উত্তরদাতা :
প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটাই অমূলক ও বিভ্রান্তিকর। কেননা কোনো সুস্থ্য-সবল মুসলিম জেনে-বুঝে কখনো উটের প্রস্রাব পান করেনা, করতে কাউকে উৎসাহিতও করেনা। বরং ইসলামের উপর এধরণের বেশিরভাগ আপত্তি অগভীর এবং অস্বচ্ছ, বিদ্বেষ মূলক এবং যাচাই-বাছাই বিহীন। আসুন, জবাবটা নিন।
- রাসূল (সা.)-এর হাদীস সমূহকে সামনে রাখলে নিচের বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে যে,
১। হাদীসের কোথাও মুসলমানদেরকে উটের প্রস্রাব পান করতে বলা হয়নি, বরং উটের প্রস্রাব পান করতে চাওয়ায় নির্দিষ্ট একটি রোগাক্রান্ত সম্প্রদায়কে সাময়িক সময়ের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছিল মাত্র। এই সংক্রান্ত সবগুলো বর্ণনা দেখলে এটাই প্রতীয়মান হবে।
২। সুস্থ্য কাউকে নয়, বরং নির্দিষ্ট একটি অসুস্থ সম্প্রদায়কে রোগমুক্তির জন্য স্রেফ প্রতিষৌধক হিসেবেই তা পান করতে অনুমতি দিয়েছিলেন।
৩। ঐ সম্প্রদায়টি মুসলিম ছিল না, তবে ইসলাম গ্রহণ করার আগ্রহ জানিয়েছিল কিন্তু বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করার পর পরবর্তীতে মুরতাদ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটায় বলা যাচ্ছে যে, ঐ সম্প্রদায়টি মূলত মুনাফিকই ছিল।
৪। অমুসলিম সম্প্রদায়টি ইসলাম গ্রহণের আর্জি নিয়ে মদীনায় রাসূল সা.-এর নিকট এসে নিজেদের অসুস্থতার অভিযোগ করে উটের প্রস্রাব পান করতে আগ্রহ পেশ করায় রাসূল সা. তাদেরকে সেটি দুধের সাথে মিশিয়ে পান করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন শুধুমাত্র রোগের প্রতিষৌধক হিসেবে, সাধারণভাবে ও নিঃশর্তভাবে নয়।
৫। উটের প্রস্রাব পান করার উক্ত পরামর্শ সাধারণ কোনো বিধান বা উদ্বুদ্ধমূলক বিষয় ছিল না, শুধুমাত্র সময়সাপেক্ষ ও নির্দিষ্ট একটি রোগাক্রান্ত সম্প্রদায়ের জন্য, যারা ভিনদেশী ছিলেন এবং মদীনার আবহাওয়ার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে ব্যর্থ ছিলেন। যেজন্য ফোকাহায়ে কেরামদের প্রায় সকলেই উটের মুত্র বা প্রস্রাব পান করাকে শরীয়তের অন্যান্য বিধিমালার আলোকে নিষিদ্ধ বলেই ফতুয়া (রায়) প্রদান করে গেছেন। যাদের মধ্যে ইমামে আযম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী প্রমুখ অন্যতম।
উপরে কয়েকটি পয়েন্টে কিছু জবাব দিলাম, এবার একটু নাতিদীর্ঘ জবাবে আসি,
প্রথমে রাসূল সা.-এর একটি হাদীস আপনাকে শুনাব। হযরত আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ رَهْطًا، مِنْ عُكْلٍ ثَمَانِيَةً قَدِمُوا عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَاجْتَوَوُا الْمَدِينَةَ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ، ابْغِنَا رِسْلاً. قَالَ “ مَا أَجِدُ لَكُمْ إِلاَّ أَنْ تَلْحَقُوا بِالذَّوْدِ ”. فَانْطَلَقُوا فَشَرِبُوا مِنْ أَبْوَالِهَا وَأَلْبَانِهَا حَتَّى صَحُّوا وَسَمِنُوا، وَقَتَلُوا الرَّاعِيَ، وَاسْتَاقُوا الذَّوْدَ، وَكَفَرُوا بَعْدَ إِسْلاَمِهِمْ
অর্থ, উকল নামক গোত্রে আট ব্যক্তির একটি দল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এলো। মদীনার আবহাওয়া তারা উপযোগী মনে করেনি। তারা বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য দুগ্ধবতী উটনীর ব্যবস্থা করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমরা বরং সাদকার উটের পালের কাছে যাও। তখন তারা সেখানে গিয়ে সেগুলোর প্রস্রাব ও দুধ পান করে সুস্থ এবং মোটাতাজা হয়ে গেল। তারপর তারা উটের রাখালকে হত্যা করে উটের পাল হাকিয়ে নিয়ে গেল এবং তারা মুরতাদ হয়ে গেল। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৮০৯; ইফা)।
এই হাদীসের দিকে লক্ষ্য করুন, রাসূল (সা.) তাদেরকে উটনীর প্রস্রাব পান করতে নিজ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই পরামর্শ দেয়ার উল্লেখ নেই। ওরা নিজেরাই বরং স্বেচ্ছায় উটনীর প্রস্রাব এবং দুধ এক সাথে পান করে এবং সেখানেই তাদের প্রতিষৌধক রয়েছে বলে বিশ্বাস করেছিল। এভাবে এই সংক্রান্ত সবগুলো হাদীস একত্রিত করে মোটের উপর চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, রাসূল সা. নিজ থেকে প্রস্রাব পান করতে বলেননি, বরং ওরা পান করতে আগ্রহ প্রকাশ করায় তিনি (সা.) হয়ত বা তাদেরকে একটি নিয়ম মেনে অনুমতি দিয়েছিলেন মাত্র। নিয়মটি নিম্নরূপ,
- সদকার উটনীর প্রস্রাব।
- দুধের সাথে মিশিয়ে।
- শুধু রোগের আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে প্রয়োজন মাফিক।
বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান কী বলে? এবং ইসলাম বিরুধীদের অপপ্রচারের জবাবে মুসলিম গবেষকরা কী বলে?
ইসলাম বিরোধী ওরিয়েন্টালিস্টরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বলে থাকে যে, “দেখ দেখ, তোমাদের নবী উটের প্রস্রাব পান করতে বলেছে। তোমাদের নবী কত বাজে আর অবৈজ্ঞানিক কথা বলল!” এবার তাদের এসমস্ত কাটছাঁট ও খন্ডিত বক্তব্যের বিপরীতে আমরা যুক্তি দিয়ে বলতে পারি যে,
রাসূল (সা.) শুধু শুধু উটের প্রস্রাব পান করতে বলেননি, বরং রোগের প্রতিষৌধক হিসেবে দুধের সাথে মিশিয়ে কেউ পান করতে চাইলে তখন হয়ত বা অনুমতি দিয়েছিলেন, ব্যাস এটুকুই। এছাড়া বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনার চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘আল কানুন ফিত-তিব’ (القانون فى الطب) ১৬ শতক পর্যন্ত মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্বের মেডিক্যালগুলোতে পড়ানো হতো। সে গ্রন্থে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্যে উটের প্রস্রাবকে অন্য কিছুর সাথে মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করার নিয়মাবলী দেয়া হয়েছে। সে নিয়ম কেবল মুসলিম বিশ্ব নয়, পশ্চিমা বিশ্বেও গত তিন-চার’শ বছর আগে প্রচলিত ছিলো। ইবনে সীনার চিকিৎসা গ্রন্থ ‘আল কানূন‘ এর খন্ড ৩ পৃষ্ঠা নং ১৮০ দেখুন, তিনি লিখেছেন, وقد جُرِّبَ بول الجمل الأعرابي، والمعقود منه ضماداً ومرهماً ومخلوطاً به، فكان نافعاً অর্থ, আরবীয় উটের প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তার মিশ্রণ ঘটিয়ে মলম আর মালিশের মেডিসিন তৈরির কাজ সম্পন্ন করা গিয়াছে। আর তাতে উপকারিতাও রয়েছে।
এমনকি এই আধুনিক যুগে এসেও আমেরিকার নাসা সহ জার্মান, জাপান, চীন, ভারতের মতো বিভিন্ন দেশে মেডিক্যালের একাডেমিক জার্নাল ও বইয়ে উটের প্রস্রাব নিয়ে রিসার্চ হচ্ছে; এবং তারা বলছেন যে, প্রস্রাবকে মেডিসিন হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে ও এতে বহু রোগের প্রতিষৌধক রয়েছে। এ সম্পর্কে এটিও দেখা যেতে পারে, ক্লিক করুন।

সুতরাং, উটের প্রস্রাবকে ওরিয়েন্টালিস্টরা যেভাবে অযৌক্তিক ও বর্বর আকারে উপস্থাপন করে ইসলামের নবীকে আক্রমণ করছে, তা সম্পূর্ণ অবিচার ও অন্যায়। নবী করীম (সা.) নিজ থেকে প্রস্রাব পান করতে যদি বলতেনও তবু এই সংক্রান্ত বর্ণনাগুলোর বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলার কোনোই সুযোগ নেই। দুঃখের বিষয় যে, হাদীস বিশেষজ্ঞ পূর্ববর্তী স্কলারদের ব্যাখ্যাগুলো যাদের পড়াশোনা নেই তারাই মূলত হাদীসগুলোর উপর ভাসা ভাসা কিংবা স্বল্প পরিসরে জ্ঞান রাখার কারণেই বিভ্রান্ত হয়ে থাকে এবং হাদীস অস্বীকারকারীদের চটকদার কথাবার্তায় ধোকা খাচ্ছেন, হাদীসকে অস্বীকার করার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্তেও ভুগছেন! আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক























