Home Blog Page 39

মির্যা কাদিয়ানীর স্ববিরোধী ইলহামের সামান্য চিত্র

0

একজন কাদিয়ানী আর একজন মুসলমান তাদের দুইজনের মাঝে ঈসা (আ:) সম্পর্কে কথোপকথন হচ্ছে

  • জনৈক কাদিয়ানীর বক্তব্য :

আল্লাহ তায়ালা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে ১৮৯১ সালে ইলহামের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ঈসা (আঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন, তাই বর্তমানে তাঁর আকাশে থাকা এবং কেয়ামতের আগে সেখান থেকে নাযিল হওয়ার প্রচলিত বিশ্বাস ঠিক না। (মির্যা সাহেবের সংক্ষিপ্ত জীবনীগ্রন্থ ‘আহমদ চরিত‘ বইয়ের পৃষ্ঠা নং ৮ দ্রষ্টব্য)। তাই আমাদের বিশ্বাস মতে, আগত ঈসা বলতে সে ঈসা-ই উদ্দেশ্য যিনি বনী ইসরাইলী ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ)-এর পরিপূর্ণ গুণাবলির অধিকারী হয়ে এই উম্মতের মধ্যে জন্ম নিবেন। আর তিনি-ই ভারতের কাদিয়ান গ্রামের মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৩৯-১৯০৮ ইং)।

  • কাদিয়ানীর বক্তব্যের প্রতিউত্তর :

প্রিয় আহমদী (কাদিয়ানী)বন্ধু! আমাদের মুসলিম উম্মাহা’র সাথে মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীদের মাঝে অন্যতম সাংঘর্ষিক বিষয়টি হল, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পরে মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবী করা। তাই মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবীর সাথে ঈসা (আঃ) জীবিত নাকি মৃত এ সমস্ত বিষয়ের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমরা মনে করিনা। আর যেহেতু ঈসা (আ:) জীবিত নেই মর্মে সম্পূর্ণ বিষয়টি শুধুমাত্র মির্যা কাদিয়ানীরই কথিত ইলহাম-নির্ভর; তাই এই মুহূর্তে হযরত ঈসা (আঃ) জীবিত নাকি মৃত সেই প্রসঙ্গে আপাদত ১০টা মিনিট পরে যাই। তার আগে মির্যা কাদিয়ানীর কথিত ইলহাম সম্পর্কে আমার যে প্রশ্নগুলো রয়েছে তার উত্তর দিন! অন্যথা ঈসা (আ:) সম্পর্কে সে যেই ইলহামের (আল্লাহপ্রদত্ত দৈব-বাণী) কথা লিখে গেছে তা জঘন্য মিথ্যা ও বানোয়াট বলেই সাব্যস্ত হবে!

  • মির্যা কাদিয়ানীর বই ‘এক গলতি কা ইযালা’ থেকে তার নবী রাসূল দাবী করার প্রমাণ দেখুন! Click

আপনাদের মির্যা গোলাম কাদিয়ানী নিজেকে মাসীহ ঈসা, ইমাম মাহদী এবং নবী রাসূল ইত্যাদি দাবী করার আগে ১৮৭৫ সাল থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছরব্যাপী নিজেকে একজন মুজাদ্দিদ এবং মুলহাম হবার দাবী করতেন। তারই দাবী অনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ১৮৮০-৮৪ ইং মধ্যকার সময়টিতে তিনি ৪ খন্ডে “বারাহীনে আহমদিয়া” নামক একখানা কিতাব-ও রচনা করেন। মূলকথা শুরু করার আগে আমি মির্যা সাহেবের চারখানা বক্তব্য পেশ করছি।

  • বারাহীনে আহমদিয়া কিতাবের বৈশিষ্ট্যঃ

প্রথমত, ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ কিতাবের বিশেষত্ব উল্লেখ করে মির্যা সাহেব লিখেছেন :-

“১৮৬৪ কিংবা ১৮৬৫ সালে তথা কাছাকাছি কোনো একটি সময় যখন এই অধম (মির্যা) স্বীয় হায়াতের প্রথমাংশে শিক্ষা-দীক্ষা অর্জনে ব্যস্ত ছিল, তখন (এই অধম) জনাব আঁ-হযরত (সা:)-কে স্বপ্নে দেখতে পেল এবং সেই সময় এই অধম (মির্যা)’র হাতে একটি দ্বীনি কিতাব ছিল যেটি এই অধমের কোনো কিতাব বলেই (তখন) মনে হচ্ছিল। আঁ-হযরত (সা:) তিনি এই কিতাবটি দেখতে পেয়ে আরবি ভাষায় (স্বপ্নে) জিজ্ঞাসা করলেন যে, তুমি (মির্যা) এই কিতাবের নাম কী রেখেছ? (আমি) অধম প্রত্যুত্তরে বললাম, আমি এর নাম “কুতুবী” রেখেছি। এই নামের স্বপ্ন-ব্যাখ্যা এখন এই ইশতিহারী কিতাব রচিত হওয়াতে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, এই কিতাব (বারাহীনে আহমদী) এমন একটি কিতাব, যেটি কুতুবে ছেতারা (ধ্রুবতারা)’র ন্যায় গয়রে মুতাযালযিল (নিখুঁত) এবং মুসতাহকিম (সুদৃঢ় ও শক্তিশালী)। যার পরিপূর্ণ দৃঢ়তা পেশ করতে দশ হাজার রূপিয়ার ইশতিহার দেয়া হয়। মোদ্দাকথা, আঁ-হযরত (সা:) তিনি কিতাবটি আমার কাছ থেকে নিয়ে নেন। কিতাবটি যখন হযরত (সা:)-এর পবিত্র হাতের সংস্পর্শে আসল এবং তাঁর হাতের ছোঁয়া লাগল তখনি সেটিতে অবর্ণনীয় একটি খোশ রঙ সৃষ্টি হল এবং চমৎকার আমরুত (পেয়ারা) ফল হিসেবে পরিণত হয়ে গেল। আঁ-হযরত (সা:) যখন এই ফলকে বণ্টন করার জন্য টুকরো টুকরো করতে চাচ্ছিলেন তখন তা হতে এই পরিমাণে স্বাদ নির্গত হল যার ফলে আঁ-হযরত (সা:)-এর হাত মুবারক কনি পর্যন্ত মধুতে ভরে গেল।” (রেফারেন্স – বারাহীনে আহমদিয়া খন্ড নং ৩ (বাংলা অনূদিত পৃষ্ঠা নং ১৯২); রূহানী খাযায়েন খন্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ২৭৫; লেখক, মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি বইয়ের সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত; ২০০৮ সালে পুনঃ মুদ্রিত)।

  • পুরো বক্তব্যের খোলাসাঃ

(১) খোদার নির্দেশিত কিতাবটির নাম “কুতুবী“। অর্থাৎ ধ্রবতারার ন্যায় নিখুঁত, আর দলিল-প্রমাণের দিক থেকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী।

(২) এটি অপ্রতিরোধ্য কিতাব যার মুকাবিলায় সেই সময়ে দশ হাজার রূপীর ইশতিহার (চ্যালেঞ্জ) ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

(৩) এমন কিতাব যেটি হযরত (সা:)-এর পবিত্র হাতের ছোঁয়া লাগায় তাতে অবর্ণনীয় খোশ রঙ সৃষ্টি হয় এবং চমৎকার আমরুত (পেয়ারা) ফলে পরিণত হয় এবং যার স্বাদ এই পরিমাণে নির্গত হয় যার ফলে হুজুর (সাঃ)-এর হাত কনি পর্যন্ত মধুতে ভরে যায়।

(৪) মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত পুস্তকের ১ম খন্ডের ৫৬ নং পৃষ্ঠায় মির্যা সাহেব “বারাহীনে আহমদিয়া” সম্পর্কে আরো লিখেছেন “প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় দিক থেকে এই কিতাবের তত্ত্বাবধায়ক এবং কর্তৃপক্ষ হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।

  • যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদের বৈশিষ্ট্যঃ

দ্বিতীয়ত, মুজাদ্দিদ ও যুগ ইমামগণ সম্পর্কে মির্যার বক্তব্য :

মির্যা কাদিয়ানী সাহেব ১৮৯৯ সালেও খোদ নিজ হাতে যুগ ইমাম তথা মুজাদ্দিদ আর মুফাসসির সম্পর্কে তার কিতাবে লিখে গেছেন, دوسرے ایسے ائمہ اور اکابر کے ذریعہ سے جن کو ہریک صدی میں فہم قرآن عطا ہوا ہے جنہوں نے قرآن شریف کے اجمالی مقامات کی احادیث نبویہ کی مدد سے تفسیر کرکے خدا کی پاک کلام اور پاک تعلیم کو ہریک زمانہ میں تحریف معنوی سے محفوظ رکھا. ایام الصلح অর্থাৎ [আল্লাহতালা কর্তৃক পবিত্র কুরআনের সঠিক শিক্ষাকে প্রত্যেক যুগে সর্বসাকুল্য অবিকৃত রাখার চারটি পদ্ধতির মধ্য হতে] দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এমন ইমাম এবং আকাবের (তথা মুজাদ্দিদ)গণ দ্বারাও যাঁদের প্রত্যেক শতাব্দীর মাথায় কুরআনের বিশুদ্ধ বুঝ প্রদান করা হয়ে থাকে। তারা কুরআন শরীফের অস্পষ্ট বিষয়াদী নবীর হাদীস সমূহের সাহায্যে তাফসীর করে খোদার পবিত্র বাণী ও পবিত্র শিক্ষাকে প্রত্যেক যুগেই অর্থগত বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছিলেন।’ (আয়্যামুছ ছুলহি ৫৫, সংকলনের তাং ১৮৯৯ ইং; রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮)। (স্ক্রিনশটে দেখুন)

  • তারপর প্রত্যেক যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের ব্যাখ্যা মেনে নেয়া কিরূপ জুরুরী সে সম্পর্কে মির্যা সাহেব লিখেছেন :

(১) মুজাদ্দিদ ব্যক্তি খোদাপ্রদত্ত জ্ঞান আর ঐশী আয়াত সহকারে আগমন করা জুরুরী। (রূহানী খাযায়েন ৩/১৭৯)।

(২) মুজাদ্দিদকে কুরআনের বুঝ দান করা হয়। (রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮)।

(৩) স্মরণ রেখো! মুজাদ্দিদ ব্যক্তি দ্বীনের মধ্যে কোনোরূপ বেশকম করেননা। (রূহানী খাযায়েন ৬/৩৪৪)।

(৪) যে ব্যক্তি ইলহামপ্রাপ্ত সে কি নিজ থেকে কোনো কথা বলতে পারে? (রূহানী খাযায়েন ১৯/২২১)।

(৫) মুজাদ্দিদের কথায় বিশ্বাস রাখা ফরজ নয় বলা খোদার হুকুম থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার সমতুল্য। (রূহানী খাযায়েন ৬/৩৪৪)।

  • মির্যা সাহেব ভুল-ক্রুটির উর্ধ্বে হওয়াঃ

তৃতীয়ত, মির্যা সাহেব নিজেকে একজন সুরক্ষিত এবং ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে বুঝাতে যা যা লিখে গেছেন তা তারই বই থেকে জেনে নিন!

(১) আল্লাহতালা আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলের উপর স্থির থাকতে দেন না এবং আমাকে প্রত্যেক ধরণের ভুল ভ্রান্তি কথা হতে রক্ষা করেন। (নূরুল হক, রূহানী খাযায়েন ৮/২৭২)।

(২) আমি যাই কিছু বলি সবই খোদার নির্দেশে বলি এবং আমি আমার নিজ থেকে কিছুই করিনা। (মাওয়াহিবুর রহমান, রূহানী খাযায়েন ১৯/২২১)।

(৩) আমি দুনিয়ার কথা বলিনা। কেননা আমি দুনিয়া হতে নই। বরং আমি সেটাই বলি যা খোদাতায়ালা আমার মুখে ঢেলে দেন। (পয়গামে ছুলহি, রূহানী খাযায়েন ২৩/৪৮৫)।

  • কুরআনের সমস্ত প্রজ্ঞা অর্জনকরাঃ

চতুর্থত, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-ও তুলে ধরা হবে। মির্যা সাহেবের কথিত ওহী, ইলহাম আর কাশফ এর সমষ্টিকে গ্রন্থবদ্ধ করা হয় “তাযকিরা” নামে। এই বইয়ের ৩৫ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে,

তিনি লিখেছেন, ১৮৮২ সালে তার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম হয় ‘আর রাহমান আল্লামাল কুরআন’। মির্যা কাদিয়ানী সাহেব তার উক্ত কথিত ইলহামের ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, اس الہام کے رو سے خدا نے مجھے علوم قرآنی عطا کئے ہیں اور میرا نام اول المومنین رکھا اور مجھے سمندر کی طرح معارف اور حقائق سے بهر دیا ہے অর্থাৎ “আর-রহমান আল্লামাল কুরআন” এই ইলহাম দ্বারা খোদাতায়ালা আমাকে কুরআনের অগণিত প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং আমার নাম রেখেছেন ‘আওয়্যালুল মুমিনীন’। আমাকে সমুদ্রের মত কুরআনের প্রজ্ঞা আর নিগূঢ় রহস্যাবলী দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন।” (রূহানী খাযায়েন ১৩/৫০২)।

  • এক নজরে মির্যা কাদিয়ানী ও কাদিয়ানীয়ত Click


মূল-কথাঃ

এবার মূল কথায় ফিরে আসা যাক ! মির্যা সাহেবের মত এমন একজন মুলহিম এবং মুজাদ্দিদ দাবীদারের বইতে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে পরিস্কার শব্দে লিখা আছে,

(১) ঈসা (আঃ) তো ইঞ্জিল কিতাবকে একদম অসম্পূর্ণ অবস্থায় ছেড়ে আকাশে গিয়ে বসে আছেন। (টীকাঃ বারাহীনে আহমদিয়া ৩৬১; রূহানী খাযায়েন ১/৪৩১)।

(২) “আমার-ও এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে নাযিল হবে।” (রূহানী খাযায়েন ২২/১৫২)।

(৩) “আমি বারাহীনে আহমদিয়ার মধ্যে লিখেছিলাম, মাসীহ ইবনে মরিয়ম (আঃ) আকাশ থেকে নাযিল হবেন। কিন্তু পরবর্তীতে লিখেছি, আগত সেই মাসীহ আমি নিজেই।” (রূহানী খাযায়েন ২২/১৫২-৫৩)।

(৪) খোদাতালা স্বীয় পবিত্র বাণীতে ঈসার পুনঃআগমন বিষয়ে ইংগিত করেছেন। তাই সেই ইংগিতের বর্ণনা বারাহীনে আহমদিয়া’র তৃতীয় খন্ডে উল্লেখ করা হয়েছে। অত্র আয়াত ‘হুয়াল্লাযী আরসালা রাসূলাহু বিল হুদা… (সূরা তাওবা ৩৩)’র মধ্যে ফোরকানি ইশারা রয়েছে যে, اور جب حضرت مسیح علیہ السلام دوبارہ اس دنیا میں تشریف لائیں گے تو ان کے ہاتھ سے دین اسلام جمیع آفاق اور أقطار میں پہیل جائے گا অর্থাৎ যখন মাসীহ আলাইহিস সালাম ‘দ্বিতীয়বার’ এই পৃথিবীতে আগমন করবেন তখন তাঁর হাতে ইসলাম সমগ্র দুনিয়ার আনাচেকানাচে পৌঁছে যাবে। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১/৫৯৩; সারমর্ম)।

  • আমার প্রশ্নগুলোঃ

যদি মনে করেন যে, মির্যা সাহেবের আগের সে সমস্ত কথা সঠিক ছিলনা অথবা তার পরবর্তী বক্তব্যের মাধ্যমে আগের গুলো রহিত হয়ে গেছে কিংবা আল্লাহতায়ালা তাকে পরবর্তীতে নতুনভাবে ইলহামের মাধ্যমে ঈসা’র মৃত্যুর কথা জানিয়ে দিয়েছেন; তখন নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর কিভাবে দেবেন!

(১) প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ কিতাবটির তত্ত্বাবধায়ক ও কর্তৃপক্ষ স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিভাবে হন যেখানে ঈসা (আঃ) আকাশে থাকা এবং তাঁর দ্বিতীয়বার আগমন সম্পর্কে উল্লিখিত কথাগুলো ভুল ও ভ্রান্ত?

(২) এই ধরণের ভুল ভ্রান্তি কথা যেই কিতাবে থাকে সেটি কিভাবে “কুতুবী” (ধ্রুবতারা)’র ন্যায় নিখুঁত এবং দলিল-প্রমাণের দিক থেকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়? ভাবিয়ে তোলে কিনা?

(৩) স্বপ্নযোগে রাসূল (সাঃ) এমন একখানা কিতাবের প্রসংশা কিভাবে করতে পারেন যেই কিতাবটি চরম পর্যায়ের ভুলভ্রান্তি এমনকি শিরিকি আকীদায় ভরপুর? কারণ মির্যা সাহেব বলেছেন, ঈসা (আঃ)-কে জীবিত থাকার বিশ্বাস শিরিক! (রূহানী খাযায়েন ২২/৬৬০)।

(৪) ‘দোবারা‘ তথা দ্বিতীয়বার তো সে ব্যক্তি-ই আসতে পারেন যিনি প্রথমবার এসেছিলেন, তাই নয় কি? এমতাবস্থায় সে ঈসা-ই যদি আর জীবিত না থাকেন তখন গোলাম আহমদের এই “দো-বারা” ওয়ালা ইলহামের কী হবে? অথচ বারাহিনে আহমদিয়া নামক বইটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে গিয়ে মির্যা সাহেব লিখেছেন “আমি এই কিতাব খোদাতায়ালার পক্ষ হতে ‘মামূর’ তথা নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েই লিখেছি। কেউ তার প্রদত্ত কোনো দলিল ভাঙ্গতে পারলে তাকে দশ হাজার রূপিয়া পুরস্কার দেয়া হবে।” (দেখুন, মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ১/২৩-২৫; আরো ১/২৭-২৮; নতুন এডিশন)। এই কথাগুলোর কী জবাব? মির্যা সাহেবের আকীদা-বিষয়ক পরের ইলহামী কথা দ্বারা কি তার আগের ইলহামী কথা রহিত হয়ে যাবে?

(৫) মির্যা সাহেব খোদার নির্দেশ ছাড়া কিছুই বলেন না, মুলহাম কখনো নিজ থেকে কিছুই বলেন না, মির্যা সাহেবের মুখে আল্লাহ যা ঢেলে দেন তিনি শুধু তাই বলেন, আল্লাহ তাকে ভুলের উপর এক মুহূর্ত-ও স্থির থাকতে দেন না, কথাগুলো সত্য হলে তখন এই টাইপের একটি লোক কিভাবে খোদার নির্দেশিত পুস্তকে-ও যতসব ভ্রান্তিপূর্ণ(!) আর শিরিকি(!) কথা লিখতে পারেন? তা-ও আবার “কুতুবী” নামক খ্যাতি পাওয়া কোনো বইতে যেটি স্বপ্নে রাসূল (সাঃ) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বলেই মির্যার দাবী! জবাব কিভাবে দেবেন!

(৬) মির্যা গোলাম আহমদ সাহেব (মৃত ১৯০৮ ইং) পরিস্কারভাবে কিন্তু এ-ও লিখে গেছেন : میرے ہر بات الہامات پر مبنی ہوتی ہے۔ অর্থাৎ আমার প্রত্যেকটা কথা ইলহামের উপর প্রতিষ্ঠিত। (রূহানী খাযায়েন খন্ড ১৯ পৃষ্ঠা ২২১)। কাজেই ঈসা (আঃ) বেঁচে নেই, তার এই বক্তব্য ইলহামী হলে তখন ঈসা (আঃ) আকাশে জীবিত, তিনি সেখান থেকে কেয়ামতের আগে দ্বিতীয়বার আগমন করবেন, মর্মে আগেকার ইলহামী বক্তব্যগুলোর কী হবে?

(৭) এতদ্ব্যতীত মির্যা সাহেবের পরবর্তী দাবী অনুসারে আগত সেই মাসীহ যদি তিনি নিজে-ই হন তখন বনী ইসরায়েলি ঈসা’র দ্বিতীয়বার আগমনের সেই ফোরকানী ইশারা‘র কী হবে?

(৮) মির্যা গোলাম আহমদকে সমুদ্রের মত কুরআনের অগণিত প্রজ্ঞা আর নিগূঢ় রহস্যাদি দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেয়ার ইলহামের দুই বছর পর ১৮৮৪ সালে ঈসা (আঃ)-এর দ্বিতীয়বার আগমন করার সেই ‘ফোরকানী ইশারা’ ওয়ালা ইলহামটির-ও বা কী জবাব?

সংক্ষেপে এ কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। আল্লাহর ওয়াস্তে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করুন আর ভেবে দেখুন, ইসলামের গত চৌদ্দশত বছরের উম্মতে মুহাম্মদিয়ার সর্বসম্মত আকীদা, তাফসির, অসংখ্য সহীহ হাদীস আর সকল যুগ ইমাম এবং ইসলামের ইতিহাস সব কিছুকে পাশ কেটে শুধু এমন একজন ব্যক্তির কথায় আপনারা কিভাবে আস্থা আর বিশ্বাস রেখে ঈসা (আঃ) এর দ্বিতীয়বার আগমনকে অস্বীকার করতে পারেন, যেই মানুষটির জীবনে স্ববিরোধী কথাবার্তার অন্ত ছিল না!? নতুবা উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর জবাব কিভাবে দেবেন?

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইসলামকে সহজীকরণের উদ্দেশ্যে দাওয়াতের এক ভয়ঙ্করপন্থা

0
  • আলোচনার শুরুতে আমরা দু’টি পরিভাষার সাথে পরিচিত হই… ওলামায়ে কেরামের তো জানাই আছে, অন্যদের জন্য নিম্নে পরিভাষা দুটোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো!

১। التلفيق (আত তালফীক) :

একাধিক মাযহাবকে একত্র করে আমল করাকে তালফীক বলা হয়। যেমন- একজন অজু করলো। এরপর তার শরীর থেকে রক্ত বের হলো। সে মনে মনে বললো, ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ এর মাযহাব অনুযায়ী যেহেতু শরীর থেকে রক্ত বের হলে অযু ভাঙ্গে না, অতএব আমি এ ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহের মাযহাব অবলম্বন করলাম। কিছুক্ষণ পর তার স্ত্রীর শরীরের সাথে হাত লাগলো। মেয়েদের শরীর স্পর্শ করলে ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মাযহাব অনুযায়ী ওযু নষ্ট হয় না। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহর মাযহাব মোতাবেক ওযু নষ্ট হয়ে যায়। সে এখন স্থির করলো, এ ব্যাপারে আমি ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ এর মাযহাব গ্রহণ করলাম। এরপর সে ঐ অজু দ্বারা নামায আদায় করলো। এটা হচ্ছে তালফীকের উদাহরণ।

২। تتبع الرخص (রুখসত অন্বেষণ বা সুযোগ সন্ধান) :

শরীয়তে রুখসত বলতে দুই ধরনের বিষয়কে বুঝানো হয় : এক. কোরআন-সুন্নাহ দ্বারা নির্দেশিত রুখসত। যেমন- মুসাফির অবস্থায় চার রাকআত বিশিষ্ট নামাযকে দুই রাকআত আদায় করা। এ ধরনের রুখসত পালনে কোনো অসুবিধাই নেই। এই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:

  • ان الله يحب ان تؤتى رخصه كما يحب ان تؤتى عزائمه

আল্লাহ তাআলা রুখসতগুলো পালন করাও তেমনটিই পছন্দ করেন, যেমনটি তিনি চান আযীমতগুলো পালন করা। (আল মুজামুল কাবীর: ১১/৩২৩, হাফেয মুনযিরী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আত তারগীব: ২/১৩৫)। দুই. ফুকাহায়ে কেরামের ইজতেহাদী রুখসত সমূহ খুঁজে বেড়ানো। অর্থাৎ কোনো একজন মুজতাহিদ ইমাম একটি বিষয়কে নাজায়েয বলে আখ্যা দিয়েছেন, আর অন্য কোনো ইমাম সে ব্যাপারে জায়েযের ফতওয়া দিয়েছেন। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র সুবিধার স্বার্থে এই ধরনের রুখসতগুলো অন্বেষণ করে করে আমলের জন্য গ্রহণ করার চেষ্টা করা। এক কথায় নিজের মনের সাথে যেটা মিলে, সব মাযহাব থেকে এমন সহজটা গ্রহণ করা। অথচ শরীয়তে প্রবৃত্তির অনুসরণকে সম্পূর্ণভাবে হারাম করা হয়েছে। (দেখুন, আল মুওয়াফাকাত,৫/৯৯, আল বাহরুল মুহীত,৬/৩২৫, জামিউ বয়ানিল ইলমি ওয়া ফাজলিহী ২/৯২)। এখানে এই দ্বিতীয় অর্থ উদ্দেশ্য।

তালফীক ও তাতাব্বুউর রুখাসের মাঝে যেমন কিছুটা সাদৃশ্য আছে, তেমনিভাবে এ দু’য়ের মাঝে কিছুটা পার্থক্যও রয়েছে। এ সম্পর্কে অনেক লম্বা আলোচনা আছে, যা এ অল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ‘তালফীক’ ও ‘তাতাব্বুউর রুখসাত’ এ দু’টি চিন্তাধারাকেই ওলামায়ে কেরাম নাজায়েয, হারাম ও মারাত্মক গোনাহের কাজ বলে গণ্য করেছেন। (আল মুওয়াফাকাত: ৪/১৪০)। কেউ বলতে পারেন, হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো দুই জিনিসের মাঝে সহজটাই গ্রহণ করতেন। আমি বলবো, হাদীসটা অর্ধেক বলে থামেন কেন? পূর্ণ হাদীসটি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, ভুল ভেঙ্গে যাবে।

  • عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ أَنَّهَا قَالَتْ مَا خُيِّرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنَ أَمْرَيْنِ إِلاَّ أَخَذَ أَيْسَرَهُمَا، مَا لَمْ يَكُنْ إِثْمًا، فَإِنْ كَانَ إِثْمًا كَانَ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنْهُ.‏

হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে যখনই দু’টি জিনিসের মাঝে একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া হতো, তখন তিনি সহজটিই গ্রহণ করতেন যদি তা গুনাহ না হতো। গুনাহ হতে তিনি অনেক দূরে অবস্থান করতেন। সহীহুল বুখারী, হাদীস নম্বর: ৩৫৬০।

দুইজিনিসের মাঝে স্বাধীনতা দেয়া হলে, সেই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহজটা ওই সময় গ্রহণ করতেন, যখন তা গুনাহ না হতো। আর তালফীক ও সুযোগসন্ধানকে তো প্রবৃত্তির অনুসরণ হবার কারণে নাজায়েয ও গুনাহের কাজ বলা হয়েছে। তাই অর্ধেক হাদীস পড়ে মন্তব্য করা উচিত হবে না। হাফেয ইবনে হাযম রাহিমাহুল্লাহ এবং হাফেয ইবনে আব্দুল বার রহিমাহুল্লাহ এই ধরনের চিন্তাধারা নাজায়েয ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের ইজমা’ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। (মারাতিবুল ইজমা’: পৃষ্ঠা নম্বর: ১৭৫, জামিউ বয়ানিল ইলম)। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন: যদি কোনো ব্যক্তি নাবীযে তামারের ব্যাপারে আহলে কূফার মাযহাবের উপর, সেমা’ অর্থাৎ গান-বাদ্যের ব্যাপারে আহলে মদীনার মাযহাবের উপর, আর নিকাহে মুতআ’র ব্যাপারে আহলে মক্কার অভিমতের উপর আমল করে, তাহলে সে ফাসেক হয়ে যাবে। মা’মর রহিমাহুল্লাহ থেকেও এই ধরনের বর্ণনা এসেছে। (ইরশাদূল ফুহূল: পৃষ্ঠা নম্বর: ২৭২)।

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ইফতাবোর্ড এর ফতওয়ার কিতাব ফাতাওয়া আল লাজনা আদ দাইমাহ ও আল মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ-তে (২২/১৬৪) শরয়ী মাসায়েলে রুখসত খুঁজে বেড়ানো বা সুযোগসন্ধানকে নাজায়েয, শরীয়তবিমুখতা, ও প্রবৃত্তির অনুসরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে শরীয়ত মানুষের খেল তামাশার পাত্র হয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। ফাতাওয়া আল লাজনাহ আদ দাইমাহ এর এই ইবারতটিও ভালো করে লক্ষ্য করুন :

  • أما إن كان المراد بالأخذ بالرخص في الدين هو الأخذ بالأسهل وما يوافق هوى الإنسان من فتاوى وأقوال العلماء – فإن ذلك غير جائز، والواجب على الإنسان أن يحتاط لدينه، وأن يحرص على إبراء ذمته، فلا يتبع إلا ما صح به الدليل من كتاب الله وسنة نبيه صلى الله عليه وسلم، وإن كان جاهلا بالحكم فإنه يسأل أهل الذكر ممن يوثق بعلمه وفتواه، ولا يكثر من سؤال العلماء في المسألة الواحدة فيتبع الأسهل له وما يوافق هواه، فإن ذلك دليل على تفريطه وإهماله لأمور دينه، وقد أثر عن بعض السلف قوله: (من تتبع رخص العلماء فقد تزندق).

রুখসত থেকে উদ্দেশ্য যদি তুলনামূলক বেশি সহজটি ও বিভিন্ন অভিমত থেকে নিজের মনমতো অভিমতটি গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তাহলে তা নাজায়েয। মানুষের জন্য জরুরী হলো, দ্বীনের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা। কর্তব্য আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। অতএব, কুরআন-সুন্নাহর সহীহ দলীল দ্বারা প্রমাণিত অভিমতটিই অনুসরণ করবে। আর যদি হুকুম না জানা থাকে তাহলে যার ইলম এবং ফায়ারওয়াল উপর আস্থা রাখা যায় এমন গ্রহণযোগ্য কোনো আহলে ইলমকে জিজ্ঞাসা করবে। সহজ ও সুযোগ সন্ধানের উদ্দেশ্যে একই মাসআলা বিভিন্ন জনের কাছে জিজ্ঞেস করবে না। এটা তার দ্বীনের ব্যাপারে অবহেলা ও উদাসিনতার প্রমাণ হবে। সালাফের মধ্যে অনেকে বলেছেন, যে ওলামায়ে কেরামের রুখসতগুলো খুঁজে বেড়াবে, সে বদ্বদ্বীন হয়ে যাবে। বড় আফসোসের বিষয় আমাদের কিছু দাঈ ভাইয়েরা বর্তমানে জনপ্রিয়তা অর্জন করার ভয়ঙ্কর এক দাওয়াতিপন্থা বেছে নিয়েছেন। তা হলো, ইসলামকে সহজীকরণ। আর এ উদ্দেশ্যে তারা কখনো তালফীক, কখনো রুখসত সন্ধানের পথ বেছে নেন। এ ধরনের তালফীকপন্থী ও সুযোগসন্ধানী শায়েখদেরকে দেখবেন, তারা নিরপেক্ষতার ভূমিকা গ্রহণ করে বিভিন্ন সময়ে বলে যে, “এটা কি অমুক মাযহাবে নাই?” হানাফী মাযহাবের ইমামগণও তো কখনো কখনো অন্য মাযহাব মোতাবেক ফতওয়া দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ঐ ধরনের আমল করলে কী অসুবিধা?

আমি এদের কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হই। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তারা আমজনতাকে গোমরাহী ও বদদ্বীনির দিকে ঠেলে দিতে চান। শরীয়তকে খেল-তামাশা বানাতে চান। নিজ মাযহাব থেকে অন্য মাযহাবের দিকে গমন করা কোনো অপরিহার্য জরুরতের ক্ষেত্রেই হতে পারে। আর এটা কেবলমাত্র যুগশ্রেষ্ঠ, বিজ্ঞ মুফতীয়ানে কেরামের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ক্ষেত্র বিশেষে হয়। আমজনতা নিজে নিজেই এ ধরনের যেকোনো সময় যেকোনো মাযহাবের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ ধরনের অনুমতি আমজনতার জন্য কখনোই হতে পারে না।

যেখানে এসব শায়খদেরও কোনো না কোনো ইমামের ব্যাখ্যার আলো অনুসরণ করা ছাড়া চলার কোনো পথ নেই। সেখানে তারা কি আমজনতাকে মুজতাহিদ মনে করেন? কোরআন-হাদীসের সামান্য ও সাধারণ জ্ঞান এবং কোরআন-হাদীসের শুধুমাত্র অনুবাদ জানা এ ব্যাপারে যথেষ্ট নয়। কখনো হতে পারে না। সেখানে আমজনতা, যারা কুরআন-সুন্নাহর অনুবাদ জানা তো দূরের কথা অনেকে তো অনুবাদ পড়তেও জানেন না। তাদেরকে আমাদের নিরপেক্ষ এ সমস্ত শায়খ ও দাঈগণ কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও ইচ্ছাস্বাধীনভাবে যেকোনো সময় যেকোনো মাযহাবের অনুসরণ করার অনুমতি দিচ্ছেন। এর প্রতি উৎসাহিত করছেন। আপনি কি ভেবে দেখেছেন, অবস্থা কতটা ভয়ংকর ? কতটা মারাত্মক? এভাবে সাধারণ মানুষ আস্তে আস্তে সুযোগ সন্ধান করতে করতে, মাযহাব থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে, দ্বীন থেকেই এক সময় বের হয়ে যাবে।

মাওলানা মোহাম্মদ হোসাইন বাটালবী, যিনি লা-মাযহাবীদেরকে ওয়াহাবী নাম হতে আহলে হাদীস নামের রেজিস্ট্রেশন এনে দিয়েছিলেন, ইংরেজ সরকার থেকে। তিনি তার ইশাআতুস সুন্নাহ পত্রিকায় উল্লেখ করেছেন, “আমার পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারলাম, পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলম ছাড়া যারা মাযহাব ত্যাগ করে, তারা আস্তে আস্তে দ্বীন থেকে সটকে পড়ে। কেউ খ্রিস্টান হয়, কেউ লামাযহাবী। শরীয়তের আহকাম থেকে বের হয়ে ফাসেক আর ফাজের হয়ে যাওয়া তো এই স্বাধীনচিন্তার অতি স্বাভাবিক ফলাফল।” (ইশাআতুস সুন্নাহ, খ:১১, সংখ্যা: ২, পৃষ্ঠা নম্বর: ৫৩)

শরীয়তের দৃষ্টিতে আসল হচ্ছে সরাসরি কুরআন সুন্নাহর উপর আমল করা। ‌ কিন্তু এটা কার জন্য? জায়েদ, ওমর, বকরের জন্য? যেকোনো কলিমুদ্দিন সলিমুদ্দিনের জন্য? এটা কি খেলনা? এটা কি ছেলের হাতের মোয়া? তা কখনো না। তাহলে কেনো এবং কোন স্বার্থে আমজনতার সামনে যেকোনো সময় যেকোনো মাযহাবের অনুসরণের দ্বার উন্মোচন করে দেয়া হচ্ছে? বিভিন্ন মাযহাবের রুখসত আর সুযোগগুলো তাদের সামনে বয়ান করে করে কেনো তাদের মধ্যে সুযোগসন্ধানী মানসিকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হচ্ছে?

আমাদের দেশের একজন জনপ্রিয় দাঈ আছেন। যিনি সদাসর্বদা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টায় মত্ত। কখনো ইংরেজি, কখনো সুযোগসন্ধানী বক্তব্য রেখে একে একে আলোচনার শিরোনাম হতে তিনি প্রতিনিয়তই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তালফীকপন্থী। রুখসত অন্বেষণ তথা সুযোগসন্ধানী মানসিকতায় বিশ্বাসী তিনি। আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন, তিনি কিছুদিন আগে একজন ইমামের একটি অভিমত সামনে এনে ফতওয়া দিয়েছিলেন, মেয়েরা চেহারা খুলে বাইরে বের হতে পারবে। চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়। পরবর্তীতে আবার অন্য একজন ইমামের বক্তব্য অনুযায়ী ফতওয়া দিলেন, নামাযে কোরআন শরীফ দেখে পড়া যাবে। এটাকেই বলে তালফীক ও সুযোগসন্ধান । আবার ইদানিং নতুন একটি ফতওয়া দিয়েছেন, কষ্টকর কাজ যারা করেন, তারা রোযা না রাখলেও চলবে। আবার বলছেন, তারাবীহের নামায চার রাকাত পড়লেও চলবে। আবার কেহ কেহ বলছেন, অজু ছাড়াও কুরআন মাজিদ স্পর্শ করা যাবে। এটাকে বলে রুখসত অন্বেষণ , সুযোগসন্ধান। অনেকে বলেন, উক্ত মাওলানার এটা ভুল হয়েছে। তাঁর ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতা নাই, ইত্যাদি….।

কিন্তু আমি তা মনে করি না। ইফতা না পড়লেও আমাদের দারুল ইফতাগুলো থেকে সাধারণ যেসব মুফতী বের হন, কিতাব পত্র দেখে-শুনে তাকওয়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে ফতোয়া দিলে তিনি তাঁদের চেয়ে খারাপ করবেন না। আমি মনে করি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এরকম করে যাচ্ছেন এবং আগামীতেও করবেন। কারণ তিনি তালফীকপন্থী, সুযোগসন্ধানী মানসিকতায় বিশ্বাসী। যা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। শরীয়তের বুনিয়াদ বিধ্বংসী চিন্তা। কিন্তু তিনি সেই নিষিদ্ধ পন্থাই অনুসরণ করে যাচ্ছেন। বরং সেদিকে মানুষকে বয়ানের মাধ্যমে উৎসাহিত করছেন। দাওয়াত দিচ্ছেন। তাঁর জনপ্রিয়তা অর্জনের মেইন হাতিয়ারই হচ্ছে, تلفيق ও تتبع الرخص । কারণ, তাঁর যে প্রয়োজন জনপ্রিয়তা…দ্বীন কোথায় যায় যাক, দ্বীনের বুনিয়াদ ধ্বংস হয় হোক, তাতে তেমন কিবা যায় আসে? দ্বীনের অবস্থা যাই হোক, নিজের অবস্থান তো তৈরি হবে… বস্তুবাদী ও ভোগবাদী সমাজের যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী ও আমজনতা অধিকাংশই যে এখন শুধু সহজ চায় তাদেরকে আকৃষ্ট করতে দ্বীনের সহজীকরণ প্রয়োজন। তাই দরকার তালফীক ও রুখসত। অথচ আমরা দেখি, আমাদের সালাফগণ এ ব্যাপারে অনেক অনেক সর্তকতা অবলম্বন করেছেন। যেনো সাধারণ মানুষ দ্বীন-ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে না পড়ে। সামান্য ব্যাপারে রুখসত অন্বেষণ না করে। সুযোগসন্ধানী না হয়ে যায়। এখানে আমি সহীহুল বুখারীতে তায়াম্মূম অধ্যায়ে উল্লেখিত একটি হাদীস পেশ করছি –

  • عَنْ شَقِيقٍ، قَالَ كُنْتُ جَالِسًا مَعَ عَبْدِ اللَّهِ وَأَبِي مُوسَى الأَشْعَرِيِّ فَقَالَ لَهُ أَبُو مُوسَى لَوْ أَنَّ رَجُلاً أَجْنَبَ، فَلَمْ يَجِدِ الْمَاءَ شَهْرًا، أَمَا كَانَ يَتَيَمَّمُ وَيُصَلِّي فَكَيْفَ تَصْنَعُونَ بِهَذِهِ الآيَةِ فِي سُورَةِ الْمَائِدَةِ ‏{‏فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا‏}‏ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ لَوْ رُخِّصَ لَهُمْ فِي هَذَا لأَوْشَكُوا إِذَا بَرَدَ عَلَيْهِمُ الْمَاءُ أَنْ يَتَيَمَّمُوا الصَّعِيدَ‏.‏ قُلْتُ وَإِنَّمَا كَرِهْتُمْ هَذَا لِذَا قَالَ نَعَمْ‏.‏

শাক্বীক রাহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি ‘আবদুল্লাহ্‌ ইব্‌নে মাস’ঊদ ও আবূ মূসা আশ’আরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা-এর সঙ্গে বসা ছিলাম। আবু মূসা আশ’আরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ‘আবদুল্লাহ্‌ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-কে বললেন, কোনো ব্যক্তি জুনুবী (গোসল ফরজ হওয়া ব্যক্তি) হলে সে যদি এক মাস পর্যন্ত পানি না পায়, তা হলে কি সে তায়াম্মুম করে নামায আদায় করবে না? শাক্বীক (রহঃ) বলেন, ‘আবদুল্লাহ্‌ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, এক মাস পানি না পেলেও সে তায়াম্মুম করবে না। তখন তাঁকে আবূ মূসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, তাহলে সূরা মায়িদাহ্‌র এ আয়াত সম্পর্কে কী করবেন যে, “পানি না পেলে পাক মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে” (সূরা আল-মায়িদা ৫/৬)। আবদুল্লাহ্‌ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু জওয়াব দিলেন, মানুষকে সেই অনুমতি দিলে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে যে, সামান্য ঠান্ডা লাগলেই লোকেরা মাটি দিয়ে তায়াম্মুম শুরু করবে। আমি বললাম আপনারা এ জন্যেই কি তা অপছন্দ করেন? তিনি জবাব দিলেন, হাঁ।

জুনুবীর ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনে তায়াম্মুমের অনুমতি থাকলেও, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এ ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করতেন। কেন? যাতে করে মানুষের মাঝে সুযোগ সন্ধানের মানসিকতা সৃষ্টি না হয়। সামান্য ঠাণ্ডার ভয়েই যেন তায়াম্মুম শুরু করে না দেয়। সহীহুল বুখারী, হাদীস নম্বর: ৩৪৭। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু কিছু বক্তা আমজনতার অজ্ঞতা আর মূর্খতাকে পুঁজি করে তাদের চাহিদা মোতাবেক শুধু সহজ ও রুখসতের মাসায়েলগুলো উল্লেখ করেন। মাঝেমধ্যে হিন্দি ও বাংলা সিনেমার গান গেয়েও শোনান। যাতে সহজেই শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হওয়া যায়। বাস্তবিকপক্ষে এ সকল বক্তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য তো নয়ই, বরং তারা প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কারণ তারা শরীয়তকে তামাশায় রূপান্তরিত করছে। আহ্ ! যে জনপ্রিয়তা অর্জনে আমরা গর্ব করি, আমাদের আসলাফ ও পূর্বসূরীগণ সেটা ঘৃণা করতেন।

ওয়াজ-নসীহত ও দ্বীনের কথা সবার থেকে হাসিল করা যায় না। এখনতো স্টেজে দু-চারটি কথাবার্তা সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারলেই তাকে অনেক বড় ‘আল্লামা’ মনে করা হয়। আমাদের দেশের সাধারণ পাবলিকের ভক্তি-শ্রদ্ধার কোনো মাপকাঠি বলতেই নেই। রাস্তার হকাররা এমবিবিএস ডাক্তারের চেয়ে লেকচার ভালো দেয়। তার লেকচার যতই শ্রুতিমধুর হোক, তার কথায় ওষুধ খাওয়া যাবে না। তদ্রুপ সব বক্তার উপর আস্থা রাখা যাবে না। তাদের সবার বক্তব্যের উপর আমল করা যাবে না। বিনোদনমূলক ওয়াজ থেকে বিনোদন নেওয়া যাবে, আমল করা যাবে না। একমাত্র হকপন্থী, উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য উলামায়ে কেরামের ফাতাওয়ার উপরই আমল করতে হবে। যেনতেন বক্তার বক্তৃতা, যেকোনো লেকচারারের লেকচার শুনেই দৌড় দেওয়া যাবে না। মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে, মুহাম্মদ ইবনে ছীরীন রহিমাহুল্লাহ বলেন :

  • إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ.

“নিশ্চয় ইহা দ্বীনের অংশ। সুতরাং তোমরা কার কাছ থেকে দ্বীন গ্রহণ করছো, তা ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখো।” (মুকাদ্দিমায়ে মুসলিম: পৃষ্ঠা ১১)। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় গোমরাহী হলো, চিন্তা-চেতনার গোমরাহী। মানুষের মতাদর্শ যখন বদলে যায়, ইসলামের সঠিক রূপরেখা থেকে ফিরে যেতে থাকে, তখন আস্তে আস্তে সে ‘ফিকরি ইরতিদাদে’র শিকার হয়ে যায়। উপর থেকে দেখে আপনি মনে করবেন, সে আসলে একজন পাক্কা মুসলিম। কিন্তু বাস্তবে ভেতর থেকে চিন্তা-চেতনা, মাসলাক-মাশরাবের দিক থেকে, সে সম্পূর্ণই ভ্রান্ত পথের অনুসারী হয়ে যায়। মানুষ যখন তালফীক ও সুযোগসন্ধানের পথে চলতে থাকে, তখন তারাও এই ধরনের পরিনণতির পথে চলতে শুরু করে…. আমাদের কিছু ভাইয়েরা বুঝে না বুঝে আমজনতাকে সে পথের দিকেই নিয়ে যাচ্ছেন।

হঠাৎ জনপ্রিয়তা সংক্রান্ত একটি গল্প মনে পড়লো। ছোটবেলায় আমি আমার কোনো একজন শিক্ষকের কাছে গল্পটি শুনেছিলাম। একজন লোক কয়েকবার হজ্ব করলো। কিন্তু তাকে কেউ হাজী বলে না। তখন সে একজনের কাছে পরামর্শ চাইলো, আমি এতবার হজ করলাম, আমাকে কেউ তো হাজী বলে না, এখন কী করি বলুন তো? লোকটি সব শুনে বললো, ব্যতিক্রমধর্মী কিছু না করলে, স্রোতের বিপরীত না চললে, রাতারাতি শোহরত পাওয়া যায় না। জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায় না। তুমি এবার হজে গিয়ে এমন একটা কাজ করবা, যা ইতিপূর্বে কেহই করে নি, তাহলে দেখবা সবাই তোমাকে হাজী বলে ডাকবে। সে জিজ্ঞাসা করলো, কী করতে হবে? লোকটি বললো, এবার হজে গিয়ে জমজম কূপে পেশাব করতে শুরু করবা, দেখবে সবাই তোমাকে হাজী বলবে। লোকটি এবার হজে গিয়ে সত্যি সত্যি জমজম কূপের মধ্যে পেশাব করার পরিকল্পনা করলো। জমজম কূপের পারে গিয়ে যেই মাত্র পেশাব শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছে, ওমনি লোকজন বাঁধা দিয়ে বলা শুরু করলো, এই দেখো দেখো মুতুরে হাজী কী করে ! হায়রে মুতুরে হাজীর কারবার ইত্যাদী। তখন থেকে সবাই লোকটিকে হাজী বলা শুরু করলো, তবে সাথে একটি বিশেষণ যুক্ত করে। সেটা হলো, “মুতুরে হাজী”। জনপ্রিয় হওয়ার জন্য ইসলামকে সহজীকরণ করে ব্যবসা করার কোনো দরকার নেই। ইসলাম ধর্মের সমস্ত হুকুম-আহকাম এমনিতেই সহজ। সুন্দর। আকর্ষণীয়। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই যুগে যুগে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলাম ধর্মে অনুপ্রাণিত হয়েছে। ইসলাম তলোয়ারের জোরে নয়, আদর্শ ও সৌন্দর্যের কারণে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

  • وَ مَا جَعَلَ عَلَیۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ مِنۡ حَرَجٍ

আল্লাহ তাআলা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি। (সূরা হজ্ব, আয়াত নম্বর:৭৮)। অর্থাৎ ইসলামের মধ্যে এমন কোনো নির্দেশ নেই, যেখানে সঙ্কীর্ণতা রয়েছে।

  • يريد الله بكم اليسر

এই আয়াতটির এবং الدين يسر হাদীসটির আজকাল অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য সহজ আহকাম চান। কোনো হুকুম-আহকামের মধ্যে সংকীর্ণতা রাখেননি, কথাটির অর্থ হচ্ছে, ইসলামে যে বিধানগুলো দেওয়া হয়েছে, তা আসলেই অনেক সহজ। এতে কোনো ধরনের সংকীর্ণতা নেই, কঠোরতা নেই। যেমন পূর্ববর্তী উম্মতের উপরে ছিলো। পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য গুনাহের তওবা ছিলো, হত্যা করে ফেলা। রাতে গুনাহ করলে সকালে দরজায় লেখা উঠতো। জাকাতের কোনো নিসাব ছিল না। সবারই দিতে হতো‌। দেওয়াও লাগতো চার ভাগের এক ভাগ। আবার তা কারো উপকারে আসতো না। মাঠে রেখে আসতে হতো। আগুন এসে জ্বালিয়ে দিতো। কোরবানীর বিষয়ও ঠিক এমনই ছিল। কেউ গোশত খেতে পারত না। আগুন এসে কবুল হওয়া কোরবানীটি জ্বালিয়ে দিতো। কাপড়ে এমনকি কোনো কোনো বর্ণনা মোতাবেক শরীরেও নাপাক লাগলে, পবিত্রতার জন্য কাপড় বা শরীরের ওই স্থান কেটে ফেলতে হতো। এরকম আরো অনেক অনেক কঠোর বিধান ছিল‌। চিন্তা করে দেখুন ! ইসলামের বিধানগুলো সে তুলনায় কত সহজ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

  • بُعِثْتُ بِالْحَنِيفِيَّةِ السَّمْحَةِ

অর্থাৎ আমাকে সব বাতিল আদয়ান ও ভ্রান্তমতবাদ থেকে ভিন্নতর, সহজ সরল দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। মুসনাদে আহমাদ,৩৬/৬২৪, হাদীস নম্বর: ২২২৯১, আল মুজামুল কাবীর,৮/২২২ হাদীস নম্বর: ৭৮৮৩। আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত ইসলামী বিধি-বিধান এমনিতেই সহজ। সব মাযহাব থেকে রুখসত, সুযোগ ও ছাড় দেওয়া বিধানগুলো একত্রিত করে, নতুন করে সহজীকরণের কোনো প্রয়োজন নেই। যারা ইসলামকে শর্টকাট ও সহজীকরণের মতাদর্শে বিশ্বাসী তারা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছেন! আপনি যদি শরীরের উপরের অংশের সবচেয়ে শর্টকাট পোশাকটি, আর নিচের অংশের সবচেয়ে শর্টকাট পোশাকটি পরিধান করেন, তাহলে এই পোশাক পরিধান করে জনসম্মুখে যাওয়ার, স্টেজে বসে লেকচার দেওয়ার মত পরিস্থিতি থাকবে কি? (সতর শুধুমাত্র নিজের সামনের ও পিছনের লজ্জাস্থান দুটি, এমন অভিমতও তো একজন অনেক বড় ইমামের রয়েছে।) তাহলে স্টেজে বসে ইসলামকে এতো শর্টকাট করার চিন্তাভাবনা কেন? রুখসত ও সুযোগসন্ধানী মানসিকতায় বিশ্বাসীরা সালাফের একটি কথা স্মরণ করে ভয় করা উচিৎ।

  • من تتبع الرخص فقد تزندق

যে ব্যক্তি রুখসত ( সুযোগ ) খুঁজে বেড়াবে, সে ঈমানহারা হয়ে যাবে। এটা সম্ভবত ইমাম আউযায়ী রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য। ইরশাদুল ফুহুল কিতাবে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। কাজী ইসমাঈল রাহিমাহুল্লাহ একদিন খলীফা মু’তাজিদ বিল্লাহ আব্বাসীর দরবারে প্রবেশ করলেন। তখন খালীফা তার সামনে একটি কিতাব তুলে ধরে বললেন, এটা ভালো করে দেখুন তো! কাজী সাহেব ভালো করে দেখলেন, সেখানে বিভিন্ন ওলামায়ে কেরামের রুখসতগুলো (সুযোগ এর ফতোয়াগুলো) একত্রিত করা হয়েছে। কাজী সাহেব খলীফার উদ্দেশ্যে বললেন, এ কিতাবের লেখক বদদ্বীন। খলীফা জিজ্ঞাসা করলেন, একিতাবের হাদীসগুলো কি সহীহ নয়? এখানে উল্লেখিত মাসআলাগুলো কি সহীহ হাদীস শরীফে উল্লেখ নেই? তিনি বললেন, অবশ্যই সহীহ। তবে যিনি একটিকে জায়েয বলেছেন, তিনি অন্যটিকে জায়েয বলেননি। যিনি একটির অনুমতি দিয়েছেন, তিনি অন্যটির অনুমতি দেননি। কিন্তু লেখক সব মাযহাব থেকে শুধু সুযোগ ও রুখসতের ফতোয়াগুলোই এখানে একত্র করেছেন। তখন খলীফা ওই কিতাবটি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ,২২/১৬৪)। এসব শর্টকাট ও সহজীকরণের কথা শুনলে, আমার ছোটবেলায় পড়া একটি বাবুরাম সাপুড়ে কবিতার কথা মনে পড়ে।

                    বাবুরাম সাপুড়ে,               কোথা যাস্ বাপুরে ?                আয় বাবা দেখে যা,               দুটো সাপ রেখে যা—              যে সাপের চোখ্ নেই,               শিং নেই, নোখ্ নেই,  ছোটে না কি হাঁটে না, ‌‌কাউকে যে কাটে না, ‌করে নাকো ফোঁস্ ফাঁস্, মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ, নেই কোনো উৎপাত, খায় শুধু দুধ ভাত, সেই সাপ জ্যান্ত গোটা দুই আন্ত ! তেড়ে মেরে ডাণ্ডা ক'রে দিই ঠাণ্ডা।!

আমাদের কিছু ভাইয়েরা এরূপ ইসলামই চান, যেটা হবে এ কবিতার সাপের মতো, নখ-দন্ত বিহীন। আর সে জন্যই তারা বেছে নিয়েছেন মারাত্মক ভয়ংকর দাওয়াতীপন্থা ” তালফীক ও সুযোগসন্ধান” । আল্লাহ তাআ’লা আমাদের ঐসকল ভাইদেরকে হিদায়াত করুন। সঠিক পথে ব্যবহৃত হলে, তাঁরা আমাদের সম্পদ । আল্লাহ তাআলা তাদের সঠিক পথে, ইখলাসের সাথে দাওয়াত দেওয়ার তাওফীক দিন। আর আমাদের সবাইকে শরীয়াহ’র বুনিয়াদ বিধ্বংসী তালফীক ও সুযোগসন্ধানী মানসিকতা থেকে হিফাজত করুন।

  • মুফতী মুহাম্মদ শফী কাসেমী সাহেবের টাইমলাইন থেকে
  • স্বনামধন্য হাদীস বিশারদ [মুহাদ্দিস], বগুড়া জামিল মাদরাসা

মির্যার স্ববিরোধীতা-১

1

প্রথমত, নবুওয়ত ও রেসালত দাবী অস্বীকার:

এখন এমন ব্যক্তিও কী করে আপনা দাবীতে সত্য হন?

১. মির্যা কাদিয়ানীর বই থেকে (তিনি লিখেছেন) ‘আমাদের নবী সৈয়্যদেনা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-কে খোদার পক্ষ থেকে খাতামান নাবীঈন নিযুক্ত করার পর নবুওয়তের দাবী করা থেকে আমি খোদার আশ্রয় চাই’। (হামামাতুল বুশরা [বাংলা], পৃষ্ঠা নং ১৪৮; অনুবাদক ফিরোজ আলম, কেন্দ্রীয় বাংলা ডেস্ক, ইউ. কে; প্রকাশকাল নভেম্বর ২০১১ ইং, প্রকাশনায় আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত বাংলাদেশ; মূল লিখক মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী [আরবী])।

২. আরো লিখেছেন : ‘আমাদের রসূল (সা.)-এর পর কীভাবে কোন নবী আসতে পারে? তাঁর মৃত্যুর পর ওহী বন্ধ হয়ে গেছে আর আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে নবীদের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন।’ (হামামাতুল বুশরা [বাংলা], পৃষ্ঠা নং ৪৮)।

৩. মির্যা সাহেব তার বইটির আরেক স্থানে আরও লিখেছেন : “আর আমার দ্বারা নবুওয়তের দাবী করে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাওয়া এবং কাফের জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া মোটেও সম্ভবপর নয়।” (দেখুন ‘হামামাতুল বুশরা‘ (বাংলা) অনূদিত পৃষ্ঠা নং ১৪২; স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য)। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তিনি পরবর্তীতে নবুওয়তের দাবী করে নিজেই নিজের ফতুয়ায় কাফের জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন!

৪. মির্যা কাদিয়ানী সাহেব আরো লিখেছেন :
ان سب باتوں کو مانتا ہوں جو قرآن اور حديث کی رو سے مسلم الثبوت ہیں. اور سیدنا مولانا حصرت محمد مصطفیٰ صلى الله عليه وسلم ختم المرسلين کے بعد کسی دوسرے مدعی نبوت اور رسالت کو کازب اور کافر جانتا ہوں. میرا یقین ہے کہ وحی رسالت حضرت آدم صفی اللہ سے شروع ہوئی اور جناب رسول اللہ محمد مصطفیٰ صلی اللہ علیہ و سلم پر ختم ہو گئی

  • (উচ্চারণ) “যূ কুরআন আওর হাদীস কি রো ছে মুসাল্লামুছ ছবূত হেঁ আওর সাইয়েদানা ওয়া মওলানা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খতমুল মুরসালীন কে বা’দ কেসি দোসরে মুদ্দায়ীয়ে নবুওয়ত আওর রেসালত কো কাজিব আওর কাফের জানতা হোঁ। মেয়েরা একীন হে, কে ওহীয়ে রেসালত হযরত আদম ছফিউল্লাহ চে শুরু হুয়ি আওর জনাবে রাসূলুল্লাহ মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফর খতম হো গি।”

অর্থঃ কুরআন হাদীস দ্বারা যেসব বিষয় দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত আমি সেসব বিষয় মান্য করি। সায়্যেদিনা মাওলানা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতমুল মুরসালিন)’র পরে কেউ নবুওয়ত আর রিসালতের দাবি করলে সে মিথ্যাবাদীকাফের। আমার ইয়াক্বিন (বিশ্বাস), ওহী এবং রেসালত ছফি উল্লাহ হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু হয়ে জনাব রাসূলুল্লাহ মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র উপর সমাপ্ত হয়ে গেছে। (মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ১/২৩১; উর্দূ এডিশন ও অনলাইন ভার্সন)।

সূত্র: মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ১/২৩১ (উর্দূ)

দ্বিতীয়ত, নবুওয়ত ও রেসালত দাবী :

১. মির্যা কাদিয়ানীর বইতে লিখা আছে : ‘মোটকথা আমি মুহাম্মদ ও আহমদ (সঃ) হওয়ার কারণে আমার নবুওয়ত ও রেসালত লাভ হয়েছে, স্বকীয়তায় নয়, ‘ফানাফির রসূল’ হয়ে অর্থাৎ রসূলের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে পেয়েছি। সুতরাং এতে ‘খাতামান্নাবীঈনের’ অর্থে কোন ব্যতিক্রম ঘটলো না। পক্ষান্তরে ঈসা আলায়হেস্সালাম আবার (এ পৃথিবীতে) আসলে [খাতামান্নাবীঈনের অর্থে] নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ঘটবে।’ (দেখুন ‘এক গলতি কা ইযালা’ বা একটি ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নং ৫; [বাংলায় অনূদিত], দ্বিতীয় বাংলা সংস্করণ ২০০১ ইং; অনুবাদক মৌলভী মোহাম্মদ; মূল লিখক, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী; রচনাকাল ১৯০১ইং, প্রকাশনায় আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত বাংলাদেশ)।

২. আরো লিখেছেন : “সুতরাং আমি যখন আজ পর্যন্ত খোদার নিকট হতে প্রায় দেড়শত ভবিষ্যতবাণী লাভ করে স্বচক্ষে পূর্ণ হতে দেখেছি। তখন আমার নবী ও রসূল হওয়া আমি কীরূপে অস্বীকার করতে পরি? যখন স্বয়ং খোদাতাআলা আমাকে নবীরসূল আখ্যা দিয়েছেন, তখন আমি কীরূপে এটা প্রত্যাখ্যান করতে পারি এবং তাকে ছেড়ে অন্যকে ভয় করি?” (দেখুন ‘এক গলতি কা ইযালা’ বা একটি ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নং ৮; [বাংলায় অনূদিত], দ্বিতীয় বাংলা সংস্করণ ২০০১ ইং; অনুবাদক মৌলভী মোহাম্মদ; মূল লিখক, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী; রচনাকাল ১৯০১ইং, প্রকাশনায় আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত বাংলাদেশ)। সংক্ষেপে এই কয়েকটি প্রমাণ দেয়া হল।

নইলে আরো অসংখ্য প্রমাণ দেয়া যেত। যাদের সত্য গ্রহণকরার মত পিপাসা রয়েছে তাদের জন্য মির্যা কাদিয়ানীর নবী রাসূল দাবীর প্রমাণের জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। সুতরাং তার অনুসারীরা মির্যার এই কুফুরীগুলো ঢাকতে যতভাবেই ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেয় না কেন, কথা একটাই; নবুওয়তের দাবীদার মুসাইলামা কাজ্জাব, আসওয়াদে আনুসী, তুলায়হা ও শাজাহ এরা যেমন কাফের ও মুরতাদ হিসেবে গণ্য হয়েছিল তদ্রুপ মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীরাও কাফের হিসেবে গণ্য হবে। যে পর্যন্ত মির্যার মত এই নিকৃষ্ট কাফের ও মুরতাদকে ত্যাগ না করবে, মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-এর খতমে নবুওয়তের উপর পরিপূর্ণরূপে ঈমান না আনবে সে পর্যন্ত তারা নামায রোজা হজ্ব ও যাকাত সহ যাই করুক না কেন তার সবই মূল্যহীন ও অগ্রহণযোগ্য। সহজকথায়, অজু ব্যতীত নামায পড়লে নামাযের যে অবস্থা হবে ঠিক অনুরূপ অবস্থা হবে মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-এর খতমে নবুওয়তের উপর পরিপূর্ণ ঈমান না রাখলে।

শেষকথা : মির্যা কাদিয়ানী লিখেছেন: মিথ্যাবাদীর কথায় অবশ্যই স্ববিরোধীতা হয়ে থাকে। (রূহানী খাযায়েন: ২১/২৭৫)। অতএব এবার মির্যা কাদিয়ানী তারই স্ববিরোধী কথার কারণে কী সাব্যস্ত হলেন একটু ভেবে দেখবেন কি? এমন একজন মিথ্যাবাদীকে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান কিজন্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন তা এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। আল্লাহ আমাদের ঈমানকে রক্ষা করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

তারাবীহ’র সালাতের রাকাত সংখ্যা কত?

0

তারাবীহ’র সালাত কত রাকাত, প্রশ্নের উত্তর শুনে তিনি আর কোনো প্রতিউত্তর করলেন না….

গত রাত্রে হঠাৎ এক লোক ফোন দিলো। রিসিভ করার পর সে বলল, আপনি কি মুফতী শফী কাসেমী? আমি বললাম আপনার পরিচয়টা? সে পরিচয় দিতে রাজি হলো না। বারবার জিজ্ঞাসা করার পরে বলল, আমি লালমনিরহাট থেকে বলছি। কী করেন? জিজ্ঞাসা করলে বলল, তিনি নাকি কোথা থেকে কামিল পাস করেছেন।

আমি বললাম, ঠিক আছে ভাই! কোনো কথা থাকলে বলতে পারেন। সে কোনো ভুমিকা ছাড়াই সরাসরি বলে উঠলো, আপনারা যে ২০ রাকআত তারাবীহ পড়েন এটা ভুল। আমি বললাম কেন? সে বলল, বুখারী শরীফে আছে, মা আয়েশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। আমি বললাম, ভাই ! হাদীসটির মূল এবারত পড়ে, তারপরে অনুবাদ করুন। আপনার ভুলটা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। হাদীসের আরবী ইবারত বলতে পারবেনা বলে জানালো সে। কিন্তু তার দাবি, বাংলাতে তিনি যা বলেছেন হাদিসটা এমনই। বারবার বলতে লাগলো, বাংলায় বললে কি হবে না? আমি বললাম, ভাই আপনি এখানে হাদিসের কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে বলছেন। তাই আমি আপনাকে মূল আরবী ইবারত বলে, এরপর তরজমা করতে বলেছিলাম। এবার মূল হাদীসটি শুনুন, বলে আমি তাকে মূল ইবারত ও তার অনুবাদ শোনালাম, (আরবী)

روى البخاري (3569) ، ومسلم (738) عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا : كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ ؟ قَالَتْ : " مَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ وَلاَ فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً ، يُصَلِّي أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ ، فَلاَ تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا ، فَلاَ تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًا ، فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ تَنَامُ قَبْلَ أَنْ تُوتِرَ؟ قَالَ :(تَنَامُ عَيْنِي وَلاَ يَنَامُ قَلْبِي)

তারপর বললাম, এখানে আমার তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিন,

১) রাবীয়ে হাদীস হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সালামের যে নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য গিয়েছিলেন, সেটা যদি তারাবিহ হতো, তাহলে হযরত আয়েশা সিদ্দিকাকে জিজ্ঞাসা করতে যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? তারাবীহ তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল সাহাবীদের সামনে মসজিদেই পড়েছেন। যে কোনো পুরুষ সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর পেয়ে যেতেন। এতে তো বোঝা যায়, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে ওই নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্যই গিয়েছিলেন, যেটা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়িতে নীরবে নিভৃতে একাকী পড়তেন অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায সম্পর্কে।

২) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বলেছেন, এটা ঐ নামায যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান এবং রমজান ছাড়া বাকি এগারো মাস অর্থাৎ সারাবছরই পড়তেন। বলুনতো তারাবির নামাজ কি সারা বছর পড়ে? এতে কি স্পষ্ট হয়ে যায় না যে এ নামাযটি তারাবীহ নয়, বরং তাহাজ্জুদের নামায?

৩) আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের পর চৌদ্দ হিজরীতে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সকল সাহাবীদের সামনেই মসজিদে নববীতে সকলকে একত্রে এক জামাতে এক ইমামের পিছনে ২০ রাকাত তারাবীহর নামাযের উপরে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তখন তো হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাও জীবিত ছিলেন। কারণ তিনি ইন্তেকাল করেছেন আটান্ন হিজরীতে। এই দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা তাঁর হুজরা শরীফের পাশে ২০ রাকাত তারাবিহ হতে দেখলেন। এই হাদীসটি যদি ৮ রাকাত তারাবির দলিলই হতো, তাহলে মা আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা কেন এই সুদীর্ঘ ৪৪ বছর সময়কালের মধ্যে একবারও মনে করলেন না যে, এ হাদিস দিয়ে ৮ রাকাত তারাবি প্রমাণ হতে পারে? তিনি তো কোনদিনই বলেননি, ওগো নবীর সাহাবীরা! আপনারা আমার হুজুর শরীফের পাশে রসুলের জায়নামাজে কেন ২০ রাকাত তারাবিহ আদায় করছেন? অথচ আমার কাছে একটি হাদিস আছে যা দ্বারা ৮ রাকাত তারাবীহ প্রমাণ হয়। বরং হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাও সকল সাহাবীদের সঙ্গে ২০ রাকাত তারাবিই মেনে নিয়েছেন। তারাবির নামায ৮ রাকাত হয়, এটা তিনি কখনো মনে করেননি। তিনি এও মনে করেন নি যে, তার বর্ণিত হাদীস শরীফটি দিয়ে ৮ রাকাত তারাবিহ প্রমাণ হতে পারে। দয়া করে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিন।

আমার প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর না দিয়েই সে বললো, আমি আপনার সাথে বাহাস করবো। আপনি কি হাদীস জানেন?

আমি বললাম, ভাই বাহাস‌ তো করবেন কিন্তু দয়া করে হাদীসের সংজ্ঞাটা একটু বলুন! হাদীস কাকে বলে? এটা বাংলায় বললেও হবে। তিনি হাদীসের সংজ্ঞা জানেন না বলে জানালেন। আমি বললাম, দাবী করলেন আপনি আহলে হাদীস, আপনি হাদীস নিয়ে বাহাস করবেন। অথচ হাদীস কাকে বলে তাই জানেন না? তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গালি দিতে দিতে ফোন রেখে দিলেন।এরপর আর কোনো দলিল নয়, বারবার এসএমএস পাঠিয়ে শুধু গালিই দিয়ে যাচ্ছেন।কী আর করবেন? দলীল যখন নেই, গালিই তো তখন পুঁজি…..।

  • মুফতি মুহাম্মদ শফী কাসেমী সাহেবের টাইমলাইন থেকে
              

এক নজরে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী

0

নবী রাসূল দাবী :

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী লিখেছেন : ‘মোটকথা আমি মুহাম্মদ ও আহমদ (সঃ) হওয়ার কারণে আমার নবুওয়ত ও রেসালত লাভ হয়েছে, স্বকীয়তায় নয়, ‘ফানাফির রসূল’ হয়ে অর্থাৎ রসূলের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে পেয়েছি। সুতরাং এতে ‘খাতামান্নাবীঈনের’ অর্থে কোন ব্যতিক্রম ঘটলো না। পক্ষান্তরে ঈসা আলায়হেসসালাম আবার (এ পৃথিবীতে) আসলে (খাতামান্নাবীঈনের অর্থে) নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ঘটবে।’ (দেখুন ‘এক গলতি কা ইযালা’ বা একটি ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নং ৫; [বাংলায় অনূদিত], দ্বিতীয় বাংলা সংস্করণ ২০০১ ইং; অনুবাদক মৌলভী মোহাম্মদ; মূল লিখক, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী; রচনাকাল ১৯০১ইং, প্রকাশনায় আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত বাংলাদেশ)।

সারমর্ম :

উপরের দীর্ঘ বক্তব্য হতে সুস্পষ্টভাবে বুঝা গেল, [১] মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে মুহাম্মদ ও আহমদ দাবীর পাশাপাশি নবুওয়ত এবং রেসালত লাভকারীও দাবী করত। [২] সে নবুওয়ত ও রেসালত লাভ করার জন্য নিজেকে নবী করীম (সা:) এর [পূর্ণ আনুগত্যের] মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিলীনকারী বলেও দাবী করত। [৩] আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) যে ভবিষ্যতবাণী দিয়ে হাদীসে বলে গেছেন, হযরত ঈসা (আ:) শেষযুগে পৃথিবীতে একজন ন্যায়পরায়ন প্রশাসকরূপে আগমন করবেন [বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া], মির্যা কাদিয়ানী তার উক্ত বক্তব্যে নবী করীম (সা:)-এর সেই ভবিষ্যতবাণীকেও ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে অস্বীকার করলো।

ইমাম মাহদী দাবী :

মির্যা কাদিয়ানীর অনুসারীরা তাকে ইমাম মাহদী বলেও দাবী করে। অথচ নবী করীম (সা:) সহীহ হাদীসগুলোতে হযরত ইমাম মাহদীর যে পরিচয় উম্মতকে জানিয়ে গেছেন তার কোনো একটি হাদীসও মির্যা কাদিয়ানীর সাথে মিলে না। এই দেখুন, বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদীসগ্রন্থের অন্যতম ‘সুনানু আবুদাউদ শরীফ’ কিতাবের ২য় খন্ডের ‘কিতাবুল মাহদী’ অধ্যায় ইমাম মাহদী সম্পর্কে পরিচয় কীভাবে রয়েছে :

ইমাম মাহদীর নাম হবে, মুহাম্মদ এবং পিতার নাম হবে আব্দুল্লাহ। তিনি হযরত ফাতেমা (রা:)-এর পুত্র সন্তান হযরত হাসান (রা:)-এর বংশধর (তথা কুরাইশী) হবেন।

  • উল্লেখ্য, হযরত হাসানের সাথে হযরত আব্বাসের পুত্র আল-ফজলের মেয়ে উম্মে কুলছুমের বিয়ে হয়। তাদের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ আল-আসগর, জাফর, হামজা এবং ফাতেমা (দেখুন তবক্বাতে ইবনে সা’আদ ৬/৩৫২)। সে হিসেবে ইমাম মাহদী মায়ের দিক থেকে হযরত আব্বাস (রা:)-এর বংশধর বললেও ভুল হবেনা।

ইমাম মাহদী মক্কায় বাইয়েত গ্রহণ করার পর যথাক্রমে গোরাসান এবং শামের উদ্দেশ্যে রণযাত্রা করবেন। অতপর তিনি এক বিশাল মুজাহিদ বাহিনী সাথে নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা বিরতি করবেন এবং হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর জন্য অপেক্ষা করবেন। ইমাম ইবনে হাজার আল হাইছামী ওয়াল মাক্কী (রহ:) রচিত ‘আল ক্বওলুল মুখতাসার’ পৃষ্ঠা নং ৩৬ দ্রষ্টব্য। স্ক্রিনশট দেখুন!

‘আল-ক্বওলুল মুখতাসার’ পৃষ্ঠা নং ৩৬; ইমাম হাইছামী রহ:

তিনি আরবে (মদীনায়) জন্মগ্রহণ করবেন এবং পরিণত বয়সে সমস্ত শিক্ষা-দীক্ষা আল্লাহর পক্ষ হতে ইলহাম (দৈব-বাণী)’র মাধ্যমে প্রাপ্ত হবেন। ইমাম মাহদী কোনো উস্তাদের ছাত্রত্বগ্রহণ করবেন না, একথা মির্যা কাদিয়ানী নিজেও লিখে গেছে। দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৪/৩৯৪।

তিনি শেষযুগে হযরত ঈসা (আ:) নাযিল হওয়ার নিকটবর্তী সময় মক্কায় (হজ্বের সময়) আত্মপ্রকাশ করবেন এবং হাজরে আসওয়াদ [রুকন] আর মাকামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তী জায়গায় তিনি মাহদীয়তের উপর প্রথম বাইয়াত নেবেন।

কিন্তু মির্যা কাদিয়ানীর সাথে এগুলোর একটিও মিলে না কিভাবে দেখুন :

তার নাম ছিল, মির্যা গোলাম আহমদ এবং পিতার নাম ছিল মির্যা গোলাম মর্তূজা, (তার মায়ের নাম, চেরাগ বিবি)। তার বংশ ছিল মোঘল [সম্রাট তৈমুরের বংশধর]। জন্মস্থান ছিল কাদিয়ান [গুরুদাসপুর জেলা, পাঞ্জাব, ভারত]।

সে সাধারণ মানুষের ন্যায় পড়াশোনা করেছিল। তার শিক্ষকবৃন্দের নাম, ফযল ইলাহী, ফযল আহমদ, মৌলভী গোলাম আলী। সে ১৮৯১ সালে নিজেকে রূপক ঈসা দাবী করেছিল এবং তার দুইবছর আগে লুধিয়ানায় (পাকিস্তান) মুজাদ্দিয়তের উপর প্রথম বাইয়াত নিয়েছিল। তারপর ১৮৯৪ সালে ইমাম মাহদীও দাবী করেছিল। বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন তারই পুত্রগণের রচিত ‘আহমদ চরিত’ [বাংলা অনূদিত] পৃষ্ঠা নং ১-৯; সীরাতে মাহদী, ক্রমিক নং ২০।

শুনে অবাক হবেন, তার অনুসারীরা সাধারণ মানুষকে তাদের দলে ভিড়ানোর সময় মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়ত আর রেসালত লাভকরার দাবীকে গোপন রাখে। সহজে স্বীকার করেনা। আর যখন স্বীকার করতে বাধ্য হয় তখন সেটিকে ‘উম্মতিনবী’ শব্দে ব্যাখ্যা দিয়ে কোনোমতে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। এরা কেয়ামতের দিন নবী করীম (সা:) এর সামনে কোন্ মুখ নিয়ে দাঁড়াবে? সেদিন নবী করীম (সা:) যদি তাদের প্রশ্ন করেন, আমি কি ইমাম মাহদীর পরিচয় আমার হাদীসগুলোর মধ্যে রেখে আসিনি? তারপরেও তোমরা কিজন্য প্রকৃত ইমাম মাহদীকে সনাক্ত করতে [চিনতে] ভুল করলে? যাও আজকে তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই! এমতাবস্থায় এই সকল হতভাগা কাদিয়ানীদের তখন নাজাতের কী উপায় হবে?

মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে নবী করীম (সা:) এর মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করার দাবীও সত্য নয় কেন?

  • আমরা তার জীবনচরিত্র থেকে যা যা পেয়েছি তা সংক্ষেপে এই যে,

[১] খেয়ানত ও আত্মসাৎ : আনুমানিক ১৮৬৪ সালের দিকে মির্যা কাদিয়ানী স্বীয় পিতা মির্যা গোলাম মর্তুজার পেনশনের সাতশত রূপি উত্তোলন করে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর। [সীরাতে মাহদী ১/৪৩ পুরাতন এডিশন, নতুন এডিশন ১/৩৮; ক্রমিক নং ৪৯ দ্রষ্টব্য, মির্যাপুত্র বশির আহমদ এম.এ]। চিন্তার বিষয়, এমন আত্মসাৎকারী ব্যক্তিও কিভাবে ইমাম মাহদী হওয়ার দাবী করতে পারে? আরো প্রশ্ন আসে, এমন একজন ব্যক্তি কিভাবে নবী করীম (সা:) এর মাঝে নিজেকে বিলীন করার দাবী করতে পারে?

[২] অশ্লিল গালি : মির্যা কাদিয়ানীর কথিত ওহী, ইলহাম এবং কাশ্ফ এর সমষ্টি একখানা বইয়ের নাম ‘তাযকিরাহ’। বইটির ৫১৯ নং পৃষ্ঠাতে যারা তাকে গ্রহণ করবেনা তারা মুসলমান নয় বলেই উল্লেখ রয়েছে।

সে তার বইয়ের আরেক জায়গায় এও লিখেছে : যারা তাকে গ্রহণ করেনা এবং সত্য বলে বিশ্বাস করেনা তারা যুররিয়্যাতুল বাগাইয়া তথা বেশ্যার সন্তান। নাউযুবিল্লাহ। দেখুন মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি বইয়ের সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত রূহানী খাযায়েন খন্ড নং ৫ পৃষ্ঠা নং ৫৪৭-৪৮। চিন্তার বিষয় হল, এমন অশ্লিল গালিবাজ কিভাবে ইমাম মাহদী দাবী করতে পারে?

[৩] প্রতারণা : মির্যা কাদিয়ানী শিয়ালকোট জেলা থেকে চাকুরী ছেড়ে চার বছর পর নিজ এলাকায় ফিরে যান। তখন নিজেকে শুধুমাত্র মুলহাম [দৈব-বাণীর অধিকারী] ও ইসলামের সেবক বলে দাবী করেন। তারপর ১৮৮০ সালে ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ নামক বই লিখার মনস্থ করেন। তিনি বইটি ৫০ খন্ডে লেখবেন বলে ওয়াদাও করেন। (বারাহীনে আহমদীয়া ৫/৮ [উর্দূ] দ্রষ্টব্য)। সেহিসেবে তিনি সবার নিকট চাঁদা দাবীও করেন। (বারাহীনে আহমদীয়া ৩/৩-৪ [বাংলা] দ্রষ্টব্য)। ফলে সেই সময় অসংখ্য মুসলমান তাকে প্রচুর রূপি চাঁদা প্রদান করেন। কিন্তু মির্যা সাহেব বই তো লিখলেন, তবে ৫০ খন্ডে নয়; মাত্র ৫ খন্ডে। তাই তিনি এর জবাবে লিখলেন, প্রথমে ৫০ খন্ডে লিখার ইচ্ছে [বা ওয়াদা] ছিল, কিন্তু ৫ খন্ডে সমাপ্ত করে দিয়েছি। কেননা ৫ ও ৫০ এর মধ্যে মাত্র একটি শূন্যের পার্থক্য! ফলে [পঞ্চাশ খন্ড লেখার] সেই ওয়াদা ৫ খন্ডে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে (রূহানী খাযায়েন ২১/৯ দ্রষ্টব্য)। আফসোস! একজন নবী দাবীদারের ওয়াদা পূর্ণ করার এ কি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত! কল্পনাতেও ভাবা যায় কি?

[৪] থিয়েটার দেখা : মির্যা কাদিয়ানীর খাস শিষ্য মুহাম্মদ ছাদেকের লেখিত বই ‘যিকরে হাবীব’ এর ১৪ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে, মির্যা কাদিয়ানীর এক শিষ্য মুন্সী জফর আহমদ একবার মির্যা কাদিয়ানীর নিকট মির্যার আরেক শিষ্য মুহাম্মদ ছাদেক সম্পর্কে তার থিয়েটার দেখা নিয়ে নালিশ করলে মির্যা কাদিয়ানী প্রতিউত্তরে বললো : “আমিও একবার থিয়েটার [সিনেমা, নাট্যশালা] দেখতে গিয়েছিলাম সেখানে কী হয় তা দেখতে”! চিন্তার বিষয়, একজন ইমাম মাহদী দাবীদার তিনি থিয়েটারও দেখতে যান! শুনে অবাক হবেন, তার অনুসারীরা এর জবাবে লিখেছে ‘মির্যা সাহেবের এই আচরণ তাকে আধুনিক প্রগতিশীল মানসিকতা সম্পন্ন একজন মানুষ সাব্যস্ত করে।’ 100 Reply to Allegations : 46 দ্রষ্টব্য।

[৫] ওয়াইন মদ : মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর শিষ্য হাকিম মুহাম্মদ হুসাইন কুরাইশী তার ‘খতূতে ইমাম ব-নামে গোলাম’ নামক একটি বইয়ের ৫ নং পৃষ্ঠায় মির্যা কাদিয়ানীর একখানা পত্র উল্লেখ করেন। সেখানে লিখা আছে, হে আমার ভ্রাতা হাকিম মুহাম্মদ হুসাইন সাহেব! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আমি এখন মিয়া ইয়ার মুহাম্মদকে পাঠাচ্ছি। আপনি নিজেই সবকিছু কিনে দেবেন এবং পলিমারের দোকান থেকে এক বোতল টনিক ওয়াইন [মদ]ও কিনে দেবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ওয়াইন (Wine) মদই হতে হবে। ওকে ফাইন।” উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ওয়াইন মদ একপ্রকার অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় যা সাধারণত গাঁজনকৃত আঙুরের রস থেকে তৈরি হয়। চিন্তার বিষয়, তবে কি একজন ইমাম মাহদী দাবীদার শরাবী আর মদ্যপায়ীও হতে পারে?

[৬] মাঝেমধ্যে জেনা করা : কাদিয়ানীদের তথাকথিত দ্বিতীয় খলিফা মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ এমন এক ধরণের ব্যক্তি ছিল যার অত্যধিক পরিমাণে জেনা করার অভ্যাস ছিল। তাই নও মুসলিম আব্দুর রহমান মিসরী তিনি জামাতে আহমদিয়ার উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের বরাবর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে একটি পত্র লিখেন। মির্যা বশিরের হাতে পত্রটি পৌঁছা মাত্রই সে কাদিয়ানে তাদের উপাসনালয়ে জুমার(!) বক্তৃতাকালে পত্রটি সবাইকে পড়ে শুনায় এবং মির্যা কাদিয়ানীর ঘনিষ্ট শিষ্য [হিন্দু থেকে কাদিয়ানী হওয়া] আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে সবাইকে ক্ষেপিয়ে তুলার চেষ্টা করে। কারণ পত্রটিতে লিখা ছিল:

  • “হযরত মসীহ মাওউদ [অর্থাৎ মির্যা কাদিয়ানী] আল্লাহর ওলী ছিলেন। আল্লাহর ওলীও কখনো কখনো জেনা করতেন। যদিও তিনি কখনো কখনো জেনা করতেন তাতে অসুবিধা কী! (তারপর লিখেন) মসীহ মাওউদের ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কেননা তিনি জেনা করতেন কখনো কখনো। আমার অভিযোগ বিদ্যমান খলিফার ব্যাপারে। যেহেতু তিনি প্রতিদিন জেনা করে থাকেন।” (কাদিয়ানীদের পত্রিকা দৈনিক আল-ফজল, প্রকাশকাল ৩১ শে আগস্ট ১৯৩৮ ইং)।

উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানী নিজের তথাকথিত মাহ্দিয়ত দাবীর সত্যতার দলিল হিসেবে ‘তিনশ তের’ শিরোনামে নিজ অনুসারীদের মধ্য হতে ৩১৩ জনের নাম লিপিবদ্ধ করেছিল। যাদের ব্যাপারে সে লিখেছে “ইয়ে তামাম আছ্হাব খাছলত ছিদক ওয়া ছাফা রাখতে হেঁ।” অর্থাৎ এ সমস্ত সাথীরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বিশ্বস্ত এবং নির্মল ও পরিচ্ছন্ন রেখে থাকেন [রূহানী খাযায়েন ১১/৩২৫ দ্রষ্টব্য]। সেখানে উক্ত তালিকার ২৫৫ নং সিরিয়ালে রয়েছেন শায়খ আব্দুর রহমান মিসরী। [রূহানী খাযায়েন ১১/৩২৮ দ্রষ্টব্য]।

[৭] বেগানা নারীদের সাথে অবাধ মেলামেশা : মির্যা কাদিয়ানীর পুত্র মির্যা বশির আহমদ এম.এ তার পিতার জীবনীগ্রন্থে লিখেছেন : ‘মোসাম্মৎ ভানু’ নামের জনৈকা মহিলা এক রাতে এক শীত মৌসুমে লেপের উপর দিয়ে মির্যা সাহেবের পা টিপতেছিলেন। হঠাৎ তিনি খাটের পট্টিকে পা ভেবে টিপতে থাকেন। সংক্ষেপে। উক্ত বইতে আরো উল্লেখ আছে যে, মোসাম্মৎ ভানু বেগম ছাড়াও মির্যার ব্যক্তিগত খাদেম (সেবক) হাফিয হামেদ আলীর স্ত্রী ‘মায়ী রসুল বিবি’ আর ‘বাবু শাহ্দীন’ এর স্ত্রী তারা উভয়ে সারা রাত্রী মির্যাকে পাশে বসে থেকে পাহারা দিতেন। মির্যার আরেক মুরিদ মুহাম্মদ দীন এর স্ত্রী ‘মায়ী ফাজ্জু’ এবং অন্য আরেক মুরিদ সাইয়েদ আব্দুস সাত্তার শাহ্ এর যুবতী কন্যা ‘যয়নব বেগম’ তারা সকলে কোনো কোনো সময় গভীর রাত পর্যন্ত মির্যা কাদিয়ানীর শারীরিক সেবায় নিয়োজিত থাকতেন বলেও উক্ত বইতে উল্লেখ রয়েছে। (সীরাতে মাহদী ৩/২১০ পুরাতন এডিশন, নতুন এডিশন ৩/৭২২; ক্রমিক নং ৭৮০ ও ৯১০ দ্রষ্টব্য)। আহা! একজন নবুওয়তের দাবীদার ও একই সাথে রাসূল (সা:) এর মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীনকারী দাবীদারের পক্ষে বেগানা নারীদের সাথে এইরূপ অবাধ মেলামেশা সত্যি বড়ই আজব ব্যাপার! অথচ আমাদের প্রিয় নবী (সা:)-এর জীবনে এসবের কল্পনাও করা যায় না!

[৮] নবীর শানে অবমাননা : ১৪শত বছর যাবত বিশ্বের সকল মুসলমানের অকাট্য বিশ্বাস হযরত মুহাম্মদ (সা:) আধ্যাত্মিকতা, খোদাভীরুতার দিক দিয়ে সমস্ত মানুষের উপরে, কিন্তু কাদিয়ানীদের বিশ্বাস যেহেতু উন্নতির কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি সেহেতু আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে যে কেউ মুহাম্মদ (সা:)-কে পেছনে রেখে সামনে বেড়ে যেতে পারে। আর যিনি বেড়ে যেতে পেরেছেন তিনি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। নাউযুবিল্লাহ। এটি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হিসেবে আল্লাহ কর্তৃক মুহাম্মদ (সা:)-এর নির্বাচনের প্রতি একটি পরিষ্কার চ্যালেঞ্জ নয় কি? প্রমাণের জন্য দেখুন : কাদিয়ানীদের পত্রিকা আখবারে ‘আল ফজল’ ১৭ ই জুলাই ১৯২২ ইং। সেখানে পরিষ্কার লিখা আছে : “এটা একটি সম্পূর্ণ বাস্তবধর্মী কথা যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই [আধ্যাত্মিকতার পথে] উন্নতি করতে পারে এবং উচ্চাসনে সমাসীন হতে পারে। এমনকি মুহাম্মদ (সা:) থেকেও সামনে বেড়ে যেতে পারে।” বক্তব্যটি মির্যা কাদিয়ানীদের কথিত দ্বিতীয় খলিফা মির্যাপুত্র মির্যা বশির উদ্দীন মাহমূদের। অপ্রিয় হলেও সত্য, মির্যা কাদিয়ানী থেকেও তার এই ধরণের আকীদা রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। দেখুন আখবারে ‘বদর’ ২৫ অক্টোবর ১৯০৬ ইং। তাতে উল্লেখ আছে, একদা তার সামনে তারই এক শিষ্য কাজী জহুর উদ্দিন আকমল কবিতা পড়ছিলেন: “মুহাম্মদ আবার আমাদের মাঝে এসেছে এবং মর্যাদায় আগের [মুহাম্মদের] চেয়েও সামনে বেড়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ মুহাম্মদকে যদি কেউ দেখতে চাও; তাহলে কাদিয়ানে এসে গোলাম আহমদকে দেখে যাও।” নাউযুবিল্লাহ। এমনকি সে তা সমর্থন করে তাকে ‘জাজাকাল্লাহ’-ও বলেছিল। (আখবারে ‘আল ফজল’ পাতা ৪, কলাম ১; ২২ ই আগস্ট ১৯৪৪ ইং)।

কাদিয়ানীদের পত্রিকা, আখবারে ‘আল ফজল’ ১৭ ই জুলাই ১৯২২ ইং
কাদিয়ানীদের পত্রিকা, আখবারে ‘বদর’ ২৫ অক্টোবর ১৯০৬ ইং
মির্যাপুত্র মির্যা বশির আহমদ এম.এ রচিত ‘কালিমাতুল ফজল’ এর পিডিএফ কপি। মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ দাবী করার সুস্পষ্ট প্রমাণ এই বইতেও রয়েছে। রচনাকাল : ১৯১৫ ইং, কাদিয়ান ভারত।
আখবারে ‘আল ফজল’ পাতা ৪, কলাম ১; ২২ ই আগস্ট ১৯৪৪ ইং

শেষকথা: তাহলে এমন জঘন্য চরিত্রের মানুষটি যদি দাবী করে যে, আমি নবুওয়ত ও রেসালত লাভ করেছি নবী করীম (সা:) এর মাঝে নিজেকে বিলীন করে, তার এই দাবী শুধুই কি মিথ্যা? নাকি নবী করীম (সা:) এর শানে চরম বেয়াদবিও! সুতরাং বুঝা গেল, মির্যা কাদিয়ানীর মত এই বেয়াদব জেনাকার ব্যক্তিটি আর যাইহোক না কেন; অন্তত ইমাম মাহদী হতে পারেনা, বরং সে একজন মিথ্যাবাদী ও মুরতাদ কাফের। ফলে তার মৃত্যুও হয়েছিল টয়লেটে। যেমন তাদেরই বইয়ের ভাষায়, “তিনি টয়লেটে গমন করতেই (নিচে) পড়ে যান। অতপর আমরা কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি ইহধম ত্যাগ করেন।” (হায়াতে নাসের পৃষ্ঠা নং ১৪; পুরতান এডিশন, লিখক, শায়খ ইয়াকুব আলী ইরফানী কাদিয়ানী, এডিটর : দৈনিক আল হিকাম পত্রিকা)।

অপ্রিয় হলেও সত্য, কাদিয়ানীরা ইদানীং তাদের বইগুলোর প্রতি সংস্করণে বইগুলো থেকে কখনো শব্দ কখনো বা সম্পূর্ণ এক কিংবা একাধিক বাক্য বাদ দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার নিকৃষ্টতম গোজামিলের পন্থা অবলম্বন করেছে। এই ভিডিওটি দেখুন Click

সংক্ষেপে এই পর্যন্ত। আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দিন। [বিশেষ অফার : কোনো কাদিয়ানী তথ্যগুলো ভুল প্রমাণ করতে পারলে উপযুক্ত পুরষ্কার দেয়া হবে]।

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

হযরত মওলানা লাল হোসাইন আখতার (রহ:) কেন কাদিয়ানী থেকে ইসলামে ফিরে এলেন?

0
.

সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

জন্মসূত্রে একজন মুসলমান। অতপর ১৯২৪ সালে কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপে কনভার্ট হন। লাহোরী গ্রুপের তাবলীগী আহমদীয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বাইবেল, সংস্কৃত ভাষা এবং বেদসহ মির্যায়ী যাবতীয় বিষয়ে পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি প্রায় আট বছর ‘আহমদীয়া এসোসিয়েশন’ এর সেক্রেটারী এবং ‘পয়গামে ছুলহে’ পত্রিকা এর এডিটর ও ‘মুহছিল’ ইত্যাদীর নানা পদে যিম্মাদার ও লাহোরী জামাতের তার্কিক মুবাল্লিগদের চিফ ইনসার্চ ছিলেন। ৭ই মে ১৯৩২ সালে ইসলাম গ্রহণের পর কাদিয়ানীরা উনার উপর নানা জায়গায় হামলা করে। উপায়ন্তর না দেখে অর্থের বিনিময়ে উনার মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টাও করে। কিন্তু উনি বরাবরই তৎকালীন কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলিফা মির্যাপুত্র বশির উদ্দীন মাহমুদকে মুনাজারা (বিতর্ক) করার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু মুনাজারার আহবান তো গ্রহণ করেইনি, বরং অফিসিয়ালিভাবে তারা ‘দৈনিক আল ফজল’ পত্রিকায় এই মর্মে ডিগ্রি জারি করে দেয় যে, মাওলানা লাল হোসাইন আখতার এর সাথে কখনো কেউ মুনাজারায় যোগ দেবেনা। সকল কাদিয়ানী মুরুব্বীর প্রতি উক্ত ঘোষণা আমলে নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। দেখুন ‘আল ফজল’ পৃষ্ঠা নং ৪, ১লা জুলাই ১৯৫০ ইং। তিনি জীবনের শেষ দিকে পাক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওত এর মহামান্য আমীরের পদ মর্যাদা লাভ করেন। তিনি ১১ই জুন ১৯৭৩ইং ইন্তেকাল করেন। হযরত মাওলানা মুফতি যাইনুল আবেদীন সাহেব উনার জানাযা পড়ান।

ইসলামে ফিরে আসার বিস্তারিত ঘটনা :

হযরত মওলানা লাল হোসাইন আখতার (রহ:) বলেন, একবার লাহোরী জামাতের কয়েকজন মুবাল্লিগ (মিশনারী সদস্য) আমার সাক্ষাতে এলো। তারা আমার নিকট খুবই জোরদারের সাথে তাদের জামাতের দাওয়াতি কার্যক্রমের বর্ণনা দিল। ইসলামের খেদমতে মির্যা কাদিয়ানীর সীমাহীন আত্মোৎসর্গের কথাও শুনাল। তারা আমাকে বলল, আমাদের (লাহোরী) জামাতের সেই আকীদা (ধর্মমত) যা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতেরও আকীদা। মির্যা কাদিয়ানী সাহেব নবুওয়তের দাবীদার ছিলেন না। যারা মির্যা কাদিয়ানীর প্রতি নবুওয়ত দাবীর আপত্তি তুলে তারা আসলে মির্যা সাহেবের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মিথ্যা, অপবাদ আর বাগাড়ম্বর করে বেড়ায়। তারা তাদের এসমস্ত বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে মির্যা কাদিয়ানীর প্রথম দিককার লেখিত বইগুলো হতে উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে শুনালো যেখানে মির্যা কাদিয়ানী সাহেব নবুওয়ত দাবীদারকে কাফের, দাজ্জাল এবং ইসলামের দায়েরা (গন্ডি) থেকে খারিজ আখ্যা দিয়েছেন। আর যেহেতু মির্যায়ী মতবাদ সম্পর্কে আমার তখনো পর্যন্ত পড়াশোনা ছিল শূন্যের কোটায়, তাই ইসলামের তাবলীগের নামে আমি তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে দিলাম এবং দুর্ভাগ্যবশত আমি মির্যা কাদিয়ানীর মুজাদ্দিয়ত এবং মাহদিয়তের ফাঁদ আপনা গলায় তুলে নিলাম। আমি তাদের জামাতে বাইয়াত নেয়ার পর জামাতের আঞ্জুমানের তাবলীগী কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখানে সংস্কৃত এবং ভেদগুলোসহ ইত্যাদী বইপুস্তক অধ্যায়ন করলাম। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোর্স সম্পূর্ণ করলাম। অতপর একজন সফল মুবাল্লিগ হিসেবে তারা আমাকে তাবলীগ এবং ইশায়াতের কাজে নিযুক্ত করলেন। এই সময় আমি শুধুমাত্র একজন মুবাল্লিগ আর মুনাজির (তার্কিক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করিনি বরং ‘আহমদীয়া এসোসিয়েশন’ এর একজন সেক্রেটারী এবং ‘পয়গামে ছুলহে’ পত্রিকা এর এডিটর ও ‘মুহছিল’ ইত্যাদীর নানা পদে যিম্মাদারী পালন করেছিলাম। আমি আট (৮) বছর পর্যন্ত চরম প্রচেষ্টা আর আত্ম-ত্যাগের মাধ্যমে মির্যায়ী মতবাদের তাবলীগ এবং ধর্মপ্রচার করেছিলাম।

১৯৩১ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি একাধিকবার স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে মির্যা কাদিয়ানী ভয়ংকর বীভৎস চেহারায় সাক্ষাৎ দিলেন এবং তাকে খুবই খারাপ অবস্থায় দেখতে পেলাম। আমি স্বপ্নের এই ঘটনা কোনো মির্যায়ীকে বলিনি। কেননা যদি আমি তাদেরকে স্বপ্নের উক্ত ঘটনা বলতাম তাহলে তারা (হয়ত) বলত যে, এই স্বপ্ন শয়তান দেখিয়েছে। আমি কোনো মুসলমানকেও উক্ত স্বপ্নের ঘটনা বলিনি। কেননা যদি তাদেরকে সেটি শুনাতাম তাহলে তারা বলত, মির্যা কাদিয়ানী আপনা সমস্ত দাবীতে মিথ্যাবাদী ছিল। তুমি মির্যায়িত হতে তাওবা কর। আমার অবস্থা এভাবেই চলতে থাকল।

একদা রাতে আমি আরও একটি স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম যে, এক বিশাল ময়দান। হাজার হাজার মানুষ সেখানে অত্যন্ত পেরেশানি আর অস্থিরতার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকেও তাদের মধ্যে দেখতে পেলাম। তাদের চারপাশে লোহার উঁচু উঁচু পিলার। সেগুলোতে ভুমি হতে একজন মানুষের উচ্চতা পর্যন্ত কাঁটাতারে পেঁচানো রয়েছে। কাঁটাতারের সেই হালকা থেকে বাহিরে আসার কোনো দরজা কিংবা রাস্তা নেই। হাজারো মানুষকে তার অভ্যন্তরে বন্ধি রাখা হলো। তাদের মধ্যে আমার পরিচিত কিছু চেহারাও ছিল। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদেরকে এই বিপদের মধ্যে কিজন্য গ্রেপ্তার করে রাখা হলো? তারা আমাকে জবাবে বলল, আমাদেরকে আহমদিয়তের কারণে [কাদিয়ানী হওয়ার অপরাধে] বিরুদ্ধবাদীরা এখানে বন্ধি করে রেখেছে। এখান থেকে খানিক দূরে হযরত মসীহ মওউদ (মির্যা কাদিয়ানী) পালংকের উপর শুয়ে আছেন। আমাদের ব্যাপারে তার কোনোই খবর ছিলনা যাতে তিনি আমাদের পরিত্রানের জন্য কোনো চেষ্টা করতে পারেন। আমাদের কারো নিকটে এমন কোনো যন্ত্রপাতিও ছিলনা যার মাধ্যমে আমরা তাঁরকাটা কেটে বাহিরে আসতে পারি। আমি তাঁরকাটা ঘেরাওয়ের চারপাশ ঘুরতে শুরু করলাম। আমি দেখতে পেলাম, এক স্থানে মাটির সামান্য উপরিভাগে তাঁরকাটা ঢিলা হয়ে আছে। আমি মাটির উপর বসে পড়লাম। উক্ত তাঁরকাটাকে আমি আমার ডান পা দিয়ে নিচের দিকে দাবাতে শুরু করলাম। তখন উক্ত তাঁরকাটাটি একদম ঢিলে হয়ে মাটির সাথে লেগে গেল। মাথার নিকটতম তাঁরকাটাকে সামান্য উপরের দিকে ধাক্কা দিলাম। ফলে উভয় তাঁরকাটার মধ্যভাগে এই পরিমাণ ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হল যে, আমি সেখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলাম।

একটু দীর্ঘ ব্যবধান শেষে উক্ত পালংকটি চোখে পড়ল যেখানে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী একটি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। আমি অত্যধিক শিষ্টাচারিতা আর সম্মানের সাথে পালংয়ের নিকটবর্তী হলাম। তিনি যখনি নিজের চেহারা থেকে চাদর সরালেন তখন দেখতে পেলাম তার মুখটি প্রায় দুই ফুট লম্বা এবং চেহারা শুয়োরের ন্যায়। একটি চোখ একদমই দৃষ্টিহীন এবং বন্ধ। দ্বিতীয় চোখটি মাশ [একপ্রকারের ডাইল]’র দানা সমপরিমাণ ক্ষুদ্র। তিনি বললেন, আমার খুবই খারাপ অবস্থা। তার কথার আওয়াজ থেকে অস্বাভাবিক ধরণের দুগন্ধ বেরুল। তার বিকৃত চেহারা আর কথার আওয়াজে আমি কাঁপতে লাগলাম। ইত্যবসরে আমার চোখ খুলে গেল এবং আমি জেগে গেলাম।

কিছুদিন পর দ্বিতীয়বার আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, এক ব্যক্তি আমার থেকে প্রায় দুইশত গজ দুরত্ব বজায় রেখে সামনে দিয়ে চলতে লাগল। আমি তার পিছে পিছে চলতে লাগলাম। লম্বা একটি ফিতা তার কোমরে বাঁধা, ফিতার আরেক অংশ আমার গলায় পরানো। আমাদের সফর পশ্চিম দিকে থেকে পূর্ব দিকে চলছে। সফরের প্রতিমধ্যে ডান দিকে তাকাতেই দেখলাম, অত্যন্ত সুদর্শন চেহারার একব্যক্তি। তিনি শুভ্রবর্ণের ও মধ্যম আকৃতির এমন একজন যার চোখ দুটো ঝলঝল করছে। যার পাগড়ির রং সাদা এবং পরিহিত লম্বা জামার রংও সাদা। সেলোয়ারের রংও সাদা। মুচকি হাসি হাসলেন এবং আমাকে বললেন, কোথায় চলছো? আমার সামনের জন আমাকে যেদিকে নিয়ে চলছে সেদিকে। আমি আরো বললাম, আমার জানা নেই এই ব্যক্তিটি কে? আমি এও জানিনা যে, ইনি কোথায় নিয়ে চলছেন? এবার আমাকে প্রতিউত্তরে বললেন, এই বেটা তো মির্যা কাদিয়ানী! খোদ জাহান্নাম কো জা-রাহা হে আওর তুমহে বিহি ওয়াহী লে জা-রাহা হে। অর্থাৎ সে নিজেই জাহান্নামে যাচ্ছে আর সাথে তোমাকেও নিয়ে চলছে। আমি তখন বলে উঠলাম, দুনিয়াতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে জেনেবুঝে জাহান্নামের দিকে ছুটবে আর অন্যকেও সাথে করে চলবে! এই কথা বলার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মুসাইলামা কাজ্জাব সম্পর্কে তোমার ধারণা কী বল! সে কি নবুওয়তের মিথ্যা দাবী করে নিজেই জাহান্নামের পথ বেচে নেয়নি? আমি তখন তাঁর এই দলিলের কোনো প্রতিউত্তর করতে পারিনি। তিনি পুনরায় বললেন, খুব মনযোগ দিয়ে সামনের দিকে তাকাও! আমি সামনের দিকে তাকালাম। তাকাতেই মনে হল, বহু দূর ব্যাপী জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত সবকিছু লাল বর্ণের দেখাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান যে, এই লাল বর্ণটা কী? আমি বললাম, না আমি জানিনা। বললেন, এটি হচ্ছে জাহান্নামের আগুনের পুলকি।

আমি যথারীতি চলতে থাকি। লোকটিও আমার পাশাপাশি চলতে থাকল। হঠাৎ লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বরাবরই উক্ত ব্যক্তির [মির্যা কাদিয়ানী] পেছনে পেছনে চলছি। আমরা লাল বর্ণের একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। অনেক দূর থেকে তাপও অনুভব করছি। সেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া লোকটি পুনরায় দৃশ্যমান হলেন এবং আমার আর উক্ত ব্যক্তির মাঝে থাকা ফিতার বন্ধনটির উপর সজোরে আঘাত করলেন। অমনি ফিতাটি দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। আমি সুস্পষ্টত দেখলাম যে, মির্যা কাদিয়ানী জাহান্নামে পতিত হয়ে গেলেন আর আমি তা হতে রক্ষা পেয়ে যাই। সাথে সাথে আমার দুই চোখ খুলে গেল। যদিও বা মির্যা কাদিয়ানীর বেশকিছু ইলহাম আর ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে শুরু থেকেই আমাকে ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল কিন্তু মির্যার প্রতি সু-ধারণা আর অতি-ভক্তি থেকে যে শক্তি পেতাম তা সেগুলোকে তৎক্ষণাৎ দমিয়ে রাখত। আর মনে মনে এই চিন্তা করে প্রশান্তি পেতে চেষ্টা করতাম যে, মির্যা সাহেব তো আর নবী ছিলেন না; যে তার সব কয়টি ইলহাম আর ভবিষ্যৎবাণী পূর্ণ হতে হবে! কিন্তু অধিকহারে স্বপ্ন দেখতে থাকায় আমি খুব বেশি হতচকিত হয়ে গেলাম এবং চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করলাম। আমি এও ভাবলাম যে, যদিও বা স্বপ্ন আমাদের ইসলামের জন্য শরীয়তের দলিল-প্রমাণ নয়, কিন্তু তা সত্যের দিকে পথপ্রদর্শন করার কোনো প্রেরণা তো হতে পারে! পরিশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মির্যা কাদিয়ানীর প্রতি আমার যত মুহাব্বত আর যত দুশমনি দুইটিই আপাতদৃষ্টে একদিকে রাখব এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সাথে শুধুমাত্র মির্যা কাদিয়ানীর সত্যবাদিতা আর মিথ্যাবাদিতা নিয়ে চুলচেরা অনুসন্ধান চালাব।

এক ও অদ্বিতীয় পবিত্র খোদাকে হাজির নাজির জেনে আমি এই ঘোষণা দেয়াকে আমার উপর ফরজ মনে করছি যে, আমি মির্যা কাদিয়ানীর প্রতি পূর্ণ মুহাব্বত আর দুশমনি দুটোই পরিত্যাগ করে একদম সাদামনে [পূর্ণ নিরপেক্ষতার সাথে] তার প্রসিদ্ধ রচনাবলী এবং কাদিয়ানী আর লাহোরী দুনো ফেরকার নির্বাচিত কিতাবগুলো যেখানে মির্যা কাদিয়ানীর দাবীগুলোকে প্রমাণ করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে সবগুলো আমি দীর্ঘ ছয়মাস ধরে পুনরায় [নজরে ছানী] খুব ভালোভাবে মনযোগসহকারে পড়ে শেষ করলাম। সেসাথে মির্যায়ীদের খন্ডনে লেখিত মুসলিম বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের বেশকিছু কিতাবও পড়লাম। অপ্রিয় হলেও প্রকৃত বাস্তবতা হল এই যে, আমি যতই পড়ছি এবং পড়ার কলেবর যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই আমার নিকট মির্যা কাদিয়ানীর মিথ্যাচারীতা পরিস্কার হতে লাগল। এমনিভাবে আমার নিকট একদমই পূর্ণ ঈমান (বিশ্বাস) হয়ে গেল যে, মির্যা কাদিয়ানীর দাবী ইলহাম, মুজাদ্দিদ, মসীহ এবং নবুওয়ত লাভ করাসহ অন্যান্য সবকিছুই ছিল ডাহা মিথ্যা। আমি পরক্ষণে এই ফলাফলে এসে উপনিত হলাম যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ছিলেন একজন সর্বশেষ নবী। হযরত মসীহ (ঈসা) আলাইহিস সালাম আকাশে জীবিত রয়েছেন। তিনি কেয়ামতের পূর্বে আমাদের এই নশ্বর পৃথিবীতে একজন উম্মতি হয়ে তাশরিফ আনবেন। (ঊর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ সমাপ্ত হল)।

পড়ুন – কাদিয়ানীদের বই পুস্তকে মুসলমানদের প্রতি তাকফিরি ফাতাওয়াবাজি

  • অনুবাদক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ

ঈসা (আ:) প্রসঙ্গে কাদিয়ানীদের বিভ্রান্তিকর তিনটি প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর

0

প্রশ্ন : আল্লাহ যাঁকে নবী করে পাঠিয়েছিলেন দুনিয়াতে মৃত্যুর সময়ে তাঁর কি ঈমান ও আমলের ঘাটতি হবে, যার দরুণ তিনি (আ:) মারা যাবেন একজন অ-নবী হিসেবে?

উত্তর : না, তাঁর ঈমান ও আমলের কোনো ঘাটতি হবেনা। তাই তাঁর জন্য মৃত্যুর সময় অ-নবী হিসেবে মারা যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। তবে কথা হচ্ছে প্রিয় নবী (সা:) এর ভবিষ্যৎবাণীতে বুঝা যাচ্ছে যে, তখন তিনি নবুওয়তের দায়িত্বে না থেকে শুধুমাত্র একজন ন্যায়পরায়ন প্রশাসকপরিপূর্ণ সুপথপ্রাপ্ত ইমাম আর মুহাম্মদ (সা:)-এর শরীয়তের উপর আমলকারী শুধু একজন ‘উম্মতি’ হবেন। [সহীহ বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া হা/২৩৬৪; মসনাদে আহমদ হা/৯১১৭; তাফসীরে কাশশাফ, ইমাম যামাখশারী]।

প্রশ্ন : অ-নবী হিসেবে মারা গেলে ঈসা (আ:) তো আর পরকালেও নবী থাকবেন না। কেননা মউতের দুয়ার দিয়ে তিনি তাঁর যে পরিচিতি নিয়ে যাবেন সেই পরিচিতিই তো হবে তাঁর পরকালের পরিচয়, নয় কি?

উত্তর : আগেই বলেছি যে, তিনি অ-নবী হিসেবে মারা যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা; বড়জোর তখন তিনি নবুওয়তের দায়িত্বে থাকবেন না। মির্যা কাদিয়ানী সে নিজেও ঈসা (আ:) প্রসঙ্গে লিখে গেছে : আগত মসীহ’র জন্য আমাদের নবী করীম (সা:) নবুওয়ত শর্ত করেননি। [দেখুন রূহানী খাযায়েন ৩/৫৯]। সুতরাং মউতের দুয়ার দিয়ে তিনি যখন প্রবেশ করবেন তখন তিনি একই সাথে একজন পুরাতন নবী এবং উম্মতি উভয় পরিচিতি নিয়ে প্রবেশ করবেন। এটি তাঁর প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বলতে হবে।

প্রশ্ন : অ-নবী হিসেবে তাঁর যদি পুনরুত্থান ঘটে তাহলে আল্লাহ তাঁকে (আ:) তাঁর উম্মতের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পর্কে জবাবদিহি করবেন কি করে?

উত্তর : না, অ-নবী হিসেবে তাঁর (আ:) পুনরুত্থান ঘটার কোনো কারণ নেই। যেহেতু তিনি মউতের দুয়ার দিয়ে একজন পুরাতন নবী হিসেবেও প্রবেশ করবেন।

  • লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

হযরত ঈসা (আ:) স্বশরীরে আকাশে জীবিত থাকা সম্পর্কে মাননীয় যুগ-ইমামগণের আকীদা

0

হযরত ঈসা (আ:) বর্তমানে সশরীরে আকাশে জীবিত এবং শেষ যুগে পুন: আগমন করার সমর্থনে সর্বজন বরেণ্য যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদগণের উক্তি নিচে তুলে ধরা হল:-

[১] যুগশ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ইমাম মালেক (রহ:) লিখে গেছেন, হযরত ঈসা (আ:) বর্তমানে জীবিত। তাঁকে তেত্রিশ বছর বয়সে আকাশে তুলে নেয়া হয়েছিল। তাঁর সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি নিম্নরূপ مات و هو ابن ثلاث و ثلاثين سنة و لعله أراد رفعه إلى السماء او حقيقته و يجئى آخر الزمان لتواتر خبر النزول “(ইমাম মালেক বলেন) তাঁকে (ঈসা) আকাশে তুলে নেয়ার ইচ্ছে করায় তিনি [ঈসা] সম্ভবত কিংবা প্রকৃতপক্ষেই নিদ্রা গিয়েছিলেন আর তখন তিনি তেত্রিশ বছরের (যুবক) ছিলেন। নুযূল সম্পর্কিত বহু তাওয়াতূর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, তিনি [ঈসা] শেষ যুগে পুন:আগমন করবেন।” (রেফারেন্স, মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার ১/৫৫৩; লেখক, মির্যা কাদিয়ানী স্বীকৃত মুজাদ্দিদ শায়খ মুহাম্মদ তাহির আস-সিদ্দীক আল-পাটনী)। এবার তাহলে বুঝা গেল কী? স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য :-

ইমাম মালেক (রহ:)-এর বক্তব্যের খোলাসা ও কাদিয়ানিদের মিথ্যাচারের জবাব :

(ক) ইমাম মালেক (রহ:)-এর ভাষ্যমতে, আকাশে যখন উঠিয়ে নেয়া হয় তখন ঈসা (আ:)-এর বয়স ছিল ৩৩ বছর। এখানে তিনি (ইমাম মালেক) মাতা/مات শব্দ বলে ঈসা (আ.)-এর “মৃত্যু” বুঝাননি, বরং নিদ্রা যাওয়া বুঝিয়েছেন। হাদীসেও এসেছে, রাসূল (সা.) নিদ্রার দোয়া শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন اللهم باسمك اموت و احى অর্থ হে আল্লাহ তোমার নামেই আমি মৃত্যুবরণ করছি তথা নিদ্রা যাচ্ছি আর তোমার নামেই জীবিত হব তথা জাগ্রত হব। ইমাম মালেক (রহ.) ঐ একই বক্তব্যে আরও বলেছেন, ঈসা (আ:)-কে আকাশে স্বশরীরে উঠিয়ে নেয়ার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৩ বছর। এখন ঈসা (আ.)-কে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন বলে থাকলে তিনি কাদিয়ানীদের মতই ১২০ বছরে মারা যাওয়ার উল্লেখ কেন করলেন না? (খ) ইমাম মালেক (রহ:) এর বক্তব্যের চম্বুকাংশ হচ্ছে, مات و هو ابن ثلاث و ثلاثين سنة و لعله أراد رفعه إلى السماء অর্থাৎ তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার ইচ্ছে করায় তিনি সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েন। বলে রাখা জরুরি, মাতা/مات অর্থ এখানে ঘুম অথবা অচেতন। মির্যা কাদিয়ানীও তার পুস্তক ‘ইযালায়ে আওহাম’-এর ভেতর লিখেছেন, অভিধানে موت শব্দের আরেক অর্থ ঘুম এবং অচেতনও হতে পারে, দেখ কামূস! (রেফারেন্স, রূহানী খাযায়েন ৩/৪৫৯)। (গ) ইমাম মালেক (রহ:)-এর ভাষ্যমতে, তিনি (ঈসা) শেষ যুগে পুনরায় আসবেন। কারণ একথা মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। প্রিয় আহমদীবন্ধু! এইবার চিন্তা করে দেখুন, আপনার কথিত জিল্লি নবী মির্যা কাদিয়ানী কিভাবে কাটছাঁট করে উদ্ধৃতি দিয়েছে এবং দুনিয়াকে ধোকা দিয়ে বোকা বানাতে চেয়েছে!

কিতাব :- মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার, ইমাম তাহের পাটনী রহ.

[২] বিখ্যাত হাদীস সংকলক, হযরত ইমাম বুখারী (রহ:) আপনা কিতাব ‘তারীখে কাবীর’ এর মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) এর বর্ণনায় একটি হাদীস নিয়ে এসেছেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) রেওয়ায়েত করেন, لَيَدْفِنَن عيسى بنُ مريمَ مع النبي صلى الله عليه وسلم في بيته. التاريخ الكبير “নিশ্চিত ভাবেই হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর কবর নবী করীম (সা:)-এর রাওজাতে হবে।” [হাদীসের মান, হাসান]। ইমাম বুখারী সংকলিত ‘তারীখে কাবীর [التاريخ الكبير للبخاري]’ খন্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ১৬৩ দ্রষ্টব্য। উল্লেখ্য কিতাবটি সর্বমোট ৯ খন্ডে প্রকাশিত।

  • বলাবাহুল্য যে, এ হাদীসে ‘ফী বাইতিহি’ (فى بيته) শব্দ থাকায় রাসূল (সা:)-এর রাওজা শরিফ খুঁড়ে তার ভেতরে ঈসাকে দাফন করা হবে বুঝাল কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কারণ আরবী বর্ণ ‘ফী’ (فى) কখনো সখনো ‘নিকট’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নামল এর একটি আয়াতে মূসা (আ:) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে فَلَمَّا جَاءهَا نُودِيَ أَن بُورِكَ مَن فِي النَّارِ وَمَنْ حَوْلَهَا “অতপর সে (মূসা) যখন (আগুনের) কাছে পৌছলো, তখন তাঁকে (অদৃশ্য থেকে) আওয়াজ দেয়া হল, বরকতময় হোক সে, যিনি এই আগুনের মধ্যে (তথা আগুনের সন্নিকটে) আছে, বরকতময় হোক তারা যারা এর আশেপাশে আছে।” (আন নামল ৮)। জ্ঞানীদের নিকট গোপন থাকেনি যে, তূর পর্বতমালায় সেই সময় মূসা (আ:) আগুনের ভেতর ছিলেন না, বরং আগুনের সন্নিকটে তথা কোনো এক পাশে-ই ছিলেন। তথাপি আয়াতে শব্দটি ‘ফী’ (আরবী: في) যোগেই এসেছে।” [রেফারেন্স, তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাজী ২৪/১৮৩ দ্রষ্টব্য] তদ্রপ উক্ত হাদীসেও ‘ফী বাইতিহি’ (فى بيته) বলতে রাওজা শরীফ খুঁড়ে তার অভ্যন্তরে, এই অর্থ নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হল, রাওজা শরীফের পার্শ্বে। অতএব দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ থাকল না।

[৩] ইমাম আবুল হাসান আল-আশ’আরী (রহ:) লিখেছেন و أجمعت الأمة على أن الله عز وجل رفع عيسى عليه السلام إلى السماء অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদিয়া এই ব্যাপারে ইজমা তথা একমত আছেন যে, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ঈসা (আ:)-কে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। (রেফারেন্স, ইমাম আবুল হাসান আল-আশ’আরী রচিত ‘কিতাবুল আমানত’ পৃষ্ঠা ৪৬)।

[৪] ইমাম আলী ইবনে আহমদ ইবনে হাজম (রহ.) তার রচনাবলীতে ঈসা (আ.)-এর পুনরায় আগমনের যেমন কনসেপ্ট দিয়ে গেছেন, ঠিক তদ্রূপ তিনি তার অন্যতম একটি রচনা ‘আল ফসলু ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়ান নাহলি’ (الفصل في الملل والأهواء والنحل) নামীয় কিতাবের ১ম খণ্ডের ৭৭ নং পৃষ্ঠায় আগমনকারী ঈসাকে পরিষ্কার শব্দে ‘বনী ইসরাইলী’ ঈসা (من نزُول عِيسَى عَلَيْهِ السَّلَام الَّذِي بعث إِلَى بني إِسْرَائِيل) বলেই আখ্যা দিয়েছেন। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য :-

ইবনে হাযম (রহ.) রচিত আল মুহাল্লা-তে ঈসা (আ.) সংক্রান্ত কনসেপ্টটা কী?

ইমাম ইবনে হাযম (মৃত: ৪৫৬ হিজরী)-এর উপরিউক্ত আকীদা সম্পর্কে যাদের কোনো জ্ঞান নেই শুধুমাত্র তারাই তাঁর রচিত ‘আল-মুহাল্লা বিল আছার‘ কিতাবের إنما عنى وفاة الموت কথাটির সঠিক তাৎপর্য না বুঝার দরুন ধোকা খেয়ে যান। কাদিয়ানীদের বইপুস্তক পড়লে দেখবেন, তারা ইবনে হাযমের অন্যান্য রচনাবলীকে উপেক্ষা করে সাধারণদের কিভাবে প্রতারিত করে গেছে! আসুন, এবার ইমাম ইবনে হাজম (রহ.) ‘আল মুহাল্লা’ কিতাবে কী ধরনের কনসেপ্ট দিয়ে গেছেন দেখা যাক। তিনি ইবনে আব্বাস (রা.)-এর তাফসীরকে সামনে রেখে আল মুহাল্লা-তে লিখেছেন, فالوفاة قسمان نوم وموت فقط ولم يرد عيسى عليه السلام بقوله فلما توفيتني وفاة النوم فصح أنه إنما عنى وفاة الموت ومن قال إنه عليه السلام قتل أو صلب فهو كافر مرتد حلال دمه وماله لتكذيبه القرآن وخلافه الإجماع অর্থ- “ওফাত’ দুই প্রকার। শুধুমাত্র নিদ্রা এবং মৃত্যু। হযরত ঈসা (আ:) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী: ফা-লাম্মা তাওয়াফফাইতানি (অর্থাৎ [কেয়ামতের দিন আল্লাহর প্রশ্নের উত্তরে ঈসা (আ:) বলবেন] আপনি যখন আমাকে নিয়ে নিলেন – মায়েদা: ১১৭) দ্বারা ‘নিদ্রা’ উদ্দেশ্য নেয়া হয়নি। সুতরাং আমার দৃষ্টিতে (এখানে) ওফাত এর সঠিক অর্থ হল ‘ওফাতুল মওত’ (দুনিয়াতে পুন: আগমনের পর তাঁকে মৃত্যুর মাধ্যমে নিয়ে নেয়া)-ই বুঝানো উদ্দেশ্য (ইবনে হাযমের এই উক্তি ইবনে আব্বাসের ‘و فى آخر الزمان’ তথা ঈসার ওফাত শেষযুগে হবে, উক্তির সাথে মিলে যায়)। (তিনি আরো লিখেছেন) যারা বলবে ঈসা (আ:)-কে হত্যা বা ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে তারা কাফের, মুরতাদ এমনকি কুরআনকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করায় এবং ইজমার বিপরীতে আকীদা রাখায় তাদের রক্ত হালাল [তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া বৈধ]।” (রেফারেন্স, ইবনে হাযম রচিত ‘আল-মুহাল্লা বিল আছার’ খন্ড ১; আকীদা নং ৪১)।

  • কে জানি প্রশ্ন করল, ইবনে হাযম তার উপরিউক্ত ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কৃত তাফসীরের দিকেই ইংগিত করার সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ আছে কি? আমি উত্তরে বলব, জ্বী আছে। ইবনে হাযমের আরেকটা রচনা ‘আল ফসলু ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়ান নাহলি’-এর ৪নং খণ্ডের ১৩৮ নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার লিখা আছে, هذا مع سماعهم قول الله تعالى {ولكن رسول الله وخاتم النبيين} وقول رسول الله صلى الله عليه وسلم لا نبي بعدي فكيف يستجيزه مسلم أن يثبت بعده عليه السلام نبيا في الأرض حاشا ما استثناه رسول الله صلى الله عليه وسلم في الآثار المسندة الثابتة في نزول عيسى بن مريم عليه السلام في آخر الزمان

অর্থাৎ ‘এটা তাদের (জানা) শোনা আছে যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র বাণী {কিন্তু তিনি আল্লাহ’র রসূল এবং নবীদের সমাপ্তি} এবং রাসূল (সা.)-এর বাণী, আমার পরে আর কোনো নবী নেই। এমতাবস্থায় কিভাবে একজন মুসলিম তাঁকে (ঈসাকে) তাঁর পরে পৃথিবীতে একজন নবী প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দিতে পারে? শেষ যুগে মরিয়ম তনয় ঈসা (আ.)-এর নেমে আসার ব্যাপারে আল্লাহ’র রসূল (সা.) ব্যতিক্রম যা বলে গেছেন তা প্রমাণিত।’

এখানে ইবনে হাযম (রহ.) কতটা সুস্পষ্ট করে নিজের আকীদা পেশ করেছেন তা চিন্তা করুন! আগমনকারী ঈসা আবার এসে নবীর দায়িত্বে থাকবেন না বা একজন নবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের অনুমতি পাবেন না, তিনি বিষয়টি ক্লিয়ার করে যেন কাদিয়ানীদের বিশ্বাসের গোড়ায় কুঠারাঘাত করলেন! তিনি তার পরই লিখলেন, الآثار المسندة الثابتة في نزول عيسى بن مريم عليه السلام في آخر الزمان (শেষ যুগে মরিয়ম তনয় ঈসা (আ.)-এর নেমে আসার ব্যাপারে আল্লাহ’র রসূল (সা.) ব্যতিক্রম যা বলে গেছেন তা প্রমাণিত)। এখন বলুন, ইবনে হাযম (রহ.)-এর আকীদা সুস্পষ্ট করতে এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে? কিন্তু সাধারণ কাদিয়ানীরা তো বটে, অধিকাংশ মু’আল্লিম বা মুরুব্বি পর্যায়ের কাদিয়ানীরাও ইবনে হাযম (রহ.)-এর উল্লিখিত আকীদা সম্পর্কে পুরোই অন্ধকারে। কাজেই ইমাম ইবনে হাযম (রহ:)-এর সম্পূর্ণ বক্তব্য চেপে গিয়ে যারা এতকাল উনার খন্ডিত বক্তব্যে ধুম্র জাল সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন এবার তাদের অবশ্য লজ্জা হওয়া উচিত। তারপর চলুন “ইজমা” সম্পর্কে জেনে নিই!

[৫] ইমাম আবুল হাইয়ান আল-উন্দুলূসী (রহ:) লিখেছেন و اجمعت الأمة على ما تضمنه الحديث المتواتر من أن عيسى في السماء حى وأنه ينزل في آخر الزمان “উম্মতে মুহাম্মদিয়া (বহু) মুতাওয়াতির হাদীসের প্রেক্ষিতে এই ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, নিশ্চয়ই ঈসা (আ:) আকাশে (স্বশরীরে) জীবিত এবং শেষ যামানায় তিনি [আকাশ থেকে] নাযিল হবেন।” [রেফারেন্স, আল-বাহরুল মুহীত: ২/৪৭৩]।

[৬] শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ:) তাঁর আরেকটি কিতাবে লিখেছেন ينزل عيسى بن مريم من السماء على المنارة البيضاء شرقى دمشق “ঈসা ইবনে মরিয়ম দামেস্কের পূর্বে সাদা মিনারার নিকটে আকাশ থেকে নাযিল হবেন।” [রেফারেন্স, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘আল-জাওয়াবুস সহীহ’ ২/৩১]। শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ:) তিনি এর উপর উম্মতের ইজমা সম্পর্কে লিখেছেন و اجمعت الأمة على ان الله رفع عيسى إلى السماء “উম্মতে মুহাম্মদিয়া একথার উপর একমত আছেন যে, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন।” [রেফারেন্স, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়্যা’ ২/৪১৯]।

[৭] ইমাম ইবনে কাইয়ুম (রহ:) সম্পর্কে ‘রূহানী খাযায়েন’ এর ১৩ নং খন্ডের ২২১ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে, ফাযেল, মুহাদ্দিস এবং মুফাসসির ইবনে কাইয়ুম ছিলেন স্বীয় যামানার একজন যুগ ইমাম। এবার ঈসা (আ:) সম্পর্কে উনার আকীদা কেমন ছিল জেনে নিন। তিনি লিখেছেন و هذا المسيح ابن مريم حي لم يمت و غذاه من جنس غذاء الملائكة “এই মসীহ ইবনে মরিয়ম তিনি জীবিত, ইন্তেকাল করেননি আর (আকাশে) তাঁর খাবার-দাবার [’র প্রয়োজনীয়তা] ফেরেশতাজাতির খাবার-দাবারের মতই [আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ণতা লাভ করে]।” [রেফারেন্স, আত-তিবইয়ান ফী ঈমানিল কুরআন পৃষ্ঠা নং ২২৮]। ইমাম ইবনে কাইয়ুম (রহ:) ঈসা (আ:) আকাশ থেকে নাযিল হবেন মর্মে লিখেছেন نازلا من السماء فيحكم بكتاب الله وسنة رسوله . هداية الحيارى فى اجوبة اليهود والنصارى “[লোকেরা ঈসাকে] আকাশ থেকে নাযিল হতে দেখবেন। অতপর তিনি কিতাবুল্লাহ এবং তদীয় রাসূলের সুন্নাহ দ্বারা শাসন কায়েম করবেন।” [রেফারেন্স, ‘হিদায়াতুল হাইয়ারা ফী আজবিবাতিল ইয়াহুদ ওয়ান নাসারা’ পৃষ্ঠা নং ১৬৮; লিখক, ইবনে কাইয়ুম রহ:]।

[৮] ইমাম ইবনে কাসীর দামেস্কী (রহ:) তিনি স্বীয় তাফসীর গ্রন্থের অত্র পৃষ্ঠায় হযরত ঈসা (আ:) আকাশ থেকে নাযিল হবেন বলে বর্ণিত হাদীসগুলো উল্লেখপূর্বক শিরোনাম দিলেন নিম্নরূপ ذكر الأحاديث الواردة في نزول عيسى ابن مريم إلى الأرض من السماء في آخرالزمان قبل يوم القيامة “কিয়ামতের পূর্বে শেষ যুগে আকাশ থেকে পৃথিবীতে ঈসা ইবনে মরিয়মের অবতরণকরা সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলোর আলোচনা।” (রেফারেন্স, তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড ২; সূরা নিসা)। তিনি তাঁর ‘তাফসীরে ইবনে কাসীর’-এর মধ্যে (২/৪৭) একদম পরিষ্কার করে এও লিখেছেন, فإن المسيح عليه السلام لمَّا رفعه الله إلى السماء: تَفَرَّقت أصحابه شيَعًا بعده অর্থাৎ হযরত মসীহ (আ.)-কে আল্লাহতালা যখন আকাশে উঠিয়ে নেন তার পর থেকে তাঁর সাথীরা (অনুসারীরা) দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জ্ঞানীরা চিন্তা করুন, যিনি হযরত ঈসা (আ:) এর নাযিল ‘আকাশ থেকে হবে’ মর্মে শিরোনাম দিলেন, ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার বিশ্বাসও দুনিয়ার সামনে রেখে গেলেন, তিনি আদৌ কি ঈসা (আ:)-কে মৃত বিশ্বাস করতে পারেন? কখনো না। তাহলে আমাদের আহমদীবন্ধুরা কোথা থেকে এইসব বিভ্রান্তি আমদানি করেন!

[৯] মির্যা কাদিয়ানী স্বীকৃত হিজরী অষ্টম শতকের মুজাদ্দিদ ও সহীহ বুখারির ব্যাখ্যাকারক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) ‘ফাতহুল বারী’ কিতাবে লিখেছেন و ليس له قبر অর্থাৎ তাঁর (ঈসা) কোনো কবর-ই নেই। [ফাতহুল বারী, কিতাবুস সালাত, ১/৬৩৪ দ্রষ্টব্য]। তিনি তাঁর অন্য আরেকটি কিতাবে আরো লিখেছেন: ‘সকল হাদীস বিশারদ এবং তাফসীরকারক একমত এই কথার উপর যে, انه رفعه ببدنه حيا অর্থাৎ নিশ্চয় তাঁকে (ঈসা) সশরীরে জীবিত উঠিয়ে নিয়েছেন। তবে মতভেদ শুধু এতটুকুতে যে, (আকাশে) উঠিয়ে নেয়ার আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন নাকি [মৃত্যুর সদৃশ] ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। [রেফারেন্স, ইবনে হাজার রচিত ‘আত-তালখীছুল হাবীর’ কিতাবুত তালাক: ৩/৪৬২]।

[১০] মির্যা কাদিয়ানী স্বীকৃত হিজরী নবম শতকের মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী (রহ:) লিখেছেন و انه يحكم بشرع نبينا و وردت به الأحاديث و انعقد عليه الإجماع অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি (ঈসা) আমাদের নবী (মুহাম্মদ)’র শরীয়ত দ্বারা বিচার-ব্যবস্থা (কায়েম) করবেন এবং এর প্রমাণে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে ও এর উপর ইজমা [উম্মতের ঐক্যমত্য] প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [রেফারেন্স, ইমাম সুয়ূতী রচিত ‘আল-হাভী লিল ফাতাওয়া’ ২/১৫৫]। ইমাম সুয়ূতী (রহ:) আরো লিখেছেন و مَكَرَ اللهُ بِهِمْ بِألْقَى شِبْهِ عِيسى على مَن قَصَدَ قتْلَهُ فقتلوه و رَفَعَ عيسى إلى السماء . جلالين অর্থাৎ আল্লাহ তিনিও তাদের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। যার ফলে আল্লাহতায়ালা তাদের একজনকে ঈসার সাদৃশ্য করে দেন যে তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছে করেছিল। তারপর তারা (ইহুদীরা) ঈসার সদৃশ-লোকটিকে (ঈসা ভেবে) হত্যা করে ফেলে। আর (ওদিকে) ঈসাকে [তাদের পাকড়াও হতে নিবৃত রেখে] আকাশে উঠিয়ে নেন। [রেফারেন্স, তাফসীরে জালালাইন: সূরা আলে ইমরান ৫৫]। মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক স্বীকৃত ৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রহ:) আরো লিখেছেন ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﻣﺪ ﻓﻲ ﻋﻤﺮﻩ ﺣﺘﻰ ﺍﻫﺒﻂ ﻣﻦ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﻲ ﺍﻷﺭﺽ ﻭ ﻳﻘﺘﻞ ﺍﻟﺪﺟﺎﻝ অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর (ঈসা) আয়ুস্কাল বিলম্বিত করে দিয়েছেন। তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। [রেফারেন্স, দুররে মানছূর ২/৩৫০]।

[১১] হিজরী দশম শতকের মুজাদ্দিদ মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) ‘তারীখে কাবীর’ এর ১ম খন্ডের ১৬৩ নং পৃষ্ঠায় একটি হাদীসে উল্লিখিত في قبري এর ব্যাখ্যায় লিখেছেনفي قبري اى في مقبرتى ، و عبر عنها بالقبر لقرب قبره بقبره فكأنما فى قبر واحد {فأقوم انا و عيسى في قبر واحد} أي من مقبرة واحدة. ففي القاموس : ان في تأتى بمعنى من “[রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন] ঈসা (আ:) আমার কবরে দাফন হবেন’ একথার অর্থ হল তিনি আমার গোরস্তানে [রাওজাতে] দাফন হবেন। তাঁর (ঈসা) কবরটি রাসূলের কবরের একদম সন্নিকটে হওয়াতে যেন (দু’জনের কবরদ্বয়) একই ব্যক্তির কবরে পরিগণিত। [হাদীসের পরের অংশ] ‘অতপর আমি এবং ঈসা একই কবরে দাফন হব’ একথার অর্থ হচ্ছে একই গোরস্তানে [পাশাপাশি দুইজন] দাফন হব। কারণ, কামূছ [অভিধান]’র ভেতর আছে, কোনো কোনো সময় ‘ফী’ (মধ্যে) বর্ণটি ‘মিন’ (সন্নিকটে) অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।” [মেরকাত শরহে মেশকাত: ১০/১৬৬; কিতাবুল ফিতান দ্র.]।

[১২] মির্যা কাদিয়ানী স্বীকৃত হিজরী দশম শতকের মুজাদ্দিদ শায়খ মুহাম্মদ গুজরাটী (রহ:) লিখেছেন و يجئى آخر الزمان لتواتر خبر النزول অর্থাৎ তিনি (ঈসা) শেষ যামানায় পুন: আগমন করবেন একথা নাযিল সংক্রান্ত বহু তাওয়াতূর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। [রেফারেন্স, মাজমাউল বিহার: ১/ ৫৩৪]।

[১৩] ইমাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস আদ-দেহলভী (রহ:) লিখেছেন فظنوا رفعه إلي السماء قتلا . الفوز الكبير অর্থাৎ ফলে তারা (ইহুদীরা) তাঁকে (ঈসাকে) আকাশে উঠিয়ে নেয়াকে হত্যা করার ধারণা করেছিল। [রেফারেন্স, আল-ফাওযুল কাবীর [আরবী] ৩৮; দারুল গাওছানী লিদ-দিরাসাতিল কুরআনিয়্যা, দামেস্ক হতে প্রকাশিত]।

[১৪] ইমাম মুহম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে সালেম ইবনে সোলায়মান আস-সাফারিনী (রহ:) (মৃত: ১১১৪ হিজরী) লিখেছেন العلامة الثالثة : ان ينزل من السماء السيد المسيح عيسى بن مريم و نزوله ثابت بالكتاب و السنة و الإجماع “(কেয়ামতের) তৃতীয় আলামত হচ্ছে, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর আকাশ থেকে নাযিল হওয়া। তাঁর নাযিল হওয়া এটি কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা (সকলের ঐক্যমত্য) দ্বারা সাব্যস্ত।” [রেফারেন্স, লাওয়ামিউল আনওয়ারিল বাহিয়্যাহ: ২/৯৪]।

[১৫] হিজরী তের শতকের মুজাদ্দিদ দাবিদার ও একই সাথে ইমাম মাহদী, মসীহে মওঊদ এবং নবুওয়তের দাবীদার কাদিয়ানের ‘কাজ্জাব’ মির্যা গোলাম আহমদ নিজেও ১৮৯৯ সালে স্বীকারোক্তি দিয়ে তার বইয়ের এক জায়গায় লিখে গেছেন, اس پر اتفاق ہو گیا ہے کہ مسیح کے نزول کے وقت اسلام دنیا پر کثرت سے پھیل جائے گا اور ملل باطلہ ہلاک ہو جائیں گی اور راست بازی ترقی کرےگی অর্থাৎ “গোটা উম্মতে মুহাম্মদিয়া এই ব্যাপারে একমত রয়েছেন যে, মসীহ (ঈসা)’র নাযিল হওয়ার প্রাক্কালে দুনিয়াতে ইসলাম বহুলাংশে ছড়িয়ে পড়বে। বাতিল ধর্মমতের অবসান ঘটবে এবং সর্বাত্মক ন্যায়পরায়ণতার উন্নতি ঘটবে।” [রেফারেন্স, মির্যা কাদিয়ানী রচিত ‘আইয়্যামুছ ছুলহি’ (রচনাকাল: ১৮৯৯ ইং) পৃষ্ঠা ১৩৬; রূহানী খাযায়েন ১৪/৩৮১। তিনি ‘বারাহিনে আহমদিয়া’ [রচনাকাল: ১৮৮৪ ইং] নামক বইয়ের ৪র্থ খন্ডের ৪৯৯ পৃষ্ঠায় [উর্দূ] আরো লিখেছেন, جب حضرت مسیح علیہ السلام دوبارہ اس دنیا میں تشریف لائیں تو ان کے ہاتھ سے دین اسلام جمیع آفاق اور أقطار میں پهیل جائے گا অর্থাৎ যখন হযরত মসীহ (ঈসা) আলাইহিস সালাম এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আগমন করবেন তখন তাঁর হাতে ইসলামধর্ম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। [আরো দেখুন রূহানী খাযায়েন ১/৫৯৩]।

পরিশেষ : পরিশেষে বলতে পারি, ঈসা (আ:) বর্তমানে আকাশে জীবিত থাকা এবং শেষ যুগে পৃথিবীতে তাঁর পুন: আগমন হওয়া একটি অকাট্য সত্য ও সুপ্রমাণিত আবার এটি জুরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্তও। ফলে কোনো মুসলমানের পক্ষে এটি অস্বীকার করার কোনোই সুযোগ নেই।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

মুসলিম শরীফের হাদীসে ঈসা (আ:)-কে ‘নাবিউল্লাহ’ বলা প্রসঙ্গে

2

প্রশ্নকর্তা : ঈসা (আ:) যদি আবার এসে নবী না হন (তথা নবুওয়তের দায়িত্বে না থাকেন) তাহলে মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে তাঁকে ‘নাবিউল্লাহ’ (আল্লাহর নবী) সম্বোধন করা হয়েছে কেন?

উত্তরদাতা : এর উত্তর হল, আগত ঈসা কোনো রূপক ঈসা নন, বরং বনী ইসরায়েলের জন্য ইতিপূর্বে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন শেষ যুগে তিনি-ই পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, এ কথাটি সুস্পষ্ট করে দিতেই হাদীসে “নাবিউল্লাহ” বলে ইংগিত দেয়া হয়েছে। যাতে রূপক ঈসা দাবীদারদের উদ্দেশ্যমূলক ও বিকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে প্রকৃত ঈসাকে বাদ দিয়ে কথিত রূপক ঈসার জালে বন্দী হয়ে না যায়!

আরেকটু বুঝিয়ে বলছি, মনে করুন, সাবেক দুই-একজন চেয়ারম্যান যারা বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলেও জীবিত, কিন্তু চেয়াম্যানের দায়িত্বে নেই। আর লোকজন তাদেরকেও চেয়ারম্যান শব্দে সম্বোধন করার অর্থ কি এই যে, তারাও নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান? অবশ্যই না। এবার একটি হাদীস দিয়ে বুঝিয়ে বলছি! কেয়ামত দিবসেও হযরত ঈসা (আ:)-কে ‘ইয়া ঈসা আন্তা রাসূলুল্লাহ’ (يا عيسى انت رسول الله) অর্থাৎ হে ঈসা আপনি আল্লাহর রাসূল, এইভাবে সম্বোধিত হবেন। (ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, কিতাবুর রিক্বাক, হাদীস নং ৬১৯৭)। এখন বুঝে থাকলে বলুন, ঈসা (আ:)-কে বিচার দিবসে ‘রাসূলুল্লাহ’ বলা হবে বলে তিনি কি সেই সময় পুনরায় রেসালতপ্রাপ্ত হবেন? অবশ্যই না। অনুরূপ আগমনকারী ঈসাকে ‘নাবিউল্লাহ’ বলা হয়েছে বলে তিনিও পুনরায় নবুওয়তের দায়িত্বে সমাসীন হবেন, বুঝায়নি।

মজার ব্যাপার হল, আগত ঈসা সম্পর্কে সহীহ বুখারীর (কিতাবুল আম্বিয়া অধ্যায়) হাদীসে রাসূল (সা.) ভবিষ্যৎবাণীতে কসম বাক্য সহকারে و الذى نفسى بيده ليوشكن ان ينزل فيكم ابن مريم (শপথ সে সত্তার যাঁর মুঠোয় আমার প্রাণ নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে মরিয়ম পুত্র নাযিল হবেন) শব্দচয়নে সংবাদ দেয়ার উল্লেখ রয়েছে। জেনে আশ্চর্য হবেন যে, মির্যা গোলাম আহমদের ভাষ্যমতে ‘যেসব হাদীসে কসম বাক্য সহ কোনো বিষয়ে সংবাদ দেয়া হবে সেটি কখনো রূপক অর্থে উদ্দেশ্য হবেনা, বরং প্রকৃত অর্থেই হবে।’ (মির্যা কাদিয়ানী রচিত, হামামাতুল বুশরা, বাংলা পৃ-২৭ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং মির্যা গোলাম আহমদের কথা অনুসারেও হাদীসে উল্লিখিত ‘ইবনু মরিয়ম’ হতে রূপক ইবনু মরিয়ম উদ্দেশ্য হওয়ার কথা নয়! সত্যানুরাগী কাদিয়ানীদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে!

হামামাতুল বুশরা পৃ-২৭; মির্যা গোলাম আহমদ
শায়খ ইবনুল আরাবী (রহ.) লিখেছেন, আগমনকারী ঈসা যখন নাযিল হবেন তখন তিনি তার পূর্বের শরীয়ত নিয়ে আসবেন না, যা আল্লাহ বনী ইসরাইলের নির্দেশনার জন্য তাঁর প্রতি অবতীর্ণ করেছিলেন! (ফতুহাতে মাক্কিয়্যা খ-২ পৃ-৩)।

একটি সংশয় নিরসন :

মুসলিম শরীফের ‘كتاب الفتن و اشراط الساعة’ অধ্যায়ে ঈসা নাবিউল্লাহ শীর্ষক হাদীসটি প্রায় দুই পৃষ্ঠাব্যাপী। হাদীসটিতে হযরত ঈসা (আ:) ফেরেশতার মাধ্যমে দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে শুভ্র মিনারার নিকটে অবতরণ করার কথাও উল্লেখ আছে। তিনি ইয়াজুজ আর মাজুজ গোষ্ঠীর অনিষ্টতা থেকে আত্মরক্ষার্থে আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী তথা ইলহাম প্রাপ্ত হয়ে আপনা সঙ্গী সাথীদের সাথে নিয়ে তূর পর্বতমালার চূড়ায় উঠে যাবেন মর্মেও উল্লেখ আছে।

ফলে মহাসমুদ্র হতে একফোঁটা পানি তুলে নেয়ার মতই উক্ত সম্পূর্ণ হাদীসটির একটি মাত্র শব্দ ‘নাবিউল্লাহ’-এর আশ্রয় নিয়ে কাদিয়ানীরা মির্যা গোলাম আহমদের ‘নবী’ দাবীর বৈধতা খোঁজার চেষ্টা করে, যেহেতু সে নিজেকে প্রতিশ্রুত মসীহ ঈসা দাবীও করেছে। অথচ তার মসীহ ঈসা দাবীটাই একটি উদ্ভট দাবী। ইসলামে কথিত রূপক মসীহ ঈসার কোনো ধারণাই নেই। মজার ব্যাপার হল, সে নিজেও লিখেছে যে, ‘আমার মসীহ দাবীর ভিত্তি কোনো হাদীস নয়।’ (রূহানী খাযায়েন ১৯/১৪০)। মুসলিম শরীফের নাবিউল্লাহ শীর্ষক সম্পূর্ণ হাদীসটি অর্থ সহ এখানে।

ওহী শব্দের আভিধানিক অর্থগুলো সম্পর্কে :

ওহী শব্দটি কখনো সখনো ‘ইলহাম’ (আল্লাহর পক্ষ হতে অন্তরে কোনো বিষয়ে ইলক্বা বা প্রক্ষেপণ) অর্থেও হয়ে থাকে। এধরণের ইলহাম আ’ম বা সাধারণ, নবুওয়তের দায়িত্বে সমাসীন নন—এমন পুরুষদের ক্ষেত্রে তো বটে; এমনকি আল্লাহ’র যে কোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। (দেখুন পবিত্র কুরআন ১৬:৬৮; ২০:৩৮; ২৮:০৭)। মজার ব্যাপার, মির্যা কাদিয়ানী তার ‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ (বাংলা) বইয়ের ৬২ নং পৃষ্ঠায় তদীয় শিষ্য সাহেবজাদা আব্দুল লতিফ ওহীর ভিত্তিতেও কথা বলতেন বলেই লিখে গেছেন (স্ক্রিনশট দেখুন)। কাদিয়ানীদের জিজ্ঞেস করা উচিত যে, তো এখানে এই ‘ওহী’ বলতে কী উদ্দেশ্য? নিশ্চয়ই ‘ওহীয়ে নবুওয়ত’ উদ্দেশ্য নয়! সুতরাং উক্ত হাদীসেও ঈসা (আ:) এর প্রতি যে ‘ওহী’ হবে বলা হয়েছে তদ্দ্বারাও ‘ওহীয়ে নবুওয়ত’ (الوحى النبوة) উদ্দেশ্য নয়, বরং ‘ওহীয়ে বেলায়ত’ (الوحى الولايت) তথা ইলহাম-ই উদ্দেশ্য।

মির্যা কাদিয়ানীর বই

মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়ত দাবী তারই বই থেকে :

কে জানি প্রশ্ন করেছিল যে, ওহীর আরেক অর্থ যেহেতু ইলহাম (অন্তরে প্রক্ষেপণ) সেহেতু মির্যা গোলাম আহমদ এর ওহী দাবীর ফলে তিনিও কিজন্য সমালোচনার পাত্র হবেন এবং ইসলাম থেকে খারিজ বলে গণ্য হবেন? এর উত্তর হল, মির্যা গোলাম আহমদ এর ওহী দাবী সাধারণ ওহীর পর্যায়ভুক্ত ছিলনা, বরং ওহীয়ে নবুওয়তেরই পর্যায়ভুক্ত ছিল। তাই তার ওহী দাবী আর অন্যান্য সাধারণ ওহী (ইলহাম) দুটো এক নয়। যেমন সে এক জায়গায় লিখেছে, ‘মোটকথা আমি মুহাম্মদ ও আহমদ (সা.) হওয়ার কারণে আমার নবুওয়ত ও রেসালত লাভ হয়েছে, স্বকীয়তায় নয়, ফানাফির রসূল হয়ে…।’ (দেখুন, একটি ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নং ৫)।

ঈসা (আ:) এর প্রতি ওহী করা সম্পর্কে আরেকটু খোলাসা :

কাদিয়ানীদের পক্ষ হতে কখনো সখনো এধরণের প্রশ্নও করা হয় যে, ঈসা (আ:) দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর যদি তিনি পুনরায় নবী না হন, তবে কিজন্য তাঁর প্রতি ওহী করার কথা উল্লেখ আছে? এর জবাব হচ্ছে, আপনি হয়ত “ওহী” শব্দের আক্ষরিক অর্থ আরো কী কী আছে সে সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই রাখেন না। হাদীসটিতে এ মর্মে বাক্যটি কিভাবে আছে লক্ষ্য করুন, إِذْ أَوْحَى اللَّهُ إلى عِيسَى (ইয আওহাল্লাহু ইলা ঈসা) অর্থাৎ…. ইত্যবসরে আল্লাহতালা ঈসার প্রতি ওহী করবেন….। এখানে ক্রিয়াপদ “আওহা” (أوحى) এসেছে। এর বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে। ‘ওহী করা’ কিংবা ‘ইলহাম বা ইলক্বা (অন্তরে প্রক্ষেপণ)‘ ইত্যাদী সবই তার অর্থ বহন করে।

  • এই সম্পর্কে আমার নিজের একটি ভিডিও দেখুন, হাদীসে “ঈসা নাবিউল্লাহ” চার চার বার এসেছে, এইরূপ জালিয়াতিমূলক বয়ান দেয়ায় কাদিয়ানী আমীরের ইজ্জত শেষ! ভিডিও

তবে হাদীসটিতে শেষোক্ত অর্থই ধর্তব্য হবে এ জন্যই যে, এখানে প্রথমোক্ত অর্থটি উদ্দেশ্য নেয়া পূর্ব থেকে পরিত্যাজ্য। কারণ প্রতীক্ষিত ঈসা (আঃ) ‘নবুওতি ওহী‘র দ্বার ভাঙ্গতে আসবেন না, বরং শরীয়তে মুহাম্মদীর তাবলীগ করতে আসবেন। হাদীসটির অবিকল “আওহা” শব্দটি পবিত্র কুরআনেরও বহু স্থানে গায়রে নবীদের জন্য এসেছে যার একটিতেও তদ্দ্বারা “নবুওয়তি-ওহী” অর্থ কেউ নেয়নি। এমন কি কাদিয়ানী সম্প্রদায়ও নেয় না। যেমন পবিত্র কুরআনের সূরা আন নাহল এর ৬৮ নং আয়াত দেখুন। সেখানে মৌমাছির প্রতিও ওহী পাঠানোর কথা আছে। তো এর দ্বারা আপনি শেষোক্ত অর্থ বাদ দিয়ে কি প্রথমোক্ত অর্থ নেবেন? মৌমাছিকেও “নবী” বানাবেন? মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, اَوۡحٰی رَبُّکَ اِلَی النَّحۡلِ اَنِ اتَّخِذِیۡ مِنَ الۡجِبَالِ بُیُوۡتًا وَّ مِنَ الشَّجَرِ وَ مِمَّا یَعۡرِشُوۡنَ অর্থ- ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে ওহী (প্রত্যাদেশ) করেছেন যে, তুমি গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।’ (সূরা আন নাহল ৬৮)। তাফসীরের কিতাবে আয়াতটির ওহী (وحي) শব্দকে ইলহাম অর্থে ব্যাখ্যা দিয়ে লিখা আছে যে, এখানে ওহী থেকে ‘ইলহাম’ (অন্তরে প্রক্ষেপণ) বা এমন জ্ঞান-বুদ্ধি যা নিজ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য প্রত্যেক জীবকে দান করা হয়েছে। (আহসানুল বয়ান)।

এভাবে আরো দেখুন সূরা ক্বাছাছ, আয়াত নাম্বার ৭ এবং সূরা ত্বাহা, আয়াত নাম্বার ৩৮; পবিত্র কুরআন খুলে দেখুন সবখানে “আওহা” শব্দ পাবেন। কিন্তু সবাই এ থেকে অর্থ নিয়েছেন “ইলহাম করেছেন”। সুতরাং উক্ত হাদীসেও এ একই অর্থ ধরে নিতে হবে। তখন আর কোনো সন্দেহ জাগবেনা। ওয়াল্লাহু আ’লাম। আল্লাহ সবাইকে ভ্রান্তি থেকে বের করে শেষনবী মুহাম্মদে আরাবীর উম্মতে শামিল হওয়ার তাওফিক দিন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কাদিয়ানীরা যেসব হাদীস দেখিয়ে ঈসা (আ:)-কে মৃত দাবী করে

0

ঈসা (আ:) সম্পর্কিত কাদিয়ানীদের উদ্ধৃত ৫টি হাদীসের জবাব :

১. ইহুদী-নাসারাগণ তাদের নবীগণের কবর-সমূহকে সেজদার স্থলে পরিণত করা… প্রসঙ্গে (এপিসোড-১) :

প্রশ্নকর্তা, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, অভিশাপ সেসব ইহুদী নাসারার প্রতি। যারা তাদের নবীগণের কবরগুলোও সেজদার স্থলে পরিণত করেছিল। এখন এর দ্বারা ঈসা (আ.)ও একজন কবর-পথযাত্রী মৃত সাব্যস্ত হল না?

উত্তরতাদা, প্রশ্নকারী হয়ত জানেই না যে, উল্লিখিত হাদীস সহীহ বুখারীতে সংক্ষিপ্তাকারে এলেও সহীহ মুসলিম শরীফ, মসনাদে আহমদ, মু’জামুল কাবীর এবং তাবারানী প্রভৃতিগ্রন্থে আরেকটু বিস্তারিত উল্লেখ আছে। যদ্দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, বনী ইসরাইলী সম্প্রদায় তাদের নবীগণের কবরগুলো তো বটে, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্য হতে পুন্যবান ব্যক্তিদের কবরগুলোও সেজদার স্থলে পরিণত করেছিল। তাই সবগুলো বর্ণনাকে সামনে রেখে বিশিষ্ট যুগ-ইমাম আল্লামা জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী (রহ.) হাদীসটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে,

  • “রাসূল (সা.) যখন মৃত্যুশয্যায় নিপতিত হন তখন তিনি আপন মুখের উপর একখানা চাদর দিয়ে রাখলেন পরে যখন খারাপ লাগল তখন তা চেহারা মুবারক হতে সরিয়ে দিলেন এবং তিনি এ অবস্থায় বললেন, ‘ইহুদী আর নাসারা জাতির উপর আল্লাহ’র অভিশাপ। কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সেজদার স্থলে পরিণত করেছে’।” (সহীহ বুখারী)।

হাদীসটিতে ‘নাসারা’ (ঈসায়ী) শব্দ উল্লেখ থাকায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, তবে কি ঈসা (আ.)ও মৃত্যুবরণ করেছেন? আর যেহেতু নাসারাদের একমাত্র নবী ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেননি, তাই এর জবাব হল, হাদীসে ইহুদী এবং নাসারা সম্পর্কে ‘নবী’ শব্দের বহুবচন أنبياء (আম্বিয়া) উল্লেখ থাকায় আরও বেশি কৌতূহল জাগে! যেহেতু (নাসারা-ধর্মে একজন ছাড়া) আর কেউই নবী ছিলেননা। যেমন ঈসা (আ:)-এর শিষ্যগণ এবং হযরত মরিয়ম সিদ্দিকা প্রমুখ। কাজেই (এখানে ‘আম্বিয়া’/انبياء শব্দের পর ‘ছলেহীন’/صَالِحين শব্দ ঊহ্য মেনে) ‘নবীগণ’ দ্বারা যথাক্রমে ইহুদীদের নবীগণ আর (ছলেহীন থেকে) নাসারাদের অনুসৃত পুন্যবান ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য নিতে হবে। মুসলিম শরীফের একখানা হাদীস হতে ব্যাখ্যাটির সমর্থনে জোরালো ইংগিত পাওয়া যায়। হাদীসটি এই যে, হযরত জুনদুব (রা.) হতে বর্ণিত আছে, كانوا يتخذون قبورَ أنبيائِهم وصَالِحِيْهِمْ مَسَاجِدَ অর্থাৎ তোমাদের পূর্ববর্তীরা তাদের নবীগণের এবং নেককার ব্যক্তিদের কবরগুলোকে সেজদার স্থলে পরিণত করেছিলো।” (তথ্যসূত্রঃ শরহে সুয়ূতী লি-সুনানে নাসায়ী, কিতাবুল মাসাজিদ; আরো দেখুন, ফাতহুল বারী, কিতাবুস সালাত; হাদীস নং ৪৩৭)। {এই প্রশ্নটির দ্বিতীয় উত্তর পড়ুন}।

আফসোস! কাদিয়ানীরা মুসলিম শরীফের হাদীসটির এই অংশটিকে কৌশলে এড়িয়ে যায় এবং সহীহ বুখারীর উল্লিখিত হাদীসের একতরফা বাহ্যিক অর্থে নিজেরা তো ধোকা খায়, অন্যকেও একই ধোকা দেয়ার চেষ্টা করে। অধিকন্তু রাসূল (সা:) থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণিত আছে ان عيسى لم يمت অর্থাৎ “নিশ্চয়ই ঈসা (আ:) মৃত্যুবরণ করেননি।” (তাফসীরে তাবারী ৫/৪৪৮; দুররে মানছূর ২/৬৪)। নির্বোধদের কি জানা নেই যে, রাসূল (সা.)-এর সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসগুলোয় কখনো বৈপরীত্য নেই। অথচ কাদিয়ানীদের একতরফা মতলবি-দলিল নেয়া হলে তখন হাদীসগুলোয় চরম বৈপরীত্য দেখা দেবে, যা কখনো কোনো উম্মতে মুহাম্মদীর পক্ষে বরদাশত করার মত নয়। সংক্ষেপে।

২. যদি মূসা এবং ঈসা জীবিত থাকত তাহলে তাদের উভয়ের জন্য আমার আনুগত্য করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা :

উত্তর এখানে

৩. ঈসা (আ.) একশত বিশ বছর জীবন-যাপন করা :

প্রশ্নকর্তা : ঈসা (আ:) (ইহ-জাগতিক) একশত বিশ বছর জীবন যাপনকরা মর্মে রেওয়ায়েতটির তাহকিক এবং তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তরদাতা : প্রথমত, হাদীসশাস্ত্রের প্রায় সকল স্কলারই বলে গেছেন, এর সনদ অর্থাৎ সূত্র দুর্বল (ফাতহুল বারী শরহে বুখারী ৬/৩৮৪)। ইমাম বুখারী (রহ.) তার বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে উসমান সম্পর্কে স্পষ্টই বলে গেছেন : لا يكاد يتابع فى حديثه অর্থাৎ তার বর্ণনা অনুসরণ করার মত কোনো গ্রহণযোগ্যতাই তার নেই।’ (আস-সিলসিলাতুয য’য়ীফাহ ৯/৪২৫; ক্রমিক নং ৪৪৩৪)। ইমাম ইবনে আসাকীর (রহ.) এ সম্পর্কে মন্তব্য করে লিখেছেন : সঠিক হচ্ছে, হযরত ঈসা (আ.) এইরূপ বয়সে পৌঁছেননি। (তারিখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৮২)। ইমাম নূরউদ্দিন আল-হাইছামী (রহ.) বলেছেন : رواه الطبرانى باسناد ضعيف অর্থাৎ ইমাম তাবারানী এটি দুর্বল সূত্রে এনেছেন (মাজমা’উয যাওয়ায়েদ, ক্রমিক নং ১৪২৪৫)।

দ্বিতীয়ত, বর্ণনাটির ‘আ’শা’ (عَاشَ) শব্দের অর্থ ‘জীবিত বা বেঁচে থাকা’ নয়। খুব ভালোভাবে খেয়াল করলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে (হাদীসের আরবী ইবারত) ان عيسى ابن مريم عاش عشرين و مائة سنة (অর্থাৎ নিশ্চয়ই ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) একশত বিশবছর (ইহ-জাগতিক) জীবন যাপন করেছিলেন) হাদীসটির عَاشَ শব্দের অর্থ অভিধানে ‘বেঁচে থাকা, জীবনযাপন করা, জীবিকা নির্বাহ করা’ রয়েছে। তাই হাদীসটির সঠিক তাৎপর্য এটাই দাঁড়ায় যে, ঈসা (আ:)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার আগে তিনি পৃথিবীতে একশত বিশবছর (ইহ-জাগতিক) জীবন যাপন করেছিলেন। এখন হয়ত আপনি ভাবছেন যে, ওম্মা আকাশটাই না যেন ভেঙ্গে পড়লো মাথার উপর! জ্বী হ্যাঁ, আশ্চার্য হবার কিছু নেই; সত্য এটাই! কিন্তু আফসোস! খোদাদ্রোহী, সত্যগোপনকারী যারা তারা হাদীসের শব্দের অর্থ উলোটপালোট করে দরাকে সরা বানিয়েছে। তাই সাধারণ যে কেউই তাদের এই সমস্ত ভুল অনুবাদ অত:পর অপব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে।

আরো বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন।

৪. হাদীসেও মুহাম্মদ (সা.) এবং ঈসা (আ.) দুইজনের জন্যই ‘ফা-লাম্মা তাওয়াফ্ফাইতানী’ শব্দ উল্লেখ থাকা :

প্রশ্নকর্তা : হাদীস শরীফে মুহাম্মদে আরাবী (সা:) আর ঈসা (আ:) দু’জনের ক্ষেত্রেই কিন্তু ‘ফা-লাম্মা তাওয়াফ্ফাইতানী’ শব্দ উল্লেখ আছে। তাহলে দুই স্থানে দুইরকম অর্থ কেন?

জবাবদাতা : হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীসটির উদ্দিষ্ট অংশের মর্মার্থ হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন আমি সেই সময় অর্থাৎ কেয়ামত দিবসে অনুরূপ বলব যেরূপ আল্লাহর নেক বান্দা ঈসাও বলবেন : ‘অতপর যখন তুমি আমাকে নিয়ে নিলে (তখন) তুমিই ছিলে তাদের (উম্মতে মুহাম্মদীয়া) উপর একক নেগাহ্বান।’ (সংক্ষেপে)। দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, ইসলাম সম্পর্কে যাদের নূন্যতম জ্ঞান আছে তারাও বুঝতে পারে যে, ঈসা (আ:)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে প্রশ্নকারীর উল্লিখিত যুক্তি একদমই ঠিক না। কারণ প্রশ্নকারী জানেনই না যে ‘তাওয়াফ্ফা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিয়ে নেয়া। যেমন حتى يتوفهن الموت (সূরা নিসা, আয়াত ১৫ দ্রষ্টব্য)। যদিও বা শব্দটি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ক্বারীনার বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন অর্থ প্রদান করবে। আর তাই রাসূল (সা:) এর ক্ষেত্রে উপরিউক্ত হাদীসের توفى শব্দটি ক্বারীনার কারণে রূপক অর্থে মৃত্যু বুঝালেও ঈসা (আ:)-এর ক্ষেত্রে সেটি অসংখ্য ক্বারীনার বিচারে সশরীরে উঠিয়ে নেয়াই বুঝাবে।

মির্যা কাদিয়ানীর বইতেও توفى শব্দের ভিন্ন ভিন্ন ৬ ধরণের অর্থ পাওয়া যায়। সেই অর্থগুলো হচ্ছে ‘পরিপূর্ণ নেয়ামত দান করা’ (১:৬২০); ‘পরিপূর্ণ পুরষ্কার দেয়া’ (১:৬৬৪-৬৫); ‘অপমানকর ও অভিশপ্ত মৃত্যু হতে রক্ষাকরা’ (১২:২৩); ‘জন্মগ্রহণকরা’ (১৯:৪৯) ইত্যাদী। সব কয়টি জায়গাতেই তারই কৃত ঊসূল-মতে ‘কর্তা আল্লাহ্ আর কর্ম প্রাণী’ই রয়েছে। এখন পবিত্র কুরআন আর হাদীসে توفيتنى একই রকম হয়েছে বলে আপনারা যারা একই অর্থ নেয়ার যুক্তি দিচ্ছেন তারা এর কী উত্তর দেবেন?

দ্বিতীয়ত, আলোচ্য হাদীসটির হুবহু ‘তাওয়াফ্ফাইতানী’ শব্দটি আয়াতেও উল্লেখ থাকায় যদি মনে করেন যে, ঈসা (আ:) এর توفي আর রাসূল (সা:)-এর توفي মর্মের দিক থেকে হুবহু একই হওয়া যুক্তিক; তাহলে বিরাট ভুল করবেন। তার কারণ, আপনারা যে হাদীসটি নিজেদের মতের পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করছেন সেটি হযরত সাঈদ ইবনু জুবায়ের (রহ:) এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) উনাদের সূত্রেই কিন্তু বর্ণিত হয়েছে। আর উনাদের দুইজনই বিশ্বাস করতেন, হযরত ঈসা (আ:) সশরীরে আকাশে জীবিত।

মূলকথা হল, আজরাইল (আ:)-এর মাধ্যমে তুলে নেয়া আর জিবরাইল (আ:)-এর মাধ্যমে তুলে নেয়ার তাৎপর্য কিন্তু এক নয়। রাসূল (সা:)-এর তুলে নেয়ার ঘটনা মালাকুল মউত হযরত আজরাইল (আ:)-এর মাধ্যমে ঘটেছিল। তাই এর অর্থ মৃত্যুর মাধ্যমে শুধু রূহ তুলে নেয়া উদ্দেশ্য আর ঈসা (আ:)-এর তুলে নেয়ার ঘটনা রূহুল কুদস হযরত জিবরাইল (আ:)-এর মাধ্যমে ঘটেছিল। পবিত্র কুরআনেও এর ইংগিত রয়েছে। দেখুন اذ ايدتك بروح القدس অর্থ—স্মরণ কর, যখন রূহুল কুদস (জিবরাইল)-এর মাধ্যমে আমি তোমাকে শক্তিশালী (সুদৃঢ়) করেছিলাম। (সূরা মায়েদা ১১০)। এর সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে একাধিক সহীহ হাদীসে। যেমন রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন : ‘লাম্মা ইজতামা’আল ইয়াহূদু আ’লা ঈসা আলাইহিস সালাম লি-ইয়াকতুলূহু ওয়া আতা-হু জিবরাইলু…ফা-আওহাল্লা-হু ইলা জিবরাইলা আন ইরফা ইলাইয়্যা আ’বদী’। অর্থাৎ যখন ইহুদীরা ঈসা (আ:)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে সমবেত হলো তখন জিবরাইল (আ:) তাঁর নিকট আগমন করেন…আল্লাহতালা তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার বান্দা (ঈসা)-কে আমার নিকট তুলে নিয়ে এসো।’ (তারীখে দামেস্ক ৪৭/৪৭২; তারীখে বাগদাদ ১১/৩৭৯)। স্ক্রিনশট :-

তারীখে দামেস্ক ৪৭/৪৭২

ঈসা (আ.)-কে রাফা করা হয়েছিল, মানে সশরীরে ও জীবিত আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। এর সমর্থনে আরো কিছু প্রমাণ উল্লেখ করছি। (১) رفع كان ابن اثنتين و ثلاثين سنة و ستة اشهر অর্থ—তাঁকে বত্রিশ বছর ছয় মাস বয়সে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল (আত তবকাতুল কাবীর লি ইবনে সা’আদ, ১/৩৬; ইবনে আব্বাস থেকে)। (২) رفع عيسى من روزننة فى البيت الى السماء অর্থ—ঈসাকে বাড়ীর বাতায়ন পথে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, হাফিয ইবনে কাসীর; ইবনে আব্বাস থেকে)। (৩) হযরত সাঈদ ইবনে জোবায়ের তিনি ইবনে আব্বাস থেকে, রাসূল (সা.) বলেছেন, لما اراد الله ان يرفع عيسى الى السماء خرج على اصحابه الخ অর্থ—যখন আল্লাহতালা ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নিতে চাইলেন সে মুহূর্তে তিনি তার হাওয়ারীদের নিকট গমন করলেন…! (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হাদীস নং ৩১৮৭৬, ইমাম নাসাঈ হাদীসটি عن ابى كريب عن ابى معاوية به نحوه এইরূপ সূত্রে রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম হাফিয ইবনে কাসীর (রহ.) তার ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ কিতাবে উদ্ধৃত করে লিখেছেন و هذا اسناد صحيح الى ابن عباس على شرط مسلم অর্থ—ইবনে আব্বাস পর্যন্ত এই সনদটি সহীহ, মুসলিম শরীফের কর্ত শর্তেই সহীহ। আরও দেখুন, আল ফাতহুর রব্বানী খ-২০/পৃ-১৪১। সংক্ষেপে।

তাই ঈসা (আ:)-এর ‘তুলে নেয়া’ জীবিত ও সশরীরে হওয়াই উদ্দেশ্য। সুতরাং বুঝা গেল ‘তাওয়াফফা’ শব্দটি নির্দিষ্ট কোনো অর্থের জন্য খাস নয়। আবার সব জায়গায় তার একটি মাত্র অর্থ নেয়াও আইন-সিদ্ধ নয়। আশাকরি জবাব পেয়েছেন।

৫. হাদীস শরীফে ঈসা (আ:)-কে চার চার বার ‘নাবীউল্লাহ’ বলা প্রসঙ্গে :

প্রশ্নকর্তা : মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে আগমনকারী মসীহকে ‘নাবিউল্লাহ’ (অর্থাৎ আল্লাহর নবী) সম্বোধন করা হয়েছে। মির্যা সাহেবই যখন সেই মসীহ হবার দাবীদার তখন তিনি কিজন্য ‘নবী’ হবেন না?

উত্তর এখানে

কাদিয়ানীদের ভ্রান্ত মতবাদের খন্ডন সম্পর্কে ‘মারকায উমর ডট অর্গ’ – ওয়েবসাইটের গুরুত্বপূর্ণ লিংক :- (৪টি ক্যাটাগরিতে) Click

মির্যা কাদিয়ানী “নবী রাসূল” দাবী করার স্ক্রিনশটসহ ডকুমেন্ট এখানে Click

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