Home Blog Page 35

হাদীসের নামে মির্যা কাদিয়ানীর ডজনখানেক মিথ্যা-৫

রাসূল (সা:)-এর নামে মিথ্যা রটানো সম্পর্কে হাদীস : যে ব্যক্তি আমার প্রতি স্বেচ্ছায় মিথ্যাচার করে তার ঠিকানা জাহান্নাম। (সূত্র : সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইলম)।

মির্যা কাদিয়ানীর ধারাবাহিক মিথ্যাসমূহ (প্রামাণ্য স্ক্যানকপি সহ) :

(১) বহু সহীহ হাদীসে এসেছে মসীহ মওউদ শতাব্দির শুরুতে আগমন করবেন এবং তিনি চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ হবেন। (রূহানী খাযায়েন ২১:৩৫৯)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(২) কুরআন এবং বহু হাদীসে ভবিষ্যতবাণী রয়েছে, মসীহ মওউদ (আ:) এর যখন আত্মপ্রকাশ হবে তখন তিনি ইসলামী উলামাদের হাতে কষ্ট পাবেন। তারা তাকে কাফের আখ্যা দেবেন, হত্যার ফতুয়া দেবেন, কঠিনভাবে অবমাননা করবেন এবং ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে ও ধর্ম নষ্টকারী বলে মনে করবেন। (রূহানী খাযায়েন ১৭:৪০৪)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৩) কিছু সংখ্যক হাদীসে উল্লেখ আছে, আগত মসীহ এর একটি আলামত এটিও রয়েছে যে, তিনি জুলকারনাঈন হবেন। (রূহানী খাযায়েন ২১:১১৮)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৪) বহু হাদীসে নববীতে এমনি এসেছে, প্রতিশ্রুত মাহদীর উপর কুফুরীর ফতুয়া লাগানো হবে। অতএব সেটি এখন পূরণ হলো। (রূহানী খাযায়েন ১২:৭৫)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৫) বহু সহীহ হাদীস দ্বারা এটি প্রমাণিত যে, মসীহ ছয় হাজার সালে জন্ম নিবেন। (রূহানী খাযায়েন ২২:২০৯)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৬) যেহেতু সহীহ হাদীসে আছে, ইমাম মাহদীর কাছে একটি কিতাব থাকবে যার মধ্যে ৩১৩ জন সাথীর নাম থাকবে। সে ভবিষ্যতবাণী আজ পূরণ হল। (রূহানী খাযায়েন ১১:৩২৪)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৭) সহীহ বুখারীতে সুস্পষ্টভাবে লিখা আছে যে, হযরত ঈসা (আ:) মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। (রূহানী খাযায়েন ১৯:৬৫)প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৮) কুরআন শরীফ এবং বহু হাদীস ও পূর্বেকার বহু কিতাবে উল্লেখ আছে, মসীহ এর যুগে একটি নতুন গাড়ী আবিস্কৃত হবে যা আগুন দ্বারা চলবে, তখন উট বেকার হয়ে পড়বে। আর এই শেষ অংশের হাদীসটি সহীহ মুসলিমেও রয়েছে। এই সেই গাড়ী যেটি আবিস্কৃত হল সেটি রেল (Rail)। (রূহানী খাযায়েন ২০:২৫)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৯) বহু হাদীসে এই কথা পরিষ্কার রয়েছে, শেষ যুগে মুহাম্মদ (সা:) দুনিয়াতে আবার আসবেন এবং মসীহও আসবেন। তবে দুইজনই বুরুজীভাবে আসবেন, হাকীকীভাবে নয়। (রূহানী খাযায়েন ১৮:৩৮৪)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(১০) বহু হাদীসে এটিও উল্লেখ আছে, মসীহ এর সময় তাউন [প্লেগ, মহামারী] ছড়িয়ে পড়বে এবং হজ্জে বাধা প্রদান করা হবে। সুতরাং এই সমস্ত নিদর্শন প্রকাশ্যে আসিয়া গেল। (রূহানী খাযায়েন ১৭:৩৯৯)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(১১) নবী করীম (সা.)-এর বহু হাদীসে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে যে, হুজুর (সা.) এর উম্মতের মধ্য হতে এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করবে যাকে ঈসা এবং ইবনে মরিয়ম বলা হবে এবং নবী নামেও ডাকা হবে। (রূহানী খাযায়েন ২২:৪০৬)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,


১২। ‘মুজাদ্দিদ সেরহান্দী (রহ.) নিজ ‘মাকতুবাত’ () এর মধ্যে লিখেছেন, যদিও বা এই উম্মতের কিছু সদস্য আল্লাহর সাথে কথপোকথন ও আল্লাহর সম্বোধনের অধিকারী এবং কেয়ামত পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকবে কিন্তু যাকে খুব বেশি এই বৈশিষ্ট্য এবং গায়েবের সংবাদ দান করা হয় তাকে নবী বলা হয়।’ (রূহানী খাযায়েন ২২:৪০৬)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

শেষকথা : আহমদীবন্ধুদের উচিত, মির্যা সাহেবের মতবাদগুলো অন্ধভাবে ফেরি করার আগে তাকে অন্ততপক্ষে সত্যবাদী প্রমাণ করা। কারণ তিনি নিজেই লিখে গেছেন ‘কেউ একটি কথায় মিথ্যুক প্রমাণিত হলে তার অন্য আর কোনো কথার গ্রহণযোগ্যতা থাকেনা।’ (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২৩/২৩১)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! লিখাটি উপকারী মনে হলে অবশ্যই দেশের আক্রান্ত এলাকাগুলোতে পৌঁছে দেবেন। বিশেষ করে দাঈদের উচিত, লিখাটি প্রিন্ট করে নিজেদের সংরক্ষণে রাখা। যাতে প্রয়োজনে সত্যানুরাগী কাদিয়ানীদের চোখে আঙুল দিয়ে মির্যার বাস্তবতা দেখিয়ে দিতে পারেন। আল্লাহপাক যেন এই উসিলায় আমাদেরকে ক্ষমা করেন এবং পরকালে নাজাতের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহুম্মা আমীন।

লিখক : প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইমামান মাহদিয়্যান [إماما مهديا] শীর্ষক হাদীসের সঠিক অর্থ ও তাৎপর্য

  • ইমামান মাহদিয়্যান [إماما مهديا] শীর্ষক হাদীস :

সহজ সরল জবাব : চরম অর্থ-বিকৃতিকারী কাদিয়ানী সম্প্রদায় নিচে উল্লিখিত হাদীসটির ‘ইমামান মাহদিয়্যান’ খন্ডাংশ হতে যেই অর্থটি নিয়ে থাকে তা সম্পূর্ণরূপে ভুল ও ব্যাকরণ বিরুদ্ধ! প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আরেকটু পরে আসছি। প্রথমে পুরো হাদীসটির ব্যাকরণসিদ্ধ বাংলা অর্থ জেনে নিন। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন :

  • يوشك من عاش منكم ان يلقى عيسى بن مريم إماما مهديا وحكما عدلا فيكسر الصليب ويقتل الخنزير ويضع الجزية وتضع الحرب أوزارها
  • উচ্চারণ : ইউশিকু মান আ’-শা মিনকুম আঁই ইয়ালক্বা ঈসা ইবনা মারইয়ামা ইমামান মাহদিয়্যান ওয়া হাকামান আ’দালান ফা ইয়ুকছিরাছ ছালীবা ওয়া ইয়াক্বতুলাল খিনজীরা ওয়া তাদ্বা’আল হারবু আওঝা-রাহা।

অর্থাৎ তোমাদের মধ্য হতে যারা বেঁচে থাকবে তারা অচিরেই ঈসা (আ:)-কে একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম ও ন্যায়পরায়ণ প্রশাসকরূপে দেখতে পাবে। তিনি ক্রুশ ভাঙবেন এবং শূকর হত্যা করবেন। জিজিয়া (রাষ্ট্রীয় কর) তুলে দেবেন। তখন (আর কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায়) যুদ্ধ আপনা সরাঞ্জামাদী গুটিয়ে নেবে (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৯১১৭)।

বিশ্লেষণমূলক আলোচনা : উক্ত হাদীসে “ইমামান” শব্দটি মওসূফ [বিশেষিতপদ] আর “মাহদিয়্যান” শব্দটি ছিফাত [বিশেষণপদ]। যেজন্য অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রথমে “মাহদিয়্যান” এর অর্থ করতে হবে তারপর “ইমামান” এর অর্থ করতে হবে। ফলে “ইমামান মাহদিয়্যান” এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে : ‘একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম’। একজন ব্যাকরণের ছাত্র হিসেবে অবশ্যই জানার কথা যে, আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে ছিফাত [বিশেষণপদ]’র অর্থ আগে হয় আর মওসূফ [বিশেষিতপদ]’র অর্থ পরে হয়। যেমন :
[১] আজরান আযীমা [اجرا كريماً] অর্থাৎ উত্তম প্রতিদান। এখানে প্রথমে ‘কারীমা’ এর অর্থ নিতে হবে। কেননা এটি ছিফাত [বিশেষণপদ]। তারপর ‘আজরা’ এর অর্থ নিতে হবে। একই নিয়মে নিম্নরূপ। [২] ফাদ্বলান কাবীরা [فضلاً كبيراً] অর্থাৎ মহা অনুগ্রহ।
[৩] আযাবান মুহীনা [عذابا مهينا] অর্থাৎ লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি। (সূরা আহযাব : ৪৪, ৪৭, ৫৭)। সংক্ষেপে। লক্ষনীয় বিষয় যে, হাদীসটিতে “ইমামান মাহদিয়্যান” এর পূর্বেই ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম’ শব্দ উল্লেখ আছে। যেটি বাক্যে “যুলহাল” [যার অবস্থা বুঝানো হয় এমন]। অনুরূপ “মাহদিয়্যান” শীর্ষক একটি রেওয়ায়েত সহীহ বুখারীতেও আছে। নিচে দেখুন :

(ক) হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) সম্পর্কে রাসূল (সা:) বলেছেন, ﻭﺍﺟﻌﻠﻪ ﮬﺎﺩﯾﺎ ﻣﮭﺪﯾﺎ [ওয়াজ’আলহু হাদিয়ান মাহ্দিয়্যান] অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাকে একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী বানিয়ে দিন (বুখারী কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার)।
(খ) রাসূল (সা:) হযরত মু’আবিয়া (রা:) সম্পর্কেও বলেছেন : ﺍﻟﻠﮭﻢ ﺍﺟﻌﻠﻪ ﮬﺎﺩﯾﺎ ﻣﮭﺪﯾﺎ ﻭﺍﮬﺪ ﺑﻪ [আল্লাহুম্মাজ আলহু হাদিয়ান মাহ্দিয়্যান ওয়াহ্দি বিহি] অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাঁকে একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী বানিয়ে দিন আর তার মাধ্যমে [মানুষকে] হিদায়াত দান করুন। (তিরমিযী কিতাবুল মানাকিব, সনদ হাসান ও গরিব)।

সর্বশেষ কথা হল, যারা মওসূফ ছিফাত এর স্বতসিদ্ধ ব্যকরণিক নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করেই ‘ইমামান মাহদিয়্যান’ এর অর্থ করে ‘ইমাম মাহদীরূপে’ (মহা সুসংবাদ পৃ-১০)। তাদের নিকট আমার প্রশ্ন হল, ‘মুসনাদে আহমদ’ নামক কিতাবসহ হাদীসের অন্যান্য যেসব কিতাবে হযরত ঈসা (আ:)-এর দ্বিতীয় আগমন সম্পর্কে শব্দের সামান্য পরিবর্তনসহ আরো যেসব বাক্যাংশ রয়েছে সেখানেও কি অনুরূপ অর্থ নিবেন? যেমন :

১. ইমামান মাহদিয়্যান ওয়া হাকামান আদালা [إماماً مهديا و حكماً عدلاً]। মুসনাদে আহমদ : হা/৯১১৭। ২. ইমামান মুকছিতান [إماماً مقسطا]। মুসনাদে আহমদ : হা/৭৬২২, ৭৬৯০; তারিখে দামেস্ক : হা/৫১৩৫৫। ৩. ইমামান আদিলান [إماماً عادلاً]। ইমাম ইবনে আবী শাইবাহ (মৃত ২৩৫ হিজরী) সংকলিত মুছান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ : হা/৩৮৪৯১, ৩৬৮০৪। ৪. ইমামান আদিলান ওয়া ক্বাজিয়ান [اماما عادلاً و قاضياً]। ইমাম আবু বকর আশ-শাফেয়ী (মৃত ৩৫৪ হিজরী) সংকলিত, আল ফাওয়ায়িদুশ শাহীর বিল গাইলানিয়াত : হা/৭৯৩, ৮২৪। আপাদত এই কয়েকটা দিলাম। এখন বলুন, প্রথমোক্ত বর্ণনায় “ইমামান মাহদিয়্যান” এর অর্থ ‘ইমাম মাহদীরূপে’ হলে তবে অন্যান্যগুলোর অর্থ কীরূপে হবে? আশাকরি বুঝতেই পেরেছেন যে, কাদিয়ানীরা ব্যাকরণবিরুদ্ধ ও মতলবসিদ্ধ অনুবাদ করতে গিয়ে কত মারাত্মক ভুলভাল অনুবাদ করে থাকে। ফলে একে তো নিজেরা পথভ্রষ্ট হল সে সাথে অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে চলল!

  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইমাম মাহদীকে মানার গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে কতেক জিজ্ঞাসা

  • ইমাম মাহদীকে মানার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখপূর্বক কিছু প্রশ্ন :

আমরা প্রায়শই দেখি আহমদী তথা কাদিয়ানী জামাতের আলোচনায় ইবনে মাজাহ’র হাদীসের সে অংশটি আসে যা জনাব ফিরোজ আলম সাহেব [কাদিয়ানী ইনচার্জ কেন্দ্রীয় বাংলা ডেস্ক, লন্ডন] খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেন। যেমন فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ [ফা-ইজা রাআইতুমূহু ফা-বাইয়ূহু] অর্থাৎ যখন তোমরা তাকে দেখবে তখন বাইয়াত (যোগদান) করবে। কিংবা فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الثَّلْجِ فَإِنَّهُ خَلِيفَةُ اللَّهِ الْمَهْدِيُّ [ফা-ইজা রাআইতুমূহু ফা-বাইয়ূহু ওয়া লাও হাবওয়ান আলাছ ছালজি ফা-ইন্নাহু খালীফাতুল্লাহিল মাহ্দী] অর্থাৎ তাঁকে [গোরাসানের দিক থেকে] আত্মপ্রকাশ করতে দেখলে তোমরা বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তার বাইয়াত (যোগদান) করবে। কারণ সে আল্লাহ’র খলীফা আল-মাহদী। কিন্তু কখনো পুরো হাদীসটি বর্ণনা করতে শুনিনি।

এ হাদীসটি ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত একটি বড় হাদীসের (হা/৪০৮৪) খন্ডিত অংশ। বলে রাখা প্রয়োজন, একমাত্র ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ:) এককভাবে এটি বর্ণনা করেছেন এবং হাদীস বিশারদগণ এর সনদকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। সেযেইহোক, আমার প্রশ্ন সেটি নয়।

  • তবে ইমাম হাকেম (রহ:) যেই সনদে বর্ণনা করেছেন সেখানে ‘ক্বদ জাআত মিন ক্বিবালি খোরাসান’ [কালো পতাকাধারী বাহিনী খোরাসানের দিক থেকে আগমন করবে] শব্দটিও উল্লেখ আছে। এমনকি সেটি সনদের বিচারে সহীহ মুসলিম এর সমমানে উন্নীত। দেখুন মুসতাদরিক আলা আস সহীহাইন, কিতাবুল ফিতান ওয়াল মালাহিম।

আমি প্রথমে সম্পূর্ণ হাদীসটির অনুবাদ নিচে পেশ করছি : হযরত সাওবান (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:

“তোমাদের একটি সম্পদের [সিংহাসন বা গুপ্তধন] নিকট এক খলিফার তিন পুত্র যুদ্ধ করবে। তাদের কেউ সেই সম্পদ দখল করতে পারবে না। অতঃপর প্রাচ্যদেশ থেকে কালো পতাকা উড্ডীন করা হবে। তারা তোমাদেরকে এত ব্যাপকভাবে হত্যা করবে যে, ইতোপূর্বে কোনো জাতি তদ্রুপ করেনি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা:) আরো কিছু বলেছেন, যা আমার মনে নেই। তিনি আরো বলেন, তাকে [খোরাসানের দিক থেকে] আত্মপ্রকাশ করতে দেখলে তোমরা বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তার বাইয়াত করো [তথা তাঁর সিরিয়াভিমুখী মুজাহিদবাহিনীতে যোগদান করো – ইমাম যুহরী, নুআঈম ইবনে হাম্মাদ কৃত আল ফিতান ১/২০৬]। কারণ তিনি আল্লাহর খলীফা আল-মাহদী।”

এখন জনাব ফিরোজ আলম সহ কাদিয়ানী শীর্ষনেতাদের নিকট প্রশ্ন হল :

[১] আহমদীরা (তথা কাদিয়ানীরা) কেন হাদীসটির সম্পূর্ণ অংশ বর্ণনা করেন না?

[২] যদি করে থাকেন তাহলে মির্যা সাহেবের ইমাম মাহ্দী দাবির সময় খলিফার এই তিনপুত্র কারা ছিলেন যারা সেই সময় গুপ্তধনের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু অর্জন করতে পারেন নি? كُلُّهُمُ ابْنُ يَقْتَتِلُ عِنْدَ كَنْزِكُمْ ثَلاَثَةٌ خَلِيفَة [ইয়াকতাতিলু ইনদা কাঞ্জিকুম ছালাছাতুন কুল্লুহুম ইবনু খালীফাতিন]।

[৩] পূর্ব থেকে কালো পতাকাধারী কারা ছিলেন যারা মির্যা সাহেবের যুগে ব্যাপকভাবে মুসলমানদের হত্যা করেছেন, যা ইতোপূর্বে কোনো জাতি করেনি? فَيَقْتُلُونَكُمْ قَتْلاً لَمْ يُقْتَلْهُ قَوْمٌ [ফা-ইয়াকতুলূনাকুম কাতলান লাম ইয়ুকতালহু কাওমুন]।

[৪] ইমাম মাহদী খোরাসানের দিক থেকে সদলবলে সিরিয়াভিমুখে রাওয়ানা হলে মির্যা সাহেব কবে কখন খোরাসানের দিক থেকে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে জিহাদের জন্য বের হয়েছিলেন? বরং আমরা তো জানি যে, তিনি জিহাদের কবর রচিত করতেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন। উল্লেখ্য, উইকিপিড়িয়া’র তথ্যমতে খোরাসান এর ভূগৌলিক অবস্থান হল, উত্তর পশ্চিম আফগানিস্তান, উত্তর ও দক্ষিণ পূর্ব উজবেকিস্তান, উত্তর পূর্ব ইরান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, দক্ষিণ কাজিকিস্তান, উত্তর ও পশ্চিম তাজিকিস্তানসহ সম্পূর্ণ বিস্তৃত এলাকা।

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মির্যা কাদিয়ানীর বিভিন্ন দাবী দাওয়া ও সময়কাল

  • এক নজরে মির্যা কাদিয়ানীর বিভিন্ন দাবী দাওয়া

দাবীসমূহের রেফারেন্স ও দাবীকরার সময়কাল

মুলহাম (দৈব-বাণীর অধিকারী)। তাযকিরাহ পৃ ০৬; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৬৮ ইং।

বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর)। তাযকিরাহ পৃ ২৮; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮১ ইং।

মুজাদ্দিস (সংস্কারক)। তাযকিরাহ পৃ ৩৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮২ ইং।

মামূর মিনাল্লাহ (আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট)। তাযকিরাহ পৃ ৩৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮২ ইং।

নাযীর (ভয়প্রদর্শনকারী)। তাযকিরাহ পৃ ৩৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮২ ইং।

আদম, বিবি মরিয়ম, আহমদ। তাযকিরাহ পৃ ৫৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮৩ ইং।

মুরসাল (প্রেরিত)। তাযকিরাহ পৃ ৯৯; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮৪ ইং।

মাসীলে মসীহ (রূপক ঈসা আ:)। তাযকিরাহ পৃ ১৪৮; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯১ ইং।

তাওহীদ এবং তাফরিদ। তাযকিরাহ পৃ ১৬৪; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯২ ইং।

কুন ফা ইয়াকুন (হও বললে হয়ে যাওয়া)। তাযকিরাহ পৃ ১৬৪; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯২ ইং।

মাসীহে ইবনে মরিয়ম (স্বয়ং ঈসা আ:)। তাযকিরাহ পৃ ১৭৮; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯৩ ইং।

ইমাম মাহদী ও মাসীহ ঈসা। তাযকিরাহ পৃ ২০৯; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯৪ ইং।

ইমামুয যামান (যামানার ইমাম)। রূহানী খাযায়েন ১৩/৪৯৫, সময়কাল : ১৮৯৮ ইং।

খোদা। রূহানী খাযায়েন ১৩/১০৩, সময়কাল : ১৮৯৮ ইং।

নবুওয়তি প্রাসাদের আখেরি ইট। রূহানী খাযায়েন ১৬/১৭৭-৭৮, সময়কাল : ১৯০০ ইং।

কাশফ (অতিব জাগ্রত দিব্যি-দর্শন) অবস্থায় নিজেকে স্ত্রীলোক মনে হওয়া এবং আল্লাহকে পুরুষরূপে দেখা ও সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার দাবী। ইসলামী কুরবানী ট্রাক্ট (উর্দু) পৃ ১২; ১৯২০ ইং, লিখক, কাজী ইয়ার মুহাম্মদখান সাহেব (মির্যা কাদিয়ানীর ঘনিষ্ট সহচর)।

বুরূজি খাতামুল আম্বিয়া (শেষনবীর দ্বিতীয় প্রকাশ)। রূহানী খাযায়েন ১৮/২১২, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

জিল্লি মুহাম্মদ (মুহাম্মদ সা: এর প্রতিবিম্ব)। রূহানী খাযায়েন ১৮/২১২, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

জিল্লি, বুরুজি, উম্মতিনবী। রূহানী খাযায়েন ১৮/২১২, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

নবী ও রসূল। একটি ভুল সংশোধন পৃ. ৮, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

শরীয়তবাহক নবী (নতুন বিধি-বিধানসহ প্রেরিত)। রূহানী খাযায়েন ১৫/৪৩২; ১৭/৪৩৫-৩৬, সময়কাল : ১৯০২ ইং।

আখেরী নবী (শেষনবী)। রূহানী খাযায়েন ২০/৬৯-৭০; ১৯/৬১, সময়কাল : ১৯০২ ইং।

শ্রীকৃষ্ণ-এর অবতার (হিন্দু ধর্মানুসারীদের আরাধ্য বিশিষ্ট একজন দেবতা যিনি তাদের বিশ্বাস মতে ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতাররূপে খ্যাত)। রূহানী খাযায়েন ২২/৫২২, সময়কাল : ১৯০৭ ইং।

শেষকথা : মির্যা কাদিয়ানী মিরাক (সিজোফ্রেনিয়া) রোগেও আক্রান্ত ছিল (সীরাতে মাহদী: নতুন এডিশন ক্রমিক নং ১৯)। তার অসঙ্গত দাবীগুলো সেই রোগেরই উপসর্গ ছিল বলা চলে।

তথ্য-সংগ্রহে, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ

একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ এর ঘটনা নিয়ে কাদিয়ানীদের বাড়াবাড়ি

কাদিয়ানীদের অন্যতম একটি প্রতারণা মাহদীয়তের কথিত নিদর্শন চন্দ্রসূর্যগ্রহণের অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা :

চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ একই রমাজানের ১৩ এবং ২৮ তারিখে হওয়ার যুক্তিতর্ক কতটুকু সন্তোষজনক?

অপ্রিয় হলেও সত্য, বহু মানুষকে কাদিয়ানীরা এই একটা মিথ্যা দিয়ে অনবরত পথভ্রষ্ট করেই চলছে। অথচ এই ধরণের কোনো বর্ণনা-ই ‘হাদীস’ হিসেবে প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এর সনদের মধ্যে দুইজন মিথ্যুক এবং মুনকার পর্যায়ের রাবী (বর্ণনাকারী) থাকার কারণে বর্ণনার কথাগুলো তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনু আলী তথা ইমাম বাকের (রহ.)-এর কিনা তাও নিশ্চিত নয়। যদি কথাগুলো ইমাম বাকের-এর বলেও নিশ্চিত হওয়া যেত তাহলেও কথাগুলোর একটু হলেও গুরুত্ব থাকত। কাজেই বর্ণনাটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল। প্রিয় ভাই ও বোনেরা! বিষয়টিকে আমি প্রশ্নোত্তর আকারে নিচে তুলে ধরছি, যাতে সবাই সহজে বুঝতে পারে। তার আগে বর্ণনাটির সনদ বা ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র উল্লেখ করা হল। যথা গ্রন্থকার ইমাম দারে কুতনী, আবু সাঈদ, মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু নওফল, উবায়েদ ইবনু ইয়া’ঈশ, ইউনুস ইবনু বুকাইর, আমর ইবনু শিমার, জাবের ইবনু ইয়াজিদ, মুহাম্মদ ইবনু আলী ইবনু হোসাইন ইবনু আলী।

প্রশ্নর্কতা : এটি ইমাম বাকেরের বক্তব্য হওয়াটাও কিজন্য নিশ্চিত নয়?

উত্তরদাতা : ঐ যে দুই মিথ্যুকের কারণে। উপরেই সনদ উল্লেখ করে দিলাম! সেখানে ইমাম বাকেরের নামে যে দুই ব্যক্তি চন্দ্রসূর্যগ্রহণের কথাটি মাহদীয়তের নির্দশন বলে চালিয়ে দিয়েছে তাদের নামও উল্লেখ আছে, দেখুন! ইমাম বুখারী, ইবনে হাব্বান, ইয়াহইয়া ইবনু মঈন সহ হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, এই দুই ব্যক্তি মিথ্যুক এবং মুনকারুল হাদীস। এদের সূত্রে বর্ণিত কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এদের বর্ণিত কথাটি এই জন্যই ইমাম বাকেরের কথাও কিনা নিশ্চিত নয়।

প্রশ্নকর্তা : ইমাম বুখারীও কি এধরণের কথা বলেছেন?

উত্তরদাতা : জ্বী, বলেছেন। মূল কিতাব ‘তালখীছুল মুস্তাদরিক’ (১/২৪৬) থেকে হুবহু আরবী ইবারত তুলে ধরছি। যেমন قال يحيى بن معين : ليس بشيئ و قال الجورجانى : زائغ كذاب. و قال ابن حبان : رافضى يشتم الصحابة و يروى الموضوعات عن الثقات. و قال البخارى : منكر الحديث. و قال يحيى : لا يكتب حديثه و قال السليمان : كان عمرو يضع للروافض و قال ابو حاتم : منكر الحديث جدا ضعيف الحديث الخ و قال الحاكم ابو عبدالله : كان كثير الموضوعات عن جابر. এখানে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন যে, ইমাম বুখারীও (রহ.) আমর ইবনে শিমার-কে ‘মুনকারুল হাদীস’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তো বলেছেনই।

যেমন, তার বর্ণিত রেওয়ায়েত গুরুত্বহীন, সে কপট প্রকৃতির ও মিথ্যাবাদী, সে একজন রাফেজি (শীয়া মতাদর্শী) এবং সাহাবীদের গালি দিত, সে বিশ্বস্থ রাবীদের নামে জাল হাদীস তৈরী করত, সে একজন মুনকার রাবী, তার কোনো হাদীসই লিখাযোগ্য নয়, সে রাফেজিদের জন্য হাদীস জাল করত, সে একজন খুবই জঈফুল হাদীস, ইমাম হাকেম (রহ.) বলেছেন, সে জাবের ইবনু ইয়াজিদের কাছ থেকে বহু জাল হাদীস বর্ণনাকারী। উপরে যে সব কথা লিখলাম তা মূলত আরবী ইবারতটিরই অনুবাদ।

এবার দ্বিতীয় রাবী সম্পর্কে কী লিখা আছে শুনুন। আসমাউর রিজাল শাস্ত্রেল বিখ্যাত কিতাব ইমাম ইবনু আদী (২৭৭-৩৬৫ হিজরী) রচিত ‘আল কামেল ফী দ্বু’আফায়ির রিজাল’ (২/১১৩) থেকে হুবহু আরবী ইবারত তুলে ধরছি। যেমন عن ابى حنيفة قال : ما رأيت احدا اكذب من جابر الجعفى. অর্থাৎ ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, আমি জাবের ইবনে ইয়াজিদ আল জা’ফি এর চাইতে বড় মিথ্যাবাদী দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম লাইছ ইবনু আবি সুলাইম (রহ.) বলেছেন فانه كذاب অর্থাৎ নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি বহুত বড় মিথ্যাবাদী।

এবার তাহলে নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করুন, যে বর্ণনার মধ্যে দুইজন রাবীই মিথ্যাবাদী এবং জাল হাদীস তৈরীকারী হিসেবে অভিযুক্ত ও মুনকারুল হাদীসও সেটির কথাগুলো ইমাম বাকের-এরই ছিল বলে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?

প্রশ্নকর্তা : তা বুঝলাম, কিন্তু মির্যা সাহেবের ইমাম মাহদী দাবীকালে এই ধরণের ঘটনা ঘটলো কেন? এটা চিন্তার বিষয় নয় কি?

উত্তরদাতা : চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটা নিয়ে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, যেখানে এটি আল্লাহর অন্যান্য প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মতই! হ্যাঁ, যদি এটি প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মত না হত আর ইতিপূর্বে এইধরণের ঘটনা অসংখ্যবার না ঘটত! এখন এইধরণের ঘটনা ইতিপূর্বে অসংখ্যবার ঘটে যাওয়ায় বলার আর অপেক্ষা রাখেনা যে, মাহদীয়তের নির্দশ হিসেবে এর মধ্যে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যই বাকি থাকেনি।

প্রশ্নকর্তা : আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, চন্দ্রসূর্যগ্রহণের এই অলৌকিক ঘটনাটি বিশেষ কোনো নিদর্শন নয়, ইতিপূর্বেও সময় সময় এটি দৃশ্যমান ছিল? এর সমর্থনে আপনার নিকট কী প্রমাণ আছে?

উত্তরদাতা : জ্বী, ইতিপূর্বেও এটি বহুবার সাধারণ নিয়মেই দৃশ্যমান হয়েছিল। আর এটি আমার নিজের কোনো বক্তব্য নয়। এর পক্ষে ইতিহাস বড় সাক্ষী। আপনাদের ঢাকা বকশিবাজার থেকে প্রকাশিত ‘পাক্ষিক আহমদী’ (পৃ-২৪, তাং ১৫-এপ্রিল-২০১৫ইং) পড়ে দেখুন, আপনারাও এটি স্বীকার করে লিখেছেন এভাবে যে, ‘হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগের প্রফেসর জি. এম. বল্লভ ও আমি (মির্যায়ী লিখক) যে হিসাব কষেছি তাতে দেখা গেছে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ থেকে এ পর্যন্ত একই রমযান মাসে চন্দ্রসূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়েছে মোট ১০৯ বার। এর মধ্যে তিনবার দুটি গ্রহণই নির্ধারিত তারিখে অর্থাৎ ১৩ ও ২৮ রমযানে কাদিয়ান থেকে দৃশ্যমান ছিল।’

বলে রাখা জরুরী, মির্যায়ী লিখক এখানে ’কাদিয়ান থেকে দৃশ্যমান ছিল’ দাবী করলেও আমেরিকা মহাকাশ গবেষণা বিভাগ ‘নাসা’ তার এই দাবী প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ নাসা-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ১৮৯৪ সালের ৬ই এপ্রিলে সংঘটিত গ্রহণের মানচিত্রে (বেগুনি রঙ্গের একটি অঙ্কিত রেখা দ্বারা) উক্ত গ্রহণের কক্ষপথ দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, সেটি বাংলাদেশ আর বেঙ্গালুরু-এর উপর দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে চলে যায়। এই গ্রহণ এশিয়ার নানা দেশসহ ভারতেরও কয়েকটি স্থান থেকে দৃশ্যমান হলেও কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাঞ্জাব থেকে দেখা যায়নি। এখন প্রশ্ন হল, ‘কাদিয়ান’ কি ভারতের পাঞ্জাবের বাহিরে না ভেতরে?

নাসা

এখানে মজার বিষয় হল, নাসা-এর বিজ্ঞানীদের ওয়েবসাইটটিতে পরিষ্কার করে এও লিখা আছে, এই ধরণের চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা আজ অব্ধি প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক বার ঘটেছিল। আপনি কি এরপরেও এটিকে প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মতই মানতে অস্বীকার করবেন?

প্রশ্নকর্তা : আপনি কি আর কোনো মাহদী দাবীদারের সময়ও এই ধরণের চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল বলে প্রমাণ করতে পারবেন?

উত্তরদাতা : জ্বী, পারব। আপনি কি মরক্কো বংশোদ্ভূত সালেহ বিন তারিফ-এর নাম শুনেছেন? তিনি নিজেকে ৭৪৪ সালে নবী দাবী করেন। তিনি ৭৯১ সাল পর্যন্ত মরক্কোর ‘বারঘৌতা বারবার’ রাজ্যের একজন শাসক ছিলেন। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদীও দাবী করেছিলেন। তিনি যে বছর ইমাম মাহদী দাবী করেন তার পরের বছর অর্থাৎ ১২৬ হিজরী মুতাবিক ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে একই রমাযানের ১৩ এবং ২৮ তারিখে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের ঘটনাও ঘটেছিল। আর এই ঘটনা তার সময় চারবার ঘটেছিল যথাক্রমে ৭৪৪, ৭৪৫, ৭৮৭ এবং ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে। তার প্রতিষ্ঠিত ঐ জামাতের নাম ছিল ‘সালেহুল মুমিনীন’। তার মৃত্যুর পরেও তার এই জামাত প্রায় সাড়ে তিন’শ বছর পর্যন্ত আফ্রিকায় খুব দাপটের সাথে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। পরবর্তীতে ১০ম শতকের শেষের দিকে আল মুরাবিত রাজ-বংশের মুসলিম বীর সিপাহসালার ইউসুফ বিন তাসফিন এর নেতৃত্বে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে সালেহ বিন তারিফের রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ঐ মিথ্যা দলটিরও বিলুপ্তি ঘটে।

প্রশ্নকর্তা : কিন্তু মির্যা সাহেব তো ১৮৯৪ সালের দিকে শুধুই ইমাম মাহদী দাবীদারই ছিলেন, তিনি নবী দাবী করেননি? অথচ সালেহ বিন তারিফ তো নবী দাবীও করেছিল?

উত্তরদাতা : তাহলে ‘বাবী জামাত’ এর প্রতিষ্ঠাতা ইরানের আলী মুহাম্মদ বাব সম্পর্কে কী বলবেন? সে ইমাম মাহদী দাবী করেছিল ১৮৪৪ সালে। একই রমাযানে চন্দ্রসূর্য গ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল ১৮৫১ সালে। তিনি কিন্তু শুধু ইমাম মাহদী দাবীই করেছিলেন। বর্তমানেও তার বহু অনুসারী (প্রায় ৪ মিলিয়ন, উইকিপিডিয়া) পৃথিবীতে রয়েছে। প্রায় ২১৮টি রাষ্ট্রে তার অনুসারীদের অবস্থান রয়েছে। যাইহোক, মির্যা সাহেবের জন্য একটি দুঃসংবাদ আছে, বলব?
: বলুন!
: মির্যা কাদিয়ানী ঐ চন্দ্রসূর্যগ্রহণ সংক্রান্ত বর্ণনাটির মর্মার্থ বুঝাতে গিয়ে নিজ কিতাবে লিখে গেছেন, ‘বরং হাদীসের উদ্দেশ্য হল, কোনো নবুওয়ত বা রেসালত দাবীদারের সময়টিতে কখনো এই দুইটি গ্রহণ একত্রিত হবেনা।’ (রূহানী খাযায়েন ২২/২০৩)। মির্যা সাহেব এই কথা বলে মূলত সে সমস্ত মাহদী দাবীদারের বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঠাতে চাচ্ছেন যারা মাহদী দাবীর সময় নবুওয়ত ও রেসালতের দাবী করেনি, যদিও চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনাও ঘটেছিল! হায়! মানুষ কতটা ধূর্ত হলে এইরূপ উদ্ভট ব্যাখ্যাও দিয়ে যেতে পারে! যাইহোক, এখন আমার প্রশ্ন হল, মির্যা সাহেব ১৮৯৪ বা ১৮৯৫ সালে চন্দ্র সূর্যগ্রণের সময়ও নবুওয়ত বা রেসালতের দাবিদার ছিলেন না, যা আপনিও জানেন বরং তিনি ১৮৯৭ সালের দিকেও নবুওয়ত দাবিদারের প্রতি লানত (অভিশাপ) বর্ষণ করেছেন। (দেখুন মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ২/২৯৭-২৯৮ ও ২/২)।

এমতাবস্থায় ঐ দুই মিথ্যুকের বর্ণনাকে সহীহ মেনে নেয়া হলেও এর মাধ্যমে মির্যা কাদিয়ানীকে কীভাবে ইমাম মাহদী সাব্যস্ত করবেন? অথচ মির্যা কাদিয়ানীর উক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে আপনি ‘সালেহ বিন তারিফ’-কেই ইমাম মাহদী মানতে বাধ্য। কারণ সে একই সময় ইমাম মাহদী এবং নবী দুটোরই দাবীদার ছিল!

আচ্ছা! আপনি কি জানেন আপনাদের মির্যা কাদিয়ানী সাহেব পরিষ্কার ভাষায় লিখে গেছেন যে, তার একনিষ্ঠ অনুসারীরা যে কোনো মতভেদপূর্ণ বিষয়ের সমাধান যেন তার কাছ থেকেই নেয়? (দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৭/৬৪)। অন্তত এ দিক থেকেও আপনাদের জন্য বৈধ হবেনা ঐ দুই মিথ্যুকের বর্ণিত রেওয়ায়েতকে মাহদীয়তের কথিত নিদর্শন মনে করা। কারণ মির্যা সাহেব এও লিখে গেছেন ‘ইমাম বুখারীর কৃত শর্তের বিপরীত যে হাদীস সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।’ (দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৭/১১৯-২০)। এখন এর কী উত্তর দেবেন?

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

সহীহ হাদীসের আলোকে দাজ্জাল এর প্রকৃত পরিচয়

মসীহ দাজ্জাল এর প্রকৃত পরিচয় :

পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে রূপ দেয়ার ঘটনা কম ঘটেনি। ‘দাজ্জাল’ তন্মধ্যে অন্যতম। গভীর অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা গেছে তার সিংহভাগই রাজনৈতিক কিবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশ্যেই ছিল। অথচ ‘দাজ্জাল’ এর পরিচয় সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী (সা:) থেকে সহীহ সনদে আমাদের নিকট যেসমস্ত বর্ণনা পেীঁছেছে তা খতিয়ে দেখলে বুঝা যায় :

১. দাজ্জাল একজন মানবাকৃতির হবে। কারণ হাদীসে ‘রাজুলুন জাসিমুন আহমারু’ (رجل جسيم احمر) শব্দ আসছে। যার অর্থ লালচে বর্ণের ও স্থূলদেহের এক ব্যক্তি। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। সুতরাং কোনো সভ্যতা কিংবা কোনো মিশনারী গোষ্ঠীকে হাদীসে বর্ণিত সেই ‘দাজ্জাল’ ব্যাখ্যা দেয়া ভুল এবং সুস্পষ্ট হাদীস বিকৃতির শামিল। যেহেতু সভ্যতাকে যেমন মানুষ বলা যায় না, তেমনি দলবদ্ধ কোনো মিশনারীও একব্যক্তি হয় না।

২. দাজ্জালের চুল হবে কোঁকড়ানো। তার উভয় চোখই ক্রুটিযুক্ত থাকবে। তার যে চোখটি কানা থাকবে সেটি দেখতে ফোলা আঙ্গুরের ন্যায় দেখাবে। (সূত্র ঐ)। আর তার ডান চোখটি সম্পূর্ণ নষ্ট থাকবে। (সূত্র ফাতহুল বারী ১৩/৯৭; ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী)। এভাবে অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় রাসূল (সা:) যেই ‘দাজ্জাল’ এর ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে গেছেন সেটিকে কাদিয়ানী, হেযবুত তওহীদসহ কতিপয় নির্বোধ সম্প্রদায় নানা প্রকারের রঙ চড়িয়ে নানা কল্পনা করে যেই কাল্পনিক অ-মানবীয়রূপে চিত্রিত করে থাকে সেটি পুরোপুরি বাতিল, সত্যের সাথে লেশমাত্র সম্পর্কও নেই।

  • বলাইবাহুল্য এসবই আজগুবি কল্পনা, সত্যের সঙ্গে এগুলোর কোনোই সম্পর্ক নেই। তাদের সেসব কল্পিত-নির্ভর অ-মানবীয় ও রূপক ব্যাখ্যার সমর্থনে কোনো প্রমাণ না আছে কুরআনে, না আছে সহীহ কোনো হাদীসে। অদ্যাবধি কেউ দেখাতে পারেনি, পারবেও না। কথাটা আমি জেনেশুনেই বলছি। এই পর্যায়ে বেশি না আমি তাদের উদ্দেশ্যে বেশকিছু হাদীসের খন্ডিত উদ্ধৃতি পেশ করব। যদি হাদীসে বর্ণিত ‘দাজ্জাল’ তাদের বিচারে রূপক কিবা অ-মানবীয় কিছু হয়ে থাকে তখন তারা নিচের প্রশ্নগুলোর কী ব্যাখ্যা দেবে? যেমন,

(ক) দাজ্জাল সম্পর্কে হাদীসে ‘রাজুল’ (Man) শব্দ আসছে। রাজুল অর্থ মানুষ বা ব্যক্তি। রাসূল (সা:) তাকে তৎকালীন আব্দুল উজ্জাহ ইবনে কাতান নামক জনৈক ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। এখন দাজ্জাল মানবাকৃতির না হলে রাসূল (সা:) তাকে অন্য আরেকজন মানবের সাথে কিজন্য সাদৃশ্য থাকার সংবাদ দিলেন?

(খ) দাজ্জালের চুল কোঁকড়ানো হবে উল্লেখ আছে। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। এখন এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?

(গ) দাজ্জাল আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীতে ধারাবাহিক তিন বছর খরা ও দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং ২৭৫৬৮)। এখন কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন আসে মির্যা কাদিয়ানীর সময় কি এধরণের ঘটনা ঘটেছিল?

(ঘ) রাসূল (সা:) বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকতেই যদি দাজ্জাল আগমন করে তাহলে ….। (তিরমিজী কিতাবুল ফিতান)। এতে বুঝা গেল, তখনো পর্যন্ত দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হয়নি। বড়জোর দাজ্জালকে আবিস্কার করা হয়েছিল মাত্র। সে হিসেবে আধুনিক গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন দাজ্জাল বারমুডা ট্রায়েঙ্গেলে থাকতে পারে। কারো কারো মতে জাপানের ড্রাগন ট্রায়েঙ্গেল (Triagle) বা ডেভিল সী-তে থাকতে পারে। তবে এগুলো নিছক কারো কারো গবেষণাধর্মী বক্তব্য, যার সমর্থনে ইসলামের অথেনটিক সোর্সগুলো নিরব।

(ঙ) হযরত তামীম আদ-দারী (রা:) তার কাফেলাসহ দাজ্জালকে মদীনার পূর্বদিকের এক অজানা দ্বীপে সচক্ষে শিকলাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করতে দেখেছেন। রাসূল (সা:) তাঁর এই তথ্য নাকচও করেননি, সহমত-ও ব্যক্ত করেননি। (সহীহ মুসলিম কিতাবুল ফিতান হাদীস নং ২৯৪২)। এটি তামীম আদ-দারী (রা:)-এর হয়ত স্বপ্নের বর্ণনা! যার উপর না সাহাবাদের ইজমা হয়েছিল আর না সালাফদের ইজমা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, কিছুই না। সুতরাং ইজমার বিপরীতে বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনাপূর্ণ বর্ণনার উপর দাজ্জালের কনসেপ্ট দাঁড় করতে চাওয়া দুষ্টমি ছাড়া কিছুই না।

(চ) তামীম আদ-দারীর বর্ণনামতে, দাজ্জাল যথাসময় আল্লাহতালার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে পৃথিবীর প্রাচ্যে অবস্থিত পারস্য অঞ্চল খোরাসানের ইস্পাহান শহরের ‘ইয়াহুদিয়া’ এলাকা থেকে আসলরূপে আত্মপ্রকাশ করবে বলে উল্লেখ রয়েছে। (তিরমিজী কিতাবুল ফিতান)। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) লিখেছেন, দাজ্জাল তার আসলরূপে আত্মপ্রকাশের পূর্বে ‘নবী’ দাবী করবে। তারপর ‘খোদা’ দাবী করবে। তখনি সে আসলরূপে আত্মপ্রকাশ হয়ে দুনিয়াব্যাপী ফেতনা ছড়াবে। (ফাতহুল বারী, কিতাবুল ফিতান)। তাই প্রশ্ন আসে আধুনিক যান্ত্রীক সভ্যতা বা খ্রিস্টান মিশনারীরা কবে কিভাবে নবী আর খোদা দাবী করলো, বলবেন কি?

(ছ) দাজ্জাল মদীনার অদূরে এক পাশ্বে এসে পৌঁছবে। এই সময় মদীনা তিনবার কেঁপে উঠবে। তখন মদীনায় অবস্থানকারী সকল কাফের মুনাফিক বেরিয়ে পড়বে এবং দাজ্জালের সাথে মিলিত হবে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৪)। এখন এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?

(জ) দাজ্জাল পৃথিবীতে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। তখন প্রথম দিনটি এক বছর সমান দীর্ঘ হবে। রাসূল (সা:) সেই দীর্ঘ সময়টিতে সময়ের অনুমান করে নামায পড়তে বলেছেন। (সহীহ মুসলিম কিতাবুল ফিতান)। এখন প্রশ্ন হল, কল্পনাবীদদের রূপক দাজ্জাল কি পৃথিবীতে শুধুই চল্লিশ দিন অবস্থান করছে?

(ঝ) দাজ্জাল মদীনার অদূরে এক যুবককে হত্যা করার পর পুনরায় জীবিত করে আবার যখন হত্যা করতে চাইবে তখন সে আর হত্যা করতে সক্ষম হবেনা। (সহীহ বুখারী কিতাবুল ফিতান)। কল্পনাবীদদের দাজ্জাল কবে কাকে হত্যার পর পুনরায় জীবিত করল, বলবেন কি?

লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এর পরিচয়

  • মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী :

নাম, গোলাম আহমদ। পিতা, গোলাম মর্তুজা আর মাতা, চেরাগবিবি। তিনি মোঘল সম্রাট তৈমুর লং এর বংশধর। [আহমদ চরিত পৃ-১; মূল লিখক, মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ]। তার আরেক পূর্ব পুরুষ ছিল মোঘল বরলাস। জন্মস্থান ভারতের পাঞ্জাবের কাদিয়ান নামক গ্রাম। জন্মগ্রহণ ১৮৩৯ সালে মতান্তরে ১৮৩৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি। তিনি বহুমুত্র রুগী ছিলেন। পরিণত বয়সে মিরাক [সিজোফ্রেনিয়া], হিস্টিরিয়া [মূর্ছারোগ] এবং মালিখোলিয়া (উম্মাদনা) রোগেও আক্রান্ত ছিলেন (সীরাতে মাহদী ১/১৪-১৬; বর্ণনা নং ১৯ নতুন এডিশন)। আনুমানিক ১৮৬৪ সালের দিকে পিতা গোলাম মর্তুজার পেনশনের সাতশত রুপি উত্তোলন করে সঙ্গীসহ উধাও হন এবং তা মাত্র তিনদিনের মধ্যেই উড়িয়ে দেন। অতপর চোখ-লজ্জায় বাড়ি না ফিরে চলে যান পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট জেলায় (সীরাতে মাহদী ১/৩৮; বর্ণনা নং ৪৯ নতুন এডিশন)। সেখানে তিনি এক ইংরেজ ডেপুটি কমিশনারের অফিসে চার বছরব্যাপী (১৮৬৪-৬৮) কেরানীর চাকুরী করেন।

সে সময় খ্রিস্টান মিশনারিদের অন্যতম ও ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স মিশনের ইনচার্জ অফিসার Mr. Reverend Butler (১৮১৯-৬৯) এর সাথে তার খুব সখ্যতা গড়ে উঠে [সীরাতে মসীহে মওউদ পৃ. ১৫; মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ]। তারই কিছুদিনের মধ্যে তিনি রহস্যজনকভাবে চাকুরী ছেড়ে নিজ এলাকায় ফিরে যান এবং নিজেকে প্রথমাবস্থায় ‘ইসলামের সেবক’ বলে প্রচার করা শুরু করেন। তখন ১৮৬৮ সাল। তিনি সেই বছরই নিজেকে প্রথমে ‘মুলহাম’ [আল্লাহর পক্ষ হতে অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত] হবার দাবী করেন। ১৮৮২ সালে মুজাদ্দিদ দাবী করেন। ১৮৯১ সালে রূপক ঈসা দাবী করেন। ১৮৯৩ সালে ঈসা ইবনে মরিয়ম দাবী করেন। একই বছর নিজেকে একজন জিল্লি বুরুজি নবীও দাবী করেন। তিনি ঠিক সেই বছরই ‘জিহাদ’ হারাম বলে দেশব্যাপী জোর আওয়াজ তুলেন।

১৮৫৭ সালে মুসলমানরা সর্বশক্তি দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করায় ইংরেজরা ক্ষমতা হারানোর উপক্রম হয়েছিল। তাই জিহাদ হারাম ঘোষণা দিয়ে তিনি এক দিকে যেমন মিস্টার রিভার্ন্ড বাটলারের পরামর্শে ইংরেজদের গদি রক্ষায় নেমে পড়লেন অপরদিকে নিজে ঈসা (আ:) হওয়ার দাবী করে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত আকীদার উপর উপর্যুপরি হামলা করতে লাগলেন। কেননা জিহাদকে বন্ধ করার জন্য তার পক্ষে তখন নিজেকে ঈসা দাবী করা ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো উপায় ছিলনা। তাই প্রথমেই তিনি যে কাজটি করলেন সেটি ছিল, ঈসাকে মৃত প্রমাণ করা। এতে ব্রিটিশরাও তার উপর ছিল ভীষণ খুশি। কারণ, অন্তত জিহাদটা যদি বন্ধ করা যায় তবে গদিটা রক্ষা পাবে! কথায় আছেনা, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা! নানা নমুনায় তার প্রমাণও মিলে। জেনে অবাক হবেন, মির্যা সাহেব ১৮৯৮ সালের দিকে কোনো এক প্রেক্ষিতে তৎকালীন ভারত সম্রাজ্ঞী বৃটিশ রাণী আলেকজান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়াকে সম্বোধন করে পত্র লিখেছিলেন:

[১] ‘নিজেদের হাতে রোপিত এই চারাগাছটির ব্যাপারে খুব সতর্কতা ও অনুসন্ধানের সাথে অগ্রসর হবেন এবং আপনার অধীনস্তদের বলবেন তারা যেন এই পরিবারের ত্যাগ ও নিষ্ঠার কথা মনে করে আমার দলের প্রতি সদয় দৃষ্টি জ্ঞাপন করেন। আমাদের পরিবার ইংরেজ সরকারের কল্যাণে নিজেদের খুন বইয়ে দিতে ও জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি আর না এখনো দ্বিধা করছে।’ (মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ৩/২১-২২; নতুন এডিশন)।

[২] তিনি এও লিখেছেন : আমার বিশ্বাস, যে হারে প্রতিদিন আমার অনুসারির সংখ্যা বাড়ছে সেই হারে জিহাদের পক্ষাবলম্বীর সংখ্যাও কমছে। (মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ৩/১৯)।

[৩] তিনি এও লিখে গেছেন, ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য ইসলামেরই একটি অংশ (রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০)। যাইহোক ২৫ শে মে ১৮৯৩ সালে অমৃতসর নামক স্থানে তার সাথে শায়খ আব্দুলহক গজনভী সাহেবের মুবাহালা হয় (রূহানী খাযায়েন ৬/৩৭২)। উভয়পক্ষ নিজের উপর নিজে বদ দোয়া করেন এবং মুবাহালাকারী দুইপক্ষের সত্যবাদীর জীবদ্দশায় যেই মিথ্যাবাদী তার ধ্বংস কামনাও করেন (মালফূজাত ৫/৩২৭; চতুর্থ এডিশন)।

ইতিহাস সাক্ষী, শায়খ গজনভী মারা যান ১৬ই মে ১৯১৭ সালে। অপরদিকে মির্যা কাদিয়ানী শায়খের জীবদ্দশায় প্রায় ৯ বছর পূর্বেই ১৯০৮ সালে ২৬ শে মে বুধবার সকাল সাড়ে দশটায় কলেরায় মারা যান। তাই দৃঢ়ভাবে বলা যায় মির্যা কাদিয়ানী মুবাহালায় আপনা বদ-দোয়ার মাধ্যমেও অভিশপ্ত ও মিথ্যুক প্রমাণিত হন। সংক্ষেপে।

প্রকৃত ইমাম মাহদীর পরিচয়

  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

হযরত ইমাম মাহদী এর পরিচয়

কাদিয়ানীদের ইসলাম বিরুধী ১৬টি চেপে রাখা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জানুন Click

বিখ্যাত আরবি অভিধান গ্রন্থ ‘লিসানুল আরব‘ এর উদ্ধৃতিতে “আল-আমালী” এর ৫৬ নং পৃষ্ঠায় ইমাম মাহদীর বংশ পরিচয় ও অন্যান্য

মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মাহদী এর পরিচয় জেনে নিন!

হযরত ইমাম মাহদীর নাম হবে মুহাম্মদ এবং পিতার নাম হবে, আব্দুল্লাহ [আবুদাউদ, কিতাবুল মাহদী হা/৪২৮২]। উপাধি, আল-মাহ্দী তথা হিদায়াতপ্রাপ্ত।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ:) তাঁর কিতাবে ইমাম মাহদীর নামের শেষে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’ লিখেছেন (মাকতুবাত ৪/৫৮৭; দপ্তরে আউয়াল, উর্দূ)। স্কিনশট দেখুন : Click

তিনি নবী পরিবার থেকে ও হযরত ফাতেমা (রা:) এর সন্তান হযরত হাসানের বংশে জন্মগ্রহণ করবেন (আবুদাউদ হা/৪২৮৪)। মাতার দিক থেকে হযরত হাসান এবং হযরত আব্বাস উভয়ের বংশধর হবেন। কেননা হযরত হাসানের সাথে হযরত আব্বাসের পুত্র আল-ফজলের মেয়ে উম্মে কুলছুমের বিয়ে হয়। তাদের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ আল-আসগর, জাফর, হামজা এবং ফাতেমা (দেখুন তবক্বাতে ইবনে সা’আদ ৬/৩৫২)। স্ক্রিনশট

তবক্বাতে ইবনে সা’আদ

তিনি কুরাইশী হবেন (আবুদাউদ, মাহদী অধ্যায় হা/৪২৭৯)। জনৈক খলিফার মৃত্যুর পর মতানৈক্য সৃষ্টি হলে তিনি মদীনা হতে মক্কায় চলে যাবেন। তিনি আগ বাড়িয়ে নিজেকে ইমাম মাহদী দাবী করবেন না। হাদীসে এই দিকে ইংগিত করতেই و هو كاره [তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে] শব্দ উল্লেখ আছে। সেই সময় মক্কাবাসীরা তাঁকে সনাক্ত করবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা তাঁর হাতে মক্কায় রুকন আর মাকামে ইবরাহিমের মাঝখানে বাইয়াতগ্রহণ করবেন (আবুদাউদ, মাহদী অধ্যায় হা/৪২৮৬)। বাইয়াত গ্রহণকরার পর তিনি গোরাসান অতপর শাম—’র অভিমুখে রণসাজে রওয়ানা হবেন। তিনি আরবে সাত বছর রাজ্যত্ব করবেন (আবুদাউদ, মাহদী অধ্যায় হা/৪২৮২)। তাঁর শাসনামলে সারা দুনিয়া ন্যায় ও ইনসাফ দ্বারা ভরে যাবে। সবশেষে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস এসে অবস্থান নেবেন এবং হযরত ঈসা (আ:)-এর অপেক্ষায় থাকবেন। দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে বায়তুল মোকাদ্দাসে (لأن بيت المقدس شرقى دمشق মেরকাত শরীফ, কিতাবুল ফিতান) ঈসা (আ:) এর অবতরণের পর তথায় ইমাম মাহদীর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে। তিনি একজন উম্মতি হিসেবে প্রথম সালাত ইমাম মাহদীর পেছনে বায়তুল মোকাদ্দাসে আদায় করবেন। তিনি মোট ৭ মতান্তরে ৯ বছর বেঁচে থাকবেন তারপর ইন্তেকাল করবেন (আবুদাউদ, মাহদী অধ্যায় হা/৪২৮৬; উম্মে সালমা হতে)। হযরত হাসান (রা:) যেরূপ খিলাফতের দায়িত্বভার হযরত মু’আবিয়া (রা:)-এর হাতে ন্যস্ত করেছিলেন অনুরূপ তিনিও ঈসা (আ:)-এর নিকট খিলাফত ন্যস্ত করবেন। সংক্ষেপে।

ইমাম মাহদী সম্পর্কিত সনদ সহ (আরবী ইবারত সমেত) ৭টি সহীহ হাদীস ও হাদীসগুলোর মান সহকারে এখান থেকে দেখুন। ক্লিক করুন

  • শায়খ আহমদুল্লাহ (হাফিজাহুল্লাহ) এর ভিডিওটি শুনুন : Click
  • আরো পড়ুন: একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ এর ঘটনা নিয়ে কাদিয়ানীদের বাড়াবাড়ি। ক্লিক করুন।
  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) এর পরিচয়

হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের পরিচয়

তিনি (অর্থাৎ হযরত ঈসা আলাইহিস-সালাম) বনী ইসরাইলের প্রতি প্রেরিত একজন রাসূল ছিলেন, رسولا الى بنى اسرائيل (কুরআন ০৩:৪৯)। পুরো নাম আল-মসীহ ঈসা ইবনে মরিয়ম (কুরআন ০৩:৪৫)। ৩৩ খ্রিস্টপূর্ব ফিলিস্তিনের বেথেলহাম শহরে সতীসাধ্বী রমনী বিবি মরিয়মের উদরে পিতা ছাড়াই জন্ম নেন (কুরআন ০৩:৪৭)। নবুওয়ত লাভ করেন সাড়ে ৩২ বছর বয়সে। মাত্র তিন মাস নবুওয়তের দায়িত্ব পালন করেন [আত-তবকাতুল কোবরা ১/৩৫, ইবনে সা’আদ]। তিনি ইঞ্জিল কিতাব লাভ করেন। যা বর্তমানে রহিত। (কুরআন ০৩:৮৫)।

ইহুদীরা যখন উনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল [কুরআন ০৩:৫৪] এবং পাকড়াও করতে তাঁকে ঘিরে সবাই সমবেত হল [لما اجتمع اليهود على عيسى عليه السلام] ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী মহান আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে রফা করেন অর্থাৎ উঠিয়ে নেন (কুরআন ০৪:১৫৮)। তিনি জিবরাইল (আ:)-এর মাধ্যমে তাঁকে এইভাবেই সাহায্য করেন এবং তাঁর কাছে উঠিয়ে নিতে নির্দেশ করেন [কুরআন ০৫:১১০; তারীখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৭২]।

তারীখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৭২

আল্লাহতালা সেই মুহুর্তে তাঁর শিষ্যদের একজনকে তাঁরই সাদৃশ করে দেন। [কুরআন ০৪:১৫৭; তাফসীরে জালালাইন, তাবারী ৮/৩৭৪, হা/১০৭৮৯]। ফলে ইহুদীরা তাকে ঈসা ভেবে হত্যা করে দাবী করল, নিশ্চয় আমরা মসীহকে হত্যা করেছি (কুরআন ০৪:১৫৭)। ইহুদীরা ঈসার সাদৃশ একব্যক্তিকে ধরে নিয়ে হত্যা করে অত:পর শূলে চড়িয়ে রাখে [فأخذوا الشبه فقتلوه ثم صلبوه /ফা-আখাযুশ শিবহা ফা-ক্বাতালূহু ছুম্মা ছালাবূহু]। এই হাদীস ইবনে আব্বাস (রা:) হতে সহীহ মুসলিম-এর কৃত শর্তে সনদ দ্বারা বর্ণিত। [ইমাম ইবনে কাসীর রচিত, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ভলিউম ২]।

পবিত্র কুরআন এও বলেছে, ইহুদীরা তাঁর নাগাল পেতেও ব্যর্থ হয় [অর্থাৎ তারা ঈসাকে পাকড়াও করতে পারেনি]। যেমন আল্লাহ বলেন, ওয়া ইয কাফাফতু বানী ইসরাঈলা আনকা… (কুরআন ০৫:১১০)। অর্থ : যখন আমি বনী ইসরাইলকে তোমা হতে নিবৃত্ত রেখেছিলাম…। ইমাম সুয়ূতী (রহ:) লিখেছেন, এটি তখনকার ঘটনা যখন বনী ইসরাইল তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল (তাফসীরে জালালাইন)। সুতরাং কাদিয়ানীদের আকীদা, ঈসাকে শূলে তুলা হয়েছিল, এটি কুরআন বিরোধী ও কুফুরী আকীদা।

আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই ঈসা কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন (কুরআন ৪৩:৬১)। শেষযুগে তাঁর দ্বিতীয়বার আগমন ঘটবে। কেননা তিনি প্রৌঢ়বয়সে উপনীত হবেন, এই কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন (কুরআন ০৩:৪৬)।

  • মুসলিম শরীফের কিতাবুল ঈমান অংশে ‘ফা আম্মাকুম’ (فامكم) রয়েছে। তার পরের হাদীসে ‘ফা আম্মাকুম’ এর পরে এও রয়েছে ‘বি কিতাবি রাব্বিকুম ওয়া সুন্নাতি নাবিয়্যিকুম’ (بكتاب ربكم و سنة نبيكم) অর্থাৎ তিনি একজন শাসক হিসেবে কুরআন সুন্নাহ দ্বারা তোমাদের নেতৃত্ব (ইমামতে ছোগরা) প্রদান করবেন। (দেখুন হাদীস নং ২৪৬)। তিনি দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে [বায়তুল মোকাদ্দাস সীমানায় – মেরকাত ১০/১২০ কিতাবুল ফিতান] শ্বেত মিনারার নিকটে দুইজন ফেরেশতার দুই ডানায় আপনা দুই বাহু রেখে অবতরণ করবেন (মুসলিম, কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাতিশ সা’আহ)। ইমাম আবু বাকর আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বায়হাকী (মৃত. ৩৮৪ হিজরী) কর্তৃক সহীহ বুখারীর সমমানের সনদ সহ বর্ণিত সতন্ত্র একখানা হাদীসে উল্লেখ আছে [من السماء فيكم/মিনাছ ছামায়ি ফীকুম] অর্থাৎ ঈসা আকাশ থেকে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন। (রেফারেন্স, আল আসমা ওয়াস সিফাত ২/৩৩১; হাদীস নং ৮৯৫)।

তিনি দাজ্জালকে ‘লূদ’ [বায়তুল মোকাদ্দাস এর নিকটবর্তী একটি এলাকা- রূহানী খাযায়েন ৩/২০৯] নামক ফটকে [বর্শার আঘাতে] হত্যা করবেন (মুসলিম, কিতাবুল ফিতান)।

তিনি চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর দুনিয়ায় শরীয়তে মুহাম্মদিয়ার ভিত্তিতে রাজ্য পরিচালনা শেষে ইন্তেকাল করবেন (আবুদাউদ, কিতাবুল মালাহিম, হাদীসের মান, সহীহ)। মদীনায় মহানবী (সা:)-এর রাওজায় দাফন হবেন। সেখানে তাঁর কবরটি চতুর্থতম কবর হবে [فيكون قبره رابعا]। (দেখুন, আল মু’জামুল কাবীর ১৩/১৫৯। ইমাম তিরমীযি (রহ:) বলেছেন, হাদীসটির মান: ‘হাসান’। হাদীসটি অপরাপর আরো ৪টি সনদে বর্ণিত হয়েছে)।

তবে ‘কিতাবুল ওয়াফা’ এর একটি বর্ণনায় ‘ফী কবরী’ শব্দ এসেছে। ফলে রাসূল (সা:)-এর কবর খুঁড়ে ভেতরে দাফন করার কথা বুঝাল কিনা তা নিয়ে কাদিয়ানীদের ফালতু চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা বিশিষ্ট যুগ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) তার ব্যাখ্যায় ‘ফী মাক্ববারাতী’ [আমার গোরস্তানে] লিখে অনেক আগেই সমাধা দিয়ে গেছেন। (মেরকাত, কিতাবুল ফিতান ১০/১৬৬)।

ইমাম রাজী (রহ:) লিখেছেন, ‘ফী’ বর্ণটি অভিধানে ‘অতি নিকটে’ অর্থ বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন সূরা আন-নমল আয়াত নং ৮; মূসা (আ:) সম্পর্কে ان بورك من فى النار [অর্থাৎ বরকতময় হোক তিনি যিনি আগুনের মধ্যে আছেন…] উল্লেখ আছে। অথচ তূর পর্বতমালায় তখন মূসা আ. আগুনের অভ্যন্তরে ছিলেন না, বরং অতি নিকটে বা কোনো এক পাশেই ছিলেন (তাফসীরে কাবীর ২৪/১৮৩)।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) কর্তৃক স্বপ্নে দেখা তিনখানা চন্দ্রের [নবী, আবুবকর এবং উমর] ব্যাখ্যা হল, ওই তিনখানা চন্দ্র উনার জীবদ্দশায় হুজরাখানায় দাফন হবে। হযরত ঈসা (আ:)-কে উক্ত স্বপ্নে দেখতে না পাওয়ার কারণ উনার (আ:) দাফন হওয়ার ঘটনা উনার জীবদ্দশায় ঘটবে না। এখানে আরো বলে রাখা দরকার, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) হতেও বর্ণিত আছে যে, রাসূলের রাওজাতে আবুবকর, উমর এবং হযরত ঈসা দাফন হবেন। দেখুন ‘মসনাদে আহমদ’ ৬/৫৭। (সংক্ষেপে)।

সুতরাং কাদিয়ানী সম্প্রদায় ঈসা (আ:)-কে মৃত সাব্যস্ত করে মির্যা কাদিয়ানীকে কথিত রূপক ঈসা (মসীহ) সাব্যস্ত করতে যে সমস্ত অপব্যাখ্যা, মিথ্যা আর প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে তা সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রত্যাখ্যাত। ইসলামের মূলধারায় রূপক ঈসার কোনো কনসেপশন-ই নেই।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মওলানা কাসেম নানুতবী (রহ:) এর নামে মিথ্যাচারের জবাব

.

জনৈক বিদয়াতি নির্বোধ বক্তা ‘তাহযীরুন্নাস‘ (تحذير الناس) কিতাবের নামে ভুল আর বিকৃত উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, কাসেম নানুতবী সাহেব নাকি ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ অর্থ শেষনবী নয়, বলেছেন!

  • (এ সংক্রান্ত এ লিখাটিও পড়া যেতে পারে। এখানে ক্লিক করুন – https://markajomar.org/?p=6212)

উত্তর, তাহযীরুন্নাস কিতাবটি ফার্সি ভাষায়। অনেকে উর্দূ ভাষায়ও কনভার্ট করেছেন। আসুন তাহলে মাজলুম মওলানা সাহেবের কিতাবে এই বিষয়টি কিভাবে উল্লেখ আছে জেনে নিই। (আরও সংক্ষেপে ফেইসবুক থেকে পড়ুন)।

মওলানা নানুতবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মওলানা কাসেম নানুতুবী (১৮৩২-১৮৮০) ছিলেন উপমহাদেশের একজন মুসলিম পণ্ডিত। তিনি বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের নিকট নানুতা নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ শহরে তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি দেওবন্দ যান এবং মৌলভী মাহতাব আলীর মাদরাসায় শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি শাহারানপুর যান। সেখানে তার নানার সাথে অবস্থান করেন। শাহারানপুরে মৌলভী নওয়াজের তত্ত্বাবধানে তিনি আরবী ব্যাকরণ বিষয়ে প্রাথমিক গ্রন্থাদী পাঠ করেন। ১৮৪৩ সালের শেষের দিকে মামলুক আলী (রহ.) তাকে দিল্লি নিয়ে যান। সেখানে তিনি কাফিয়া ও বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি মাদরাসা গাজিউদ্দিন খানে ভর্তি হন। তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুলউলুম দেওবন্দ-এর প্রতিষ্ঠাতা।

মওলানা নানুতবী (রহ.) সাহেব লিখেছেন : اگر بالفرض آپ کے زمانہ میں بھی کہیں اور کوئی نبی ہو جب بھی آپ کا خاتم ہونا بدستور باقی رہتا ہے۔ অর্থাৎ “বিল-ফারজ তথা যদি ধরে নেয়া হয় যে, হুজুর (সা:)-র যামানায়ও কোথাও কেউ নবী হয়েছে তবুও হুজুর (সা:)-এর ‘খাতাম’ থাকা বরাবরই বহাল থাকবে।” (তাহযীরুন্নাস পৃ. ৩৮; হুজ্জাতুল ইসলাম একাডেমী ওয়াক্বফে দারুলউলুম দেওবন্দ, সাহারানপুর হতে প্রকাশিত)।

এতে বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে যে, মওলানা নানুতবী সাহেব (রহ.) বোধহয় বর্তমানেও নবী হবে অথবা নবী হওয়া সম্ভব বুঝাতে চেয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ সমালোচনাকারীদের জন্য দুঃসংবাদ হল, তিনি নিজ বইটির ৩৭ নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার এও লিখেছেন যে, اطلاق خاتم اس بات کو مقتضی ہے کہ تمام انبیاء علیہم السلام کا سلسلہ نبوت آپ پر ختم ہوتا ہے অর্থাৎ “খাতাম (خاتم)-এর প্রয়াগ এই কথারই দাবী রাখে যে, হুজুর (সা:)-এর উপরই সমস্ত নবীর নবুওয়তেরধারা শেষ হয়ে গেছে।” এবার মওলানা’র বিরুদ্ধে আরোপিত উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যামূলক উত্তর নিচে উল্লেখ করছি,

.

প্রথমত, তাঁর (মওলানা কাসেম নানুতবী) বক্তব্যের শুরুতেই ‘বিল-ফারজ’ (بالفرض) শব্দ উল্লেখ রয়েছে। যার তাৎপর্য হল- “যদি ধরে নেয়া হয়”। অর্থাৎ মওলানা’র কথাটি প্রকৃতার্থে ছিলনা, বরং ফারজী বা ‘যদি ধরে নেয়া হয়’ এরকম ছিল। পবিত্র কুরআনেও ফারজী অর্থে আল্লাহতালা বলেছেন, لو كان فيهما آلهة الا الله لفسدتا অর্থাৎ ‘যদি আসমান জমিনে আল্লাহ ছাড়াও কোনো ইলাহ থাকত তাহলে উভয়ই নিশ্চিত ধ্বংস হয়ে যেত।’ কিন্তু কোনো নির্বোধও এইজন্য একথা মনে করেনা যে, আল্লাহ ছাড়াও দ্বিতীয় কোনো ইলাহ বোধহয় থাকতে পারে!

দ্বিতীয়ত, উক্ত বক্তব্যটিতে বিদ্যমান ‘খাতাম’ (خاتم) শব্দটি মওলানা’র শুধুমাত্র ‘খাতামিয়তে মুরতাবী’ বিশ্লেষণের আলোকেই ছিল। যেহেতু তাঁর মতে খাতামিয়তে মাকানী, যামানী এবং মুরতাবী–সবদিক থেকে নবীজি (সা.) খাতামুন নাবিয়্যীন। তিনি যেন বুঝাতে চাচ্ছেন, মুহাম্মদ (সা.) শুধুই শেষনবী ছিলেননা।কারণ, শেষে হওয়ার মধ্যে মূলত স্বতন্ত্র কোনো ফজিলত থাকেনা। তাই মওলানা সাহেব ‘খাতাম’ শব্দের মর্মার্থকে ‘খাতামিয়তে যামানী’-এর সাথে খাস করাকে স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন সাধারণ মানুষদের ধারণা বলে আখ্যা দেন।

উল্লেখ্য, মওলানা নানুতবী সাহেব তার বক্তব্যে ‘খাতাম’ শব্দকে দার্শনিক উপায়ে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন মাত্র। ফলে নির্বোধ আর মাথামোটাদের নিকট তার বক্তব্যের উদ্দেশ্য বুঝা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। মূলত বিদয়াতীরা এ থেকেই ছিদ্র খুঁজতে শুরু করে। পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা ভুলে গিয়ে ইচ্ছেমতো অপপ্রচার শুরু করে।

যাইহোক, মওলানা’র উল্লিখিত বক্তব্যের তাৎপর্য দাঁড়াচ্ছে, ‘যদি ধরে নেয়া হয় যে, নবীজি (সা.)-র যামানায়ও কোথাও কেউ নবী হয়েছে তবু হুজুর (সা.)-এর ‘খাতাম’ (অর্থাৎ খাতামীয়তে মুরতাবী বা সর্বোচ্চ মর্যাদার শেষ মার্গে অধিষ্ঠিত থাকা) বরাবরই বহাল থাকবে।’

পাঠকবৃন্দ, এবার নিজেরাই চিন্তা করুন নির্বোধ মাথামোটারা কিভাবে মওলানার বক্তব্যকে নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করে দরাকে সরা বানিয়ে ফেললো! অথচ মওলানা নানুতবী এখানে ‘খাতাম‘ শব্দ থেকে ‘মুরতাবী‘ (مرتبى) অর্থই উদ্দেশ্য নিয়েছেন, ‘যামানী’ বা ‘মাকানী’ অর্থকে উদ্দেশ্য নেননি। যার ফলে তাদের উল্লিখিত আপত্তি ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যমূলক। অপ্রিয় হলেও সত্য, বিদয়াতীদের একটা অংশ (বিশেষত বেরেলিরা) মওলানার বিরুদ্ধে এই প্রপাগাণ্ডা মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলি থেকেই লুপে নিয়েছিল।

আল্লাহতালা এইধরনের মিথ্যাচারকারীদের সহীহ বুঝ দিন। নয়ত ধ্বংস করে দিন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক