Home Blog Page 36

হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) এর পরিচয়

হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের পরিচয়

তিনি (অর্থাৎ হযরত ঈসা আলাইহিস-সালাম) বনী ইসরাইলের প্রতি প্রেরিত একজন রাসূল ছিলেন, رسولا الى بنى اسرائيل (কুরআন ০৩:৪৯)। পুরো নাম আল-মসীহ ঈসা ইবনে মরিয়ম (কুরআন ০৩:৪৫)। ৩৩ খ্রিস্টপূর্ব ফিলিস্তিনের বেথেলহাম শহরে সতীসাধ্বী রমনী বিবি মরিয়মের উদরে পিতা ছাড়াই জন্ম নেন (কুরআন ০৩:৪৭)। নবুওয়ত লাভ করেন সাড়ে ৩২ বছর বয়সে। মাত্র তিন মাস নবুওয়তের দায়িত্ব পালন করেন [আত-তবকাতুল কোবরা ১/৩৫, ইবনে সা’আদ]। তিনি ইঞ্জিল কিতাব লাভ করেন। যা বর্তমানে রহিত। (কুরআন ০৩:৮৫)।

ইহুদীরা যখন উনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল [কুরআন ০৩:৫৪] এবং পাকড়াও করতে তাঁকে ঘিরে সবাই সমবেত হল [لما اجتمع اليهود على عيسى عليه السلام] ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী মহান আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে রফা করেন অর্থাৎ উঠিয়ে নেন (কুরআন ০৪:১৫৮)। তিনি জিবরাইল (আ:)-এর মাধ্যমে তাঁকে এইভাবেই সাহায্য করেন এবং তাঁর কাছে উঠিয়ে নিতে নির্দেশ করেন [কুরআন ০৫:১১০; তারীখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৭২]।

তারীখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৭২

আল্লাহতালা সেই মুহুর্তে তাঁর শিষ্যদের একজনকে তাঁরই সাদৃশ করে দেন। [কুরআন ০৪:১৫৭; তাফসীরে জালালাইন, তাবারী ৮/৩৭৪, হা/১০৭৮৯]। ফলে ইহুদীরা তাকে ঈসা ভেবে হত্যা করে দাবী করল, নিশ্চয় আমরা মসীহকে হত্যা করেছি (কুরআন ০৪:১৫৭)। ইহুদীরা ঈসার সাদৃশ একব্যক্তিকে ধরে নিয়ে হত্যা করে অত:পর শূলে চড়িয়ে রাখে [فأخذوا الشبه فقتلوه ثم صلبوه /ফা-আখাযুশ শিবহা ফা-ক্বাতালূহু ছুম্মা ছালাবূহু]। এই হাদীস ইবনে আব্বাস (রা:) হতে সহীহ মুসলিম-এর কৃত শর্তে সনদ দ্বারা বর্ণিত। [ইমাম ইবনে কাসীর রচিত, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ভলিউম ২]।

পবিত্র কুরআন এও বলেছে, ইহুদীরা তাঁর নাগাল পেতেও ব্যর্থ হয় [অর্থাৎ তারা ঈসাকে পাকড়াও করতে পারেনি]। যেমন আল্লাহ বলেন, ওয়া ইয কাফাফতু বানী ইসরাঈলা আনকা… (কুরআন ০৫:১১০)। অর্থ : যখন আমি বনী ইসরাইলকে তোমা হতে নিবৃত্ত রেখেছিলাম…। ইমাম সুয়ূতী (রহ:) লিখেছেন, এটি তখনকার ঘটনা যখন বনী ইসরাইল তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল (তাফসীরে জালালাইন)। সুতরাং কাদিয়ানীদের আকীদা, ঈসাকে শূলে তুলা হয়েছিল, এটি কুরআন বিরোধী ও কুফুরী আকীদা।

আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই ঈসা কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন (কুরআন ৪৩:৬১)। শেষযুগে তাঁর দ্বিতীয়বার আগমন ঘটবে। কেননা তিনি প্রৌঢ়বয়সে উপনীত হবেন, এই কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন (কুরআন ০৩:৪৬)।

  • মুসলিম শরীফের কিতাবুল ঈমান অংশে ‘ফা আম্মাকুম’ (فامكم) রয়েছে। তার পরের হাদীসে ‘ফা আম্মাকুম’ এর পরে এও রয়েছে ‘বি কিতাবি রাব্বিকুম ওয়া সুন্নাতি নাবিয়্যিকুম’ (بكتاب ربكم و سنة نبيكم) অর্থাৎ তিনি একজন শাসক হিসেবে কুরআন সুন্নাহ দ্বারা তোমাদের নেতৃত্ব (ইমামতে ছোগরা) প্রদান করবেন। (দেখুন হাদীস নং ২৪৬)। তিনি দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে [বায়তুল মোকাদ্দাস সীমানায় – মেরকাত ১০/১২০ কিতাবুল ফিতান] শ্বেত মিনারার নিকটে দুইজন ফেরেশতার দুই ডানায় আপনা দুই বাহু রেখে অবতরণ করবেন (মুসলিম, কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাতিশ সা’আহ)। ইমাম আবু বাকর আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বায়হাকী (মৃত. ৩৮৪ হিজরী) কর্তৃক সহীহ বুখারীর সমমানের সনদ সহ বর্ণিত সতন্ত্র একখানা হাদীসে উল্লেখ আছে [من السماء فيكم/মিনাছ ছামায়ি ফীকুম] অর্থাৎ ঈসা আকাশ থেকে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন। (রেফারেন্স, আল আসমা ওয়াস সিফাত ২/৩৩১; হাদীস নং ৮৯৫)।

তিনি দাজ্জালকে ‘লূদ’ [বায়তুল মোকাদ্দাস এর নিকটবর্তী একটি এলাকা- রূহানী খাযায়েন ৩/২০৯] নামক ফটকে [বর্শার আঘাতে] হত্যা করবেন (মুসলিম, কিতাবুল ফিতান)।

তিনি চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর দুনিয়ায় শরীয়তে মুহাম্মদিয়ার ভিত্তিতে রাজ্য পরিচালনা শেষে ইন্তেকাল করবেন (আবুদাউদ, কিতাবুল মালাহিম, হাদীসের মান, সহীহ)। মদীনায় মহানবী (সা:)-এর রাওজায় দাফন হবেন। সেখানে তাঁর কবরটি চতুর্থতম কবর হবে [فيكون قبره رابعا]। (দেখুন, আল মু’জামুল কাবীর ১৩/১৫৯। ইমাম তিরমীযি (রহ:) বলেছেন, হাদীসটির মান: ‘হাসান’। হাদীসটি অপরাপর আরো ৪টি সনদে বর্ণিত হয়েছে)।

তবে ‘কিতাবুল ওয়াফা’ এর একটি বর্ণনায় ‘ফী কবরী’ শব্দ এসেছে। ফলে রাসূল (সা:)-এর কবর খুঁড়ে ভেতরে দাফন করার কথা বুঝাল কিনা তা নিয়ে কাদিয়ানীদের ফালতু চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা বিশিষ্ট যুগ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) তার ব্যাখ্যায় ‘ফী মাক্ববারাতী’ [আমার গোরস্তানে] লিখে অনেক আগেই সমাধা দিয়ে গেছেন। (মেরকাত, কিতাবুল ফিতান ১০/১৬৬)।

ইমাম রাজী (রহ:) লিখেছেন, ‘ফী’ বর্ণটি অভিধানে ‘অতি নিকটে’ অর্থ বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন সূরা আন-নমল আয়াত নং ৮; মূসা (আ:) সম্পর্কে ان بورك من فى النار [অর্থাৎ বরকতময় হোক তিনি যিনি আগুনের মধ্যে আছেন…] উল্লেখ আছে। অথচ তূর পর্বতমালায় তখন মূসা আ. আগুনের অভ্যন্তরে ছিলেন না, বরং অতি নিকটে বা কোনো এক পাশেই ছিলেন (তাফসীরে কাবীর ২৪/১৮৩)।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) কর্তৃক স্বপ্নে দেখা তিনখানা চন্দ্রের [নবী, আবুবকর এবং উমর] ব্যাখ্যা হল, ওই তিনখানা চন্দ্র উনার জীবদ্দশায় হুজরাখানায় দাফন হবে। হযরত ঈসা (আ:)-কে উক্ত স্বপ্নে দেখতে না পাওয়ার কারণ উনার (আ:) দাফন হওয়ার ঘটনা উনার জীবদ্দশায় ঘটবে না। এখানে আরো বলে রাখা দরকার, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) হতেও বর্ণিত আছে যে, রাসূলের রাওজাতে আবুবকর, উমর এবং হযরত ঈসা দাফন হবেন। দেখুন ‘মসনাদে আহমদ’ ৬/৫৭। (সংক্ষেপে)।

সুতরাং কাদিয়ানী সম্প্রদায় ঈসা (আ:)-কে মৃত সাব্যস্ত করে মির্যা কাদিয়ানীকে কথিত রূপক ঈসা (মসীহ) সাব্যস্ত করতে যে সমস্ত অপব্যাখ্যা, মিথ্যা আর প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে তা সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রত্যাখ্যাত। ইসলামের মূলধারায় রূপক ঈসার কোনো কনসেপশন-ই নেই।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মওলানা কাসেম নানুতবী (রহ:) এর নামে মিথ্যাচারের জবাব

.

জনৈক বিদয়াতি নির্বোধ বক্তা ‘তাহযীরুন্নাস‘ (تحذير الناس) কিতাবের নামে ভুল আর বিকৃত উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, কাসেম নানুতবী সাহেব নাকি ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ অর্থ শেষনবী নয়, বলেছেন!

  • (এ সংক্রান্ত এ লিখাটিও পড়া যেতে পারে। এখানে ক্লিক করুন – https://markajomar.org/?p=6212)

উত্তর, তাহযীরুন্নাস কিতাবটি ফার্সি ভাষায়। অনেকে উর্দূ ভাষায়ও কনভার্ট করেছেন। আসুন তাহলে মাজলুম মওলানা সাহেবের কিতাবে এই বিষয়টি কিভাবে উল্লেখ আছে জেনে নিই। (আরও সংক্ষেপে ফেইসবুক থেকে পড়ুন)।

মওলানা নানুতবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মওলানা কাসেম নানুতুবী (১৮৩২-১৮৮০) ছিলেন উপমহাদেশের একজন মুসলিম পণ্ডিত। তিনি বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের নিকট নানুতা নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ শহরে তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি দেওবন্দ যান এবং মৌলভী মাহতাব আলীর মাদরাসায় শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি শাহারানপুর যান। সেখানে তার নানার সাথে অবস্থান করেন। শাহারানপুরে মৌলভী নওয়াজের তত্ত্বাবধানে তিনি আরবী ব্যাকরণ বিষয়ে প্রাথমিক গ্রন্থাদী পাঠ করেন। ১৮৪৩ সালের শেষের দিকে মামলুক আলী (রহ.) তাকে দিল্লি নিয়ে যান। সেখানে তিনি কাফিয়া ও বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি মাদরাসা গাজিউদ্দিন খানে ভর্তি হন। তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুলউলুম দেওবন্দ-এর প্রতিষ্ঠাতা।

মওলানা নানুতবী (রহ.) সাহেব লিখেছেন : اگر بالفرض آپ کے زمانہ میں بھی کہیں اور کوئی نبی ہو جب بھی آپ کا خاتم ہونا بدستور باقی رہتا ہے۔ অর্থাৎ “বিল-ফারজ তথা যদি ধরে নেয়া হয় যে, হুজুর (সা:)-র যামানায়ও কোথাও কেউ নবী হয়েছে তবুও হুজুর (সা:)-এর ‘খাতাম’ থাকা বরাবরই বহাল থাকবে।” (তাহযীরুন্নাস পৃ. ৩৮; হুজ্জাতুল ইসলাম একাডেমী ওয়াক্বফে দারুলউলুম দেওবন্দ, সাহারানপুর হতে প্রকাশিত)।

এতে বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে যে, মওলানা নানুতবী সাহেব (রহ.) বোধহয় বর্তমানেও নবী হবে অথবা নবী হওয়া সম্ভব বুঝাতে চেয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ সমালোচনাকারীদের জন্য দুঃসংবাদ হল, তিনি নিজ বইটির ৩৭ নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার এও লিখেছেন যে, اطلاق خاتم اس بات کو مقتضی ہے کہ تمام انبیاء علیہم السلام کا سلسلہ نبوت آپ پر ختم ہوتا ہے অর্থাৎ “খাতাম (خاتم)-এর প্রয়াগ এই কথারই দাবী রাখে যে, হুজুর (সা:)-এর উপরই সমস্ত নবীর নবুওয়তেরধারা শেষ হয়ে গেছে।” এবার মওলানা’র বিরুদ্ধে আরোপিত উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যামূলক উত্তর নিচে উল্লেখ করছি,

.

প্রথমত, তাঁর (মওলানা কাসেম নানুতবী) বক্তব্যের শুরুতেই ‘বিল-ফারজ’ (بالفرض) শব্দ উল্লেখ রয়েছে। যার তাৎপর্য হল- “যদি ধরে নেয়া হয়”। অর্থাৎ মওলানা’র কথাটি প্রকৃতার্থে ছিলনা, বরং ফারজী বা ‘যদি ধরে নেয়া হয়’ এরকম ছিল। পবিত্র কুরআনেও ফারজী অর্থে আল্লাহতালা বলেছেন, لو كان فيهما آلهة الا الله لفسدتا অর্থাৎ ‘যদি আসমান জমিনে আল্লাহ ছাড়াও কোনো ইলাহ থাকত তাহলে উভয়ই নিশ্চিত ধ্বংস হয়ে যেত।’ কিন্তু কোনো নির্বোধও এইজন্য একথা মনে করেনা যে, আল্লাহ ছাড়াও দ্বিতীয় কোনো ইলাহ বোধহয় থাকতে পারে!

দ্বিতীয়ত, উক্ত বক্তব্যটিতে বিদ্যমান ‘খাতাম’ (خاتم) শব্দটি মওলানা’র শুধুমাত্র ‘খাতামিয়তে মুরতাবী’ বিশ্লেষণের আলোকেই ছিল। যেহেতু তাঁর মতে খাতামিয়তে মাকানী, যামানী এবং মুরতাবী–সবদিক থেকে নবীজি (সা.) খাতামুন নাবিয়্যীন। তিনি যেন বুঝাতে চাচ্ছেন, মুহাম্মদ (সা.) শুধুই শেষনবী ছিলেননা।কারণ, শেষে হওয়ার মধ্যে মূলত স্বতন্ত্র কোনো ফজিলত থাকেনা। তাই মওলানা সাহেব ‘খাতাম’ শব্দের মর্মার্থকে ‘খাতামিয়তে যামানী’-এর সাথে খাস করাকে স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন সাধারণ মানুষদের ধারণা বলে আখ্যা দেন।

উল্লেখ্য, মওলানা নানুতবী সাহেব তার বক্তব্যে ‘খাতাম’ শব্দকে দার্শনিক উপায়ে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন মাত্র। ফলে নির্বোধ আর মাথামোটাদের নিকট তার বক্তব্যের উদ্দেশ্য বুঝা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। মূলত বিদয়াতীরা এ থেকেই ছিদ্র খুঁজতে শুরু করে। পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা ভুলে গিয়ে ইচ্ছেমতো অপপ্রচার শুরু করে।

যাইহোক, মওলানা’র উল্লিখিত বক্তব্যের তাৎপর্য দাঁড়াচ্ছে, ‘যদি ধরে নেয়া হয় যে, নবীজি (সা.)-র যামানায়ও কোথাও কেউ নবী হয়েছে তবু হুজুর (সা.)-এর ‘খাতাম’ (অর্থাৎ খাতামীয়তে মুরতাবী বা সর্বোচ্চ মর্যাদার শেষ মার্গে অধিষ্ঠিত থাকা) বরাবরই বহাল থাকবে।’

পাঠকবৃন্দ, এবার নিজেরাই চিন্তা করুন নির্বোধ মাথামোটারা কিভাবে মওলানার বক্তব্যকে নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করে দরাকে সরা বানিয়ে ফেললো! অথচ মওলানা নানুতবী এখানে ‘খাতাম‘ শব্দ থেকে ‘মুরতাবী‘ (مرتبى) অর্থই উদ্দেশ্য নিয়েছেন, ‘যামানী’ বা ‘মাকানী’ অর্থকে উদ্দেশ্য নেননি। যার ফলে তাদের উল্লিখিত আপত্তি ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যমূলক। অপ্রিয় হলেও সত্য, বিদয়াতীদের একটা অংশ (বিশেষত বেরেলিরা) মওলানার বিরুদ্ধে এই প্রপাগাণ্ডা মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলি থেকেই লুপে নিয়েছিল।

আল্লাহতালা এইধরনের মিথ্যাচারকারীদের সহীহ বুঝ দিন। নয়ত ধ্বংস করে দিন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

‘তোমরা বলোনা মুহাম্মদ (সা:)-এর পর আর কোনো নবী নেই’ এর কী ব্যাখ্যা!

কাদিয়ানীরা হযরত আয়েশা (রা.) এবং দারুলউলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.)-এর প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন এবং বুঝাতে চেয়েছেন যে, এঁনাদের বিশ্লেষণের সাথে নাকি তারাও সম্পূর্ণ একমত! তাই প্রথমেই দেখে নেয়া যাক উনাদের সেই বিশ্লেষণটুকু কেমন।

আরো পড়ুন : মওলানা কাসেম নানুতবী (রহ:) এর নামে কাদিয়ানীদের মিথ্যাচারের জবাব Click

  • ‘তোমরা বলিও না তাঁর পরে কোনো নবী নেই’- উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.)-এর খণ্ডিত বক্তব্যে বিভ্রান্তির মুখোশ উন্মোচন :

প্রশ্ন, বিভ্রান্তি কিভাবে ছড়ায়? উত্তর, কাদিয়ানীরা হযরত আয়েশা (রা.)-এর বক্তব্যের শেষের অংশটুকু বাদ দিয়ে বুঝাতে চায়, বর্তমানেও নতুন নবীর আগমন হতে পারার ইংগিত রয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)।

প্রশ্ন, তাহলে সম্পূর্ণ রেওয়ায়েতটি কিরকম?

উত্তর, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাল্লাম আল বছরী (মৃত : ২০০ হিজরী) বিরচিত ‘তাফসীরে ইয়াহইয়া ইবনে সাল্লাম’ (تفسير يحي بن سلام) নামক কিতাবে হযরত আয়েশা (রা.)-এর বক্তব্যটি এইরূপ, عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : لا تَقُولُوا : لا نَبِيَّ بَعْدَ مُحَمَّدٍ ، وَقُولُوا : خَاتَمُ النَّبِيِّينَ ، فَإِنَّهُ يَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلا وَإِمَامًا مُقْسِطًا ، فَيَقْتُلُ الدَّجَّالَ ، وَيَكْسِرُ الصَّلِيبَ ، وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيرَ ، وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ ، وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا অর্থাৎ “তোমরা বলিও না মুহাম্মদ (সা.)-এর পর আর কোনো নবী নেই (তবে) তোমরা ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ বলো। কেননা (অচিরেই) ঈসা ইবনে মরিয়ম একজন ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক এবং ইনসাফগার ইমাম হিসেবে অবতরণ করবেন। তিনি দাজ্জাল হত্যা করবেন এবং ক্রুশ ভাঙ্গবেন ও শূয়োর হত্যা করবেন। তিনি রাষ্ট্রিয় টেক্স (কর) রহিত করে দেবেন। তখন (আর কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায়) লড়াই তার সরঞ্জামাদি গুটিয়ে নেবে (অনুবাদ শেষ হল)।” (সূরা আহযাব, আয়াত ৪০ দ্রষ্টব্য)।

তারা এই ক্ষেত্রে ‘মাজমাউল বিহার’ গ্রন্থ থেকেও উদ্ধৃতি দেয়। সেক্ষেত্রেও তারা একই বাক্যের শেষের অংশটি বাদ দিয়ে বলে। যেমন, তারা বলে থাকে যে, আয়েশা (রা.) বলেছেন, قولوا خاتم الأنبياء و لا تقولوا لا نبى بعده অর্থাৎ তোমরা খাতামুল আম্বিয়া বলো, (তবে) তোমরা বলবেনা তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই।

প্রশ্ন, তারা কোন অংশটি বাদ দিয়ে বলে?

উত্তর, তারা একই বাক্যের পরের অংশটুকু বাদ দিয়ে বলে। অথচ সংশয় নিরসনকারী জবাব তার পরের অংশেই রয়েছে। কেননা পরের অংশটি হচ্ছে, هذا ناظراً إلى نزول عيسى অর্থাৎ এটি ঈসার নাযিল হওয়ার প্রতি দৃষ্টি রেখে। (মাজমাউল বিহার ৫০২; ইমাম তাহের পাটনী গুজরাটী রহ.)।

যাইহোক উল্লিখিত বর্ণনাটি কাটছাঁট না করলে যে কথা বুঝতে কষ্ট হয়না তা হল, মূলত হযরত ঈসা (আ.)-এর দ্বিতীয়বার আগমনের দিকে তিনি ইংগিত করতেই এই কথা বলেছিলেন! অথচ তারা উদ্ধৃত করার সময় শেষের অংশটুকু বাদ দিয়ে দেয়। আল্লাহ তাদের এই সমস্ত খেয়ানত ক্ষমা করে হিদায়াত দান করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

কাদিয়ানীদের বইতে ‘খাতামান নবীঈন’ এর প্রকৃত মর্মার্থ

  • কাদিয়ানী সম্প্রদায় হযরত মুহাম্মদ (সা:)-কে ‘খাতামান নবীঈন’ স্বীকারকরার দাবী সুস্পষ্ট প্রতারণা :

কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের লিফলেট ও বইপুস্তকে ‘খাতামান নবীঈন হযরত মুহাম্মদ (সা:)’ শিরোনামে একটি হাদীস উল্লেখ করে থাকে। হাদীসের অর্থ: ‘আমি নিশ্চয়ই তখনও আল্লাহর বান্দা ও খাতামান নবীঈন ছিলাম যখন আদম (আ:) কর্দমাক্ত অবস্থায় তাঁর সৃষ্টির সূচনায় ছিলেন। (মুসনাদে আহমদ)। তারা এরপর নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করতে গিয়ে যা লিখে থাকেন তার সারসংক্ষেপ এই যে, তারা আরবী ভাষায় ‘খাতাম’ শব্দের যতগুলো অর্থ রয়েছে সব অর্থেই রাসূল (সা:)-কে ‘খাতামান নবীঈন’ বলে মান্য করে। অথচ এটি তাদের সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ধোকা। প্রসঙ্গিক আলোচনায় যাওয়ার ‘শেষনবী’ এর সংজ্ঞা কী, তা জেনে নিই।

আরো পড়ৃন : ঈসা (আ:) পুনঃবার আগমন করলে তখন কে শেষ হবেন?

  • ‘শেষনবী’ বলতে এমন ব্যক্তিই উদ্দেশ্য যাঁকে সবার শেষে ‘নবী’ বানানো হয়েছে। [দেখুন, তাফসীরে কাশশাফ খন্ড ২২; সূরা আহযাব ৪০, বরেণ্য ইমাম যামাখশারী রহ: রচিত]। যেজন্য সবার শেষে নবুওয়ত লাভকারী হিসেবে মুহাম্মদে আরাবী (সা:)ই শেষনবী, অন্য আর কেউ নন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার, এই একই কারণে ঈসা (আ:) আবার আগমন করলে তিনি ‘শেষনবী’ হবেন না। কেননা তিনি তাঁরও আগ থেকে নবুওয়তপ্রাপ্ত হয়ে নবী হিসেবে মনোনীত।
  • এবার কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন :

[১] এখন কাদিয়ানী সম্প্রদায় ‘খাতাম’ শব্দের সকল অর্থেই রাসূল (সা:)-কে ‘খাতামান নবীঈন’ বলে মান্য করলে তাদের ‘এক গলতি কা ইযালা’ বইতে উল্লিখিত “সত্য কথা এই যে, আমার প্রতি অবতীর্ণ আল্লাহর পবিত্র ওহী (বাণী)-সমূহে নবী, রাসূল ও মুরসাল শ্রেণীর শব্দ একবার দু’বার নয়, শত শত বার বিদ্যমান রয়েছে” – মির্যা কাদিয়ানির এই কথার কী অর্থ? (রেফারেন্স, এক গলতি কা ইযালা পৃ-৩)।

[২] তাদের কথা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তারা রাসূল (সা:)-কে নিঃশর্তে ‘শেষনবী’ স্বীকার করেনা। বরং তারা মনে করে রাসূল (সা:) শুধুমাত্র শরীয়তবাহক নবী হিসেবেই একজন ‘শেষনবী’। তারমানে নবুওয়তেরধারা বন্ধ হয়নি, নবুওয়তে মুহাম্মদীর পরেও নতুন কেউ শরীয়ত বিহীন নবী হতে পারবে (নাউযুবিল্লাহ)। নতুবা তারা ‘শরীয়তবাহক’ এইরূপ Condition [শর্ত] যুক্ত করে কী বুঝাতে চায়?

অথচ কোনোরূপ শর্ত যুক্ত ছাড়াই রাসূল (সা:) বিনা ব্যতীক্রমে ইরশাদ করেছেন : ‘লা নাবিয়্যা বা’দী’ অর্থাৎ আমার পরে আর কোনো প্রকারের নবী নেই। (বুখারী ২/৬৩৩, মুসলিম ২/২৭৮)। খুবই লক্ষণীয় যে, হাদীসে ‘নবী’ শব্দটি নাকেরা বা অনির্দিষ্টবাচক। তাই এখন এই হাদীসের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া তাদের পক্ষে মির্যা কাদিয়ানীকে নবুওত লাভকারী মান্য করা কিভাবে সম্ভব? যদিও বা মির্যায়ী নবুওয়ত(!) তথাকথিত উম্মতি, বুরুজি কিবা জিল্লি প্রভৃতি যেই শ্রেণীরই হোক না কেন! সত্য বলতে, তাদের কাছে এর সঠিক কোনো জবাব নেই!

আসল কথা হল, মির্যার নবুওয়ত দাবীর বদনাম ঘোচানোর উদ্দেশ্যেই সেটিকে ‘উম্মতি’ শব্দে জাহির করা হয়, যা সুস্পষ্ট ধোকা। মনে করুন আপনার সন্তানকে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করানোর উদ্দেশ্যে গভমেন্ট স্বীকৃত একমাত্র কোনো বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারলেন যে, তাদের কোটা পূর্ণ হয়ে গেছে, ভর্তি নেয়া বন্ধ। এখন আপনার সন্তানকে ওই বিদ্যালয়ের কোন শ্রেণীর ছাত্র গণ্য করবেন? পঞ্চম শ্রেণীর তো অবশ্যই না। আবার যেখানে টোটালি ভর্তি-ই বন্ধ, সেখানে ১ম, ২য়, ৩য় কিবা ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র বলে দাবীটাও কি অবৈধ নয়? তদ্রুপ, যেখানে Unconditionaly নবুওয়তের দ্বারই বন্ধ, সেখানে মির্যার জন্য উম্মতি, বুরুজি কিবা জিল্লি শ্রেণীর নবুওয়ত দাবীর সুযোগ কোথায়?

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-কে কাদিয়ানীদের ‘খাতামান নাবীঈন’ স্বীকার করার তাৎপর্য এটাই। এককথায়, তারা মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-কে খাতামান নাবীঈন মানার অর্থ হল, মুহাম্মদ (সা:) শুধুমাত্র শরীয়তবাহক হিসেবেই শেষনবী কিন্তু বিনা ব্যতিক্রমে ও নি:শর্তে তিনি শেষনবী নন। নাউযুবিল্লাহ। আশাকরি তাদের প্রকৃত আকীদা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পেরেছেন।

  • লিখক শিক্ষাবিদ ও গবেষক

হাদীসের অপব্যাখ্যায় কাদিয়ানীদের দুই ঈসা তথ্যের খন্ডন

তথাকথিত দুই ঈসা’র গোলক ধাঁধাঁয় কাদিয়ানী জামাতের ভ্রান্ত মতবাদের তাত্ত্বিক ও যুক্তিক খন্ডন :

কাদিয়ানীদের দাবী, হাদীসে দুই ঈসা’র বর্ণনা রয়েছে। অতএব শেষ যুগে আগমনকারী ঈসা (আ:) পূর্বের ঈসা নন, বরং তিনি সেই ঈসা যার গায়ের রং গধুম বর্ণের এবং মাথার চুল সােজা। যাকে রাসূল (সা:) স্বপ্নযােগে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে দেখেছিলেন। মির্যা কাদিয়ানী ছিলেন সেই গধুম (বাদামী) বর্ণের ঈসা। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)।

তবে কি সত্যই হাদীসে দুই ঈসার বর্ণনা এসেছে??

একথার জবাবে বলা হবে যে, হাদীসে দুই ঈসার বৃত্তান্ত থাকার দাবী সম্পূর্ণরূপে একটি ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণােদিত দাবী। কেননা ‘লালচে’ (احمر) বর্ণ সংক্রান্ত হাদীসে ‘আহমারু’ শব্দের পূর্বে ‘রাবআতুন’ (ربعة) শব্দও রয়েছে (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া/৩৩৯৪)। ফলে মর্মার্থ দাঁড়াচ্ছে, ঈসা (আ:) মাঝারী আকারের লালচে বর্ণের। যার বিশ্লেষণ রাসূল (সা:) নিজেই করেছেন : মারবূ’উল খালকি ইলাল হুমরাতি ওয়াল বাইয়াদ্বি (مربوع الخلق إلى الحمرة و البياض) অর্থাৎ লালচে এবং সাদা উভয় বর্ণে মিশ্রিত মাঝারী বর্ণের’ (সহীহ বুখারী, কিতাবু বুদুয়িল খালকি, বাবু যিকরিল মালাইকাহ)। আরেক হাদীসে সেটাকেই এককথায় প্রকাশার্থে গধুম (آدم) অর্থাৎ বাদামী বলা হয়েছে (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া/৩৪৪১)।

মজারব্যাপার হল, মির্যা কাদিয়ানী নিজেও তার বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, “হযরত মসীহ চুঁকে বালাদে শাম কে রাহনে ওয়ালে থে এসলিয়ে উয়ােহ্ বগাওয়া ইয়ানে সফীদ রং থে।” অর্থাৎ হযরত মসীহ (আ:) শাম দেশের অধিবাসী ছিলেন বলেই তিনি সাদা বর্ণের ছিলেন (রূহানী খাযায়েন ১৫/৮৩)। কাদিয়ানীদের মাথাটা খুব বেশি মোটা না হলে অন্তত মির্যার এই কথাতেও অনেক কিছু ভাবার আছে। কারণ মির্যা কাদিয়ানী যাঁকে হাদীসের উদ্ধৃতিতে “লাল” বর্ণের বলেছেন এখানে ওই একই ব্যক্তিকে “সাদা” বর্ণের-ও বলছেন! ভাবিয়ে তুলে কিনা? কী জবাব?

যাইহোক, বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারক হাদীসগুলাের মধ্যে সামঞ্জস্যতার বিধান করে লিখেছেন : ‘ওয়া ইয়ুমকিনুল জাময়ু বাইনাল ওয়াছফাইনি (و يمكن الجمع بين الوصفين)…অর্থাৎ উভয় গুণের মাঝে সামঞ্জস্যতার বিধান সম্ভব এইভাবে যে, তাঁকে (ঈসা) আপনা ক্লান্তি আর বিষন্নতার কারণে লালচে বর্ণের দেখাবে তবে কিন্তু তিনি সাধারণভাবে তাম্র ও গােধুম-বর্ণের হবেন (ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী ৬/৩৭৭)।

হাদীসে কি ঈসা (আ:) এর চুল কোঁকড়ানো বলে উল্লেখ আছে??

একথার জবাবে বলব, ঈসা (আ:) এর শারীরিক গঠন কেমন হবে সে সম্পর্কে হাদীসে উল্লিখিত জা’দ (جعد) শব্দের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট যুগ-ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) লিখেছেন : ‘ওয়া ওয়াছাফাহু লিজাউদাতি ফী জিসমিহি লা শারিহি ওয়াল মুরা-দু বিযা-লিকা ইজতিমা-ইহি ওয়া ইকতিনাযিহি (و وصفه لجعودة في جسمه لا شعره والمراد بذالك إجتماعه و اكتنازه)। অর্থাৎ হযরত মসীহ (আ:) সম্পর্কে জা’দ (جعد) শব্দের উল্লেখ হয়েছে তাঁর শারীরিক গঠন বর্ণনা দিতে, চুলের ধরণ বুঝাতে নয়। ওই জা’দ (جعد) হতে উদ্দেশ্য হল তিনি শক্তসুঠাম দেহের অধিকারী (ফাতহুল বারী ৬/৪৮৬)। কাজেই অভিধানে জা’দ অর্থ কোঁকড়া চুল হলেও হাদীসটিতে শব্দটি শরীরের গাঠনিক বর্ণনা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এসেছে বলেই আমরা বুঝতে পারলাম। অতএব, একই ব্যক্তির শারীরিক বর্ণের একাধিক বিশেষণ এসেছে বলেই তিনি কখনো একাধিক ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যাবেন না!

  • এরপরেও যারা মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্যের চর্বিতচর্বণ করেই দুই ঈসার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা দিয়ে জল ঘােলা করতে চান তাদের উদ্দেশ্যে আমার কয়েকটি প্রশ্ন এই যে,

[১] রাসূল (সা:) এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে উমর (রা:) বলেছেন : ما قال النبى صلى الله عليه وسلم لعيسى أحمر (উচ্চারণ) মা ক্বা-লান্নাবিয়্যু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লি-ঈসা আহমারু। অর্থাৎ আল্লাহর শপথ! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি ঈসাকে লাল বর্ণের বলেননি (দেখুন সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীস নং ৩৪৪১)। বিপরীতে মির্যা গােলামের দাবী হচ্ছে, হযরত ঈসা (আ:)-কে রাসূল (সা:) নাকি লাল বর্ণের বলেছেন! নাউযুবিল্লাহ। যাইহােক, এখন কাদিয়ানীদের কৃত ব্যাখ্যা অনুসারে যদি ঈসা দুইজন হয় তাহলে লালচে আর সাদা উভয় বর্ণে মিশ্রিত সহ এবার ঈসা মােট তিনজন হল কিনা? এমনকি মির্যা নিজেও যে লিখে গেলেন, শামের অধিবাসী হযরত মসীহ (আ:) সাদা বর্ণের ছিলেন। একথাগুলাের কী জবাব?

[২] তর্কের খাতিরে মানলাম, ঈসা দুইজন। সে হিসেবে মির্যা কাদিয়ানী যদি দ্বিতীয় ঈসা হন তাহলে তিনি নিজেকে ইসরায়েলি ঈসার রূপক দাবী করলেন কেন?

[৩] আর যদি তিনি ইসরায়েলি ঈসার রূপক সত্তা হন তখন রাসূল (সা:) কর্তৃক স্বপ্নে দেখতে পাওয়া কথিত দ্বিতীয় ঈসার কী হবে? সত্য বলতে, এমন জগাখিচুড়ি মতবাদ জগতে দুই একটা আছে কিনা আল্লাহ মালুম।

[৪] তাছাড়া দুই ঈসা’র অস্তিত্ব থাকলে এবং তিনি (মির্যা) দ্বিতীয় ঈসা হলে: তখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, তিনি জীবনে কখনাে কাবার তাওয়াফ (طواف) করতে সক্ষম হলেন না কিজন্য? (সীরাতে মাহদী ২/১১৯)। তবে কি কথিত দ্বিতীয় ঈসা (মির্যা)-কে স্বপ্নে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখাটা রাসূল (সা:)-এর ভুল ছিল বলবেন? নাউযুবিল্লাহ। উল্লেখ্য, দাজ্জালের তাওয়াফ এর ব্যাখ্যায় মির্যা কাদিয়ানী নিজেই লিখে গেছেন, তার মানে হচ্ছে ‘কাবার আশপাশে চোরের ন্যায় ঘুরাঘুরি করা, অভ্যন্তরে প্রবেশ না করা।’ (রূহানী খাযায়েন ১৪/২৭৫)।

সুতরাং বুঝা গেল, দাজ্জাল এর তাওয়াফ বলতে শরয়ীপন্থার তাওয়াফ উদ্দেশ্য নয়, বরং অভ্যন্তরে ঢুকতে না পেরে চোরের মত চারদিকে ঘুরাঘুরি করাই উদ্দেশ্য। কেননা অভিধানে চারপাশে ঘুরাঘুরি করাকেও ‘তাওয়াফ’ বলে।

[৫] সুনানু আবু দাউদ শরীফের “কিতাবুল মালাহিম” অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা:) বলেছেন: আমার আর ঈসার মধ্যখানে আর কোনাে নবী নেই। নিশ্চয়ই তিনি (ঈসা) নাযিল হবেন (হাদীস নং ৪৩২৪]। আর এদিকে মির্যার ভাষ্যমতে, হাদীসটিতে বর্ণিত আগত এই ঈসা নাকি মির্যা নিজেই। তাই প্রশ্ন আসে, এই ঈসা যদি মির্যা-ই হন, তাহলে তিনি একই সাথে কথিত দ্বিতীয় ঈসা-ও কিভাবে হন? সমীকরণ তাে মিলেনা! কিংবা রাসূল (সা:) থেকে অন্ততপক্ষে একটি হাদীসেও ‘রূপক’ শব্দের আরবী সমার্থক “মাছীল” (مثيل) শব্দটিও কেন উল্লেখ হলনা? আশাকরি বুঝতেই পেরেছেন, ওদের কথিত দুই ঈসা তত্ত্বের গােড়াতে কী পরিমানে অসঙ্গতি নিহিত!

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা’ হাদীসের খন্ডাংশটির সঠিক ব্যাখ্যা

‘আগমনকারী ইমাম মাহদীর-ই আরেক নাম ঈসা ইবনে মরিয়ম’ একটি মিথ্যা ও তার খন্ডন :

.

তাত্ত্বিক ও যুক্তিক খন্ডন : তাদের উপরিউক্ত বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনু মরিয়াম’ (যার অর্থ তাদের কৃত অনুবাদ অনুসারে) ‘প্রতিশ্রুত মাহদী (আ.) আগমনকারী ঈসা ইবনে মরিয়ম ছাড়া অন্য কেউ নন’। এই হিসেবে তাদের বিচারে, প্রতিশ্রুত ঈসা পূর্বের ঈসা নন, বরং এটি ইমাম মাহদীরই একটি পরিচয়। আর সেই কারণেই ইমাম মাহদী দাবিকারী মির্যা কাদিয়ানী একই সাথে রূপক অর্থে হযরত ঈসাও। (নাউযুবিল্লাহ)। আবার তাদের এও দাবী, হাদীসে দুই ঈসার বৃত্তান্ত রয়েছে। এবার তাদের দাবীগুলোর ধারাবাহিক খন্ডন করা হবে!

প্রথমত, উল্লিখিত ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনু মরিয়ম’ বর্ণনাটি কাদিয়ানিদের লিফলেটে যেইটুকু উল্লেখ আছে সেইটুকুতে শেষ নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ হাদীসটির মাত্র এক পঞ্চমাংশ। সম্পূর্ণ হাদীস দেখলে যে কেউই অনুধাবন করতে পারবে যে, উক্ত খন্ডিত অংশটি ধরে কাদিয়ানিরা যেই অর্থ নিয়ে থাকে তা পুরোপুরি ভুল ও বাতিল।

আমি তাদেরকে প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে ওই একই বর্ণনার মধ্যে ‘ওয়া লান নাসু ইল্লা শুহ্হান’ [ولا الناس إلا شحا]-এর কেমন অর্থ হবে? তার অর্থও কি ‘যত মানুষ রয়েছে তারা কৃপণ ছাড়া আর কেউ নন’ অনুরূপ হবে? তবে কি নবী রাসূলগণও কৃপণদের অন্তর্ভুক্ত? লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।

দ্বিতীয়ত, হাদীসটিতে শেষযুগের অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে। সেগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার পরেই বলা হয়েছে ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনু মরিয়ম’। এতে শুরুতে যেই ‘ওয়াও’ [و] রয়েছে সেটি আরবী ব্যাকরণের ভাষায় ‘ওয়ায়ে হালিয়াহ’ [الواو الحالية]। সেহিসেবে এর অর্থ দাঁড়াবে, তখন একমাত্র পরিপূর্ণ সুপথপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি ঈসা ইবনু মরিয়ম ছাড়া অন্য কেউ নন। উল্লেখ্য, প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর ইন্তিকালের পরেও ঈসা (আ.) কমবেশি আরো প্রায় চল্লিশ বছর বেঁচে থাকবেন। (আবুদাউদ, কিতাবুল মালাহিম)। এখানে ‘তখন’ বলে মূলত সেদিকেই ইংগিত করা হয়েছে। এই সম্পর্কে পূর্বেও প্রমাণ করা হয়েছে যে, ঈসা আর ইমাম মাহদী এঁরা মূলত দুইজনই। (দেখুন, সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)।

  • আসল কথা হল, ‘ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা’ এই হাদীস সনদের বিচারে সকলের নিকট এমনকি মির্যা কাদিয়ানীর নিকটেও দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। মির্যা কাদিয়ানী নিজেও তার ‘হামামাতুল বুশরা’ (ঊর্দূ)’র ১৭৮ নং পৃষ্ঠায় [বাংলা অনূদিত পৃ-১৬১] ‘ইবনে মাজাহ’-র হাদীসটির সনদ (সূত্র)-কে দুর্বল, ত্রুটিপূর্ণ এবং অনির্ভরযোগ্য বলে-ই স্বীকার করেছেন। স্ক্রিনশট দেখুন-
.

হাদীস শাস্ত্রের যুগ বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণও হাজার বছর আগেই বলে গেছেন যে, “ওয়া লাল মাহদী” ওয়ালা বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য নয়। স্ক্রিনশট দেখুন!

জেনে আশ্চর্য হবেন, একজন ‘মুলহাম’ এবং ‘ইমাম মাহদী’ দাবী করা অবস্থায় মির্যা কাদিয়ানী আপনা ‘তুহফায়ে গোলডবিয়া’ (প্রথম প্রকাশ, আগস্ট ১৯০২ইং) নামক বইতে লিখে গেছেন : اور ہم ثابت کر چکے ہیں کہ وہی رجل فارسی مہدی ہے اس لئے ماننا پڑا کہ مسیح موعود اور مہدی اور دجال تینوں مشرق میں ہی ظاہر ہوں گے اور وہ ملک ہند ہے۔ অর্থাৎ এবং আমি প্রমাণ করেছি যে, সেই পারস্যের পুরুষটি-ই মাহদী। যেজন্য মানতে হবে যে, মসীহ মওঊদ, মাহদী এবং দাজ্জাল তিনোজন পূর্বদিকেই প্রকাশিত হবে আর সেই রাষ্ট্রটি হচ্ছে হিন্দুস্থান।” (রূহানী খাযায়েন ১৭/১৬৭ দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট :

.

এবার ‘মসীহ আর মাহদী’ একই ব্যক্তি হলে ‘তিনো’ (উর্দূ) শব্দের কী মানে? তবে কি মসীহ + মাহদী + দাজ্জাল = একজন? পরিশেষে বলে রাখতে চাই, আক্ষরিক অর্থে চারো খলীফা ‘আল-মাহদী’ তথা সুপথপ্রাপ্ত [তিরমিযী শরীফ, কিতাবুল ইলম হা/২৬৭৬]। এই দিক থেকে নবীগণ সবাই ‘মাহদী’। এমনকি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ও ‘মাহদী’। এগুলো স্বয়ং মির্যা সাহেবই লিখে গেছেন। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১৪/৩৯৪)। সুতরাং বুঝা গেল, আক্ষরিক অর্থে ঈসা (আ:)-কে ‘মাহদী’ সম্বোধন করা হলেও সমস্যা নেই। তাতে দুইজনকে একই ব্যক্তি বুঝাবেনা। সব চে বড় কথা হল, “ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা” সংক্রান্ত হাদীসটি স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীর বইতেও ক্রুটিপূর্ণ, দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলেই লিখা আছে। তাই যে সমস্ত কাদিয়ানী ঈসা আর মাহদীকে একই চরিত্রের অভিন্ন সত্তা দাবী করে প্রমাণ স্বরূপ উক্ত বর্ণনাটি পেশ করেন তারা প্রকারান্তরে মির্যাকেও অস্বীকার করল!

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ক্বদ খালাত মিন ক্ববলিহির রসুল প্রসঙ্গে – পর্ব ১

অত্র বিষয়ে আর্টিকেল নং ২

অত্র বিষয়ে আর্টিকেল নং ৩

কাদিয়ানীদের দাবীর মূল ভিত্তি হযরত ঈসা (আ:)-এর মৃত্যু :

এই কথা সবাই জানেন যে, মুসলিম উম্মাহার মূল আপত্তি হল, মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়ত দাবী। কিন্তু তার অনুসারীরা সেদিক থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে ‘ওফাতে ঈসা’ সম্পর্কিত বিষয়কে বরাবরই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে, যা একদমই অপ্রসঙ্গিক একটি বিষয়। এখানে বলে রাখা দরকার যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় ঈসা (আ:)-কে মৃত সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যই হল আগত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর কুরসিতে মির্যা কাদিয়ানীকে একজন নকল ঈসারূপে বসানো! মূলত এইজন্যই তারা ঈসা (আ:)-কে যে কোনো মূল্যে মৃত প্রমাণ করতে এক পায়ে খাড়া। প্রয়োজনে তারা পবিত্র কুরআনকেও মনগড়া ব্যাখ্যার নিশানা বানাতে কুণ্ঠিতবোধ করবেনা। তারা বিশেষত, পবিত্র কুরআনের (আলে ইমরান/০৩:৫৫ এবং ১৪৪) এবং (আল মায়েদা/০৫:১১৭) আয়াতগুলো বিকৃত অনুবাদ ও মনগড়া ব্যাখ্যাসহ পেশ করে থাকে।

এখানে শুধুমাত্র সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৪৪ এর জবাব দেব, ইনশাআল্লাহ। প্রথমে আয়াতটির সঠিক অনুবাদ,

(আরবী) وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِہِ الرُّسُلُ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡہِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰہَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیَجۡزِی اللّٰہُ الشّٰکِرِیۡنَ

অর্থাৎ মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র; তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিবে? এবং কেহ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিলে সে কখনও আল্লাহ ক্ষতি করিতে পারিবে না; বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করিবেন।” (অনুবাদ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন/ইফা)। বলে রাখা দরকার যে, কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা হেকিম নূরউদ্দীনও আয়াতটির ‘আর-রসুল’ (الرسل) হতে ‘বহু রাসূল’ (بہت رسول) অর্থ নিয়েছেন। (দেখুন, ফাছলুল খিতাব লি-মুকাদ্দিমাতি আহলিল কিতাব [উর্দূ] পৃষ্ঠা ২৮; রচনা ১৮৮৭-৮৮ইং দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট সহ আর্টিকেল নং ২ দ্রষ্টব্য। দেখুন।

ব্যাখ্যা-মূলক জবাব : এই আয়াত ঈসা (আ:) সহ পূর্বেকার কোনো নবী রাসূলকে মৃত কিবা জীবিত কোনোটাই সাব্যস্ত করার জন্য নাযিল হয়নি। আয়াতের প্রেক্ষাপট দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয়। মনে রাখতে হবে যে, গত হওয়া মানে শুধু মরে যাওয়া বুঝায় না, দায়িত্বে বর্তমান নেই অথবা একস্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকেও এই অর্থে অন্তর্ভুক্ত করবে। তার স্থানান্তরিত হওয়াটা হোক মৃত্যুর মাধ্যমে কিংবা সশরীরে রাফা বা উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। উভয় অবস্থায় এই ক্ষেত্রে খালা/খালাত (خلا، خلت) শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। একজন জ্ঞানী মাত্রই বুঝতে পারে যে, এই আয়াতে আল্লাহতালা ‘মউত’ (قد ماتت) শব্দের পরিবর্তে ‘খালা’ (قد خلت) শব্দের উল্লেখের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে! এমন ব্যতিক্রমী শব্দ-প্রয়োগের মধ্যে মহান রাব্বুল আলামীনের কী রহস্যটা লুকায়িত! হ্যাঁ, এখানে রহস্যটা এই যে, ‘খালা’ শব্দ-প্রয়োগের কারণে এমন সব রাসূলকেও ‘গত হয়ে যাওয়া’ অর্থে শামিল করতে পারে, মৃত্যুর মাধ্যমে যাদের স্থানান্তর হওয়া জরুরি নয়; বরং রাফা বা উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমেও স্থানান্তরের ঘটনা ঘটা যথেষ্ট।পবিত্র কুরআনে এমন সব ‘গত হয়ে যাওয়া’ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ‘খালা’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে যাদের ‘গত হয়ে যাওয়াটা’ মউতের মাধ্যমে ঘটেনি। যেমন আল্লাহতালা বলেন, (আরবী) اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ بِالۡحَقِّ بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا ؕ وَ اِنۡ مِّنۡ اُمَّۃٍ اِلَّا خَلَا فِیۡہَا نَذِیۡرٌ অর্থাৎ আমি তো তোমাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; এমন কোনো সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি (সূরা ফাতির/৩৫:২৪)। অন্য এক জায়গায় এসেছে, (আরবী) وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قَالُوۡۤا اٰمَنَّا ۚۖ وَ اِذَا خَلَوۡا اِلٰی شَیٰطِیۡنِہِمۡ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا مَعَکُمۡ ۙ اِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَہۡزِءُوۡنَ অর্থাৎ যখন তারা বিশ্বাসীগণের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা বিশ্বাস করেছি। আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তান (মুনাফিক দলপতি)দের সাথে (গিয়ে) মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তো তোমাদের সাথেই রয়েছি; আমরা শুধু তাদের সাথে পরিহাস করে থাকি (সূরা বাকারা/০২:১৪)। অতএব বুঝা গেল যে, সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৪৪ এর মধ্যেও যে ‘খালা’ (মাসদার/ক্রিয়ামূল الخلو) রয়েছে সেটি ‘আম’ বা ব্যাপক অর্থকে নির্দেশ করবে। চাই তো ‘গত হয়ে যাওয়া’ ব্যক্তিটি মারা যাক কিংবা রাফার মাধ্যমে সশরীরে কোথাও স্থানান্তরিত হয়ে যাক!

নির্বোধ কাদিয়ানীদের প্রতি আমার শুধু একটি প্রশ্ন। পবিত্র কুরআনের সূরা হাজ্জ, আয়াত নং ৬৬ এর মধ্যে এসেছে, (আরবী) وَ هوَ الَّذِیۡۤ اَحۡیَاکُمۡ ۫ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡکُمۡ ؕ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَکَفُوۡرٌ অর্থাৎ তিনিই তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন; অতঃপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পুনরায় তোমাদেরকে জীবন দান করবেন। নিশ্চয় মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ (সূরা হাজ্জ/২২:৬৬)। আয়াতটিতে আল্লাহতালা মৃত্যু অর্থের জন্য সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘মউত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অথচ তিনি সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৪৪ এর ক্ষেত্রে ‘মউত’ শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করেছেন ‘খালা’ শব্দ যেটি দ্বৈত অর্থের নির্দেশকারী। অর্থাৎ রাফা বা উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে যিনি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যান তাকেও সেই অর্থে শামিল করে থাকে। আল্লাহর এই ব্যতিক্রমী শব্দচয়নের উদ্দেশ্য কী? জানি কোনো উত্তর নেই! বলাবাহুল্য যে, আল্লাহর এইরূপ ব্যতিক্রমী শব্দচয়ন দ্বারাই সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে তখন من قبله الرسل এর ভেতর الرسل হতে ‘সমস্ত রাসূল’ অথবা ‘সব রাসূল’ অর্থ গ্রহণ করলেও অন্তত আয়াতটির ‘খালা’ (قد خلت) শব্দ দ্বারা সমস্ত রাসূলের গত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘মৃত্যু’ বুঝানো জরুরি নয়। বড়জোর শব্দটির রূপক অর্থ হিসেবে ‘মউত’ বা মৃত্যু নেয়া সত্ত্বেই কতিপয় রাসূল ব্যতীত বাকি সমস্ত রাসূলকে মৃত বুঝাতে পারে! কেননা الرسل এর শুরুতে যুক্ত ال-কে ‘আহদে খারেজি’ বলা হয়। যার অর্থ, বিভিন্ন কারীনা বিদ্যমান থাকায় এখানে শর্ত প্রযোজ্য। মির্যায়ীদের নানা লিটারেচার-ও একথার সাক্ষী। প্রমাণের জন্য এখানে ক্লিক করুন। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে অত্র বিষয়ে লেখিত আর্টিকেলগুলোও পড়া যেতে পারে। উপরে লিংক দেয়া হয়েছে, দেখুন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কাদিয়ানীদের খলীফা ও খিলাফত একটি চরম উপহাস

কাদিয়ানীদের তথাকথিক খলীফা ও খিলাফত প্রসঙ্গ :

কাদিয়ানীদের লিফলেটে উল্লেখ আছে ‘ঐশী খিলাফতই ইসলামের উন্নতির মূলমন্ত্র’। তাতে আরো লিখা আছে, সেই ঐশী খিলাফতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে পঞ্চম খলীফার যুগ চলছে। তাঁর পবিত্র নাম হযরত মির্যা মাসরূর আহমদ। তাদের এ সমস্ত কথাবার্তার সারাংশ হল, শেষ যুগে ইমাম মাহদীর আগমনপূর্বক পৃথিবীতে যেই ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎবাণী সহীহ হাদীসগুলোতে এসেছে এটাই সেই খিলাফত! কিন্তু তাদের এই দাবী সম্পূর্ণ আজগুবি কল্পনা ও মুসলিম উম্মাহার সাথে চরম উপহাস বৈ নয়!

প্রথমত, তাদের কথিত ‘ঐশী খিলাফত’ ইসলামের সোনালী যুগের চার খলীফার নমুনায় সেই ‘খিলাফত’ কখনই নয়। তার অন্যতম কারণ, সহীহ হাদীসগুলোর কোথাও শেষ যামানার ‘খিলাফত’-কে ‘ঐশী‘ শর্তের ফ্রেমে বন্দী করার প্রমাণ নেই বরং হাদীস শরীফে চার খলীফার খিলাফতের ন্যায় শেষ যুগের ইমাম মাহদীর প্রতিষ্ঠিত খিলাফতকেও ‘খিলাফত আ’লা মিনহাজিন নবুওয়ত’ (خلافة على منهاج النبوة) বলেই আখ্যা দেয়া হয়েছে! (দেখুন, মুসনাদে আহমদ হাদীস নং ১৭৬৮০)। তাদের কথিত খিলাফতকে চরম হাস্যকর প্রমাণ করার জন্য সিহাহ সিত্তা’র অন্যতম আবুদাউদ শরীফের দীর্ঘ একটি হাদীসের এই অংশটুকুই যথেষ্ট। যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে : ‘আল-খিলাফাতু ছালাছূনা সানাতান ছুম্মা তাকূনু বা‘দা যালিকা মালিকান’ (الخلافة ثلاثون سنة ثم تكون بعد ذالك ملكا)। অর্থাৎ ‘খিলাফত ত্রিশ বছর অব্ধি থাকবে তারপর বাদশাহী শাসন আরম্ভ হবে (হা/৪৬৪৬)’। আমরা এখানে স্পষ্টত দেখতে পেলাম, রাসূল (সা:)-এর হাদীসটিতে ‘খিলাফত’ শব্দকে ‘ঐশী’ সহ সব ধরণের Condition বা শর্ত থেকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখা হয়েছে। তাই কাদিয়ানীদের বর্তমান নখদন্তহীন কথিত ‘ঐশী খিলাফত’ আর যাইহোক না কেন, কোনোভাবেই সাহাবীদের নমুনার ‘রাষ্ট্র-ব্যবস্থামূলক’ খিলাফত নয়-ই প্রমাণিত হল।

দ্বিতীয়ত, তাদের এই কথিত খিলাফত ‘খিলাফত আ’লা মিনহাজিন নবুওয়ত’ [অর্থাৎ চার খলীফার নমুনায় নবুওয়তে মুহাম্মদী পন্থায় রাষ্ট্রব্যবস্থামূলক খিলাফত] হলে তখন তাদের নিকট নিচের প্রশ্নগুলোর আর কোনোই জবাব থাকেনা। এই পর্যায় প্রশ্নগুলো করার আগে বলে রাখতে চাই যে, আন্তর্জাতিক বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া’র ভাষ্যমতে, খিলাফত হল, সরকারের ইসলামী রূপ যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক একতার প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধরণের শাসন ব্যবস্থার সরকার প্রধানকে খলীফা বলা হয়। তারপর খলীফা [আরবি : خليفة‎‎] শব্দটির আভিধানিক অর্থ উত্তরাধিকারী, প্রতিনিধিত্বকারী, সেনাপ্রধান। ইসলামী পরিভাষায় খলীফা হলেন এমন ব্যক্তি যিনি যাবতীয় বিষয়ে শরিয়ত অনুযায়ী সমস্ত উম্মতকে পরিচালিত করেন। ইসলামী রাষ্ট্রে খলীফা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর, শাসক, নেতা, [কাযী] নিযুক্ত করেন।

  • ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামী সোনালী যুগে প্রতিষ্ঠিত ‘খিলাফত’ সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হওয়ার মধ্য দিয়ে সমগ্র আরব উপদ্বীপ, লেভ্যান্ট থেকে উত্তর ককেসাস, পশ্চিমে মিসর থেকে বর্তমান তিউনিসিয়া ও পূর্বে ইরানীয় মালভূমি থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেই সময় খিলাফতের রাজধানী ছিল, যথাক্রমে মদীনা (৬৩২-৬৫৬খ্রি:) এবং কূফা (৬৫৬-৬৬১খ্রি:)। আরো ছিল সুশৃঙ্খল সামরিক ফোর্স যাতে নিয়মিত সৈন্যবাহিনী ছিল সর্বনিম্ন ১,০০,০০০ (এক লক্ষ)। যাদের বেতন ভাতার জন্য ছিল বায়তুলমাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগার। তাই আপনাদের [অর্থাৎ কাদিয়ানিদের] এই খিলাফত যদি প্রকৃতই চার খলিফার নমুনায় খিলাফত ব্যবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে সর্বাগ্রে প্রশ্ন আসবে, আপনাদের খিলাফত রাষ্ট্র কোথায়? সুনির্দিষ্ট কোনো ভুখন্ড আপনাদের খলীফার শাসনের অধীনে নেই কেন? সাহাবীদের খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকলে আপনাদের কেন থাকবেনা? যেখানে আপনাদের কর্তৃত্বাধীন কোনো খিলাফত রাষ্ট্রই মজুদ নেই সেখানে খিলাফত রাষ্ট্রের রাজধানী কিবা সামরিক ফোর্স নিয়ে কী আর প্রশ্ন করব বলুন! কাজেই ব্রিটিশ আশ্রিত নখদন্তহীন আপনাদের খলীফারা নামমাত্র খলীফা ছাড়া আর কী? ফলে আপনাদের ‘বায়তুলমাল’ প্রতিষ্ঠার দাবীটাও বড্ড হাস্যকর বিনে কিছুই না!

সুতরাং আপনাদের দাবী, ঐশী খিলাফতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে পঞ্চম খলীফার যুগ চলছে, সম্পূর্ণ মিথ্যা ও আজগুবি কথা!

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

সহীহ হাদীসের আলোকে ঈসা এবং ইমাম মাহদী তারা দুইজন-ই

শেষ যুগে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যেই প্রতিশ্রুত মসীহ এবং ইমাম মাহদীর আবির্ভাব হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী হাদীসসমূহে এসেছে সেই মসীহ এবং ইমাম মাহদী তারা ভিন্নভিন্ন চরিত্রের হওয়া সত্ত্বেও মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে একই সাথে ইমাম মাহদী এবং মসীহ হওয়ার দাবী করেছিল। তাই এবার আসুন জেনে নিই, প্রতিশ্রুত মসীহ এবং প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী এঁরা একই ব্যক্তি নাকি ভিন্ন ভিন্ন দুই ব্যক্তি?

[১] বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) বলেন, আমি নবী (সা:)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন :

  • لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ قَالَ فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا فَيَقُولُ لاَ.‏ إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ ‏.‏ تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ‏ ‏‏

অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের একটি দল হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে এবং অবশেষে ঈসা (আ:) অবতরণ করবেন। (সেই সময়কার) মুসলমানদের ‘আমীর’ (নেতা) বলবেন, আসুন সালাতে আমাদের ইমামতি করুন! তারপর তিনি (ঈসা) বলবেন, না; নিশ্চয় আপনারাই একে অন্যের ইমাম। এই হলো আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত এ উম্মতের সম্মান। (রেফারেন্স, সহীহ মুসলিম, খন্ড নং ১, কিতাবুল ঈমান, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শরীয়ত অনুসারী প্রশাসক হিসেবে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) এর অবতরণ শীর্ষক পরিচ্ছেদ, হাদীস নং ১৫৬)। এই হাদীসে ঈসা (আ:) অবতরণ করার পরে সেই সময়কার মুসলমানদের আমীরের সাথে তৎক্ষণাৎ সালাতের ইমামতির বিষয়ে দুই পক্ষের কথাবার্তার উল্লেখ রয়েছে। তাদের একজন ঈসা (আ:) আর অন্যজন মুসলমানদের ‘আমীর তথা নেতা’। মূলত, সেই ‘নেতা’-ই কিন্তু ইমাম মাহদী। একথার প্রমাণ একই সাহাবী থেকে ভিন্ন আরেকটি সহীহ হাদীসে নিম্নরূপ বর্ণিত আছে। যেমন :

[২] হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন রাসূল (সা:) বলেছেন :

  • يَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ فَيَقُولُ أَمِيْرُهُمُ الْمَهْدِيْ تَعَالَ صَلِّ بِنَا فَيَقُولُ لاَ.‏إِنَّ بَعْضَهُمْ أَمِيْرُ بَعْضٍ تَكْرِمَةَ اللَّهِ لِهذه الأُمةِ‏‏

অর্থাৎ, ঈসা (আ:) অবতরণ করবেন। অতপর মুসলমানদের আমীর ইমাম মাহদী বলবেন, আসুন সালাতে আমাদের ইমামতি করুন! তারপর তিনি বলবেন, না; নিশ্চয় তাদেরই একে অন্যের ইমাম। এটি আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত এই উম্মতের সম্মান। [দেখুন, ইমাম বুখারীর উস্তাদ হাফেযুল হাদীস আবু আব্দুল্লাহ নু’আইম বিন হাম্মাদ সংকলিত আখবারুল মাহদী; বিশিষ্ট যুগ ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ:) বলেছেন, এই হাদীসের সনদ জায়্যিদ বা খুবই ভাল; আল-মানারুল মুনীফ পৃষ্ঠা নং ১৪৭; শায়খ আলবানী (রহ:) বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ এবং তিনি স্বীয় কিতাব ‘আস-সিলসিলাতুস সহীহা’তেও এনেছেন। হাদীস নং ২২৩৬]। উক্ত হাদীসটিতে ‘আমীরুহুম আল-মাহদী’ [أميرهم المهدي] অর্থাৎ মুসলমানদের আমীর ইমাম মাহদী-এভাবেই কিন্তু পরিষ্কার উল্লেখ আছে। সুতরাং মুসলিম শরীফের হাদীস এবং এই হাদীসদুটো মিলে একদম সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আগত মসীহ আর প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন দুইজনই।

[৩] রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন :

  • يكون في زمن المهدي ويصلى عيسى خلفه (ইয়াকূনু ফী যামানিল মাহদী ওয়া ইউসাল্লী ঈসা খালফাহু)

অর্থাৎ ইমাম মাহদী’র যুগেই ঈসার আগমন হবে এবং তিনি ইমাম মাহদী’র পেছনে সালাত পড়বেন।’ [রেফারেন্স : কাঞ্জুল উম্মাল খন্ড নং ৫ পৃষ্ঠা নং ৩৮৩; হাদীস নং ৭৩৮৪; কিতাবুল ফিতান মানাকিবুল মাহদী, সংকলক ইমাম বুখারীর উস্তাদ হাফেযুল হাদীস আবু আব্দুল্লাহ নু’আইম বিন হাম্মাদ; মুসনাদে আহমদ, মুসতাদ্রিক লিল হাকিম। হাদীসের মান : সহীহ]। এই তো অতি সামান্য। পরন্তু সিহাহ সিত্তাহসহ প্রায় সব কয়টি হাদীসের কিতাবে ঈসা (সা:)-এর দ্বিতীয়বার আগমন করার সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান।

সুতরাং মির্যা কাদিয়ানী সে মসীহ কিংবা ইমাম মাহদী হবে তো দূরের কথা বরং সে মসীহ এবং মাহদী একই সঙ্গে দুইজন হওয়ার দাবী করে শুধু ভন্ড সাব্যস্ত হয়নি, বরং রাসূল (সা:)-এর হাদীসকে বিকৃত করে সে মহা প্রতারকে পরিণত হয়েছে।

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মুসলমান আর কাদিয়ানীদের মধ্যকার পার্থক্য

মির্যা কাদিয়ানী কোথায় এবং কিভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল?

