Home Blog Page 36

ঈসা (আ:) এর আয়ুষ্কাল দীর্ঘ করে দেয়া

0

প্রশ্ন :- পবিত্র কুরআন এবং সহীহ হাদীসের আলোকে প্রতিশ্রুত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর হায়াত শেষ যামানা পর্যন্ত বিলম্বিত হওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত কিনা?

উত্তর :- হ্যাঁ শেষ যামানা পর্যন্ত আল্লাহতালা ঈসা (আ:)-এর হায়াত বিলম্বিত করে দেয়া পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা ইংগিতে এবং হাদীস শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত আছে। পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ দেখুন। সূরা যুখরূফ এর ৫৯ আর ৬১ নং আয়াত দুটোর সমন্বিত মর্মার্থ নিয়ে একটু ভেবে দেখুন। আল্লাহ’র রহমতে আপনি সঠিক মাসয়ালায় পৌঁছে যাবেন, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতালা হযরত ঈসা (আ:)-এর হায়াত কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিলম্বিত করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবী রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে নিচের হাদীসটির অনুবাদ দেখুন!

রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন- “ওয়া মাদ্দা ফী উমরিহি হাত্তা আহবাতা মিনাস সামায়ী ইলাল আরদ্বি। ওয়া ইয়াক্বতুলুদ দাজ্জালা।” অর্থাৎ আল্লাহতালা তাঁর (ঈসা) হায়াত দীর্ঘ করে দিয়েছেন। এমনকি তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। (দেখুন, ইমাম জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী রহঃ রচিত ‘দুররে মানছূর’ খন্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ৩৫০)। ইবনে আব্বাস থেকে উক্ত হাদীসটি ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) পবিত্র কুরআনের – ইন তু’আয্যিবহুম ফা-ইন্নাহুম ইবাদুকা’ শীর্ষক আয়াতের তাফসীর অংশে উল্লেখ করেছেন।

মির্যা কাদিয়ানীর বাগাড়ম্বর ও তার খন্ডনঃ

প্রিয়পাঠক! এবার জানতে হবে, মির্যা কাদিয়ানী নিজের দাবীটি কিরকম শব্দচয়নে করে গেলেন? জ্ঞানীদের নিকট গোপন থাকেনি যে, মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীরা পবিত্র কুরআনের মধ্যে অপব্যাখ্যা দিয়ে দাবী করতে চায় যে, প্রতিশ্রুত ঈসা (আ:)-কে ইহুদীরা নাকি শূলিতে চড়িয়েছিল (নাউজুবিল্লা) এবং তিনি (শূলি থেকে অব্যাহতি পেয়ে) পরবর্তীতে গোপনে ফিলিস্তিন ছেড়ে কাশ্মীরে পালিয়ে যায়। সেখানেই তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করা শেষে ১২০ বছর বয়সে মারা যান। এছিল মির্যা কাদিয়ানির বক্তব্য। মা’আজাল্লাহ।

আমি কাদিয়ানিদের উক্ত দাবী কিছুক্ষণের জন্য তর্কের খাতিরে মেনে নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিতে চাই! তা হল, হযরত ঈসা (আ) বর্তমানে জীবিত না থাকলে পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে কেন তার পুনঃ আগমনের ভবিষৎবাণী এলো? আমি আরো জানতে চাই, পবিত্র কুরআন এবং সহীহ হাদীসে শেষ যুগে আগমনকারী সম্পর্কে “ইবনে মরিয়ম” উল্লেখ আছে। কোথাও “মাছীলে ইবনে মরিয়ম” তথা ‘ইবনে মরিয়মের অনুরূপ’ কারো আসার কথা নেই। এমতাবস্থায় মির্যা কাদিয়ানী কিজন্য প্রতিশ্রুত সেই মাসীহ ঈসা নামে সম্বোধিত হবেন? এ প্রশ্নগুলোর সমাধান কোথায়?

  • এবার আপনি হয়ত জানতে চাচ্ছেন যে, হযরত ঈসা (আ)-এর পুনঃ আগমন সম্পর্কে ইঙ্গিত কোথায়?

তার জবাবে সংক্ষেপে মাত্র কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করছি। আল্লাহতালা ইরশাদ করেন – “তিনি (ঈসা) পরিণত বয়সেও মানুষের সাথে কথা বলবেন।” (সূরা আলে ইমরান ৪৮)।

“নিশ্চয় তিনি [ঈসা] কেয়ামতের একটি আলামত বা নিদর্শন (সূরা যুখরুফ ৬১)”।

এ আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) একদম খুলে খুলে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, “এর দ্বারা কেয়ামতের নিকটবর্তী সময় হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ)-এর আত্মপ্রকাশ কেয়ামতের-ই অন্যতম একটি আলামত।” বিস্তারিত দেখুন ইবনে কাসীর ৪র্থ খন্ডের ১৩৩ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৫৯ নং আয়াতটিও দেখুন। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে সকল ইহুদ খ্রিষ্টান তাঁর প্রতি ঈমান আনবে।

সূরা মায়েদার ১১০ নং আয়াতটিও দেখুন। ঈসা (আ)-কে আল্লাহতালা ইহুদীদের ধরপাকড় থেকে নিবৃত্ত রেখেছিলেন যখন তারা তাঁকে মেরে ফেলার ইচ্ছে করেছিল। অর্থাৎ ইহুদীরা তাঁকে পাকড়াও করবে তো দূরে থাক, তাদেরকে তাঁর কাছেও ভিড়তে দেননি।

সূরা আলে ইমরান ৫৫ নং আয়াতটিও দেখুন। আল্লাহ তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন। আরেকটু পেছনে সূরা আলে ইমরানের ৫৪ নং আয়াতে ফিরে যান। আল্লাহতালা ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের মুকাবেলায় নিজের অবস্থান জানান দিয়ে বলেন – ওয়ামাকারু ওয়ামা কারাল্লাহ ওয়াল্লাহু খাইরুল মাকিরীন অর্থাৎ “তারা চক্রান্ত করেছিল আর আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্রের মুকাবেলায় উত্তম কৌশলী।” এখন ভাবনার বিষয় যে, ইহুদিদের ষড়যন্ত্র যদি ঈসাকে পাকড়াও করে হাতে পায়ে পেরেগ বিদ্ধ করে প্রাণবধ করতে শূলিতে স্থাপনকরাই হয়, তখন এর বিপরীতে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ’র সুকৌশলী ব্যবস্থাটি কি ঈসাকে ইহুদীদের হাতে তুলে দেয়া? জ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলবে কিনা?

  • মনে রাখতে হবে যে, পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা পবিত্র সহীহ হাদীস। এবার দীর্ঘ আলোচনার খোলাসা নিম্নোক্ত হাদীসগুলোর আলোকে বুঝে নিন! হাদীস শরীফে রাসূলেপাক (সা:) বলেছেনঃ

১- আল্লাহ’র শপথ অতি সত্বর নিশ্চয় ইবনে মরিয়ম একজন ন্যায় পরায়ণ শাসক হিসেবে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন (সহীহ বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া – ৩২৬৪)।

২- ইবনে মরিয়ম আকাশ থেকে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন। (ইমাম বায়হাক্বী সংকলিত ‘আল-আসমা ওয়াছ ছিফাত’ পৃষ্ঠা নং ৩৩১; হাদীস নং ৮৯৫)।

৩- সেই মুহূর্তে মরিয়ম পুত্র ঈসা তিনি দুজন ফেরেশতার পাখার উপর আপনা বাহুদ্বয় রেখে পৃথিবীতে নাযিল হবেন। (মুসলিম শরীফ ৫০১; কিতাবুল ফিতান অধ্যায়)।

৪- আমার ভাই ঈসা ইবনে মরিয়ম সিরিয়ার পূর্ব দিকে সাদা মিনারার নিকট আফিক নামক পর্বতের উপর আকাশ থেকে নাযিল হবেন। (কাঞ্জুল উম্মাল খন্ড নং ১৪ পৃষ্ঠা নং ৬১৯; হা/৩৯৭২৬, ইবনে আসাকীর)।

এবার কাদিয়ানিবন্ধুদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন হল, হযরত ঈসা (আ:) এর পুনরায় আগমন দ্বারা যদি আপনাদের মির্যা কাদিয়ানী-ই উদ্দেশ্য হন তাহলে বলুন তো মির্যা সাহেব ইতিপূর্বে দুনিয়াতে আরেকবার কখন কোথায় এসেছেছিলেন? কেননা “পুনঃ আগমন” (ঊর্দূভাষায় : দো-বারা) বলতে তো এটাই বুঝাবে যে, তিনি ইতিপূর্বে আরেকবার এসেছিলেন, তাই নয় কি?

আমার বুঝে আসেনা, এরকম একটি দিব্যি সত্যকে চেপে রাখতে আপনাদের মির্যা কাদিয়ানী কিজন্য যতসব মিথ্যা আর অহরহ বিদঘুটে অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন? অথচ বেশিদূর যেতে হবেনা শুধুমাত্র সূরা যুখরূফ এর ৬১ নং আয়াতের দুই লাইন উপরের আয়াতটির অনুবাদ দ্বারা সমাধান পাওয়া সম্ভব যে, শেষযুগে অত্যাসন্ন মাসীহ ঈসা হতে মাসীহে ইসরাইলি-ই উদ্দেশ্য। যেখানে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে ‘ওয়াজা’আলনাহু মাছালান লি-বানী ইসরাঈল। অর্থাৎ (আল্লাহতালা ইরশাদ করছেন) তাঁকে বনী ইসরাঈলের জন্য আমি (আমার কুদরতের) একটা আদর্শ বানিয়েছিলাম।” তার দুই লাইন পরেই কিন্তু উল্লেখ আছে, “নিশ্চয় সে (মরিয়মের পুত্র ঈসা) হবে (মূলত) কেয়ামতের একটি নিদর্শন।”

এবার আয়াত দুটির সমন্বিত মর্মার্থ দাঁড়াল এই যে, কেয়ামতের একটি নিদর্শন যেই ঈসা তিনি নিঃসন্দেহ সেই ব্যক্তি যাকে ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলের জন্যে খোদাতায়ালা তার কুদরতের একটি নিদর্শন বানিয়েছিলেন, তাই নয় কি? সুতরাং মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার মাসীহ দাবীর ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী এবং ভন্ড প্রমাণিত হল। আহমদীবন্ধুদের উচিৎ পবিত্র কুরানের এ সুস্পষ্ট মর্মবাণীর সাথে সহমত পোষণ করে মির্যা কাদিয়ানীকে ত্যাগ করে ইসলামে ফিরে আসা। আল্লাহতালা আমাদের সবাইকে সত্য বুঝে তা মেনে নেয়ার হিম্মত দান করুন। আমীন।

  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

তাওয়াফফা ও লাম্মা তাওয়াফফাইতানী এর সঠিক ব্যাখ্যা

0

দয়া করে কোনো কাদিয়ানী সম্পূর্ণ লিখাটি না পড়ে কোনোরূপ মন্তব্য করবেন না!

‘তাওয়াফ্ফা’ শব্দের বিশ্লেষণ ও আমার তিনটি প্রশ্ন :

  • প্রশ্ন : ‘তাওয়াফফা’ শব্দের আভিধানিক আর ব্যবহারিক (পারিভাষিক) অর্থ নিয়ে কাদিয়ানীদের খুব বেশি ধূম্রজাল সৃষ্টি করতে দেখেছি। তাই এই সম্পর্কে জানাবেন!

উত্তর : আপনার প্রশ্নমতে উত্তরে আসার আগে দুটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সে সাথে উত্তরের শেষাংশে ৩টি পাল্টা প্রশ্ন থাকবে।

দুটি বিষয় এই যে, ‘তাওয়াফফা’ (توفي) শব্দযোগে গঠিত কোনো আয়াত বা হাদীসের অনুবাদ কিংবা ব্যাখ্যা নেয়ার ক্ষেত্রে নিচের দুটি বিষয়ে খেয়াল রাখা অপরিহার্য।

(১) আয়াতটির তাওয়াফফা শব্দটি হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) প্রসঙ্গে ব্যবহার হল কিনা?

(২) হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) ছাড়া ভিন্ন আর কোনো প্রসঙ্গে ব্যবহার হল কিনা? এই দুই অবস্থায় ক্বারীনার বিচারে তাওয়াফফা’র প্রকৃত মর্মার্থ কী তা নির্ণয় হবে।

মির্যা কাদিয়ানীর নবী ও রাসূল দাবী করার প্রমাণ

‘তাওয়াফফা’ শব্দের ব্যবহার বিধি : প্রথমেই বলে রাখতে চাই যে, এখানে “তাওয়াফফা” এর ব্যবহার বিধি নিয়ে যা লিখব তার সিকিভাগও আমি আমার নিজ থেকে লিখব না, বরং সম্পূর্ণ লিখাটিই এমন দুইজন বিশিষ্ট তাফসীরকারক ও যুগ ইমামের (ইবনে তাইমিয়াহ, আল্লামা শাওক্বানী) উদ্ধৃতি দিয়ে লিখব যাঁরা খোদ মির্যা কাদিয়ানীর নিকটও বরেণ্য ও যুগ ইমাম হিসেবে স্বীকৃত। যুগ ইমাম সম্পর্কে একটু পরেই মির্যা কাদিয়ানীর উদ্ধৃতি সহ লিখা হবে, ইনশাআল্লাহ। চলুন! আগের বিষয়টিতে আবার ফিরে যাই। তাওয়াফফা শব্দটি যদি ঈসা (আ:) প্রসঙ্গে ব্যবহার হয় তখন অসংখ্য ক্বারীনা (নিদর্শন) এর কারণে সেটির ব্যবহারিক অর্থ ‘সশরীরে নিয়ে নেয়া’-ই উদ্দেশ্য হবে। আর যদি হযরত ঈসা (আ:) ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ব্যবহার হয় তখন শব্দটির মর্মগত উদ্দেশ্য ক্বারীনা’র বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ‘তাওয়াফফা’ অর্থ কোথাও ঘুম বা অচেতন উদ্দেশ্য হবে। আবার কোথাও মৃত্যু উদ্দেশ্য হবে। মনে রাখতে হবে যে, ক্বারীনা’র কারণে ‘তাওয়াফফা’ এর যতগুলো ব্যবহারিক অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া হবে তার সবগুলোই মাজাজ তথা রূপক। অধিকন্তু ‘তাওয়াফফা’ শব্দটির মূল ধাতু হল ‘ওয়াফ্ইউ’ (وفي) যেটি বাবে তাফা’উল এর মধ্যে থেকেتوفي  রূপে আশ্রিত হয়ে অর্থ দেবে ‘নিয়ে নেয়া’ অথবা ‘পূর্ণকরা’ (‘লিসানুল আরব’ দ্রষ্টব্য)। এবার একথাগুলোই উক্ত বিশিষ্ট দুই যুগ ইমামের উদ্ধৃতিতে দেখা যাক।

প্রথমত, শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ (রহ:) রচিত ‘আল জাওয়াবুস সহীহ লি-মান বাদ্দালা দীনাল মসীহ’ (৪/৩৮) নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তাওয়াফফা শব্দটি পবিত্র কুরআনে ব্যবহারিক দিক থেকে তিনটি অর্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা, ঘুম বা অচেতন, মৃত্যু বা প্রাণ হরণকরা এবং শরীর আর রূহ দুটো একত্রে নিয়ে নেয়া

দ্বিতীয়ত, ইমাম শাওক্বানী (রহ:) রচিত ‘ফাতহুল ক্বাদীর’ (৭/৪০৬; সূরা মায়েদা ১১৭) এর মধ্যেও উল্লেখ আছে যে, তাওয়াফফা শব্দটি পবিত্র কুরআনের মধ্যে ব্যবহারিক দিক থেকে তিনটি অর্থেই উল্লেখ হয়েছে। যথাক্রমে ঘুম, মৃত্যু বা প্রাণ হরণকরা এবং সশরীরে নিয়ে নেয়াস্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য। এবার ‘তাওয়াফফা’ শব্দের আভিধানিক (আক্ষরিক) অর্থ এবং ব্যবহারিক অর্থের উদাহরণ দেখুন!

তাফসীরে ফাতহুল কাদীর, বিশিষ্ট যুগ-ইমাম আল্লামা শাওক্বানী

‘তাওয়াফফা’ শব্দযুক্ত কতিপয় উদাহরণ : ‘তাওয়াফফা’ এর আভিধানিক অর্থ উদ্দেশ্য নেয়ার উদাহরণ :

(১) সূরা নিসা আয়াত নং ১৫ দ্রষ্টব্য। যেমন আল্লাহতালা ইরশাদ করেন: فإن شهدوا فامسكوهن فى البيوت حتى يتوفهن الموت  (উচ্চারণ) ফা ইন শাহিদূ ফা আমছিকূহুন্না ফিল বুয়ূতি হাত্তা ইতাওয়াফফাহুন্নাল মওতু। অর্থাৎ যদি তাহারা (ব্যভিচারিণী মহিলা) সাক্ষ্য দেয় তবে তাহাদেরকে গৃহে অবরুদ্ধ করিবে, যে পর্যন্ত না মৃত্যু তাহাদের নিয়ে নেয়। এখানে মৃত্যু অর্থের জন্য আরবী শব্দ الموت  (আল-মওত) এর পাশাপাশি توفى  (তাওয়াফফা) শব্দও রয়েছে। ফলে বুঝাই যাচ্ছে দুটির ভিন্ন ভিন্ন অর্থই ধর্তব্য হবে। মনে রাখতে হবে, এখানে ‘মওত’ শব্দ উল্লেখ থাকায় ‘তাওয়াফফা’ তার আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহার হয়েছে।

(২) সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৬১। আল্লাহ’র বাণী ‘ছুম্মা তুওয়াফ্ফা কুল্লু নাফসিম বিমা-কাছাবা…’ অর্থাৎ অতপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেয়া হবে যা সে উপার্জন করেছে। বলে রাখা দরকার, এখানে ‘তা’ বর্ণে পেশ পড়া হয়েছে শুধুমাত্র এটি কর্মবাচ্যমূলক ক্রিয়াপদ বলে। উপরন্তু এটি বাবে তাফা’উল থেকেই নির্গত।

(৩) পবিত্র হাদীস শরীফ। হযরত ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত আছে রাসূল (সা:) বলেছেন: و إذا رمى الجمار لا يدرى احد ماله حتى يتوفاه الله يوم القيامة  (উচ্চারণ) ‘ওয়া ইযা রামাল জামা-রা লা-ইয়াদরী আহাদুন মা-লাহূ হাত্তা ইয়াতাওয়াফফা-হুল্লাহু ইয়াওমাল ক্বিয়ামাহ।’ অর্থাৎ যদি কেউ (হাজ্জের মধ্যে) শয়তানকে পাথর মারে তাহলে সে তার প্রাপ্ত সাওয়াব সম্পর্কে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ধারণাই রাখবেনা যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে কেয়ামত দিবসে তা পূর্ণ করে দেবেন! দেখুন, মুসনাদে বাজ্জার, সুনানু তাবারানী, সহীহ ইবনে হাব্বান। (আরো দেখুন, আত-তারগিব ওয়াত-তারহীব খন্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ২০৫)। এবার ‘ফাতহুল ক্বাদীর’ গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে পারিভাষিক দিক থেকে ঐ তিনখানা অর্থ উদ্দেশ্য নেয়ার উদাহরণ নিচে দেখানো হল :

প্রথমত, ঘুম বা অচেতন অর্থে : যেমন আল কুরআনের ভাষ্য و هو الذى يتوفاكم بالليل و يعلم ما جرحتم بالنهار “(উচ্চারণ) ওয়া হুয়াল্লাজি ইয়াতাওয়াফ্ফাকুম বিল্লাইল ওয়া ইয়া’লামু মা জারাহ্তুম বিন্নাহারি। অর্থ: তিনিই রাত্রিকালে তোমাদের (নিদ্রারূপ) মৃত্যু ঘটান এবং দিবসে তোমরা যাহা কর তাহা তিনি জানেন।” (০৬:৬০ ইফা)।

দ্বিতীয়ত, মৃত্যু বা প্রাণ হরণকরা অর্থে : আল কুরআনের ভাষ্য (ক) আল কুরআনের ভাষ্যالله يتوفى الأنفس حين موتها و التى لم تمت فى منامها  “(উচ্চারণ) আল্লাহু ইয়াতাওয়াফফাল আনফুসা হীনা মওতিহা ওয়াল্লাতি লাম তামুত ফী মানামিহা। অর্থ: আল্লাহই প্রাণহরণ করেন জীবনসমূহের তাহাদের মৃত্যুর সময় এবং যাহাদের মৃত্যু আসে নাই তাহাদের প্রাণও নিদ্রার সময়।” (৩৯:৪২ ইফা)। (খ) আল কুরআনের ভাষ্য و توفنا مع الأبرار  “(উচ্চারণ) ওয়া তাওয়াফফানা মা’আল আবরার। অর্থ: আমাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের সহগামী করিয়া মৃত্যু দিও।” (০৩:১৯৩ ইফা)। এখানেও ‘তাওয়াফফা’ এর ব্যবহারিক অর্থ মৃত্যু নেয়ার ক্ষেত্রে ক্বারীনা (নিদর্শন) হল, আয়াতটিতে ঈসা (আ:) কিংবা রাত্রির উল্লেখ না থাকা। ফলে সেটি ‘মৃত্যু’ ভিন্ন আর কোনো রূপক অর্থকে নির্দেশ করেনা। যে কারণে সেটির তাওয়াফফা-কে ঈসা (আ:) বা রাত্রি সম্পর্কিত আয়াতের ‘তাওয়াফফা’র সাথে তুলনা করা চলবেনা।

তৃতীয়ত, শরীর আর রূহ দুইটি একত্রে নিয়ে নেয়া অর্থে : আল কুরআনের ভাষ্য إنى متوفيك ؛  لما توفيتنى  ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে তুলিয়া নেব’ (অনুবাদ, আল্লামা শাওক্বানী); যখন আপনি আমাকে তুলিয়া নিলেন (অনুবাদ, আল্লামা শাওক্বানী)। (০৩:৫৫;০৫:১১৭)। মজারব্যাপার হল, কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা হেকিম নূরউদ্দীন বিরচিত পুস্তকেও ‘মুতাওয়াফফীকা’ এর ‘তাওয়াফফা’ অর্থ ‘মুত্যু’ নেয়া হয়নি। যেমন يا عيسى إنى متوفيك يعنى اے عیسی میں لینے والا ہوں تجہکو  ‘হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে নিয়ে নিচ্ছি।’ (কাদিয়ানীদের প্রথম খলিফা হেকিম নূরউদ্দিন কর্তৃক রচিত ‘তাসদীকে বারাহীনে আহমদীয়া’ পৃষ্ঠা নং ৮ দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য।

এবার কাদিয়ানীদের একটি মনগড়া উসূল ও তার জবাব দেয়া হবে। তার আগে মির্যা কাদিয়ানীর উদ্ধৃতিতে মুজাদ্দিদের মর্যাদা ও স্বার্থকতা সম্পর্কে একটু আলোচনা :

তাসদীকে বারাহীনে আহমদিয়া ৮

মির্যা কাদিয়ানীর বইতে মুজাদ্দিদগণের মর্যাদা : মির্যা কাদিয়ানী নিজের রূপক মসীহ দাবীর পরেও সেই ১৮৯৯ সালে নিজ পুস্তকে বরেণ্য যুগ ইমাম সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীনভাবে লিখেছেন (উর্দু): دوسرے ایسے ائمہ اور اکابر کے ذریعہ سے جن کو ہریک صدی میں فہم قرآن عطا ہوا ہے جنہوں نے قرآن شریف کے اجمالی مقامات کی احادیث نبویہ کی مدد سے تفسیر کرکے خدا کی پاک کلام اور پاک تعلیم کو ہریک زمانہ میں تحریف معنوی سے محفوظ رکھا. ایام الصلح  “(আল্লাহতালা কর্তৃক পবিত্র কুরআনের সঠিক শিক্ষাকে প্রত্যেক যুগে সর্বসাকুল্য অবিকৃত রাখার চারটি পদ্ধতির মধ্য হতে) দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এমন ইমাম এবং আকাবের (তথা মুজাদ্দিদ)গণ দ্বারাও যাঁদেরকে প্রত্যেক শতাব্দীর মাথায় কুরআনের বিশুদ্ধ বুঝ প্রদান করা হয়ে থাকে। তারা কুরআন শরীফের অস্পষ্ট বিষয়াদী নবীর হাদীস সমূহের সাহায্যে তাফসীর করে খোদার পবিত্র বাণী ও পবিত্র শিক্ষাকে প্রত্যেক যুগেই অর্থগত বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছিলেন।” (আইয়্যামুছ ছুলহি ৫৫, সংকলনের তাং ১৮৯৯ ইং; রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮)। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য।

রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮

মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য থেকেও সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, নবী করীম (সা:)-এর হাদীস সমূহের সাহায্যে যুগ ইমামগণ খোদার পবিত্র বাণীকে প্রত্যেক যুগেই অর্থগত বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছেন। কাজেই মির্যা কাদিয়ানীর অনুসারীদের জন্য একথা বলার আর সুযোগ থাকেনি যে, যুগ ইমামগণ ‘তাওয়াফফা’ এর ব্যবহারিক অর্থ সম্পর্কে কী লিখলেন আমাদের নিকট তার কোনোই মূল্য নেই! (নাউযুবিল্লাহ)। কেননা তখন প্রকারান্তরে যুগ-ইমাম সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর উক্ত বক্তব্যকেই অগ্রাহ্য করা হবে!

কাদিয়ানীদের উসূল ও তার খন্ডন : কাদিয়ানীদের উসূল (নীতিমালা) হল, যেসব জায়গায় ‘তাওয়াফফা’ এর কর্তা (ফায়েল) আল্লাহ এবং কর্ম (মাফ’উল) যীরূহ তথা প্রাণী হবে আর ক্বারীনা হিসেবে রাত্রি’র উল্লেখ থাকবেনা সেখানে ‘তাওয়াফফা’ শব্দটি শুধুই মৃত্যু অর্থের জন্য। তাই ঈসা (আ:) সম্পর্কিত তাওয়াফফা মানে ‘মৃত্যু’ই! এবার আমার পক্ষ থেকে তাদেরই উল্লিখিত উসূলের খন্ডন ও তারই পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র তিনটি প্রশ্ন নিম্নরূপ :

১. তাহলে আপনারা ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত : و إذا رمى الجمار لا يدرى احد ماله حتى يتوفاه الله يوم القيامة   হাদীসটির ‘তাওয়াফফা’ অর্থও কি মৃত্যু নিবেন? সেখানেও কিন্তু কর্তা আল্লাহ আর কর্ম যীরূহ!

২. মির্যা কাদিয়ানীর বইতে ‘ইন্নী মুতাওয়াফফীকা’র ভিন্ন ভিন্ন ৬ ধরণের অর্থ রয়েছে। সেগুলো হল, পরিপূর্ণ নেয়ামত (১/৬২০); পরিপূর্ণ পুরষ্কার (১/৬৬৪-৬৫); অপমানকর ও অভিশপ্ত মৃত্যু হতে রক্ষা (১২/২৩) জন্মগ্রহণকরা (১৯/৪৯) ইত্যাদী। তার কৃত অনুবাদের ৬ স্থানের মাত্র একটিতেই ‘তাওয়াফফা’ অর্থ মৃত্যু উল্লেখ আছে। অথচ সবগুলোতেই কর্তা আল্লাহ আর কর্ম যীরূহ বা প্রাণী! কী জবাব? স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য।

৩. তার বইতে আরো লিখা আছে, যেখানে রাত্রিবেলার উল্লেখ আছে শুধুমাত্র সেখানেই উক্ত ক্বারীনার কারণে তাওয়াফফা’ অর্থ মৃত্যু নেয়া হবেনা। তো একই ভাবে আমিও কি বলতে পারিনা যে, যেখানে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর প্রসঙ্গ রয়েছে সেখানেও অন্যান্য বহু ক্বারীনার কারণে ‘তাওয়াফফা’ মৃত্যু অর্থে হবেনা! বরং বিশিষ্ট যুগ ইমাম, ইবনে তাইমিয়াহ (রহ:)-এর বিশ্লেষণ অনুসারে সেই ‘তাওয়াফফা’ অর্থ- توفى الروح و البدن جميعا অর্থাৎ রূহ এবং শরীর দুটো একত্রে নিয়ে নেয়া। (আল-জওয়াবুস সহীহ ৪/৩৮ দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য।

আশাকরি এইটুকুতেই জ্ঞানীদের সত্যটা বুঝতে আর কোনো কষ্ট হবেনা।

  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কেয়ামতের সর্বশেষ আলামত অগ্নুৎপাত

0

প্রশ্নকর্তা : কেয়ামতের সর্বশেষ আলামত কী? দলিল সহ জানতে চাই!

উত্তরদাতা: সহীহ মুসলিম এর একটি হাদীস থেকে কেয়ামতের সর্বশেষ আলামত সম্পর্কে জেনে নিন!

  • حَدَّثَنَا أَبُو خَيْثَمَةَ، زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ وَإِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ وَابْنُ أَبِي عُمَرَ الْمَكِّيُّ – وَاللَّفْظُ لِزُهَيْرٍ – قَالَ إِسْحَاقُ أَخْبَرَنَا وَقَالَ الآخَرَانِ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ، عَنْ فُرَاتٍ، الْقَزَّازِ عَنْ أَبِي الطُّفَيْلِ، عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ أَسِيدٍ الْغِفَارِيِّ، قَالَ اطَّلَعَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَيْنَا وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ فَقَالَ ‏”‏ مَا تَذَاكَرُونَ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا نَذْكُرُ السَّاعَةَ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ إِنَّهَا لَنْ تَقُومَ حَتَّى تَرَوْنَ قَبْلَهَا عَشْرَ آيَاتٍ ‏”‏ ‏.‏ فَذَكَرَ الدُّخَانَ وَالدَّجَّالَ وَالدَّابَّةَ وَطُلُوعَ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم وَيَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَثَلاَثَةَ خُسُوفٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ بِجَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَآخِرُ ذَلِكَ نَارٌ تَخْرُجُ مِنَ الْيَمَنِ تَطْرُدُ النَّاسَ إِلَى مَحْشَرِهِمْ ‏.

অর্থাৎ হযরত হুযাইফাহ্‌ ইবনু আসীদ আল গিফারী (রা:) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, একদিন আমরা (বিভিন্ন বিষয়ে) আলোচনা করছিলাম। এমন সময় রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কাছে আসলেন এবং প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি বিষয়ে আলোচনা করছ? উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা কিয়ামতের ব্যাপারে আলোচনা করছি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, ততক্ষন পর্যন্ত কিয়ামাত সংঘটিত হবে না যতক্ষন না তোমরা দশটি বিশেষ আলামত দেখবে।

তারপর তিনি ধুম্র, দাজ্জাল, দাব্বা, পশ্চিমাকাশ হতে সূর্যোদয় হওয়া, মারইয়াম পুত্র ‘ঈসা (‘আঃ)-এর অবতরণ, ইয়া‘জূজ মা‘জূজ এবং তিনবার ভূখণ্ড ধ্বসে যাওয়া তথা পূর্ব দিকে ভূখণ্ড ধ্বস, পশ্চিম দিকে ভূখণ্ড ধ্বস এবং আরব উপদ্বীপে ভূখণ্ড ধ্বসের কথা বর্ণনা করলেন। এ আলামতসমূহের পর এক অগ্নুৎপাতের প্রকাশিত হবে, যা তাদেরকে ইয়ামান থেকে হাশরের মাঠ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন. ৭০২১, ই.সে. ৭০৭৮)। সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭১৭৭।

উল্লেখ্য, হাদীসটির বর্ণিত আলামতগুলোর মধ্যে প্রথম আলামত ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম’ (আ:) এর আত্মপ্রকাশ এবং সর্বশেষ আলামত ‘অগ্নুৎপাত‘ যা দুনিয়ার একদম শেষ সময় প্রকাশিত হয়ে সমস্ত মানুষকে হাশরের ময়দান তথা সিরিয়ার দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে। আল্লাহু আ’লাম।

  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ঈসা (আ:) জীবিত থাকলে তাঁর শরীয়তও কি জীবিত থাকবে?

0
  • কাদিয়ানীদের প্রশ্ন ও আমার জবাব :

প্রশ্ন : ঈসা (আ:) জীবিত থাকলে তাঁর ঈসায়ী শরীয়তও বর্তমানে জীবিত, রহিত নয়; মানতে হবে। কারণ কোনো নবী যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর আনীত শরীয়তও কোনোভাবেই বাতিল হতে পারেনা, এটাই যুক্তিসংগত। সুতরাং অ-কাদিয়ানী মুসলমানদের বিশ্বাস যেহেতু ঈসা (আ:) বর্তমানে জীবিত ও আকাশে আছে, সেহেতু তারা তাঁর শরীয়তের অনুসারী হওয়াই যুক্তিযুক্ত! অন্যথা তাদেরকেও আহমদীদের (কাদিয়ানীদের) ন্যায় বিশ্বাস করতে হবে যে, ঈসা (আ:) মৃত, জীবিত নন!

আমার জবাব : প্রশ্নকারীর উল্লিখিত প্রশ্ন থেকে মোটামুটি যে কয়টি পয়েন্ট আমি দাঁড় করতে পারি তা হল, প্রশ্নকারী যেন বুঝাতে চাচ্ছে, (১) শরীয়তধারী নবীগণের শরীয়ত শুধুমাত্র তাঁদের মৃত্যুর মাধ্যমেই রহিত বা বাতিল হয়; আর কোনোভাবেই বাতিল হয়না! (২) হযরত ঈসা (আ:)-কে মৃত বলে বিশ্বাস করার অর্থই হল, শরীয়তে মুহাম্মদীয়াকে জীবিত বিশ্বাস করা। অন্যথা শরীয়তে মুহাম্মদীকে মৃত ও বাতিল বলেই বিশ্বাস করার শামিল! (৩) ঈসা (আ:)-কে যারা মৃত বিশ্বাস করেনা তাদের জন্য উচিৎ, তারা যেন ঈসায়ী ধর্মমত গ্রহণ করে নেয়। নতুবা তারা ঈসায়ী ধর্মকে প্রকারান্তরে জীবিত বিশ্বাস করা সত্ত্বেও সেটি গ্রহণ না করাই সুস্পষ্ট কুফুরীর শামিল।

  • এমতাবস্থায় নিচের প্রশ্নগুলোর কী জবাব?

(১) সহীহ হাদীসে আছে, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন:

  • ولو كان موسى حيا ما وسعه إلا اتباعي رواه أحمد والبيهقي في كتاب شعب الإيمان، وهو حديث حسن

অর্থাৎ যদি মূসাও জীবিত থাকত তবে তার জন্য আমার আনুগত্য করা ছাড়া উপায় ছিলনা।” (সুনানে আহমদ, বায়হাক্বী ফী শু’আবিল ঈমান। হাদীসের মান : হাসান)। উপরের হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, মূসা (আ:) জীবিত থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র তাঁর জীবদ্দশায় আমাদের প্রিয় নবী ও শেষনবী মুহাম্মাদে আরাবী (সা:)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে মূসোয়ী শরীয়ত বাতিল হয়ে যাবে। যার ফলে তাঁর (আ:) জন্য আমাদের প্রিয় নবীর শরীয়তের আনুগত্য করা আবশ্যক হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় কাদিয়ানীদের দাবী, ঈসা (আ:) জীবিত থাকা সত্ত্বে বর্তমানে তাঁর শরীয়তও জীবিত থাকবে, এইধরণের কথাবার্তার ভিত্তি কী? তবে কি উল্লিখিত হাদীস মিথ্যা হয়ে যাবে?

(২) তাদের উল্লিখিত দাবী সত্য হলে, তখন তো তাদেরই যুক্তি অনুসারে মুহাম্মদ (সা:) এর মৃত্যুতে শরীয়তে মুহাম্মদীয়াও বাতিল হয়ে যাচ্ছে! নাউযুবিল্লাহি। এর কী জবাব?

(৩) ঈসায়ী ধর্মকে মৃত সাব্যস্ত করতে ঈসা (আ:)-কে মৃত বিশ্বাস করতে হবে, কাদিয়ানীদের এইধরণের দাবীর ভিত্তি কোথায়? ঈসায়ীদের বর্তমান ধর্ম-গ্রন্থ (নিউ টেস্টামেন্ট) বাইবেল ঈসা (আ:)-এর আকাশে উত্থিত হওয়ার বহু বছর পরে সেন্ট পৌল নামক এক ব্যক্তি কর্তৃক রচিত, ঈসা (আ:)-এর সাথে যার কোনোই সম্পর্ক নেই; এগুলো প্রমাণ করার মাধ্যমেও কি বর্তমান ঈসায়ীধর্ম বাতিল সাব্যস্ত হবেনা?

(৪) মির্যা কাদিয়ানীর জন্ম ১৮৩৯ সালে। সে নিজেকে ১৮৬৫ সালে মুলহাম এবং ১৮৮১ সালে মুজাদ্দিদ ও মামূর মিনাল্লাহ দাবী করার পর থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত টানা ২৯ বছর পর্যন্ত মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে আসছিল যে, ঈসা (আ:) জীবিত ও আকাশে। (বারাহীনে আহমদিয়া দ্রষ্টব্য)। তবে কি মির্যা কাদিয়ানীও এই ২৯ বছর যাবৎ ঈসায়ী ধর্মকে সত্য আর শরীয়তে মুহাম্মদীকে বাতিল বিশ্বাস করে আসছিল?

(৫) ঈসা (আ:)-কে জীবিত ও আকাশে বিশ্বাস করার আকীদা উম্মতে মুহাম্মদীয়ার একটি সর্বসম্মত আকীদা। একথার স্বীকারোক্তি মির্যাপুত্র মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদের বইতেও পরিষ্কার উল্লেখ আছে (আনওয়ারুল উলূম ২/৪৬৩; মির্যা বশির উদ্দিন)। অপরদিকে রাসূল (সা:)-এর হাদীস বলছে, উম্মতে মুহাম্মদীয়া কখনো কোনো ভুল-ভ্রান্তির উপর একমত হবেনা। যেমন হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন :

  • إِنَّ أُمَّتِي لَا تَجْتَمِعُ عَلَى ضَلَالَةٍ فَإِذَا رَأَيْتُمْ اخْتِلَافًا فَعَلَيْكُمْ بِالسَّوَادِ الْأَعْظَمِ.” (رواه ابن ماجة في السنن رقم 3950)

অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমার উম্মত গোমরাহির উপর কখনোই একমত হবেনা। অতএব তোমরা যখনই মতানৈক্য দেখতে পাবে তখন তোমরা বড় দলটিকে আঁকড়ে ধরবে। (দেখুন, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৯৫০)। তাই কাদিয়ানীদের উল্লিখিত দাবী সঠিক হলে, তখন কি রাসূল (সা:)-এর উপরিউক্ত হাদীস মিথ্যা হয়ে যাচ্ছেনা? আমরা কি রাসূল (সা:)-এর হাদীসগুলো ত্যাগ করে কাদিয়ানীদের দাবীকে সত্য মেনে নেব?? সংক্ষেপে। কাদিয়ানীদের নিকট আমার এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর আছে কি?

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

হাদীসের নামে মির্যা কাদিয়ানীর ডজনখানেক মিথ্যা-৫

0

রাসূল (সা:)-এর নামে মিথ্যা রটানো সম্পর্কে হাদীস : যে ব্যক্তি আমার প্রতি স্বেচ্ছায় মিথ্যাচার করে তার ঠিকানা জাহান্নাম। (সূত্র : সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইলম)।

মির্যা কাদিয়ানীর ধারাবাহিক মিথ্যাসমূহ (প্রামাণ্য স্ক্যানকপি সহ) :

(১) বহু সহীহ হাদীসে এসেছে মসীহ মওউদ শতাব্দির শুরুতে আগমন করবেন এবং তিনি চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ হবেন। (রূহানী খাযায়েন ২১:৩৫৯)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(২) কুরআন এবং বহু হাদীসে ভবিষ্যতবাণী রয়েছে, মসীহ মওউদ (আ:) এর যখন আত্মপ্রকাশ হবে তখন তিনি ইসলামী উলামাদের হাতে কষ্ট পাবেন। তারা তাকে কাফের আখ্যা দেবেন, হত্যার ফতুয়া দেবেন, কঠিনভাবে অবমাননা করবেন এবং ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে ও ধর্ম নষ্টকারী বলে মনে করবেন। (রূহানী খাযায়েন ১৭:৪০৪)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৩) কিছু সংখ্যক হাদীসে উল্লেখ আছে, আগত মসীহ এর একটি আলামত এটিও রয়েছে যে, তিনি জুলকারনাঈন হবেন। (রূহানী খাযায়েন ২১:১১৮)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৪) বহু হাদীসে নববীতে এমনি এসেছে, প্রতিশ্রুত মাহদীর উপর কুফুরীর ফতুয়া লাগানো হবে। অতএব সেটি এখন পূরণ হলো। (রূহানী খাযায়েন ১২:৭৫)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৫) বহু সহীহ হাদীস দ্বারা এটি প্রমাণিত যে, মসীহ ছয় হাজার সালে জন্ম নিবেন। (রূহানী খাযায়েন ২২:২০৯)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৬) যেহেতু সহীহ হাদীসে আছে, ইমাম মাহদীর কাছে একটি কিতাব থাকবে যার মধ্যে ৩১৩ জন সাথীর নাম থাকবে। সে ভবিষ্যতবাণী আজ পূরণ হল। (রূহানী খাযায়েন ১১:৩২৪)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৭) সহীহ বুখারীতে সুস্পষ্টভাবে লিখা আছে যে, হযরত ঈসা (আ:) মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। (রূহানী খাযায়েন ১৯:৬৫)প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৮) কুরআন শরীফ এবং বহু হাদীস ও পূর্বেকার বহু কিতাবে উল্লেখ আছে, মসীহ এর যুগে একটি নতুন গাড়ী আবিস্কৃত হবে যা আগুন দ্বারা চলবে, তখন উট বেকার হয়ে পড়বে। আর এই শেষ অংশের হাদীসটি সহীহ মুসলিমেও রয়েছে। এই সেই গাড়ী যেটি আবিস্কৃত হল সেটি রেল (Rail)। (রূহানী খাযায়েন ২০:২৫)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(৯) বহু হাদীসে এই কথা পরিষ্কার রয়েছে, শেষ যুগে মুহাম্মদ (সা:) দুনিয়াতে আবার আসবেন এবং মসীহও আসবেন। তবে দুইজনই বুরুজীভাবে আসবেন, হাকীকীভাবে নয়। (রূহানী খাযায়েন ১৮:৩৮৪)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(১০) বহু হাদীসে এটিও উল্লেখ আছে, মসীহ এর সময় তাউন [প্লেগ, মহামারী] ছড়িয়ে পড়বে এবং হজ্জে বাধা প্রদান করা হবে। সুতরাং এই সমস্ত নিদর্শন প্রকাশ্যে আসিয়া গেল। (রূহানী খাযায়েন ১৭:৩৯৯)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

(১১) নবী করীম (সা.)-এর বহু হাদীসে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে যে, হুজুর (সা.) এর উম্মতের মধ্য হতে এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করবে যাকে ঈসা এবং ইবনে মরিয়ম বলা হবে এবং নবী নামেও ডাকা হবে। (রূহানী খাযায়েন ২২:৪০৬)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,


১২। ‘মুজাদ্দিদ সেরহান্দী (রহ.) নিজ ‘মাকতুবাত’ () এর মধ্যে লিখেছেন, যদিও বা এই উম্মতের কিছু সদস্য আল্লাহর সাথে কথপোকথন ও আল্লাহর সম্বোধনের অধিকারী এবং কেয়ামত পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকবে কিন্তু যাকে খুব বেশি এই বৈশিষ্ট্য এবং গায়েবের সংবাদ দান করা হয় তাকে নবী বলা হয়।’ (রূহানী খাযায়েন ২২:৪০৬)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

শেষকথা : আহমদীবন্ধুদের উচিত, মির্যা সাহেবের মতবাদগুলো অন্ধভাবে ফেরি করার আগে তাকে অন্ততপক্ষে সত্যবাদী প্রমাণ করা। কারণ তিনি নিজেই লিখে গেছেন ‘কেউ একটি কথায় মিথ্যুক প্রমাণিত হলে তার অন্য আর কোনো কথার গ্রহণযোগ্যতা থাকেনা।’ (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২৩/২৩১)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি এই,

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! লিখাটি উপকারী মনে হলে অবশ্যই দেশের আক্রান্ত এলাকাগুলোতে পৌঁছে দেবেন। বিশেষ করে দাঈদের উচিত, লিখাটি প্রিন্ট করে নিজেদের সংরক্ষণে রাখা। যাতে প্রয়োজনে সত্যানুরাগী কাদিয়ানীদের চোখে আঙুল দিয়ে মির্যার বাস্তবতা দেখিয়ে দিতে পারেন। আল্লাহপাক যেন এই উসিলায় আমাদেরকে ক্ষমা করেন এবং পরকালে নাজাতের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহুম্মা আমীন।

লিখক : প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইমামান মাহদিয়্যান [إماما مهديا] শীর্ষক হাদীসের সঠিক অর্থ ও তাৎপর্য

0
  • ইমামান মাহদিয়্যান [إماما مهديا] শীর্ষক হাদীস :

সহজ সরল জবাব : চরম অর্থ-বিকৃতিকারী কাদিয়ানী সম্প্রদায় নিচে উল্লিখিত হাদীসটির ‘ইমামান মাহদিয়্যান’ খন্ডাংশ হতে যেই অর্থটি নিয়ে থাকে তা সম্পূর্ণরূপে ভুল ও ব্যাকরণ বিরুদ্ধ! প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আরেকটু পরে আসছি। প্রথমে পুরো হাদীসটির ব্যাকরণসিদ্ধ বাংলা অর্থ জেনে নিন। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন :

  • يوشك من عاش منكم ان يلقى عيسى بن مريم إماما مهديا وحكما عدلا فيكسر الصليب ويقتل الخنزير ويضع الجزية وتضع الحرب أوزارها
  • উচ্চারণ : ইউশিকু মান আ’-শা মিনকুম আঁই ইয়ালক্বা ঈসা ইবনা মারইয়ামা ইমামান মাহদিয়্যান ওয়া হাকামান আ’দালান ফা ইয়ুকছিরাছ ছালীবা ওয়া ইয়াক্বতুলাল খিনজীরা ওয়া তাদ্বা’আল হারবু আওঝা-রাহা।

অর্থাৎ তোমাদের মধ্য হতে যারা বেঁচে থাকবে তারা অচিরেই ঈসা (আ:)-কে একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম ও ন্যায়পরায়ণ প্রশাসকরূপে দেখতে পাবে। তিনি ক্রুশ ভাঙবেন এবং শূকর হত্যা করবেন। জিজিয়া (রাষ্ট্রীয় কর) তুলে দেবেন। তখন (আর কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায়) যুদ্ধ আপনা সরাঞ্জামাদী গুটিয়ে নেবে (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৯১১৭)।

বিশ্লেষণমূলক আলোচনা : উক্ত হাদীসে “ইমামান” শব্দটি মওসূফ [বিশেষিতপদ] আর “মাহদিয়্যান” শব্দটি ছিফাত [বিশেষণপদ]। যেজন্য অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রথমে “মাহদিয়্যান” এর অর্থ করতে হবে তারপর “ইমামান” এর অর্থ করতে হবে। ফলে “ইমামান মাহদিয়্যান” এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে : ‘একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম’। একজন ব্যাকরণের ছাত্র হিসেবে অবশ্যই জানার কথা যে, আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে ছিফাত [বিশেষণপদ]’র অর্থ আগে হয় আর মওসূফ [বিশেষিতপদ]’র অর্থ পরে হয়। যেমন :
[১] আজরান আযীমা [اجرا كريماً] অর্থাৎ উত্তম প্রতিদান। এখানে প্রথমে ‘কারীমা’ এর অর্থ নিতে হবে। কেননা এটি ছিফাত [বিশেষণপদ]। তারপর ‘আজরা’ এর অর্থ নিতে হবে। একই নিয়মে নিম্নরূপ। [২] ফাদ্বলান কাবীরা [فضلاً كبيراً] অর্থাৎ মহা অনুগ্রহ।
[৩] আযাবান মুহীনা [عذابا مهينا] অর্থাৎ লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি। (সূরা আহযাব : ৪৪, ৪৭, ৫৭)। সংক্ষেপে। লক্ষনীয় বিষয় যে, হাদীসটিতে “ইমামান মাহদিয়্যান” এর পূর্বেই ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম’ শব্দ উল্লেখ আছে। যেটি বাক্যে “যুলহাল” [যার অবস্থা বুঝানো হয় এমন]। অনুরূপ “মাহদিয়্যান” শীর্ষক একটি রেওয়ায়েত সহীহ বুখারীতেও আছে। নিচে দেখুন :

(ক) হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) সম্পর্কে রাসূল (সা:) বলেছেন, ﻭﺍﺟﻌﻠﻪ ﮬﺎﺩﯾﺎ ﻣﮭﺪﯾﺎ [ওয়াজ’আলহু হাদিয়ান মাহ্দিয়্যান] অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাকে একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী বানিয়ে দিন (বুখারী কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার)।
(খ) রাসূল (সা:) হযরত মু’আবিয়া (রা:) সম্পর্কেও বলেছেন : ﺍﻟﻠﮭﻢ ﺍﺟﻌﻠﻪ ﮬﺎﺩﯾﺎ ﻣﮭﺪﯾﺎ ﻭﺍﮬﺪ ﺑﻪ [আল্লাহুম্মাজ আলহু হাদিয়ান মাহ্দিয়্যান ওয়াহ্দি বিহি] অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাঁকে একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী বানিয়ে দিন আর তার মাধ্যমে [মানুষকে] হিদায়াত দান করুন। (তিরমিযী কিতাবুল মানাকিব, সনদ হাসান ও গরিব)।

সর্বশেষ কথা হল, যারা মওসূফ ছিফাত এর স্বতসিদ্ধ ব্যকরণিক নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করেই ‘ইমামান মাহদিয়্যান’ এর অর্থ করে ‘ইমাম মাহদীরূপে’ (মহা সুসংবাদ পৃ-১০)। তাদের নিকট আমার প্রশ্ন হল, ‘মুসনাদে আহমদ’ নামক কিতাবসহ হাদীসের অন্যান্য যেসব কিতাবে হযরত ঈসা (আ:)-এর দ্বিতীয় আগমন সম্পর্কে শব্দের সামান্য পরিবর্তনসহ আরো যেসব বাক্যাংশ রয়েছে সেখানেও কি অনুরূপ অর্থ নিবেন? যেমন :

১. ইমামান মাহদিয়্যান ওয়া হাকামান আদালা [إماماً مهديا و حكماً عدلاً]। মুসনাদে আহমদ : হা/৯১১৭। ২. ইমামান মুকছিতান [إماماً مقسطا]। মুসনাদে আহমদ : হা/৭৬২২, ৭৬৯০; তারিখে দামেস্ক : হা/৫১৩৫৫। ৩. ইমামান আদিলান [إماماً عادلاً]। ইমাম ইবনে আবী শাইবাহ (মৃত ২৩৫ হিজরী) সংকলিত মুছান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ : হা/৩৮৪৯১, ৩৬৮০৪। ৪. ইমামান আদিলান ওয়া ক্বাজিয়ান [اماما عادلاً و قاضياً]। ইমাম আবু বকর আশ-শাফেয়ী (মৃত ৩৫৪ হিজরী) সংকলিত, আল ফাওয়ায়িদুশ শাহীর বিল গাইলানিয়াত : হা/৭৯৩, ৮২৪। আপাদত এই কয়েকটা দিলাম। এখন বলুন, প্রথমোক্ত বর্ণনায় “ইমামান মাহদিয়্যান” এর অর্থ ‘ইমাম মাহদীরূপে’ হলে তবে অন্যান্যগুলোর অর্থ কীরূপে হবে? আশাকরি বুঝতেই পেরেছেন যে, কাদিয়ানীরা ব্যাকরণবিরুদ্ধ ও মতলবসিদ্ধ অনুবাদ করতে গিয়ে কত মারাত্মক ভুলভাল অনুবাদ করে থাকে। ফলে একে তো নিজেরা পথভ্রষ্ট হল সে সাথে অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে চলল!

  • লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইমাম মাহদীকে মানার গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে কতেক জিজ্ঞাসা

0
  • ইমাম মাহদীকে মানার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখপূর্বক কিছু প্রশ্ন :

আমরা প্রায়শই দেখি আহমদী তথা কাদিয়ানী জামাতের আলোচনায় ইবনে মাজাহ’র হাদীসের সে অংশটি আসে যা জনাব ফিরোজ আলম সাহেব [কাদিয়ানী ইনচার্জ কেন্দ্রীয় বাংলা ডেস্ক, লন্ডন] খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেন। যেমন فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ [ফা-ইজা রাআইতুমূহু ফা-বাইয়ূহু] অর্থাৎ যখন তোমরা তাকে দেখবে তখন বাইয়াত (যোগদান) করবে। কিংবা فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الثَّلْجِ فَإِنَّهُ خَلِيفَةُ اللَّهِ الْمَهْدِيُّ [ফা-ইজা রাআইতুমূহু ফা-বাইয়ূহু ওয়া লাও হাবওয়ান আলাছ ছালজি ফা-ইন্নাহু খালীফাতুল্লাহিল মাহ্দী] অর্থাৎ তাঁকে [গোরাসানের দিক থেকে] আত্মপ্রকাশ করতে দেখলে তোমরা বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তার বাইয়াত (যোগদান) করবে। কারণ সে আল্লাহ’র খলীফা আল-মাহদী। কিন্তু কখনো পুরো হাদীসটি বর্ণনা করতে শুনিনি।

এ হাদীসটি ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত একটি বড় হাদীসের (হা/৪০৮৪) খন্ডিত অংশ। বলে রাখা প্রয়োজন, একমাত্র ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ:) এককভাবে এটি বর্ণনা করেছেন এবং হাদীস বিশারদগণ এর সনদকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। সেযেইহোক, আমার প্রশ্ন সেটি নয়।

  • তবে ইমাম হাকেম (রহ:) যেই সনদে বর্ণনা করেছেন সেখানে ‘ক্বদ জাআত মিন ক্বিবালি খোরাসান’ [কালো পতাকাধারী বাহিনী খোরাসানের দিক থেকে আগমন করবে] শব্দটিও উল্লেখ আছে। এমনকি সেটি সনদের বিচারে সহীহ মুসলিম এর সমমানে উন্নীত। দেখুন মুসতাদরিক আলা আস সহীহাইন, কিতাবুল ফিতান ওয়াল মালাহিম।

আমি প্রথমে সম্পূর্ণ হাদীসটির অনুবাদ নিচে পেশ করছি : হযরত সাওবান (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:

“তোমাদের একটি সম্পদের [সিংহাসন বা গুপ্তধন] নিকট এক খলিফার তিন পুত্র যুদ্ধ করবে। তাদের কেউ সেই সম্পদ দখল করতে পারবে না। অতঃপর প্রাচ্যদেশ থেকে কালো পতাকা উড্ডীন করা হবে। তারা তোমাদেরকে এত ব্যাপকভাবে হত্যা করবে যে, ইতোপূর্বে কোনো জাতি তদ্রুপ করেনি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা:) আরো কিছু বলেছেন, যা আমার মনে নেই। তিনি আরো বলেন, তাকে [খোরাসানের দিক থেকে] আত্মপ্রকাশ করতে দেখলে তোমরা বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তার বাইয়াত করো [তথা তাঁর সিরিয়াভিমুখী মুজাহিদবাহিনীতে যোগদান করো – ইমাম যুহরী, নুআঈম ইবনে হাম্মাদ কৃত আল ফিতান ১/২০৬]। কারণ তিনি আল্লাহর খলীফা আল-মাহদী।”

এখন জনাব ফিরোজ আলম সহ কাদিয়ানী শীর্ষনেতাদের নিকট প্রশ্ন হল :

[১] আহমদীরা (তথা কাদিয়ানীরা) কেন হাদীসটির সম্পূর্ণ অংশ বর্ণনা করেন না?

[২] যদি করে থাকেন তাহলে মির্যা সাহেবের ইমাম মাহ্দী দাবির সময় খলিফার এই তিনপুত্র কারা ছিলেন যারা সেই সময় গুপ্তধনের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু অর্জন করতে পারেন নি? كُلُّهُمُ ابْنُ يَقْتَتِلُ عِنْدَ كَنْزِكُمْ ثَلاَثَةٌ خَلِيفَة [ইয়াকতাতিলু ইনদা কাঞ্জিকুম ছালাছাতুন কুল্লুহুম ইবনু খালীফাতিন]।

[৩] পূর্ব থেকে কালো পতাকাধারী কারা ছিলেন যারা মির্যা সাহেবের যুগে ব্যাপকভাবে মুসলমানদের হত্যা করেছেন, যা ইতোপূর্বে কোনো জাতি করেনি? فَيَقْتُلُونَكُمْ قَتْلاً لَمْ يُقْتَلْهُ قَوْمٌ [ফা-ইয়াকতুলূনাকুম কাতলান লাম ইয়ুকতালহু কাওমুন]।

[৪] ইমাম মাহদী খোরাসানের দিক থেকে সদলবলে সিরিয়াভিমুখে রাওয়ানা হলে মির্যা সাহেব কবে কখন খোরাসানের দিক থেকে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে জিহাদের জন্য বের হয়েছিলেন? বরং আমরা তো জানি যে, তিনি জিহাদের কবর রচিত করতেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন। উল্লেখ্য, উইকিপিড়িয়া’র তথ্যমতে খোরাসান এর ভূগৌলিক অবস্থান হল, উত্তর পশ্চিম আফগানিস্তান, উত্তর ও দক্ষিণ পূর্ব উজবেকিস্তান, উত্তর পূর্ব ইরান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, দক্ষিণ কাজিকিস্তান, উত্তর ও পশ্চিম তাজিকিস্তানসহ সম্পূর্ণ বিস্তৃত এলাকা।

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মির্যা কাদিয়ানীর বিভিন্ন দাবী দাওয়া ও সময়কাল

0
  • এক নজরে মির্যা কাদিয়ানীর বিভিন্ন দাবী দাওয়া

দাবীসমূহের রেফারেন্স ও দাবীকরার সময়কাল

মুলহাম (দৈব-বাণীর অধিকারী)। তাযকিরাহ পৃ ০৬; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৬৮ ইং।

বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর)। তাযকিরাহ পৃ ২৮; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮১ ইং।

মুজাদ্দিস (সংস্কারক)। তাযকিরাহ পৃ ৩৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮২ ইং।

মামূর মিনাল্লাহ (আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট)। তাযকিরাহ পৃ ৩৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮২ ইং।

নাযীর (ভয়প্রদর্শনকারী)। তাযকিরাহ পৃ ৩৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮২ ইং।

আদম, বিবি মরিয়ম, আহমদ। তাযকিরাহ পৃ ৫৫; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮৩ ইং।

মুরসাল (প্রেরিত)। তাযকিরাহ পৃ ৯৯; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৮৪ ইং।

মাসীলে মসীহ (রূপক ঈসা আ:)। তাযকিরাহ পৃ ১৪৮; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯১ ইং।

তাওহীদ এবং তাফরিদ। তাযকিরাহ পৃ ১৬৪; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯২ ইং।

কুন ফা ইয়াকুন (হও বললে হয়ে যাওয়া)। তাযকিরাহ পৃ ১৬৪; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯২ ইং।

মাসীহে ইবনে মরিয়ম (স্বয়ং ঈসা আ:)। তাযকিরাহ পৃ ১৭৮; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯৩ ইং।

ইমাম মাহদী ও মাসীহ ঈসা। তাযকিরাহ পৃ ২০৯; ৪র্থ এডিশন, সময়কাল : ১৮৯৪ ইং।

ইমামুয যামান (যামানার ইমাম)। রূহানী খাযায়েন ১৩/৪৯৫, সময়কাল : ১৮৯৮ ইং।

খোদা। রূহানী খাযায়েন ১৩/১০৩, সময়কাল : ১৮৯৮ ইং।

নবুওয়তি প্রাসাদের আখেরি ইট। রূহানী খাযায়েন ১৬/১৭৭-৭৮, সময়কাল : ১৯০০ ইং।

কাশফ (অতিব জাগ্রত দিব্যি-দর্শন) অবস্থায় নিজেকে স্ত্রীলোক মনে হওয়া এবং আল্লাহকে পুরুষরূপে দেখা ও সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার দাবী। ইসলামী কুরবানী ট্রাক্ট (উর্দু) পৃ ১২; ১৯২০ ইং, লিখক, কাজী ইয়ার মুহাম্মদখান সাহেব (মির্যা কাদিয়ানীর ঘনিষ্ট সহচর)।

বুরূজি খাতামুল আম্বিয়া (শেষনবীর দ্বিতীয় প্রকাশ)। রূহানী খাযায়েন ১৮/২১২, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

জিল্লি মুহাম্মদ (মুহাম্মদ সা: এর প্রতিবিম্ব)। রূহানী খাযায়েন ১৮/২১২, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

জিল্লি, বুরুজি, উম্মতিনবী। রূহানী খাযায়েন ১৮/২১২, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

নবী ও রসূল। একটি ভুল সংশোধন পৃ. ৮, সময়কাল : ১৯০১ ইং।

শরীয়তবাহক নবী (নতুন বিধি-বিধানসহ প্রেরিত)। রূহানী খাযায়েন ১৫/৪৩২; ১৭/৪৩৫-৩৬, সময়কাল : ১৯০২ ইং।

আখেরী নবী (শেষনবী)। রূহানী খাযায়েন ২০/৬৯-৭০; ১৯/৬১, সময়কাল : ১৯০২ ইং।

শ্রীকৃষ্ণ-এর অবতার (হিন্দু ধর্মানুসারীদের আরাধ্য বিশিষ্ট একজন দেবতা যিনি তাদের বিশ্বাস মতে ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতাররূপে খ্যাত)। রূহানী খাযায়েন ২২/৫২২, সময়কাল : ১৯০৭ ইং।

শেষকথা : মির্যা কাদিয়ানী মিরাক (সিজোফ্রেনিয়া) রোগেও আক্রান্ত ছিল (সীরাতে মাহদী: নতুন এডিশন ক্রমিক নং ১৯)। তার অসঙ্গত দাবীগুলো সেই রোগেরই উপসর্গ ছিল বলা চলে।

তথ্য-সংগ্রহে, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ

একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ এর ঘটনা নিয়ে কাদিয়ানীদের বাড়াবাড়ি

0

কাদিয়ানীদের অন্যতম একটি প্রতারণা মাহদীয়তের কথিত নিদর্শন চন্দ্রসূর্যগ্রহণের অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা :

চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ একই রমাজানের ১৩ এবং ২৮ তারিখে হওয়ার যুক্তিতর্ক কতটুকু সন্তোষজনক?

অপ্রিয় হলেও সত্য, বহু মানুষকে কাদিয়ানীরা এই একটা মিথ্যা দিয়ে অনবরত পথভ্রষ্ট করেই চলছে। অথচ এই ধরণের কোনো বর্ণনা-ই ‘হাদীস’ হিসেবে প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এর সনদের মধ্যে দুইজন মিথ্যুক এবং মুনকার পর্যায়ের রাবী (বর্ণনাকারী) থাকার কারণে বর্ণনার কথাগুলো তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনু আলী তথা ইমাম বাকের (রহ.)-এর কিনা তাও নিশ্চিত নয়। যদি কথাগুলো ইমাম বাকের-এর বলেও নিশ্চিত হওয়া যেত তাহলেও কথাগুলোর একটু হলেও গুরুত্ব থাকত। কাজেই বর্ণনাটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল। প্রিয় ভাই ও বোনেরা! বিষয়টিকে আমি প্রশ্নোত্তর আকারে নিচে তুলে ধরছি, যাতে সবাই সহজে বুঝতে পারে। তার আগে বর্ণনাটির সনদ বা ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র উল্লেখ করা হল। যথা গ্রন্থকার ইমাম দারে কুতনী, আবু সাঈদ, মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু নওফল, উবায়েদ ইবনু ইয়া’ঈশ, ইউনুস ইবনু বুকাইর, আমর ইবনু শিমার, জাবের ইবনু ইয়াজিদ, মুহাম্মদ ইবনু আলী ইবনু হোসাইন ইবনু আলী।

প্রশ্নর্কতা : এটি ইমাম বাকেরের বক্তব্য হওয়াটাও কিজন্য নিশ্চিত নয়?

উত্তরদাতা : ঐ যে দুই মিথ্যুকের কারণে। উপরেই সনদ উল্লেখ করে দিলাম! সেখানে ইমাম বাকেরের নামে যে দুই ব্যক্তি চন্দ্রসূর্যগ্রহণের কথাটি মাহদীয়তের নির্দশন বলে চালিয়ে দিয়েছে তাদের নামও উল্লেখ আছে, দেখুন! ইমাম বুখারী, ইবনে হাব্বান, ইয়াহইয়া ইবনু মঈন সহ হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, এই দুই ব্যক্তি মিথ্যুক এবং মুনকারুল হাদীস। এদের সূত্রে বর্ণিত কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এদের বর্ণিত কথাটি এই জন্যই ইমাম বাকেরের কথাও কিনা নিশ্চিত নয়।

প্রশ্নকর্তা : ইমাম বুখারীও কি এধরণের কথা বলেছেন?

উত্তরদাতা : জ্বী, বলেছেন। মূল কিতাব ‘তালখীছুল মুস্তাদরিক’ (১/২৪৬) থেকে হুবহু আরবী ইবারত তুলে ধরছি। যেমন قال يحيى بن معين : ليس بشيئ و قال الجورجانى : زائغ كذاب. و قال ابن حبان : رافضى يشتم الصحابة و يروى الموضوعات عن الثقات. و قال البخارى : منكر الحديث. و قال يحيى : لا يكتب حديثه و قال السليمان : كان عمرو يضع للروافض و قال ابو حاتم : منكر الحديث جدا ضعيف الحديث الخ و قال الحاكم ابو عبدالله : كان كثير الموضوعات عن جابر. এখানে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন যে, ইমাম বুখারীও (রহ.) আমর ইবনে শিমার-কে ‘মুনকারুল হাদীস’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তো বলেছেনই।

যেমন, তার বর্ণিত রেওয়ায়েত গুরুত্বহীন, সে কপট প্রকৃতির ও মিথ্যাবাদী, সে একজন রাফেজি (শীয়া মতাদর্শী) এবং সাহাবীদের গালি দিত, সে বিশ্বস্থ রাবীদের নামে জাল হাদীস তৈরী করত, সে একজন মুনকার রাবী, তার কোনো হাদীসই লিখাযোগ্য নয়, সে রাফেজিদের জন্য হাদীস জাল করত, সে একজন খুবই জঈফুল হাদীস, ইমাম হাকেম (রহ.) বলেছেন, সে জাবের ইবনু ইয়াজিদের কাছ থেকে বহু জাল হাদীস বর্ণনাকারী। উপরে যে সব কথা লিখলাম তা মূলত আরবী ইবারতটিরই অনুবাদ।

এবার দ্বিতীয় রাবী সম্পর্কে কী লিখা আছে শুনুন। আসমাউর রিজাল শাস্ত্রেল বিখ্যাত কিতাব ইমাম ইবনু আদী (২৭৭-৩৬৫ হিজরী) রচিত ‘আল কামেল ফী দ্বু’আফায়ির রিজাল’ (২/১১৩) থেকে হুবহু আরবী ইবারত তুলে ধরছি। যেমন عن ابى حنيفة قال : ما رأيت احدا اكذب من جابر الجعفى. অর্থাৎ ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, আমি জাবের ইবনে ইয়াজিদ আল জা’ফি এর চাইতে বড় মিথ্যাবাদী দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম লাইছ ইবনু আবি সুলাইম (রহ.) বলেছেন فانه كذاب অর্থাৎ নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি বহুত বড় মিথ্যাবাদী।

এবার তাহলে নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করুন, যে বর্ণনার মধ্যে দুইজন রাবীই মিথ্যাবাদী এবং জাল হাদীস তৈরীকারী হিসেবে অভিযুক্ত ও মুনকারুল হাদীসও সেটির কথাগুলো ইমাম বাকের-এরই ছিল বলে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?

প্রশ্নকর্তা : তা বুঝলাম, কিন্তু মির্যা সাহেবের ইমাম মাহদী দাবীকালে এই ধরণের ঘটনা ঘটলো কেন? এটা চিন্তার বিষয় নয় কি?

উত্তরদাতা : চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটা নিয়ে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, যেখানে এটি আল্লাহর অন্যান্য প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মতই! হ্যাঁ, যদি এটি প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মত না হত আর ইতিপূর্বে এইধরণের ঘটনা অসংখ্যবার না ঘটত! এখন এইধরণের ঘটনা ইতিপূর্বে অসংখ্যবার ঘটে যাওয়ায় বলার আর অপেক্ষা রাখেনা যে, মাহদীয়তের নির্দশ হিসেবে এর মধ্যে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যই বাকি থাকেনি।

প্রশ্নকর্তা : আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, চন্দ্রসূর্যগ্রহণের এই অলৌকিক ঘটনাটি বিশেষ কোনো নিদর্শন নয়, ইতিপূর্বেও সময় সময় এটি দৃশ্যমান ছিল? এর সমর্থনে আপনার নিকট কী প্রমাণ আছে?

উত্তরদাতা : জ্বী, ইতিপূর্বেও এটি বহুবার সাধারণ নিয়মেই দৃশ্যমান হয়েছিল। আর এটি আমার নিজের কোনো বক্তব্য নয়। এর পক্ষে ইতিহাস বড় সাক্ষী। আপনাদের ঢাকা বকশিবাজার থেকে প্রকাশিত ‘পাক্ষিক আহমদী’ (পৃ-২৪, তাং ১৫-এপ্রিল-২০১৫ইং) পড়ে দেখুন, আপনারাও এটি স্বীকার করে লিখেছেন এভাবে যে, ‘হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগের প্রফেসর জি. এম. বল্লভ ও আমি (মির্যায়ী লিখক) যে হিসাব কষেছি তাতে দেখা গেছে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ থেকে এ পর্যন্ত একই রমযান মাসে চন্দ্রসূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়েছে মোট ১০৯ বার। এর মধ্যে তিনবার দুটি গ্রহণই নির্ধারিত তারিখে অর্থাৎ ১৩ ও ২৮ রমযানে কাদিয়ান থেকে দৃশ্যমান ছিল।’

বলে রাখা জরুরী, মির্যায়ী লিখক এখানে ’কাদিয়ান থেকে দৃশ্যমান ছিল’ দাবী করলেও আমেরিকা মহাকাশ গবেষণা বিভাগ ‘নাসা’ তার এই দাবী প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ নাসা-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ১৮৯৪ সালের ৬ই এপ্রিলে সংঘটিত গ্রহণের মানচিত্রে (বেগুনি রঙ্গের একটি অঙ্কিত রেখা দ্বারা) উক্ত গ্রহণের কক্ষপথ দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, সেটি বাংলাদেশ আর বেঙ্গালুরু-এর উপর দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে চলে যায়। এই গ্রহণ এশিয়ার নানা দেশসহ ভারতেরও কয়েকটি স্থান থেকে দৃশ্যমান হলেও কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাঞ্জাব থেকে দেখা যায়নি। এখন প্রশ্ন হল, ‘কাদিয়ান’ কি ভারতের পাঞ্জাবের বাহিরে না ভেতরে?

নাসা

এখানে মজার বিষয় হল, নাসা-এর বিজ্ঞানীদের ওয়েবসাইটটিতে পরিষ্কার করে এও লিখা আছে, এই ধরণের চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা আজ অব্ধি প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক বার ঘটেছিল। আপনি কি এরপরেও এটিকে প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মতই মানতে অস্বীকার করবেন?

প্রশ্নকর্তা : আপনি কি আর কোনো মাহদী দাবীদারের সময়ও এই ধরণের চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল বলে প্রমাণ করতে পারবেন?

উত্তরদাতা : জ্বী, পারব। আপনি কি মরক্কো বংশোদ্ভূত সালেহ বিন তারিফ-এর নাম শুনেছেন? তিনি নিজেকে ৭৪৪ সালে নবী দাবী করেন। তিনি ৭৯১ সাল পর্যন্ত মরক্কোর ‘বারঘৌতা বারবার’ রাজ্যের একজন শাসক ছিলেন। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদীও দাবী করেছিলেন। তিনি যে বছর ইমাম মাহদী দাবী করেন তার পরের বছর অর্থাৎ ১২৬ হিজরী মুতাবিক ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে একই রমাযানের ১৩ এবং ২৮ তারিখে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের ঘটনাও ঘটেছিল। আর এই ঘটনা তার সময় চারবার ঘটেছিল যথাক্রমে ৭৪৪, ৭৪৫, ৭৮৭ এবং ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে। তার প্রতিষ্ঠিত ঐ জামাতের নাম ছিল ‘সালেহুল মুমিনীন’। তার মৃত্যুর পরেও তার এই জামাত প্রায় সাড়ে তিন’শ বছর পর্যন্ত আফ্রিকায় খুব দাপটের সাথে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। পরবর্তীতে ১০ম শতকের শেষের দিকে আল মুরাবিত রাজ-বংশের মুসলিম বীর সিপাহসালার ইউসুফ বিন তাসফিন এর নেতৃত্বে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে সালেহ বিন তারিফের রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ঐ মিথ্যা দলটিরও বিলুপ্তি ঘটে।

প্রশ্নকর্তা : কিন্তু মির্যা সাহেব তো ১৮৯৪ সালের দিকে শুধুই ইমাম মাহদী দাবীদারই ছিলেন, তিনি নবী দাবী করেননি? অথচ সালেহ বিন তারিফ তো নবী দাবীও করেছিল?

উত্তরদাতা : তাহলে ‘বাবী জামাত’ এর প্রতিষ্ঠাতা ইরানের আলী মুহাম্মদ বাব সম্পর্কে কী বলবেন? সে ইমাম মাহদী দাবী করেছিল ১৮৪৪ সালে। একই রমাযানে চন্দ্রসূর্য গ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল ১৮৫১ সালে। তিনি কিন্তু শুধু ইমাম মাহদী দাবীই করেছিলেন। বর্তমানেও তার বহু অনুসারী (প্রায় ৪ মিলিয়ন, উইকিপিডিয়া) পৃথিবীতে রয়েছে। প্রায় ২১৮টি রাষ্ট্রে তার অনুসারীদের অবস্থান রয়েছে। যাইহোক, মির্যা সাহেবের জন্য একটি দুঃসংবাদ আছে, বলব?
: বলুন!
: মির্যা কাদিয়ানী ঐ চন্দ্রসূর্যগ্রহণ সংক্রান্ত বর্ণনাটির মর্মার্থ বুঝাতে গিয়ে নিজ কিতাবে লিখে গেছেন, ‘বরং হাদীসের উদ্দেশ্য হল, কোনো নবুওয়ত বা রেসালত দাবীদারের সময়টিতে কখনো এই দুইটি গ্রহণ একত্রিত হবেনা।’ (রূহানী খাযায়েন ২২/২০৩)। মির্যা সাহেব এই কথা বলে মূলত সে সমস্ত মাহদী দাবীদারের বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঠাতে চাচ্ছেন যারা মাহদী দাবীর সময় নবুওয়ত ও রেসালতের দাবী করেনি, যদিও চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনাও ঘটেছিল! হায়! মানুষ কতটা ধূর্ত হলে এইরূপ উদ্ভট ব্যাখ্যাও দিয়ে যেতে পারে! যাইহোক, এখন আমার প্রশ্ন হল, মির্যা সাহেব ১৮৯৪ বা ১৮৯৫ সালে চন্দ্র সূর্যগ্রণের সময়ও নবুওয়ত বা রেসালতের দাবিদার ছিলেন না, যা আপনিও জানেন বরং তিনি ১৮৯৭ সালের দিকেও নবুওয়ত দাবিদারের প্রতি লানত (অভিশাপ) বর্ষণ করেছেন। (দেখুন মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ২/২৯৭-২৯৮ ও ২/২)।

এমতাবস্থায় ঐ দুই মিথ্যুকের বর্ণনাকে সহীহ মেনে নেয়া হলেও এর মাধ্যমে মির্যা কাদিয়ানীকে কীভাবে ইমাম মাহদী সাব্যস্ত করবেন? অথচ মির্যা কাদিয়ানীর উক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে আপনি ‘সালেহ বিন তারিফ’-কেই ইমাম মাহদী মানতে বাধ্য। কারণ সে একই সময় ইমাম মাহদী এবং নবী দুটোরই দাবীদার ছিল!

আচ্ছা! আপনি কি জানেন আপনাদের মির্যা কাদিয়ানী সাহেব পরিষ্কার ভাষায় লিখে গেছেন যে, তার একনিষ্ঠ অনুসারীরা যে কোনো মতভেদপূর্ণ বিষয়ের সমাধান যেন তার কাছ থেকেই নেয়? (দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৭/৬৪)। অন্তত এ দিক থেকেও আপনাদের জন্য বৈধ হবেনা ঐ দুই মিথ্যুকের বর্ণিত রেওয়ায়েতকে মাহদীয়তের কথিত নিদর্শন মনে করা। কারণ মির্যা সাহেব এও লিখে গেছেন ‘ইমাম বুখারীর কৃত শর্তের বিপরীত যে হাদীস সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।’ (দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৭/১১৯-২০)। এখন এর কী উত্তর দেবেন?

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

সহীহ হাদীসের আলোকে দাজ্জাল এর প্রকৃত পরিচয়

0

মসীহ দাজ্জাল এর প্রকৃত পরিচয় :

পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে রূপ দেয়ার ঘটনা কম ঘটেনি। ‘দাজ্জাল’ তন্মধ্যে অন্যতম। গভীর অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা গেছে তার সিংহভাগই রাজনৈতিক কিবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশ্যেই ছিল। অথচ ‘দাজ্জাল’ এর পরিচয় সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী (সা:) থেকে সহীহ সনদে আমাদের নিকট যেসমস্ত বর্ণনা পেীঁছেছে তা খতিয়ে দেখলে বুঝা যায় :

১. দাজ্জাল একজন মানবাকৃতির হবে। কারণ হাদীসে ‘রাজুলুন জাসিমুন আহমারু’ (رجل جسيم احمر) শব্দ আসছে। যার অর্থ লালচে বর্ণের ও স্থূলদেহের এক ব্যক্তি। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। সুতরাং কোনো সভ্যতা কিংবা কোনো মিশনারী গোষ্ঠীকে হাদীসে বর্ণিত সেই ‘দাজ্জাল’ ব্যাখ্যা দেয়া ভুল এবং সুস্পষ্ট হাদীস বিকৃতির শামিল। যেহেতু সভ্যতাকে যেমন মানুষ বলা যায় না, তেমনি দলবদ্ধ কোনো মিশনারীও একব্যক্তি হয় না।

২. দাজ্জালের চুল হবে কোঁকড়ানো। তার উভয় চোখই ক্রুটিযুক্ত থাকবে। তার যে চোখটি কানা থাকবে সেটি দেখতে ফোলা আঙ্গুরের ন্যায় দেখাবে। (সূত্র ঐ)। আর তার ডান চোখটি সম্পূর্ণ নষ্ট থাকবে। (সূত্র ফাতহুল বারী ১৩/৯৭; ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী)। এভাবে অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় রাসূল (সা:) যেই ‘দাজ্জাল’ এর ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে গেছেন সেটিকে কাদিয়ানী, হেযবুত তওহীদসহ কতিপয় নির্বোধ সম্প্রদায় নানা প্রকারের রঙ চড়িয়ে নানা কল্পনা করে যেই কাল্পনিক অ-মানবীয়রূপে চিত্রিত করে থাকে সেটি পুরোপুরি বাতিল, সত্যের সাথে লেশমাত্র সম্পর্কও নেই।

  • বলাইবাহুল্য এসবই আজগুবি কল্পনা, সত্যের সঙ্গে এগুলোর কোনোই সম্পর্ক নেই। তাদের সেসব কল্পিত-নির্ভর অ-মানবীয় ও রূপক ব্যাখ্যার সমর্থনে কোনো প্রমাণ না আছে কুরআনে, না আছে সহীহ কোনো হাদীসে। অদ্যাবধি কেউ দেখাতে পারেনি, পারবেও না। কথাটা আমি জেনেশুনেই বলছি। এই পর্যায়ে বেশি না আমি তাদের উদ্দেশ্যে বেশকিছু হাদীসের খন্ডিত উদ্ধৃতি পেশ করব। যদি হাদীসে বর্ণিত ‘দাজ্জাল’ তাদের বিচারে রূপক কিবা অ-মানবীয় কিছু হয়ে থাকে তখন তারা নিচের প্রশ্নগুলোর কী ব্যাখ্যা দেবে? যেমন,

(ক) দাজ্জাল সম্পর্কে হাদীসে ‘রাজুল’ (Man) শব্দ আসছে। রাজুল অর্থ মানুষ বা ব্যক্তি। রাসূল (সা:) তাকে তৎকালীন আব্দুল উজ্জাহ ইবনে কাতান নামক জনৈক ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। এখন দাজ্জাল মানবাকৃতির না হলে রাসূল (সা:) তাকে অন্য আরেকজন মানবের সাথে কিজন্য সাদৃশ্য থাকার সংবাদ দিলেন?

(খ) দাজ্জালের চুল কোঁকড়ানো হবে উল্লেখ আছে। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। এখন এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?

(গ) দাজ্জাল আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীতে ধারাবাহিক তিন বছর খরা ও দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং ২৭৫৬৮)। এখন কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন আসে মির্যা কাদিয়ানীর সময় কি এধরণের ঘটনা ঘটেছিল?

(ঘ) রাসূল (সা:) বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকতেই যদি দাজ্জাল আগমন করে তাহলে ….। (তিরমিজী কিতাবুল ফিতান)। এতে বুঝা গেল, তখনো পর্যন্ত দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হয়নি। বড়জোর দাজ্জালকে আবিস্কার করা হয়েছিল মাত্র। সে হিসেবে আধুনিক গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন দাজ্জাল বারমুডা ট্রায়েঙ্গেলে থাকতে পারে। কারো কারো মতে জাপানের ড্রাগন ট্রায়েঙ্গেল (Triagle) বা ডেভিল সী-তে থাকতে পারে। তবে এগুলো নিছক কারো কারো গবেষণাধর্মী বক্তব্য, যার সমর্থনে ইসলামের অথেনটিক সোর্সগুলো নিরব।

(ঙ) হযরত তামীম আদ-দারী (রা:) তার কাফেলাসহ দাজ্জালকে মদীনার পূর্বদিকের এক অজানা দ্বীপে সচক্ষে শিকলাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করতে দেখেছেন। রাসূল (সা:) তাঁর এই তথ্য নাকচও করেননি, সহমত-ও ব্যক্ত করেননি। (সহীহ মুসলিম কিতাবুল ফিতান হাদীস নং ২৯৪২)। এটি তামীম আদ-দারী (রা:)-এর হয়ত স্বপ্নের বর্ণনা! যার উপর না সাহাবাদের ইজমা হয়েছিল আর না সালাফদের ইজমা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, কিছুই না। সুতরাং ইজমার বিপরীতে বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনাপূর্ণ বর্ণনার উপর দাজ্জালের কনসেপ্ট দাঁড় করতে চাওয়া দুষ্টমি ছাড়া কিছুই না।

(চ) তামীম আদ-দারীর বর্ণনামতে, দাজ্জাল যথাসময় আল্লাহতালার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে পৃথিবীর প্রাচ্যে অবস্থিত পারস্য অঞ্চল খোরাসানের ইস্পাহান শহরের ‘ইয়াহুদিয়া’ এলাকা থেকে আসলরূপে আত্মপ্রকাশ করবে বলে উল্লেখ রয়েছে। (তিরমিজী কিতাবুল ফিতান)। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) লিখেছেন, দাজ্জাল তার আসলরূপে আত্মপ্রকাশের পূর্বে ‘নবী’ দাবী করবে। তারপর ‘খোদা’ দাবী করবে। তখনি সে আসলরূপে আত্মপ্রকাশ হয়ে দুনিয়াব্যাপী ফেতনা ছড়াবে। (ফাতহুল বারী, কিতাবুল ফিতান)। তাই প্রশ্ন আসে আধুনিক যান্ত্রীক সভ্যতা বা খ্রিস্টান মিশনারীরা কবে কিভাবে নবী আর খোদা দাবী করলো, বলবেন কি?

(ছ) দাজ্জাল মদীনার অদূরে এক পাশ্বে এসে পৌঁছবে। এই সময় মদীনা তিনবার কেঁপে উঠবে। তখন মদীনায় অবস্থানকারী সকল কাফের মুনাফিক বেরিয়ে পড়বে এবং দাজ্জালের সাথে মিলিত হবে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৪)। এখন এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?

(জ) দাজ্জাল পৃথিবীতে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। তখন প্রথম দিনটি এক বছর সমান দীর্ঘ হবে। রাসূল (সা:) সেই দীর্ঘ সময়টিতে সময়ের অনুমান করে নামায পড়তে বলেছেন। (সহীহ মুসলিম কিতাবুল ফিতান)। এখন প্রশ্ন হল, কল্পনাবীদদের রূপক দাজ্জাল কি পৃথিবীতে শুধুই চল্লিশ দিন অবস্থান করছে?

(ঝ) দাজ্জাল মদীনার অদূরে এক যুবককে হত্যা করার পর পুনরায় জীবিত করে আবার যখন হত্যা করতে চাইবে তখন সে আর হত্যা করতে সক্ষম হবেনা। (সহীহ বুখারী কিতাবুল ফিতান)। কল্পনাবীদদের দাজ্জাল কবে কাকে হত্যার পর পুনরায় জীবিত করল, বলবেন কি?

লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক