প্রশ্ন :- পবিত্র কুরআন এবং সহীহ হাদীসের আলোকে প্রতিশ্রুত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর হায়াত শেষ যামানা পর্যন্ত বিলম্বিত হওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত কিনা?
উত্তর :- হ্যাঁ শেষ যামানা পর্যন্ত আল্লাহতালা ঈসা (আ:)-এর হায়াত বিলম্বিত করে দেয়া পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা ইংগিতে এবং হাদীস শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত আছে। পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ দেখুন। সূরা যুখরূফ এর ৫৯ আর ৬১ নং আয়াত দুটোর সমন্বিত মর্মার্থ নিয়ে একটু ভেবে দেখুন। আল্লাহ’র রহমতে আপনি সঠিক মাসয়ালায় পৌঁছে যাবেন, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতালা হযরত ঈসা (আ:)-এর হায়াত কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিলম্বিত করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবী রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে নিচের হাদীসটির অনুবাদ দেখুন!
রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন- “ওয়া মাদ্দা ফী উমরিহি হাত্তা আহবাতা মিনাস সামায়ী ইলাল আরদ্বি। ওয়া ইয়াক্বতুলুদ দাজ্জালা।” অর্থাৎ আল্লাহতালা তাঁর (ঈসা) হায়াত দীর্ঘ করে দিয়েছেন। এমনকি তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। (দেখুন, ইমাম জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী রহঃ রচিত ‘দুররে মানছূর’ খন্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ৩৫০)। ইবনে আব্বাস থেকে উক্ত হাদীসটি ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) পবিত্র কুরআনের – ইন তু’আয্যিবহুম ফা-ইন্নাহুম ইবাদুকা’ শীর্ষক আয়াতের তাফসীর অংশে উল্লেখ করেছেন।
মির্যা কাদিয়ানীর বাগাড়ম্বর ও তার খন্ডনঃ
প্রিয়পাঠক! এবার জানতে হবে, মির্যা কাদিয়ানী নিজের দাবীটি কিরকম শব্দচয়নে করে গেলেন? জ্ঞানীদের নিকট গোপন থাকেনি যে, মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীরা পবিত্র কুরআনের মধ্যে অপব্যাখ্যা দিয়ে দাবী করতে চায় যে, প্রতিশ্রুত ঈসা (আ:)-কে ইহুদীরা নাকি শূলিতে চড়িয়েছিল (নাউজুবিল্লা) এবং তিনি (শূলি থেকে অব্যাহতি পেয়ে) পরবর্তীতে গোপনে ফিলিস্তিন ছেড়ে কাশ্মীরে পালিয়ে যায়। সেখানেই তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করা শেষে ১২০ বছর বয়সে মারা যান। এছিল মির্যা কাদিয়ানির বক্তব্য। মা’আজাল্লাহ।
আমি কাদিয়ানিদের উক্ত দাবী কিছুক্ষণের জন্য তর্কের খাতিরে মেনে নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিতে চাই! তা হল, হযরত ঈসা (আ) বর্তমানে জীবিত না থাকলে পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে কেন তার পুনঃ আগমনের ভবিষৎবাণী এলো? আমি আরো জানতে চাই, পবিত্র কুরআন এবং সহীহ হাদীসে শেষ যুগে আগমনকারী সম্পর্কে “ইবনে মরিয়ম” উল্লেখ আছে। কোথাও “মাছীলে ইবনে মরিয়ম” তথা ‘ইবনে মরিয়মের অনুরূপ’ কারো আসার কথা নেই। এমতাবস্থায় মির্যা কাদিয়ানী কিজন্য প্রতিশ্রুত সেই মাসীহ ঈসা নামে সম্বোধিত হবেন? এ প্রশ্নগুলোর সমাধান কোথায়?
- এবার আপনি হয়ত জানতে চাচ্ছেন যে, হযরত ঈসা (আ)-এর পুনঃ আগমন সম্পর্কে ইঙ্গিত কোথায়?
তার জবাবে সংক্ষেপে মাত্র কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করছি। আল্লাহতালা ইরশাদ করেন – “তিনি (ঈসা) পরিণত বয়সেও মানুষের সাথে কথা বলবেন।” (সূরা আলে ইমরান ৪৮)।
“নিশ্চয় তিনি [ঈসা] কেয়ামতের একটি আলামত বা নিদর্শন (সূরা যুখরুফ ৬১)”।
এ আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) একদম খুলে খুলে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, “এর দ্বারা কেয়ামতের নিকটবর্তী সময় হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ)-এর আত্মপ্রকাশ কেয়ামতের-ই অন্যতম একটি আলামত।” বিস্তারিত দেখুন ইবনে কাসীর ৪র্থ খন্ডের ১৩৩ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৫৯ নং আয়াতটিও দেখুন। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে সকল ইহুদ খ্রিষ্টান তাঁর প্রতি ঈমান আনবে।
সূরা মায়েদার ১১০ নং আয়াতটিও দেখুন। ঈসা (আ)-কে আল্লাহতালা ইহুদীদের ধরপাকড় থেকে নিবৃত্ত রেখেছিলেন যখন তারা তাঁকে মেরে ফেলার ইচ্ছে করেছিল। অর্থাৎ ইহুদীরা তাঁকে পাকড়াও করবে তো দূরে থাক, তাদেরকে তাঁর কাছেও ভিড়তে দেননি।
সূরা আলে ইমরান ৫৫ নং আয়াতটিও দেখুন। আল্লাহ তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন। আরেকটু পেছনে সূরা আলে ইমরানের ৫৪ নং আয়াতে ফিরে যান। আল্লাহতালা ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের মুকাবেলায় নিজের অবস্থান জানান দিয়ে বলেন – ওয়ামাকারু ওয়ামা কারাল্লাহ ওয়াল্লাহু খাইরুল মাকিরীন অর্থাৎ “তারা চক্রান্ত করেছিল আর আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্রের মুকাবেলায় উত্তম কৌশলী।” এখন ভাবনার বিষয় যে, ইহুদিদের ষড়যন্ত্র যদি ঈসাকে পাকড়াও করে হাতে পায়ে পেরেগ বিদ্ধ করে প্রাণবধ করতে শূলিতে স্থাপনকরাই হয়, তখন এর বিপরীতে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ’র সুকৌশলী ব্যবস্থাটি কি ঈসাকে ইহুদীদের হাতে তুলে দেয়া? জ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলবে কিনা?
- মনে রাখতে হবে যে, পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা পবিত্র সহীহ হাদীস। এবার দীর্ঘ আলোচনার খোলাসা নিম্নোক্ত হাদীসগুলোর আলোকে বুঝে নিন! হাদীস শরীফে রাসূলেপাক (সা:) বলেছেনঃ
১- আল্লাহ’র শপথ অতি সত্বর নিশ্চয় ইবনে মরিয়ম একজন ন্যায় পরায়ণ শাসক হিসেবে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন (সহীহ বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া – ৩২৬৪)।
২- ইবনে মরিয়ম আকাশ থেকে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন। (ইমাম বায়হাক্বী সংকলিত ‘আল-আসমা ওয়াছ ছিফাত’ পৃষ্ঠা নং ৩৩১; হাদীস নং ৮৯৫)।
৩- সেই মুহূর্তে মরিয়ম পুত্র ঈসা তিনি দুজন ফেরেশতার পাখার উপর আপনা বাহুদ্বয় রেখে পৃথিবীতে নাযিল হবেন। (মুসলিম শরীফ ৫০১; কিতাবুল ফিতান অধ্যায়)।
৪- আমার ভাই ঈসা ইবনে মরিয়ম সিরিয়ার পূর্ব দিকে সাদা মিনারার নিকট আফিক নামক পর্বতের উপর আকাশ থেকে নাযিল হবেন। (কাঞ্জুল উম্মাল খন্ড নং ১৪ পৃষ্ঠা নং ৬১৯; হা/৩৯৭২৬, ইবনে আসাকীর)।
এবার কাদিয়ানিবন্ধুদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন হল, হযরত ঈসা (আ:) এর পুনরায় আগমন দ্বারা যদি আপনাদের মির্যা কাদিয়ানী-ই উদ্দেশ্য হন তাহলে বলুন তো মির্যা সাহেব ইতিপূর্বে দুনিয়াতে আরেকবার কখন কোথায় এসেছেছিলেন? কেননা “পুনঃ আগমন” (ঊর্দূভাষায় : দো-বারা) বলতে তো এটাই বুঝাবে যে, তিনি ইতিপূর্বে আরেকবার এসেছিলেন, তাই নয় কি?
আমার বুঝে আসেনা, এরকম একটি দিব্যি সত্যকে চেপে রাখতে আপনাদের মির্যা কাদিয়ানী কিজন্য যতসব মিথ্যা আর অহরহ বিদঘুটে অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন? অথচ বেশিদূর যেতে হবেনা শুধুমাত্র সূরা যুখরূফ এর ৬১ নং আয়াতের দুই লাইন উপরের আয়াতটির অনুবাদ দ্বারা সমাধান পাওয়া সম্ভব যে, শেষযুগে অত্যাসন্ন মাসীহ ঈসা হতে মাসীহে ইসরাইলি-ই উদ্দেশ্য। যেখানে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে ‘ওয়াজা’আলনাহু মাছালান লি-বানী ইসরাঈল। অর্থাৎ (আল্লাহতালা ইরশাদ করছেন) তাঁকে বনী ইসরাঈলের জন্য আমি (আমার কুদরতের) একটা আদর্শ বানিয়েছিলাম।” তার দুই লাইন পরেই কিন্তু উল্লেখ আছে, “নিশ্চয় সে (মরিয়মের পুত্র ঈসা) হবে (মূলত) কেয়ামতের একটি নিদর্শন।”
এবার আয়াত দুটির সমন্বিত মর্মার্থ দাঁড়াল এই যে, কেয়ামতের একটি নিদর্শন যেই ঈসা তিনি নিঃসন্দেহ সেই ব্যক্তি যাকে ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলের জন্যে খোদাতায়ালা তার কুদরতের একটি নিদর্শন বানিয়েছিলেন, তাই নয় কি? সুতরাং মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার মাসীহ দাবীর ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী এবং ভন্ড প্রমাণিত হল। আহমদীবন্ধুদের উচিৎ পবিত্র কুরানের এ সুস্পষ্ট মর্মবাণীর সাথে সহমত পোষণ করে মির্যা কাদিয়ানীকে ত্যাগ করে ইসলামে ফিরে আসা। আল্লাহতালা আমাদের সবাইকে সত্য বুঝে তা মেনে নেয়ার হিম্মত দান করুন। আমীন।
- লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক