Home Blog Page 30

যেকোনো একটা মাযহাবের পরিপূর্ণ অনুসরণ করার যৌক্তিকতা

যেকোনো একটা মাযহাবের পরিপূর্ণ অনুসরণ করার যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে :

পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলিম মুফতি তারিক মাসউদ একটি চমৎকার ঘটনা বলেছেন। তিনি তাঁর লম্বা বয়ানের এক স্থানে বলেছেন :

তারেক মাসউদ হাফিঃ

“এক লোক স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে আমার কাছে এসে জানতে চাইল, -‘মুফতি সাহেব, স্ত্রীকে একত্রে তিন তালাক দিলে কি তিন তালাক হয়?’

আমি বললাম, ‘জ্বি, হয়ে যায়।’

-‘কিন্তু, সৌদি আরবের বড় আলেম বিন বায রহ. তো বলেছেন, ‘হয় না’। তিনি তো কুরআন-সুন্নাহর আলোকেই বলেছেন।’

-‘আপনি সাহাবীদের আমল, আইম্মায়ে আরবা’আর সর্বসম্মত মত ও ইজমার সাথে শাইখ বিন বায রহ.-এর মতের তুলনা করছেন! তিনি অবশ্যই বড় আলেম ছিলেন; তবে এক্ষেত্রে তিনি বিচ্ছিন্ন অভিমত দিয়েছেন। এমন বিচ্ছিন্ন অভিমত অনুসরণীয় নয়।’

-‘না. না… না… তিনি তো কুরআন-সুন্নাহর আলোকেই ফাতওয়া দিয়েছেন। আমি শুধু কুরআন-সুন্নাহ মানি।’

-‘ঠিক আছে। আপনি যদি বিন বায রহ. এর এই বিচ্ছিন্ন ফতোয়া মানেন তাহলে শায়খের আরেকটা ফাতওয়া আছে। ওটাও মানুন। শাখ বিন বায রহ. বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় এক ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দেয় তাহলে সে কাফির-মুরতাদ হয়ে যায়। স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যায়।’ এটাও মানবেন আশা করি।’

‘না, না। এটা ঠিক না…।’

তখন আমি বললাম, ‘আপনি মাঝে মাঝে নামায ছেড়ে দেন। শায়খ বিন বায রহ. এর ওই ফতোয়া মানলে তো পৃথিবীর কোনো নারীর সাথেই আপনার বিয়ে টিকবে না। কাজেই কারো কথা এক মাসআলায় মানবেন, অন্য মাসআলায় মানবেন না। এর নাম ইসলাম নয়।”

সংগ্রহীত

কুরআন ও হাদীসের আলোকে হযরত ইদ্রিস (আ:) এর মৃত্যু কোথায় হয়েছিল?

কুরআন ও হাদীসের আলোকে হযরত ইদ্রিস (আ:) এর মৃত্যু কোথায় হয়েছিল?

এই যে দেখতে পাচ্ছেন এটা কি জানেন? এটি বিখ্যাত যুগ ইমাম ও মুফাসসির বরেণ্য মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী (রহ:)-এর সংকলিত ‘তাফসীর’ তাফসীরে জালালাইন এর একটি পৃষ্ঠা (অনলাইন ভার্সন)।

তাফসীরে জালালাইন (আল কুরআন /১৯:৫৭)।

যাইহোক, আজ হযরত ইদ্রিস (আ:) সম্পর্কে কিছু লিখব। কেননা সূরা মরিয়ম আয়াত নং ৫৭ এর ‘রাফা‘ শব্দ নিয়েও কাদিয়ানীরা দুরভিসন্ধিমূলক কতেক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়ে যায়। আজ অতিব সংক্ষেপে সেটির খন্ডন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

প্রথমেই ইদ্রিস (আ:)-এর অন্যতম কতেক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানুন। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত হলো আল্লাহর তরফ থেকে আসা ঐশী বাণী যা হযরত ইদ্রিস (আ:)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রথম বিকাশ ঘটে। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম ব্যক্তি আল্লাহ যাঁকে ‘ওয়া রাফা’নাহু মাকা-নান আলিয়্যা’ বলে আকাশে স্বশরীরে জীবিত উঠিয়ে নেয়ার কথা পবিত্র কুরআনে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি ছাড়াও পরবর্তীতে আল্লাহতালা যথাক্রমে হযরত ঈসা (আ:)-কে ক্রুশীয় ঘটনাকালে এবং শেষনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেরাজের ঘটনাকালে স্বশরীরে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন।

হযরত ইদ্রিস (আ:)-এর আলোচনা আসলেই গণিতবিদ্যা আর জ্যোতির্বিদ্যার প্রসঙ্গ অটোমেটিকেলি সামনে চলে আসে। যদিও বা উক্ত শিক্ষাদুটিকে আজকাল কেউ কেউ অবজ্ঞা করেন। এসব আসলে তাদের অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। আপনারা হয়তো অনেকেই হযরত ইদ্রিস (আ:) এর নাম পর্যন্ত শোনেননি বা চিনেন না জানেন না। তাই গণিতের জন্মকথা বলার আগে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের আলোকে হযরত ইদ্রিস (আ:)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের কিছুটা তুলে ধরছি।

সূরা মরিয়মে উল্লেখ করা হয়েছে : “এই গ্রন্থে উল্লেখিত ইদ্রিসের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, সে ছিল সত্যবাদী নবী। আমি তাঁকে সুউচ্চে তুলে নিয়েছি।” এই আয়াতের তাফসীর থেকে জানা যায়, এখানে ইদ্রিস (আ:)-এর কথা বর্ণনা করা হয়েছে; তিনি ছিলেন একজন সত্যনবী এবং আল্লাহ তাআলার একজন বিশিষ্ট বান্দা। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুউচ্চে তুলে নিয়েছেন।

হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছে, মেরাজ গমনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সাথে হযরত ইদ্রিস (আ:)-এর সাক্ষাত ঘটেছিল। এ নিয়ে ইমাম ইবনে জারীর (রহ:) একটি অতি বিস্ময়কর হাদীস তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস (রা:) কা’আব ( রা:)-কে “ওয়া রাফা’নাহু মাকা-নান আলিয়্যা” (وَّ رَفَعۡنٰہُ مَکَانًا عَلِیًّا)- আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন: “আল্লাহ তা’আলা হযরত ইদ্রিস (আ:)-কে ওহী করেন – ‘আদম সন্তানের আমলের সমান তোমার একার আমল আমি প্রতিদিন উঠিয়ে থাকি। কাজেই আমি পছন্দ করি যে, তোমার আমল বৃদ্ধি পাক।’ অতঃপর তাঁর নিকট একজন বন্ধু ফেরেশতা আগমন করলে তিনি তাঁর কাছে বলেন – ‘আমার নিকট ওহী এসেছে; অতএব আপনি মৃত্যুর ফেরেশতাকে বলে দিন তিনি যেন একটু দেরি করে আমার জান কবজ করেন, যাতে আমার আমল বৃদ্ধি পায়।” তারপর ওই বন্ধু ফেরেশতা তখন তাঁকে নিজের পালকের উপর বসিয়ে নিয়ে আকাশে উঠে যান এবং চতুর্থ আসমানে গিয়ে মালাকুল মাউত অর্থাৎ হযরত আজরাইল ফেরেশতার সাক্ষাত পান। ওই ফেরেশতা মালাকুল মাউত ফেরেশতাকে হযরত ইদ্রিস (আ:)-এর ব্যাপারে সুপারিশ করলে মৃত্যুর ফেরেশতা বন্ধু ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করেন, “তিনি কোথায় আছেন?” উত্তরে বন্ধু ফেরেশতা বলেন, “এই তো তিনি আমার পালকের উপর বসে আছেন।”

মৃত্যুর ফেরেশতা তখন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “সুবহানাল্লাহ! আমাকে এখনই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেন ইদ্রিস (আ:)-এর রূহ চতুর্থ আসমান থেকে কবজ করি। কিন্তু আমি চিন্তা করছিলাম – ইদ্রিস (আ:) তো আছেন জমিনে, চতুর্থ আসমান থেকে তাঁর রূহ কবজ করবো কিভাবে?” অতঃপর তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর ফেরেশতা হযরত ইদ্রিস (আ:)-এর রূহ কবজ করে নেন।

উক্ত রেওয়ায়েতটিই অন্য এক সনদে এভাবে এসেছে – হযরত ইদ্রিস (আ:) বন্ধু ফেরেশতার মাধ্যমে মালাকুল মাউত ফেরেশতাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, “আমার হায়াত আর কত দিন বাকী আছে?” অন্য আরেক হাদীসে আছে তাঁর এই প্রশ্নের উত্তরে মালাকুল মাউত বলেছিলেন, “আমি লক্ষ্য করছি, চক্ষুর একটা পলক ফেলার সময় মাত্র বাকী আছে।” বন্ধু ফেরেশতা তাঁর পলকের নিচে তৎক্ষণাৎ তাকিয়ে দেখেন, হযরত ইদ্রিস (আ:)-এর জান এরই মধ্যে কবজ করা হয়ে গেছে।

হযরত মুজাহিদ (রহ:) বলেন – হযরত ইদ্রিস (আ:)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, তিনি [জমিনে] মৃত্যুবরণ করেননি, বরং তাঁকে হযরত ঈসা (আ:)-এর মতো জীবিত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আউফী (রহ:)-এর রেওয়ায়েতের মাধ্যমে ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত আছে – হযরত ইদ্রিস (আ:)-কে ষষ্ঠ আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল, আর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

ইমাম জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী এবং ইবনে কাসীর এই দু’জনের মতামত কী?

ইমাম সুয়ুতি (রহ:) এর মতও পবিত্র কুরআনের (১৯:৫৭) অনুসারে হযরত ইদ্রিস (আ:)-কে চতুর্থ আকাশে স্বশরীরে উঠিয়ে নেয়ার কথাই বুঝানো উদ্দেশ্য। তবে কারো কারো মতে, ষষ্ঠ বা সপ্তম আকাশে উঠিয়ে নেয়ার কথাও এসেছে। আল্লাহতায়ালা তাকে সেখানেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন অতপর তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। ইমাম ইবনে কাসীর (রহ:) হতেও অনুরূপ মত রয়েছে। ইমাম ইবনে কাসীর (রহ:) লিখেছেন : (আল কুরআন /১৯:৫৭) ‘আমরা তাঁকে উন্নীত করেছিলাম সুউচ্চ স্থানে অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা ইদ্রিস আলাইহিস সালামকে সুউচ্চ স্থানে উঠিয়ে নিয়েছেন এর উদ্দেশ্য এই যে, তাঁকে উচ্চ স্থান তথা আকাশে অবস্থান করার ব্যবস্থা করেছেন (তাফসীরে ইবন কাসীর)। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যখন আমাকে আকাশে উঠানো হয়েছিল মেরাজের রাত্ৰিতে আমি ইদ্রিসকে চতুর্থ আসমানে দেখেছি।” (তিরমিয়ী : ৩১৫৭)। তবে ইবনে কাসীর (রহ:) এই সম্পর্কে বলেছেন : এটা কা’আব আল-আহবারের ইসরাঈলী বৰ্ণনাগুলোর অন্যতম। সম্ভবত এইজন্যই কেউ কেউ আয়াতটির ‘স্বশরীরে উঠিয়ে নেয়া’র ভিন্ন অর্থ—তাঁকে উঁচু স্থান জান্নাতে দেয়া হয়েছে অথবা তাঁকে নবুওয়ত ও রিসালাত দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে, উদ্দেশ্য নিয়েছেন। যাইহোক, উদ্দেশ্য যে কোনোটাই হতে পারে। তবে আকাশে স্বশরীরে উঠিয়ে নেয়ার পক্ষেই ক্বারীনা বা ইংগিত শক্তিশালী। কেননা আয়াতের ‘রাফা’ এমন একটি সকর্মক ক্রিয়াপদ যার ‘কর্ম‘ বা Object (ه/ادريس) সত্তাবাচক। যেজন্য তাফসীরকারকদের বেশিরভাগই মনে করেন যে, এখানে রাফা শব্দটি রূপক কোনো অর্থকে (মর্যাদা উন্নীত করা বা নবুওয়ত ও রিসালত দ্বারা সম্মান বৃদ্ধি করা) বুঝাবেনা।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

মির্যা কাদিয়ানীর গালিগালাজ

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কি গালিগালাজও করত?

নীতিবাক্য : মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী লিখেছেন, কোনো খারাপ কথা মুখে আনা আমার স্বভাব পরিপন্থি। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ৪/৩২০) তিনি তার রচনায় এও দাবী করে লিখেছেন, আল্লাহ তা’আলা তাকে নাকি সুন্দর চরিত্র দিয়ে পাঠিয়েছেন। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১৭/৪২৬)।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির সৃষ্ট কাদিয়ানীদের কথিত মসীহ ও মাহদীর রচনা

মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের গালিগালাজ :

অথচ মানুষকে গালিগালাজের যে লম্বা তালিকা মির্যা সাহেব তার বই-পুস্তকে রেখে গেছেন তা সত্যিই একজন ভদ্র মানুষের ক্ষেত্রে ভাবা কঠিন। কোনো নবী রাসূল তো দূরের কথা, ন্যূনতম একজন সৎ এবং ভদ্র মানুষের জন্যও তা কল্পনা করা যায় না। নমুনা স্বরূপ কয়েকটি দেখুন :

১. খানকীর ছেলে। (রূহানী খাযায়েন ৫/৫৪৮)।
২. মিথ্যার গু খাদক। (রূহানী খাযায়েন১১/৩৩৪)।
৩. কুত্তা। (রূহানী খাযায়েন ১২/১২৮)।
৪. হিন্দুর বাচ্চা। (রূহানী খাযায়েন ১১/৫৯)।
৫. শুয়োর। (রূহানী খাযায়েন ১১/৩৩৭)।
৬. বেশ্যার বংশ। (রূহানী খাযায়েন ৮/১৬৩)।
৭. হে মরা খাওয়া মওলভী। (রূহানী খাযায়েন ১১/৩০৫)।
৮. আঁধারের কীট। (রূহানী খাযায়েন ১১/৩০৫)।
৯. হে নাপাক দাজ্জাল। (রূহানী খাযায়েন ১১/৩৩০)।
১০। হে পেঁচা। (রূহানী খাযায়েন ২১/৩৩২)।
১১. নাপাক মোল্লারা। (রূহানী খাযায়েন ১৪/৪১৩)।
১৫. নিকৃষ্ট নাপাক। (রূহানী খাযায়েন ১৪/৪১৩)।
১৬. হারাম-জাদাহ। (রূহানী খাযায়েন ৯/৩১)।
১৭. শুয়োরের চেয়ে বেশি নাপাক। (রূহানী খাযায়েন১১/৩০৫)।
১৮. খান্নাস। (রূহানী খাযায়েন ১১/১৭ [টিকা] দ্র.)
১৯. দুনিয়ার কীট। (রূহানী খাযায়েন ২১/৩১১)।
২০. তাদের উপর হাজার লা’নত। (রূহানী খাযায়েন ১১/৩৩০)।
২১. বিশ্বাসঘাতক। (রূহানী খাযায়েন ১৯/১৯০)।

মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের গালিগুলো কাদেরকে উদ্দেশ্যে করে?

মির্যা কাদিয়ানী সাহেব এই গালিগুলোর অধিকাংশই আলেম-উলামাদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়েছেন। তার সমকালীন সময়ে ইলমে দ্বীনের আলোচিত খাদেম, উম্মতের আস্থাভাজন কোনো আলেমই মির্যা সাহেবের এ কুরুচিপূর্ণ গালিগালাজ থেকে বাঁচতে পারেননি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মির্যা সাহেব তৎকালীন দখলদার ব্রিটিশের মত জালিম স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো কথা বলেছেন বা তাদের গালি দিয়েছেন বলে কোনোই দৃষ্টান্ত নেই।

দখলদার ব্রিটিশ সরকার সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর অভিব্যক্তি :

মির্যা সাহেব নিজেই লিখেছেন, আমার কথার মধ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কখনও কোনো বক্তব্য থাকবে না। আমরা এ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। কেননা আমরা তার কাছে আরাম ও শান্তি পাই। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২৩/৪৮৪)।

আরো লিখেছেন, আমার শিরা-উপশিরায় ব্রিটিশ সরকারের কৃতজ্ঞতা বহমান। (রূহানী খাযায়েন ৬/৩৭৮)।

তিনি আরও লিখেছেন, আমার জীবনের অধিকাংশই অতিবাহিত হয়েছে ব্রিটিশ সরকারকে সুদৃঢ় আর সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে। (রূহানী খাযায়েন ১৫/১৫৫-৫৬)। চিন্তার বিষয় যে, আল্লাহ যাকে ইমাম মাহদী করে পাঠাবেন তার জীবনের অধিকাংশই নাকি সমসাময়িককালীন এমন একটি সরকারের সহযোগিতায় অতিবাহিত হবে যেই সরকার খ্রিস্টান এবং স্বৈরাচারী! ভাবিয়ে তুলে কিনা? স্ক্রিনশট দেখুন।

তিনি আরও লিখেছেন, ব্রিটিশ সরকার তোমাদের জন্য রহমত ও বরকত স্বরূপ। (মজমু’আয়ে ইশতিহারাত ২/৭০৯)।

তিনি আরও লিখেছেন, ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য ইসলামেরই একটি অংশ। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০)। স্ক্রিনশট দেখুন

রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০

তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অজ্ঞ, নোংরা ও পাপী ইত্যাদি শব্দে কটুক্তি করে গেছেন। (দেখুন, বারাহীনে আহমদিয়া বাংলা অনূদিত ৩/৮; প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০১৭ ইং)। স্ক্রিনশট দেখুন

তিনি নিজেকে সুস্পষ্টভাবে ব্রিটিশ সরকারের রোপিত চারাগাছ বলেও স্বহস্তে লিখে গেছেন। দেখুন, মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত (উর্দূ) ৩/২১-২২, নতুন এডিশন। সংক্ষেপে দু’চারটে কথা লিখলাম। নতুবা এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। স্ক্রিনশট দেখুন

কী বুঝলাম?

বুঝলাম যে, মির্যা কাদিয়ানী মূলত ব্রিটিশ সরকারেরই সৃষ্ট। ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এবং জিহাদকে নিষ্প্রভ করার জন্যই তারা তাকে দাঁড় করিয়েছিল । যেজন্য তাকে প্রথমে ইমাম মাহদী অতপর প্রতিশ্রুত মসীহ ঈসা হওয়ার দাবী করতে হয়েছে। কেননা সে ভালো করেই জানত যে, জিহাদ নিষ্প্রভ করার ঘোষণা দিতে হলে তাকে একই সাথে মসীহ দাবী করাও বাধ্যতামূলক। কারণ হাদীসে এসেছে, ওয়াইয়াদ্বা’উল হার্বু। অর্থাৎ মসীহ’র যুুুগে লড়াই স্থগিত হয়ে যাবে।

আশাকরি বুঝতেই পারছেন যে, ব্রিটিশরা খেলাটা কিভাবে খেলেছে! অথচ ইতিহাস সাক্ষী, কোনো রিফর্মার বা আল্লাহ প্রেরিত মহাপুরুষ তাদের সমসাময়িককালের স্বৈরশাসকদের কখনো অনুগত ছিলেননা, বরং আমৃত্যু তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়েছেন। আহ! কাদিয়ানী সম্প্রদায় এসব কেন যে ভেবে দেখেনা! উপরন্তু তারা মনে করছে, মির্যা কাদিয়ানীই মসীহ এবং একজন নবী! নাউযুবিল্লাহ।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

প্রতিশ্রুত ঈসা (আ:) দ্বিতীয়বার এসে হজ্জ্ব পালন করবেন

হযরত ঈসা (আ:) পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার এসে হজ্জ্ব করার উপর কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যমূলক আপত্তি উত্থাপন ও তার খন্ডন :

গুগোল ম্যাপের আলোকে —by Principal NurunNabi

প্রতিশ্রুত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) শেষযুগে পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার যখন আসবেন তখন তিনি হজ্জ্ব এবং উমরাহ পালন করবেন। সহীহ মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে রাসূল (সা:) হতে প্রতিশ্রুত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) সম্পর্কে এমনি ভবিষ্যৎবাণী উল্লেখ রয়েছে। (রেফারেন্স : সহীহ মুসলিম [হাঃ একাডেমী] হাদীস নং ২৯২০)।

বলাবাহুল্য যে, উল্লিখিত হাদীসে ঈসা (আ:)-এর শুধুই তালবিয়াহ্ পাঠ করা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে তিনি ইহরাম কোথা হতে বেঁধে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন সে সম্পর্কে কোনো কথারই উল্লেখ নেই। তবে বহু সহীহ হাদীস আর ভৌগোলিক বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা খুব জোরালোভাবে সাব্যস্ত হচ্ছে যে, ঈসা (আ:) দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে ও জেরুজালেমের নিকটবর্তী আফীক নামক পাহাড়ে আকাশ থেকে নাযিল হওয়ার পর যথাসময় ওখান থেকেই হজ্জ্বের ইহরাম বেঁধে মক্কার উদ্দেশ্যে (উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে) মদীনারই অন্তবর্তী এলাকা ‘রাওহা‘ উপত্যকায় কাফেলা সহ এসে পৌঁছুবেন। তারপর সেখান থেকে তালবিয়াহ পাঠ আরম্ভ করবেন। কেননা হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা:) নিজেও কখনো কখনো হজ্জ্ব আর উমরাহ করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে রাওহা উপত্যকায় নির্মিত ‘মসজিদে রাওহা’-তে অবতারণ করতেন। সেখান থেকেই তিনি ইহরাম ও তালবিয়াহ পাঠ আরম্ভ করে দিতেন। (ইমাম ইবনে জাওযীর ‘আলওয়াফা’ এর সূূত্রে উইকিপিডিয়া [আরবি])। অতএব, কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যমূলক সমুদয় আপত্তি পুরোপুরি অসার বলেই সাব্যস্ত হল ! (আল্লাহু আ’লাম)।

স্ক্রিনশট :

ঈসা (আ:) আকাশ থেকে ‘আফিক‘ নামক পাহাড়ে নাযিল হবেন। (কাঞ্জুল উম্মাল খন্ড ১৪ পৃষ্ঠা ৬১৯ দ্রষ্টব্য) ।

এক নজরে রাওহা’র ভৌগোলিক অবস্থান :

মক্কা হতে জেরুজালেম (দক্ষিণ -উত্তরে) দূরত্ব ১৪৭৮ কি:মি:| (চারচাকা গাড়ির গতিবেগে) সময় ১৫:৫৩/মি.।

মক্কা হতে রাওহা উপত্যকা (দক্ষিণ -উত্তরে) দূরত্ব ৩৪৬.৪ কি:মি:|সময় ০৩:২৩/মি.।

রাওহা উপত্যকা হতে মদীনা (দক্ষিণ -উত্তরে) দূরত্ব ১০৪ কি:মি:|সময় ০১:০৭/মি.।

মদীনা হতে জেরুজালেম তথা বায়তুল মুকাদ্দাস (দক্ষিণ -উত্তরে) দূরত্ব ১২০০ কি:মি:|সময় ১৩:১৫/মি.।

এখানে জানিয়ে দিতে চাই যে, হযরত ঈসা (আ:) যেই রাওহা উপত্যকার সন্নিকটবর্তী হয়ে হজ্জ্বের তালবিয়াহ পাঠ আরম্ভ করবেন বলে সহীহ মুসলিম শরীফে এসেছে, মক্কার কেন্দ্র থেকে সেটির দূরত্ব ৩৪৬.৪ কিলোমিটার আর রাওহা অঞ্চলের উত্তরের প্রান্তসীমা থেকে মদীনার কেন্দ্রের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। কারণ রাওহা উপত্যকা ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিস্তৃত এলাকা। (সূত্র : আধুনিক গুগোল ম্যাপ)। এবার হাদীসটি দেখুন :-

অধ্যায়ঃ ১৬। হজ্জ্ব (كتاب الحج); হাদিস নম্বর : ২৯২০

(আরবী) باب إِهْلاَلِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَهَدْيِهِ ‏ وَحَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ مَنْصُورٍ، وَعَمْرٌو النَّاقِدُ، وَزُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، جَمِيعًا عَنِ ابْنِ عُيَيْنَةَ، قَالَ سَعِيدٌ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ، حَدَّثَنِي الزُّهْرِيُّ، عَنْ حَنْظَلَةَ الأَسْلَمِيِّ، قَالَ سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ، رضى الله عنه يُحَدِّثُ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَيُهِلَّنَّ ابْنُ مَرْيَمَ بِفَجِّ الرَّوْحَاءِ حَاجًّا أَوْ مُعْتَمِرًا أَوْ لَيَثْنِيَنَّهُمَا

২৯২০-(২১৬/১২৫২) সাঈদ ইবনু মানসূর, আমর আন নাকিদ ও যুহায়র ইবনু হারব (রহ:) …… আবু হোরায়রাহ (রা:) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ:) নিশ্চিত রাওহা উপত্যকায় হজ্জ্ব (হাজ্জ/হজ)  অথবা উমরাহ অথবা উভয়ের তালবিয়াহ্ পাঠ করবেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২৮৯৬, ইসলামীক সেন্টার ২৮৯৫)।

ফুটনোট :

এখানে দুটো প্রশ্ন থাকে :-

প্রশ্ন ১ :

রাওহা উপত্যকা কোথায়? সাহাবীদের যুগেও রাওহা উপত্যকা হতে হজ্জ্ব বা উমরাহ এর জন্য তাদের তালবিয়াহ্ পাঠকরার দৃষ্টান্ত আছে কি?

জবাবে বলা হবে যে, ‘রাওহা‘ এটি মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ২৫ কিলোমিটার বিস্তৃত মদীনারই একটি উপত্যকা। উইকিপিডিয়া (আরবী) দ্রষ্টব্য। ফলে এটি ‘যুল-হুলাইফাহ’ নামক মীকাতের ভুগৌলিক সীমানারই অন্তর্ভুক্ত। ইমাম বুখারী’র শায়খের শায়খ ‘মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা’ (রহ:) তিনি হযরত ইয়াকুব ইবনে যায়েদ (রা:) হতে বর্ণনা করেছেন : كان اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم لايبلغون الروحاء حتى تبح اصواتهم من التلبية অর্থ : রাসূল (সা:)-এর সাহাবীরা ‘রাওহা’ উপত্যকায় পৌঁছার আগ পর্যন্ত উচ্চাওয়াজে তালবিয়াহ্ পাঠ করতেন না। (মুসান্নাফ ইবেন আবী শাইবা ৩/৩৭২; হাদীস নং ১৫০৫১)। অতএব, সাহাবীদের যুগেও রাওহা উপত্যকা হতে হজ্জ্ব বা উমরাহ এর জন্য তাদের তালবিয়াহ্ পাঠকরার দৃষ্টান্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেল এবং হাদীসটির ন্যায় উক্ত হাদীস ঈসা (আ:) এর হজ্জ্বের তালাবিয়াহ্ পাঠের স্থান সম্পর্কেও জানান দিলো।

স্ক্রিনশট :

উইকিপিডিয়া (আরবী) এর স্ক্রিনশট

প্রশ্ন ২ :

সহীহ বুখারীর কিতাবুল হাজ্জ্ব পর্বে হজ্জ্বের মীকাত মাত্র ৪টির উল্লেখ আছে। সেখানে মদীনার সীমান্তবর্তী যে কোনো হজ্জ্ব পালনকারীর ইহরামের ক্ষেত্রে ‘যুল-হুলাইফা’ নামক মীকাতের বর্ণনা এসেছে। অর্থাৎ যুল-হুলাইফা নামক স্থান অতিক্রম করার আগেই ইহরাম বাঁধা আবশ্যক যেভাবে আমাদের বাংলাদেশীরা এয়ারপোর্ট থেকে ইহরাম অবস্থায় ‘ইয়ালামলাম‘ নামক মীকাত অতিক্রম করে থাকে। তো ঈসা (আ:) রাওহা উপত্যকা হতে তালবিয়াহ্ পাঠ আরম্ভ করবেন বুঝলাম কিন্তু উনার মীকাত হিসেবে ওই চারখানা মীকাতের কোনটি ধর্তব্য হবে?

জবাবে বলব, আর যেহেতু ‘রাওহা’ উপত্যকা ‘যুল-হুলাইফাহ’ নামক মীকাতের ভুগৌলিক সীমানারই অন্তর্ভুক্ত হওয়াই প্রমাণিত সেহেতু হযরত ঈসা (আ:)-এর জন্য ওই স্থান থেকেই হজ্জ্বের তালবিয়াহ্ পাঠ করা প্রকারান্তরে ‘যুল-হুলাইফাহ’ থেকেই ইহরাম সহ তালবিয়াহ্ পাঠ করার নামান্তর। সুতরাং কাদিয়ানীদের দৃষ্টিতে সহীহ বুখারীর উক্ত মীকাত শীর্ষক হাদীসের সাথে মুসলিম শরীফের উল্লিখিত হাদীসের বৈপরীত্য থাকার যেই আপত্তি উত্থাপন করা হয় তজ্জন্য মূলত ‘রাওহা‘ এর ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে তাদের চরম অজ্ঞতা কিংবা মতলবসিদ্ধ অসৎ উদ্দেশ্যই দায়ী! আশাকরি উত্তর পেয়েছেন।

মির্যা কাদিয়ানীর প্রকৃত পরিচয় Click

কাদিয়ানীদের জন্য দুঃসংবাদ :

কাদিয়ানীদের জন্য দুঃসংবাদ যে, উক্ত হাদীসটি ‘কসম’ সহ বর্ণিত হওয়ায় তার সংবাদটি বাহ্যিক অর্থেই পূর্ণ হবে এর রূপক অর্থ করা যাবেনা। অন্যথা কসম করে কী লাভ হল? মির্যা কাদিয়ানী থেকেও ‘কসম’ সম্বলিত হাদীস সম্পর্কে অনুরূপ মতই উল্লেখ আছে। (দেখুন, হামামাতুল বুশরা [বাংলা] পৃষ্ঠা নং ২৭)।

শেষকথা : ভারতীয় বংশোদ্ভূত নবুওয়তের দাবীদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকেই ইমাম মাহদী এবং প্রতিশ্রুত ঈসা ইবনে মরিয়ম হওয়ার দাবীও করেছিল। তার অনুসারিরা তাকে একজন রূপক মসীহ বলেও বিশ্বাস করে। অথচ মির্যা কাদিয়ানী জীবনে কখনো হজ্জ্ব বা উমরাহ কোনোটাই করতে পারেনি। আমরা যদি সহীহ মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হাদীসটির মানদণ্ডেও মির্যাকে পরিমাপ করতে চাই তাতেও যথেষ্ট হবে যে, হাদীসে বর্ণিত প্রতিশ্রুত সেই মসীহ ঈসা আর যেই হবেনা কেন—সে অন্তত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হতে পারেনা!! বিষয়টি তার অনুসারীদের অবশ্যই ভাবিয়ে তুলতে সাহায্য করবে, ইনশাআল্লাহ।

স্ক্রিনশট :

মির্যা কাদিয়ানীর ভাগ্যে জীবনে কোনোদিন হজ্জ্ব, উমরাহ, যাকাত, ইতিকাফ করা সম্ভব হয়নি। দেখুন তারই পুত্র মির্যা বশির আহমদ এম.এ রচিত মির্যার জীবনীগ্রন্থ ‘সীরাতে মাহদী‘ খন্ড নং ৩, রেওয়ায়েত নং ৬৭২

পরিশেষে রাসূল (সা:) এর সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎবাণীটি আপনাদের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দিতে চাই যে, রাসূল (সা:) ঈসা (আ:) সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন : নিশ্চয়ই ঈসা মৃত্যুবরণ করেননি। নিশ্চয়ই তিনি কেয়ামতের পূর্বে তোমাদের নিকট ফিরে আসবেন। (তাফসীরে তাবারী, ৫/৪৪৮)।

স্ক্রিনশট :

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কোন ফেরকার ইসলামে ফিরে আসব—কাদিয়ানীদের প্রশ্নের উত্তর

কাদিয়ানীদের প্রশ্নের উত্তর : কোন ফেরকার ইসলামে ফিরে আসব?

কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন : কাদিয়ানীয়ত ছেড়ে কোন ইসলামে ফিরে যেতে চান? শীয়া, সুন্নী, হানাফী, মালেকী…..দেওবন্দী, বেরলবী….ইত্যাদী কোন ফেরকার ইসলামে ফিরে গেলে সঠিক ইসলামে ফিরে যাওয়া হবে?

আমার উত্তর : (পিকচারটি দ্রষ্টব্য)।

প্রথমকথা হল, মনে করুন কাদিয়ানীয়ত ছেড়ে কেউ এদের যে কোনাে একটিতে চলে গেল! অন্ততপক্ষে তাতেও তার ঈমানটা বাঁচবে, ইনশাআল্লাহ। কেননা সে মুহাম্মদ (সা:)-এর পরে দ্বিতীয় আর কাউকে নবী মেনে নেয়া থেকে রক্ষা পেল। ফলে তার আমলের দুর্বলতার কারণে সাময়িক শান্তি ভােগ করলেও একটি সময় ঈমানের কারণে সে নাজাত পাবে।

দ্বিতীয়কথা হল, প্রশ্নে বর্ণিত নামগুলাের মধ্যে শীয়া হল ইসলামের একটি পুরনাে ফেরকা। তাদের বিচারে তারাও সঠিক। বিপরীতে অন্যগুলাের মধ্যে হানাফী শাফেয়ী মালেকী আর হাম্বলী এই চারটি ভিন্ন ভিন্ন কোনাে ফেরকাই নয়, বরং ফিকহি মাসয়ালায় চারজন বিশিষ্ট ফকিহ ও মুজতাহিদ ইমামের চারটি ফিকহ (মাযহাব) বা গবেষণালব্ধ বুঝের দালিলিক ভিন্নতা মাত্র। মূলত কুরআন হাদীসের আলােকে পরিপূর্ণ চলার পথ-ই এককথায় মাযহাব’। সামগ্রিক বিচারে চারোে মাযহাবই আহলে সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। তারপর আহলে হাদীস, চরমােনাই, জামাতে ইসলামী ইত্যাদী এগুলাের কোনাে কোনােটি রাজনৈতিক দল আবার কোনােটি পীর মুরশিদি তরিকা, কোনাে কোনােটি মানহাজ মাত্র; আলাদা কোনাে ফেরকা নয়। যেহেতু ফেরকা, মানহাজ, পলিটিকাল পার্টি ও মাযহাব এগুলাে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস।

কাদিয়ানীদের নিকট আমার প্রশ্ন হল, আপনারা অন্যদের মত যদি ইসলামী কোনাে ফেরকা কিংবা আহলে সুন্নাহর অন্তর্গত কোনাে মুসলিম সংগঠন হয়ে থাকেন তাহলে মির্যা কাদিয়ানীও কলেমা’র মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র মর্মার্থে শামিল—এমন কুফুরী কথাও আপনাদের ‘কালিমাতুল ফছল’ বইতে উল্লেখ থাকবে কেন? কিংবা মির্যা কাদিয়ানীকে ত্যাগ করার দরুন কোনাে ব্যক্তি মুরতাদ আখ্যায়িত হবে কেন? তাই অপ্রিয় হলেও সত্য, সাধারণ কাদিয়ানীদের বুঝে আসুক বা না আসুক, সত্য এটাই যে, কাদিয়ানীয়ত নতুন একটি ধর্ম। ফলে এটি ইসলামের কোনাে ফেরকারই অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব যারা এখনাে এই দলের অন্তর্ভুক্ত আছেন তাদের উচিৎ, আমার কথাগুলাে নিজ দায়িত্বে ও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যাচাই করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা। আল্লাহতালা সবাইকে বুঝার তাওফিক দিন।

কাদিয়ানীদের কলেমায় ‘মুহাম্মদ‘ শব্দের তাৎপর্য:

কালিমাতুল ফছল (ষষ্ঠ অধ্যায়) অনলাইন ভার্সন
কাদিয়ানীদের কলেমার গোপন তথ্য নিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট করার পর তারা প্রতিউত্তর স্বরূপ যেই পোস্ট করেছিল সেটির স্ক্রিনশট পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হল। নিচে ঐ পোস্টের লিংক দেয়া হল!

ক্লিক করুন

কাদিয়ানী সংগঠন ত্যাগকারী কিংবা মির্যা কাদিয়ানীকে অমান্যকারী ‘মুরতাদ’ ও অমুসলিম হিসেবে আখ্যায়িত :

মির্যা কাদিয়ানীর রচিত ‘হাকীকাতুল ওহী’ ১৩০ (বাংলা অনূদিত)

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

বাইবেলে কি ‘ইলিয়া’ নামের কারো পুনঃআগমনের সংবাদ রয়েছে?

কথিত ইলিয়া (ইলিয়াস) থেকে ইউহান্না (ইয়াহিয়া) উদ্দেশ্য?

কাদিয়ানীঃ বাইবেলে উল্লেখ আছে, বনী ইসরাইলের পূর্বেকার বহু নবী ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে বলেছেন, মাসীহ মওঊদ ততক্ষণ পর্যন্ত আগমন করবেন না যতক্ষণ না “ইলিয়া” (ইলিয়াস) নামের একজন নবীর পুনঃআগমন হচ্ছে!

আমিঃ আচ্ছা, তারপর!

কাদিয়ানীঃ তারপর যখন মাসীহে মওঊদ হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) নবুওত দাবী করলেন তখন ইহুদী সম্প্রদায় এই বলে তা অস্বীকার করলো যে, আপনার পূর্বে তো “ইলিয়া” (ইলিয়াস) নামের একজন নবীর পুনঃ আগমন হওয়ার কথা! তিনি আসার আগে আপনি কিভাবে মাসীহ হন? মাসীহ’র আগে তো তাঁর আসার কথা!

আমিঃ আচ্ছা তারপর!

কাদিয়ানীঃ তারপর মাসীহে মওঊদ হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) বললেন, ইলিয়া তো এসে গেছেন! ইউহান্না তথা ইয়াহিয়া (আঃ) এর প্রতি ইংগিত করে ঈসা (আঃ) বললেন, ইনি-ই সেই ইলিয়া! যার আসার কথা তিনি এসে গেছেন! 

(ইঞ্জিল মথি, অধ্যায় ১১, আয়াত ১৩-১৫; অধ্যায় ১৭, আয়াত ১০-১৩ দ্রষ্টব্য) 

উল্লেখ্য,  সাধারণভাবে মনে করা হয়, মথি লিখিত সুসমাচারটি হিব্রু বা আরামিক ভাষায় সন্ত মথির দ্বারা প্রথমে লিখিত হয়েছিল ও পরে গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। কিন্তু কোথাও লেখক দাবি করেননি যে, তিনি কোনো ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। অধিকাংশ গবেষকের মতে, মথি-লিখিত সুসমাচার রচিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর শেষ ভাগে। অর্থাৎ, এটি দ্বিতীয় প্রজন্মের খ্রিস্টানদের রচনা। (উইকিপিডিয়া, সাধু মথি লিখিত সুসমাচার দ্রষ্টব্য)   

আমিঃ কিন্তু এসব জেনে আমার কী লাভ? 

কাদিয়ানীঃ বুঝেননি!! ওই যে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী যাকে আপনারা ভন্ডনবী বলেন; অথচ আমরা তাঁকে হাদীসে বর্ণিত প্রতিশ্রুত সেই মাসীহে মওঊদ বলেই বিশ্বাস করি! কারণ বাইবেলে যেমন “ইলিয়া” নবীর পুনঃআগমন এর কথা থাকা সত্ত্বেও তাঁর স্থলে ইউহান্না অর্থাৎ যোহনকে-ই “ইলিয়া” আখ্যা দেয়া হয়েছিল ঠিক তেমনি হাদীস শরীফে বনী ইসরাইলী যেই ঈসা আকাশ থেকে আসার ভবিষ্যৎবাণী এসেছে তদ্দ্বারা মূলত ভারতের কাদিয়ান গ্রামের মির্যা গোলাম আহমদ-ই উদ্দেশ্য। অতএব যার আসার কথা তিনি এসে গেছেন!

আমিঃ ও আচ্ছা, তাই নাকি? তার মানে আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন, যেই ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) এর পুনঃ আগমনের ভবিষ্যৎবাণী হাদীসে আছে সেই ঈসা বলতে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী!?

কাদিয়ানীঃ জ্বী হ্যাঁ।

আমিঃ আচ্ছা, ওই যে ইলিয়া আর ইউহান্না আরো যা যা বললেন—একথাগুলো বাইবেল (ইঞ্জিল) কিবা আগের যুগের কিতাবগুলো ছাড়া আমাদের কুরআন হাদীসের কোথাও আছে কিনা?

কাদিয়ানীঃ না নেই, এগুলো শুধুমাত্র বাইবেলের নতুন নিয়মে (New Testament) রয়েছে।

আমিঃ যদি তাই হয়, তাহলে তো আমাদের মুসলমানদের নিকট এসমস্ত গল্পের কানাকড়িও মূল্য থাকার কথা না! আফসোস! আপনি নিজেকে মুসলমান দাবী করেন আবার বাইবেলকেও দলিল মানেন! লোকমুখে শুনতাম, কাদিয়ানিরা ইহুদী খ্রিস্টানের জাত-ভাই, আর এখন তো প্রমাণ-ই পেলাম!

কাদিয়ানীঃ কেন, বাইবেলের রেফারেন্স কী অগ্রহণযোগ্য? বাইবেল কি ঐশী গ্রন্থ ছিল না?

আমিঃ এই প্রশ্ন আমাকে না করে বরং আপনার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে করুন। কেননা তিনি নিজেও লিখেছেন غرض یہ چاروں انجیلیں جو یونانی سے ترجمہ ہو کر اس ملک میں پہیلائی جاتی ہیں ایک ذرہ بہی قابل اعتبار نہیں۔ تریاق القلوب (অর্থাৎ মোটকথা হচ্ছে এই চারো ইঞ্জিল [বাইবেল পুরাতন বা নতুন নিয়ম–অনুবাদক] যা ইউনানি (গ্রীস) ভাষায় অনুবাদ হয়ে এই রাজ্যে প্রচারিত হয়েছে এগুলো এক অণু পরিমাণ-ও গ্রহনযোগ্য নয়)। দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৫/১৪২।

মির্যা কাদিয়ানী সাহেব আরেক জায়গায় আর-ও লিখেছেন بلکہ سچ تو یہ بات ہے کہ وہ کتابیں آنحضرت صلی اللہ علیہ و سلم کے زمانہ تک ردی کی طرح ہو چکی تہیں اور بہت سے جہوٹ ان میں ملائے گئے تہے جیساکہ قرآن شریف فرمایا گیا ہے کہ وہ کتابیں محرف مبدل ہیں اور اپنی اصلیت پر قائم نہیں رہیں۔ چشمہ معرفت  (অর্থাৎ বরং সত্যকথা তো এটাই যে, এ সমস্ত কিতাব [আগের ঐশীগ্রন্থ গুলো–অনুবাদক] হুজুর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ পর্যন্ত নষ্ট বস্তুতে পরিণত ছিল এবং প্রচুর মিথ্যা তাতে মিশ্রিত ছিল। যেমনটা কুরআন শরীফে বলা হয়েছে যে, এ সমস্ত কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তিত এবং আপনা মৌলিকত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়)। দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২৩/২৬৬)। স্ক্রিনশট দেখুন।

মির্যা সাহেবের বক্তব্যের সারাংশ হচ্ছে, (১) ইঞ্জিলের যতগুলো কপি রয়েছে তার একটির-ও অণু পরিমাণ গ্রহনযোগ্যতা নেই। (২) এগুলো রাসূল (সাঃ) এর যুগ পর্যন্ত নষ্ট আর অকেজো বস্তুতে পরিণত ছিল। (৩) এগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটেছে। (৪) কুরআন শরীফ দ্বারাও প্রমাণ আছে যে, এই কিতাবগুলোতে বিকৃতি আর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। (৫) এই কিতাব গুলো মৌলিকত্বের উপর অক্ষুণ্ণ থাকেনি ইত্যাদি।

এমতাবস্থায় আপনার ওই সব ইলিয়া কিবা ইউহান্না টাইপের কেচ্ছা কাহিনীর সত্যতার গ্যারান্টি কোথায়? এমন একটি অগ্রহণযোগ্য ও বিকৃত সোর্সের উপর ডিফেন্স করে আমি কিভাবে আমার নবী মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ)-এর ভবিষ্যৎবাণীকে বেঁকিয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারি?

কাদিয়ানীঃ (পুরোই লা-জবাব!) হুম!

আমিঃ এরপরও যদি বলেন যে, ইলিয়া হতে ইউহান্না-ই উদ্দেশ্য কিবা বাইবেলের উক্ত গল্প সঠিক তখন আপনার নিকট নিচের প্রশ্নগুলোর আদৌ কোনো জবাব থাকবে না।

(১) ইউহান্না অর্থাৎ যোহনের ইঞ্জিল এর  মধ্যে পরিস্কার উল্লেখ আছে, সে সময়ের জেরুজালেম এর নেতৃস্থানীয় ইহুদীরা ইউহান্না’র নিকট কতিপয় ভবিষ্যদ্বক্তাসহ লোকজন প্রেরণ করেছিলেন এই মর্মে যে, ইউহান্না-ই সেই প্রতিশ্রুত ‘ইলিয়া‘ কিংবা ‘মাসীহ‘ কিনা—তা যেন খোদ ইউহান্না’র মুখ থেকেই জেনে আসেন। তাই ইউহান্নাকে যখন প্রশ্ন করা হল তখন তিনি পরিস্কার করে জানিয়ে দিলেন যে ‘আমি (ইউহান্না) সেই প্রতিশ্রুত মাসীহ নই’। তারা তাঁকে আরো জিজ্ঞেস করলো, তাহলে আপনি কে?  ইলিয়া? ইউহান্না উত্তরে বললেন : না, আমি তা-ও নই। (রেফারেন্স : ইউহান্না’র ইঞ্জিল ১ম অধ্যায়, আয়াত ১৯-২১)। উল্লেখ্য, ইউহান্না আর যোহন একই জিনিস। প্রমাণের জন্য স্ক্রিনশট দেখুন!

বাইবেল নতুন নিয়ম

এবার ইউহান্না তিনি যে ইলিয়া (ইলিয়াস নবী) হওয়া অস্বীকার করতেন সে কথা মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের বই থেকে জেনে নিন! মির্যা সাহেবের পুস্তক “নুসরাতুল হক্ব” এর মধ্যে লিখা আছে اور عجیب یہ ہے کہ یوحنا اپنے الیاس ہونے سے خود منکر ہے۔ مگر تا ہم یسوع ابن مریم نے زبردستی اسکو الیاس ٹہراہی دیا۔ نصرة الحق অর্থাৎ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ইউহান্না (তথা যোহন) নিজেও ইলিয়াস অর্থাৎ ইলিয়া হওয়া অস্বীকার করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসোয়া তথা ঈসা ইবনে মরিয়ম জবরদস্তির সাথে তাঁকে ইলিয়া আখ্যা দেন।’ দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২১/৪২-৪৩।

ইউহান্না তথা যোহনের ইঞ্জিল আর মির্যা সাহেবের ‘নুসরাতুল হক্ব’ দুটির বক্তব্যের সার-সংক্ষেপ হল, ঈসা (আঃ) ইউহান্নাকে ইলিয়া আখ্যা দিলে ইউহান্না নিজে “ইলিয়া” হওয়া অস্বীকার করেন। ফলে অর্থ দাঁড়াল, ঈসা (আঃ) আপনা কথায় সত্যবাদী হলে তখন ইউহান্না হয়ে যান মিথ্যাবাদী আর যদি ইউহান্না সত্যবাদী হন তাহলে ঈসা (আঃ) হয়ে যান মিথ্যাবাদী! (নাউযুবিল্লাহ)। তো এবার নিরপেক্ষতার সাথে ভেবে দেখুন,  বাইবেলের গল্পটি সঠিক হলে তখন উক্ত দুইজনের যে কোনো একজন নিশ্চিত মিথ্যাবাদী হয়ে যাচ্ছেন কিনা? শুধুমাত্র একবার চিন্তা করে  দেখুন, এমন একটি বিকৃত ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য সোর্সের উপর ভিত্তি করে  ‘ইলিয়া আর ইউহান্না’ গল্পে কিভাবে ঈমান রাখতে পারেন যার পরিণতিতে আল্লাহ’র মনোনীত কোনো না কোনো পয়গাম্বরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে হচ্ছে? অথচ এই প্রসঙ্গে আমি জীবনেও যদি কথা না বলি, তবুও আল্লাহ আমাকে কেয়ামতের দিন এজন্য পাকড়াও করবেন না।           

(২) তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে, ইউহান্না তিনি নিজেকে “ইলিয়া” হওয়া অস্বীকার করেননি, বরং স্বীকার করেছেন যে তিনি-ই ইলিয়া। তা সত্ত্বেও সেটির উপর কিয়াস করে মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ) এর হাদীসকে তাবীল (ব্যাখ্যা) করে ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম’ বলতে “রূপক ঈসা” এর ধারণা কোনোমতেই ঠিক হবেনা। কারণ, “ইলিয়া” এর দ্বিতীয় আগমন সম্পর্কে বনী ইসরাইলের পূর্বেকার নবীদের ভবিষ্যৎবাণীতে “শপথ বাক্য” এর উল্লেখ নেই।

অপরদিকে   হাদীস শরীফে নুযূলে ঈসার বর্ণনায় “শপথ বাক্য” এর উল্লেখ আছে। এ সম্পর্কে মির্যা সাহেবের বক্তব্য নিম্নরূপ-

মির্যা সাহেব ‘হামামাতুল বুশরা’ (মূলগ্রন্থ) এর ১৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন “শপথ (কসম করে কিছু বলা) একথারই প্রমাণ বহন করে যে, নিশ্চয়ই খবর বা হাদীসটি জাহেরি (আক্ষরিক) অর্থই বুঝাবে। সেখানে কোনো তাবীল (ব্যাখ্যা) চলবে না, ব্যতিক্রম মর্মার্থ নেয়াও চলবেনা। নচেৎ শপথ করে লাভ কী হল?”

এবার দেখা যাক, ঈসা (আঃ) এর নুযূল হওয়া সম্পর্কে সহীহ বুখারী’র কিতাবুল আম্বিয়া-তে হাদীসটি কেমন শব্দচয়নে এসেছে! রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ওয়াল্লাজী নাফসি বি-ইয়াদিহি অর্থাৎ সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ….অবশ্যই ইবনে মরিয়ম একজন ন্যায়পরায়ন শাসক হিসেবে নাযিল হবেন।

তাহলে এবার চিন্তা করার বিষয় যে, ঈসা (আঃ) এর দ্বিতীয়বারের আগমন সম্পর্কিত হাদীসে ‘শপথ’ বাক্যের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সেখানে তাবীল করে ‘রূপক ঈসা‘ এর ধারণা নেয়া কতটুকু গ্রহণযোগ্য? এটি খোদ মির্যা কাদিয়ানীর-ও নীতিবিরুদ্ধ নয় কি? এখানে কী জবাব? (সংক্ষেপে এ পর্যন্ত)।

কাদিয়ানীঃ হুম! আগে তো কখনো এই বিষয়গুলো ভাবিনি!!   

আমিঃ আমি সাহস করে সত্যটা তুলে ধরলাম মাত্র। এবার যাচাইবাচাই করে গ্রহণ করা কিবা এড়িয়ে যাওয়া যার যার ব্যাপার।

হাসবুনাল্লাহ নি’মাল ওয়াকিল নি’মাল মওলা ওয়া নি’মান নাছীর! আল্লাহ আপনাকে সুমতি দিন!

পবিত্র কুরআন দ্বারাও ঈসা (আ:) এখনো জীবিত থাকার প্রমাণ  Click

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক   

নবী ও রাসূল এর সংজ্ঞা ও কাদিয়ানীদের উচিত জবাব

নবী এবং রাসূল কি একই? কুরআন হাদীস এবং যুগ ইমামরা কী বলেছেন?

যারা মনে করেন যে, নবী আর রাসূল মূলতই অভিন্ন তাদের নিকট নিচের প্রশ্নগুলোর জবাব চাচ্ছি!

[১] পবিত্র কুরআনঃ সূরা হাজ্জ এর ৫২ নং আয়াতে আল্লাহতালা ইরশাদ করেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا إِذَا تَمَنَّى أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنسَخُ اللَّهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللَّهُ آيَاتِهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ অর্থাৎ আমি তোমার পূর্বে যে সমস্ত রাসূল এবং নবী প্রেরণ করিয়াছি, তাহাদের কেহ যখনই কিছু আকাঙ্ক্ষা করিয়াছে, তখনই শয়তান তাহার আকাঙ্ক্ষায় কিছু প্রক্ষিপ্ত করিয়াছে, কিন্তু শয়তান যাহা প্রক্ষিপ্ত করে আল্লাহ তাহা বিদূরিত করেন। অতপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহকে সু-প্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (অনুবাদ, ইফা হতে প্রকাশিত)।

আমার প্রশ্ন হল, নবী আর রাসূল যদি একই হত তাহলে আল্লাহতায়ালা কেন বললেন “রাসুল ওয়া লা নবী”? মানে তিনি “রাসূল” বলেই তো থেমে যেতে পারতেন! তারপর আবার “নবী” শব্দ কেন আনলেন? অথচ পবিত্র কুরআন সব ধরণের অনর্থক বর্ণনা ও দ্বিরুক্তি হতে পবিত্র!

[২] হাদীস শরীফঃ বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন [হাশরের কঠিন মুহূর্তে শাফায়াতের উদ্দেশ্যে সমস্ত হাশরবাসী হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকট শাফায়াতের জন্য যখন আসবেন তখনকার ঘটনা] হাদীসের খন্ডাংশ : فيأتون نوحا فيقولون يا نوح انت اول الرسل الى اهل الارض و سماك الله عبدا شكورا (উচ্চারণ) ফা ইয়া’তূনা নূহান ফা ইয়াকূলূনা ইয়া নূহুন আন্তা আউয়ালুর রুসুলি ইলা আহলিল আরদ্বি ওয়া সাম্মা-কাল্লাহু আব্দান শাকূরা।” অর্থাৎ… অতপর সমস্ত হাশরবাসী হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকট ছুটে আসবে। তারা এসে বলবে, হে নূহ! আপনি হলেন পৃথিবীতে প্রথম রাসূল। আল্লাহতায়ালা আপনার নাম রেখেছিলেন ‘একজন শুকরগুজার বান্দা’। (সহীহ বুখারীঃ কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীস নং ৩৩৪০)।

আমার প্রশ্ন হল, যদি নবী আর রাসূল একই হত তাহলে হযরত নূহ (আঃ)-কে হাশরবাসীরা কেন বলবেন انت اول الرسل (You are first messenger) অর্থাৎ আপনি প্রথম রাসূল! এর মানে কি তাহলে নূহ (আঃ)-ই প্রথম নবী? আপনারাও কি এটাই বুঝাতে চান? যদি তাই হয় তাহলে নূহ (আঃ)-এর পূর্বে গত হয়ে যাওয়া হযরত আদম (আঃ) এবং হযরত শীষ (আঃ) প্রমুখ এঁরা কি নবী ছিলেন না? অর্থাৎ আমার প্রশ্নটি হল, নূহ (আঃ)-ই প্রথম রাসূল মানে তিনিই প্রথম নবী—এই অর্থ হলে তখন আদম আর শীষ এঁদের কী হবে? ভাবিয়ে তুলে কিনা?

[৩] যুগশ্রেষ্ঠ ইমামঃ নবুওয়তের মিথ্যা দাবিদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ)-কে হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দীর একজন যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদ হিসেবেই মানতেন। (রেফারেন্স, আছলে মুছাফফা, উর্দু এশিশন ১/১৬২-৬৫ দ্রষ্টব্য, মির্যা খোদাবক্স কাদিয়ানী রচিত; প্রথম প্রকাশ ১৯০১ ইং; মহাসুসংবাদ পৃষ্ঠা নং ৪৪)। এবার শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) কী বলেছেন শুনুন :

রাসূল হলেন তিনি, যাঁকে অবিশ্বাসী কাফের সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর নবী হলেন তিনি যাঁকে এমন কোনো সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয় যারা পূর্বেকার রাসূলের শরীয়তে বিশ্বাসী। ফলে প্রেরিত এই পয়গম্বর তিনি তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেন এবং তাদের মধ্যকার সংঘটিত বিভেদগুলোর মীমাংসা করেন।” শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) এর বক্তব্যের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত হল। (মাজমু’আয়ে ফাতাওয়া লি-ইবনে তাইমিয়াহ)।

একটি প্রশ্ন ও তার জবাবঃ

আল্লাহতালা হযরত ইসমাইল (আঃ) সম্পর্কে ‘ওয়া কা-না রাসূলান নাবিয়্যা’ (আরবী: وَكَانَ رَسُولًا نَّبِيًّا ) বলে তাঁকে ‘রাসূল’ আখ্যা দিয়েছেন। অথচ তিনি নতুন কোনো শরিয়তি ওহীর বাহক ছিলেন না! তারপরেও তাকে ‘রাসুল’ বলল কেন?

উত্তর : উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলা হবে যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) কর্তৃক প্রচারিত শরীয়ত যদিও নতুন কোনো শরীয়ত ছিলনা, বরং এটি ইবরাহিমী শরীয়ত ছিল; কিন্তু তিনি যেই বনু জুরহাম সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের দিক থেকে তাঁর প্রচারিত শরীয়তে ইবরাহিমী নতুন ছিল; এমনকি তারা ইসমাইল (আঃ) এর মাধ্যমেই শরীয়তে ইবরাহিমী সম্পর্কে নতুনভাবে জ্ঞান লাভ করতে পেরেছিলো। তাই প্রত্যক্ষভাবে যদিও ঈসমাইল (আঃ) নতুন কোনো শরিয়তি ওহীর বাহক ছিলেন না কিন্তু পরোক্ষভাবে তিনি বনু জুরহামের নিকট একজন শরিয়তি ওহীর প্রচারকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত শাহ আশরাফ আলী থানভী-ও লিখেছেন,

“আল্লাহ’র যেই প্রেরিত পুরুষ তাঁর অনুসারীদের নিকট নতুন শরীয়ত পৌঁছান তাঁকে ‘রাসূল’ বলে। চাইত উক্ত শরীয়ত রাসূলের দিক থেকে নতুন হোক, যেমন তাওরাত ইঞ্জিল যবূর ইত্যাদি; অথবা যাদের নিকট তিনি প্রেরিত হলেন তাদের দিক থেকে নতুন হোক, যেমন হযরত ইসমাইল (আঃ) এর প্রচারিত শরীয়তে ইবরাহিমী। কেননা ইসমাইল (আঃ) কর্তৃক প্রচারিত শরীয়ত নতুন কোনো শরীয়ত ছিলনা বরং এটি ইবরাহিমী শরীয়তই ছিল। কিন্তু বনু জুরহাম সম্প্রদায় হযরত ইসমাইল (আঃ) এর মাধ্যমেই শরীয়তে ইবরাহিমী সম্পর্কে নতুনভাবে জ্ঞান লাভ করেছিলো। (রেফারেন্স, ইমদাদুল ফাতাওয়া, খন্ড নং ৫ পৃষ্ঠা নং ৪৫৩)।

[৪] মির্যা কাদিয়ানীঃ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক ১৮৮৪ সালে রচিত ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ নামক কথিত ইলহামি বইয়ের ৩নং খন্ডের ২৪৬ নং পৃষ্ঠাতে তিনি “সকল নবী এবং সকল রাসূল” এইরূপ শব্দচয়নে নবী এবং রাসূলকে ভিন্ন ভিন্ন মর্মার্থে উল্লেখ করেছেন। এবার তার বই থেকে ‘রাসূল’-এর পরিচয় কিভাবে আছে দেখা যাক!

মির্যা কাদিয়ানী রচিত ‘ইযালায়ে আওহাম‘ কিতাবের ৩ নং খন্ডের ২৪৬ নং পাতায় লেখা আছে حسب تصريح قرآن کریم رسول اسی کو کہتے ہیں جس نے احکام و عقائد دین جبرائیل کے ذریعہ حاصل کئی ہوں لیکن وحی نبوت پر تو تیرہ سو برس سے مہر لگ گئی ہے. کیا یہ مہر اس وقت ٹوٹ جائے گی؟ অর্থাৎ কুরআনের সুস্পষ্ট বিবরণ মতে রাসূল তাঁকেই বলে যিনি জিবরাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে দ্বীনী-বিধিমালা ও আকিদাসমূহ লাভ করে থাকেন। পরন্তু নবুওয়াতি-ওহীর উপর তো তেরশত বছর হতে মোহর (সীল) লেগে আছে! তো এই মোহর কি বর্তমানে ভেঙ্গে পড়বে? (রূহানী খাযায়েন ৩/৩৮৭ দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য এখানে তার (মির্যা) “রাসূল” -এর সংজ্ঞায় পরিষ্কার শব্দে ‘আহকাম” (আরবী : احکام) শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। যেটি ‘শরীয়ত’ শব্দের সমার্থক।

এখানে আমার প্রশ্ন হল, “রাসূল” -এর সংজ্ঞায় মির্যা কাদিয়ানী থেকেও “রাসুল যিনি তিনি একজন শরীয়তি ওহীর বাহক” এইরূপই প্রমাণ পাওয়া গেল কিনা? একইভাবে অত্র পৃষ্ঠায় মির্যা সাহেব “নবী” এর পরিচয়টাও “গত তেরশত বছর হতে নবুওয়াতি-ওহীর উপর যেই মোহর (সীল) লেগে আছে তা বর্তমানে ভাঙ্গতে পারে এমন সাধ্য কার”-মর্মে সুস্পষ্ট করে দিলেন কিনা? আপনাদের মতে নবী আর রাসূল দুটো যখন একই তাহলে দুটোর সংজ্ঞায় বা পরিচয়ের ক্ষেত্রে বৈপরীত্য কেন?

সুতরাং বলতে পারি, কাদিয়ানীরা যেটি মনে করে বসে আছে সেটি ভুল এবং পুরোপুরি বাতিল। বরং নবী এবং রাসূল দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক রাসূল একই সাথে নবীও কিন্তু প্রত্যেক নবী একই সাথে রাসূল নন! কথা সংক্ষেপ রাখতে আজকের মত এই পর্যন্তই। আল্লাহ হাফেজ।

লেখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

হাদীসের নাম ভেঙ্গে উম্মতিনবীর দলিল ও তার খন্ডন

আর্টিকেল

জনৈক প্রশ্নকর্তা : একটি হাদীসে উল্লেখ আছে “…অতপর মূসা (আ:) আরজ করলেন اِجْعَلْنِىْ نَبِيًّا تِلْكَ الْاُمَّة অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে সেই উম্মতের নবী বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন “মিনহা নাবিয়্যুহা” অর্থাৎ তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে।” ( ইমাম আবু নাঈম আল-ইস্ফাহানী (রহ:)-এর সীরাতগ্রন্থ “হুলিয়া” এবং থানভীর সীরাতগ্রন্থ “নশরুত্তিব” দ্রষ্টব্য)। এই হাদীসে ‘তাদের নবী’ হতে মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের কথাই কি বুঝানো হয়েছে?

সূরা নিসা আয়াত নং ৬৯ এর অপব্যাখ্যা খন্ডন Click

উত্তর : শায়খ আলবানী (রহ:) লিখেছেন, এর সূত্র খুবই দুর্বল বরং মওজূ অর্থাৎ বানোয়াট। সনদের একজন রাবী আবু আইয়ুব আল জানাইরি একজন মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য এমনকি তার ভেতর দুর্বলতা থাকাও প্রসিদ্ধ, অপর আরেক রাবী সাঈদ ইবনে মূসা একজন মাজহূল অর্থাৎ অজ্ঞাত রাবী। ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন মঈন, ইবনে আদী, ইমাম বুখারী, আবু যুর’আ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ বর্ণনাটির রাবীগণের কঠোর সমালোচনা করেছেন (ইমাম যাহাবী (রহ:) রচিত ‘মীযানুল ইতিদাল’ ৩/৬৭ দ্রষ্টব্য)। ইমাম ইবনে হাব্বান (রহ:) থেকে উক্ত বর্ণনাটির একজন রাবী সাঈদ ইবনে মূসা আল-উমাবী সম্পর্কে ‘মীযানুল ইতিদাল’ কিতাবে লিখা আছে اتهمه ابن حبان بالوضع. ثم ساق له ثلاثة أحاديث هذا أحدها ، وقال: موضوع অর্থাৎ ইবনে হাব্বান (রহ:) উক্ত বর্ণনাকারীকে জাল হাদীস তৈরিকারী বলে অভিহিত করেছেন। অতপর তিনি ঐ বর্ণনাকারীর তিনখানা হাদীসের অন্যতম এই একখানা হাদীসকে জাল তথা বানোয়াট বলেছেন।

  • কিতাবের ভাষ্যমতে :-

শায়খ নাসির উদ্দীন আল-বানী (রহ:) লিখেছেন, إسناده ضعيف جدا، بل موضوع، ولوائح الوضع عليه ظاهرة ، وآفته أبو أيوب الجنائري واسمه سليمان بن سلمة الحمصي قال أبو حاتم: متروك لا يشتغل به. وقال ابن الجنيد: كان يكذب. وقال الخطيب: سعيد بن موسى مجهول، والجنائزي مشهور بالضعف. অর্থাৎ – এর সনদ (সূত্র) খুবই দুর্বল, বরং বানোয়াট। বানোয়াট হওয়ার লক্ষণসমূহ এতে সুস্পষ্ট। আর এখানে সমস্যা হল, আবু আইয়ুব আল জানাইরি। তার নাম সুলেমান ইবনে সালামাহ আল হেমসি। তার সম্পর্কে ইমাম আবু হাতেম বলেছেন, সে মাতরূক বা পরিত্যাজ্য, তাকে নিয়ে হাদীসের কাজ করা যাবেনা। ইবনুল জুনাইদ বলেছেন, সে মিথ্যা বলত। ইমাম খতিব আল-বাগদাদী বলেছেন, সাঈদ ইবনে মূসা একজন মাজহূল তথা অজ্ঞাত রাবী। আর আবু আইয়ুব আল-জানায়িরি দুর্বলতার জন্য প্রসিদ্ধ।

(সূত্র : জিলালুল জুন্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ লি-ইবনে আবী আ’ছেম- শায়খ আলবানী রহ. খ-১, পৃ-২২২; বর্ণনা নং ৬৯৬)। এবার কবি সত্যি নিরব! স্ক্রিনশট এই :-

জিলালুল জুন্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ লি-ইবনে আবী আ’ছেম- শায়খ আলবানী রহ: খ-১, পৃ-২২২; বর্ণনা নং ৬৯৬
  • সতর্কতা :

এখানে যে কথাটি বলে রাখা জরুরি সেটি হচ্ছে, এটি সহীহ হলেও এর দ্বারা কখনোই কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট প্রমাণিত হয় না। তার কারণ এখানে মূলত মূসা (আ:)-এর নিবেদনের প্রতিউত্তরে আল্লাহর যেই কথাটি উল্লেখ আছে অর্থাৎ قال نبيها منهم তথা তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবেন। এ থেকে উদ্দেশ্য হল, মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-এর আবির্ভাবের সংবাদ দেয়া। তার কারণ এর একটু উপরেই লিখা আছে, قال موسى و من امة احمد؟ (উচ্চারণ, ক্বালা মূসা ওয়া মান উম্মাতু আহমদ?) অর্থাৎ মূসা (আ:) জিজ্ঞেস করলেন, আহমদ এর উম্মত কারা (তথা মুহাম্মদ সাঃ এর উম্মতের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে?)। এতেই সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মূসা (আ:) যেই উম্মতের নবী হতে চেয়ে নিবেদন করার কথা রয়েছে সেই উম্মত মূলত উম্মতে মুহাম্মদীই। সুতরাং এই থেকে কাদিয়ানীদের কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট পুরোই অপ্রাসঙ্গিক, বানোয়াট ও বাস্তবতা বিবর্জিত বলে প্রমাণ পাওয়া গেল। এরপরেও যারা এটিকে সাত অন্ধের হাতি দেখা উল্লু কা পাঠাদের ন্যায় উম্মতিনবীর দলিল মনে করবে তাদেরকে বুঝানোর সাধ্য কারো নেই! আল্লাহর নিকট তাদের সোপর্দ করছি।

লিখকের পেইজ থেকে পড়ুন Click

  • কাদিয়ানীদের তথাকথিত “উম্মতিনবী”র দলিলটি সম্পূর্ণরূপে ও হাদীসের নাম ভেঙ্গে নিম্নরূপ:-

তাদের বইতে উল্লেখ আছে যে, হাদীসে কুদসীতে এসেছে : “আল্লাহতায়ালা একবার মূসা (আ:)-কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন তুমি বনী ইসরাঈলদের জানিয়ে দাও, যে ব্যক্তি আহমদ (সা:) এর প্রতি অবিশ্বাসী অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে সে যেই হোক আমি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব। হযরত মূসা (আ:) আরজ করলেন, আহমদ কে? আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন : হে মূসা! আমার ইজ্জত ও গৌরবের শপথ। আমি সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে তাঁর চেয়ে অধিক সম্মানিত কাউকেই সৃষ্টি করিনি। আমি তাঁর নাম আরশের মধ্যে আমার নামের সাথে আসমান ও জমিন এবং চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টির বিশ লক্ষ বছর পূর্বে লিপিবদ্ধ করেছি। আমার ইজ্জত ও গৌরবের শপথ! আমার সমস্ত মাখলূকের জন্য জান্নাত হারাম যতক্ষণ মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর উম্মত জান্নাতে প্রবেশ না করবে। অতপর মূসা (আ:) আরজ করলেন : “ইজ’আলনী নাবিয়্যা তিলকাল উম্মাতি” অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে সেই উম্মতের নবী বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন “মিনহা নাবিয়্যুহা” অর্থাৎ তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে। মূসা (আ:) পুনরায় আরজ করলেন : তবে আমাকে সেই নবীর একজন ‘উম্মত’ বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন, তুমি তাঁর পূর্বেই নবীরূপে আবির্ভূত হয়েছ আর সেই নবী তোমার পরে প্রেরিত হবেন। তবে জান্নাতে তাঁর সাথে তোমাকে একত্রিত করে দেব।”

  • কাদিয়ানীদের বিশ্বাস:

কাদিয়ানীদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, মূসা (আ:)-এর নিবেদনের প্রতিউত্তরে আল্লাহর বাণী : ‘তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে।’ অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা:) এর উম্মতের মধ্য হতে একজন ‘নবী’ হবেন। অতএব, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই ছিলেন সেই উম্মতিনবী! (নাউযুবিল্লাহ)।

  • আরেকটি জবাব:

‘তাফসীরে আবী হাতিম’ (৫/১৫৮৭) এর মধ্যে এই ধরণের আরেকটি দুর্বল বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, আল্লাহপাক মূসা (আ:)-কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করলেন : تلك الامة تكون بعدك امة احمد (উচ্চারণ) ‘তিলকাল উম্মাতু তাকূনু বা’দাকা উম্মাতু আহমাদ’ অর্থাৎ ঐ উম্মত তোমার পর আহমদের উম্মত হবে। এতে কিন্তু পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মূসা (আ:) যেই উম্মতের নবী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলিয়া কথিত আছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহও যে বলেছেন ‘তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে’—এই সমস্ত কথাবার্তায় ভবিষ্যতে একজন ‘উম্মতিনবী’ হবে—বুঝায় না, বরং ঐ সমস্ত কথাবার্তায় মুহাম্মদ (সা:)-এরই আগমনী সংবাদ দেয়া উদ্দেশ্য। নচেৎ ‘তাকূনু বা’দাকা উম্মাতু আহমাদ’—একথার কী মানে?

এছাড়াও উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা:) হতে একটি বর্ণনায় উল্লেখ আছে, “যে রাতে প্রিয়নবী (সা:) জন্মগ্রহণ করলেন সেই রাতে একজন [জ্যোতিষী] ইহুদী পন্ডিত মক্কার দিকে আগমন করছিল। সে কুরাইশদের সম্বোধন করে বলল, হে কুরাইশ সকল! আজ রাতে তোমাদের কি কোনো পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে? তারা জবাব দিলো, আমরা জানিনা। তখন সেই ইহুদী বলল : অনুসন্ধান করো! কেননা, আজ রাতে এই উম্মতের নবী জন্মগ্রহণ করেছেন যার দুই কাঁধের মাঝখানে একটা চি‎‎‎‎‎হ্ন রয়েছে। অতপর কুরাইশরা অনুসন্ধান করার পর জানতে পারল যে, জনাব আব্দুল্লাহ’র এক পুত্র [মুহাম্মদ সা:] সন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন।” (ফাতহুল বারী’র সুত্রে নশরুত্তিব’ [বাংলা] অধ্যায় ষষ্ঠ হাদীস নং ৭ দ্রষ্টব্য)।

অতএব বর্ণনাটি সহীহ হোক কিংবা জাল হোক, যাই হোক; কোনো অবস্থাতেই এর ‘তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে’ খন্ডিত অংশকে আশ্রয় করে তথাকথিত উম্মতিনবী’র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। এটি পূর্বেকার আরো সে সকল সীরাতগ্রন্থকার স্ব স্ব কিতাবে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ফজিলত বর্ণনা করতে উল্লেখ করেছেন তাদের কারো থেকে কাদিয়ানীদের কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট প্রমাণিত হয়না! উল্লেখ্য, ফজিলত বর্ণনার ক্ষেত্রে যদিও বা সহীহ হাদীস নয় এমন হাদীসও প্রাসঙ্গিকক্রমে উল্লেখ করা কারো কারো মতে বৈধ, কিন্তু আকীদার প্রমাণে একমাত্র সহীহ হাদীসই অথেনটিক, এটি উম্মাহার সর্বসম্মত মুহাদ্দিসীনের মত। আল্লাহ তুমি তাদের হিদায়াত দান কর।

একই বিষয়ে আরও একটি লিখা হাদীসে কথিত ‘উম্মতিনবী’র দলিল থাকার দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

সূরা নিসা’র ৬৯ নং আয়াতটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট

আর্টিকেল

সূরা নিসা আয়াত নং ৬৯ এর নাযিলের প্রেক্ষাপট “তাফসীরে ইবনে কাসীর” থেকে (আরবী ইবারত সহ) :

وقد روي مرفوعا من وجه آخر ، فقال أبو بكر بن مردويه : حدثنا عبد الرحيم بن محمد بن مسلم ، حدثنا إسماعيل بن أحمد بن أسيد ، حدثنا عبد الله بن عمران ، حدثنا فضيل بن عياض ، عن منصور ، عن إبراهيم ، عن الأسود ، عن عائشة قالت : جاء رجل إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال : يا رسول الله : إنك لأحب إلي من نفسي وأحب إلي من أهلي ، وأحب إلي من ولدي ، وإني لأكون في البيت فأذكرك فما أصبر حتى آتيك فأنظر إليك ، وإذا ذكرت موتي وموتك عرفت أنك إذا دخلت الجنة رفعت مع النبيين ، وإن دخلت الجنة خشيت ألا أراك . فلم يرد عليه النبي صلى الله عليه وسلم حتى نزلت عليه : ( ومن يطع الله والرسول فأولئك مع الذين أنعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالحين وحسن أولئك رفيقا ). وهكذا رواه الحافظ أبو عبد الله المقدسي في كتابه : ” صفة الجنة ” ، من طريق الطبراني ، عن أحمد بن عمرو بن مسلم الخلال ، عن عبد الله بن عمران العابدي ، به . ثم قال : لا أرى بإسناده بأسا والله أعلم .

অর্থ- মারফূ (যে হাদীসের সূত্রের ক্রমধারা রাসূল পর্যন্ত পৌঁছেছে এমন) সূত্রে বর্ণিত আছে, (সম্পূর্ণ সনদ বা Chain of narration) আবু বকর বিন মারদাওয়াই বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুর রহিম বিন মুহাম্মাদ বিন মুসলিম বলেছেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে ইসমাইল বিন আহমেদ বিন আসীদ বলেছেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে আবদুল্লাহ বিন ইমরান বলেছেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে ফুদায়েল বিন ইয়ায বলেছেন, তিনি মনসুর থেকে, তিনি ইবরাহীম থেকে, তিনি হযরত আয়েশা (রা.) থেকে। (হাদীসের মতন বা Text) হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, এক সাহাবী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহ’র রসূল! আপনি আমার কাছে আমার নিজের জীবনের চেয়েও প্রিয়, আমার পরিবার চেয়েও প্রিয়, আমার সন্তানদের চেয়েও প্রিয়, আমি যখন গৃহে অবস্থান করি আপনাকে (মনে মনে) স্মরণ করি। আর আপনার সাহচর্যে না এসে এবং আপনাকে না দেখে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারি না। আর যখনি আমি আমার মৃত্যুর কথা স্মরণ করি তখন আপনার মৃত্যুর কথাও স্মরণ করি। আমি তো জানি যে, আপনি যখন জান্নাতে প্রবেশ করবেন তখন নবীগণের সাথেই উঠাবসা করবেন। পক্ষান্তরে আমি যদি জান্নাতে প্রবেশ করিও তবু আপনাকে (জান্নাতে) দেখতে পাব কিনা আশংকা করছি।’ এরপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এই আয়াত ( ومن يطع الله والرسول فأولئك مع الذين أنعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالحين وحسن أولئك رفيقا ) নাযিল হয়। তারপরই তিনি তাঁকে (ঐ সাহাবীকে) প্রতিউত্তর দেন। (ইমাম ইবনে কাসীর তারপর লিখেছেন), হাফেযুল হাদীস আবু আব্দিল্লাহ আল মাকদিসি (রহ.) [মৃত. ৬৪৩ হিজরী] বিরচিত ‘সিফাতুল জান্নাহ’ গ্রন্থে তিনি ইমাম তাবারানী (রহ.)-এর সূত্রে [তাবারানী, আহমদ ইবনে আমর ইবনে মুসলিম আল খিলাল, আব্দুল্লাহ ইবনে ইমরান আল আবেদী সূত্রে] এটি বর্ণনা করে বলেছেন, لا أرى بإسناده بأسا অর্থাৎ আমি বর্ণনাটির সনদ বা সূত্রে কোনো সমস্যা দেখিনা। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা নিসা আয়াত ৬৯ এর তাফসীর অংশ দ্রষ্টব্য)।

আফসোস হল, সূরা নিয়া আয়াত নং ৬৯ এর শানে নুযূল যেখানে পরিষ্কার বলছে অন্য কথা সেখানে কাদিয়ানী জ্ঞানপাপীরা আয়াতটির উপবাক্য مع النبيين হতে তথাকথিত “উম্মতিনবী”-এর কনসেপশন দাঁড় করানোর চেষ্টায় রত! আহা! এই নির্বোধরা কোথায়কার জল কোথায় ঢালতে শুরু করলো!! দুঃখের বিষয় হল, অধিকাংশ কাদিয়ানীই আয়াতটির শানে নুযূল কী বলল তা খোঁজে দেখেনা। যদি তারা সামান্যই আত্মসচেতন হত আর আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখত তাহলেও আয়াতটির অপব্যাখ্যায় এভাবে অন্ধের মত গা ভাসিয়ে দিত না। আল্লাহ তাদের হিফাজত করুন। যাইহোক, এই একই তাফসীর রয়েছে “আত-তাফসীরুল মাছীর, আল-ওয়াছীত, আল-বাগাভী, আল-কুরতুবী, আত-তাবারী এবং তাফসিরে জালালাইন” ইত্যাদি কিতাবে-ও। নিচে উল্লেখ করা হল,

[১] আত-তাফসীরুল মুইয়াসসার থেকে : (আরবী) فكانوا في صحبته من أنعم الله تعالى عليهم بالجنة من الأنبياء والصديقين الخ . التفسير الميسر অর্থাৎ তাঁরা সেসব ব্যক্তিদের সঙ্গী হবেন যাঁদেরকে আল্লাহতালা জান্নাতে নেয়ামত দেবেন। আর তাঁরা হলেন নবীগণ, ছিদ্দীকীন, ইত্যাদি। (দেখুন : আত-তাফসীরুল মুইয়াসসার)।

 [২] আল-ওয়াসীত লি-ত্বনতাভী থেকে : (আরবী) يكونون يوم القيامة في صحبة الأنبياء الذين ارسلهم الله مبشرين و منذرين الخ. الوسيط لطنطاوى অর্থাৎ তারা কিয়ামতের দিন নবীদের সঙ্গী হবেন যাঁদেরকে আল্লাহতালা সুসংবাদ দাতা আর ভয়প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করিয়াছেন। (দেখুন : আল-ওয়াসীত লি-ত্বনতাভী)।

[৩] তাফসীরে বাগাভী থেকে : (আরবী) أولئك رفيقا يعني رفقاء الجنة. البغوي অর্থাৎ তারা সবাই জান্নাতে সঙ্গী হবেন। (দেখুন : তাফসীরে বাগাভী, প্রাচীন যুগের শ্রেষ্ঠ তাফসীর গ্রন্থ)।

[৪] তাফসীরে কুরতুবী থেকে : (আরবী) أى هم معهم في دار واحد و نعيم واحد يستمتعون برؤيتهم والحضور معهم لا أنهم يساوونهم في الدرجة. القرطبي অর্থাৎ তারা সবাই একই ঘরে ও একই দারুন নাঈমে (জান্নাতের একটি নাম) তাঁদের সঙ্গী হবেন। তারা নিজেদের চোখ দিয়ে নেয়ামত উপভোগ করবে এবং তাঁদের সাথেই উপস্থিত থাকবে। তবে মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁরা এঁদের সমকক্ষ হবেনা। (দেখুন তাফসীরে কুরতুবী)।

[৫] তাফসীরে তাবারী থেকে : (আরবী) এবার তাফসীরে তাবারী থেকে উদ্ধৃতি দিয়েই ইতি টানব, ইনশাল্লাহ। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত-তাবারী (রহ.) লিখেছেন, فهو مع الذين أنعم الله عليهم بهدايته والتوفيق لطاعته فى الدنيا من أنبيائه و فى الآخرة إذا دخل الجنة.الخ অর্থাৎ যাকে আল্লাহতালা স্বীয় হিদায়াত দ্বারা নেয়ামত দান করেছেন এবং দুনিয়াতে নবীদের অনুগত হওয়ার জন্য (যাকে) তাওফিক দিয়েছেন, সে পরকালে তাঁদের সঙ্গী হবে যখন সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (প্রাচীন তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে তাবারী, নিসা আয়াত ৬৯ দ্রষ্টব্য )।

শেষকথা, আয়াতটির অবতরণের প্রেক্ষাপট যাচাই করলে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, সূরা নিসা’র ৬৯ নং আয়াতে যেসকল নেয়ামতপ্রাপ্তের সঙ্গী হবার সুসংবাদ দান করা হয়েছে সেটি কার্যত পরকালের সাথেই সম্পর্কিত, দুনিয়ার জীবনের সাথে নয়। সুতরাং প্রমাণ পাওয়া গেল যে, কথিত উম্মতিনবী কনসেপ্ট শুধুই মির্যা কাদিয়ানীর নবী দাবী হালাল করার অসৎ উদ্দেশ্যেই! আল্লাহ আমাদেরকে এইধরনের ইসলাম বিরোধী আকীদা থেকে হেফাজত করুন।

আরও পড়ুন : উম্মতিনবী ধারণাটি কেন বেহুদা আর বাতিল?

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কুরআনের যেসব আয়াত দিয়ে মির্যা কাদিয়ানীর নবী দাবীকে বৈধতা দিতে চায় সে সম্পর্কে

হাদীসের নাম ভেঙ্গে কথিত উম্মতিনবীর দলিল ও তার খন্ডন পড়ুন

সূরা আলে ইমরান ৮১, আল মুমিনূন ৫১, আহযাব ০৭, আন নাহল ০২, আ’রাফ ৩৫, আলে ইমরান ১৬৪, নিসা ৬৯, সূরা হাজ্জ ৭৫, সূরা জুমা ২-৩, সূরা রা’আদ ৭ ইত্যাদি আয়াত সমূহের অপব্যাখ্যা খন্ডন :

অপ্রিয় হলেও বাস্তব সত্য কথা, ৯৯% কাদিয়ানী মু’আল্লিমের ইসলাম সম্পর্কে ফান্ডামেন্টাল কোনো নলেজই নেই। এদের জ্ঞানের দৌড় পাকি কাদিয়ানী মুরুব্বি আব্দুর রহমান খাদিম রচিত আহমদীয়া পকেটবুক পর্যন্তই। আর মিস্টার আব্দুল আউয়াল সাহেব থেকে যতটুকু শুনেন ততটুকুই। তাই কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট নিয়ে বিতর্ক করার আগে নিচের লিখাটি ভালো করে বুঝে পড়ুন। যাতে পবিত্র কুরআন থেকে তাদের ইজরায়ে নবুওয়ত এর কনসেপ্ট আবিষ্কার করার পূর্বে এই নকশার দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। ঠিক আছে, এবার শুরু করা যাক!

তাদের মু’আল্লিমদের প্রথমে জিজ্ঞেস করে জবানবন্দি নিবেন এভাবে যে,

মির্যা কাদিয়ানীর “নবী” দাবী কুরআন হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত, এই তো? তাহলে প্রথমেই জেনে নেয়া যাক মির্যা সাহেবের রচনাবলীতে তার “নবী” দাবীটা কেমন শব্দচয়নে উল্লেখ আছে!

১- মির্যা কাদিয়ানীর মতে তিনিই একমাত্র ও সর্বশেষ উম্মতিনবী। যেমন তার ‘হাকীকাতুল ওহী’ বইয়ের ৩৩০-৩১ নং পৃষ্ঠায় (বাংলায় অনূদিত) লিখা আছে, “মোটকথা খোদার ওহী ও অদৃশ্য বিষয়ের এই বিপুল অংশের জন্য এই উম্মতে আমি-ই একমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি। আমার পূর্বে এই উম্মতে যত আউলিয়া, আবদাল ও কুতুব চলিয়া গিয়াছেন তাহাদিগকে এই পুরস্কারের বিপুল অংশ দেওয়া হয় নাই। অতএব এই কারণে “নবী” নাম পাওয়ার জন্য আমাকেই নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। অন্য সকল লোক এই নামের যোগ্য নয়।…. সহীহ হাদীস অনুযায়ী এই রূপ ব্যক্তি একজনই হইবেন এবং এই ভবিষৎবাণী পূর্ণ হইয়াছে। (আরো দেখুন রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৬-৭)।

২- আরো লিখা আছে, নবী তিন (৩) প্রকার। হাকিকি নবী, মুস্তাকিল নবী এবং উম্মতিনবী। মির্যা সাহেবদের মতে, হাকিকি আর মুস্তাকিল এই দুই প্রকারের নবী আর হবেনা কিন্তু জিল্লি [উম্মতি] নবী’র আগমনীধারা বন্ধ হয়নি। (মির্যাপুত্র বশির আহমদ এম.এ রচিত ‘কালিমাতুল ফসল’ পৃ-২৩ প্রথম অধ্যায়)। তবে জিল্লি [উম্মতি] নবী শুধুমাত্র একজনই হবেন। আর তিনি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সাহেব নিজেই।

৩। অন্যত্রে লিখা আছে, মির্যা কাদিয়ানীর দাবীকৃত ‘নবুওয়ত’ আগের নবীগণের মত আল্লাহপ্রদত্ত নয়, বরং তা মুহাম্মদে আরাবী (সা.)-এর আনুগত্য দ্বারাই অর্জিত। (দেখুন হাকীকাতুুন নবুওয়ত ১/৫৪২)।

৪। অন্যত্রে আরো লিখা আছে, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘রাসূল’ (رسول) শব্দটি আ’ম (عام) বা ব্যাপক অর্থবোধক যার অর্থের মধ্যে নবী, রাসূল এবং মুহাদ্দাসও অন্তর্ভুক্ত। (রূহানী খাযায়েন ৫/৩২২)।

৫। অন্যত্রে এও লিখা আছে যে, عام لفظ کو خاص معنی میں محدود کرنا صریح شرارت ہے ((আ’ম লফজ কো খাস মা’নি মে মাহদূদ করনা ছরীহ শারারত হে)) অর্থাৎ ‘আম’ (عام) শব্দকে খাস (خاص) অর্থে সীমাবদ্ধ করা সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। (রূহানী খাযায়েন ৯/৪৪৪)। তদুপরি মির্যাপুত্র মির্যা বশির আহমদ এম. এ সাহেবের রচনার ভাষ্যমতে, পবিত্র কুরআনের কোথাও এই তৃতীয় প্রকারের (জিল্লি/বুরুজি/উম্মতি) নবী শব্দ উল্লেখ নেই। (কালিমাতুল ফছল ২৭, প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

(তারপর বলবেন)

এবার আপনাদের উত্থাপিত আয়াত আর হাদীসগুলোর উপর একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। কেননা আপনারা ভবিষ্যতেও নবী-রাসূল আগমনীধারা অব্যাহত থাকার দলিল হিসেবে সাধারণত নিচের আয়াতগুলোই প্রদর্শন করে থাকেন। যেমন:-


১। “আর যখন আল্লাহ নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা দান করছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রসূল আসবে, তখন নিশ্চয় তোমরা তাকে বিশ্বাস ও সাহায্য করবে” (আলে ইমরান ৮১)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- প্রথমত, উক্ত আয়াতে যেই ‘রাসূল’ সম্পর্কে আলোচনা তার থেকে মির্যা কাদিয়ানীকে উদ্দেশ্য নেয়া শুধু মূর্খতা আর পাগলের প্রলাপ নয় বরং সুস্পষ্ট হটকারিতাও। আয়াতের শানে নুযূল বলছে, এখানে উল্লিখিত “রাসূল” বলতে হযরত মুহাম্মদ (সা:)-কেই বুঝানো হয়েছে। আল্লাহতালা রূহের জগতে সমস্ত নবী রাসূলকে একজন অত্যাসন্ন ‘রাসূল’ এর আবির্ভাব সম্পর্কে অবহিত করেছেন। অত্র আয়াতে রূহের জগতে সমস্ত নবী রাসূলকে সম্বোধন করে ‘লাতু-মিনুন্নাহ বিহী‘ (لتؤمنن به তথা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে) শব্দও বলা হয়েছে। কাজেই এখন যদি ঐ মীছাক-ওয়ালা রাসূল (নাউজুবিল্লা) মির্যা কাদিয়ানীই হন তখন কিন্তু বহু অসঙ্গতির কবলে পড়তে হবে! মির্যা কাদিয়ানী নিজেও একথা তার বইতে লিখে গেছেন। দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১৮/৬৭৫। স্ক্রিনশট –
.

১- আয়াতের “রাসূল” শব্দটি আ’ম হওয়া সত্ত্বেও সেটি খাস (উম্মতি/বুরুজি) অর্থে গৃহীত হচ্ছে, যা সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। যেজন্য সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে হবে যে, অত্র আয়াতে উল্লিখিত “রাসূল” শব্দটি স্রেফ বুরুজি বা উম্মতি অর্থেই খাস, হাকিকি বা মুস্তাকিল ধরনের কোনো অর্থ তাতে নিহিত নয়।

২- মির্যার কথিত উম্মতি বা বুরুজি কনসেপ্টও ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ আয়াতটিতে ঐ আগমনকারী রাসূলের উপর অবশিষ্ট সমস্ত নবী রাসূলকে ঈমান আনতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠে, মির্যা কি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার স্তরে উন্নীত যে, তার উপর ঈমান আনতে স্বয়ং মুহাম্মদ (সা:)ও আদিষ্ট? নাউযুবিল্লাহ।

৩- মির্যায়ীদের জন্য সব চেয়ে বড় দুঃসংবাদ হল, মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ) নিজেই হাদীসে বলে গেছেন لو كان بعدى نبى لكان عمر ابن الخطاب (লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লাকা-না ওমর ইবনুল খাত্তাব) অর্থাৎ যদি আমার পরে কোনো নবী হত তাহলে সে ওমর ইবনুল খাত্তাব-ই হত। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ৩৬৮৬)। এখন প্রশ্ন হল, পবিত্র কুরআনেই নতুন কোনো নবী-রাসুলের আগমনী সংবাদ সত্যিই যদি থাকবে তাহলে মহানবী (সা:) কিজন্য উমর (রা:) সম্পর্কে ঐ ধরনের বাণী রেখে গেলেন? অথচ পবিত্র কুরআনের সঠিক মর্মার্থ উনার (সা:) থেকে বেশি বুঝার দাবী করার দুঃসাহস কারো নেই! জ্ঞানীদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে।


২। ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হইতে আহার কর ও সৎকর্ম কর; তোমরা যাহা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (আল মুমিনূন ৫১; ইফা)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- এই আয়াত কিভাবে আগামীতে আরো নতুন নবী রাসূল আগমন করবেন বলে বুঝাল তা বোধগম্য নয়। উল্লেখ্য, এখানে “হে রাসূলগণ” বলে বহু রাসূলকে সম্বোধন করা হয়েছে। এখন যদি ওদের কথাই সঠিক ধরি তাহলে মানতে হবে যে, অত্র আয়াতে কমপক্ষে তিন বা ততোধিক রাসূলের আগমনের ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে। ফলে এটি মির্যা কাদিয়ানীর ‘এই উম্মতে নবী নাম পাওয়ার জন্য আমিই একমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি’—কথা মিথ্যা এবং বাতিল হয়ে যাচ্ছে বৈ নয়!

৩। ‘স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়ম তনয় ঈসার নিকট হইতেও – তাহাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।’ (আহযাব ৭; অনুবাদ-ইফা)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- আয়াতটির সঠিক তাৎপর্য কী এ নিয়ে বহু কাদিয়ানী জ্ঞানপাপী আজও দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিপতিত। ফলে তাদের অধিকাংশই মনে করছে যে, বোধহয় আয়াতটি নতুন একজন নবীর আগমনের বার্তা দিচ্ছে!! নাউযুবিল্লাহ। অথচ অত্র আয়াতে নতুন নবীর আগমনের বিন্দুমাত্র কোনো ইংগিতই নেই। প্রথমে আয়াতের অর্থ :- وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِنَ النَّبِیّٖنَ مِیۡثَاقَہُمۡ وَ مِنۡکَ وَ مِنۡ نُّوۡحٍ وَّ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسَی ابۡنِ مَرۡیَمَ ۪ وَ اَخَذۡنَا مِنۡہُمۡ مِّیۡثَاقًا غَلِیۡظًا অর্থ- স্মরণ কর, আমি নবীদের নিকট হতে, তোমার নিকট হতে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, মরিয়ম-তনয় ঈসার নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম; গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে এই দৃঢ় অঙ্গীকার বলতে কি বুঝানো হয়েছে? উত্তরে বলতে পারি, এটি ঐ অঙ্গীকার, যার বর্ণনা সূরা (الشورى) আশ-শূরার ৪২:১৩ নং আয়াতে রয়েছে এবং তা এই যে, اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡہِ অর্থ—”দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে বিভক্ত হয়ো না।এবার সূরা আশ-শূরার ১৩ নং আয়াতের অনুবাদ :- شَرَعَ لَکُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا وَصّٰی بِہٖ نُوۡحًا وَّ الَّذِیۡۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ وَ مَا وَصَّیۡنَا بِہٖۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰۤی اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡہِ ؕ کَبُرَ عَلَی الۡمُشۡرِکِیۡنَ مَا تَدۡعُوۡہُمۡ اِلَیۡہِ ؕ اَللّٰہُ یَجۡتَبِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یُّنِیۡبُ অর্থ- তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে, আর যা আমরা ওহী করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ‘ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে বিভেদ সৃষ্টি কর না।

আয়াতটিতে মুহাম্মদ (সা:)-এর নাম প্রথমে থাকার কারণ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) নিজেই হাদীসে ইরশাদ করে গেছেন। তাফসীরে তাবারী-তে এসেছে, তিনি বলেছেন كنت اولهم فى الخلق و آخرهم فى البعث (কুনতু আউয়ালুহুম ফিল খালকি ওয়া আখিরুহুম ফিল বি’ছি) অর্থ আমি (যদিও) আবির্ভাবের দিক থেকে সবার শেষে (তবে কিন্তু) আমি সৃষ্টির দিক থেকে সবার প্রথম।

এখন বিস্ময়কর কথা হল, মহানবী (সা:) যে আয়াত দ্বারা নিজের খতমে নবুওয়তের প্রমাণ দিয়ে গেছেন সেই আয়াত দ্বারা কাদিয়ানীরা নবুওয়ত জারি থাকার প্রমাণ দিচ্ছে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পবিত্র কুরআনের সঠিক মর্মবাণী মহানবী (সা:)-এর চেয়েও কাদিয়ানীরা খুব ভালো বুঝে! নাউযুবিল্লাহ।


৪। “তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে ওহী (প্রত্যাদেশ) সহ ফিরিশতা অবতীর্ণ করেন, এই মর্মে যাতে তোমরা সতর্ক করো, আমি ছাড়া কোনো (সত্য) উপাস্য নেই; সুতরাং তোমরা আমাকে ভয় করো।” (আন-নাহল ০২)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- আয়াতটিতে মুদারের (الفعل المضارع) ছিগাহ যোগে ينزل ক্রিয়াপদ থাকায় ভবিষ্যতেও আরো নবী রাসূলের আগমন ঘটবে বলে ধারণা করা নিতান্তই চরম পর্যায়ের মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না। কারণ ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ চলমান এবং পুরো ঘটিত দুইভাবেই অর্থ প্রদান করে থাকে। উক্ত আয়াতে ‘ওহী প্রেরণ করাটা’ সময়সাপেক্ষ পুরো ঘটিত একটি ক্রিয়া মাত্র, ভবিষ্যতেও এর ধারা চলমান থাকবে বুঝায়নি। পবিত্র কুরআনে এর আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, সূরা তওবা আয়াত নং ৭১ এর মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে তাদের পূর্ণ আনুগত্যের উপর মুদারের ছিগাহ যোগেই উল্লেখ আছে, و يطيعون الله و رسوله (অর্থাৎ এবং তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করিয়াছেন)। এখন এর মানে কি বর্তমানেও তাদের সেই আনুগত্যের ধারা অব্যাহত? আসলে আরবী ব্যকরণজ্ঞানে শূন্য নির্বোধদের বুঝাতে পারে এমন সাধ্য কার?

নির্বোধদের কথা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও বিপত্তি থেকেই যাচ্ছে। কেননা আয়াতটির ভেতর ان انذروا (অর্থাৎ যাতে তোমরা সতর্ক করো) বহুবচনাত্মক পদ এসে যেন নির্দেশ করছে যে, আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাদের প্রতি ওহীসহ ফেরেশতা নাযিল করবেন তাদের সংখ্যা কোনোভাবেই একক কোনো ব্যক্তির ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। পক্ষান্তরে মির্যা কাদিয়ানীর দাবী হল,সহীহ হাদীস অনুযায়ী এই রূপ ব্যক্তি একজনই হইবেন এবং এই ভবিষৎবাণী পূর্ণ হইয়াছে।(দেখুন রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৬-৭)। এখন সমীকরণ কিভাবে মিলাবেন? সুতরাং নির্বোধগুলোর ঐ দাবী মিথ্যা ও বাতিল। এখানে মির্যার হাকীকাতুল ওহী বইয়ের ৩৩০ নং পৃষ্ঠা থেকে দেখুন,

.

৫। ‘হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে কোনো রাসূল (বার্তাবাহক) আগমন করেন, তোমাদেরকে আমার আয়াতসমূহ শুনায়, তাহলে যে ব্যক্তি সংযত হয় এবং সৎকাজ করে; তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা।’ (আ’রাফ ৩৫)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- প্রথমত, এখানে ‘তোমাদের মধ্য থেকে রসূলগণ’ আগমন করবে বলা হয়েছে। কাজেই প্রশ্ন আসবে যে, এ আয়াত যদি ভবিষ্যতেও নবী রাসূল হওয়ার দিকে ইংগিত হয় তাহলে তো মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের পরেও কেয়ামত পর্যন্ত আরও অসংখ্যা-অগণিত নবী রাসূল হওয়ার কথা। আরও প্রশ্ন আসবে যে, আয়াতটির “রাসূল” শব্দের সাথে মির্যা কাদিয়ানীর কী সম্পর্ক? যখন তিনি নিজেই লিখে গেলেন যে, তার নবুওয়ত আগের নবী রাসূলদের মত আল্লাহপ্রদত্ত নয়! অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটা জিনিস যাকে ‘মুহাদ্দাস’ অর্থে অভিহিত করা হবে। অধিকন্তু মির্যা সাহেব এর ‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ (বাংলা অনূদিত) বইয়ের ৮২ নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার করে একথাও লিখা আছে, মুহাম্মদী সিলসিলায় শেষনবী এই অধম (অর্থাৎ মির্যা কাদিয়ানী)। এখন কোনো ভাবেই তো এ আয়াত মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের নবুওয়তকে সাব্যস্ত করল না!

দ্বিতীয়ত, অত্র আয়াত নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট যাদের জানা, তারা নিশ্চয়ই মির্যা কাদিয়ানী ও তার মুরিদদের কথাবার্তায় হেসে খুন হবেন। কেননা এর শানে নুযূল (প্রেক্ষাপট) বলছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন “হে আদম সন্তানেরা! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে রসূলগণ আগমন করে তোমাদেরকে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনায়..” কথাটি রূহের জগতে সমস্ত বনী আদমকে লক্ষ্য করেই বলেছিলেন। তখনো কিন্তু পৃথিবীতে নবী রাসূলের আগমনীধারা শুরুই হয়নি (আয়াতটির শানে নুযূল বা প্রেক্ষাপট জানুন! ক্লিক করুন)। অতএব, অত্র আয়াত দিয়ে বর্তমানেও নবী রাসূলের আগমনীধারা অব্যাহত থাকার বিশ্বাস সুস্পষ্ট কুরআন-বিকৃতির শামিল। রেফারেন্স : তাফসীরে তাবারী, সূরা আল আ’রাফ; হাদীস নং ১৪৫৫৪, তাফসীরকারক বিশিষ্ট যুগ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃত : ৩১০ হিজরী)। আশাকরি এবার বুঝতে পেরেছেন।


৬। জনৈক কাদিয়ানীর প্রশ্ন, সূরা আলে ইমরান এর ১৬৪ নং আয়াতে লিখা আছে, “ইয বা’আছা ফীহিম রাসূলাম মিন আনফুসিহিম” অর্থাৎ যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে এক রাসূল আবির্ভূত করলেন…”। এর দ্বারা কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্য হতেই একজন রাসূলের কথাই বুঝিয়েছেন। আর তিনিই হলেন মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। কারণ মুহাম্মদ (সা:)-এর আবির্ভাব ‘মুমিনদের মধ্য হতে হয়নি’ বরং ‘উম্মীদের মধ্য হতে হয়েছে’। দেখুন সূরা জুম’আ আয়াত নং ২-৩।

  • ভ্রান্তি নিরসন:– না, এই আয়াতে উল্লিখিত ‘রাসূল’ দ্বারা হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর আগমনেরই সংবাদ দেয়া হয়েছে। মির্যাপুত্র মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদও একই কথা লিখে গেছেন (বারাকাতে খিলাফত পৃ-৯; অনলাইন এডিশন) । কেননা আয়াতে ‘বা’আছা’ (بعث) শব্দটি অতীতকালবাচক ক্রিয়াপদ। ফলে আয়াতের ঐ কথা পরবর্তীতে নতুন কোনো রাসূল সম্পর্কে নয়, বরং এমন এক রাসূল সম্পর্কে যিনি অতীতকালে আবির্ভূত হয়ে গেছেন। তর্কের খাতিরে মানলাম যে, এখানে ‘রাসূল’ শব্দটি দ্বারা মির্যা কাদিয়ানীর আবির্ভাবকেই বুঝিয়েছে। তাহলে নিচের এই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন!

প্রথমত, ঐ একই আয়াতে কিন্তু و يعلمهم الكتاب (উচ্চারণ : ওয়া ইয়ু’আল্লিমুহুমুল কিতাব) অর্থাৎ তিনি তাদেরকে কিতাব শিক্ষা দেবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। তাহলে মির্যা কাদিয়ানীর সেই কিতাবটি কী যার শিক্ষা তিনি তার উম্মতদের দিয়ে গিয়েছিলেন? আর হ্যাঁ, আপনাদের জন্য ঐ ‘কিতাব’ হতে কুরআন শরীফ উদ্দেশ্য নেয়ার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ আয়াতে শব্দটি নবী নয় বরং ‘রাসূল’। আর রাসূল কখনো নতুন বিধি-বিধান ব্যতীত আবির্ভূত হন না।

উল্লেখ্য, কোনো কোনো নির্বোধ এখানে বলতে পারে যে, নবী আর রাসূল তো একই। আমি এর জবাবে বলতে চাই, তাহলে হাশরের ময়দানে হযরত নূহ (আ:) হাশরবাসীদস্র দ্বারা يا نوح انت اول الرسل অর্থাৎ হে নূহ! আপনি প্রথম রাসূল—এইরূপ শব্দচয়নে কেন আহূত হবেন? (সহীহ বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া হাদীস ৩৩৪০ দ্রষ্টব্য)। অথচ নূহ (আ:)-এর আগেও বহু নবী ছিলেন! এটাই প্রমাণ করে, প্রত্যেক রাসূল একই সাথে নবী বটে, কিন্তু প্রত্যেক নবী একই সাথে রাসূল নন। যাইহোক, এখন ঐ আয়াতের রাসূল দ্বারা মির্যাকে উদ্দেশ্য নিতে গেলে তাকে নতুন শরীয়তবাহক নবী হওয়াও মানতে হচ্ছে! তো ঐ নির্বোধরা কি তাকে নতুন শরীয়তবাহকও মেনে নিলো?

দ্বিতীয়ত, আয়াতটির “রাসূল” শব্দ হতে মির্যাকে উদ্দেশ্য নিলে তখন সেটি আ’ম হওয়া সত্ত্বেও খাস (উম্মতি/বুরুজি) অর্থে গৃহীত হচ্ছে, যা সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। যেজন্য সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে হবে যে, অত্র আয়াতে উল্লিখিত “রাসূল” শব্দটি স্রেফ বুরুজি বা উম্মতি অর্থেই খাস, হাকিকি বা মুস্তাকিল ধরনের কোনো অর্থ তাতে নিহিত নয়। এবার আপনাকে একখানা হাদীস শুনাব।

হাদীসে এসেছে রাসূল (সা:) বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই নবুওয়ত এবং রেসালত বন্ধ, আমার পর না কোনো রাসূল আছে আর না কোনো নবী আছে।’ (তিরমিযী ২/৪৫৫, আনাস ইবনে মালেক হতে বর্ণিত)। হাদীসের মান : হাসান ও সহীহ। আশাকরি আপনাদের ভুলটি কোথায় এবং কিভাবে তা নিঃসন্দেহে বুঝতে পেরেছেন!


৭। জনৈক কাদিয়ানীর বক্তব্য, উম্মতে মুহাম্মদীয়ার কোনো ব্যক্তি ‘নবী’ হতে পারবেন, একথার উল্লেখ সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে এভাবে আছে যে, “এবং যারা আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য করবে তারা ঐ সকল লোকদের মধ্যে শামিল হবে যাদেরকে আল্লাহ পুরস্কার দান করেছেন অর্থাৎ নবীগণ এবং সিদ্দীকগণ এবং শহীদগণ এবং সালেহগণের মধ্যে। এবং এরাই সঙ্গী হিসেবে উত্তম।” (০৪:৬৯) এই আয়াতে কারীমায় একথাই বলা হয়েছে যে, রসূলেপাক (সা:)-এর উম্মতের মধ্যে এমন উম্মতীও হতে পারবেন যিনি সিদ্দীকের স্তর অতিক্রম করে যাবেন এবং নবীর স্তরে উন্নীত হবে। (উম্মতিনবী পৃষ্ঠা নং ১০; চতুর্থ সংস্করণ মার্চ, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ; প্রকাশনায় : আহমদীয়া মুসলিম জামাত, বাংলাদেশ)। স্ক্রিনশট :-

.
  • ভ্রান্তি নিরসন:– আয়াতের শানে নুযূল নিয়ে চিন্তা করলে একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষও বুঝতে পারে যে, আয়াতটি কখনো তথাকথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট ধারণ করেনা। যারা আয়াতটির শানে নুযূল নিয়ে ভাবতে প্রস্তুত নন তাদেরকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই!

১- ঐ আয়াতে তো ‘নবী’ এর বহুবচন ‘নাবিয়্যীন’ (অর্থাৎ নবীগণ) শব্দ রয়েছে। তাহলে কি কথিত ‘উম্মতীনবী’ আরো হবে বিশ্বাস করেন? যদি আরো হবে বিশ্বাস করেন তাহলে মির্যা কাদিয়ানী তার বইতে (হাকীকাতুল ওহী [বাংলা] পৃষ্ঠা নং ৩৩০) ‘এই উম্মতে আমিই একমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি’ বলে শুধুমাত্র একজনই উম্মতিনবী হবে, কেন লিখলেন?

হাকীকাতুল ওহী ৩৩০

২- আয়াতের অনুবাদ “যারা আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য করবে তারা ঐ সকল লোকদের মধ্যে শামিল হবে…”—এরকম হলে তখন و حسن اولئك رفيقا (ওয়া হাছুনা উলা-ইকা রফীকা) অর্থাৎ এবং এরাই সঙ্গী হিসেবে উত্তম, (অনুবাদ, উম্মতিনবী, পৃষ্ঠা নং ১০) একথার কী মানে?

৩- আনুগত্যকারী ব্যক্তি যেসব নবীর মধ্যে শামিল হচ্ছেন সেসব নবীকেও তথাকথিত ‘উম্মতীনবী’ মানা হচ্ছে কিনা? অন্যথা তাদের মধ্যে শামিল হবে কেমনে?

৪- যদি আয়াতের مع الذين انعم الله عليهم من النبيين الخ এর ‘মা’আ’ (مع) অর্থ শামিল বা অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে لا تحذن ان الله معنا (লা-তাহযান ইন্নাল্লাহা মা’আনা)-এর ‘মা’আ’ (مع) কী অর্থে দাঁড়াল? আশাকরি কথিত বুরজি/জিল্লি/ উম্মতিনবী’র কনসেপশনটাই বাতিল হওয়ার প্রমাণ পেলেন! আসুন, এবার উক্ত আয়াতের সঠিক তাৎপর্য কী জেনে নিই!

উক্ত আয়াতের সঠিক তাৎপর্য হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারী নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলে পরকালে (কেয়ামত দিবসে) শ্রেণীভেদে নবী, সিদ্দিক, শহীদ এবং পুণ্যবানদের সঙ্গী (সঙ্গ লাভকারী) হবে। তাফসীরে ইবনে কাসীর সহ প্রায় সমস্ত তাফসীরগ্রন্থে আয়াতটির Context বা শানে নুযূলের প্রেক্ষিতে বিশুদ্ধ বর্ণনার আলোকে এটাই লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর এই জন্যই আয়াতটির শেষাংশে ‘তাহারা কতই না উত্তম সঙ্গী’ বলে উল্লেখ রয়েছে, যাতে কেউ এই স্থলে মা’আ (مع) শব্দের অর্থ ভুলক্রমে শামিল বা অন্তর্ভুক্ত না নেয়।


৮। “আল্লাহতালা ফেরেশতাদের মধ্য হতে বাণীবাহক মনোনীত করেন, মানুষের ভেতর থেকেও (তিনি বাণীর গ্রহীতা বাছাই করেন); অবশ্যই আল্লাহতালা সবকিছু শোনেন ও সব কিছু দেখেন।” (সূরা আল হাজ্জ ৭৫)।

  • ভ্রান্তি নিরসন:- প্রথমত, আয়াতটিতে উল্লিখিত رسل বা রাসূলগণ হতে স্রেফ বুরুজি রঙ্গের নবী-রাসূলই উদ্দেশ্য—এর দলিল কী? কারণ মির্যা সাহেবের মত অনুযায়ী পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘রাসূল’ (رسول) শব্দটি আ’ম (عام) বা ব্যাপক অর্থবোধক যার অর্থের মধ্যে নবী, রাসূল এবং মুহাদ্দাসও অন্তর্ভুক্ত। (রূহানী খাযায়েন ৫/৩২২)।

দ্বিতীয়ত, আয়াতে یَصۡطَفِیۡ শব্দ দেখে ধোকা খাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আয়াতটির শানে নুযূল নিয়ে চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে, মুদারের এই ছিগাহ পুরো ঘটিত বর্তমানকালের জন্যই এসেছে। বিশিষ্ট যুগইমাম আল্লামা সুয়ূতী (রহ:) তাফসীরে জালালাইনের ভেতর এর শানে নুযূল উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এখানে রাসূলগণের মনোনীত করা সময়সাপেক্ষ একটা বিষয় মাত্র। এর মানে ভবিষ্যতেও নবী-রাসুল মনোনীত করতে থাকবেন—এমনটা উদ্দেশ্য নয়। নির্বোধদের বুঝার জন্য বলতে হয় যে, মির্যা কাদিয়ানী লিখেছেন, ‘সামান্য কিছুদিন পর মুন্সী এলাহী বখশ এর নিকট ইলহাম হয় يريدون ان يروا طمثك অর্থাৎ এই লোকেরা তোমার (মির্যা) ঋতুস্রাবের খুন দেখতে চাচ্ছে।’ (রূহানী খাযায়েন ১৭/৪৫২)। তো নির্বোধরা কি মনে করে যে, লোকেরা মির্যা সাহেবের ঋতুস্রাবের (হায়েজ) খুন কেয়ামত পর্যন্ত দেখতে চাচ্ছে? যতসব হাস্যকর!!

তৃতীয়ত, এখানেও رسل শব্দটি رسول এর বহুবচন। অর্থ বার্তাবাহক, প্রেরিত রাসূল। এখানেও সেই পূর্বের ন্যায়ই প্রশ্ন আসবে যে, মির্যা কাদিয়ানীর মত অনুযায়ী বুরুজি রঙ্গের নবী শুধু একজনই হবেন। এ সম্পর্কে উপরে আবার দেখা যেতে পারে। সুতরাং এই আয়াতও তথাকথিত বুরুজি রঙ্গের নবীর আগমনের দলিল নয়। অন্যথা তখন বুরুজি রঙ্গের নবী কমপক্ষে তিনজনই হওয়ার কথা! যাইহোক, ফেরেশতা ও মানুষের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা আল্লাহতালা বার্তাবাহক হিসেবে চয়ন করেন। বার্তাবাহক হিসেবে ফেরেশতাদের কাজ হল নবীদের কাছে ওহী পৌঁছে দেয়া, এ কাজগুলো করত জিবরাইল (আ:)। আর বার্তাবাহক হিসেবে নবীদের কাজ হল তাদের উপর আগত ওহী অনুসারে মানুষদেরকে দাওয়াত দেয়া, ওহীর বাণী পৌঁছে দেয়া। আশাকরি জবাব পেয়েছেন।


৯। সূরা জুম’আ এর ২ ও ৩ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে কাদিয়ানীরা দাবী করে যে, পৃথিবীতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর দ্বিতীয়বার আগমন ঘটবে! নাউযুবিল্লাহ। অথচ এই দাবী সম্পূর্ণ অসার, মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। এবার আসুন, প্রথমে আয়াত দুটির অনুবাদ জেনে নিই। আল্লাহতালা বলেন, هوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡن অর্থ- তিনিই নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রসূলরূপে যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা, যদিও ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে। (পরের আয়াত) وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡم অর্থ- আর তাদের (اٰخَرِیۡنَ) অন্যান্যদের মধ্যেও যারা এখনো তাদের সাথে (لَمَّا یَلۡحَقُوۡا) মিলিত হয়নি। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

  • বিভ্রান্তি নিরসন :– প্রথমত, এই আয়াতে أُمِّيِّيْنَ (নিরক্ষর) থেকে এমন আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে যাদের অধিকাংশই লেখাপড়া জানত না। অত্র আয়াতের সম্পূর্ণ বিষয়টির সংযোগ হল أُمِّيِّيْنَ এর সাথে। মানে, بَعَثَ فِي آخَرِيْنَ مِنْهُمْ (অর্থাৎ তিনি রসূল পাঠিয়েছেন তাদের অন্যান্যদের মধ্যেও)। আর آخَرِيْنَ বলতে পারসীক (বিশেষত, হযরত সালমান ফারসীর বংশধরেরা) এবং অন্যান্য অনারব লোক, যারা কিয়ামত পর্যন্ত রসূল (সা:)-এর উপর ঈমান আনয়ন করবে। এই সম্পর্কে সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে একটি হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আরব ও অনারবদের সেই সমস্ত লোক, যারা সাহাবাদের যামানার পর কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। আর ঈমান গ্রহণ করার পর এরা সবাই مِنْهُمْ (তাদের অন্যান্য) তথা সাহাবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রথম প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীরা أُمِّيِّيْن এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা সমস্ত মুসলমান একই উম্মত। এই (তাদের) সর্বনামের কারণে কেউ কেউ বলেন, ‘অন্যান্য’ বলতে পরে আগমনকারী আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, ‘তাদের’ সর্বনাম দ্বারা (আরব) ‘নিরক্ষরদের’ প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (বিশিষ্ট যুগ ইমাম আল্লামা শাওক্বানী রচিত, ফাতহুল ক্বাদীর দ্রষ্টব্য)।

দ্বিতীয়ত, ‘আখারীনা’ (آخرين) শব্দটি উম্মিয়্যীন (اميين) এর উপর আতফ (عطف) হওয়ায় সেটি যের-এর অবস্থায় হয়েছে। একথা বলেছেন, সহীহ বুখারী’র ব্যাখ্যাকারক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (ان يكون مجرورا عطفا على الاميين)। [ফাতহুল বারী, কিতাবু তাফসীরিল কুরআন দ্রষ্টব্য]। যার ফলে আখারীনা শব্দকে বা’আছা’ এর দ্বিতীয় মাফউল (object/কর্ম) ধরে এভাবে অর্থ নেয়া যাবেনা যে, আল্লাহ অন্যান্যদের পাঠিয়েছেন! এখানে দুইটা বিষয় খুবই লক্ষণীয়। একটি হল, ‘আখারীনা’ শব্দটি بعث এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে নসবের অবস্থায় হয়নি, বরং اميين এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে মাজরূরের (যের-এর) অবস্থায় হয়েছে। অপরটি হল, এখানে بعث পদটি ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ নয়, বরং অতীতকাল বাচক ক্রিয়াপদ। যদ্দরুন পরবর্তীতে কারো আবির্ভাবের কনসেপ্ট এখানে অনুপস্থিত। সুতরাং আপনাদের (কাদিয়ানীদের) বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে মুহাম্মদ (সা:)-এর পুনরায় আগমনের কোনো কথারই লেশমাত্র সম্পর্ক থাকবে তো দূরের কথা, ভবিষ্যতে দ্বিতীয় কারো আসার কোনো কনসেপ্টই এখানে নেই।

  • এই সম্পর্কে চমৎকার আরেকটি লিখা Click করুন

১০। “যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে, ‘তার প্রতিপালকের নিকট হতে তার নিকট কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ করা হয় না?’ তুমি তো শুধুমাত্র একজন সতর্ককারী। আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পথ প্রদর্শক রয়েছে।” (সূরা রা’আদ, ৭)।

  • ভ্রান্তি নিরসন : এখানে নবীর আগমনীধারা অব্যাহত রয়েছে বলে দাবীদারদের যুক্তি হল, আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, وَ لِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ মানে, ‘আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পথ প্রদর্শক রয়েছে।’ সুতরাং নবীর আগমনীধারা বন্ধ হয়নি। এর উত্তর হল, এই আয়াতে আল্লাহতালা আপনা কানূনে কুদরত (বিধিবিধান) সম্পর্কে জানান দিয়েছেন মাত্র। সেটি হল, তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নির্দেশনার জন্য তাদেরই ভাষাভাষী একজন সতর্ককারী বা নবী প্রেরণ করে থাকেন। আর সেই সতর্ককারী বা নবীদের প্রেরণের ধারাক্রম ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। সূরা ফাতিরের ২৪ নং আয়াতে ‘খালা’ (خَلَا) অতিতকালবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা সে কথার পরিষ্কার ইংগিতও রয়েছে। যেমন আল্লাহতালা বলেন, وَ اِنْ مِّنْ اُمّةٍ اِلَّا خَلَا فِيْهَا نَذِيْرٌ (ওয়া ইম্মিন উম্মাতিন ইল্লা খালা ফীহা নাযীর) অর্থাৎ ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট সতর্ককারী অবশ্যই এসেছে।’ এখন জানার বিষয় হল, কোন্ নবীর মাধ্যমে আল্লাহ সতর্ককারীদের ক্রমধারা পূর্ণ করলেন? এর উত্তরে সূরা আহযাব আয়াত নং ৪০ এর وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ (ওয়া খাতামান নাবিয়্যীন) এর ঘোষণাই যথেষ্ট। কারণ এখানে আল্লাহ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদ (সা.)-ই সেসব সতর্ককারীদের ক্রমধারা সমাপ্তকারী। সুনানু তিরমিজীর হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) নিজেই ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ এর মর্মার্থ পরিষ্কার করে দিয়ে বলেছেন لَا نَبِيَّ بَعْدِىْ (লা নাবিয়্যা বা’দী) অর্থাৎ ‘আমার পরে আর কোনো নবী নেই’।

খুব বেশি ব্যস্ততার কারণে বিস্তারিত লিখা সম্ভব হয়নি। সংক্ষেপে আজ এই পর্যন্ত। জ্ঞানীরা নিশ্চয়ই লিখাটি নিয়ে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করবেন এবং সত্যটা উন্মুক্ত মন নিয়ে খোঁজে নেবেন। আল্লাহ আমাদের বিভ্রান্ত ভাইবোনদের ঈমান হেফাজত করুন। আমীন।

সূরা নিসা আয়াত ৬৯ এর শানে নুযূল সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।

লিখাটি ফেইসবুক পেইজ থেকে পড়ুন

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ
এডমিন, www.markajomar.org
তারিখ ১৩/১০/২০২১ইং