।” এ থেকে প্রমাণিত হয় আবদুল্লাহ ইবনে সা’আদ সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় ইসলাম পুনরায় গ্রহণ করেন। কারণ ঠিক মক্কা বিজয়ের সময়কালে তাকে প্রভাবিত করার কোনো মুসলিম সামরিক শক্তি তার আশেপাশে ছিল না। তারপর তিনি আমৃত্যু ইসলামের সেবায় নিয়োজিত থাকেন এবং হযরত উসমান (রা:) এর খেলাফতের আমলে মিশরের মত রাষ্ট্রের গভর্নরও হন। তিনি সামুদ্রিক বড় বড় জিহাদগুলোর চিপ কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। একথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল, উক্ত কাতেবে ওহী ব্যক্তিটি সাময়িকভাবে ইসলাম ত্যাগ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু এজন্য তিনি না কুরআনকে ভুল আখ্যা দিয়েছেন আর না মুহাম্মদ (সা:)-কে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়েছেন; বরং নিজেই নিজেকে দুষেছেন এবং নিজ ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করেছেন। পক্ষান্তরে ডক্টর হানী তাদের সহ যারাই কাদিয়ানীয়ত ত্যাগ করেছেন সবাই মির্যাকে মিথ্যুক আর ভন্ড আখ্যা দিয়েছে। তাহলে কিসের সাথে কিসের উপমা দিতে এলেন!
১২. কাদিয়ানীয়ত ছেড়ে কোন ইসলামে ফিরে যেতে চান? শীয়া, হানাফী মালেকী শাফেয়ী হাম্বলী আহলে হাদীস, দেওবন্দী, বেরলবী, জামাত শিবির, চরমোনাই, রাজারবাগী মাইজভাণ্ডারী ইত্যাদি কোন ফেরকার ইসলামে ফিরে গেলে সঠিক ইসলামে ফিরে যাওয়া হবে?
আমার বক্তব্য : প্রথমকথা হল, মনে করুন কাদিয়ানীয়ত ছেড়ে কেউ এদের যে কোনো একটিতে চলে গেল! অন্ততপক্ষে তাতেও তার ঈমানটা বাঁঁচবে। কেননা সে মুহাম্মদ (সা:)- এর পরে দ্বিতীয় আর কাউকে নবী মেনে নেয়া থেকে রক্ষা পেল। ফলে তার আমলের দুর্বলতার কারণে সাময়িক শাস্তি ভোগ করলেও একটি সময় ঈমানের কারণে সে নাজাত পাবে, ইনশাল্লাহ । দ্বিতীয় কথা হল, প্রশ্নে বর্ণিত নামগুলোর মধ্যে শীয়া হল ইসলামের একটি পুরনো ফেরকা। তাদের বিচারে তারাও সঠিক। বিপরীতে অন্যগুলোর মধ্যে হানাফী শাফেয়ী মালেকী আর হাম্বলী এগুলো ফেরকাই নয়, বরং ফিকহি মাসয়ালায় চারজন বিশিষ্ট ফকিহ ও মুজতাহিদ ইমামের চারটি ফিকহ বা গবেষণালব্ধ বুঝের ভিন্নতা মাত্র। যা আহলে সুন্নাহরই অভ্যন্তরীণ একটি ফিকহি মতভিন্নতা। তারপর আহলে হাদীস, চরমোনাই, জামাতে ইসলামি সহ এগুলোর কোনো কোনোটি রাজনৈতিক দল আবার কোনোটি পীর মুরশিদি তরিকা, কোনো কোনোটি মানহাজ তথা পার্সোনালিটি মাত্র। মনে রাখতে হবে যে, ফেরকা, মানহাজ, পলিটিকাল পার্টি ও মাযহাব এগুলো প্রত্যেকটি আলাদা জিনিস। কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন হল, কাদিয়ানীয়ত ইসলামী ফেরকা বা মানহাজ হলে তখন কেউ সেটিকে ত্যাগ করার দরুন ‘মুরতাদ’ হবে কেন? বলাবাহুল্য, কাদিয়ানীয়তের দৃষ্টিতে মির্যা কাদিয়ানীই তাদের সর্বশেষ নবী (রূহানী খাযায়েন খন্ড ২০ পৃষ্ঠা ৭০ দ্রষ্টব্য) !
তাই অপ্রিয় হলেও সত্য, সাধারণ কাদিয়ানীদের বুঝে আসুক বা না আসুক, সত্য এটাই যে, কাদিয়ানীয়ত নতুন একটি ধর্ম। ফলে এটি ইসলামের কোনো ফেরকারই অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লাহ আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন! আমীন। সংক্ষেপে…
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকাহ (রা.)-এর বিয়ের সময় উনার বয়স কত ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে দুইটি মত থাকা সত্ত্বেও আমাদের অধিকাংশ মুসলমান শুধুমাত্র একটি মতই ব্যক্ত করে থাকেন যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। আমি আজ এখানে উভয় মতই তুলে ধরব। সে সাথে আমি আমার পছন্দনীয় মতের পক্ষে দলিল ও যুক্তি পেশ করব, ইনশাআল্লাহ। (মহানবীর যুগে মেয়েদের বিয়ের আদর্শ বয়স সম্পর্কে এই লিখাটিও পড়া যেতে পারে)।
সম্প্রতি ইসলামের প্রাণ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিয়ে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মুখপাত্র নূপুর শর্মা ও দিল্লির মিডিয়া শাখার প্রধান নবীন কুমার জিন্দাল। যার ফলে সারা দুনিয়ায় নিন্দার ঝড় উঠে। অথচ হিন্দুদের বাল্মিকী রামায়ণের তৃতীয় খণ্ডের ৪৭শ অধ্যায়ে সীতার বিবৃতি থেকে আমরা জানতে পারি যে, সীতা অষ্টাদশ বছর বয়ঃক্রমকালে বিবাহের ত্রয়োদশ বছরে রামের বন গমণকালে তাঁর সঙ্গে অযোধ্যা ত্যাগ করেছিলেন। পাটিগণিতের সহজ হিসাব মতে, বিবাহের সময় সীতার বয়স পাঁচ-ছয় বছর ছিল। (মোহাম্মদ মতিয়র রহমান, প্রাচীন ভারতে বাল্যবিয়ে)। এছাড়া হিন্দুদের ‘স্কন্দ পুরান’ গ্রন্থেও লিখা আছে যে, রাম সীতাকে বিয়ে করেন, যখন সীতার বয়স ৬ বছর। (স্কন্দ পুরান ৩:২:৩০:৮-৯)। কথা এখানেই শেষ নয়, হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণও রুক্সীনিকে বিয়ে করেন যখন রুক্সীনির বয়স ৮ বছর। (স্কন্দ পুরান ৫:৩:১৪২:৮-৭৯)। আরও উল্লেখ আছে, শিব পার্বতিকে বিয়ে করেন যখন পার্বতির বয়স ৮ বছর। (শিব পুরান, রুদ্রসংহিতা, পার্বতি খণ্ড ৩:১১:১-২)। অপ্রিয় হলেও সত্য, যাঁরা মহানবী (সা.) ও আয়েশা (রা.)-এর বিয়ের বয়স নিয়ে আপত্তি করেন, তাঁরা কিন্তু রাম আর সীতার, শ্রীকৃষ্ণ আর রুক্সীনি, শিব আর পার্বতি এদের কারোরই বিয়ের বয়স নিয়ে টুঁ শব্দটুকুও করেন না। এটি তাদের কেমন ইনসাফ?
উল্লেখ্য, বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণে ২৪,০০০ শ্লোক ছিল। এই রামায়ণ ছয়টি (মতান্তরে সাতটি) কাণ্ড বা খণ্ডে বিভক্ত ছিল। রামায়ণের উপজীব্য অযোধ্যার রাজকুমার রামের জীবনকথা। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এই মহাকাব্য রচিত হয়। এই মহাকাব্য মহাভারতের পূর্বসূরি।
হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিয়ের সময়কার বয়স :
প্রথম মত :
১. রাসূল (সা.) এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.) এর বিয়ে হয় তৃতীয় হিজরী সনের শাওয়াল মাসে বা ৬২৩-৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে। যদিও বলা হয়, হযরত আয়েশা (রা.)-এর জন্ম ৬১৪ খৃষ্টাব্দে কিন্তু সহীহ বুখারীতে এসেছে আল কোরআনের ৫৪ তম অধ্যায় নাযিলকালে আয়েশা (রা.) একজন কিশোরী (جارية) বয়স্কা ছিলেন। যেমন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, بَلِ السَّاعَۃُ مَوۡعِدُہُمۡ وَ السَّاعَۃُ اَدۡہٰی وَ اَمَرُّ (অর্থাৎ বরং কিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত সময়। আর কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্তকর) আয়াতটি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি মক্কায় নাযিল হয়েছিল তখন আমি কিশোরী ছিলাম, খেলা-ধুলা করতাম। [সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর অধ্যায় নং ৫২, হাদীস নং ৪৫১২ (ইফা)]
সহীহ বুখারী কিতাবুল তাফসীর, হাদীস নং ৪৫১২ (ইফা)
উল্লেখ্য, সর্বসম্মত মুসলিম স্কলারদের মতে ৫৪তম উক্ত অধ্যায় (সূরা আল-ক্বমর) নাযিল হয় মক্কায় মুশরিকদের একটি প্রশ্নের জবাবে (সহীহ মুসলিম)। আনুমানিক ৬১৫ খৃষ্টাব্দের দিকে (তাফসিরে কুরতুবী, সূরা ক্বমার আয়াত নং ২৪ দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ সূরা আত-ত্বরিক আর সূরা ছোয়াদ নাযিলের পর নবুওয়তের পঞ্চমবর্ষে । রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) নিজেও বলেছেন, قال ابن عباس: كان بين نزول هذه الآية وبين بدر سبع سنين؛ فالآية على هذا مكية. وفي البخاري عن عائشة أم المؤمنين رضى الله عنها قالت: لقد أنزل على محمد صلى الله عليه وسلم بمكة وإني لجارية ألعب অর্থাৎ বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া আর এই সূরাটি নাযিল হওয়া উভয়ের মধ্যখানে সাত (৭) বছরের তফাৎ রয়েছে। আর এই ক্ষেত্রে আয়াতটি মক্কায় নাযিল হয়। এবং বুখারীতে এসেছে যে, আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত আছে….। যাইহোক, সে হিসাবে হযরত আয়েশা’র বয়স তখন ৯ বছর হলেও ৬২৩-৬২৪ খৃষ্টাব্দে তাঁর বয়স কোনো ভাবেই ১৭-১৮ বছরের নিচে নয়। স্ক্রিনশট :-
তাফসিরে কুরতুবিতে ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত বর্ণনাটি দেখুন
২. অধিকাংশ বর্ণনাকারীর মতে হযরত আয়েশা (রা.) বদরের যুদ্ধ (৬২৪ খৃষ্টাব্দে) এবং ওহুদের যুদ্ধ (৬২৫ খৃষ্টাব্দে) ইত্যাদীতে অংশগ্রহণ করেছেন। উল্লেখ্য রাসুল (সা.) এর বাহিনীতে ১৫ বছরের কম বয়স্ক কেউ গ্রহণযোগ্য ছিলনা বরং তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হত। সুতরাং সেসময় যে হযরত আয়েশা’র বয়স ৬ বা ৯ ছিলনা, তা বলাই বাহুল্য। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার)।
A narrative regarding Ayesha’s participation in the battle of Uhud is given in Bukhari, (Kitabu’l-jihad wa’l-siyar, Arabic, Bab Ghazwi’l-nisa’ wa qitalihinna maa’lrijal; that all boys under 15 were sent back is given in Bukhari, Kitabu’l- maghazi, Bab ghazwati’l- khandaq wa hiya’l-ahza’b, Arabic).
৩. অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মতে, হযরত আয়েশার বোন হযরত আসমা ছিলেন তাঁর চেয়ে দশ বছরের বড়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আসমা ৭৩ হিজরী সনে যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ১০০ বছর। সে হিসাবে ১লা হিজরীতে তাঁর বয়স ছিল ২৭ বছর। তাহলে সে হিসেবে ১লা হিজরীতে হযরত আয়েশার বয়স যে তখন ১৭ এর কম ছিলনা, তা বোঝা যায়। তাহলে ৬২৩-৬২৪ খৃষ্টাব্দ তাঁর বয়স ১৯ বছরই ছিল বলতে হয়। (ইমাম যাহাবীর আস-সিয়ারু আলামিন নুবালা ২/২৮৯)।
(For Asma being 10 years older than Ayesha, see Ala’ma’l- nubala’, Al- Zahabi, Vol 2, Pg 289, Arabic, Mu’assasatu’l- risalah, Beirut, 1992. Ibn Kathir confirms this fact, [Asma] was elder to her sister [Ayesha] by ten years” (Al- Bidayah wa’l- nihayah, Ibn Kathir, Vol 8, Pg 371, Arabic, Dar al-fikr al-arabi, Al-jizah, 1933).
For Asma being 100 years old, see Al-Bidayah wa’l-nihayah, Ibn Kathir, Vol 8, Pg 372, Arabic, Dar al-fikr al- `arabi, Al-jizah, 1933). Ibn Hajar al-Asqalani also has the same information: “She [Asma (ra)] lived a hundred years and died in 73 or 74 AH.” Taqribu’l-tehzib, Ibn Hajar Al- Asqalani, Pg 654, Arabic, Bab fi’l-nisa’, al- harfu’l-alif, Lucknow).
৪. প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল তাবারী’র বই ‘তারীখুল উমাম ওয়াল মামলূক’ থেকে পাওয়া যায় যে, হযরত আবু বকর (রা.) এর চার সন্তান ছিলেন যাঁরা সকলেই ইসলামপূর্ব যুগে জন্মগ্রহণ করেন (ইসলামপূর্ব যুগ ৬১০ খৃষ্টাব্দ শেষ হয় – লিখক)। তাহলে নিশ্চয়ই হযরত আয়েশা (রা.) এর জন্ম ৬১০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেই হয়েছিল বলতে হবে। সে হিসাবেও মানতে হবে যে, তিনি বিবাহের সময় কমপক্ষে ১৯ বছর বয়স্কা ছিলেন। (তারীখুল উমাম ওয়াল মামলূক ৪/৫০; দারুল ফিকর, বৈরুত লেবানন)।
৫. আরেক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে হাইসাম থেকে জানা যায়, হযরত আয়েশা (রা.) হযরত উমর ইবন আল খাত্তাব (রা.) এর বেশ আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য উমর ইবনে আল খাত্তাব (রা.) ৬১৬ খৃষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করেন। আবার হযরত আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন ৬১০ খৃষ্টাব্দে। সুতরাং মানতে হবে যে, হযরত আয়েশা (রা.) ৬১০ এর কাছাকাছি সময়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার অর্থ আবারো দাঁড়ায় যে, তিনি ৬১০ খৃষ্টাব্দের আগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কোন ধর্ম গ্রহণ করবার নূন্যতম বয়স ৬ অথবা ৭ হলেও তাঁর ছিল। এমতাবস্থায় ৬২৩-৬২৪ সালে তাঁর বয়স প্রায় ১৮-২০ এর কম ছিলনা। (আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ইমাম ইবনে আল হাইছাম ১/২২৭-২৩৪ এবং ২৯৫)।
৬. হাম্বলী মাযহাবের ইমাম, আহমদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে (৬/২১০) উল্লেখ করেছেন, বিবি খাদিজাহ (রা.) এর মৃত্যুর পরে (৬২০ খৃষ্টাব্দ) হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্য খাওলাহ (خولة) নামের এক মহিলা দু’খানা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। যার মধ্যে হযরত আয়েশা (রা.) এর কথা উল্লেখ করার সময় একজন পূর্ণবয়স্কা যুবতী হিসেবেই উল্লেখ করেন, কোনো ছোট্ট শিশু (طفل) হিসেবে নয়। (মুসনাদে আহমদ ৬/২১০)।
(Musnad, Ahmad ibn Hanbal, Vol 6, Pg 210, Arabic, Dar Ihya al-turath al- `arabi, Beirut).
৭. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)-এর একটি কিতাবের নাম ﺍﻹﺻﺎﺑﺔ ﻓﻲ ﺗﻤﻴﻴﺰ ﺍﻟﺼﺤﺎﺑﺔ (আল-ইছাবাহ ফী তাময়ীঝিস সাহাবাহ)। কিতাবটির ৪র্থ খণ্ডের ৩৭৭ নং পৃষ্ঠায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত ফাতেমা (রা.)- এর জন্মের ৫ বছর পর হযরত আয়েশা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। আর ফাতেমা (রা.) এর জন্মের সময় রাসুল (সা.) এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। সে হিসেবে আয়েশা (রা.) এর জন্মের সময় মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স ছিল ৪০ বছর। সে হিসেবেও বিয়ের সময় হযরত আয়েশা (রা.) এর বয়স কোনোভাবেই ১৩ বছরের কম ছিল না।
(Al-isabah fi tamyizi’l- sahabah, Ibn Hajar al- Asqalani, Vol 4, Pg 377, Arabic, Maktabatu’l- Riyadh al- haditha, al- Riyadh,1978)
উক্ত দীর্ঘ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হল, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সাথে বিয়ের সময় আয়েশা (রা.) যে ৬-৯ বছরের শিশু ছিলেননা, বরং নিম্নে ১৩ বছর আর উপরে ১৯ অথবা ২০ বছর বয়স্কা ছিলেন বলেই প্রমাণ করা। সংক্ষেপে। এই থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিয়ের সময় তিনি কত বছরের বয়সী ছিলেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে দুইটি মতই সেই শুরু থেকেই অদ্যাবধি চলে আসছে। দ্বিতীয় মতটি হল, তাঁর বিয়ের সময় বয়স ৬ থেকে ৯ বছর থাকা। সহীহ বুখারীতে উক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ থাকায় অধিকাংশ মানুষ সেটিকে গ্রহণ করে থাকে আর অপর মতটির কোনোই পরোয়া করেনা! অথচ ঐতিহাসিক বিচার-বিশ্লেষণ মতে প্রথম মতটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। এবার সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে হযরত হিশাম ইবনে উরওয়াহ (রহ.) -এর সেই বর্ণনাটি নিয়ে কিছু কথা বলব।
বুখারীর বর্ণনা ও হিশাম ইবনে উরওয়াহ :
দ্বিতীয় মত :
অনেকে ইমাম বুখারী (রহ.)-এর বর্ণিত একটি মওকূফ (যে হাদিসের সনদ বা সূত্র নবী কিংবা সাহাবীদের কারো সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় এমন) হাদীসের উপর ভিত্তি করে হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিয়ের বয়স ৬ বছর ছিল বলে মনে করে থাকেন। অথচ হাদীসটির সনদের ভেতর হিশাম ইবনে উরওয়াহ নামের রাবী (হাদীসের বর্ণনাকারী) সম্পর্কে ইমাম মালেক (রহ.) বলেছেন, তিনি শেষ বয়সে তথা ৭১ বছর বয়সে মদিনা থেকে ইরাক চলে যাওয়ার পর স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে তার বর্ণনায় অনেক কিছুই উল্টোপাল্টা হয়ে যেত। সেজন্য তার থেকে কোনো ইরাকী রাবী যত হাদীসই বর্ণনা করবে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবেনা। উল্লেখ্য, বুখারী শরীফে হযরত হিশাম ইবনে উরওয়াহ তিনি ইরাকি রাবী থেকেই এটি বর্ণনা করেন। দেখুন, তাহযীবুত তাহযীব, লেখক ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)।
(ক) প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম আবুল হাসান ইবনে ক্বাত্তান (রহ.) ‘বায়ানুল ওয়াহাম ওয়াল ইবহাম‘ (بيان الوهم و الإبهام) কিতাবের ৫ম খন্ডের ৫০৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন: أن هشام اختلط في آخر عمره অর্থ হিশাম ইবনে উরওয়াহ শেষ বয়সে উল্টাপাল্টা করে ফেলত।’
(খ) ইমাম যাহাবী (রহঃ) ‘মিযানুল ই’তিদাল‘ কিতাবের ৪র্থ খন্ডের ৩০১-৩০২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন : هشام بن عروة أحد الأعلام، حجة إمام، لكن في الكبر تناقض حفظه و لم يختلط أبداً অর্থ হিশাম ইবনে উরওয়াহ (রহ.) তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন। নির্ভরযোগ্য ইমাম ছিলেন। তবে বৃদ্ধাবস্থায় তার স্মৃতিলোপ পায় অথচ (ইতিপূর্বে) তিনি কখনো উল্টাপাল্টা করেননি।’ আরো দেখুন, আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ৬/৪৯০, ইমাম যাহাবী (রহ.)।
সহীহ বুখারীর হাদীস :
সহীহ বুখারী, মুসলিম সহ অনেক হাদীসগ্রন্থে হিশাম ইবনে উরওয়াহ’র সূত্রে হযরত আয়েশা (রা.) এর বয়স নিয়ে যে তথ্য এসেছে, তা হিশাম ইবনে উরওয়াহ (রহ.) কর্তৃক বর্নিত একটি মওকূফ বর্ণনারই আশ্রয় করে। প্রায় ৫-টি সনদে হযরত আয়েশা (রা.) এর বয়স সম্পর্কিত রেওয়ায়েত উল্লেখ রয়েছে। সবই হিশাম ইবনে উরওয়াহ (রহ.) কর্তৃক বর্নিত। হিশামের বর্নিত ওই ৫-টি সনদে মদিনার কোনো রাবী (বর্ণনাকারী)’র সংশ্লিষ্টতা নেই। হিশাম তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন : ﺃﻥ ﺍﻟﺮﺳﻮﻝ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﺗﺰﻭﺝ ﺃﻡ ﺍﻟﻤﺆﻣﻨﻴﻦ ﻋﺎﺋﺸﺔ ﻭ ﻫﻲ ﺍﺑﻨﺔ ﺳﺖ ﺳﻨﻮﺍﺕ ﻭ ﺩﺧﻞ ﺑﻬﺎ ﻭ ﻫﻲ ﺍﺑﻨﺔ ﺗﺴﻊ অর্থাৎ, রাসূল (সা.) উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.)-কে যখন বিয়ে করেন তখন তিনি ছয় বছরের মেয়ে আর যখন তিনি তাঁকে উঠিয়ে নেন তখন তিনি নয় বছরের মেয়ে। (অনুবাদ শেষ হল)।
শেষকথা, হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিয়ের সময় তাঁর বয়স কত ছিল তা ঐতিহাসিক ভাবে দু’টি মতের উপরেই স্থাপিত। বুখারীর উক্ত হাদীসের আলোকে ও রাবী হিশাম ইবনে উরওয়াহ’র সাক্ষ্যমতে দ্বিতীয় মতটি একে তো ঊসূলে হাদীসের শর্তের বিরুদ্ধে যাওয়ায় গ্রহণযোগ্যতার পাল্লায় টিকছেনা তদুপরি ঐতিহাসিক বহু বর্ণনার সাথেও সাংঘর্ষিক। তাই আমার মতে এই বিষয়ে প্রথম মতটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। আল্লাহু আ’লাম।
প্রশ্ন : অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ:)-এর পুনঃ আগমন সত্য ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত। তেমনি পবিত্র কুরআনেও এর সমর্থনে কোনো ইংগিত কিবা প্রমাণ আছে কিনা?
জবাব : জ্বী হ্যাঁ, অবশ্যই পবিত্র কুরআনেও হযরত ঈসা (আ.)-কে সশরীরে জীবিত উঠিয়ে নেয়া এবং অচিরেই পৃথিবীতে পুনঃ আগমনের উপর সুস্পষ্ট ইংগিত ও প্রমাণ পাওয়া যায়। এজন্য পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৪৬; ৪৮; ৫৫; সূরা নিসা, আয়াত নং ১৫৭; ১৫৮; ১৫৯; সূরা যুখরুফ, আয়াত নং ৬১ ইত্যাদি দেখা যেতে পারে। অত্র লিখাটির শেষে মাত্র একখানা আয়াত ও তাফসীর পেশ করা হবে। জ্ঞানীদের জন্য সংক্ষেপে ততটুকুই যথেষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ। উম্মতে মুহাম্মদীয়া তথা মুসলমানদের অকাট্য বিশ্বাসগুলোর অন্যতম ঈসা (আ.)-কে মহান আল্লাহ সশরীরে জীবিত আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন, এটিকে কাদিয়ানীরা অনর্থক আখ্যা দিয়ে বলে বেড়ায় যে, কোনো মানুষকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া প্রকৃতি বিরোধী ও আল্লাহর নিয়ম বা কানুনের পরিপন্থী। মজার ব্যাপার হল, তাদের এসব অর্বাচীন আর অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তার জবাব আমাদের দিতে হয়না, বরং তাদের মির্যা কাদিয়ানীর লেখিত বইপুস্তকই তাদের ওসব মূর্খতার প্রতিউত্তরের জন্য যথেষ্ট। দেখুন, মির্যা কাদিয়ানী নিজেই লিখেছে, “তাকে (খোদাকে) কানুনের আকারে কোনো সীমার মধ্যে আবদ্ধ করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। খোদাকে চেনার জন্য এ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, খোদার জুল-জালাল-এর কুদরত ও হেকমতসমূহ অসীম ও অনন্ত।” (আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলী – ৫৭; প্রকাশকাল ২৭ মে ১৯৯৮ইং)।
স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য –
কাদিয়ানীদের প্রকাশনা হতে ‘মির্যার বিভিন্ন পুস্তক হতে আহরিত’ রচনাবলির সমষ্টি আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলী, পৃ-৫৭
কোনো কোনো ভাই হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন যে, হযরত ঈসা (আ:)-কে সশরীরে আকাশে তুলে নেয়ার উল্লেখ কুরআনের কোন আয়াতে আছে?
এমন প্রশ্নকারী যারা তাদের ভাবখানা এমন যে, কুরআনে যা পরিষ্কার করে উল্লেখ নেই তা হাদীসে যতই পরিষ্কার করে উল্লেখ থাকুক না তা হবেনা! অথচ তাদের জানা থাকা উচিৎ ছিল যে, পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলোর কোনো কোনোটি সুস্পষ্ট আবার কোনো কোনোটি অস্পষ্ট। তাই পবিত্র কুরআনে যেসব বিষয় সংক্ষেপে কিংবা অস্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে তা সুস্পষ্ট করতে পবিত্র হাদীসের মুখোমুখি হওয়া জরুরী। কেননা পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, রাসূল (সা.) খোদ কুরআনের ব্যাখ্যাদাতা। আল্লাহতালা ফরমান :وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الذِّکۡرَ لِتُبَیِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَیۡہِمۡ وَ لَعَلَّہُمۡ یَتَفَکَّرُوۡنَ অর্থাৎ আর তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দাও, যা তাদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে। (সূরা আন-নাহল /১৬ঃ৪৪)। এখন পবিত্র কুরআনেই যদি সব কিছু সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয় তাহলে রাসূল (সা.)-এর হাদীসের প্রয়োজন মিটানোর উপায় কী? কিংবা রাসূল (সা.)-এর আগমনেরই দরকার কী? ভাবিয়ে তুলে কিনা?
এবার আসুন প্রথমে হাদীস শরীফে ঈসা (আ.)-এর জীবিত থাকা ও পুনঃআগমন বিষয়ে কিরূপ শব্দচয়নে উল্লেখ আছে দেখে নিই!
পবিত্র হাদীস শরীফ থেকে : (১) সহীহ বুখারী মুসলিমে এসেছে, শপথ খোদাতায়ালার যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয় অচিরেই ইবনে মরিয়ম তোমাদের মাঝে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে নাযিল হবেন। (বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীস নং ৩২৬৪)।
(হাদীসটি সহ নিচের সব কয়টি হাদীসের আরবী ইবারত ও মূল কিতাবের স্ক্রিনশট দেখতে চাইলে ক্লিক করুন)।
আল আসমা ওয়াছ ছিফাত ২/৩৩১; হাদীস নং ৮৯৫
(৩) অত:পর ঈসা ইবনে মরিয়ম আকাশ থেকে নাযিল হবেন। ইমাম আবুবকর আহমদ ইবনে আমর আল বাজ্জার (মৃত ২৯২ হিজরী) সংকলিত ‘মসনাদে বাজ্জার’ ১৭/৯৬; হাদীস নং ৯৬৪২। হাদীসের মান সহীহ, বর্ণনাকারীদের ভেতর ‘আলী ইবনে আল মুনযির’ ব্যতীত সবাই বুখারী ও মুসলিমের রাবী। স্ক্রিনশট :-
মসনাদে বাজ্জার নামক হাদীসগ্রন্থের কিতাব
(৪) সেই সময় আমার ভ্রাতা ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) আকাশ থেকে (শুভ্র মিনারার নিকটে) উঁচু টিলায় একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে অবতরণ করবেন। (ইমাম ইবনে আসাকির সংকলিত ‘তারিখে দামেস্ক’ – খণ্ড নং ৪৭ পৃষ্ঠা নং ৫০৪-৫ ; প্রকাশনী বৈরুত লেবানন)।
তারিখে দামেস্ক
(৫) সেই সময় আমার ভ্রাতা ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) আকাশ থেকে (শুভ্র মিনারার নিকটে) উঁচু টিলায় অবতরণ করবেন। (দেখুন, কাঞ্জুল উম্মাল – খণ্ড ১৪ পৃষ্ঠা ৬১৮-১৯; রেওয়ায়েত নাম্বার ৩৯৭২৬)।
কাঞ্জুল উম্মাল
(৬) মির্যা কাদিয়ানী নিজেও মাসীহ দাবী করার পূর্বে ১৮৯১ সালের আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) তিনি আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। নইলে তিনি কেন লিখলেন যে ‘সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এমন শব্দও উল্লেখ রয়েছে যে, মসীহ (ঈসা) যখন আকাশ থেকে অবতরণ করবেন তখন তার পরনে দুইটি হলুদ বর্ণের চাদর থাকবে! স্ক্রিনশট দেখুন :-
রূহানী খাযায়েন (উর্দূ) ৩/১৪২
এখানে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, কাদিয়ানীদের পক্ষ হতে হযরত ঈসা (আ.)-কে মৃত বলে আখ্যা দেয়ার সকল প্রচেষ্টা মূলত খ্রিষ্টানদের রদ (খণ্ডন) করার উদ্দেশ্যে ছিলনা, বরং মির্যা কাদিয়ানী নিজের মসীহ দাবীকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই ছিল।
অন্যথা মির্যা কাদিয়ানী সেই নিজেকে মসীহ ঈসা, ইমাম মাহদী এবং নবী দাবী করার আগে ১৮৬৫ সাল থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর যাবত ইসলামের পক্ষে বহু লেখালেখি করলেন, বারাহীনে আহমদিয়া (খন্ড ১-৪) লিখলেন কিন্তু কখনো তো ঈসা (আ.)-কে মৃত বলে আখ্যা দেননি! ১৮৮১ সাল থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর নিজেকে মুজাদ্দিদ দাবি করতেন। কিন্তু সেই সময়টিতেও তিনি ঈসা (আ.)-কে মৃত বলেননি। বরং মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, মির্যা কাদিয়ানী সাহেব মসীহ উপাধি লাভ করার পরে আরো প্রায় দশ বছর পর্যন্ত বিশ্বাস করে আসছিলেন যে, ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) আকাশে জীবিত আছেন। (হাকিকাতুন নবুওয়ত, আনওয়ারুল উলূম ২/৪৬৩)।
আনওয়ারুল উলূম, মির্যা বশির উদ্দিন
পরবর্তীতে ঈসা (আ.)-কে মৃত আখ্যা দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। পবিত্র কুরআনের ৩০ টি আয়াত দিয়েও ঈসাকে মৃত প্রমাণ করার জোর চেষ্টা চালালেন। ভেবেচিন্তে অবাক হলাম যে, পবিত্র কুরআনের এই ৩০ আয়াত মির্যা সাহেবের মুজাদ্দিদ দাবীর ভেতরকার ১৮৮১-১৮৯১ সালের মধ্যে কুরআনের ভেতর কি ছিলনা? তখন কিজন্য তার মনে হলনা যে, ঈসা (আ.) জীবিত নন, বরং মৃত? সুতরাং অংক সোজা, নিজের উদ্দেশ্য পাকা করতেই তিনি আসল ঈসাকে মুর্দা আখ্যা দিতে চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন!
উল্লেখ্য, সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে ‘আসমান’ শব্দটির উল্লেখ নেই। তা সত্ত্বেও হযরত ঈসা (আ.) দ্বিতীয় আসমানে আছেন মর্মে কিরকম জোরালো বিশ্বাস থাকলে মির্যা সাহেব সহীহ মুসলিমের উদ্ধৃতিতে “ঈসা আকাশ থেকে নাযিল হবেন” এভাবে লিখে যেতে পারলেন! কাজেই, ঈসা (আ.)-কে আকাশে সশরীরে উঠিয়ে নেয়ার উল্লেখ সুস্পষ্টভাবে কুরআনের কোন আয়াতে উল্লেখ আছে, এইরূপ প্রশ্ন করা অজ্ঞতা আর নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বৈ কিছুনা। এমন ব্যক্তিকে যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয় যে, “নামায যে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করা ফরজ তার উল্লেখ কুরআনের কোন আয়াতে আছে” তাহলে সে এর জবাবে কী বলবে?
পবিত্র কুরআন থেকে : দ্বিতীয়ত, পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৪৬ নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতালা ইরশাদ করেন, وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلاً وَمِنَ الصَّالِحِينَ অর্থ-“সে (ঈসা) দোলনায় থাকা অবস্থায় (যেমন) মানুষের সাথে কথা বলবে, পরিণত বয়সেও (তেমনিভাবে) কথা বলবে এবং সে হবে নেককার মানুষদের একজন।” (০৩:৪৬)।
তাফসীর :
আলোচ্য আয়াতে হযরত ঈসা (আ.)-এর একটি অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তিনি শৈশবে যে বয়সে কোনো শিশু কথা বলতে সক্ষম হয়না, তখনই তিনি মানুষের সাথে কথা বলবেন। এখানে তার পরেই আবার বলা হচ্ছে যে, যখন তিনি প্রৌঢ় বয়সের হবেন তখনো মানুষের সাথে কথা বলবেন। উল্লেখ্য, বিখ্যাত অভিধানবেত্তা ইবনে মানযূর আল আফ্রিকী (মৃত : ৭১১ হিজরী) তার বিখ্যাত “লিসানুল আরব” অভিধানগ্রন্থে ‘আল-মুহকিম’ (আরবি : المحكم) অভিধানের উদ্ধৃতিতে ‘কাহল’ (كَهْلاً) এর সংজ্ঞায় লিখেছেন যে, هو من أربع و ثلاثين إلى إحدى و خمسين “অর্থাৎ ‘কাহল’ বলতে ৩৪ হতে ৫১ বছর বয়সের ব্যক্তিকে বুঝাবে।” আল-মু’জাম অভিধানে আছে ‘৩৩ বছর থেকে ৫০ বছরের মধ্যবয়সীকে আরবীতে ‘কাহল‘ বলে। তবে কেউ কেউ অন্যভাবেও বলেছেন।
আল মু’জামুল ওয়াসীত (অভিধান) থেকে দেখুন :
আল মু’জামুল ওয়াসিত, আরবী অভিধান
যাইহোক, এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, শৈশবে কথা বলা নিঃসন্দেহে একটি অলৌকিক ব্যাপার। যার উল্লেখ এক্ষেত্রে সমীচীন হয়েছে। কিন্তু প্রৌঢ় বয়সে কথা বলা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়। মুমিন, কাফের, পণ্ডিত, মূর্খ সবাই এ বয়সে কথা বলে। কাজেই এক্ষেত্রে বিশেষ গুণ হিসেবে এটা উল্লেখ করার অর্থ কী? জ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলবে কিনা?
তাই এই প্রশ্নের উত্তরে নির্ভরযোগ্য তাফসীরের কিতাবে লিখা আছে যে, এখানে প্রৌঢ় বয়সের কথাবার্তার উল্লেখ একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিতস্বরূপ করা হয়েছে। তা এই যে, ইসলামী ও কুরআনী বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত ঈসা (আ.)-কে তাঁর ত্রিশ-তেত্রিশ মধ্যকার বয়সেই জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নেয়া হয়েছে। মির্যা কাদিয়ানীর কিতাব ‘তুহফাতুন নদওয়া‘ এর মধ্যে লেখা আছে, اور واقعہ صلیب کے وقت حضرت عیسیٰ کی عمر قریباً 33 سال تہی অর্থাৎ ক্রুশীয় ঘটনাকালে হযরত ঈসা’র বয়স ছিল প্রায় তেত্রিশ বছর। (রেফারেন্সঃ রূহানী খাযায়েন ১৯/১০৪)।
আমাদের আকিদাও এইরকম। কারণ বিভিন্ন রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, আকাশে তুলে নেয়ার সময় তার বয়স প্রায় ত্রিশ-তেত্রিশের মাঝামাঝি ছিল। অর্থাৎ তিনি যৌবনের প্রারম্ভিককালে উত্তোলিত হয়েছেন। অত:পর প্রৌঢ় বয়স, যাকে আরবীতে ‘কাহল/কুহল’ (كَهْلاً) বলা হয়; তিনি এ জগতে সেই বয়স পাননি। কাজেই প্রৌঢ় বয়সে মানুষের সাথে তাঁর কথা বলা তখনই সম্ভব, যখন তিনি আবার এ জগতে প্রত্যাবর্তন করবেন। পবিত্র কুরআনে মূলত এ দিকেই ইঙ্গিত করে “পরিণত বয়সেও তিনি মানুষের সাথে কথা বলবেন” এভাবে বলা হয়েছে। নতুবা এভাবে বলার কোনো দরকার ছিলনা। যেহেতু প্রৌঢ় বয়সে কথা বলতে পারা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, বরং সাধারণ একটা ব্যাপার। (দেখুন, তাফসীরে বয়ানুল কুরআন, কৃত হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. এবং মা’আরেফুল কুরআন, কৃত মুফতি শফী রহ.)। অনুরূপ একই তাফসীর পাওয়া যায় সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কিতাব তাফসীরে ইবনে কাসীরেও।
মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক স্বীকৃত যুগ ইমাম, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরের কিতাব “তাফসীরে তাবারী” এর ভেতর ইমাম ইবনে জারীর আত তাবারী (রহ.) লিখেছেন- আমাকে ইউনুছ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন আমাকে ইবনে ওহাব বলেছেন, তিনি বলেন আমি ইবনে যায়েদ থেকে শুনেছি তিনি বলেন, আল্লাহতালার এই কথার অর্থ হল : قد كلمهم عيسى في المهد و سيكلمهم إذا قتل الدجال و هو يومئذٍ كهل অর্থাৎ ঈসা (আ.) দোলনাতে মানুষের সাথে কথা বলবেন, (তেমনিভাবে) তিনি অচিরেই মানুষের সাথে কথা বলবেন যখন দাজ্জালকে হত্যা করবেন আর তখন তিনি প্রৌঢ় বয়সে পরিণত হবেন। (তাফসীরে তাবারী, ইবনে জারীর রহ.)। স্ক্রিনশট
তাফসীরে তাবারী
এই একই তাফসীর রয়েছে ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) রচিত “তাফসীরে কাবীর” এর মধ্যে। তিনি হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ তাফসীরকারক ইমাম হুসাইন ইবনে ফদ্বল আল বাজালী রহ. (মৃত : ২৮২ হিজরী) এর উদ্ধৃতিতে লিখেছেন, أن المراد بقوله و كهلا ان يكون كهلا بعد ان ينزل من السماء في آخر الزمان و يكلم الناس و يقتل الدجال الخ অর্থাৎ আয়াতের উদ্দেশ্য হল, ঈসা (আ.) তিনি শেষ যামানাতে আকাশ থেকে অবতরণকরার পরে প্রৌঢ় হওয়া। (তখন) তিনি মানুষের সাথে (প্রৌঢ় লোকদের মত জ্ঞানীসূলভ, মেধা সম্পন্ন প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধভাবে) কথা বলবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তিনি বলেন, এই আয়াতে ঈসা (আ.) পৃথিবীতে অচিরেই নাযিল হওয়ার ব্যাপারে নস তথা প্রমাণ রয়েছে। (ইমাম রাজী রচিত, তাফসীরে কাবীর দ্রষ্টব্য)। আশাকরি চিন্তাশীলবন্ধুদের জন্য প্রকৃত ব্যাপারটি বুঝতে এতটুকুই যথেষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ । ওয়াসসালাম। স্ক্রিনশট –