কাদিয়ানী সম্প্রদায় হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর পরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকেও একজন নবী ও রাসূল বলিয়া বিশ্বাস করে। তাই এরা দুনিয়ার সমস্ত মুসলিম স্কলারদের সর্বসম্মতিক্রমে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত ও কাফের জাতির অন্তর্ভুক্ত। নিচে তাদেরই বিভিন্ন রচনাবলী থেকে তাদের এবং মুসলমানদের মাঝে মৌলিক পার্থক্যগুলো কী কী তা সপ্রমাণে দেখানো হল! স্ক্রিনশট দেখুন

একটি ভুল সংশোধন ৮; মির্যা কাদিয়ানী

এক. কাদিয়ানীদের ধর্মবিশ্বাস :
সকলের অবগতির জন্য বলা জরুরী, কাদিয়ানিদের ‘লিফলেট’ এর মধ্যে ‘নূরুল হক’ নামক যে বই থেকে তাদের ধর্মবিশ্বাস উল্লেখ রয়েছে ওই বইটি মির্যা কাদিয়ানী ১৮৯৪ সালের দিকে লিখেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যকথা হল, ১৯০১ সালের পর মির্যা কাদিয়ানী তার পূর্বেকার নবুওয়ত সংক্রান্ত ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করে ফেলেন। আমরা এই তথ্য তাদেরই সেকেন্ড খলিফা(!) মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদের বই থেকে পাই। [দেখুন, ২৬ খন্ডে প্রকাশিত তার রচনা-সমগ্র ‘আনওয়ারুল উলূম’ খন্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ৪৪৫]।

তাই আসুন ১৯০১ সালের পর মির্যা কাদিয়ানীর চূড়ান্ত আকীদা কেমন ছিল তার সামান্য কিছু এখান থেকে জেনে নিই।

নবী রাসূল দাবী :
মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী লিখেছেন, আমার দাবী, আমি একজন নবী ও রাসূল। (মির্যা কাদিয়ানির রচিত, মালফুযাত [ঊর্দু] ৫/৪৪৭; নতুন এডিশন)।

অ-কাদিয়ানিরা মুসলমান নয় :
মির্যা কাদিয়ানী বলেছেন, খোদাতালা আমার উপর প্রকাশ করেছেন যে, যাদের নিকট আমার দাওয়াত পৌঁছেছে আর তারা তা কবুল করেনি এরা মুসলমান নয় এবং এরা পাকড়াও হবে। (তাযকিরাহ, পৃষ্ঠা নং ৫১৯; ইলহাম, মার্চ ১৯০৬ ইং, চতুর্থ এডিশন)।

এতেই প্রমাণিত হল, মূলত মির্যা প্রকৃতপক্ষে নবী ও রাসূল হওয়াই দাবী করত। তার জিল্লি বুরূজি আর উম্মতি এই শব্দগুলো নিছক সাধারণ মানুষকে চিন্তাগতভাবে বিভ্রান্ত করার কৌশল ছিল। নইলে তাকে অস্বীকার করলে অমুসলমান হবে কেন?

মুহাম্মদ (সা:) চেয়েও মির্যা কাদিয়ানী শ্রেষ্ঠ :
মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, “এটা সম্পূর্ণ সঠিক কথা যে, প্রত্যেক ব্যক্তি (আধ্যাত্মিক জগতে) উন্নতি সাধন করতে পারে এবং উঁচু থেকে উঁচু মর্যাদা পেতে পারে। এমনকি মুহাম্মদ (সা:)-কে পেছনে রেখে সামনে বেড়ে যেতে পারে।” (আখবারে ফজল, ভারতের পাঞ্জাবের কাদিয়ানী দারুল আমান থেকে প্রকাশিত, নং ৫ জিলদ ১০, তারিখ ১৭ ই জুলাই ১৯২২ ইং)। নাউযুবিল্লাহ। এবার দেখুন, মুহাম্মদ (সা:) থেকেও মর্যাদায় সামনে বেড়ে যাওয়া ব্যক্তিটি নাকি মির্যা কাদিয়ানী! প্রমাণস্বরূপ কাদিয়ানী ঘরানার আরেকটি পত্রিকা ‘আখবারে বদর’ ২৫ অক্টোবর ১৯০৬ ইং সংখ্যায় উল্লেখ আছে, মির্যা কাদিয়ানীর সম্মুখে কাজী জহূর উদ্দিন আকমল একটি কবিতা পাঠ করেছিল।

কবিতার অর্থ ‘মুহাম্মদ আবার আমাদের মাঝে এসেছে এবং মর্যাদায় আগের (মুহাম্মদের) চেয়ে সামনে বেড়ে গেছে, পূর্ণাঙ্গ মুহাম্মদকে যদি কেউ দেখতে চাও তাহলে গোলাম আহমদকে দেখে যাও কাদিয়ানে।’ মির্যা কাদিয়ানী এই কবিতা শ্রবণ করার পর ওই ব্যক্তিকে ‘জাজাকুমুল্লাহ’ বলার কথাও ছাপিয়ে এসেছে। (দেখুন, দৈনিক আখবারে ফজল, পৃষ্ঠা নং ৪, কলাম ১; ২২ শে আগস্ট ১৯৪৪ ইং)। নাউযুবিল্লাহ। এতেই প্রমাণিত হল, মির্যা কাদিয়ানী তার শিষ্যের আবৃত্তির সাথে সহমত। যার ফলে মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে মুহাম্মদ (সা:) থেকেও মর্যাদায় বড় দাবী করা সাব্যস্ত হল। এর চেয়ে জঘন্যতম নবী অবমাননা আর কী হতে পারে?

মির্যা কাদিয়ানী তার শিষ্যকে ‘জাজাকুমুল্লাহ‘ বলার ডকুমেন্ট। দৈনিক আল ফজল ২২ আগস্ট ১৯৪৪ ইং

মুমিন হওয়ার মানদন্ড :
‘কালিমাতুল ফছল’ বইতে মির্যা কাদিয়ানীর কথিত একটি ইলহামের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখা আছে, ‘এই ইলহাম দ্বারা পরিস্কার বুঝা গেল যে, আল্লাহ তায়ালা এই যামানায় মুমিন হওয়ার মানদন্ড স্থির করেছেন মাসীহ মওঊদ [অর্থাৎ মির্যা কাদিয়ানী]’র উপর ঈমান আনয়ন করাকে। সুতরাং মসীহ মওঊদকে যেই অস্বীকার করে তার পূর্বের ঈমানও যাবে।’ (কালিমাতুল ফছল বা রিভিউ অফ রিলিজন্স (উর্দু), তৃতীয় অধ্যায় পৃষ্ঠা নং ৫২ [হার্ডকপি]; লিখক, মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক ‘কমরুল আম্বিয়া’ খ্যাত মির্যা বশির আহমদ এম. এ, প্রকাশকাল ১লা মে ১৯১৫ ইং, কাদিয়ান দারুল আমান থেকে প্রকাশিত)। এতে সাব্যস্ত হল, তারা নিজেদের বাহিরে কোনো মুসলমানকে মুসলমানই মনে করেনা। কাজেই “কে মুসলমান আর কে কাফের তা একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন” এইরূপ সস্তা কথাবার্তা অন্তত কাদিয়ানীদের মুখে মানায় না। স্ক্রিনশট দেখুন

কলেমার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র তাৎপর্য :
‘কালিমাতুল ফছল’ বইতে কলেমা তাইয়্যেবাহ সম্পর্কে জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে মির্যা কাদিয়ানীর ছেলে লিখেছেন: “আমাদের নতুন কোনো কলেমার প্রয়োজন নেই। কেননা মসীহে মওঊদ [মির্যা কাদিয়ানী] নবী করীম (সা:) থেকে ভিন্ন কেউ নন। তিনি নিজেও বলতেন, আমার সত্তা তাঁর সত্তাতে পরিণত। এমনকি [তিনি এও বলতেন] যে ব্যক্তি আমার আর মুহাম্মদ মুস্তফার মাঝে পার্থক্য করে সে না আমাকে চিনল, না আমাকে দেখল। এটি এইজন্য যে, আল্লাহতায়ালার ওয়াদা ছিল, তিনি খাতামুন নাবিয়্যীন [মুহাম্মদ মুস্তফা]’কে দুনিয়াতে আরেকবার পাঠাবেন। যেমন ‘ওয়া আখারীনা মিনহুম’ আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট। সুতরাং মসীহে মওঊদ-ই স্বয়ং মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ। যিনি ইসলাম প্রচার করতে দুনিয়াতে দ্বিতীয়বার আগমন করেছেন। তাই আমাদের [কাদিয়ানিদের] জন্য নতুন কোনো কলেমার প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ যদি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র স্থলে অন্য আর কেউ আসত তখনই কেবল [নতুন কলেমার] প্রয়াজন পড়ত।” (কালিমাতুল ফছল ৬৮, ষষ্ঠ অধ্যায়)।

প্রত্যেক বিষয়ে মতবিরোধ :
মির্যার বড় ছেলে এবং কাদিয়ানিদের দ্বিতীয় খলীফা(?) বশির উদ্দিন মাহমুদ তিনি কাদিয়ানে তাদের জুমার খুতবায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন “তিনি (মির্যা) বলেছেন, এটা ভুল কথা যে, অন্যদের [মুসলমানদের] সাথে আমাদের বিরোধ শুধু ঈসা (আ:) এর মৃত্যু বা আরো কিছু শাখাগত মাসয়ালা নিয়ে। হযরত (মির্যা) সাহেব বলেছেন, আল্লাহতালার সত্তা, রাসূল, পবিত্র কুরআন, নামায, রোজা, হজ্ব ও যাকাত মোটকথা তিনি (মির্যা) বিস্তারিত বলে গেছেন যে, প্রত্যেকটি বিষয়ে তাদের [মুসলমানদের] সাথে আমাদের বিরোধ আছে।” [দৈনিক ‘আল ফজল’ তাং ৩০ জুলাই, ১৯৩১ ইং পৃষ্ঠা নং ৭, কলাম ১]।

এবার চিন্তা করে দেখুন, এইধরণের কথাবার্তা যাদের বইপুস্তকে লিখা থাকে আর যারা এদের অনুসারী হিসেবে নিজেদের ‘আহমদী মুসলমান’ বলে পরিচয় দেয় তাদের সাথে শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর রেখে যাওয়া ইসলামধর্মের ন্যূনতম সম্পর্ক কোথায়? এমন জঘন্য ধর্মমত পোষণকারীর কোনো নেক আমল কস্মিনকালেও কি গ্রহণযোগ্য? দয়াকরে শুধুমাত্র একবার কথাগুলো নিয়ে ভাবুন এবং নিরপেক্ষতার সাথে সত্য-মিথ্যা যাচাই করুন!

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক