Home Blog Page 28

উলামা-উহুম শাররুম মান তাহতা আদীমিস সামায়ি সম্পর্কে

উলামা-উহুম শাররুম মান তাহতা আদীমিস সামায়ি…হাদীসটির উপর নাতিদীর্ঘ কিছু বিশ্লেষণ ও কিছু প্রশ্ন!

হাদীসের আরবী ইবারত : يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يَبْقَى مِنَ الْإِسْلَامِ إِلَّا اسْمُهُ، وَلَا يَبْقَى مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا رَسْمُهُ، مَسَاجِدُهُمْ عَامِرَةٌ وَهِيَ خَرَابٌ مِنَ الْهُدَى، عُلَمَاؤُهُمْ شَرُّ مَنْ تَحْتَ أَدِيمِ السَّمَاءِ منْ عِنْدَهُمْ تَخْرُجُ الْفِتْنَةُ وَفِيهِمْ تَعُودُ. হাদীসটির তাহকিক, শায়খ আলবানী (রহ.) লিখেছেন, এর সনদ খুবই যঈফ বা দুর্বল। (আস-সিলসিলাতুয য’ঈফাহ, নং ১৯৩৬; আলবানী রহ.)। Click

আমার কলিজার আহমদীবন্ধুরা! ‘শেষ যুগের নিকৃষ্ট আলেম’ সম্পর্কিত বর্ণনাটির সনদ (ধারাবাহিক বর্ণনা-সূত্র/Chain of narration) যে খুবই দূর্বল; ফলে এর কথাগুলো রাসূল (সা:) থেকে হওয়াটা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়—এ কথাগুলো কাদিয়ানী-নেতারা আপনাদেরকে কখনোই বলবেনা। কেন জানেন? যদি ওরা এটি বলতেন তাহলে আপনাদেরকে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সংশ্রব থেকে কোনোভাবেই দূরে রেখে ধোকা দিতে পারতো না।

অধিকন্তু উলামায়ে কেরাম এর মর্যাদা সম্পর্কে আরো যেসব সহীহ সূত্রে বর্ণনা অগণিত হাদীসগ্রন্থে রয়েছে তারা জীবন চলে গেলেও আপনাদেরকে সেগুলো বলবেনা! এ দেখুন, হাক্কানী উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল (সাঃ) কত সুন্দর কথা বলে গেছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন : انما يخسى الله من عباده العلماء অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে তার বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই বেশী ভয় করে। (সুরা ফাতির আয়াত ২৮)।

প্রাসঙ্গিক সামান্য কয়েকটা হাদীস :

(ক) হাদীসে এসেছে রাসূল (সা:) বলেছেন,… وَاِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ اَجْنِحَتَهَا رِضًا لِّطَالِبِ الْعِلْمِ وَاِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَه مَنْ فِى السَّموتِ وَمَنْ فِى الاَرْضِ وَالْحِيْتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ وَاِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَاِنَّ الْعُلمَاءَ وَرَثَةُ الاَنْبِيَاءِ وَاِنَّ الاَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَاِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ اَخَذَه اَخَذَ بِحَظٍّ وَّافِرٍ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَأَبُوْ دَاوٗدَ وابن مَاجَةَ وَالدَّارِمِيُّ

অর্থাৎ কাসীর বিন ক্বায়স (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দিমাশক-এর মাসজিদে আবুদ দারদা (রা:)-এর সাথে বসা ছিলাম, এমন সময় তার নিকট একজন লোক এসে বললো, হে আবুদ দারদা! আমি রাসূল (সা:)-এর শহর মদীনাহ থেকে শুধু একটি হাদীস জানার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি শুনেছি আপনি নাকি রাসূল (সা:) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশে আমি আপনার কাছে আসিনি।

তার এ কথা শুনে আবুদ দারদা (রা:) বললেন, রাসূল (সা:)-কে আমি এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি (কুরআন ও হাদীসের) ইলম সন্ধানের উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথসমূহের একটি পথে পৌঁছিয়ে দিবেন এবং ফেরেশতারা ইলম অনুসন্ধানকারীর সন্তুষ্টি এবং পথে তার আরামের জন্য তাদের পালক বা ডানা বিছিয়ে দেন। অতঃপর আলিমদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকলেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দু‘আ করে থাকেন, এমনকি পানির মাছসমূহও (ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে)। আলিমদের মর্যাদা মূর্খ-ইবাদাতকারীর চেয়ে অনেক বেশী। যেমন পূর্ণিমা চাঁদের মর্যাদা তারকারাজির উপর এবং আলিমগণ হচ্ছেন নবীদের ওয়ারিস। নবীগণ কোনো দীনার বা দিরহাম (ধন-সম্পদ) মীরাস (উত্তরাধিকারী) হিসেবে রেখে যান না। তাঁরা মীরাস হিসেবে রেখে যান শুধু ইলম। তাই যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশগ্রহণ করেছে। (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ্ ও দারিমী)। রেফারেন্স, মেশকাত শরীফ , কিতাবুল ইলম হা/২১২ দ্রষ্টব্য। হাদীসের মান, সহীহ।

(খ) নবী কারীম (সা:) আরো এরশাদ করেছেন : فضل العالم علي العابد كفضلي علي ادناكم অর্থাৎ একজন আলেমের মর্যাদা একজন সাধারণ ইবাদত কারীর উপর, তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার মর্যাদার ন্যায়। (তিরমিজি শরিফ ২৬৮৬)।

(গ) নবী কারীম (সা:) আরও এরশাদ করেছেন : ان العلماء ورثة الانبياء وانا لانبياء لم يو رثو دينارا و لا درهما و انما ورثو العلم অর্থাৎ নিশ্চয় আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিশ আর নবীগণ কখনো দিনার দিরহামের ওয়ারিস বানান না, তারা দ্বীনি শিক্ষার ওয়ারিস বানান। (মুসনাদে আহমাদ ২১৭১৫, সহীহ বুখারি ১/২৪, সুনানে আবু দাউদ ৩৬৪৯)।

(ঘ) হাদিস শরিফে হযরত আবু দারদা ও ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা:) বলেছেন : كن عالما او متعلما اومحبا اومتبعا و لا تكن الخامس فتهلك۔ قال قلت للحسن من الخامس قال المبتدع অর্থাৎ তুমি আলেম হও। নয়তো আলেমের ছাত্র হও। নয়তো আলেমকে মহব্বতকারী হও। নয়তো আলেমের অনুসারী হও, পঞ্চম ব্যক্তি হয়োনা। তাহলে তোমার ধংস অনিবার্য। হাদিসে বর্ণিত হযরত হাসান (রহ:)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, পঞ্চম ব্যক্তি কে? তিনি বলেন পঞ্চম ব্যাক্তি হচ্ছে বিদআতি। (আল ইবানাহ ইবনে বাত্তাহ হাদিস ২১০ আল মাদখাল বায়হাকি, হাদিস ৩৮১ জামিউ বায়ানিল ইলম ইবনু আব্দ বার হাদিস ১৪২)।

(ঙ) সুনানে দারেমীর ৩৭০ নং হাদিসে আরো এসেছে, রাসূল (সা:) বলেছেন, ওয়াইন্না খাইরাল খিয়ারি খিয়ারুল উলামা। অর্থাৎ এবং নিশ্চয় আলেমরাই সর্বশ্রেষ্ট মর্যাদার অধিকারী।

কিন্তু তারা (কাদিয়ানী পন্ডিতরা) আপনাদেরকে মগজ ধোলাই দিয়ে মনঃস্তাত্ত্বিকভাবে আজ যেমন নির্বোধ বানিয়ে রেখেছেন, যে কোনো ভাবেই সত্য উন্মোচন হয়ে গেলে তাদেরকে চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিতে পারেন এই আশংকায় ইসলামী স্কলার ও বিজ্ঞ আলেমের সংশ্রব থেকেও দূরে রাখতে হরহামেশা আপনাদের মন-মগজে তাদের ব্যাপারে যেই বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, তা কখনোই সম্ভব হতনা। তারা খুব ভালো করেই জানেন যে, তাদের সমুদয় প্রতারণাপূর্ণ কথাবার্তা, তাবিলাত, রূপকের কাসুন্দি সবই ধরা পড়ে যাবে; যদি আপনারা বিজ্ঞ আলেমদের সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে আসেন!

হাদীসটির বর্ণনা-প্রসঙ্গ ও সার্বিক বিচারের আলোকে যা বুঝা যায় :

উল্লিখিত বর্ণনাটির কথাগুলো সার্বিক বিচারে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এর কথাগুলো হযরত ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের পূর্বেকার সময়ের সাথেই সম্পর্কিত, পরবর্তীতে তাঁর মাধ্যমেই এর আমূল-পরিবর্তন সাধিত হতে থাকবে, ইনশাআল্লাহ। যেমন হাদীসে এসেছে, ইমাম মাহদীর যুগে সারা দুনিয়ায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। জুলুম নিপীড়ন এমনভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে যেভাবে ইতিপূর্বে তাতে সারা দুনিয়া ভরপুর হয়ে গিয়েছিল (দেখুন, ইবনে মাজাহ, কিতাবুল ফিতান হাদীস নং ৪০৭৭; হাদীসের মান – সহীহ) ।

  • খুব খেয়াল করুন, হাদীসটিতে শেষ যুগের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিকৃষ্ট আলেম সম্পর্কিত কথাটির আগে আরও ৩টি কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

১. নাম ব্যতীত ইসলামের কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা।

২. তখন পবিত্র কুরআনের শুধুই অক্ষরগুলো অবশিষ্ট থাকবে, যার তাৎপর্য হল কুরআনের কোনো আইন কানূন (শাসন-ব্যবস্থা)ই সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকবে না।

৩. বাহ্যিকভাবে মসজিদগুলো ঝলমল করতে থাকবে কিন্তু হিদায়াত শূন্য পড়ে থাকবে।

উপরের কথাগুলোর পরেই এসেছে ‘তখন (সেই যুগের) তাদের (এক শ্রেনীর) আলেমরা আকাশের নীচে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোক হবে।

সুতরাং কাদিয়ানীদের জেনে রাখা জরুরি যে, তারা এ বর্ণনাটি খুব বেশি প্রচার-প্রসার করে প্রকারান্তরে নিজেরাই প্রমাণ করল যে, অন্তত এর দ্বারাও সাব্যস্ত হচ্ছে যে, প্রকৃত ইমাম মাহদীর আগমন এখনো বাকি! যেজন্য মির্যা কাদিয়ানীর ইমাম মাহদী দাবীও সঠিক নয়। কেননা, উক্ত বর্ণনার কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে, এর সবই এ যুগেও আমরা আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান দেখতে পাচ্ছি। যা আমাদের ডেকে ডেকে বলছে যে, ওহে জ্ঞানীরা! দুনিয়ার বিচক্ষণ ও সত্যানুসন্ধিৎসুরা! একটু ভেবে দেখো! ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে আসছে মাত্র। তার আগমনের পূর্ব যুগ-লক্ষণগুলো সবে মাত্র একেক করে পূর্ণতা পেতে চলেছে। তাই আজ থেকে আরো প্রায় ১৩০ বছর আগেই ইমাম মাহদী দাবীকারী ব্রিটিশ সরকারের রোপিত চারাগাছ খ্যাত মির্যা কাদিয়ানী (মৃত. ১৯০৮ইং) একজন মিথ্যাবাদী! নইলে সূর্য আকাশে উদিত হবে অথচ দুনিয়া অন্ধকারে ভাসবে, এটি হয় কিভাবে?? অতএব চিন্তা করে দেখো!

আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার এবং চিন্তা করার তাওফিক দিন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

ঈসা (আ:) উম্মতে মুহাম্মদীয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন কি?

প্রশ্নকর্তা : একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন হযরত মূসা (আ:) কিন্তু আমাদের সমাজে হযরত ঈসা (আ:) সম্পর্কেও প্রচলিত আছে যে, তিনিও নাকি একই ধরণের প্রার্থনা করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা সেই প্রার্থনা কবুলও করেছেন!? এ সম্পর্কে দলিল সহ জানতে চাই!

উত্তরদাতা :

(ক)

প্রশ্নকারী যদি কোনো আহমদী তথা কাদিয়ানী হন তাহলে তাকে সবিনয়ে জানিয়ে দিতে চাই যে, ঈসা (আ:) নবী হিসেবে নয় বরং “উম্মত” হিসেবে আসবেন একথা স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীও লিখে গেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন : ‘আনে ওয়ালে মসীহ কেলিয়ে হামারে সাইয়েদ ওয়া মওলা নে নবুওয়ত শর্ত নিহি ঠেহরায়ি (উর্দূ : آنیوالے مسیح کے لیے ہمارے سید و مولا نے نبوت شرط نہیں ٹہرائ )।’ অর্থাৎ আগমনকারী মসীহ’র জন্য আমাদের নবী করীম (সা:) নবুওয়ত শর্ত করেননি। (মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি বইয়ের সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত ‘রূহানী খাযায়েন’ খন্ড নং ৩ এর ৫৯ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। এখানে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়েছে যে, আগত ঈসা (আ:) নবুওয়তের দায়িত্বে থাকবেন না। তার মানে দাঁড়াল, শেষ যুগে আগমনকারী ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) শুধুমাত্র একজন “উম্মত” হিসেবে আসবেন! রাসূল (সা:)-এর একাধিক হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত আছে যে, আগত ঈসা (আ:) “উম্মত” হিসেবে আসবেন। দলিল, আল-মু’জামুল আওসাত, হাদীস নং ৪৫৮০; হাদীসের মান : হাসান লি-গয়রিহি। আমি মনে করি, একজন কাদিয়ানী মতাবলম্বীর জন্য বিষয়টি বুঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

এখন প্রশ্ন আসবে যে, এমতাবস্থায় মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে ঈসা (আ:)-কে “নাবিউল্লাহ” তথা আল্লাহর নবী বলা হয়েছে কেন? এর উত্তর হল, আগত ঈসা কোনো রূপক ঈসা নন, বরং বনী ইসরায়েলের জন্য ইতিপূর্বে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন শেষ যুগে তিনি-ই পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবে, এ কথাটি সুস্পষ্ট করে দিতেই হাদীসে “নাবিউল্লাহ” বলে ইংগিত দেয়া হয়েছে। যাতে রূপক ঈসা দাবীদারদের উদ্দেশ্যমূলক ও বিকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে প্রকৃত ঈসাকে বাদ দিয়ে কথিত রূপক ঈসার জালে বন্দী হয়ে না যায়!

(খ)

হযরত মূসা (আ:) সম্পর্কিত যে বর্ণনাটিতে ‘উম্মতে মুহাম্মদীয়া’য় শামিল হতে চেয়ে তাঁর প্রার্থনা করার কথা রয়েছে এবং আবু না’ঈমের সীরাতগ্রন্থ ‘হুলিয়া’-তে যেটি উল্লেখও হয়েছে সেটির সনদ (ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র) সর্বসম্মত হাদীস বিশারদগণের অনুসন্ধান মতে খুবই দুর্বল। রিজালশাস্ত্রের অন্যতম স্কলার ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন মঈন, ইবনে আদী, ইমাম বুখারী, আবু যুর’আ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণও বর্ণনাটির রাবীগণের কঠোর সমালোচনা করেছেন [ইমাম যাহাবী (রহ:) রচিত ‘মীযানুল ইতিদাল’ ৩/৬৭ দ্রষ্টব্য]। শায়খ আলবানী (রহ:) লিখেছেন, এর সূত্র খুবই দুর্বল ও বানোয়াট (ইমাম ইবনে আবী আ’ছেম রচিত কিতাবুস সুন্নাহ’র তাহ্কিক শায়খ আলবানীর ‘যিলালুল জুন্নাহ ফী তাখরীজিস্ সুন্নাহ ১/৩০৬ দ্রষ্টব্য)। ফলে বর্ণনার ঐ কথাগুলো প্রকৃতপক্ষে রাসূল (সা:)-এরই কথা কিনা তা নিশ্চিত নয়, বরং সন্দেহজনক।

পক্ষান্তরে প্রাচীনতম বরেণ্য তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে সামরকন্দী”-তে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর ক্ষেত্রে ‘উম্মতে মুহাম্মদীয়া’য় শামিল হতে চেয়ে প্রার্থনা করার কথা রয়েছে সেটির সূত্র (Chain of narration) সম্পর্কে কোনো স্কলার থেকে নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যায়না। বরং সিয়াহ সিত্তাহ’র অনেকগুলো হাদীসের আলোকে বর্ণনাটির কথাগুলো গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে মজবুত সমর্থন পাওয়া যায়। ফলে এর সনদ অপরাপর বর্ণনাগুলোর সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় ‘হাসান লি-গয়রিহি’ (উসূলে হাদীসের পরিভাষায় যে হাদীসের সূত্র বিশুদ্ধ হওয়ার পার্সেন্টেজ ৯৯% তাকে হাসান হাদীস বলে – লিখক) স্তরে উন্নীত।

  • ১. পবিত্র কুরআনের ইংগিত দ্বারাও ঈসা আঃ এখনো জীবিত থাকার প্রমাণ Click
  • ২. ঈসা আ: -কে আকাশে জীবিত উঠিয়ে নেয়া ও সেখান থেকে অচিরেই নাযিল হওয়া মর্মে কয়েকটি হাদীস Click
  • প্রথমেই হযরত ঈসা (আ:) সম্পর্কিত বর্ণনাটির সম্পূর্ণ অনুবাদ পেশ করছি। যারা আরবি বুঝেন তাদের জন্য তাফসীরে সামরকন্দীর উক্ত পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট দিয়ে রাখলাম :

আরবীটা দেখুন,

قوله تعالى: (اذ قال الله يا عيسى انى متوفيك و رافعك إلى) ففى الآية تقديم و تاخير و معناه انى رافعك من الدنيا إلى السماء، و متوفيك بعد أن تنزل من السماء على عهد الدجال . و يقال انه ينزل و يتزوج امرأة من العرب بعد ما يقتل الدجال، و تلد له ابنة فتموت ابنته، ثم يموت هو بعدما يعيش سنين، لأنه قد سأل ربه أن يجعله من هذه الأمة فاستجاب الله دعاه- (تفسير السمرقندي المسمى بحر العلوم لأبي الليث نصر بن محمد بن إبراهيم/السمرقندي، المتوفى سنة ٣٧٥. جلد ١ رقم الصفحة ٢٧٢ سورة آل عمران الآيات ٥٥-٥٨).

বাংলায় অনুবাদ দেখুন,

অর্থ, ‘আল্লাহতালার বাণী : যখন আল্লাহতালা বললেন, হে ঈসা নিশ্চয় আমি তোমাকে নিয়ে নিচ্ছি এবং তোমাকে নিজের কাছে তুলিয়া লইতেছি।’ (কুরআন ০৩:৫৫; অনুবাদ, মির্যায়ী প্রথম খলিফা হেকিম নূরুদ্দিন কৃত তাসদীকে বারাহীনে আহমদিয়া ১/৮) আয়াতটিতে অগ্রপশ্চাৎ হয়ে আছে। তার অর্থ নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পৃথিবী থেকে আকাশে তুলিয়া লইতেছি এবং দাজ্জালের সমসাময়িক কালে আকাশ থেকে নাযিল করার পর তোমাকে নিয়ে নিচ্ছি। বলা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই তিনি নাযিল হবেন, দাজ্জালকে হত্যা করার পর আরবের কোনো এক মহিলাকে বিবাহ করবেন, উনার এক কন্যা সন্তানের জন্ম হবে অতপর তিনি বছর কতেক শেষে মৃত্যুবরণ করবেন। কেননা তিনি (ঈসা) স্বীয় প্রভুর নিকট এই উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মদীয়া) অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেন। ফলে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন।’

বাংলা অনুবাদ সমাপ্ত হল।

(রেফারেন্স, তাফসীরে সামরকন্দী, যার অপর নাম বাহরুল উলূম। রচিতা ইমামুল হুদা আবুল লাইস নাসির বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন ইবরাহীম আস-সামরকন্দী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মৃত ৩৭৫ হিজরী, খন্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ২৭২; সূরা আলে ইমরান আয়াত ৫৫-৫৮)।

স্ক্রিনশট : তাফসীরে সামরকন্দী ১/২৭২, সূরা আলে ইমরান

দৃষ্টি আকর্ষণ, পাঠকবৃন্দ! আপনারা খুবই লক্ষ্য করেছেন যে, পরিষ্কার শব্দে উল্লেখ রয়েছে যে, لأنه قد سأل ربه أن يجعله من هذه الأمة فاستجاب الله دعاه অর্থাৎ তিনি (ঈসা) স্বীয় প্রভুর নিকট এই উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মদীয়া) অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেন। ফলে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন।’ আশাকরি, দলিল পেয়েছেন।

এবার তাফসীরে সামরকন্দী (রহ:) এর লিখক সম্পর্কে অতিব সংক্ষেপে জেনে নেব, বিস্তারিত আন্তর্জাতিক বিশ্বকোষ ‘উইকিপিডিয়া‘ থেকেও দেখে নিতে পারেন!

তাফসীরে সামরকন্দী (রহ:) এর লিখকের নাম ইমাম নাসির বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন ইবরাহীম। রাশিয়ার সামরকন্দ শহরে জন্ম। তিনি আবুল লাইস আস-সামরকন্দী নামে পরিচিত। আজ থেকে ১০৩৪ বছর আগে ৩৭৩/৩৭৫ হিজরীতে আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগে ইন্তেকাল করেন। তিনি ইসলামি বিশ্বে তদানীন্তন সময়কার ‘ইমামুল হুদা’ তথা হিদায়াতের ইমাম’ উপাধিতে ভূষিত হন।

এবার উল্লিখিত বর্ণনার সমর্থনে নিচে কয়েকটি হাদীস পেশ করছি। যাতে জ্ঞানীদের নিকট বর্ণনাটির কথাগুলো আরো দৃঢ়তার সাথে প্রমাণিত হয়ে যায়।

  • ১. একটি হাদীসে এসেছে, ‘ছুম্মা ইয়ানযিলু ঈসা ইবনু মারইয়ামা মুছাদ্দিকান বি-মুহাম্মাদিন ও আ’লা মিল্লাতিহী’ (আরবী : ثم ينزل عيسى بن مريم مصدقا بمحمد و على ملته)। অর্থাৎ তারপর ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) নাযিল হবেন মুহাম্মদ (সা:)-কে সত্যায়নকারী হিসেবে ও তাঁরই উম্মত হয়ে। (আল-মু’জামুল আওসাত হাদীস নং ৪৫৮০; হাদীসের মান : হাসান)।
  • ২. মেরাজের একটি হাদীসে উল্লেখ আছে “ফা রুদ্দাল হাদীসু ইলা ঈসা ইবনে মরিয়ম ফা-ক্বলা ক্বদ ও’হিদা ইলাইয়্যা ফী-মা দূনা ওয়াজবাতিহা ফা-আম্মা ওয়াজবাতুহা ফা-লা ই’য়ালামুহা ইল্লাল্লাহু” (আরবী : فرد الحديث إلى عيسى ابن مريم قال‏:‏ قد عهد إلي فيما دون وجبتها فأما وجبتها فلا يعلمها إلا الله عز وجل)। অর্থাৎ অতপর কেয়ামতের বিষয়টি ঈসা (আ:)-এর নিকট পেশ করা হলে তিনি বলেন, আমার থেকে কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দুনিয়াতে ফেরার প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু কেয়ামতের সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নেই। (সুনানু ইবনে মাজাহ : হাদীস নং ৪০৮১)।
  • ৩. মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক স্বীকৃত ৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রহ:) লিখেছেন, ‘আ’ন ইবনে আব্বাস মাদ্দা ফী উমরিহি হাত্তা আহবাত্বা মিনাস সামায়ি ইলাল আরদি ওয়া ইয়াক্বতুলুদ দাজ্জাল’ (আরবী : ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﻣﺪ ﻓﻲ ﻋﻤﺮﻩ ﺣﺘﻰ ﺍﻫﺒﻂ ﻣﻦ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﻲ ﺍﻷﺭﺽ ﻭ ﻳﻘﺘﻞ ﺍﻟﺪﺟﺎﻝ)। অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর (ঈসা) আয়ুষ্কাল বিলম্বিত করে দিয়েছেন। তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। (দুররে মানছূর ২/৩৫০)।

মনে রাখতে হবে যে, ঈসা (আ:) ছাড়া অন্য আর কোনো নবী দুনিয়াতে ফেরার কথা বলেননি। সুতরাং এতেও প্রমাণিত হয় যে, আকাশে ঈসা (আ:) অন্য নবীদের মত শুধুই আত্মিকভাবে নন, বরং সশরীরেই জীবিত আছেন। সে সাথে এটিও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, হযরত ঈসা (আ:) কর্তৃক স্বীয় প্রভুর নিকট এই উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মদীয়া) অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করা এবং সেটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক কবুল হওয়ার বিষয়টি একদম সত্য ও প্রমাণিত।

লিখার পরিধি সংক্ষেপ রাখতে আজ এটুকুর মধ্যেই ইতি টানছি। আমার কাজ হল, সত্যটা সাহস করে তুলে ধরা। এবার সেটি কে গ্রহণ করল আর কে করল না সেটি আমার দেখার বিষয় নয়। সবাইকে ধন্যবাদ। ওয়াসসালাম।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
তাং ২৬/১২/২০২০ ইং

ঈসা (আ:) কি খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না?

কাদিয়ানীদের বইতে ঈসা (আ:)-কে মৃত প্রমাণের উদ্দেশ্যে উত্থাপিত একটি প্রশ্ন ও তার খন্ডনমূলক জবাব

কাদিয়ানী মুরুব্বী শাহ মুস্তাফিজুর রহমান রচিত ‘ঈসা আঃ এর মৃত্যুতে ইসলামের বিজয়’ বইয়ের খন্ডনে আমার রচিত ‘ঈসা আঃ এর মৃত্যু শেষ যুগে হবে’ বই থেকে নিচের উত্তরটি নেয়া।

প্রশ্ন :

খ্রিষ্টানদের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পর্কে কেয়ামতের দিনে এ ব্যাপারে আল্লাহ তাঁকে (ঈসা) অবহিত না করা পর্যন্ত ঈসা (আ:) তাঁর অনুসারীদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে কিছুই জানবেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঈসা (আ:) যদি পুনরায় পৃথিবীতে আসেন, তাহলে কি তিনি দেখতে পাবেন না যে, খ্রিষ্টানরা তাঁকে খোদার পুত্র বানিয়ে তাঁর পূজা করছে? শিরক করছে? অবশ্যই দেখতে পাবেন এবং পৃথিবীতে পুনরায় এসে খ্রিষ্টানদের এই অধঃপতিত অবস্থা দেখে তাঁর পক্ষে খোদার কাছে একথা বলা কি সম্ভব হবে যে, তিনি এসব ব্যাপারে কিছুই জানতেন না? সম্ভব হবে না। কাজেই এক্ষেত্রে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত এটাই হবে যে, ঈসা (আ:)-এর ওফাতের পরেই খ্রিষ্টানরা শিরকে লিপ্ত হয়েছে, ধর্মচ্যুত হয়েছে।

খন্ডনমূলক জবাব :

সত্য বলতে, কাদিয়ানী মুস্তাফিজুর তিনি তার বইটিতে মির্যা কাদিয়ানীর ‘আল ওসীয়্যত’ (বাংলা অনূদিত) বইটির “তখন আবার আমি কিভাবে জানতাম যে, আমার পরে তারা কোন্ বিপথগামিতায় নিপতিত হয়েছিল” (পৃষ্ঠা নং ১৫) বিকৃত অনুবাদেরই চর্বিতচর্বন করে উপরের যুক্তিটার গোড়াপত্তন করেছেন। মির্যার বইগুলো এ সমস্ত আরো বহু আকর্ষণীয় মিথ্যা আর যুক্তিতে ভরপুর, যা লোকাল কোনো মৌলভীর পক্ষে ধরতে পারা সম্ভব নয়। এখানে পবিত্র কুরআনের নামে মির্যা কাদিয়ানীর মোটাদাগে দুইটি মিথ্যা তুলে ধরব।

[মিথ্যা : ১] আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে কেয়ামতের দিন অবহিত করবেন—এটি মির্যা কাদিয়ানীর সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।

[মিথ্যা : ২] ঈসা (আ:) এসব ব্যাপারে কিছুই জানতেন না—এটিও ঈসা (আ:) এর নামে মির্যা কাদিয়ানীর জঘন্য মিথ্যা কথা।

একটু পরেই আমি তাদের সেসব জঘন্য মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করব, ইনশাআল্লাহ। তার আগে পবিত্র কুরআনের সেই আয়াতদুটির অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে অনূদিত কুরআনুল কারীম থেকে নিচে উল্লেখ করছি। আল্লাহতালা বলেন:

“[১১৬] আল্লাহ যখন (কেয়ামতের দিন) বলিবেন, হে মারইয়াম তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলিয়াছিলে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহ রূপে গ্রহণ কর? সে বলিবে, তুমিই মহিমান্বিত! যাহা বলার অধিকার আমার নাই তাহা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়। যদি আমি তাহা বলিতাম তবে তুমি তো তাহা জানিতে। আমার অন্তরের কথা তো তুমি অবগত আছ, কিন্তু তোমার অন্তরের কথা আমি অবগত নই; তুমি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।

[১১৭] তুমি আমাকে যে আদেশ করিয়াছ তাহা ব্যতীত তাহাদের আমি কিছুই বলি নাই, তাহা এই : ‘তোমরা আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদত কর এবং যতদিন আমি তাহাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাহাদের কার্যকলাপের সাক্ষী; কিন্তু যখন তুমি আমাকে তুলিয়া লইলে তখন তুমিই তো ছিলে তাহাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাধায়ক এবং তুমিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী’।”

বিজ্ঞপাঠক! এবার নিজেরাই ভেবে দেখুন, তারা উপরে যেই দুইখানা যুক্তি প্রদর্শন করলো আয়াতের সাথে তার সম্পর্ক কোথায়? উফ! কত নিকৃষ্ট মিথ্যাচার! কে জানে কত সহজ-সরল মুসলমান তাদের এই গোবেলসীয় মিথ্যার বলি হয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছে!!

এবার তাদের সেই দুইখানা মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করতে তাদের উদ্দেশ্যে মাত্র তিন (৩)টি পাল্টা প্রশ্ন :

  • [১] আল্লাহতায়ালা ঈসা (আ:)-কে যখন জিজ্ঞেস করবেন “তুমি কি লোকদেরকে বলিয়াছিলে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহ রূপে গ্রহণ কর”—সে সময় ঈসা (আ:) প্রতিউত্তরে কেন বলবেন যে, তুমি আমাকে যে আদেশ করিয়াছ তাহা ব্যতীত তাহাদের কিছুই বলি নাই! এতে কি প্রমাণিত হয় না যে, ঈসা (আ:) তখনও খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে জানবেন!
  • [২] ঈসা (আ:) পৃথিবীতে পুনরায় এসে খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদ অবস্থা দেখে না গেলে তিনি (লাম্মা আমাত্তানী) لما أمتني (অর্থাৎ যখন আপনি আমাকে মৃত্যুদান করলেন) এই শব্দ বাদ দিয়ে বরং (লাম্মা তাওয়াফ্ফাইতানী) لما توفيتني শব্দে কেন বলতে যাবেন? আল্লাহতায়ালা কি ভবিষ্যতের ব্যাপারে জানবেন না যে, ঈসা (আ:) ‘তাওয়াফফা’ এর ন্যায় এমন একটি দ্বৈত শব্দে বললে পরবর্তীতে মানুষের মাঝে এর প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে প্রচন্ড ঝগড়া বাধবে! এখন এর কী জবাব?
  • [৩] হাদীসে আছে, হাশরবাসীরা ঈসা (আ:) এর নিকটেও (শাফায়াতে কোবরা মুহূর্তে) শাফায়াতের আবেদন করলে তিনি তখন এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করবেন যে ‘ইন্নী উত্তুখিযতু ইলা-হান মিন দূনিল্লাহি ওয়া আন্নাহু লা ইউহিম্মুনিল ইয়াওমা ইল্লা নাফ্সী (আরবী : إنى اتخذت إلها من دون الله و أنه لا يهمنى اليوم إلا نفسى)।’ অর্থাৎ আমি আল্লাহ ব্যতীত একজন উপাস্যরূপে গৃহিত ছিলাম। তাই আজ (হাশর দিবসে) আমি শুধুমাত্র নিজেকে নিয়েই চিন্তিত। (রেফারেন্স, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, কিতাবুল বি’ছি : ১/৩৭৩; হাদীস নং ১৮৫০৪, মসনদে আবী ইয়া’লা আল-মওছলী, হাদীস নং ২২৭৪; আবুদাউদ আত্-ত্বয়ালিসী ২/২২৬ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত, হাদীসের মান : হাসান, রাবীদের সবাই সহীহাইন এর রাবী।)

তাই প্রশ্ন আসে, ঈসা (আ:) পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসা ব্যতীত হাশরের দিবসে তিনি (আ:) কিভাবে জানতে পারবেন যে, খ্রিস্টানরা তাঁকে ইলাহ তথা উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছিলো!? ভাবিয়ে তুলে কিনা?

এতেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি দ্বিতীয়বার দুনিয়াতে আগমন করবেন বলেই খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে জানতে পারবেন। সুতরাং প্রমাণিত হল, এই সমস্ত আয়াত কোনোভাবেই ঈসা (আ:)-কে দুনিয়ায় তাঁর পুন: আগমনের আগে মৃত প্রমাণ করেনা।

ফেইসবুকেও তারা বিভিন্ন সময় উক্ত প্রশ্নটি করে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। তাই তাদের খন্ডনমূলক জবাবে লিখাটি লিখতে হল। কয়েকজনের কমেন্টের স্ক্রিনশট

আল্লাহতালা সরলমনা ও ইসলামি আকীদায় অপরিপক্ক এবং বিভ্রান্ত সকল কাদিয়ানীবন্ধুকে ইসলামের মূলধারায় ফিরে আসার তাওফিক দিন!

  • কাদিয়ানীদের বইতে পবিত্র কুরআনের ত্রিশ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব পড়ুন Click

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

আল্লাহ’র দিক কোনটি? কাদিয়ানীদের প্রশ্নের উত্তর

আল্লাহর দিক কোনটি? কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যমূলক একটি প্রশ্ন ও আমার জবাব

আপনি যখন পবিত্র কুরআন খুলেই তাদের (কাদিয়ানীদের) ভ্রান্ত আকীদার দাঁতভাঙা জবাব দিতে বলবেন যে, ভালো করে দেখুন, পবিত্র কুরআন বলছে,

(সূরা নিসা আয়াত ১৫৭) ‘চক্রান্তকারী ইহুদীরা ঈসা (আ:)-কে না হত্যা করেছিল আর না ক্রুশবিদ্ধও করেছিল; (শুধু ধাঁধার কারণে) তাদের কাছে এমনি একটা কিছু মনে হয়েছিল; (সঠিক ঘটনা না জানার কারণে) যারা এ ব্যাপারে মতবিরোধ করেছিল, তারাও (এতে করে) সন্দেহে পড়ে গেল, আর এ ব্যাপারে তাদের অনুমানের অনুসরণ করা ছাড়া সঠিক কোনো জ্ঞানই ছিলনা, (তবে) এটুকু নিশ্চিত, তারা তাকে হত্যা করেনি। (আয়াত ১৫৮) বরং আল্লাহ তায়ালাই তাকে তাঁর নিজের কাছে [কেউ কেউ অর্থ করেছেন, নিজের দিকে – লিখক] তুলে নিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা মহাপরাক্রমশালী ও মহাপ্রজ্ঞাময়।৷ – আল কুরআন।

কাদিয়ানীরা এইরূপ অকাট্য দলিলের মুকাবিলায় পুরোদস্তুর অক্ষম হয়ে সরলমনা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে প্রশ্ন তুলে ‘আল্লাহর দিক কোনটি? তিনি তাঁকে তাঁর কোন্ দিকে তুলিয়া লইয়াছেন?’

তখন আমরাও তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করি,

পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে تعرج الملائكة و الروح اليه (তা’রুজুল মালা-ইকাতু ওয়াররূহু ইলাইহি) অর্থাৎ ফেরেশতারা এবং রূহ (জিব্রাইল) আল্লাহর দিকে আরোহন করেন এমন একটি দিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর (সূরা মা’আরিজ/৭০:০৪)।

এখানে ফেরেশতারা আল্লাহর কোন্ দিকে আরোহন করে বলা হল, বলুন! তখন তাদের কাছে আর কোনো জবাব থাকেনা।

রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) ‘আল্লাহর দিকে উঠিয়ে নেয়া’ এর কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন?

উত্তর হল, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) সহ প্রায় সমস্ত তাফসীরকারক অসংখ্য সহীহ হাদীসের আলোকে বলেছেন, ঈসা (আ:)-কে ‘আল্লাহর দিকে’ উঠিয়ে নেয়া হয় বলতে ‘আকাশে’ উঠিয়ে নেয়াই উদ্দেশ্য।

যেমন ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, ঈসা (আ:)-কে যখন পাকড়াও করতে ইহুদীরা একত্রিত হল তখন আল্লাহতায়ালা তাঁকে উদ্দেশ্য করে জানিয়ে দিলেন بانه يرفعه الى السماء و يطهره من صحبة اليهود অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে আকাশে তুলে নেবেন এবং ইহুদীদের নাগাল পাওয়া থেকে তাঁকে মুক্ত রাখবেন। (রেফারেন্স : ইমাম নাসায়ী সংকলিত হাদীসের কিতাব আস-সুনানুল কোবরা, হাদীস নং ১১৫৯০; তাফসীরে বায়দ্বাভী ২/১৮১)।

এবার ‘আল্লাহর দিক কোনটি’ একথার ব্যাখ্যা খোদ মির্যা কাদিয়ানী সাহেব কী দিয়েছেন সেটি জানব!

মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের রচনাবলীর সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত রূহানী খাযায়েন এর ১৭ নং খন্ডের ১০৮ নং পৃষ্ঠা খুলুন। সেখানে তিনি ‘আল্লাহর দিক কোনটি’ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে –

خدا کی طرف اور وہ اونچی ہے جسکا مقام انتہائے عرش ہے۔ বাংলা উচ্চারণ – খোদা কি তরফ আওর উয়ো উঁচি হে জেসকা মোক্বাম ইনতিহায়ে আ’রশ হে।

অর্থাৎ খোদার দিক আর তা উপর দিক। যেটির শেষ সীমানা আরশে আজীম। (স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য)।

মির্যা কাদিয়ানীর রচনা হতেও ‘খোদার দিক’ কোনটি, এমন প্রশ্নের উত্তরে আমরা পরিষ্কার শব্দে ‘খোদার দিক যে উপর দিক যার শেষ সীমানা আরশে আজীম‘ তা প্রমাণ করতে পারলাম। চলমান বিষয়ের ইতি টেনে আজকের মত এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সত্যাটা বুঝার অতপর মানার তাওফিক দিন। আমীন।

সংক্ষেপে এটুকু।

লেখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

আমি কোন দলের মুসলিম হব?

কোন মুসলিম দলে যোগ দিব? কোনটা সঠিক? নাস্তিক এবং কাদিয়ানীদের প্রশ্নের উত্তর!

প্লিজ, ধৈর্য্য সহকারে পুরোটা পড়ুন! না পড়ে কেউই লাইক/কমেন্ট করবেন না! ভালো লাগলে শেয়ার করুন! যাতে অনেক সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি দূর হয়!

লিখাটি সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে নাস্তিকরাই বেশি পোস্ট করে। তবে এটি কপি করে পোস্ট করতে দেখেছি অনেক কাদিয়ানীকেও। উভয়ের উদ্দেশ্য যে অভিন্ন তা যে কেউই বুঝতে পারে যদি মগজটা একটু খাটায়! আমি লিখাটি হুবহু এখানে তুলে ধরে সেটির জবাব দেয়ার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ। (লিখাটি নিচে উল্লেখ করছি)।

  • মনে করুন, আমি ইসলামধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হব কিন্তু আমি কোন মুসলিম হব? শীয়া মুসলিম, সুন্নি মুসলিম, হানাফি মুসলিম, হাম্বলি মুসলিম, শাফেঈ মুসলিম, মালেকি মুসলিম, আহলে হাদিস, আহলে সুন্নাত, তরিকত, হাকিকত, মারেফাত, চিশতিয়া, নকশেবন্দিয়া, দেওবন্দী, মাজার পূজারি, পীর পূজারি ইত্যাদি কোন মুসলিম দলে যোগ দিব। কোনটা সঠিক?

আর সংবিধান হিসেবে কোনটা গ্রহণ করবো বা মেনে চলবো? কোনটা সঠিক? প্রশ্নটা তাদের কাছে যারা নামের আগে আল্লামা, মওলানা, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, শায়েখ, মাদানী, মাক্কি, পীর, সুফি, দরবেশ, সাধু অর্থাৎ যারা নিজেদের মহা পন্ডিত মনে করেন তাদের কাছে উত্তর চাই! (নাস্তিক আর কাদিয়ানিদের প্রশ্নটি সমাপ্ত হল)।

আমার জবাব,

প্রশ্নকারীকে আমার জিজ্ঞাসা, সত্যিই কি আপনি মুসলিম হতে চান? তাহলে নবী করীম (সা:)-এর যুগে, সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের যুগে যারা মুসলিম হয়েছিলেন আপনি অন্তত তাদের মত মুসলিম হয়ে যান। কেননা, সূরা বাকারা’র মধ্যে آمنوا كما آمن الناس -(অর্থাৎ তোমরা ঈমান আনয়ন করো যেরূপ এই লোকেরা ঈমান এনেছে) উল্লেখ আছে। এই আয়াত পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, ঈমান আনতে হবে সাহাবায়ে কেরামের ন্যায়। ‘তাফসীরে তাবারী’ সহ সকল তাফসীরকারকের মতে, উক্ত আয়াতে الناس -(আন-নাস) হতে সাহাবায়ে কেরামের কথাই বুঝানো হয়েছে।

তাফসীরে তাবারী হতে ‘আন-নাস’ এর ব্যাখ্যা : عن ابن مسعود و عن ناس من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم অর্থ আয়াতে ‘আন-নাস’ দ্বারা মুহাম্মদ (সা:)-এর সাহাবীদের বুুুুুঝানোই উদ্দেশ্য। Click in here

আপনার প্রশ্ন ছিল, ‘কোন মুসলিম দলে যোগ দেব‘। কোনটা সঠিক?

উত্তরে বলব, আপনি সাহাবায়ে কেরামের ঈমান ও আমলের আদলে বর্তমানে যাদের ঈমান ও আমলের মিল দেখতে পাবেন আপনার উপর জরুরি হয়ে পড়বে তাদের দলে যোগ দেয়া। আশাকরি জবাব পেয়েছেন!

এবার হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, উপরে উল্লিখিত মুসলিম দলগুলোর কী হবে? তারা কি মুসলিম নন?

এর উত্তরে আমিও যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি উল্লিখিত মুসলিম দলগুলোর মধ্যে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, এলডিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাসদ, বাসদ, গণফোরাম, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, জামাতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট ইত্যাদি আরো যা যা আছে—তাদেরকেও কিজন্য অন্তর্ভুক্ত করলেন না? তবে কি আপনি এদেরকে মুসলিম মনে করেন না?

এখন হয়ত বলবেন, আরে ভাই এগুলো তো রাজনৈতিক দল! এগুলো কি ওগুলোর ভেতরে থাকার মত?

ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার কথাতেই আসা যাক। তাহলে আপনি ওগুলোর মধ্যে হানাফি মুসলিম, হাম্বলি মুসলিম, শাফেঈ মুসলিম, মালেকি মুসলিম এগুলোও টানলেন কেন? এগুলো তো ভিন্ন ভিন্ন কোনো মুসলিম ফেরকা নয়! বরং এগুলো হচ্ছে, চারটা ফিকহি গবেষণা (মাযহাব) মাত্র। উল্লেখ্য, শরীয়তের ইখতিলাফি মাসয়ালায় গবেষক ইমামদের গবেষণামূলক ফতুয়াকে মাযহাব বলে। মাযহাব কিন্তু আরো বহু ছিল। তন্মধ্যে ইমাম সুফিয়ান আস-সাওরি, দাউদে জাহেরি, ইমাম ইসহাক প্রমুখ এর মাযহাব অন্যতম। কিন্তু নানা কারণে ঐ চারটা মাযহাব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং উম্মতে মুসলিমার মধ্যে কুরআন হাদীসের পর অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে।

বলতে পারেন, আরে ভাই মাযহাব আবার কী? আমি বলব, আপনার সমস্যা তো এখানেই। আপনি তো মাযহাবই বুঝেন না! মাযহাব এর সংজ্ঞা কী? উৎপত্তি কখন থেকে এবং কিভাবে ও কেন? এসব পড়াশোনা ছাড়াই আপনি কিভাবে বুঝবেন যে, মাযহাব কী? সুতরাং এজন্য আপনার মত আমিও কি বলতে পারিনা যে, এমতাবস্থায় এগুলো কি ওগুলোর ভেতরে থাকার মত?

তারপর ওই একই কারণে আপনি ওগুলোর মধ্যে আহলে হাদিস, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, তরিকত, হাকিকত, মারেফাত, চিশতিয়া, নকশেবন্দিয়া, দেওবন্দী ইত্যাদি এগুলোও টেনে আনতে পারেন না! তার কারণ, আহলে হাদীস এটি পবিত্র কুরআনের পর হাদীসের উপর আমল করার বিষয়ে জোরদার ভুমিকা পালনকারী মুসলিমদেরই একটি অংশ। এরা সালাফি কিংবা হাম্বলি মাযহাবের ফিকহের আদলে সৃষ্ট একটি আধুনিক মুসলিম জনগোষ্ঠী। যারা সব সময় শিরক বিদয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীন ও সদা তৎপর। ফলে এঁদের ভিন্ন ভাবে চিত্রায়িত করার কোনো সুযোগই নেই। সুতরাং এজন্য আপনার মত আমিও কি বলতে পারিনা যে, এমতাবস্থায় এগুলো কি ওগুলোর ভেতরে থাকার মত?

তারপর ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত‘ এর নামও দেখা যাচ্ছে। এখানে বলে রাখতে চাই, এই নামে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক সংগঠনও রয়েছে। যারা ইসলামিক ফ্রন্ট (দলটির প্রতীক মোমবাতি – লিখক) নামেও আখ্যায়িত। এমতাবস্থায় এটিও একই বিচারে ওগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনা!

তারপর তরিকত, হাকিকত, মারেফাত, চিশতিয়া, নকশেবন্দিয়া ইত্যাদি এগুলো ইসলামের একটি বিভাগ তাসাউফ এর কয়েকটি পদ্ধতির ভিন্ন ভিন্ন নাম। যেমন বাংলাদেশ সরকারের অনেকগুলো মন্ত্রনালয়ের মধ্যে একটি মন্ত্রণালয় হল অর্থ-মন্ত্রনালয়। মনে করুন, তাসাউফটাও ইসলামের তেমনি একটি আত্মশুদ্ধি-মূলক বিভাগ। সেহেতু এটিও একই বিচারে ওগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনা! উল্লেখ্য, “তরিকত” আলাদা কিছু না, বরং তাসাউফ এরই একটি সংক্ষিপ্ত আরবী নাম।

তারপর ‘দেওবন্দী‘। এর ন্যায় আপনি আরো অনেক শব্দও উল্লেখ করতে পারতেন। তন্মধ্যে বেরলবি, ফুলতুলি, সোনাকান্দা, শরশীনা, জৈনপুরী, ফুরফুরা, আজানগাছি ইত্যাদি অন্যতম। এগুলো নামে ভিন্ন ভিন্ন হলেও মূলে সব একই। আকায়েদুল ইসলামিয়্যাহ এর ক্ষেত্রে এদের সবাই অভিন্ন মতানুসারী। ফলে ইসলামি স্কলারশিপদের পরিভাষায় এগুলো “মানহাজ” (MANHAJ) নামেই পরিচিত। যার সোজাসাপটা অর্থ, চয়েস বা শরীয়তসম্মত পছন্দনীয় পন্থা।

যেমন, কারো টুপি গোল, কারোটা উঁচা, কারো দুই কলি, কারোটা পাঁচ কলি, কারোটা হলুদ, কারো বা সবুজ ইত্যাদি। তবে হ্যাঁ, আকায়েদুল ইসলামিয়্যা এর মধ্যে যেসব বিষয়ে স্কলারশিপদের জন্য সালাফের নির্দেশিত পন্থায় সুস্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে ভিন্ন মত পোষণ করার সুযোগ রয়েছে সেটি ভিন্ন কথা। যেমন, আল্লাহ হাজের। এর তাৎপর্য কারো মতে, আল্লাহ’র ইলম সর্বত্রে হাজির, জাত নয়। কারো মতে, এর তাৎপর্য হল, আল্লাহতায়ালা আপনা ক্ষমতাবলে আরশ সহ সৃষ্টি জগতের সর্বত্রে হাজির তা ঠিক, কিন্তু সেটির ধরণ কেমন তা আমাদের জানা নেই। বলে রাখা দরকার, কোনো ব্যক্তি বিশেষের নিজেস্ব ভুল আকীদা কখনো ইসলাম বা মুসলিম বিশ্বের উপর বর্তাবেনা।

যাইহোক, বলতে ছিলাম এর প্রত্যেকটি যদিও বা নামে ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু মূলে একই। যেমন উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগ ইত্যাদি এগুলো নামে ভিন্ন ভিন্ন হলেও গোড়ায় সবাই আওয়ামীলীগ। কেননা আওয়ামীলীগ এর দলীয় গঠনতন্ত্রের বাহিরে এদের কেউই ব্যতিক্রম কোনো চেতনা বা চিন্তা লালন করেন না, করার সুযোগও নেই। এমতাবস্থায় এগুলোও একই বিচারে ওসবের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনা!

এরপর থাকল, মাজার পূজারি, পীর পূজারি। আরে জনাব! এগুলোও বুঝি টানতে গেলেন! ইসলামের কোন দলিলে মাজার বা পীর পূজাকে জায়েজ করা হল একটু বলবেন? জানি, বলতে পারবেন না। আসলে নাস্তিকদের কাজই হল যখন আশানুরূপ কোনো উপায় দেখেনা তখন এদিক-ওদিক থেকে ময়লা আবর্জনা যাই পাবে কুড়িয়ে এনে হলেও ইসলামের বদনাম করাই তাদের স্বভাব। এখানে মনে রাখতে হবে, মাজার জেয়ারত করা মানে পূজা নয়। আবার হাক্কানী পীরের হাতে তাসাউফ এর সবক নেয়াও পীর পূজা নয়। মনে রাখবেন, শব্দের অপব্যবহার করা খুবই অন্যায়।

তারপর বাকি থাকল “সুন্নি মুসলিম“। জ্বী হ্যাঁ, সুন্নী মুসলিম বলতে মুসলমানদের মূলধারার অনুসারীদেরই বুঝানো হয়ে থাকে। হাদীসের ما انا عليه و اصحابى -(নবীজী বলেন, আমি এবং আমার সাহাবীদের দল যেই মত ও পথে রয়েছি…তিরমিজি শরীফ, কিতাবুল ফিতান) শব্দেরই সংক্ষিপ্ত রূপ ‘সুন্নী মুসলিম’। যেটির দীর্ঘবাক্য, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত। হাদীসের উক্ত আবেদন মূলত পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত آمنوا كما آمن الناس -(অর্থাৎ তোমরা ঈমান আনয়ন করো যেরূপ এই লোকেরা ঈমান এনেছে) আয়াতেরই বহিঃপ্রকাশ। কাজেই, আপনাকে মুসলিম হতে হলে পবিত্র কুরআন আর হাদীসের নির্দেশনা মেনে অবশ্যই সুন্নী মুসলিমের মতই মুসলিম হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

তবে একটি কথা না বললেই নয়, তা হল এই ফেতনা ফাসাদের যুগে সুন্নী মুসলিমদের মধ্যে যে দলের ঈমান আমল আপনার বিচার-বিবেচনায় ما انا عليه و اصحابى -(মা আনা আলাইহি ওয়া আসহা-বী)-এর আদলে সুপ্রতিষ্ঠিত মনে হবে আপনার উচিত, সে দলের মুসলিমদের মধ্যে শামিল হয়ে যাওয়া। হোক সেটি দেওবন্দী, বেরলবি, আহলে হাদীস কিংবা সালাফি। মানে রাখবেন, এগুলোর প্রত্যেকটাই ইসলাম নামক ট্রেনের একেকটা বগি। আপনি যে বগিতেই থাকুন না কেন, গন্তব্যে অবশ্যই পৌঁছবেন। যদিও বা বগিগুলোর ক্লাস নিয়ে একটু বিশ্লেষণ আছে! কোনটা ফার্স্ট ক্লাস, কোনটা সেকেন্ড ক্লাস ইত্যাদি!

উল্লেখ্য, বর্তমানে সুন্নী মুসলিমরা চারটি মাযহাবে মিশে আছেন। ফলে আপনি দেওবন্দী, বেরলবি, আহলে হাদীস যেই হোন; আপনার আমল আকীদা অবশ্যই কোনো না কোনো মাযহাবের সাথে মিলে যাবেই। তার মানে মাযহাব বা মানহাজ কিংবা তাসাউফ এর কারণে মুসলিমরা শাখাগতভাবে ভিন্ন কোনো নামে চয়িত হলেও মৌলিকত্বের বিচারে এদের কেউই ইসলামের গন্ডি থেকে বহিষ্কৃত নন। সুতরাং ‘কোন মুসলিম দলে যোগ দেব’ প্রশ্নটিই বরং অবান্তর ও অজ্ঞতাবশত বৈ নয়।

এখন বাকি রইল, শীয়া। ঐতিহাসিকভাবে এর পেছনে একটা গুঢ় তাৎপর্য অবশ্যই রয়েছে। এরা ইসলামেরই একটি ফেরকা। এদের বিচারে এরাও সঠিক। তবে বর্তমানে এঁদের মধ্যে অনেক বেশি সংশোধনী এসেছে। তাদেরই চরমপন্থী রাফেজী (ইমামীয়া) যারা তাদের বাহিরে অন্যান্য শীয়া মতবাদের অনুসারীদের সাথে আহলে সুন্নাহ’র খুব বড় কোনো মতবিরোধ নেই। পাক মুফতীয়ে আজম মুফতি রফি উসমানী (রহ.) এঁদের মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত বলে মতামত দিয়েছেন। সেহিসেবে আমিও একজন সুন্নী মুসলিম হিসেবে বিশ্বাস করি যে, রাফেজি (ইমামীয়া) শীয়ারা যদিও ইসলামেরই অন্যতম একটি ফেরকা কিন্তু তারা আর যাইহোক না কেন, অন্তত ما انا عليه و اصحابى (আমি এবং আমার সাহাবীরা যে মত ও পথের উপর রয়েছে) এর আদলে সুপ্রতিষ্ঠিত মূলধারার মুসলিমদের বাহিরে। কেননা তাদের অন্যতম একটা মত হল, সাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুকরণযোগ্য নহে। ইত্যাদি। আশাকরি প্রশ্নকারী সঠিক ও যথাযথ উত্তর পেয়েছেন।

কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে আমার জিজ্ঞাসা :

এই পর্যায়ে কাদিয়ানীদের জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনারা অন্যদের মত যদি ইসলামী কোনাে ফেরকা কিংবা আহলে সুন্নাহর অন্তর্গত কোনাে মুসলিম হয়ে থাকেন তাহলে মির্যা কাদিয়ানীও কলেমা’র মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র মর্মার্থে শামিল—এমন কুফুরী কথাও আপনাদের ‘কালিমাতুল ফছল’ বইতে উল্লেখ থাকবে কেন? কিংবা মির্যা কাদিয়ানীকে ত্যাগ করার দরুন কোনাে ব্যক্তি মুরতাদ আখ্যায়িত হবে কেন?

ডকুমেন্ট সহ দেখতে ক্লিক করুন : ক্লিক

তাই অপ্রিয় হলেও সত্য, সাধারণ কাদিয়ানীদের বুঝে আসুক বা না আসুক, সত্য এটাই যে, কাদিয়ানীয়ত নতুন একটি ধর্ম। ফলে এটি ইসলামের কোনাে ফেরকারই অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব যারা এখনাে এই দলের অন্তর্ভুক্ত আছেন তাদের উচিৎ, আমার কথাগুলাে নিজ দায়িত্বে ও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যাচাই করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা। আল্লাহতালা সবাইকে বুঝার তাওফিক দিন।

কাদিয়ানীরা কম-বেশী বর্তমানে ১৪ দলে বিভক্ত এবং তাদের প্রত্যেকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটগুলোও ভিন্ন ভিন্ন : ক্লিক

লিখাটির কোথাও কোনোভাবে ভুল হলে সেজন্য আমিই দায়ী থাকব। ভুল ধরে দিলে অবশ্যই সংশোধন করে নেব।

ওয়াসসালাম।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
এডমিন www.markajomar.org
কাদিয়ানী বিষয়ক স্পেশালিষ্ট গবেষক ও লিখক।

ত্রিশ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব

ত্রিশ আয়াতের অপব্যাখ্যা খণ্ডন-বইটি ডাউনলোড করুন।

ত্রিশ (৩০) আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব :

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

প্রথমে প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নের এডভান্স উত্তর দেয়া হবে। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বইতে লিখা আছে, ‘তাওয়াফফী’ এমন কোনো শব্দ নয় যার তাফসীর কেউ নিজ ইচ্ছেমতো করতে পারে। (হামামাতুল বুশরা ৯৯ [বাংলা])। তিনি এর ব্যাখ্যাকারী হিসেবে কুরআন, হাদীস এবং সাহাবাদের তাফসীরসহ যুগ-ইমামগণের মতের প্রয়োজন রয়েছে বলে লিখে গেছেন। সুতরাং এখানে শব্দটির বিশ্লেষণ অনুরূপভাবেই করা হবে যাতে কোনো কাদিয়ানী আপত্তি তুলতে না পারে।

বইটি কুরিয়ার সার্ভিস যোগে পাঠানো হয়। ০১৬২৯-৯৪১৭৭৩

প্রশ্ন হতে পারে যে, সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৫৫ এর ন্যায় শব্দের আগ-পাছ করে মর্মার্থ নেয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত কুরআন মাজীদে রয়েছে কিনা? এর উত্তর হল, জ্বী হ্যাঁ। এমনি ধরণের বিশেষ বিশেষ রহস্যের কারণে শব্দ আগে-পিছে হওয়ার ভুরি ভুরি নজির কুরআন মাজীদে রয়েছে। তন্মধ্যে সূরা আলে ইমরান এর ৪৩ নং আয়াত অন্যতম। আল্লাহতালা মরিয়ম (আ:) সম্পর্কে বলেন, واسجدى واركعى مع الراكعين অর্থাৎ তুমি সিজদা কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। এখানে প্রথমে সেজদা তারপর রুকুর কথা আসছে। রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (সা.) থেকেই শব্দ আগে-পিছে করে মর্মার্থ নেয়ার প্রমাণ রয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব তাফসীরগ্রন্থে।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তবে কেন আল্লাহতালা মুহাম্মদ (সা:)-কে আকাশে নেননি?

এর জবাব মির্যা কাদিয়ানীর বই থেকে দিচ্ছি। মির্যা সাহেব লিখেছেন : “মুহাম্মদ (সা:)-কে মে’রাজের রাতে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। সকল সাহাবীর এটাই বিশ্বাস।” (রূহানী খাযায়েন ৩/২৪৭)। সুতরাং বুঝা গেল, আল্লাহতালা তাঁর প্রিয় হাবীবকেও আকাশে নেননি বলা আপনার পুরোপুরি অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই না।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে আল্লাহতালা বিশেষভাবে ঈসা (আ:)-কে কেন এজন্য নির্বাচিত করলেন?

আমরা এর জবাব বিখ্যাত মুফাসসির আবুল লাইস সামরকন্দী (রহ:)-এর কিতাব থেকে জেনে নেব যিনি আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে ৩৭৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহান ইমাম কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত ‘তাফসীরে সামরকন্দী’ এর ১ম খন্ডের ২৭২ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে ‘ঈসা (আ:) আল্লাহর নিকট শেষনবীর উম্মত হতে চেয়ে দোয়া করেছিলেন। তাই আল্লাহতালা তাঁর উক্ত দোয়া কবুল করেছেন।’ (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৫৫ এর তাফসীর অংশ দ্রষ্টব্য)।

আপনি আরও প্রশ্ন করতে পারেন, ‘আল্লাহর দিক কোনটি? তিনি তাঁকে তাঁর কোন্ দিকে তুলিয়া লইয়াছেন?’

জবাব এই যে, পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে تعرج الملائكة و الروح اليه (তা’রুজুল মালা-ইকাতু ওয়াররূহু ইলাইহি) অর্থাৎ ফেরেশতারা এবং রূহ (জিবরাইল) আল্লাহর দিকে আরোহন করেন এমন একটি দিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর (সূরা মা’আরিজ/৭০:০৪)। এখানে ফেরেশতারা আল্লাহ’র কোন্ দিকে আরোহন করে বলা হল, বলুন! আশা করি জবাব পেয়ে গেছেন।

এই প্রশ্নের আরেকটি উত্তর হল, মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলীর সমষ্টি ‘রূহানী খাযায়েন’ (১৭:১০৮) এর মধ্যে পরিষ্কার লিখা আছে,  خدا کی طرف اور وہ اونچی ہے جسکا مقام انتہائے عرش ہے۔ -(বাংলা উচ্চারণ) : খোদা কি তরফ আওর উয়ো উঁচি হে জেসকা মোক্বাম ইনতিহায়ে আ’রশ হে। অর্থাৎ “খোদার দিক হল উপরের দিক। যেটির শেষ সীমানা আরশে আজীম।”

আপনি এও প্রশ্ন করতে পারেন যে, যদি মসীহ বর্তমান যুগ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ না করে থাকেন সেক্ষেত্রে এটাও সাব্যস্ত হবে, খ্রিস্টানরা আজ পর্যন্ত শিরিকে এবং পথ ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়নি যেভাবে ‘ফালাম্মা তাওয়াফফাইতানী কুনতা আন্তার রাকীবা আলাইহিম’ আয়াত থেকে প্রতিভাব হয়।

এর জবাব হচ্ছে প্রথমত, ঈসা (আ:) সংক্রান্ত توفى হতে যুগ-ইমামগণের কেউই ‘মৃত্যু’ অর্থ নেননি। বরং ইমাম শাওক্বানী (রহ.) ‘তাওয়াফফাইতানী’ এর মর্মার্থ সুস্পষ্ট করতে লিখেছেন, يعنى فلما رفعتنى الى السماء অর্থাৎ ‘যখন আপনি আমাকে আকাশে উঠিয়ে নিলেন।’ তাফসীরের কিতাবগুলোতে আরও উল্লেখ আছে, اى قبضتنى بالرفع الى السماء অর্থাৎ ‘আপনি আমাকে (যখন) আকাশে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে নিয়ে নিলেন।’ মনে রাখা উচিত, আয়াতটির পরেই উল্লেখ আছে ‘ওয়া ইন তাগফিরলাহুম ফা-ইন্নাকা আন্তাল আজীজুল হাকীম’ (অর্থাৎ যদি তুমি তাহাদিগকে ক্ষমা কর তাহা হইলে নিশ্চয় তুমিই মহা পরাক্রমশালী, পরম প্রজ্ঞাময়)। এখন নির্বোধরা এই আয়াতের ‘তাগফিরলাহুম’ (تغفرلهم) শব্দ নিয়েও কিজন্য চিন্তা করেনা? এখান থেকে তারা কেন শিক্ষা লাভ করেনা যে, ঈসা (আ:) কেয়ামত দিবসে যাদের পক্ষে সাক্ষী হবেন তারা শুধুমাত্র তাঁর ইহ-জীবদ্দশায় বিদ্যমান থাকা একত্ববাদী ঈসায়ীগণই উদ্দেশ্য! কারণ ঈসা (আ:) এমন কারো পক্ষে কখনোই আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হবেন না, যে মুশরিক কিংবা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী!

দ্বিতীয়ত, এবার প্রশ্নকর্তার প্রতিউত্তরে আসা যাক। সবার নিকট যে ব্যাপারটি পরিষ্কার তা হল, খ্রিস্টান ধর্ম-বিশ্বাসে ত্রিত্ববাদি মতবাদ সাধু সেন্ট পৌলই ঢুকিয়ে ছিল। মূলধারার সমস্ত মুসলমানের বিশ্বাস হল, ঈসা (আ.)-কে তাঁরই তেত্রিশ বছর বয়সে যখন সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় তারই পরবর্তী কোনো এক সময় সেন্ট পৌল খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসে ত্রিত্ববাদের মতবাদ ঢুকিয়ে দেয়। অধিকন্তু কাদিয়ানীদের মতবাদও তাই। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২০/৩৭৫)। তদুপরি তাদের (কাদিয়ানীদের) আরেকটি বিশ্বাস হচ্ছে, ঈসা (আ.) ১২০ বা ১২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই প্রশ্ন আসে, এমতাবস্থায় খ্রিস্টান ধর্ম-বিশ্বাসে বিকৃতির ঘটনা ঈসা (আ.)-এর ইহ-জীবদ্দশাতেই ঘটল না কিভাবে? সুতরাং দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, এই আয়াত (ফালাম্মা তাওয়াফফাইতানী) দ্বারাও ঈসা (আ.) মারা গিয়েছেন বলিয়া সাব্যস্ত হয় না। যাইহোক, আয়াতটির ঐ অংশের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে, ‘আর যখন আপনি আমাকে তুলিয়া লইলেন….’ (অনুবাদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। বিস্তারিত সামনে।

জনৈক কাদিয়ানীর প্রশ্ন, আল্লাহতালার বাণী: (অনুবাদ) সমস্ত আহলে কিতাব তাঁর (ঈসা) মৃত্যুর আগে আগেই তাঁর (ঈসা) প্রতি ঈমান আনবে (সূরা নিসা, আয়াত নং ১৫৯)। কিন্তু একথা সঠিক নয়। কেননা হাদীসে আছে যে, দাজ্জালের সাথে ৭০,০০০ আহ্‌লে কিতাব যোগ দেবে, আর সে নিজেও আহ্‌লে কিতাবের অন্তর্গত হবে। সে মসীহ্‌র প্রতি ঈমান আনবে না এবং কাফির অবস্থাতেই মারা যাবে। অতএব এ যুক্তি ভ্রান্ত, পক্ষান্তরে এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন। এখন এর কী উত্তর দেবেন! (উত্তর এখান থেকে পড়ুন)।

এবার দুইটি পালটা প্রশ্ন :

ক. ঈসা (আ:) ইতিপূর্বে ইন্তেকাল করে থাকলে উক্ত আয়াতে ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা “আহলে কিতাবীরা ঈমান আনবে” এ কথার কী মানে?

খ. আয়াতের ‘মওতিহি’ (موته) এর “হি” (هِ) (ইংরেজি : his) একবচনের সর্বনামপদটি ‘আহলে কিতাবী’র জন্য হয়ে থাকলে তবে ঐ আহলে কিতাবীর জন্য পরের আয়াতে ‘আলাইহিম শাহীদা’ (عَلَيْهِمْ شَهِيدًا)-এর মধ্যে কেন “হিম” (هم)  (ইংরেজি : they) বহুবচনাত্মক সর্বনাম নেয়া হল? অতএব যেহেতু একই বাক্যে একই উদ্দেশ্যের সর্বনাম বিভিন্ন হওয়া ব্যাকরণিক নীতির অন্তরায়, সেহেতু নিশ্চিতভাবে বলা যায় আয়াতে قَبْلَ مَوْتِهِ   অংশের শেষোক্ত “হি” সর্বনামটি দ্বারা আহলে-কিতাবীদের বুঝানো হয়নি, বরং এককভাবে হযরত ঈসা (আ:)-কেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে, ঈসা (আ.)-এর আগমন ‘নবী’ হিসেবে না হলে মুসলিম শরীফের হাদীসে ‘নাবিউল্লাহ’ শব্দে উল্লেখ হল কিজন্য? এর জবাবে বলব, আগমনকারী ঈসা বলতে রূপক কোনো ঈসা হবেন না, বরং তিনি বনী ইসরাইলি জাতির জন্য প্রেরিত হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)ই। যেজন্য রাসূল (সা.) তার আগমনী ভবিষ্যৎবাণীতে ‘আল্লাহর নবী ঈসা’ বলে সম্বোধন করে গেছেন, যাতে মসীহ দাবীদার ভন্ডরা সাধারণদের প্রতারিত করতে না পারে। উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বিশ্বাস হল, আগমনকারী ঈসা (আ.) নবুওয়তের দায়িত্বে থাকবেন না, বরং তিনি স্রেফ একজন “উম্মতি” হিসেবে আসবেন। কাজেই এখন কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে আমরা পালটা প্রশ্ন করতে চাই যে, আপনাদের মতানুসারে, হযরত ঈসা (আ.) এসে “নবী” হলে তখন কি তাঁর “উম্মত” ও হবেনা? অবশ্যই হবে! কারণ নবীর উম্মত থাকবেনা, এটা কিভাবে হতে পারে? এখন ‘ঈসা’ দাবীদার মির্যা কাদিয়ানীর অনুসারীরা কি নিজেদেরকে তার (অর্থাৎ মির্যা কাদিয়ানীর) উম্মত মনে করেন? কী জবাব দেবেন?

আপনি আরও প্রশ্ন করতে পারেন, ঈসা (আ:)-এর যুগে এবং তাঁরই মৃত্যুর আগে সমস্ত আহলে কিতাবী (ইহুদ-খ্রিস্টান) মুমিন হয়ে গেলে তখন পবিত্র কুরআনের ০৫:৬৪ আয়াত অনুসারে আহলে কিতাবীদের মাঝে الى يوم القيامة তথা ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ শত্রুতা সঞ্চারিত থাকে কিভাবে? (উত্তর এখান থেকে পড়ুন)।

ত্রিশ আয়াতের অপব্যাখ্যার খন্ডন শুরু হল :

মির্যা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীরা পবিত্র কুরআনের প্রায় ৩০টি আয়াতের অপব্যাখ্যা দ্বারা ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে গেছে বলে মিথ্যা দাবী করে থাকে। অথচ আয়াতগুলো নবী, সাহাবী, তাবেয়ীর সোনালী যুগেও ছিল। তাদের সকলে বিশ্বাস করতেন যে, ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু শেষ যুগে হবে। কেননা তাঁর জীবনকে আল্লাহ শেষ যামানা পর্যন্ত দীর্ঘ করে দিয়েছেন। কাজেই যে সমস্ত আয়াতের অপব্যাখ্যা দ্বারা কাদিয়ানীরা বর্তমানে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে গেছে বলে মিথ্যা দাবী করছে তারা কি তাদের উক্ত দাবীর মধ্য দিয়ে একথাও প্রমাণ করতে চাচ্ছে না যে, পবিত্র কুরআনের অনুবাদ কিংবা ব্যাখ্যা আগেকার যুগের কেউই বুঝেনি, মির্যা কাদিয়ানী আর তার বর্তমান যুগের মুরিদরাই শুধু বুঝেছেন! নাউযুবিল্লাহ।

সে যাইহোক, এখানে তাদের উল্লেখযোগ্য কিছু আয়াতের অপব্যাখ্যার খন্ডনপূর্বক সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

1 হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী ‘ইন্নী মুতাওয়াফফীকা ওয়া রাফিউকা ইলাইয়্যা’ (انى متوفيك و رافعك الى)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘হে ঈসা নিশ্চয় আমি তোমাকে নিয়ে নিচ্ছি এবং তোমাকে নিজের কাছে তুলিয়া লইতেছি….।’ (সূরা আলে ইমরান ৫৫, অনুবাদ, কাদিয়ানী খলীফা হেকিম নূরুদ্দীন কৃত ‘তাসদীকে বারাহীনে আহমদীয়া’ খ-১ পৃ-৮)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে “মুতাওয়াফফীকা” (متوفيك) শব্দটি বাবে তাফা’উল (تفعل) থেকে ইসমে ফায়েল এর ছিগাহ; অর্থ ‘তোমাকে নিয়ে নেব’ বা ‘তোমার মেয়াদকাল পূর্ণ করব’ (ভবিষ্যৎকালবাচক)। কেননা এর মূলধাতু (মাদ্দাহ) ‘ওয়াফইউ’ (وفى)। এখন জানার বিষয় হল, তাহলে ঐ নিয়ে নেয়ার ঘটনাটি কিরূপে সংঘটিত হয়েছিল? আল্লাহতালা সূরা নিসার ১৫৮ নং আয়াতে ‘রাফা’আহুল্লাহু ইলাইহি’ (رفعه الله اليه) দ্বারা সুস্পষ্টভাবে তার উত্তরও দিয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ তাঁকে উপরে (আকাশে) উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমেই নিয়ে নেয়া হয়েছে (অতিতকালবাচক)। তাই আয়াতটি দ্বারা ঈসা (আ.)-কে মৃত প্রমাণ করতে চাওয়া নিজেদের অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই না। তবে হ্যাঁ ‘তাওয়াফফা’ (توفى)-এর রূপক অর্থ মৃত্যু নেয়া হলে তখন তা বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাক্যের মধ্যে শব্দের تقديم-تأخير (আগ-পিছ)-এর নীতি গ্রহণ করতে হবে। আর তখন আয়াতটির অর্থ দাঁড়াবে, ‘ইয়ানি রাফেউকা ছুম্মা মুতাওয়াফফীকা ফী আখিরিয যামান’ (يعنى رافعك ثم متوفيك فى اخر الزمان) অর্থাৎ তোমাকে উঠিয়ে নেব অতপর শেষযুগে তোমাকে ওফাত (মৃত্যু) দেব। (ইমাম সুয়ূতী রচিত ‘দুররে মানছুর’ খ-৩ পৃ-৫৯৮; ‘মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাহ’ দ্রষ্টব্য)।

বলে রাখা জরুরী, সহীহ বুখারী’র কিতাবুল ইলম অধ্যায়ে (হা/ ৭৫ ইফা) একটি হাদীসে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা:) ইবনে আব্বাসের জন্য দোয়া করেছেন اَللَّهُمَّ عَلِّمْهُ الْكِتَابَ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে কুরআন শিখিয়ে দিন।’ এখন তাহলে চিন্তা করুন, ইবনে আব্বাস (রা.)-এর তাফসীর কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি বইয়ের সমষ্টি ও ২৩ খন্ডে প্রকাশিত রচনা-সমগ্রটির নাম ‘রূহানী খাযায়েন’ বা আধ্যাত্মিক ভান্ডার। মির্যা কাদিয়ানী সেটির প্রায় চার স্থানে ‘ইন্নী মুতাওয়াফফীকা’-এর অনুবাদের মধ্যে ‘তাওয়াফফা’ হতে ‘মৃত্যু’ অর্থ নেননি। অথচ সবখানেই শব্দটির কর্তা আল্লাহ এবং কর্ম (মাফউল) মানুষই ছিল। যথা-

  • ১. মে তুজকো পুরি নে’মত দোংগা [উর্দূ]। অর্থাৎ আমি তোমাকে পূর্ণ নেয়ামত দেব। (বারাহীনে আহমদীয়া, রূহানী খাযায়েন ১/৬২০)।
  • ২. মে তুজে কামেল আজর বখশোঁগা [উর্দূ]। অর্থাৎ আমি তোমাকে পরিপূর্ণ পুরষ্কার দেব। (বারাহীনে আহমদীয়া, রূহানী খাযায়েন ১/৬৬৪-৬৫)।
  • ৩. মে তুজে এসি যলীল অওর লা’নতি মউতুঁ চে বাছাঁওগা [উর্দূ]। অর্থাৎ আমি তোমাকে এমন অপমানকর ও অভিশপ্ত মৃত্যু হতে রক্ষা করব। (সিরাজে মুনীর, রূহানী খাযায়েন ১২/২৩)।

কিন্তু অধিকাংশ কাদিয়ানীর ‘তাওয়াফফা’ শব্দের ব্যাকরণিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার দরুন ভাবেন যে, তাদের কনসেপ্টই সঠিক, বিপরীতে সব ভুল। জেনে আরো অবাক হবেন, তাদের দৈনিক ‘আল ফজল’ [উর্দূ] (তাং ২১-আগস্ট-১৯১৭ইং) সংখ্যায় পরিষ্কার লিখা আছে যে, “কিছু মানুষ ভুলক্রমেই ‘তাওয়াফফা’র অর্থ করে মৃত্যু। কিন্তু এই অর্থ সঠিক না। বরং তার অর্থ ‘রূহ কবজ’ করা।”

কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, মির্যা সাহেব তার রচনার ঐ চার জায়গায় ‘রূহ কবজ’ অর্থটিও নেননি। ওহে আহমদী/কাদিয়ানীবন্ধুরা! একটু তো ইনসাফ করবেন!! অন্যান্য ক্ষেত্রে যে শব্দটির মৃত্যু অর্থ ত্যাগ করলেন আর সেই শব্দটিকে-ই ঈসা (আ.)-এর ক্ষেত্রে মৃত্যু অর্থে নিলেন! এটি আপনাদের কেমন ন্যায় বিচার?

কাদিয়ানীদের বইগুলোতে বাইবেল থেকে অনেক উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এখানে আমি শুধু সে হিসেবেই একটি উদ্ধৃতি টানছি। বাইবেলের নতুন নিয়মে লিখা আছে “যীশু যখন জৈতুন পর্বতমালার ওপর বসেছিলেন, তখন তাঁর শিষ্যরা একান্তে তাঁর কাছে এসে তাঁকে বললেন, আমাদের বলুন, কখন এসব ঘটবে, আর আপনার আসার এবং এযুগের শেষ পরিণতির সময় জানার চিহ্নই বা কি হবে? এর উত্তরে যীশু তাদের বললেন, ‘দেখো! কেউ যেন তোমাদের না ঠকায়। আমি তোমাদের একথা বলছি কারণ অনেকে আমার নামে আসবে আর তারা বলবে, ‘আমি খ্রীস্ট।’ আর তারা অনেক লোককে ঠকাবে।” (বাইবেল : মথি, অধ্যায় নং ২৪ পদ নং ৩-৫)। কাদিয়ানীদের নিকট বাইবেল যদি অথেনটিক কোনো সোর্স হয় তবে অন্তত যীশুর এই বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, আগমনকারী যীশুখ্রিস্ট ‘রূপক’ কেউ হবেন না।

2 হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী (بل رفعه الله اليه)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘বরং আল্লাহ তাহাকে তাহার নিকট তুলিয়া লইয়াছেন।’ (০৪:১৫৮,অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন/ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু সম্পর্কে ইংগিতেও কোনো কথা নেই। বরং এই আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহতালা নিজের অলৌকিক শক্তি দ্বারা ঈসা (আ.)-কে জীবিত অবস্থায় সশরীরে আকাশে তুলে নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল, আয়াতের কোথাও তো ‘আকাশ’ শব্দের উল্লেখ নেই, তাই এর ‘রাফা’ অর্থ শুধুমাত্র রূহ উঠিয়ে নেয়াই বুঝাল কিনা? তার জবাব হল, আয়াতের কনটেক্স বা প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করে দেখুন, এই আয়াতে ঈসাকে সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার কথাই বুঝিয়েছে। কারণ ইহুদীরা যখন উনার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র করল (কুরআন ০৩:৫৪) এবং পাকড়াও করতে তাকে ঘিরে সবাই সমবেত হল (তারীখে ইবনে আসাকীর ৪৭/৪৭২; দুররে মানছূর ৩/৫৯৫); ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী মহান আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেন। তিনি জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাঁকে এইভাবেই সাহায্য করেন এবং সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নিতে নির্দেশ করেন।

বলে রাখা জরুরী যে, রূহ উঠিয়ে নেয়ার দায়িত্বে জিবরাইল (আ.) নন, বরং আজরাইল (আ.)। দেখুন সূরা আস-সিজদাহ আয়াত নং ১১; (قل يتوفكم ملك الموت)। অথচ ঈসা (আ.)-এর ‘রাফা’ জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে আকাশে হয়েছিল। দেখুন, সহীহ মুসলিম এর সমপর্যায়ের সনদে বর্ণিত হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর হাদীস (الْبَيْتِ إِلَى السَّمَاءِ وَرُفِعَ عِيْسَى مِنْ رَوْزَنَةِ فِيْ) অর্থাৎ ‘ঈসাকে বাড়ীর বায়ুপথ (Airspace) দিয়ে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর)।

তারপর হযরত ঈসা (আ.) শেষযুগে আকাশ থেকে নাযিল হবেন, একথাও সহীহ হাদীসে এসেছে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন ثم ينزل عيسى بن مريم من السماء অর্থাৎ ‘অতপর মরিয়ম পুত্র ঈসা আকাশ থেকে নাযিল হবেন।’ দেখুন মসনাদে বাজ্জার, হাদীস নং ৯৬৪২; বিশিষ্ট হাদীসবিশারদ ইমাম নূরউদ্দীন আল হাইছামী (রহ.) লিখেছেন و رجاله رجال الصحيح غير بن المنذر و هو ثقة অর্থাৎ হাদীসটির সূত্রে উল্লিখিত সকল বর্ণনাকারী সহীহ (বুখারী)’র শুধু আলী ইবনে আল মুনযির ছাড়া, তবে তিনিও একজন বিশ্বস্থ বর্ণনাকারী। (দেখুন, মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ-৭ পৃ-৩৪৯)। এভাবে একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা যাবে যে, আগমনকারী ঈসা ‘রূপক’ কেউ নন, বরং তিনি সেই ঈসা যার সম্পর্কে স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুইজন ফেরেশতার মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে (ফিলিস্তিনে) নিচে নেমে আসবেন বলেই ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন।

3 ঈসা (আ.) কেয়ামতের দিন আল্লাহতালাকে বলবেন (فلما توفيتنى)-এর সঠিক তাৎপর্য ।

আয়াত : ‘কিন্তু যখন তুমি আমাকে তুলিয়া লইলে তখন তুমিই তো ছিলে তাহাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক এবং তুমিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী।’ (০৫:১১৭/ অনুবাদ, ইফা)।

ব্যাখ্যা : কেয়ামত দিবসে মহান আল্লাহ’র একটি প্রশ্নের প্রতিউত্তরে হযরত ঈসা (আ.) বলবেন, فلما توفيتنى অর্থাৎ ‘যখন তুমি আমাকে তাওয়াফফা করলে তথা তুলিয়া লইলে’। মির্যা কাদিয়ানীর নিকটেও যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদ হিসেবে স্বীকৃত ইমাম আল্লামা শাওক্বানী (রহ.) উক্ত আয়াতাংশের তাফসীরে লিখে গেছেনو انما المعنى فلما رفعتنى الى السماء (ওয়া ইন্নামাল মা’না ফালাম্মা রফা’তানী ইলাস সামায়ি) অর্থাৎ ‘আয়াতাংশের শুধু এ অর্থই যে, আপনি যখন আমাকে আকাশে তুলিয়া লইলেন।’ কেননা পবিত্র কুরআনে ‘তাওয়াফফা’ শব্দটি তিনখানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথাক্রমে মৃত্যু (৩৯:৪২), ঘুম (০৬:৬০) এবং রাফা বা তুলিয়া নেয়া (০৩:৫৫, ০৫: ১১৭), দেখুন, ফাতহুল ক্বাদীর ৭/৪০৬; সূরা মায়েদা ১১৭। এই ক্ষেত্রে মৃত্যু, ঘুম এবং সশরীরে উঠিয়ে নেয়া, এই সমস্ত অর্থ রূপক আর ‘নিয়ে নেয়া বা পূর্ণকরা’ (কুরআন/০৪:১৫) তার প্রকৃত অর্থ। সুতরাং আয়াতটিও কাদিয়ানীদের মতের পক্ষে দলিল হয়নি।

4 ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর আগে আগে (قبل موته) তাঁর উপর প্রত্যেক আহলে কিতাবি ঈমান আনয়ন প্রসঙ্গে ।

আয়াত : কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর (ঈসা) মৃত্যুর পূর্বে তাঁহাকে বিশ্বাস করিবেই এবং কিয়ামতের দিন সে (ইতিপূর্বে যাহারা তাঁহাকে আল্লাহর পুত্র আখ্যা দিয়েছিলো) তাহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। (০৩: ১৫৯, অনুবাদ ফছলুল খেতাম, লিখক মির্যায়ী খলীফা হেকিম নূরউদ্দীন)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াত বরং ঈসা (আ.) বর্তমানেও জীবিত থাকার পক্ষেই মজবুত দলিল। কারণ যদি বলা হয় যে, ঈসা (আ.) পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন তখন প্রশ্ন আসবে যে, তবে কি বর্তমানে আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে ঈমান আনয়ন করে মুসলমান হয়ে গেল? কিন্তু নির্বোধদের বুঝানোর সাধ্য কার? কাদিয়ানীরা এই ধরণের প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্য আয়াতের অর্থ নেয় এই রূপ : ‘আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী ক্রুশীয় ঘটনার উপর ঈমান আনবে।’ কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, তারা নিজ নিজ ক্রুশীয় ঘটনার উপর তো এখনো বিশ্বাসী হয়ে আছে। তাহলে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ মৃত্যুর পূর্বে ক্রুশীয় ঘটনার উপর ঈমান আনয়নের অর্থ কি ঐ একই বিশ্বাসের উপর অটল থাকা? যদি তাই হয় তাহলে নিজেদের মৃত্যুর পূর্বের ঈমান আর জীবদ্দশাতে ধারণকৃত ঈমান এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়? সুতরাং এই আয়াত দিয়েও মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে চাওয়া পুরোপুরি বাতিল, সত্যের সাথে যার লেশমাত্র সম্পর্কও নেই। এই পর্যায় কাদিয়ানীদের প্রাসঙ্গিক বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি আমার ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখেছি। নিচে টীকা দ্রষ্টব্য।

5 ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী (وما المسيح ابن مريم)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : মারইয়াম তনয় মসীহ তো কেবল একজন রাসূল। তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে। (০৫: ৭৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু সম্পর্কে সরাসরি কিংবা ইংগিতেও কিছু বলা কওয়া নেই। বরং তার পরের আয়াতগুলো দ্বারা বুঝা যায় যে, খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদ খন্ডন করার জন্য এই আয়াতে ঈসা আর তাঁর মায়ের পানাহারের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা খ্রিস্টানরা তাঁদেরকে উপাস্য হিসেবে বিশ্বাস করে। অথচ সত্যিকারের উপাস্য যিনি তিনি সব সময় পানাহারের ঊর্ধ্বে, বরং ঊর্ধ্ব থেকেও ঊর্ধ্বে। উল্লেখ্য, কাদিয়ানী নির্বোধরা আয়াতটির শানে নুযূল তথা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় এবং নিজেদের মতবাদকে সামনে রেখে মতলবসিদ্ধ ব্যাখ্যার পেছনে দৌঁড়ায়। তারা বলে, যেহেতু ঈসা আর তাঁর মা উভয়ই পূর্বে খাবার গ্রহণ করতেন, এখন করেন না। কাজেই এর কারণ হল তারা এখন জীবিত নেই। অথচ আয়াতের প্রসঙ্গের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই।

6 পবিত্র কুরআনের বাণী (وما جعلناهم جسدا)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘এবং আমি তাহাদের এমন দেহবিশিষ্ট করি নাই যে, তাহারা আহার্য গ্রহণ করিত না, তাহারা চিরস্থায়ীও ছিল না।’ (২১:০৮ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতেও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু সম্পর্কে সরাসরি কিংবা ইংগিতেও কিছু বলা কওয়া নেই। বড়জোর এটি মক্কার মুশরিকদের একখানা প্রশ্নের জবাব মাত্র। কিন্তু কাদিয়ানী নির্বোধরা এই আয়াত দিয়ে যুক্তি দেয় যে, অত্র আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর কোনো প্রেরিত পুরুষই না খেয়ে বাঁচতে পারতেন না। অতএব ঈসা (আ.)ও আল্লাহর এই নিয়মের বিরুদ্ধে নন বলে তিনিও বেঁচে নেই, মারা গেছেন। কিন্তু আফসোস! এই নির্বোধরা যদি আয়াতের প্রসঙ্গ এড়িয়ে না যেত তাহলে তাদের পক্ষে এইরূপ জঘন্য মতলবসিদ্ধ ব্যাখ্যার খিস্তিখেউড় করা কোনোদিনও সম্ভব হত না। আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা এই যে, তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে, কাফেরদের আপত্তি ছিল, মুহাম্মদ (সা.) নবী হলে সাধারণ মানুষের মতই পানাহার করতেন না এবং জীবিকা উপার্জনের জন্য হাটবাজারে চলফেরা করতেন না। আলোচ্য আয়াতে তাদের উত্তর দেয়া হয়েছে যে, যেসব নবীকে তোমরা নবী ও রাসূল বলে স্বীকার করতে তারাও তো মানুষই ছিল, তারা মানুষের মত পানাহার করতেন এবং হাটবাজারে চলাফেরা করতেন। বুঝা গেল, পুরো ব্যাপারটাই ইহকালীন জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে ইহজগতের বাহিরে অবস্থানকারী ঈসা (আ.)-কে এর সাথে একীভূত করার প্রচেষ্টা মূর্খতা ছাড়া কিছুই না।

7 আল্লাহতালার বাণী (قد خلت من قبله الرسل)-এর প্রকৃত মর্মার্থ।

আয়াত : মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র, তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে। (০৩:১৪৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : মনে রাখতে হবে যে, “গত হওয়া” মানে মরে যাওয়াই নয়, বরং সশরীরে কোথাও স্থানান্তরিত হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিও “গত হওয়া” অর্থে শামিল। কুরআনে এর বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। দেখুন পবিত্র কুরআন ০২:১৪, ৩৫:২৪। তবে উক্ত আয়াতের শানে নুযূল দ্বারা বুঝা যায় যে, মুহাম্মদ (সা.) খোদা নন, বরং তিনি পূূর্বের নবী রাসূলগণের মতই একজন রাসূল, রাসূলগণের মত তাঁর জন্যও মৃত্যুর মাধ্যমে ইহজগত হতে পরজগতে স্থানান্তর হওয়া অবধারিত; তাই তাঁর মৃত্যুতে তোমাদের এত বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই, উক্ত আয়াত দ্বারা এটাই সবাইকে বার্তা দেয়া উদ্দেশ্য। কাজেই আয়াতের অর্থ দাঁড়াল ‘মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র, তাহার পূর্বে রাসূল-ই আগমন করিত।’ এভাবে অর্থ নেয়া হলে তখন নির্বোধদের পক্ষে আর কোনো কাসুন্দি করার সুযোগ থাকেনা। উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানী তার একটি রচনায় নিজেও قد خلت من قبله الرسل এর অর্থ করেছেন “আর তাঁর পূর্বে রাসূল-ই আগমন করিত।” (রূহানী খাযায়েন ৬/৮৯)।

রূহানী খাযায়েন ৬/৮৯; জঙ্গে মুকাদ্দাস।

পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতটি ‘খালাত’ (خلت) শব্দে না হয়ে ‘মাতাত’ (ماتت) শব্দেও হতে পারত! কুরআন কি এই ব্যতিক্রমী শব্দচয়ন দ্বারাও আমাদের বার্তা দিচ্ছে না যে, ঈসা (আ.) বর্তমানেও জীবিত, তিনি এখনো মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করেননি! অন্যথা ‘মাতাত’ এর পরিবর্তে ‘খালাত’ (خلت) শব্দের প্রয়োগের রহস্যটা কী?

কিন্তু কাদিয়ানীদের কোনো কোনো লিটারেচারে আয়াতটির ‘ক্বদ খালাত’ শব্দ দ্বারা ‘মারা গিয়াছে’ অর্থও নেয়া হয়েছে এমনকি ‘আর-রসুল’ দ্বারা ‘সমস্ত রাসূল’ অর্থও নেয়া হয়েছে। তাদের বিশ্বাস হল, এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঈসা (আ.) মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। এই মর্মে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে ইজমা (ঐক্যমত)-ও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তাদের এই কথার উত্তরে শুধু এটুকু বলতে চাই, লানাতুল্লাহি আলাল কাজেবীন।

এই পর্যায় তাদের উদ্দেশ্যে আমি প্রশ্ন করতে চাই যে, আপনাদের দাবী হচ্ছে من قبله الرسل এর মধ্যকার الرسل এর ال (আলিফ+লাম) নাহুর পরিভাষায় শুধুই الاستغراقى (আল ইস্তিগরাক্বি বা নিঃশর্তভাবে পুরোপুরি অন্তর্ভুক্তি) যা সমস্ত রাসূলকে ‘গত হওয়া মর্মে’ অন্তর্ভুক্ত করবে। সে হিসেবে আপনারা কি বিশ্বাস করবেন যে, হযরত জিবরাইল (আ.) সহ সমস্ত ফেরেশতাও মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন!? যেহেতু পবিত্র কুরআন অনুযায়ী জিবরাইল (আ.)ও একজন রাসূল বা বাণীবাহক (সূরা মরিয়ম আয়াত ১৯)। পবিত্র কুরআন অনুযায়ী মুক্তভাবে ফেরেশতাদেরও আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূল (বাণীবাহক) হিসেবে মনোনীত করার প্রমাণ রয়েছে (সূরা হাজ্জ আয়াত ৭৫)। এখন এর কী উত্তর?

তাদের জন্য দুঃসংবাদ যে, এই আয়াত নাযিল হওয়ার ছয় বছর পর অর্থাৎ হিজরী নবমবর্ষে যখন নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল রাসূল (সা.)-এর নিকট এলেন, তখন তিনি বললেন, “আপনারা কি জানেন যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব এবং মৃত্যু ঈসার নিকট আসবে?” (তাফসীরে তাবারী ৬/১৫৪, তাফসীরে ইবনে আবী হাতিম ৯/৪০৮ দ্রষ্টব্য)। এছাড়াও হযরত আলী (রা.)-এর খাস শিষ্য ও বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমাম হাসান বছরী (রহ.) থেকে একদম সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلْيَهُوْدِ إِنَّ عِيْسَى لَمْ يَمُتْ، وَإَنَّهُ رَاجِعُ إِلَيْكُمْ قَبْلَ يَوْمِ الْقِيَامَةِ অর্থাৎ রাসূল (সা.) জনৈক ইহুদীকে বলেছেন নিশ্চয় ঈসা মসীহ তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি নিশ্চয় কেয়ামতের পূর্বে তোমাদের নিকট ফিরে আসবেন। (সূত্র, সুনানে তাবারী ৩৩৩৮, হাদীস নং ৫৭৪৭; তাফসীরে দুররে মানছুর ২৬৪, ইমাম সুয়ূতী)। এই সম্পর্কে অন্য জায়গায় বিস্তারিত লিখা হয়েছে।

  • উল্লেখ্য, উপরের আয়াতটি কাদিয়ানীবাদের সব চেয়ে বড় দলিল! আর সেটির খণ্ডনে উপরে যেভাবে লিখা হয়েছে তাতে তারা কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হবেনা। সেজন্য এই টপিকের উপর আমি খণ্ডনমূলক যেভাবে জবাব দিয়ে থাকি সেটি একদমই ব্যতিক্রমী। এটি শুধুই দ্বিপাক্ষিক ডিবেটের সময়ই প্রয়োজন পড়বে। অথবা সেসব ব্রেইন ওয়াশ ঝগড়াটে ও আনাড়ি কাদিয়ানীদের মুখ বন্ধ করে দিতেই। পড়ুন : কাদিয়ানীবাদের ওফাতে মসীহ’র সব চেয়ে বড় দলিলের খণ্ডন

8 আল্লাহর বাণী (وما جعلنا لبشر من قبلك الخلد)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘আমি তোমার পূর্বেও কোনো মানুষকে অনন্ত জীবন দান করি নাই; সুতরাং তোমার মৃত্যু হইলে উহারা কি চিরস্থায়ী হইয়া থাকিবে?’ (২১:৩৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : কাদিয়ানী নির্বোধদের কথা কী আর বলব! তারা এই আয়াত থেকেও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর রসদ পাওয়ার দাবী করে। তাদের বিশ্বাস, এই আয়াত থেকেই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, রাসূল (সা.)-এর পূর্বেকার সকল নবীই ইন্তেকাল করেছেন বলে ঈসা (আ.)-ও তার ভেতর শামিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এরা আয়াতটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপটের দিকে একদমই দৃষ্টি দেয় না। যদি দৃষ্টি দিত তাহলে তারা নিজেদের কখনোই এমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিত না। এবার আয়াতটির নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট জেনে নিন। মক্কার কাফেররা রাসূল (সা.)-এর ব্যাপারে বলত, সে তো একদিন মারাই যাবে। আল্লাহতালা এরই প্রতিউত্তরে বলেন, মৃত্যু তো প্রত্যেক মানুষের জন্য অবধারিত, মুহাম্মদ (সা.)-ও এই নিয়ম বহির্ভূত নয়। কারণ সেও একজন মানুষ। আর আমি কোনো মানুষকে অমরত্ব দান করিনি। এখানে পুরো বিষয়টাই যেহেতু ইহ-জগত সংশ্লিষ্ট সেহেতু উক্ত আলোচ্যাংশে ঈসা (আ.)-কেও টেনে এনে মৃত সাব্যস্ত করতে চাওয়া আদতে কুরআনের উদ্দেশ্যকেই পরিবর্তন করার নামান্তর।

9 আল্লাহর বাণী (تلك الامة قد خلت لها ما كسبت)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘সেই ছিল এক উম্মত, তাহা অতীত হইয়াছে। তাহারা যাহা অর্জন করিয়াছে তাহা তাহাদের। তোমরা যাহা অর্জন কর তাহা তোমাদের। (০২:১৪১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতের আগের এবং পরের আয়াতগুলো দেখলে বুঝা যায়, এখানে একথাগুলো ইহুদীদের উদ্দেশ্যে ছিল। তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যারা আম্বিয়া ও সৎলোক ছিলেন তাদের সাথে সম্পর্ক জুড়ে তোমাদের কোনো লাভ নেই। রাসূল (সা.)-ও পরিষ্কার বলে রেখেছেন যে, ‘যার কার্যকলাপ তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না’ (সহীহ মুসলিম অধ্যায় যিকির ও দোয়া, পরিচ্ছেদ তেলাওয়াতে কুরআনের জন্য একত্রিত হওয়ার ফজিলত)। কাজেই উক্ত আয়াত যেন বলতে চাচ্ছে, পূর্বপুরুষদের নেকী দ্বারা তোমাদের কোনো লাভ হবেনা এবং তাঁদের পাপের কারণে তোমরা পাকড়াও হবেনা। তাঁদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে এবং তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবেনা। পবিত্র কুরআনে এসেছে ‘কেউ অপরের বোঝা বহন করবেনা।’ (সূরা ফাত্বির ৩৫:১৮)। ‘আর মানুষ তাই পায়, যা সে করে।’ (সূরা নাজম ৫৩:৩৯)। যাইহোক, কাদিয়ানীদের উদ্ধৃত এই আয়াতের সাথেও ঈসা (আ.) জীবিত না মৃত—এর কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই।

10 আল্লাহর বাণী (و اوصانى بالصلوة و الزكوة)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘যেখানেই আমি (ঈসা) থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করিয়াছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়াছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও যাকাত আদায় করিতে’। (১৯:৩১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর কোনো উল্লেখই নেই। এখানে যে বিষয়টি বলে রাখা জরুরী তা হল, আয়াতটিতে ঈসা (আ.)-এর প্রতি সালাত আর যাকাতের ওসীয়ত পালনের হুকুম শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের সাথেই সম্পর্কিত। কেননা সালাত আর যাকাত পালনের কোনো যোগ্যতাই আকাশে নেই। তাই যারা ঈসা (আ.) আকাশে থাকলে তিনি সেখানে সালাত কিভাবে পড়ছেন, যাকাত কিভাবে দিচ্ছেন ইত্যাদী উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির অন্তরালে তাঁকে মৃত সাব্যস্ত করতে চাচ্ছেন, তারা মূলত অন্ধকারেই রয়েছেন। তাদেরকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, সালাতের জন্য নির্দিষ্ট সময় আর যাকাতের জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা জরুরি কিনা?

উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে বলুন, আকাশের নিয়ম-কানুন কি ইহজগতের মত? সেখানকার সময় কি ইহজগতের মতই সূর্যের উদয় ও অস্ত যাওয়ার নিয়মের আওতায়? যদি তেমনটা না হয় তাহলে ঈসা (আ.) যে সালাত আদায় করতে ইহ-পরিমন্ডলে আদিষ্ট সেই সালাত তিনি আকাশেও কিভাবে পড়ছেন—এমন আজগুবি প্রশ্ন কেন? আর আকাশে তিনি যাকাত কাকে দেবেন? সুতরাং বুঝা গেল তাঁর সাথে এগুলোর সম্পর্ক শুধু ইহজগতের সাথে। কে জানি বলেছিল, ঈসা (আ.) আবার পৃথিবীতে আসলে তখন কি তাঁর বয়স কয়েক হাজার বছর হয়ে যাবেনা? এমন নির্বোধ প্রশ্নকারীকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, তিরমিজি শরীফে একটি হাদীস আছে, জান্নাতবাসী প্রত্যেক পুরুষ ابناء ثلاث و ثلاثين অর্থাৎ তেত্রিশ বছরের যুবক থাকবে। এখন এই জান্নাতি যুবকরা সেখানে কোটি কোটি বছর থাকার পরেও তেত্রিশ বছরের যুবক থাকতে পারলে হযরত ঈসা (আ.) ঐশী ভ্রমণ শেষে পুনরায় তেত্রিশ বছর বয়সে কেন ফিরতে পারবে না?

11 আল্লাহর বাণী (و يوم اموت و يوم ابعث حيا) সম্পর্কিত সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করিয়াছি, যেদিন আমার মৃত্যু হইবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হইব। (১৯:৩৩ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে এই আয়াত দ্বারাও একদম অপ্রাসঙ্গিক একটি যুক্তির অবতারণা করে বলে থাকে যে, আয়াতটিতে ঈসা (আ.)-এর জীবনের তিনটি ঘটনার কথা বলা হয়েছে। জন্ম, মৃত্যু আর পুনরুত্থান। এখানে তাঁর আকাশে যাওয়া এবং শেষ যুগে পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসার কথা নেই। অথচ এই দুইটি ঘটনাও তাঁকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র এক মর্যাদায় ভূষিত করে থাকে। ফলে প্রমাণিত হয় যে, এই উভয় ধারণাই মিথ্যা। তাদের এই বক্তব্যের উত্তর দিয়েছেন বিশিষ্ট যুগ ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.)। তিনি বলেছেন, ঈসা (আ.) মূলত এই কথাগুলোর মাধ্যমে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদের খন্ডন করে নিজেকে তাঁর বান্দা হওয়ার ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন। সংক্ষেপে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)। আয়াতে তাঁর জন্ম, মৃত্যু আর পুনরুত্থানের ব্যাপারটি উল্লেখ করার যেই প্রাসঙ্গিকতা তার সাথে অবশিষ্ট ঘটনা দুটির সম্পর্ক নেই বলেই তিনি তা উল্লেখ করেননি। আফসোস! কাদিয়ানী জ্ঞানপাপীরা এখানেও আয়াতের প্রসঙ্গ গোপন রেখে মনগড়া ব্যাখ্যার পিছু নিয়ে থাকে।

12 আল্লাহর বাণী -(و منكم من يرد الى ارذل العمر)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমাদের মধ্যে কাহারও কাহারও মৃত্যু ঘটান হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাহাকেও কাহাকেও প্রত্যাবৃত্ত করা হয় হীনতম বয়সে যাহার ফলে উহারা যাহা কিছু জানিত সে সম্বন্ধে উহারা সজ্ঞান থাকে না। (২২:০৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এখানে ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে নির্বোধদের যুক্তি এরকম, ঈসা (আ.) আজ প্রায় দুই হাজার বছর অব্ধি বেঁচে থাকতে পারেন না। বেঁচে থাকলে এই আয়াত অনুযায়ী তিনি নিশ্চয়ই দারুণভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছেন, জ্ঞানহারাও হয়ে পড়েছেন। অথচ কোনো নবীকে আল্লাহ এমন অথর্ব অবস্থায় উপনীত করেননি। কিন্তু কাদিয়ানীদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, তারা ইহলৌকিক সময়ের অবস্থা আর পারলৌকিক সময়ের অবস্থার সাথে কোনো পার্থক্য করেনা। অথচ আল কুরআনে (৭০:৪) আল্লাহর একদিন আমাদের গণনায় ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) বছর (كان مقداره خمسين الف سنة) বলেও উল্লেখ আছে। সে হিসেবে ঈসা (আ.) আরো অন্তত ৪৮ হাজার বছর অতিবাহিত করতে হবে যদি তাঁকে তাঁর ঐশী সফরে মাত্র একদিন অতিবাহিত করতে হয়। কিন্তু এই সূ² কথাগুলো ঐসব নির্বোধদের বুঝানোর সাধ্য কার? পরিশেষে কথা হল, উল্লিখিত আয়াত দ্বারা মূলত পার্থিব জীবনে মানুষের সৃষ্টির সূচনা ও শারিরীক হ্রাস বৃদ্ধির সাধারণ নিয়ম সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে। আমরাও বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করার পর তিনিও একটা সময় ইন্তেকাল করবেন। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা মোটেও সাব্যস্ত হয় না যে, তিনি বর্তমানেও মৃত, জীবিত নেই।

13 আল্লাহর বাণী -(ولكم فى الارض مستقر و متاع الى حين)এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আমি বলিলাম, তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নামিয়া যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রহিল (০২:৩৬ ইফা)।

ব্যাখ্যা : কাদিয়ানী নির্বোধদের দাবী হচ্ছে, এই আয়াত কোনো মানুষকে এই মাটির দেহ নিয়ে আকাশে যাওয়া এবং সেখানে থাকাকে প্রতিহত করছে। অথচ তাদের এই দাবীকে মেনে নিলে তখন মুহাম্মদে আরাবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক চির-বিস্ময়কর ঐশী ভ্রমণ (মেরাজ)-কে অস্বীকার করতে হয়। হযরত ইদরিস (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার যে কথা স্বয়ং কুরআনেই (মরিয়ম/১৯:৫৭) এসেছে সেটিও অমান্য করতে হয়। যা কখনো কোনো মুমিনের জন্য সম্ভব নয়। অধিকন্তু ইমাম ইবনে কাসীরও লিখেছেন যে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন رفع الى السماء الرابعة فمات بها অর্থাৎ ইদরিসকে চতুর্থ আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় অতপর তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। এবার আমি ঐ ব্রেইন ওয়াশ/কাল্টদের ভ্রান্তি নিরসনে বলতে চাই, উক্ত আয়াত হতে উদ্দেশ্য হল, ইবলিশ শয়তান কর্তৃক আদি পিতা-মাতা আদম হাওয়াকে জান্নাতে পদস্খলন করতে চাওয়ার বিষয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দেয়া। আয়াতটিতে এও উল্লেখ রয়েছে যে, বনী আদম পৃথিবীতে এসেছে সামান্য কিছুদিনের জন্য। এখন এখানে কোন্ শব্দে বুঝানো হয়েছে যে, মাটির দেহের কোনো মানুষ মোটেও ঐশী ভ্রমণে যেতে পারবেনা? সুতরাং এই আয়াত দ্বারাও তিনি (ঈসা) বর্তমানেই মৃত, তা মোটেই সাব্যস্ত হয় না।

14 আল্লাহর বাণী (ومن نعمره ننكسه فى الخلق) আয়াতের সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আমি যাহাকে দীর্ঘ জীবন দান করি প্রকৃতিগতভাবে তাহার অবনতি ঘটাই। তবুও কি উহারা বুঝে না? (৩৬:৬৮ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত উল্লেখপূর্বক দাবী করে যে, আয়াতটিও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু ঘটে যাওয়ার প্রতি ইংগিত। কারণ শারীরিক দিক থেকে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ দৈহিক শক্তি, তাকত ও ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মত দুরাবস্থায় উপনীত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করেছেন এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, উক্ত আয়াত হতেই যদি ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করা যেত তাহলে স্ববিরোধী নির্যা কাদিয়ানীর নিম্নোক্ত বক্তব্যের কোনো মানেই হয় না। এই যে, তিনি কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণ করেছেন ‘ঈসা (আ.)-এর দ্বিতীয়বারের আগমন করা এবং তাঁর মাধ্যমে ইসলাম সমগ্র দুনিয়ায় প্রচার প্রসার লাভ করার প্রতিশ্রুতিতে ফোরকানী ইশারা এই আয়াতে (সূরা আত-তওবাহ ৩৩) রয়েছে।’ দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১/৫৯৩। এবার নির্বোধদের সংশয় নিরসনে উত্তরে বলতে চাই, মূলত আয়াতটিতে পার্থিব জীবনে মানুষের শারীরিক হ্রাস বৃদ্ধির সাধারণ নিয়ম সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে। আমরাও বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.)ও ফিরে এসে যথাসময় উক্ত নিয়মের মুখোমুখি হবেন।

15 আল্লাহর বাণী (ثم جعل من بعد قوة ضعفا و شيبة)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আল্লাহ, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। (৩০:৫৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াতটিও উল্লেখ করে বলে থাকে যে, এই আয়াত দ্বারাই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, ঈসা (আ.)ও পরিণত বয়সে মারা গেছেন। কেননা কোনো মানুষই খোদার সৃষ্টি প্রাকৃতিক নিয়মের বাহিরে নন, তিনি সাধারণ কিবা নবী-রাসূল যেই হোন না কেন! অথচ নির্বোধদের জানা নেই যে, মির্যা কাদিয়ানীর একটি রচনায় উল্লেখ আছে যে, ‘খোদাতায়ালার যে খোদায়ী এবং খোদায়িত্ব তাঁর সীমাহীন কুদরত বা শক্তি এবং তাঁর অগণিত রহস্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাঁকে কানূনের আকারে কোনো সীমার মধ্যে আবদ্ধ করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।’ (আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলী পৃ-৫৭, প্রকাশকাল ২৭ মে ১৯৯৮ইং। যাইহোক, ঈসা (আ.) বর্তমানে আকাশে (ঐশী ভ্রমণ) থাকায় তিনি বর্তমানে ইহজাগতিক ও প্রাকৃতিক নিয়মের আওতাভুক্ত নন। ফলে তাঁকে এক্ষুণি প্রাকৃতিক নিয়মে আবদ্ধ করে ‘মৃত’ বলে সিদ্ধান্ত দেয়া নেহাতই মূর্খতা বৈ কিছুই না। অধিকন্তু আয়াতটির ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর শিষ্য বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কাতাদাহ (রহ.) বলেছেন, প্রথম দুর্বলতা হচ্ছে শুক্র আর শেষ দুর্বলতা হচ্ছে বৃদ্ধ বয়স যখন তার চুল সাদা হয়ে যেতে থাকে। (তাফসীরে তাবারী)। যাইহোক, আমরাও বিশ্বাস করি যে, ঈসা (আ.) আবার যখন পার্থিব জীবনে ফিরে আসবেন তখন আল্লাহ চাইলে তিনিও প্রকৃতির উক্ত নিয়মের বাহিরে থাকবেন না।

16 আল্লাহর বাণী -(انما مثل الحيوة الدنيا كماء انزلناه من السماء)এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : বস্তুত পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত এইরূপ যেমন আমি আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করি যদ্দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন-সন্নিবিষ্ট হইয়া উদগত হয়, যাহা হইতে মানুষ ও জীবজন্তু আহার করিয়া থাকে। (১০:২৪ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধরা আয়াতটি দ্বারাও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে যাওয়ার প্রমাণ এইভাবেই পেশ করে যে, এই আয়াতে বলা হয়েছে, পার্থিব জীবন প্রাকৃতিক নিয়মেরই অধীনে। এ প্রাকৃতিক নিয়ম লংঘন করার ক্ষমতা মানুষের নেই, ঈসা (আ.)-এরও ছিলনা। যে যুগে একজন মানুষের গড় আয়ু ধরুন নব্বই বছর ছিল। ঈসা (আ.) না হয় দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন কিন্তু সেই দীর্ঘায়ু তো শত শত বছর হতে পারে না। অতএব ঈসা (আ.) মারা গেছেন, বেঁচে নেই। (নাউযুবিল্লাহ)। উত্তরে বলতে চাই, এই নির্বোধরা কি হযরত আদম (আ.)-এর ৯৬০ বছর, নূহ (আ.)-এর ৯৫০ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা, আসহাবে কাহাফের ৩০৯ বছর সময় শুধু ঘুমেই কেটে যাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করতে পারবে? তারা কি বরেণ্য কোনো একজন যুগ ইমামের উদ্ধৃতি দিয়ে এগুলোর একটিও রদ করতে পারবে? আহা! এদের কথাবার্তা শুনলে যে কেউই বলতে বাধ্য হয় যে, এরা এতই ব্রেইনওয়াশ যে নিজের চিন্তাশক্তিটা পর্যন্ত এরা নষ্ট করে ফেলেছে! এরা এখানে ইহজগতের যে নিয়ম দ্বারা এমন একজনকে পরিমাপ করছে যে কিনা এই মুহূর্তে পার্থিব ইহজগতেরই বাহিরে।

17 আল্লাহর বাণী -(ثم انكم بعد ذالك لميتون)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ইহার পর তোমরা অবশ্যই মরিবে। (২৩:১৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত দিয়েও ঈসা (আ.)-কে কিভাবে মৃত সাব্যস্ত করছে দেখুন। তারা বলে যে, এই আয়াতেও প্রাকৃতিক নিয়মের অলঙ্গনীয়তার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। এই নিয়মের অধীনে সব কিছুই, প্রতিটি মানুষই। অতএব ঈসা (আ.)ও এই নিয়মের আয়ত্তে যথাসময় ইন্তেকাল করেছেন। জবাবে বলতে চাই, ঈসা (আ.) বর্তমানে যেহেতু প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের অধীনে নেই, সেহেতু এই মুহূর্তে উনার উপর প্রকৃতির এই নিয়ম-কানুন কোনোভাবেই প্রয়োগ হবেনা। উল্লেখ্য, বাহায়ী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা হোসাইন আলী নূরী বাহাউল্লাহও (১৮১৭-১৮৯২ইং) নিজেকে নবুওয়ত ও রেসালতের দাবী করার পাশাপাশি ১৮৬৩ সালে ইরান থেকে বাগদাদে নির্বাসনে থাকাবস্থায় ‘মসীহ’ হওয়ার দাবী করেছিলেন। তার কিতাবুল আকদাস পৃ-৭১ দ্রষ্টব্য। বাহাউল্লাহ ইরানী তার উক্ত দাবীর উপর প্রায় ২৯ বছর জীবিত ছিলেন। বর্তমানে পৃথিবীতে ২১৮টির অধিক রাষ্ট্রে প্রায় ৮০০ জাতি ও বর্ণের মানুষের মাঝে বাহায়ীধর্ম প্রচলিত। অতএব বুঝা গেল, মির্যার মত ইতিপূর্বে আরো অনেকে নিজেকে শুধু নিজেকে ‘রূপক ঈসা’ দাবী করার হীনস্বার্থেই ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল। কেউ সফল হয়নি, মির্যা কাদিয়ানীও না।

18 আল্লাহর বাণী (ثم يهيج فتراه مصفرا ثم يجعله حطاما)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করেন, অতপর উহা ভূমিতে নির্ঝররূপে প্রবাহিত করেন এবং তদ্দ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন, অতপর ইহা শুকাইয়া যায়। ফলে তোমরা ইহা পীতবর্ণ দেখিতে পাও, অবশেষে তিনি উহা খড়-কুটায় পরিণত করেন? ইহাতে অবশ্যই উপদেশ রহিয়াছে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য। (৩৯:২১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত দিয়েও ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করার জন্য বলে থাকে যে, এই আয়াতেও প্রাকৃতিক নিয়ম বা কানুনে কুদরতের কথা বলা হয়েছে, যা কেউ লঙ্গন করতে পারেনা। জবাবে বলব, প্রথমত এধরণের প্রশ্নের উত্তর একটু আগেই অন্যখানে বহুবার দেয়া হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এই আয়াতের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ইহকালীন অবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে এর সাথে ঈসা (আ.)-কে জড়ানো পুরোই অপ্রাসঙ্গিক। বরং অত্র আয়াতে বুঝানো হয়েছে যে, এই পার্থিব দুনিয়ার মুহাব্বত একদমই অনর্থক। কারণ অতি অল্প সময়ের মধ্যে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে। তার চাকচিক্য ও সতেজতা, তার শ্যামলতা ও সৌন্দর্য এবং তার আমোদ-প্রমোদ, আরাম-আয়েশ ক্ষণকালের জন্য।

19 আল্লাহর বাণী (الا انهم ليأكلون الطعام)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমার পূর্বে আমি যে সকল রাসূল প্রেরণ করিয়াছি তাঁহারা সকলেই তো আহার করিত ও হাটেবাজারে চলাফেরা করিত। হে মানুষ। আমি তোমাদের মধ্যে এক-কে অপরের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ করিয়াছি। তোমরা ধৈর্যধারণ করিবে কি? তোমার প্রতিপালক সমস্ত কিছু দেখেন। (২৫:২০ ইফা)।

ব্যাখ্যা : কাদিয়ানী নির্বোধরা এই আয়াত দ্বারাও বুঝাতে চায় যে, ঈসা (আ.)-এর ক্ষেত্রেও ইহজগতের এই সমস্ত খাবার-দাবার ইত্যাদীর কোনো প্রকার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অর্থাৎ তিনি এখন আর ইহজগতে নেই, ইহজগতের ন্যায় আহারও করেন না। তার মানে তিনি মারা গেছেন। প্রতিউত্তরে বলতে চাই, ঈসা (আ.) ইহজগতে আবার ফিরে আসার আগ পর্যন্ত এইভাবে কেয়াস করে তাঁকে মৃত সাব্যস্ত করা মস্তবড় পাগলামি ছাড়া কিছুই না। যেহেতু এই আয়াতের প্রেক্ষাপট বলছে যে, আয়াতটি ইসলামের প্রাথমিকযুগের মুশরিকদের কতেক ধারণাকে অহেতুক আখ্যা দিতেই নাযিল হয়েছিল। কারণ মুশরিকদের ধারণা ছিল যিনি নবী হন তিনি খাবার গ্রহণ করেন না, হাটেবাজারে চলাফেরা করেননা। আল্লাহতালা তাদের আপত্তি খন্ডন করে বলেন, মুহাম্মদ (সা.) সহ পূর্বের সমস্ত নবী রাসূল মানুষই ছিলেন, খাবারও গ্রহণ করেছেন, সাংসারিক প্রয়োজনে হাটে-বাজারেও গিয়েছেন। কাজেই এগুলো কোনোভাবেই নবুওয়তী মর্যাদার পরিপন্থী নয়, যেমনটি তোমরা অজ্ঞতাবশত ভাবছো (তাফসীরে কুরতুবী)।

এবার নির্বোধদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আসহাবে কাহাফ’ কুদরতে ইলাহীর মাধ্যমে ৩০৯ বছর যাবত পানাহার ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারলে এখন ঈসা (আ.) কিজন্য পারবেন না? অথচ রাসূল (সা.) বলেছেন يجزى اهل السماء من التسبيح و التقديس অর্থাৎ তাসবীহ এবং তাকদীস (আল্লাহর নামে যিকির আযকার) ঐশী জগতবাসীর খাবারের জন্য যথেষ্ট। (দেখুন, মেশকাত শরীফ হাদীস নং ৬২৯৪)। ইমাম ইবনু কাইয়ুম (রহ.) লিখেছেন, ‘মসীহ ইবনে মরিয়ম জীবিত, ইন্তেকাল করেননি আর (আকাশে) তাঁর খাবার দাবার ফেরেশতার মতই। (দেখুন, আত-তিবইয়ান ফী আক্বসামিল কুরআন পৃ- নং ২৫৫, ইবনু কাইয়ুম)।

20 আল্লাহর বাণী (اموات غير احياء وما يشعرون ايان يبعثون) -এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : উহারা আল্লাহ ব্যতীত অপর যাহাদের আহবান করে তাহারা কিছুই সৃষ্টি করে না, তাহাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়। তাহারা নিষ্প্রাণ নির্জীব এবং কখন তাহাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হইবে সে বিষয়ে তাহাদের কোনো চেতনা নাই। (১৬:২০-২১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীদের বক্তব্য হচ্ছে, এই আয়াত অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলছে যে, আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে উপাস্যরূপে ডাকা হয় সবাই নির্জীব ও নিষ্প্রাণ। সুতরাং ঈসা (আ.)ও এখন মৃত বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা খ্রিস্টানরা তাঁকে খোদারপুত্র খোদা বলেই ডাকে। প্রতিউত্তরে বলতে চাই যে, উক্ত আয়াতের اموات তথা নির্জীব শব্দ হতে মুশরিকদের হাতে বানানো জড়পদার্থ প্রতিমাগুলোই বিশেষভাবে উদ্দেশ্য। এতে পথভ্রষ্ট আহলে কিতাবীদের উপাস্য সেসব সম্মানীত ব্যক্তিবর্গ শামিল নন যাঁদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত। যেমন বিবি মরিয়ম, আল্লাহর নবী হযরত উজায়ের, ঈসা। এই সম্পর্কে আল্লাহতালা বলেন ان الذين سبقت لهم منا الحسنى اولئك عنها مبعدون অর্থাৎ ‘আমার পক্ষ থেকে যাদের জন্য পূর্বেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে (২১:১০১)।’ এতেই প্রমাণিত হয় যে, আয়াতে اموات বা নির্জীব শব্দটি ‘খাস’; ‘আম’ নয়। কিন্তু যদি আয়াতটির اموات হতে বিনা ব্যতিক্রমে সবাইকে উদ্দেশ্য নেয়া হয় তখন নিচের প্রশ্নগুলোর কোনোই জবাব থাকেনা।

১. যেহেতু ঐ আয়াতেই এসেছে ‘পুনরুত্থান সম্পর্কে যাদের কোনো খবর নেই’। তাই প্রশ্ন হল, তবে কি নবীগণও পুনরুত্থান সম্পর্কে বেখবর তথা অসচেতন? নাউযুবিল্লাহ।

২. সূরা আম্বিয়া আয়াত নং ৯৮ এর মধ্যে আল্লাহতালা সে সমস্ত উপাস্যকেও জাহান্নামের জ্বালানি বলেছেন মুশরিকরা যাদের উপাসনাকারী। তাই প্রশ্ন হল, তবে কি কাদিয়ানীরা এ হিসেবে উজায়ের এবং ঈসাকেও জাহান্নামের জ্বালানি মনে করবে? নাউযুবিল্লাহ।

21 আল্লাহর বাণী (ولكن رسول الله و خاتم االنبيين)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নয়; বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং নবীগণের আগমনীধারা সমাপ্তকারী। (৩৩:৪০)। ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ অর্থ নবীগণের সমাপ্তকারী (রূহানী খাযায়েন ৩/৪৩১, লিখক মির্যা কাদিয়ানী)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীদের বক্তব্য হল, ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ সংক্রান্ত এ আয়াতে একথা ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মহানবীর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী নবীগণের আগমনের সিলসিলাহ বা ধারাক্রম শেষ হয়ে গেছে। অতএব ঈসা (আ.) এর পুনরাগমনের ধারণাটা কল্পিত প্রসূত। অর্থাৎ তিনি মারা গেছেন, আর আসবেন না। এই নির্বোধরা আসলে জানেই না যে, ‘শেষনবী’ এর সংজ্ঞায় কী বলা হয়েছে? যদি তারা তা জানত তাহলে ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমনের বিশ্বাসকে কখনোই ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ শীর্ষক আয়াতের বিরোধী মনে করত না। এবার তাহলে জেনে নিন, “শেষনবী” এর সংজ্ঞায় ইমাম যামাখশারী (মৃত. ৪৬৭ হিজরী) কী লিখেছেন। তিনি লিখেছেন ‘আমি মনে করি, মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী—একথার অর্থ হল তাঁর পরে আর কাউকে নবী বানানো হবেনা, আর ঈসা (আ.)-কে তো তাঁর আগেই নবী বানানো হয়েছে। আর তিনি যখন পুনরাগমন করবেন তখন তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর শরীয়তের উপর একজন আগমনকারী হবেন এবং তাঁর কেবলার দিকেই সালাত আদায়কারী হবেন, যেমন নাকি তিনিও অপরাপর উম্মতগণের মত একজন উম্মতই।’ (তাফসীরে কাশশাফ খ-২২ সূরা আহযাব ৪০)।

তাছাড়া তাফসীরে সমরকান্দী-এর ১ম খন্ডের ২৭২ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে ‘ঈসা (আ.) আল্লাহর নিকট শেষনবীর উম্মত হতে চেয়ে দোয়া করেছিলেন। তাই আল্লাহতালা তাঁর উক্ত দোয়া কবুল করেছেন।’ (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৫৫ এর তাফসীর)। মির্যা কাদিয়ানীর বইতেও লিখা আছে, “আগমনকারী মসীহ’র জন্য আমাদের নবী করীম (সা.) নবুওয়ত শর্ত করেননি।” (রূহানী খাযায়েন ৩/৫৯)।

সুতরাং প্রমাণিত হয়ে গেল যে, ঈসা (আ.)-এর পুরনাগমন নবুওয়তের দায়িত্ব সহকারে হবেনা, শুধুমাত্র একজন উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে হবে। যেহেতু তাঁর পুনরাগমনে নবুওয়তের দরজায় ধাক্কা লাগবেনা। ফলে ‘খাতামান নাবিয়্যীন’ সংক্রান্ত আয়াত কোনোভাবেই ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমনের বিরোধিতা করেনা।

22 আল্লাহর বাণী (وما ارسلنا من قبلك الا رجالا نوحى اليهم)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমার পূর্বে আমি ওহীসহ পুরুষই প্রেরণ করিয়াছিলাম, তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞাসা কর। (১৬:৪৩ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াতের মর্মার্থ বাইবেলের নাম ভেঙ্গে উপস্থাপন করে বলে থাকে যে, এই আয়াতের নির্দেশ মতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের কিতাবগুলোর মধ্যে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, পূর্ববর্তী কোনো নবীর পুনরাগমন হতে রূপকভাবে অন্য কারো আগমনকে বুঝায়। কেননা ইহুদীদের বিশ্বাস ছিল, আকাশ হতে ইলিয়া নবীর আগমন হবে, তার পূর্বে ‘মসীহ’ আসতে পারেনা। কিন্তু যীশু (ঈসা) এসে বলেছিলেন যে, যাকারিয়ার পুত্র যোহন বা ইয়াহ্ইয়াই হলেন ইলিয়া (এলিজা বা এলিয়াস)।

উত্তরে বলতে চাই, প্রকৃতপক্ষে এই আয়াত দ্বারা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, ইতিপূর্বে যত রাসূলই প্রেরিত হয়েছিলেন তারা প্রত্যেকে মানুষ ছিলেন। অতএব যদি মুহাম্মদও একজন মানুষ হন তাহলে এটা কোনো নতুন কথা নয় যে, তোমরা তাঁর মানুষ হওয়ার কারণে তাঁর রেসালতকে অস্বীকার করবে। কিন্তু কাদিয়ানীরা নিজেদের উদ্দেশ্যকে পোক্ত করতে কিভাবে দরাকে সরা বানিয়ে দিল তা নিশ্চয়ই দেখেছেন। যাইহোক, এবার তথাকথিত ‘ইলিয়া’ নবী নিয়ে তাদের কাসুন্দির পোস্টমর্টেম করছি।

প্রথমত, বাইবেলের সবকয়টি সংস্করণই বর্তমানে বিকৃত ও পরিবর্তিত। দ্বিতীয়ত, ইউহান্নাহ বা যোহনের ইঞ্জিলেই লেখা আছে, “তদানিংকালের জেরুজালেমের নেতৃস্থানীয় ইহুদী নেতাদের প্রশ্নের উত্তরে ইউহান্নাহ তথা যোহন নিজেই ইলিয়া হওয়া অস্বীকার করেছেন।” মির্যা কাদিয়ানীও একথা স্বীকার করে লিখে গেছেন। দেখুন রূহানী খাযায়েন ২১/৪২-৪৩। কাজেই ইলিয়া সংক্রান্ত বাইবেলের উক্ত তথ্যটি সত্য নয়, বরং মিথ্যা। কেননা যোহন বা ইয়াহ্ইয়া (ইউহান্নাহ) যদি নিজেই নিজের ‘ইলিয়া’ হওয়া অস্বীকার করে থাকেন তাহলে এটাও নিশ্চিত সত্য যে, ঈসা (আ.) কখনো যোহনকে ‘ইলিয়া’ আখ্যা দেননি। অন্যথা দুইজনের যে কোনো একজন মিথ্যাবাদী হয়ে যাচ্ছেন, যা কখনো নবীর বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। সুতরাং ইলিয়া সংক্রান্ত পুরো ঘটনাটিই জাল ও বাতিল। ফলে এর উপর কথিত রূপক মসীহর ভিত্তি স্থাপন করতে চাওয়া এবং তারই কিয়াস করে শেষযুগে আগমনকারী ঈসাকে (আ.) রূপক দাবী করা সম্পূর্ণরূপে বাতিল।

23 আল্লাহর বাণী -(يأيتها النفس المطمئنة ارحعى الى ربك راضية مرضية)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : হে প্রশান্তচিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়া আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হইয়া। (৮৯:২৭-৩০ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা এই আয়াত হতে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু আবিষ্কার করে কিভাবে জেনে নিন। তাদের বক্তব্য হল, এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, মৃত্যুর পরে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা জান্নাতের মধ্যে জান্নাতবাসীগণের সঙ্গী হয়। মৃত্যুর পূর্বে কেউ জান্নাতবাসী হয় না। মেরাজের বিবরণে বুখারীর হাদীসে বলা হয়েছে যে, মহানবী (সা.) হযরত ঈসা (আ.)-কে জান্নাতবাসীগণের মধ্যে দেখেছেন। অতএব, বুঝা গেল মৃত্যুর পরেই ঈসা (আ.) জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। এখন এর জবাবে আমার পাল্টা চ্যালেঞ্জ থাকল, ঈসা (আ.)-কে দেখেছেন ‘জান্নাতে বা জান্নাতবাসীগণের মধ্যে’ এইরূপ শব্দচয়নে কোনো কথা নেই, এটি বরং কাদিয়ানীদের বানানো কথা। যদি কারো সাহস থাকে তাহলে দশ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। দ্বিতীয়ত, ইবনে মাজাহ এর ৪০৮১ নং হাদীসে মেরাজ সংক্রান্ত একটি হাদীসে রয়েছে যে, فَرُدَّ الْحَدِيْثُ اِلَى عِيْسَى ابْنِ مَرْيَمَ قَالَ قَدْ عُهِدَ اِلَى فِيْمَا دُوْنَ وَجْبَتُهَا فَاَمَّا وَجْبَتُهَا فَلَا يَعْلَمُهَا اِلَّا اللهِ عَزَّ وَ جَلَّ “…অতপর কেয়ামতের বিষয়টি ঈসা (আ.)-এর নিকট পেশ করা হলে তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দুনিয়ায় ফেরার প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু কেয়ামতের সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নেই।”

পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ৪৬ নং আয়াত ويكلم الناس فى المهد و كهلا এর মধ্যে ‘ইয়ুকাল্লিমু’ (তিনি কথা বলবেন) ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা ঈসা (আ.) প্রৌঢ় বয়সেও মানুষের সাথে কথা বলবেন মর্মে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতিটাও তাঁর দুনিয়ায় ফিরে আসার সমর্থনে শক্তিশালী ইংগিতবিশিষ্ট। উল্লেখ্য, প্রাচীন আরবী অভিধানগ্রন্থ ‘লিসানুল আরব’-এর মধ্যে রয়েছে, ‘কাহল’ বা প্রৌঢ় বয়স বলতে ৩৪ থেকে ৫১ বছরের মধ্যবর্তী বয়সকেই বুঝানো হয়। আর ইসলামিক সমস্ত অথেনটিক সোর্সগুলো ঘেঁটে দেখুন, ঈসা (আ.)-এর জীবন-ইতিহাস ৩৩ বছরের বাহিরে খুঁজে পাবেন না।

24 আল্লাহর বাণী (الله الذى خلقكم ثم رزقكم ثم يميتكم ثم يحييكم)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছেন, অতপর তোমাদেরকে রিযিক দিয়াছেন, তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাইবেন ও পরে তোমাদেরকে জীবিত করিবেন। (৩০:৪০ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীদের বক্তব্য হচ্ছে আয়াতটিতে মানব-জাতির চারটি পর্যায় বা অবস্থার কথা বলা হয়েছে। এটাই আল্লাহ’র সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম। সবাই এ নিয়মের আওতায়। জন্মগ্রহণ, বুদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, মৃত্যুবরণ করা এবং পুনরুত্থিত হওয়া। এর ব্যতিক্রম ঘটবেনা। ঈসা (আ.)-এর জীবনেও না। সুতরাং ঈসা (আ.)ও এই নিয়মের আওতায় হিসেবে তিনি এখন আকাশে থাকতে পারেন না, বরং মৃতুবরণ করে কবরে রয়েছেন। জবাবে বলতে চাই যে, আচ্ছা ঈসা (আ.)-এর জন্মটা তো পিতা বিহীন এবং কোনো ইনসানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়াই হয়েছিল। তাহলে প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো না কিভাবে? খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদের খন্ডনের জন্য কি এটুকুই যথেষ্ট নয় যে, প্রকৃত ঈশ্বর জন্ম হন না; অথচ তারা যাঁকে ঈশ্বর বানিয়ে বসে আছে তিনি জন্ম নিয়েছেন?

আহা আফসোস! নির্বোধ কাদিয়ানীরা বুঝলো না যে, আল্লাহর প্রতিটি কাজই হেকমতপূর্ণ। তাঁর কোনো কাজই অনর্থক নয়। আর তিনি আপনা সিদ্ধান্তে স্বাধীন, কোনো নিয়মই তাঁকে আটকাতে পারেনা। আসল কথা হল, ঈসা (আ.)-এর পুরো জীবনটাই দুনিয়ার মানুষদের জন্য একটি পরীক্ষা। বিনা পিতায় সৃষ্টি হওয়ায় চির দুশমন ইহুদী-জাতি তাঁকে জারজ সন্তান আখ্যা দিয়ে নিজেদের পরকাল ধ্বংস করেছে। খ্রিস্টানরা তাঁকে ঈশ্বরপুত্র বলে নিজেদের বিচারবুদ্ধি আর পরকাল দুটোই নষ্ট করেছে। পৃথিবীর শেষ লগ্নে এসে মুসলিম জাতির মধ্যে কাদিয়ানী, বাহায়ী সম্প্রদায় তাঁর সশরীরে ঐশী ভ্রবণ ও দুনিয়ায় আবার ফিরে আসাকে অমান্য করে শুধু ইসলামের মূলধারা থেকে বেরিয়ে যায়নি, বরং খতমে নবুওয়তের আকীদাকেও অস্বীকার করে বসেছে। ফলে তারা ইসলামের গন্ডি থেকে আপনা-আপনি বহিষ্কৃত হয়ে গেছে।

এবার ঈসা (আ.)-কে আল্লাহ কিভাবে পরীক্ষামূলক হিসেবে সৃষ্টি করলেন তার একটি প্রমাণ সূরা আলে ইমরান এর ৮১ নং আয়াত থেকে নিন। এখানে আল্লাহতালা রূহের জগতে সমস্ত নবী রাসূল থেকে শেষনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন ও আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেয়ার কথা রয়েছে, যেমন و اذ اخذ الله ميثاق النبيين অর্থাৎ যখন আল্লাহ নবীগণ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলেন…। নবীগণও সে সময় আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি গ্রহণপূর্বক বলেছিলেন اقرارنا তথা ‘আমরা স্বীকার করলাম’। হযরত ইবনে আব্বাস এবং আলী প্রমুখ থেকেও এইধরণের মতামত প্রমাণিত। (তাফসীরে তাবারী দ্রষ্টব্য)। আল্লাহতালা হযরত ঈসা (আ.)-কে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন যাতে দুনিয়ায় আবার ফিরে আসার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়ত এবং রেসালতের উপর ঈমান গ্রহণ ও তার শরীয়ত বরণ দ্বারা রূহের জগতে গৃহীত প্রতিশ্রুতি অন্যান্য সকল নবী রাসূলের পক্ষ হতে বাস্তবায়িত হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে বিষয়গুলো এত পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকার পরেও নির্বোধরা সাত অন্ধের হাতি দেখা অন্ধ বধিরদের মতই আচরণ করছে। পরিতাপের বিষয় যে, তারা তাদের পন্ডিতদের এগুলো জিজ্ঞেসও করেনা!

25 আল্লাহর বাণী -(كل من عليها فان و يبقى وجه ربك)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ভূপৃষ্ঠে যাহা কিছু আছে সবই নশ্বর (ধ্বংসশীল), অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের সত্তা যিনি মহিমাময় মহানুভব। (৫৫:২৬-২৭ ইফা)।

ব্যাখ্যা : এই আয়াত দিয়ে কাদিয়ানীরা যে খোঁড়া যুক্তির জোড়াতালি প্রদর্শন করে সেটি হল, এই আয়াত দ্বারা বুঝা গেল পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্ট সবই ধ্বংসশীল। সৃষ্টির এই ধ্বংসধারার একটা পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর সঙ্গে, সেই মৃত্যু যে কোনোভাবেই হোক। সবাই এই প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায়। হযরত ঈসা (আ.)ও এর বাহিরে নন। অতএব তাঁরও দেহ গঠনের পূর্ণত্বে পৌঁছার পর ক্ষয়েরধারা থেকে মুক্ত ছিলনা বলে তাও প্রাকৃতিক নিয়মে যথাসময়ে ক্ষয়প্রাপ্তির স্তরে পৌঁছে গেছে অর্থাৎ তিনি (ঈসা) মারা গেছেন। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। উত্তরে বলতে চাই, জ্বী হ্যাঁ; আমরা মুসলমানরাও বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.) যখন ফিরে আসবেন তখন যথাসময় মৃত্যুবরণও করবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তো তিনি ইহজগতের ধরাছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাহিরে।

26 আল্লাহর বাণী -(ان المتقين فى جنة و نهر)এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : মুত্তাকীরা থাকিবে স্রোতস্বিনী বিধৌত জান্নাতে, যোগ্য আসনে, সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী আল্লাহর সান্নিধ্যে। (৫৪:৫৪-৫৫ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ কাদিয়ানীরা আয়াতটির মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে চায়, জান্নাতে প্রবেশ করে মানুষ মৃত্যুর দুয়ার দিয়েই, অন্য কোনো উপায়ে নয়। অতএব ‘বাল রাফা’আহুল্লাহু ইলাইহি’ এর অর্থ যখন করা যে, ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর সান্নিধ্যে তুলে নেয়া হয়েছে তখন তো এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি (আ.) মৃত্যুর পরেই আল্লাহর দিকে উন্নীত হয়েছেন। যেহেতু ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি’ এর ‘ইলাইহি’ এবং ‘বাল রাফা’আহুল্লাহু ইলাইহি’ এর ‘ইলাইহি’ সমার্থক ও সমান তাৎপর্যবহ। আর খোদার দিকে উন্নীত হয়ে কেউ আর পৃথিবীর দিকে পতিত হয় না। সুতরাং ঈসা (আ.) খোদার দিকে উন্নীত হয়েছেন বলেই তাঁর আর পৃথিবীর দিকে পতিত হওয়ার সুযোগ নেই অর্থাৎ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। জবাবে বলতে চাই, নির্বোধদের কি জানা নেই যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর রাফা অর্থাৎ তুলে নেয়ার ঘটনা যদি ফেরেশতা আজরাইলের মাধ্যমে ঘটত তবেই না তাঁর ‘রাফাহুল্লাহু’ আর ইন্নালিল্লাহি-এর ‘ইলাইহি (اليه)’ একই তাৎপর্য বহনকারী হত! এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে করা হয়ে গেছে। সূরা নিসা’র ৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় [ক্রমিক নং ২] দেখুন!

27 আল্লাহর বাণী (ان الذين سبقت لهم منا الحسنى اولئك عنها مبعدون)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : যাহাদের জন্য আমার নিকট হইতে পূর্ব হইতে কল্যাণ নির্ধারিত রহিয়াছে তাহাদেরকে উহা (জাহান্নাম) হইতে দূরে রাখা হইবে। (২১:১০১ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধরা এখানেও কাসুন্দির ত্যানা পেঁচিয়ে বলে যে, এখানে ঈসা (আ.)-এর ন্যায় উজায়ের (আ.)-এর কথাও উল্লেখযোগ্য। যেহেতু ইহুদীরা উজায়ের (আ.)-এরও পূজা করত এবং আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করত। অথচ তাদের কেউই নিজেদের উপাস্য হবার দাবী করেননি। ফলে উজায়ের যেমন জান্নাতি হয়েছেন মৃত্যুর পরে, ঈসা (আ.)ও অনুরূপ জান্নাতি হয়েছেন মৃত্যুর পর। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। উত্তরে বলতে চাই যে, আয়াতটির প্রসঙ্গ নিয়ে যারাই চিন্তা করে থাকেন তাদের নিকট গোপন থাকেনি যে, নির্বোধরা কত হীন কায়দায় আয়াতের বিষয়বস্তুকে বিকৃত করেছে। অথচ আয়াতের মানশা বা উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো কোনো মানুষের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে ঈসা, উজায়ের, ফেরেশতা ও বহু সৎলোকেরও তো উপাসনা করা হয়ে থাকে, তাহলে এরাও কি তাদের ইবাদতকারীদের সাথে জাহান্নামে যাবে? আল্লাহতালা তাদের এই শঙ্কা দূর করতেই আয়াতটি নাযিল করেছেন। আসলে সত্যি বলতে কোনো গোষ্ঠী দলিল-প্রমাণে একদমই দেউলিয়া হয়ে গেলে অবস্থা যা হয় কাদিয়ানীদেরও হুবহু তাই হয়েছে!

28 আল্লাহর বাণী (اين ما تكونوا يدرككم الموت و لو كنتم فى بروج مشيدة)-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাইবেই, এমনকি সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করিলেও। (০৪:৭৮ ইফা)।

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াত হতে নির্বোধ কাদিয়ানীরা যে যুক্তি দাঁড় করে সেটি হচ্ছে, আয়াতটি দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, মৃত্যুর হাত থেকে কারো রেহাই নেই। এখনও কেউ নিস্তার পাচ্ছেনা, ভবিষ্যতেও পাবেনা, অতীতেও কেউ পায়নি। ঈসা (আ.)ও না। কেননা আল্লাহর চিরন্তন রীতি বা নিয়মে কোনো ব্যতিক্রম নেই। সুতরাং ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পক্ষে এই আয়াত অত্যন্ত বলিষ্ঠ দলিল। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)। উত্তরে জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আচ্ছা উক্ত আয়াতের সঠিক মর্মার্থ হযরত মুহাম্মদ (সা.) ভালো জানতেন নাকি কাদিয়ানীরা ভালো জানে? একজন প্রকৃত শিক্ষিত মুসলমান অবশ্যই বিশ্বাস করবে যে, পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা ও মর্মবাণী মুহাম্মদ (সা.)ই সবার চেয়ে ভালো বুঝতেন। তাহলে এবার শুনুন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ঈসা (আ.)-এর দীর্ঘ-জীবন সম্পর্কে কী বলে গেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন مَدَّ فِىْ عُمْرِهِ حَتَّى اَهْبَطَ مِنَ السَّمَاءِ اِلَى الْاَرْضِ وَ يَقْتُلُ الدَّجَالَ অর্থাৎ আল্লাহতালা তাঁর (ঈসা) হায়াত দীর্ঘায়িত করে দিয়েছেন, যাতে তিনি আকাশ থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন এবং দাজ্জালকে হত্য করেন। (দেখুন ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রহ. সংকলিত ‘দুররে মানছূর’ খ-২ পৃ-৩৫০)। সুতরাং বুঝা গেল, আল্লাহর সুন্নাহ বা রীতিনীতিকে কাদিয়ানীরা যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে তা পুরোপুরি সঠিক নয়।

29 আল্লাহর বাণী وما اتاكم الرسول فخذوه و ما نهكم عنه فانتهوا-এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : রাসূল তোমাদিগকে যাহা দেয় তাহা তোমরা গ্রহণ কর এবং যাহা হইতে তোমাদিগকে নিষেধ করে তাহা হইতে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ তো শাস্তিদানে কঠোর। (৫৯:০৭ ইফা)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধরা এই আয়াত দিয়েও কাসুন্দি করে বেড়ায়। বলতে পারেন সে কাসুন্দিটা কী রকম? তাহলে শুনুন, তারা বলে যে, এই আয়াতের দাবী হল, মানুষের হায়াত মউতের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কী বলেছেন তা আমাদের দেখা উচিত। এই ব্যাপারে একটি হাদীসে এসেছে, এই পৃথিবীর বুকে (على ظهر الارض) এমন কেউ নেই যে, শত বছর গত হয়ে যাবে তবু জীবিতই থেকে যাবে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হল যে, ঈসা (আ.)ও আর বেঁচে নেই। কারণ তিনি বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স দুই হাজার বছর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)।

জবাবে এই নির্বোধদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে, হাদীসটির সাথে হযরত ঈসা (আ.)-এর সম্পর্ক কোথায়? তাঁর অবস্থান কি পৃথিবীর বুকে না বাহিরে? তাঁর অবস্থান যে পৃথিবীর বুকে নন, বরং বাহিরে; একথার প্রমাণের জন্য কি আল্লাহ এবং তাঁর শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বক্তব্য আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? এখানে আরেকটি কথা ক্লিয়ার করা দরকার যে, দুনিয়ার নিয়ম কানুনের সাথে ঐশী জগতের নিয়ম কানুনকে যারা তুলনা করে বলতে চাচ্ছেন যে, হযরত ঈসা (আ.) বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স দুই হাজার বছর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে তারা মূলত অন্ধাকারেই আছেন। কারণ সময় বা ঞরসব ঐশী জগতে গতিশীল নয়, বরং স্থীর। তাই সেখানে ঈসা (আ.)-এর বয়স বাড়বেনা বরং আগের জায়গায় অর্থাৎ তেত্রিশই থাকবে। মুসলিম শরীফের হাদীসের খন্ডাংশ اذا طأطأ رأسه قطر (তিনি যখন মাথা নিচু করবেন তখন সদ্য গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তির মাথা থেকে যেভাবে পানি ঝরতে থাকে সেভাবে তার মাথা থেকে পানির ফোটা ঝরতে থাকবে) ঐশী জগতে সময় দুনিয়ার ন্যায় গতিশীল নয়, সে কথার দিকেই ইংগিত। (মুসলিম শরীফ, কিতাবুল ফিতান)। উল্লেখ্য, ঈসা (আ.)-কে যখন আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল তিনি তখন সদ্য গোসলখানা থেকে গোসল সেরে বের হয়েছিলেন… (وَرَأسُهُ يَقْطُرُ مَاءُ), (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।

30 আল্লাহর বাণী (او ترقى فى السماء و لن نؤمن لرقيك حتى تنزل علينا كتابا نقرؤه) -এর সঠিক তাৎপর্য।

আয়াত : ‘অথবা তোমার একটি স্বর্ণ নির্মিত গৃহ হইবে, অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করিবে, কিন্তু তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনও ঈমান আনিব না যতক্ষণ তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ না করিবে যাহা আমরা পাঠ করিব। বল (হে মুহাম্মদ)! পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক। আমি তো হইতেছি কেবল একজন মানুষ; একজন রাসূল।’ (১৭:৯৩)।

ব্যাখ্যা : নির্বোধ আর প্রতারকের দল উক্ত আয়াতটি দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে এই বলে ধোকা দেয় যে, এই আয়াতে কারীমা থেকে জানা যায় যে, কাফেররা মহানবী (সা:)-কে সশরীরে আকাশে উঠে যেতে বলেছিল এবং সেখান থেকে একটি কিতাব নিয়ে অবতীর্ণ হতে বলেছিল। কিন্তু তিনি (সা.) তাদেরকে সেই নিদর্শন দেখাতে অস্বীকার করেছিলেন এই বলে যে, তিনি আল্লাহর রাসূল বটে, কিন্তু তিনি তো মানুষ মাত্র। আর মানুষের পক্ষে তো নিজে নিজেই আকাশে উঠে যাওয়া সম্ভব নয় আর আল্লাহও এভাবে কাউকে সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেন না। (কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)।

জবাবে বলতে চাই যে, এই জ্ঞানপাপীর দল আয়াতের মূল কনসেপ্ট আড়াল করার জন্য বরাবরের মত এখানেও প্রতারণা জাল সেঁটেছে। তারা কাফেরদের আরও যে সমস্ত দাবী ছিল সেগুলো চোখবুঁজে এড়িয়ে যায়। কাফেরদের আপ টু বটম দাবীগুলোর উপর চোখ বুলালে একজন সচেতন মানুষ মাত্র কাদিয়ানীদের প্রতারণা বুঝতে পারবে। এই দেখুন, কাফেরদের দাবীগুলো এই রকম ছিল যে,

১. ভুমি হতে এক প্রস্রবণ উৎসারিত করতে হবে।

২. খেজুর ও আংগুরের বাগানের ফাঁকে ফাঁকে নদী-নালা প্রবাহিত করতে হবে।

৩. আকাশকে খন্ড বিখন্ড করে তাদের (কুরাইশ কাফেরদের) উপর ফেলতে হবে।

৪. আল্লাহ এবং ফেরেশতাদেরকে তাদের সামনে উপস্থিত করতে হবে।

৫. মহানবী (সা.)-এর জন্য একটি স্বর্ণ-নির্মিত প্রাসাদও থাকতে হবে।

তার পরেই আল্লাহতালা আয়াত নাযিল করেছেন এই বলে যে, ‘কুল সুবহানা রাব্বী হাল কুনতু ইল্লা বাশারার রাসূলা’। অর্থাৎ বল (হে মুহাম্মদ)! পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক। আমি তো হইতেছি কেবল একজন মানুষ; একজন রাসূল।’ এই আয়াতে মুশরিকরা শুধুমাত্র আকাশে আরোহণের প্রস্তাব দিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকেনি, বরং তাদের সম্পূর্ণ দাবীটা ছিল এরকম যে, “তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনও ঈমান আনিব না যতক্ষণ তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ না করিবে যাহা আমরা পাঠ করিব।” খুব খেয়াল করুন!

  • মক্কার কাফেররা পরিষ্কার বলেছিল যে, “(و لن نؤمن لرقيك) ‘ওয়া লান নু’মিনা লি-রুকিয়্যিকা অর্থাৎ তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনও ঈমান আনিব না”

তাহলে প্রশ্ন আসে, কাফেরদের মূল দাবীটা কী ছিল? কাদিয়ানীরা কত নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদী আর প্রতারক হলে কাফেরদের মূল দাবীকে আড়াল করে কত সূ²ভাবে আমাদের গোমরা করতে পারে চিন্তা করুন!

এই জন্যই আমি বলি যে, কোনো গবেষক বা অবিজ্ঞ আলেম ছাড়া কাদিয়ানীদের এই সমস্ত প্রতারণা সহজে সবার পক্ষে ধরা সম্ভব নয়।

এবার পাঠকবৃন্দ! নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, এই প্রতারকের দল কত সূক্ষ্ম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আয়াতের খন্ডিত বক্তব্যে দুনিয়াকে বোকা বানাতে চাচ্ছে?

এখন তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম যে, ঐ আয়াত ‘আল্লাহ কাউকে সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেন না’ বলেই কনসেপ্ট দেয়, যদি তাই হয় তাহলে আদম এবং হাওয়া দুইজনকে জান্নাত (আকাশ) থেকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া সম্পর্কে আল্লাহর কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটির কী ব্যাখ্যা দেবেন? পবিত্র কুরআনে এসেছে,

‘হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদের বিভ্রান্ত না করে, যেভাবে সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল; সে তাদের পোশাক টেনে নিচ্ছিল, যাতে সে তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখাতে পারে। নিশ্চয় সে ও তার দলবল তোমাদেরকে দেখে যেখানে তোমরা তাদেরকে দেখ না। নিশ্চয় আমি শয়তানদেরকে তাদের জন্য অভিভাবক বনিয়েছি, যারা ঈমান গ্রহণ করে না।’ (সূরা আ’রাফ ২৭)।

শেষকথা,

এখানে শুধুমাত্র তাদের অপব্যাখ্যার খন্ডন মূলক জবাব দেয়া হল, আমাদের আকীদার সপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণই দেয়া হয়নি।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী |

এমন ব্যাকগ্রাউন্ড যার সে কিভাবে ইমাম মাহদী দাবী করতে পারে?

এই সমস্ত চরিত্রহীন বৈশিষ্ট্যের বিচারে মির্যা কাদিয়ানীর ইমাম মাহদী দাবীও গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনা!

  • আসুন! ইমাম মাহদী দাবীদার মির্যা কাদিয়ানী সাহেবকে প্রথমেই একজন “সত্যবাদী” প্রমাণ করা যায় কিনা দেখি!

প্রিয় আহমদীবন্ধুরা! আপনারা যারা মির্যা কাদিয়ানী সাহেবকে “ইমাম মাহদী” বিশ্বাস করেন তাদের নিকট আমার প্রশ্নটি নিম্নরূপ :

১. অসংখ্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী’র কোনো একটি পরিচয়ের সাথেও যার কোনো মিল না থাকা

২. পিতা গোলাম মর্তুজার পেনশনের ৭০০ রূপী নিয়ে উধাও হয়ে চার বছর পর্যন্ত বাড়ীঘরে আর ফিরে না আসা আর ঐ পাঁচ-পঞ্চাশের ঘটনায় উদ্ভট ব্যাখ্যা’র মাধ্যমে চাঁদা দাতাদের সাথে খেয়ানতপূর্ণ আচরণ করা

৩. নিজের জামাতকে ব্রিটিশ সরকারের রোপিত চারাগাছ আখ্যা দেয়া এবং দখলদার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালে মাতৃভূমি উদ্ধারে স্বাধীনতাকামী ভারতীয় মুসলমান প্রজাদের অজ্ঞ, নোংরা চালচলনের মানুষ, অভদ্র ও পাপী বলে নিন্দা ও গালমন্দ করা, তাদের বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়াকে অবৈধ ও হারাম বলা এমনকি ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য করাকে ইসলামেরই একটি অংশ বলা

৪. অর্থ উপার্জনের জন্য ওহীর দোহাই দিয়ে “বেহেশতি মাক্ববেরাহ” নামে ধর্মের মোড়কে কবর ব্যবসার প্রচলন করা

৫. বেগানা মহিলাদের দিয়ে শরীর ম্যাসেজ করা

৬. মুহাম্মদী বেগম নামের একটি মেয়েকে বিয়ের জন্য তার পরিবারকে আমৃত্যু চাপ দেয়া, মেয়েটির অন্যখানে বিয়ে হয়ে যাওয়া সত্ত্বে তার অভিভাবকদের (মেয়েটিকে ফিরে এনে হলেও) তখনও বিয়ে দিতে চাপ অব্যাহত রাখা এবং তার সাথে মেয়েটির বিয়েকে খোদার অখন্ডনীয় নির্দেশ আখ্যা দেয়া অতপর বিয়ে করতে ব্যর্থ হওয়া

৭. লাহোরের পলিমারের দোকান থেকে নিয়মিত “টনিক মদ” কেনা ও আপনা বিশ্বস্ত শিষ্য ডাক্টার বাশারাত আহমদ—’র সাক্ষ্যমতে প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতাকে প্রশমিত করতে সেটি পান করা

৮. ১৮৮৪ সালে নুসরাত জাহানকে বিবাহ করার পর যৌন উত্তেজক ঔষধ “জদঝামে ইশক” নামীয় অষ্টধাতুর আফিম মিশ্রিত মেডিসিনকে খোদার ইলহামি ড্রাগ আখ্যা দিয়ে সেবন করা

৯. আপনা খাস ও বিশ্বস্ত শিষ্য (১৯০৫ সালে হিন্দু থেকে কাদিয়ানী হওয়া) শায়খ আব্দুর রহমান মিছরী’র স্বীকারোক্তি অনুসারে একজন জেনাকার সাব্যস্ত হওয়া

১০. আপনা শিষ্য কথিত মুফতি(!) মুহাম্মদ সাদেক রচিত ‘যিকরে হাবীব’ পুস্তক অনুসারে থিয়েটার (সিনেমা) দেখা

১১. মুখে পান রেখে নামায পড়া

১২. আমৃত্যু যাকাত না দেয়া, হজ্ব না করা এবং ইতিকাফ না করা

১৩. মস্তিষ্কে ব্যাধি এবং বহুমুত্র রোগী হওয়া

১৪. নিজ স্বীকারোক্তি মতেই মিরাক (সিজোফ্রেনিয়া) এবং হিস্টিরিয়া (মূর্ছারোগ) ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকা

১৫. মহানবী (সা:)-এর শানে গোস্তাখিমূলক কবিতার পাঠককে ‘জাজাকাল্লাহ’ বলে সমর্থন করা এবং স্বীয় রচনাবলীর পাতায় পাতায় বিরোধীদেরকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়া

১৬. পবিত্র কুরআনের আয়াত সমূহের অর্থ ইচ্ছাকৃতভাবেই বিকৃত করে তার উপর যুক্তি দাঁড় করা

১৭. নিজের মতকে সঠিক প্রমাণ করতে সহীহ হাদীসের বিপরীতে দুর্বল আর জাল হাদীস দিয়ে দলিল দেয়া, কখনো প্রধান প্রধান মুহাদ্দিসদের নামেও মিথ্যাচার করা

১৮. কখনো হাদীসের শব্দ গায়েব করে ফেলা, কখনো বা হাদীসের উপর নিজ যুক্তি আর খ্রিস্টানদের রচনাবলীকে প্রাধান্য দেয়া

১৯. হাদীস নয় এমন বানোয়াট কথাকে রাসূল (সা:)-এর হাদীস বলে চালিয়ে দেয়া এবং

২০. কথায় কথায় অহেতুক ভবিষ্যৎবাণী করা অতপর সেটি বাস্তবতার মুখ না দেখলে তখন সেটিকে বাস্তব করে দেখানোর জন্য তাবীল আর রূপক ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়া ইত্যাদী যেই লোকটির প্রকৃত চরিত্র, সে কিভাবে আপনাদের (কাদিয়ানী অনুসারীদের) বিচারে আল্লাহর প্রেরিত ও প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী হতে পারে? (উপরের ১-২০ নং এর রেফারেন্স, নিচের ফুটনোট থেকে দেখুন)।

ফুটনোট :

১. বিশেষ করে সুনানে আবুদাউদ, মাহদী অধ্যায় এর মাহদী সংক্রান্ত ১১টি হাদীস দ্রষ্টব্য। মির্যার সাথে সেগুলোর ১টিও মিল নেই। ২. মির্যাপুত্র মির্যা বশির আহমদ এম.এ কর্তৃক পাঁচ খন্ডে রচিত ‘সীরাতে মাহদী’ (উর্দু, নতুন এডিশন) খন্ড ১ পৃষ্ঠা নং ৩৮; বর্ণনা নং ৪৯। পঞ্চাশ খন্ডে বই লিখার ওয়াদা, রূহানী খাযায়েন (উর্দু) খন্ড ৯ পৃষ্ঠা নং ২১। ৩. মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত (উর্দু), নতুন এডিশন খন্ড ৩ পৃষ্ঠা ২১-২২ (ব্রিটিশ সরকারের রোপিত চারাগাছ); হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ৭২; বারাহীনে আহমদিয়া (বাংলা) খন্ড ৩ পৃষ্ঠা নং ৮, প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০১৭ ইং (স্বাধীনতাকামীরা অজ্ঞ, নোংরা ও পাপী), রূহানী খাযায়েন খন্ড ৬ পৃষ্ঠা নং ৩৮০ (ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য ইসলামের অংশ)। ৪. আল ওসীয়্যত (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ২২; ভাষান্তর, এ.এইচ.এম আলী আনোয়ার, পুনঃ মুদ্রন জুন ২০১৪ ইং।

৫. সীরাতে মাহদী (উর্দু), বর্ণনা নং ৭৮০ এবং ৯১০। ৬. রূহানী খাযায়েন খন্ড ৫ পৃষ্ঠা নং ৫৭৩ (আল্লাহ আমাকে বলেছেন, যদি অন্য কারো সাথে এই মেয়ের বিয়ে হয় তাহলে তার [মুহাম্মদী বেগম] জন্যও কল্যাণ নেই, তোমার [আহমদ বেগ] জন্যও কল্যাণ নেই); রূহানী খাযায়েন খন্ড ১১ পৃষ্ঠা নং ৬০ (আমি তোমার নিকট তাকে ফিরিয়ে দেবই, মির্যার ওহী); রূহানী খাযায়েন খন্ড ৫ পৃষ্ঠা নং ৩২৫ (তার নিকট আত্মীয়দের সমস্ত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে হলেও শেষমেষ সে বিধবা হয়ে আমার বিবাহে আসবেই)। ৭. মির্যায়ী মুরিদ হাকিম মুহাম্মদ হুসাইন কুরাইশী রচিত ‘খুতূতে ইমাম বনামে গোলাম’ (উর্দু) পৃষ্ঠা নং ৫; সেই সময় প্রতি-বোতল বাজারমূল্য ছিল পাঁচ দেরহাম, লাহোরি মুভমেন্ট এর ‘পয়গামে ছুলহে’ ৪ই মার্চ ১৯৩৫ইং। ৮. সীরাতে মাহদী ১/৫৪৮, বর্ণনা নং ৫৬৯ (আফিম সংক্রান্ত)। ৯. কাদিয়ানীদের দৈনিক উর্দু সংবাদপত্র আল ফজল তাং ৩১শে আগষ্ট ১৯৩৮ ইং (শায়খ আব্দুর রহমান মিছরীর স্বভাব চরিত্র বিশ্বস্ত এবং নির্মল ও পরিচ্ছন্ন, রূহানী খাযায়েন ১১/৩২৫; তিন’শ তের এর মধ্যে তার সিরিয়াল নং ২৫৫, রূহানী খাযায়েন খন্ড ১১ পৃষ্ঠা নং ৩২৮ দ্রষ্টব্য)।

১০. যিকরে হাবীব (উর্দু) পৃষ্ঠা নং ১৪; ‘দা’ওয়ায়ে নবুওয়ত ওয়া মুজাদ্দিয়ত’ শিরোনাম দ্রষ্টব্য। ১১. সীরাতে মাহদী পৃষ্ঠা ৬০৬ নতুন এডিশন, বর্ণনা নং ৬৩৮। ১২. সীরাতে মাহদী বর্ণনা নং ৬৭২। ১৩. তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ৪৯। ১৪. সীরাতে মাহদী বর্ণনা নং ১৯ ও ৩৭২। ১৫. দৈনিক আল ফজল (উর্দু) ২২ ই আগস্ট ১৯৪৪, পৃষ্ঠা ৪ কলাম ১; আখবারে বদর (উর্দূ) ২৫ শে অক্টোবর ১৯০৬ ইং (মুহাম্মদ সাঃ এর চেয়েও মর্যাদায় সামনে বেড়ে যাওয়া), খানকির ছেলে (রূহানী খাযায়েন খন্ড ৫ পৃষ্ঠা নং ৫৪৮), শুয়োর (রূহানী খাযায়েন খন্ড ১১ পৃষ্ঠা নং ৩৩৭), বেশ্যার বংশ (রূহানী খাযায়েন খন্ড ৮ পৃষ্ঠা নং ১৬৩), হারাম জাদাহ (রূহানী খাযায়েন খন্ড ৯ পৃষ্ঠা নং ৩১), হে মরা খাওয়া মৌলবী (রূহানী খাযায়েন খন্ড ১১ পৃষ্ঠা নং ৩০৫), হিন্দুর বাচ্চা (রূহানী খাযায়েন খন্ড ১১ পৃষ্ঠা নং ৫৯), তাদের উপর হাজার অভিশাপ (রূহানী খাযায়েন খন্ড ১১ পৃষ্ঠা নং ৩৩০) ইত্যাদি প্রায় পাঁচশতের অধিক শব্দে গালি দেয়ার দীর্ঘ লিস্ট রয়েছে। ১৬. আল ওসীয়্যত (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ১৫ মির্যার বিকৃত অনুবাদ “(সূরা মায়েদা ১১৭)…তখন আবার আমি কিভাবে জানতাম যে, আমার পরে তারা কোন বিপথগামিতায় নিপতিত হয়েছিল”। প্রমাণস্বরূপ এখানে মাত্র ১টি দেখানো হল। ১৭. হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ২৩ ও ১৫০ (দাজ্জালের গাধা প্রসঙ্গে), পৃষ্ঠা নং ৩৬ (ঈসা আঃ ১২০ বছর জীবিত থাকা প্রসঙ্গে), পৃষ্ঠা নং ৮১ (সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯-কে স্বীয় যুক্তি দ্বারা বাতিল করা), পৃষ্ঠা নং ১০৩ (প্রধান প্রধান মুহাদ্দিসগণও ঈসার মৃত্যুর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়া প্রসঙ্গে), পৃষ্ঠা নং ১৫০ (আকাশ থেকে ঘোষণা শুনা যে, মাহদী আল্লাহর খলিফা প্রসঙ্গে), পৃষ্ঠা নং ১৫৮ (ইমাম বুখারীর নামে মিথ্যাচার)।

১৮. হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ১৫৮ (ঈসা আঃ আফীক পাহাড়ে নাযিল প্রসঙ্গে। এখানে ‘আকাশ’ শব্দ বাদ দিয়ে লিখা হয়েছে। অথচ মূল হাদীসগ্রন্থে ‘আকাশ’ শব্দ এখনো আছে। কাঞ্জুল উম্মাল, হাদীস নং ৩৯৭২৬ দ্রষ্টব্য) ইত্যাদি। ১৯. হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ২৩ (ফেরেশতা দাজ্জালের মুখ সিরিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দেবে সেখানে সে ধ্বংস হবে প্রসঙ্গে), ২৬ (রাসূল সাঃ স্বপ্নে দেখেছেন, দাজ্জাল তার দুইহাত দুই ব্যক্তির কাঁধে রেখে কাবা শরীফ তাওয়াফ করছে), ৩১, ৩২ (মাহদী হিজরী বা ইসলামী শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে আসবেন প্রসঙ্গে), ৩৩, ৬১, ৬৫, ৬৬, ৬৯, ৮৩, ১৫১-১৫৪ (‘দাব্বাতুল আরয’ নামক কীটের পা মাটিতে এবং মাথা গগনচুম্বী প্রসঙ্গে), আল ওসীয়্যত (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ১৪ (হাদীসের নামে মিথ্যা উদ্ধৃতি : نبى الله و امامكم منكم অর্থাৎ তিনি নবী ও উম্মতী দুই-ই হবেন। অথচ এইরূপ শব্দচয়নে কোনো হাদীস নেই) ইত্যাদি। মির্যার অজ্ঞতাপূর্ণ অথবা খেয়ানতপূর্ণ কয়েকটি উক্তি হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ৩০, ৩৪, ৪৭, ৪৯, ৫৬ হতে। ২০. এজন্য আমার লেখিত ‘আহমদীবন্ধু ইসলামে ফিরে এসো’ বইটিও দেখা যেতে পারে। আমি মনে করি, মির্যা কাদিয়ানীকে আবিষ্কার করতে এতটুকু জানাই যথেষ্ট।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

লোহা, লেবাস, গবাদিপশু ইত্যাদি এগুলোও কি আকাশ থেকে নাযিল হয়েছে?

আল-কুরআনে লোহা, পোশাক, গবাদিপশু ইত্যাদি নাযিল হওয়ার আয়াত ও কাদিয়ানীদের ভ্রান্তি নিরসন :

আলোচনা শুরুর আগে কাদিয়ানীদের প্রশ্ন-সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো দেখে নিন :

১. সূরা হাদীদ আয়াত >> ২৭। আল্লাহতালা বলেন, ওয়া আনযালনা আলাইকুমুল হাদীদা অর্থাৎ আমি তোমাদের জন্য লোহা নাযিল করেছি।

২. সূরা আ’রাফ আয়াত >> ২৬। আল্লাহতালা এখানে ‘ক্বদ আনযালনা’র পরে বলেছেন, ‘আলাইকুম লিবাসা’ অর্থাৎ আমরা তোমাদের জন্য লেবাস (পোশাক) অবতীর্ণ করেছি।

৩. সূরা যুমার আয়াত >> ৬। আল্লাহতালা এ আয়াতে ‘আনযালা’র পরে বলেছেন, ‘লাকুম মিনাল আন’আমি ছামানিয়াতা আঝওয়াজ’। অর্থাৎ তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য আট জোড়া গবাদিপশু নাযিল করেছেন’।

৪. সূরা ত্বালাক আয়াত >> ৯। আল্লাহতালা এই আয়াতের ‘ক্বদ আনযালাল্লাহু’ এর পরেই বলেছেন, ইলাইকুম যিকরা। অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের প্রতি কুরআন নাযিল করেছেন। তার পরের আয়াতে আছে ‘রাসূলা’ অর্থাৎ রাসূল নাযিল করেছেন (কাদিয়ানীদের অনুবাদ অনুসারে)।

  • বলে রাখতে চাই যে, ইমাম সুয়ূতী (রহ:) সহ সকল যুগ ইমাম সূরা ত্বালাক এর ৯ নং আয়াতের ‘ক্বদ আনযালাল্লাহু’ এর পরের আয়াতে ‘রাসূলান’ এর তাফসীরে লিখেছেন এখানে رسولًا এর পূর্বে أَرسَلْنَا ক্রিয়াপদ ঊহ্য মেনে নিতে হবে। ফলে অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহতালা অবতীর্ণ করেছেন উপদেশ (কুরআন) এবং প্রেরণ করেছেন এক রসূল। অতএব, এই আয়াত দ্বারা “রাসূল (সা:)ও আকাশ থেকে নাযিল হলেন কিনা” কাদিয়ানীদের এই প্রশ্ন চরম মূর্খতাপূর্ণ বৈ নয়।

একটি প্রশ্নের জবাব :

  • কাদিয়ানীদের প্রশ্নটি এরকম, “নাযিল” শব্দ থাকলেই কোনো জিনিস ‘আকাশ’ থেকে অবতীর্ণ হওয়াকে আবশ্যক করেনা। যদি ‘নাযিল’ হওয়া মানে ‘আকাশ’ থেকেই অবতীর্ণ হওয়াকে আবশ্যক করত তখন প্রশ্ন আসবে যে, তবে কি আয়াতের আট জোড়া গবাদিপশুও আকাশ থেকে নাযিল হয়েছিল? লেবাস বা পোশাক পরিচ্ছেদও কি আকাশ থেকে ছিল? রাসূল অবতীর্ণ হওয়াটাও কি আকাশ থেকে বুঝাল? যেহেতু এখানে নাযিল হওয়ার অর্থ আকাশ থেকে নাযিল হওয়াকে বুঝায়নি সেহেতু ঈসা (আ:) সম্পর্কেও যেই ‘নাযিল’ অর্থাৎ অবতীর্ণ হওয়ার কথা এসেছে তার-ও একই অর্থ উদ্দেশ্য হবে। অর্থাৎ ঈসা (আ:) নাযিল হওয়ার মানে ‘আকাশ থেকে’ অবতীর্ণ হওয়া উদ্দেশ্য নয়। (কাদিয়ানিদের বক্তব্য শেষ হল)।

আমার জবাব : জ্বী হ্যাঁ, আমরাও আপনাদের উক্ত যুক্তির সাথে একমত হতে পারতাম যদি হযরত ঈসা (আ:) সম্পর্কে “নাযিল” শব্দের পাশাপাশি একাধিক সহীহ হাদীসে মিনাস সামায়ি (من السماء) বা ‘আকাশ থেকে নাযিল হবে’ শব্দ-ও উল্লেখ না থাকত এবং হাদীসের মধ্যে হযরত ঈসা (আ:)-এর আগমনী ভবিষ্যৎবাণীতে ‘রুজূ’ (رجوع) তথা ঈসা (আ:) দ্বিতীয়বার ফিরে আসবেন, এজাতীয় শব্দ-ও না হত। অধিকন্তু হযরত ঈসা (আ:)-এর আগমনী ভবিষ্যৎবাণীতে রাসূল (সা:) শপথ বাক্যসহ সংবাদ দেয়ার প্রমাণও রয়েছে। ফলে দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হল যে, আগত ঈসা (আ:) রূপক কোনো ঈসা নন এবং এতদ-সংক্রান্ত হাদীসগুলোর ‘নুযূল’ শব্দটিও প্রকৃত অর্থের বাহিরে রূপক অর্থে উদ্দেশ্য নয়!

এবার জবাবের খোলাসা :

বিজ্ঞ পাঠকবৃন্দ! এই পর্যায় ‘মিনাস সামায়ি’ (من السماء অর্থাৎ আকাশ থেকে) শীর্ষক অনেকগুলো হাদীসের মধ্য হতে শুধুমাত্র একটি সহীহ হাদীস পেশ করছি, বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন: كيف انتم إذا نزل ابن مريم من السماء فيكم و امامكم منكم অর্থাৎ তখন তোমাদের কেমন (আনন্দের) হবে যখন ইবনে মরিয়ম (ঈসা) মিনাস সামায়ি তথা আকাশ থেকে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন আর তখন তোমাদের ইমাম (মাহদী) তোমাদের মধ্য হতে হবেন। [দেখুন, সুনানে বায়হাক্বীর সংকলক কর্তৃক সংকলিত ‘আল আসমা ওয়াস সিফাত’ ২/৩৩১; হাদীস নং ৮৯৫, বাবু ক্বওলিল্লাহি আজ্জা ওয়া জাল্লা লি-ঈসা ইন্নী মুতাওয়াফ্ফীকা ওয়া রাফিউকা ইলাইয়্যা; হাদীসের মান : সহীহ]।

স্ক্রিনশট :

ইমাম বায়হাক্বীর ‘আল-আসমা ওয়াস সিফাত’ ২/৩৩১

তাওয়াতূর পর্যায়ের অসংখ্য হাদীস দ্বারা ঈসা (আ:) এর নাযিল হওয়া মানে আকাশ থেকে-ই নাযিল হওয়া উদ্দেশ্য। ক্লিক করুন >> 235

এখন প্রশ্ন হল, ঈসা (আ:)-এর আগমনী ভবিষ্যৎবাণীতে তাঁর (আ:) আগমন সম্পর্কে হাদীসে ‘রুজূ’ (رجوع) শব্দ থাকলে তাতে কিজন্য ঈসা (আ:) প্রকৃতপক্ষেই আকাশ থেকে ফিরে আসা সঠিক সাব্যস্ত হবে? মির্যা কাদিয়ানী সাহেব থেকে কি এধরণের কোনো কথার প্রমাণ আছে?

এর উত্তর হল, জ্বী হ্যাঁ। আপনি ‘রূহানী খাযায়েন’ এর ২৩ নং খন্ডের ২২৯ নং পৃষ্ঠাটি খুলে দেখুন, মির্যা সাহেব লিখেছেন, ঈসা (আ:) এর আগমন সম্পর্কে হাদীসে ‘রুজূ’ (رجوع) শব্দ থাকলে তখনি তাঁর (আ:) ফিরে আসার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে “আকাশ থেকেই” ঘটবে বলে সাব্যস্ত হবে। যেজন্য মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক স্বীকৃত বিগত তেরশত শতাব্দির সমস্ত মুজাদ্দিদ ও যুগ ইমাম সবাই ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, আগত ঈসা ইবনে মরিয়ম মানে বনী ইসরাইলী ঈসা ভিন্ন কেউ নন এবং তিনি এখনো আকাশে জীবিত আছেন।

স্ক্রিনশট :

রূহানী খাযায়েন ২৩/২২৯

তাহলে ঈসা (আ:)-এর দুনিয়ায় ফিরে আসা শীর্ষক ‘রুজূ’ (رجوع) শব্দ সম্বলিত হাদীসটি কী?

জ্বী জনাব! হাদীসটি এই যে, (ক) রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, و ان الله رفعه بجسده و أنه حى الآن و سيرجع إلى الدنيا فيها ملكا ثم يموت অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহতালা তাঁকে (ঈসা) সশরীরে উঠিয়ে নেন এবং তিনি এখনো জীবিত। অতিসত্বর তিনি পৃথিবীতে রুজূ করবেন তথা ফিরে আসবেন। তখন তিনি পৃথিবীতে একজন বাদশাহ হবেন। তারপর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন।” (দেখুন হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত, ইবনে সা’আদ [মৃত: ২৩০হিজরী] সংকলিত ‘আত-তবকাতুল কাবীর‘ : খন্ড ১ পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬; প্রকাশনায়, মাকতাবাতুল খানজী, কায়রো মিশর)।

() রাসূল (সা:) জনৈক ইহুদীকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ان عيسى لم يمت و أنه راجع إليكم قبل يوم القيامة অর্থাৎ নিশ্চয়ই ঈসা (আ:) মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি নিশ্চয়ই কেয়ামতের আগে তোমাদের নিকট ফিরে আসবেন। (তাফসীরে তাবারী ৫/৪৪৮)।

স্ক্রিনশট : (ক)

স্ক্রিনশট : (খ)

তারপর জানার বিষয় হল, হাদীসে শপথ বাক্যসহ কোনো সংবাদ বর্ণিত থাকার দরুন সংবাদটি প্রকৃত অর্থের বাহিরে রূপক অর্থে উদ্দেশ্য হবে না, এমন কোনো কথাও কি মির্যা কাদিয়ানীর রচনায় উল্লেখ আছে?

এর জবাব হল, আপনি মির্যা কাদিয়ানীর রচনাবলীর সমষ্টি ‘রূহানী খাযায়েন’ এর ৭ নং খন্ডের ১৯২ নং পৃষ্ঠাটি খুলে দেখুন। মির্যা সাহেব স্পষ্টতই লিখে গেছেন, ‘শপথ করে কোনো কথা বলা একথারই প্রমাণ বহন করে যে, নিশ্চয়ই খবর তথা হাদীসটি আক্ষরিক অর্থেই ধর্তব্য হবে। সেখানে রূপক অর্থ করা চলবেনা। নতুবা শপথ করে লাভ কী হল?’ (আরো দেখুন, হামামাতুল বুশরা, বাংলা অনূদিত পৃষ্ঠা নং ২৭)।

স্ক্রিনশট :

হামামাতুল বুশরা, বাংলা অনূদিত পৃষ্ঠা নং ২৭

আর আমরা জানি, সহীহ বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়ার ৩২৬৪ নং হাদীসে হযরত ঈসা (আ:) এর নাযিল সম্পর্কিত বর্ণনা শুরুতে রাসূল (সা:)-এর দ্ব্যর্থহীনভাবে শপথবাক্য ‘ওয়াল্লাযী নাফসি বিয়াদিহি (والذي نفسى بيده) …’ উল্লেখ রয়েছে। এতে একদম পরিস্কার হয়ে গেল যে, ঈসা (আঃ) এর নাযিল হওয়া মানে প্রকৃতপক্ষেই আকাশ থেকে তাঁর অবতীর্ণ হওয়া-ই উদ্দেশ্য! নতুবা ‘শপথ’ ব্যক্ত করে লাভ কী হল? প্রায় দেড়’শ সহীহ হাদীস রয়েছে যদ্দ্বারা ঈসা (আ:) এর পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত। উপরের লিংক থেকে দেখে নিন। সুতরাং ঈসা (আ:) এর “নাযিল” শব্দের সাথে অন্যান্য গুলোর “নাযিল” শব্দকে বিশেষ কোনো ক্বারীনা ছাড়া এক ও অভিন্ন মনে করার কোনো কারণ নেই। সংক্ষেপে।

সহীহ বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া, অনলাইন ভার্সন

এবার জানার বিষয় হল, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) ভিন্ন অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘নাযিল’ শব্দের প্রকৃত অর্থ পরিত্যাজ্য হয়ে কাছাকাছি ভিন্ন অর্থ নেয়ার কারণ কী?

এর জবাব হল, বরেণ্য তাফসীরবিদগণের তাফসীরে ঈসা (আ:) ভিন্ন অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘নাযিল’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ত্যাগ করে তার কাছাকাছি ভিন্ন অর্থ নেয়ার প্রধান কারণ হল, সেসব আয়াতে উল্লিখিত ‘নাযিল’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ইসলামের আদিম ও তিন স্বর্ণযুগ থেকেই পরিত্যাজ্য এবং তার কাছাকাছি ভিন্ন অর্থ গ্রাহ্য। যেহেতু সেসব আয়াতের ‘নাযিল’ শব্দের বিশ্লেষণে রাসূল (সা:) কিংবা কোনো একজন সাহাবী বা তাবেয়ীর তাফসীরেও ‘মিনাস সামায়ি’ তথা আকাশ থেকে শব্দ উল্লেখ পাওয়া যায়না। অথচ এর বিপরীতে হযরত ঈসা (আঃ)-এর “নাযিল” শব্দের প্রকৃত অর্থ নেয়ার পক্ষে বহু ক্বারীনা (قرينة) তথা নিদর্শন এবং উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ বিদ্যমান।

শেষকথা: তাফসীরশাস্ত্রে যাদের সামান্যতম হলেও ধারণা আছে তারা জানেন যে, পবিত্র কুরআনের অনুবাদ নেয়ার ক্ষেত্রে কুরআনের অপরাপর আয়াত আর সুন্নাহ উভয়ের সামঞ্জস্যতার বিধান মানা আবশ্যক। যার যেভাবেই খুশি অর্থ নেয়া সুস্পষ্ট বিকৃতি আর মুলহিদানা চরিত্রের শামিল! তাই সালফে সালেহীনগণ এই নিয়মের ভিত্তিতেই পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করে গেছেন। মজার ব্যাপার হল, এরূপ স্বতঃসিদ্ধ ও সুপ্রতিষ্ঠিত নিয়মের সমর্থনে খোদ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও লিখে গেছেন। ‘রূহানী খাযায়েন’ এর ১০ নং খন্ডের ৮৬ নং পৃষ্ঠাটি খুলে দেখুন! পরিষ্কার লিখা আছে,

  • “প্রথম হল কুরআন শরীফ। কিন্তু স্মরণ রাখা চাই যে, কুরআনের কোনো আয়াতের সেই মর্মার্থই আমাদের নিকট (সঠিক বলে) বিবেচিত যার পক্ষে কুরআনের অপরাপর আয়াত সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। কেননা কুরআনের কোনো কোনো আয়াত অপর আয়াতের ব্যাখ্যাকারী। এমনকি কুরআনের পরিপূর্ণ ও অকাট্য মর্মের উদঘাটন যদি কুরআনের অপরাপর স্থানগুলো দ্বারাও সহজলভ্য না হয়ে থাকে তখন তার জন্যও শর্ত হচ্ছে কোনো সহীহ, মারফূ ও মুত্তাসিল হাদীসও তার (আয়াতের) ব্যাখ্যাকারী হবে।”

এখন যেসব কাদিয়ানী-উম্মত ‘কুরআন থাকতে হাদীসে যেতে হবে কেন?’ এরূপ চটকদার ও মূর্খতাপূর্ণ যুক্তির আড়ালে নিজেদের ঈমানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঢেলে দিচ্ছেন তারা এবার মির্যা গোলাম আহমদকে কী বলবেন? কেননা সে নিজেও কুরআনের সঠিক মর্মার্থ উদঘাটন করতে মারফূ ও মুত্তাসিল স্তরের সহীহ হাদীসকে আয়াতের ব্যাখ্যাকারী বলে লিখে গেছেন! তাই তাওয়াতূর পর্যায়ের অসংখ্য হাদীস দ্বারা যেখানে ঈসা (আ:)-এর “নাযিল” হওয়া মানে আকাশ থেকে অবতীর্ণ হওয়াই উদ্দেশ্য, সেখানে লোহা, লেবাস, গবাদিপশু ইত্যাদি “নাযিল” এর কুরআনিক শব্দকে হযরত ঈসা (আ:)-এর “নাযিল” এর অ-কুরআনিক শব্দের মুকাবিলায় দাঁড় করতে চাওয়া কতটা গণ্ডমূর্খতা তা নিজেরাই একবার চিন্তা করে দেখুন! আশাকরি জবাব পেয়েছেন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
তাং ০১/১২/২০

কাদিয়ানীরা বর্তমানে কত দলে বিভক্ত জেনে নিন

কাদিয়ানীরা কম-বেশী বর্তমানে ১৪ দলে বিভক্ত এবং তাদের প্রত্যেকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটগুলোও ভিন্ন ভিন্ন :

  • উল্লেখ্য কাদিয়ানীরা মুসলমানদের তাচ্ছিল্য করে বলে, আরে আরে তোমরা মুসলিমরা ৭৩ ভাগে বিভক্ত আর অপরদিকে আমরা (অর্থাৎ কাদিয়ানীরা) শুধুই এক দল, অথচ তাদের এই দাবী শতাব্দীর জঘন্য মিথ্যা।

কাদিয়ানীদের কয়েকটি দলের নাম হল,

১. জামাতে আহমদীয়া ইন্দোনেশিয়া গ্রুপ। এদের আকীদা হল, এরা মির্যা কাদিয়ানীকে শুধুমাত্র একজন শিক্ষক মানেন। নবী রাসূল মানেন না।

২. জামাতে আহমদীয়া লাহোরী মুভমেন্ট। এই দলের বর্তমান প্রধান প্রফেসর আব্দুল করীম সাঈদ (www.aaiil.org). এই দল দুটি হেকিম নূরুদ্দীন এর মৃত্যুর পরপরই সৃষ্টি হয়েছিল। এরাও তাকে নবী রাসূল মানে না।

আব্দুল করীম সাঈদ

৩. জামাতে আহমদীয়া ইসলাহ পছন্দ। এই দলের বর্তমান প্রধান আব্দুল গাফফার জম্বাহ (www.alghulam.com). এদের অন্যতম বিশ্বাস, আব্দুল গাফফার জম্বাহ-ই কথিত মুসলেহ মওউদ।

আব্দুল গাফফার জাম্বাহ

৪. গ্রীন আহমদীয়া। এই দলের প্রধান, মির্যা রফি আহমদ (www.greenahmadiyyat.org). এরাও মির্যাকে নবী রাসূল মানেনা। উল্লেখ্য ইনি কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলিফা মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ আহমদের ছেলেদের একজন। কাদিয়ানী চতুর্থ খলিফা নির্বাচনের সময়ে সে খলিফা নির্বাচিত হয়েছে বলে শোনা যায়। (এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই -লিখক) কিন্তু মির্যা তাহির আহমদ পরবর্তীতে খলিফা হওয়ায় তিনি নিজেও ‘গ্রীন আহমদীয়া‘ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সে যে খলিফা হতে চেয়েছিল এটা নিশ্চিত। যতদূর জানা যায়, মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ আহমদ এর দুই সংসার ছিল। দুই সংসারে মোট ২৮ জন সন্তান ছিলো। ‌ফলে ১৯৬৪ সালে পিতার মৃত্যুর পর এদের মধ্যে ক্ষমতার মসনদ নিয়ে গন্ডগোল হয়, হওয়াটাই স্বাভাবিক।

রফি আহমদ

৫. জামাতে আহমদীয়া আল-মুসলিমীন। এই দলের প্রধান জাফর উল্লাহ ডায়মন্ড (www.jaam-international.org).

জাফর উল্লাহ ডায়মন্ড

৬. জামাতে আহমদীয়া হাকীকী। এই দলের প্রধান, নাসির আহমদ সুলতানী (www.ahmadiyyah.org).

নাসির আহমদ সুলতানী

৭. জামাতে আহমদী কাদিয়ানী (মাহমূদী) গ্রুপ। এই দলের বর্তমান প্রধান মির্যা মাসরূর আহমদ কাদিয়ানী (www.alislam.org).

মির্যা মাসরূর আহমদ

৮. আনওয়ারুল ইসলাম মুভমেন্ট অফ আফ্রিকা। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান আলহাজ্ব জিব্রিল মার্টিন (https://wiki.qern.org/ahmadiyya/organisations/qadiani/anwar-ul-islam-movement-of-nigeria). দলটি নাইজেরিয়াতে (আফ্রিকা) খুব তৎপর। আলহাজ্ব জিব্রিল মার্টিন (২০ নভেম্বর ১৮৮৮ – ১৩ জুন ১৯৫৯) সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি একজন নাইজেরিয়ান আইনজীবী এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন যিনি নাইজেরিয়ান আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। নাইজেরিয়ার স্বাধীনতার পর তিনি নাইজেরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের হজ পিলগ্রিমস বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন। তিনি নাইজেরিয়ার আহমদীয়া জামাতের একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। তিনি মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদের সময়টিতেই কাদিয়ানী জামাত থেকে আলাদা হয়ে যান এবং নিজেই নতুন দল গঠন করেন। বর্তমানে নাইজেরিয়ার অধিকাংশ এলিট শ্রেণীর কাদিয়ানী তারই অনুসারী। (উইকিপিডিয়া)।

আলহাজ্ব জিব্রিল মার্টিন

৯. আহমদীয়া সহীহ ইসলাম। এই দলের বর্তমান প্রধান মুনীর আহমদ আজিম (www.jamaat-ul-sahih-al-islam.com).

মুনির আহমদ আজিম

১০. আহমদীয়া জায়েদখান গ্রুপ। এই দলের প্রধান, জায়েদখান। দলটির কিছু তৎপরতা জার্মানিতে চোখে পড়ার মত।

আমীর, জায়েদখান জার্মানি।

১১. আহমদীয়া তাহের নাসিম গ্রুপ। এই দলের প্রধান তাহের নাসিম। তিনি ৩০ই জুলাই ২০২০ইং পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি আদালতে শুনানিকালে গাজি খালেদখান নামক এক যুবকের গুলিতে নিহত হন।

তাহের নাসিম

১২. তিমাহপুরী গ্রুপ। এই দলের প্রধান আব্দুল্লাহ তিমাহপুরী। সে মির্যা কাদিয়ানীর মুরিদ ছিল এবং মির্যা কাদিয়ানীর জীবদ্দশাতেই নবুওয়তের দাবী করেছিল।

১৩. আহমদীয়া আসাদশাহ গ্রুপ। এই দলের প্রধান, আসাদশাহ। সেও কয়েক বছর পূর্বে আমেরিকায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়।

আমীর, আসাদশাহ (জন্ম : রাবওয়া, পাকিস্তান)

১৪. লাহোরী ইন্দোনেশিয়ান গ্রুপ। এরা মির্যা কাদিয়ানীর মুরিদ মুহাম্মদ আলী লাহোরীর চিন্তাধারায় প্রভাবিত ও তার গ্রুপ থেকেই ছিটকে পড়া হলেও মূলত কাদিয়ানী জামাতেরই একটি ফেরকা। এই হল বর্তমান কাদিয়ানী জামাতের বিভক্তির সংক্ষিপ্ত তালিকা। আস্তে আস্তে এ তালিকা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। সুতরাং কাদিয়ানীদের দাবী, তারা একটিমাত্র দল; তাদের এই কথা জঘন্য মিথ্যা। বাকি দলগুলোর প্রধানদের ছবি এবং অবশিষ্ট দলীয় অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ঠিকানা আস্তে আস্তে যুক্ত করে দেব, ইনশাআল্লাহ।

সহজে কাদিয়ানী চেনার উপায়

কাদিয়ানীদের রচনাবলীতে মুসলমানদের কাফের-হারামজাদাহ, বেশ্যার পোলা, মুশরিক, জাহান্নামি আখ্যা দেয়া (প্রমাণসহ)

পবিত্র কুরআন দ্বারাও ঈসা (আ.) এখনো জীবিত থাকা ও দুনিয়ায় দ্বিতীয়বার আগমন করা সুস্পষ্ট ইংগিতে প্রমাণিত

সূরা তওবাহ আয়াত ৩৩ দ্বারাও ঈসা (আ.) জীবিত থাকা প্রমাণিত

তথ্য সংগ্রহে : প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।

শাহ কাশ্মীরী রহ. এর কবরের নেম প্লেটে ‘খাতামুল ফুক্বাহা ওয়াল মুহাদ্দিসীন’ লিখার জবাব

হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) এর কবরের নেম-প্লেটে “খাতামুল বা খাতিমুল ফুক্বাহা ওয়াল মুহাদ্দিসীন” উল্লেখ থাকা এবং কাদিয়ানিদের ওয়াস-ওয়াসাপূর্ণ আপত্তির জবাবে আজকের এই লিখাটি :

কবরের উপর স্থাপিত নেম প্লেট
  • আগে তাদের আপত্তি জেনে নিন!
  • তাদের বক্তব্য হল, ‘খাতাম’ অর্থ শ্রেষ্ঠ, কিন্তু ‘শেষ’ নয়। সে হিসেবে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ অর্থ শেষনবী নয় বরং শ্রেষ্ঠ নবী। অতএব মুহাম্মদ (সা:) এর পর আর কোনো নবী নেই বলা ঠিক নয়, বরং নবী আছে তবে নতুন শরীয়তবাহক নবী নেই। মুহাম্মদ (সা:) এই হিসেবেই ‘শেষনবী’। কারণ, খাতাম অর্থ ‘শেষ’ হলে তখন প্রশ্ন আসবে, শাহ কাশ্মীরী রহ. কিভাবে খাতামুল মুহাদ্দিসীন হলেন? তবে কি তাঁর পরে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো মুহাদ্দিস হবেনা? এখন যারা মুহাদ্দিস আছেন তারা কি মুহাদ্দিস নন?

আমার বক্তব্য :

১. আগে বলুন, কাদিয়ানী প্রথম খলিফা হেকিম নূরুদ্দীন এর এই বক্তব্য সম্পর্কে আপনারা কী বলবেন?

হেকিম নূরুদ্দীন সাহেব নিজেই কিন্তু বলে গেছেন যে, মুহাম্মদ (সা:) এর পর আর কোনো নবী নেই। (সূত্র : হযরত মৌলভি নুরউদ্দীন (রা.) খলীফাতুল মসীহ আউয়াল, পৃষ্ঠা নং ৯১ দ্রষ্টব্য)। স্ক্রিনশট দেখুন,

২. মির্যা কাদিয়ানীর পুত্র মির্যা বশির আহমদ এম.এ তিনি তার লেখিত “কালিমাতুল ফছল” বইটির ৯৩ নং পৃষ্ঠায় কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপের প্রধান মুহাম্মদ আলী লাহোরীর একটি বক্তব্যকে খন্ডন করতে গিয়ে কাদিয়ানিদের প্রথম খলিফা(?) হাকিম নূরুদ্দিন সম্পর্কে লিখেছেন : اگر بفرض محال مان بہی لیا جاوئے کہ حضرت خلیفہ اول کا یہی خیال تہا جو مولوی محمد علی صاحب نے ظاہر کیا ہے تو تب بہی کوی حرج واقع نہیں ہوتا کیونکہ حضرت خلیفہ اول مامور نہیں تہے کہ عقائد میں ان کا فیصلہ ہمارے لئے حجت ہو۔ অর্থাৎ “যদি মেনেও নিই যে, মৌলভি মুহাম্মদ আলী লাহোরীর যেই আকীদা সেটি খলিফা-এ আউয়াল (হাকিম নূরুদ্দিন)’রও আকীদা, তবুও কোনো সমস্যা নেই। কেননা হযরত খলিফা-এ আউয়াল মামূর (প্রত্যাদিষ্ট) ব্যক্তি ছিলেন না যে, আক্বায়েদের (ধর্মমত) ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য দলিল হতে পারে!”

স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য :

হার্ডকপি

কাদিয়ানীদের বিবেকের কাছে আমার প্রশ্ন :

কাদিয়ানিদের নিকট আমার প্রশ্ন, হাকিম নূরুদ্দিন সাহেব যিনি কাদিয়ানী জামাতের প্রথম খলিফা(?), তার সম্পর্কে মির্যা বশির আহমদ এম.এ লিখেছেন সে মামূর তথা প্রত্যাদিষ্ট ছিলেন না; তাই আক্বায়েদের ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত নাকি আপনাদের জন্য কোনো দলিল নয়! এমতাবস্থায় শাহ আনওয়ার কাশ্মীরী (রহ:) এর কবরের উপর স্থাপিত নেম-প্লেটটিতে “খাতিমুল বা খাতামুল ফুকাহা ওয়াল মুহাদ্দিসীন” শব্দটি যিনি লিখলেন তিনি যদি এই অর্থেই লিখেন যে, সত্যি-ই শাহ আনওয়ার কাশ্মীরী (রহ:) এর পর আর কোনো ফকিহ কিবা মুহাদ্দিস নেই, তার এই সিদ্ধান্তটাও আমাদের মুসলিম উম্মাহার ইজমার বিপরীতে ধর্তব্য হবে কেন? সে কি আল্লাহ, রাসূল নাকি যুগ ইমাম বা মামূর মিনাল্লাহ (আল্লাহর পক্ষ হতে প্রত্যাদিষ্ট) ব্যক্তি?

এখন যদি তিনি প্রকৃতপক্ষেই “মামূর মিনাল্লাহ” হয়ে থাকেন তাহলে সেটি প্রমাণ করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আপনাদের, তাই নয় কি? যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি অনুরূপ কেউ, তখনি কেবল আপনাদের উক্ত আপত্তি আমাদের পক্ষে আমলে নেয়ার মত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে! তার আগে নয়!

আপনারা যেখানে হাকিম নূরুদ্দিন এর মত একজন কথিত খলিফা-এ আউয়ালের সিদ্ধান্তকে দলিল মানতে নারাজ সেখানে কোথায়কার কে কী লিখল তাতে আল্লাহর কালাম, রাসূল (সা:) এর অসংখ্য হাদীস, ইজমায়ে সাহাবা এবং যুগ ইমামদের অগনিত বক্তব্য সবগুলো কি মুহুর্তেই হাওয়ায় মিশে যাবে??? আপনাদের এই কেমন ইনসাফ!!

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক